#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২২
ধ্রুবের কোলে দেখে সবাই একটু সন্তুষ্ট হলেও পরক্ষণেই আঁতকে উঠল। আমি তখনও নির্দ্বিধায় ধ্রুবের গলা জড়িয়ে রেখেছি। আমাকে ভেজা অবস্থায় সোফার উপর বসিয়ে গম্ভীর গলায় আঁখিকে বললেন, “যা দ্রুত যা। আপাতত বরফ নিয়ে আয়। আসার সময় রসুনের কোয়ায় ডুবিয়ে সরিষার তেল গরম দিয়ে আসিস।”
আঁখি নিরবে সায় দিয়ে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। আমি পায়ের দিকে চেয়ে রইলাম। নড়াতে পারছিনা। ইতোমধ্যে কালচে হয়ে গেছে। কালকে অর্কের বিয়ে। ভেঙে গেলে অর্কের বিয়ের বরযাত্রী হিসেবে যেতে পারবনা। নিজের কথায় নিজেই থতমত খেলাম। আমিই একমাত্র মেয়ে যে, বিয়েতে যাওয়ার জন্য পা ভালো করতে চাইছি। আচ্ছা যদি বিয়েটা না হত, তাহলে কি চাইলাম পা ভাঙাই থাক?
আমার ভাবনার ইতি টেনে রমিলা আন্টি থমথমে গলায় বললেন, “কী হয়েছে ওর? এভাবে নিয়ে এলি হঠাৎ?”
“গাছ থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে।” সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েই তিনি প্রসন্ন হলেন। কিন্তু প্রসন্ন হতে ব্যর্থ হলাম আমি। পড়ে ব্যথা পেয়েছি, আমি কী ইচ্ছে করে পড়েছি? হাওয়াতে ডাল ভেঙেছে, আমার দোষ কোথায়? আশ্চর্য!”
“তুই গাছে কেন উঠতে গেলি? বড়সড় কিছু হয়ে গেলে, তখন? আর ধ্রুব তুই। তুই ওকে কোথায় পেলি?”
“কোথায় আবার? বাঁদরের মত গাছে ঝুলছিল। নামতে বলেছি নামেনি,
এরজন্যই বলে বড়দের কথা শুনতে হয়, না শুনলে পস্তাতে হয়।”
“আপনি..
বাক্য শেষ করার পূর্বেই ধ্রুব শান্ত কণ্ঠে বললেন, “চুপ। ডোন্ট টক।”
রমিলা আন্টি অগোচরে হাসলেন। ধ্রুবকে তাড়া দিয়ে বললেন, “পা টা ভেঙে গেল না তো! তাড়াতাড়ি তেল দিয়ে মালিশ করে দেখতে হবে। নতুবা ডাক্তার ডাকতে হবে।”
আমি বিস্মিত হয়ে বসে রইলাম। ইতোমধ্যে আঁখি বরফ এবং তেলের বাটি নিয়ে হাজির। ওড়নায় বরফের টুকরোগুলো ঢেলে পেঁচিয়ে নিলেন। হাতের করতল মেলে দিলেন। কোমল কণ্ঠে বলেন, “পা রাখো।”
“আপনি সরুন, আমি..
“জাস্ট পা টা রাখতে বলেছি।”
ধীরে ধীরে পা হাতের উপর রাখতেই খপ করে ধরে ফেললেন। নিজের রুমাল বের করে মুছিয়ে দিলেন পায়ের মাটি কাঁদা। বরফের কাপড়টা পায়ের উপর রেখে মালিশ করে দিতে পাগলেন। অতঃপর তেল দিয়ে সেক দিলেন। আমি নতজানু হয়ে বসে রইলাম স্থির হয়ে। স্পর্শের ফলে ব্যথাটা প্রখর হয়ে উঠছে। সামলানো দায়। ওড়নার কোণা চেপে খিঁচে চোখ বন্ধ করে রইলাম। লজ্জা কী লজ্জা।
___
মহতাব বাড়ি। বাইরে বড় করে খোদাই করে লেখা ‘মহতাব’ শব্দটি। বাড়িটা নতুন হলেও মহতাব বেশ পুরোনো। যৌথ পরিবারের বসবাসের জন্য তিনতলা এই বাড়িটি। ধ্রুব এবং রমিলা আন্টি না থাকলেও তাদের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট ঘর। সবাই গ্ৰামেই বসবাস করে বিধেয় বাইরে থেকে নতুন কেউ আসেনি।
পূর্ণিমার চাঁদ নেই। বাঁকা চাঁদের ফালি। অতি শীঘ্রই আকাশে পূর্ণ চাঁদের দেখা মিলবে।
বাড়ির ছাদটা বেশ বড়। চারপাশে ফুলের গাছ লাগানো। ফাগুনের সময় বিধেয় ফুলের সুবাস ভেসে আসছে। এই গ্ৰামে এমন বাড়ি দেখা যায়না বললেই চলে, এখান থেকে বড় রাস্তা অবধি দেখা যায়। মৃদু হাওয়া বইছে। চুলে কাঁটার লাগানো। অবাধ্য ছোট চুলো একটু উড়ছে। তবে কপালেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। আড্ডা দেওয়ার জন্য এটাই উপযুক্ত জায়গা। রঙ বেরঙের আলো দিয়ে সাজানো। কালকে বরযাত্রী যাবে, পরবর্তী সময় পাবো কি-না জানা নেই। তাই আজকেই আসর জমানো হয়েছে। বড় ছোট সকলে।
পায়ের ব্যথা একটু কমেছে। মচকে গেছে। একটু একটু ভর দিতে পারলেও পুরোপুরি ভর দেওয়া যায়না। দুই তিনবার তেল গরম লাগালে ঠিক হয়ে যাবে।
আমি রেলিং ধরে ধরে ছাদে এসে পৌঁছালাম। দেয়ালের কারণে অন্যপ্রান্তটা আঁধারের চাদরে ঢাকা। ছাদে কাউকে না দেখে অন্ধকারের দিকে পা উঁচু করে একপায়ে ভর দিয়ে সেখানে গেলাম। তৎক্ষণাৎ ভাউ করে উঠল কেউ। ‘আম্মু গো’ বলে চিৎকার দিয়ে পেছনের দিকে ছুটলাম আমি। পায়ে ব্যথায় এগোতে পারছি না। পরক্ষণে পুনরায় কানের কাছে মুখ এনে ভাউ করল কেউ। আমি একটু ভীত হলাম। কিন্তু কণ্ঠটা চেনা। শুধু চেনাই বড্ড বেশি চেনা। ফট করে পেছনে ফিরতেই ধ্রুবের মুখশ্রী নজরে এলো।
ধ্রুব বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে প্রকাশ করলাম না। ‘হো হো’ করে হেসে উঠলেন তিনি। মনে হচ্ছে, এটা যাত্রা হচ্ছে আর আমি তার একটা চরিত্র। ভেংচি কাটলাম। তিনি হাসি থামাতে ব্যর্থ হয়ে বললেন,
“মুখে তো সবসময় ফটড় ফটড়। জ্ঞান দেওয়া। এবার তুমি কেন ভয় পেলে। তুমি ভয় পাও চড়ুই, হাউ ফানি। এটাও সম্ভব।”
“মোটেও না। আমি মোটেও ভয় পাই না, বুঝতে পেরেছেন আপনি?”
“তা তো দেখতেই পেলাম।”
প্রবল রাগ লাগল। আমি ভেংচি দিয়ে সরে এলাম। ততক্ষণে সবাই হাজির হয়েছে। গোল করা বসেছেন। আমি আঁখির পাশে বসলাম। ‘স্পিন দা বোতল’ শুরু হল গেমটি। প্রথম বোতল ঘোরাতেই থামল গিয়ে দাদিমার দিকে। দাদিমা হেসে বললেন,
” যাহ্! প্রথমেই আমার। আমি আর কী নিবো? বুড়ো বয়সে এইসব মানায়?”
“না দাদিমা, এটা বললে কিন্তু শুনব না। তোমাকে নিতেই হবে?”
দাদিমা বললেন, “আমি আর কী নিবো।”
আমি ফট করে বললাম, “তুমি তোমার প্রিয় গানটা গাও না, কতদিন শুনি না।”
সবাই আমার দিকে বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলেন। এই গানটা তার একান্ত প্রিয়। প্রিয় থেকেও প্রিয়। আমি শুনছি অনেকবার, দাদু বেঁচে থাকতে গাইতেন। সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি গাইলেন,
“পুরোনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়?
আয় আর একটিবার আয় সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।
মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়–
হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়–
আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়।”
থামতেই দাদিমার গাল গড়ালো অশ্রুতে। তিনি আঁচলের আড়ালে চোখ মুছে নিলেন। হাসলেন তৃপ্তিকর হাসি। বোতল পুনরায় ঘুরানো হল। থামল গিয়ে ছোট চাচার দিকে। তিনি প্রথমে বললেন, “ট্রুথ।”
অর্ক সংক্ষেপে বলল, “তোমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের জিনিস কোনটা?”
আগে পিছু না ভেবে সোজা বললেন, “কে আবার তোর চাচি। বিয়ের পর থেকে জ্বালিয়ে আসছে।
আসলে বাদুরের গলায় মুক্তার মালা হলে যা হয় আরকি!”
তখনই ছোট চাচি নিচ থেকে কাজ সেরে উপরে উঠে আসছিল। কোমড়ে হাত দিয়ে বললেন, “কী আমি বাদুর?”
চাচা অর্কের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ছাদের দরজাটা কেন লাগাসনি? দেখলি তো চলে এল, আমার রিনা খান। [চাচিকে উদ্দেশ্য করে] তুমি কেন বাদুর হবে?”
চাচি খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, “তারমানে আমি মুক্তার মালা। এতদিনে একটা ঠিক কথা বলেছ। আমি সহ্য করে আসছি এই বুড়োকে।
সবজায়গাতেই তার কবিরাজি ফলাতে যায়, আর মা’র খেয়ে আসে। জীবিত মানুষকে মৃত্যু বানিয়ে দেয়।”
“তুমি একদম আমার কাজ নিয়ে খোটা দিবেনা।”
“খোটা দিবো না কি আদর করমু, আর কোনোদিন কবিরাজি করতে দেখলে এই মুক্তার মালা আর তোমার গলায় থাকবে না।”
‘তাড়াতাড়ি নিচে যেতে’ বলে চাচি রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন। চাচা চাচির পেছনে যেতে যেতে ধ্রুবকে বললেন,
“তুই যাওয়ার আগে আমার থেকে পানি পড়া নিয়ে যাস, দুইবেলা খাওলেই শ্রেয়া তার চৌদ্দ গুষ্টির নাম ভুলে তোর নাম জপ করবে।”
ধ্রুব চোখ টিপে বললেন, “তাহলে তো নিতেই হবে।”
মুখ ঘুরিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, আমিও পানি পড়া খেতে চাই। চৌদ্দ গুষ্টির নাম ভুলে সারাদিন ধ্রুব ধ্রুব করতে চাই। ধ্রুব চাচা, ধ্রুব ভাই, ধ্রুব মামা, ধ্রুব বাবা, ধ্রুব..
তড়িগড়ি করে ধ্রুব বলল, “দরকার নাই পানি পড়া। তুমি শুধু ধ্রুব ধ্রুব করো, তাতেই চলবে।”
পুনরায় শুরু হল খেলা। একে একে সবার কাছে বোতল থামলেও আমার আর ধ্রুবের দিকে থামল না। তাই আমাদের ডেয়ার দিল। একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। আমি আপত্তি করলেও কুল পেলাম না। যে রাজি হবেনা, সে হারবে। আমি বাধ্য হয়ে ধ্রুবের চোখের দিকে তাকালাম। অদ্ভুত তার চোখজোড়া। ক্ষণে ক্ষণে দৃষ্টি আমাকে ডাকছে। ধ্রুব অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারদিকে তাকিয়ে থাকা যেন দায়। হুট করে চোখ টিপলেন ধ্রুব। তৎক্ষণাৎ পলক পড়ল চোখের। একবার নয়, বেশ কয়েকবার। চ্যাঁচিয়ে উঠল সকলে। তাজ্জব বনে গেলাম আমি। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম,
“মানে কী? আপনি আমাকে চোখ টিপ দিয়েছেন। তারপরে আমার পলক পড়েছে। আপনি আগে পলক ফেলেছেন।”
“একচোখে ফেলেছি, দুই চোখে নয়। তুমি দুইচোখের ফেলেছ, তাই আমি জিতেছি।”
উঠে দাঁড়ালেন ধ্রুব। বামহাতে চুলগুলো ঠিক করলেন। আমার চোখ থেকে চশমা খুলে নিলেন দ্রুত। নাক ধরে টান দিলেন। চোখে পড়ে নিলেন। স্থির পাজোড়া সামনের দিকে অগ্ৰসর করলেন। গান ধরলেন,
“চড়ুই ধান খাইল-রে, খেদানোর মানুষ নাই। খাবার বেলায় আছে মানুষ, কামের বেলায় নাই। চড়ুই ধান খাইল-লে।”
আমি গমনপথের দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এখানে তো কাউয়া ছিল, চড়ুই আসলো কোথা থেকে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]