মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব-১৭

0
673

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৭

“বাহ্! আজকে তোমাকে বউ বউ লাগছে। তবে শাড়ি পড়ে এসেছ কেন? তুমি তো সবসময় খালি গায়ে ঘুড়াগুড়ি করতে।”

কর্ণপথে পৌঁছাতেই চোখের মণি জ্বলজ্বল করে উঠল। অবিলম্বে মাথা ঘুরে উঠল। এবার সংযত করতে ব্যর্থ হলাম চায়ের কাপ। হাত ফসকে মেঝেতে পড়ে টুং টুং শব্দে ভেঙে গেল তৎক্ষণাৎ। কয়েক খন্ডে খন্ডিত হল। গরম চা পায়ের পাতার উপর পড়তেই জ্বলে উঠল জায়গাটা। পিছিয়ে গেলাম দুকদম। ধ্রুবের ধ্যান ভাঙল। লাফ দিয়ে মেঝেতে উঠে দাঁড়াল। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন,

“কী হয়েছে চড়ুই? বেশি লেগেছে? একটু সাবধানে ধরবে না, পড়ে গেল কীভাবে? নিশ্চয় জ্বলছে?”

“আপনি কিসব আবোলতাবোল বলছিলেন? সেগুলো শুনেই তো!”

ধ্রুব শুনলেন না। অগ্রাহ্য করলেন। বসে পড়লেন হাঁটু মুড়ে। পায়ের কাছ থেকে শাড়ি সরিয়ে স্পর্শ করলেন পায়ের পাতা। পা সরাতেই খপ করে ধরলেন। অস্ফুট স্বরে শুধালাম,
“ছাড়ুন, কী করছেন? পা ছাড়ুন।”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর গলায় বললেন, “পা এখানে রাখো।”

পরক্ষণে নিজেই পা তার হাঁটুর উপরে রাখলেন। লালচে হয়ে আসা স্থানটায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অপেক্ষা করলেন না। হুট করেই কোলে তুলে নিলেন। কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। দ্রুত গলা পেঁচিয়ে ধরলাম। মাথা রাখলাম বুকে। তিনি অতিদ্রুত পা চালিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলেন। ট্যাপের নিচে পা রেখে ট্যাপ ছেড়ে দিলেন। হাত বুলিয়ে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করলেন। মিনমিনে গলায় বললাম, “ভেতরে চলুন। পানি দিবো না, জ্বলছে।”

“জ্বলুক। জ্বলতে দাও। ধীরে ধীরে কমে যাবে।”

আরও কিয়ৎক্ষণ পানির নিচে অপেক্ষা করলেন তিনি। পুনরায় কোলে তুলে নিলেন। বিছানায় বসিয়ে দিলেন। ড্রয়ারে খুঁজতে লাগলেন কিছু। বিরক্ত মাখা গলায় বললেন, “ব্যথার স্প্রে কিংবা মলমটা কোথায় রাখল। খুঁজেই পাচ্ছিনা।”

মায়া হল বড্ড। আমার সামান্য একটু ব্যথায় উদাসীন তিনি। একটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল। এত ভালোবাসা হঠাৎ কোথা থেকে এলো। এর ছিটেফোঁটাও যদি থাকত, এতটা দূরত্ব থাকত না আমাদের মাঝে। তাচ্ছিল্য করলাম ব্যাপারটা। দীর্ঘশ্বাস নিলাম। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললাম, “ছেড়ে দিন। সামান্য একটু ব্যথা। কমে যাবে।”

“তুমি বললেই তো কমে যাবেনা। চুপচাপ বসে থাকো।”

খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলেন। উপায়হীন হয়ে ব্রাশদানী থেকে টুথপেস্ট নিয়ে এলেন। স্বযত্নে লাগিয়ে দিলেন পায়ে। জ্বলে উঠল দ্বিগুন। আঁচল চেপে গ্ৰথণ করলাম নেত্রযুগল। টলটল করছে, মাথানত। অতিবাহিত হল কিছু মুহুর্ত। কমে এসেছে ব্যথা। তিনি হাত পা ছড়িয়ে বসলেন। অগোচরে হাসলাম মৃদু। আমি ধীর কণ্ঠে শুধালাম,

“আপনার জন্য চা করেছিলাম, অসাবধানতায় পড়ে গেছে। আরেক কাপ করে দিব?”

আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, “দরকার নেই, অনেক করেছ। করতে করতে পায়ের এই হাল করেছ। এই পা নিয়ে আর করার দরকার নেই। পরে হসপিটালে যেতে হতে।”

“কিন্তু আমি যে ভালোবেসে করেছি। সমস্যা নেই, এককাপ সমপরিমাণ আছে। শুধু গরম করলেই হবে। পায়ের পাতায় ছ্যাকা খেয়েছি, তলায় নয়। বসুন এখনই নিয়ে আসছি।”

একগাল হেসে বললেন, “এখন চা খাবো না। চা খেলে ঘুম হয়না। কালকে ঘুম থেকে উঠলে বরং করে দিও।”

আমি তোয়াক্কা করলাম না। সন্তর্পণে পা ফেলে ধীরে ধীরে অগ্ৰসর হলাম রান্নাঘরের দিকে। কেক মাইক্রোওভেনের থেকে বের করে রেখেছিলাম। নতুবা এতক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। কেক খাওয়ার পরিবর্তে সেই ছাই দিয়ে দাঁত মাজা যেত। আমি রান্নাঘরের ড্রয়ারে মোমবাতি খুঁজতে কৌতূহল প্রকাশ করলাম। পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে সামান্য উঁচু করলাম। হাতের নাগালে পেয়ে গেলাম। লাইটার দিয়ে চারটে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলাম। বিদ্যুৎ সার্কিট বোর্ডের নিকট গেলাম। বিদ্যুৎ সকেট খুললাম। তৎক্ষণাৎ আঁধারে মিলিয়ে গেল আলোর রেখা। মৃদু হলদেটে আলোয় আলোকিত হল রান্নাঘর। আমি মোমবাতি নিয়ে ফিরে এলাম ঘরে। পুনরায় রান্নাঘরে গিয়ে কেক নিয়ে হাজির হলাম। ধ্রুব কোথাও নেই। বিশ্রী গন্ধে গাঁ গুলিয়ে উঠছে। হাত গিয়ে ঠেকল মুখশ্রীতে। ব্যালকেনি থেকে হাওয়ায় ভেসে আসছে এই দুর্গন্ধ। আঁচলে নাক চেপে ধরলাম। মোমবাতি নিয়ে ব্যালকেনিতে প্রবেশ করলাম। মৃদু তীক্ষ্ণ আলো দেখা যাচ্ছে। ধ্রুব মেঝেতে বসে সিগারেট টানছে।

আমার পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই হাত থেকে খসে পড়ল সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ। পায়ের উপর পড়তেই আঁতকে উঠল। দ্রুত অবশিষ্ট অংশটুকু তুলে নিল। দেয়ালের সাথে ঘসে নিভিয়ে ফেলল। অতঃপর উপর থেকে নিচে ফেলে দিল। আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, “তুমি এখানে?”

মাথানত করে ফেললাম। দুকদম পিছিয়ে গেলাম। মিনমিনে গলায় বললাম,
“আপনি সিগারেট খান? গন্ধ আসছে।”

অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন আমার পানে। পরক্ষণেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন ভেতরে। আমিও পিছুপিছু ভেতরে এলাম। তিনি ব্রাশদানি থেকে ব্রাশ তুলে নিলেন। টুথপেস্ট লাগিয়ে ব্রাশ করতে লাগলেন। আমি জ্ঞানহীন, বোধশক্তি হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কার বাড়ি এটা? নিশ্চয় ব্রাশটা তার নয়, অন্যকারো ব্রাশ। ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ!

মিনিট খানেক ব্রাশটা মুখে রাখলেন না। অতিদ্রুত ট্যাপ ছেড়ে কুলি করে নিলেন। ব্রাশটা পূর্বের স্থানে রেখে বেরিয়ে এলেন বাইরে। ঈষৎ উঁচু করে শুকলেন গায়ের শার্টটা। এক টানে খুলে ফেললেন শার্ট। যার দরুন দেহখানা উন্মুক্ত। বিন্দু বিন্দু পরিমাণ ঘামগুলো জ্বলজ্বল করছে মোমের হলদেটে আলোর শিখায়। প্রথমবার কোনো সুপুরুষকে দেখে শিহরিত আমি। চোখের পলক থেমে গেল। বোতামগুলো আলাদা হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল নিচে। তিনি তুললেন না। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে স্প্রে নামিয়ে পুরো রুমে স্প্রে করে দিলেন।

“ওভাবে সং সেজে না দাঁড়িয়ে থেকে ঘুমাও। রাত তো পেরিয়ে গেল।
আমার পাশেই শুতে পারো, একা একা অন্যঘরে ঘুমালে ভয় পাবে।”

বলেই টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন মাঝবরাবর। আমি নিশ্চুপ থেকে বেরিয়ে তাকে টেনে তুললাম। একটা মোমবাতি সামনে ধরে বললাম, “ফুঁ দিন।”

তিনি ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিলেন। আলো একটু কমে গেল। কেক আর ছু’রি এগিয়ে দিয়ে কাটতে বললাম। তিনি কেক কেটে এক টুকরো এগিয়ে দিলেন। আমি মুখে না তুলে তাকে খাইয়ে দিলাম। তিনি তৃপ্তিকর হাসি দিয়ে বললেন, “এতকিছুর কী দরকার ছিল। তুমি আমার কাছে আছো এতেই আমি খুশি।
লাভ ইউ চড়ুইপাখি।”

অহেতুক লজ্জামিশ্রিত হলাম। অস্ফুট স্বরে বললাম, “দরকার ছিল। ছিল দরকার।”

“কেন দরকার ছিল?”

“জানি না।”

ভ্রু নাচিয়ে বললেন, “তাই বুঝি! এতই যখন দরকার ছিল তাহলে আমার গিফ্ট কোথায় আর এত সাজার কারণ কী?”

নিজের অন্তরে আওড়ালাম কিয়ৎক্ষণ ‘গিফ্ট’ শব্দটা। অতঃপর বললাম, “গিফ্ট তো আনি নি। আমি তো আমাকে কিড’ন্যাপ করেছেন। যদি জানতাম তাহলে কিড’ন্যাপ হওয়ার আগে গিফ্ট ব্যাগে রেখে দিতাম।”

“তুমি চাইলে গিফ্ট দিতে পারো।”

“কোথায় পাবো?”

আমি হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তিনি মুচকি হাসলেন‌। হাত টেনে কোলে বসিয়ে দিলেন। ঘোরের ইতি পড়ল।
“তুমি তো নিজ ইচ্ছায় দেবে না, আমিই নিয়ে নিলাম।”

“মানে..

বাক্য অসম্পূর্ণ থেকে গেল। অধরে শীতল অধরের স্পর্শ পেলাম। চোখজোড়া পলকহীন হয়ে থেমে রইল।
___
মুক্ত হতেই ফুঁপিয়ে উঠলাম। নাক টেনে কেঁদে উঠলাম। ধ্রুব অনুশোচনায় পড়লেন। হতাশ হয়ে গেলেন। তিনি সামলাতে বললেন, “আ’ম স্যরি চড়ুই। ভেরি ভেরি স্যরি। প্লীজ কেঁদো না। আমার উচিত হয়নি।”

অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললাম, “আপনি ইচ্ছে করে করছেন। আমি থাকব না আপনার সাথে।”

“ঠিক আছে কালকে চলে যেও, এখন শুয়ে পড়। এতরাতে গাড়ি পাবে না।”

“গাড়ি না পেলে হেঁটে যাবো। তবুও যাবোই যাবো। আপনি কখন কী করেন ঠিক নেই।”

“চিন্তা নেই, তোমার অমতে কিছু করব না। শুধু পাশে শুয়ে পড়। আমি মন ভরে দেখব।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]