মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব-২৩

0
670

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৩

“চড়ুই ভোর হয়েছে, উঠ। আমরা এসে পড়েছি।”

কর্ণদ্বয়ে পৌঁছাতেই হন্তদন্ত হয়ে উঠলাম। বাইরে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে শুধালাম, “এখনও ভোর হয়নি, ডাকলেন কেন?”

“আমরা এসে গেছি।”
টনক নড়ল। কাল মাঝরাতে রওনা হয়েছি শহরের উদ্দেশ্য। বেমালুম ভুলে গিয়েছি কথাটা। কাঁচের ফাক দিয়ে মাথা বাইরে বের করে দিতেই মস্ত বাড়িটা নজরে এলো। লজ্জা পেলাম। তড়িগড়ি করে বের হতে নিলেই ধ্রুব বললেন, “থামো। আস্তে নামো। পায়ে ব্যথা।”

মুহুর্তেই ‘পায়ের ব্যথা’ কথাটা চাড়া দিয়ে উঠল। কালরাতে ধ্রুব হঠাৎ বলে উঠে, ভার্সিটি থেকে ফোন এসেছে। হাতে মেহেদী দেওয়া। রঙ হয়নি। দেওয়ার সাথে সাথে ধুয়ে ফেলেছি। তাকে অতিদ্রুত সেখানে থাকতে হবে। উপায়হীন হয়ে রাতেই রওনা হলেন তিনি। রাহাত স্যারও যেহুতু একই ভার্সিটির শিক্ষক, তাই তাকেও আসতে হবে। চড়ুইয়ের পরীক্ষা, আমার পরীক্ষা। তাই চলে এলাম।

ধ্রুব অতি যত্নে সিট বেল্ট খুলে দিলেন। আমি দ্রুত নামলাম। তিনি অকস্মাৎ বলে উঠেন, “নিজের খেয়াল রেখে চড়ুই। কালকে এসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।”

প্রত্যুত্তরে বললাম, “জি, আপনিও খেয়াল রাখবেন। আসি, আল্লাহ হাফেজ।”

বাবুইয়ের হাত ধরে ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। পেছন থেকে ধ্রুবের মুখশ্রী দেখা যাচ্ছিল, তিনি নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
_______

চড়ুই পাখিকে পানি দিয়ে ঘরে বসলাম। বাবুই বিছানা জুড়ে ঘুমাচ্ছে। জামা কাপড় না পাল্টেই ঘুমাচ্ছে। শরীরে চুলকানি হচ্ছে। মাত্র বাইরে থেকে ফিরলাম। আমার বের হবো। মূলত পায়ের জন ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। ব্যাগ থেকে জামা কামড় বের করলাম। ধুতে হবে। আপাতত ভিজিয়ে রাখব। মামুনি প্রবেশ করলেন। বললেন,

“এত তাড়াতাড়ি আসার কোনো দরকার ছিল তোদের। কালকে আসতে পারতি। বিয়েতে গেলি অথচ অনুষ্ঠানে না থেকে পা ভেঙে চলে এলি।”

এক চিলতে হেসে বললাম,
“সেটা কি আমার উপরে আছে মামুনি? তাছাড়া পা ভাঙেনি। একটু মচকে গেছে। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ।”

“তা বাবা মায়ের কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলিস?”

ফিচেল হেসে বললাম, “না, মামুনি। ইচ্ছে করেনি।”

“এতগুলো বছর পর গ্ৰামে গেলি, অথচ বাবা মায়ের কবরের কাছে গেলি না।”

“না, মামুনি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছি আর ভাঙতে চাইনা। তাছাড়া বাবা মা সবসময় আমার মনে বিরাজ করে, তাদের মনে রাখতে হলে স্মরণ করতে হয়।”
_______

নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আগামী দশ তারিখ থেকে পরীক্ষা শুরু। আজ সাত তারিখ। আমাদের ডিপার্টমেন্টে আগে পরীক্ষা হবে। কিছু নোটস নেওয়া দরকার। তাই ভার্সিটিতে গেলাম। সবকিছু আগের মতই আছে, মাঝখানে আমাদের সম্পর্কটাই আগের মত নেই। আগে ছিল টিচার স্টুডেন্ট, এখন স্বামী স্ত্রী।

লাল রঙের থ্রী পিছ পড়েছি। চুলগুলো ওড়না দিয়ে ঢাকা। ভাঙাচোরা ফোনটায় জ্বলজ্বল করছে ‘১০:৫৭’। ধ্রুব কিংবা রাহাত স্যারকে দেখতে পাইনি কোথাও। পরীক্ষার দরুন ব্যস্ত তারা। ক্লাসরুমের দিকে অগ্ৰসর হলাম। সেখানে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির দেখা পেলাম। হাসি ফুটে উঠল মুখে। পরক্ষণেই পিছিয়ে গেলাম। দশটা পঞ্চাশে ধ্রুব স্যারের ক্লাস শুরু হয়। কতদিন পর ধ্রুব স্যার বললাম। ভার্সিটিতে আসলে শুধু ধ্রুব স্যার উচ্চারিত হয়।

ধ্রুব বোর্ডে কিছু ইমপ্রটেন্ট চপিট লিখছেন এবং ক্লাসে অবস্থানরত সকলেই সেগুলো খাতায় তুলছে। দরজার কাছ থেকে সরে এলাম। সেদিন মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য ক্লাসে ঢুকার অনুমতি দেয়নি ধ্রুব, আজ বড্ড বেশিই দেরী।
দরজার কাছ থেকে সরে আসতে চাইলে ভেসে এলো বিরক্তমাখা কণ্ঠস্বর,
“ভেতরে এসো।”

ধ্রুব পূর্বের ভঙ্গিতেই লিখে চলেছেন। মাঝে মাঝে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে দেখে আবার লিখছেন। আমার ভাবাবেগ না পেয়ে বললেন, “এসেছ যখন তাড়াতাড়ি ভেতরে এসে লিখ।”

“আসলে সেদিন ঢুকতে দেননি..

“সেদিন চলে গেছে, সামনে পরীক্ষা। এতদিন ছিলাম না। তোমাদের পরীক্ষা যাতে ভালো হয়, তাই বাড়িতে ফিরেই বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজেছি।
সারারাত জার্নি করে এখন অবধি নির্ঘুম।”

মায়া লাগল বড্ড। চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে। খুস্কো চুলগুলো এলোমেলো। দ্রুতি স্বরে বললাম,
“মানে কী? ঘুমান নি কেন? দেখেছেন চোখ মুখের অবস্থা?”

“আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কারো ঢোকা পছন্দ নয়। ভেতরে এসো।”

গায়ে লাগল আমার। কাঁধের ব্যাগটা খামচে ধরে বেঞ্চিতে বসলাম। পেছনে প্রিয়া আঁখি নিরব তারিফ বসেছে। পূর্ণ মনোযোগ লেখায় স্থির করলাম।
ধ্রুব লেখা শেষ করলেন। বেঞ্চির মাঝের ফাঁকা জায়গা দিয়ে পদচারণা করছেন পুরো ক্লাস। পর্যবেক্ষণ করলেন হাতের লেখা এবং বানান। মাহির সামনে দাঁড়িয়ে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার মুখপানে। মাহি মুখ লুকিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
“সামনে পরীক্ষা তাই আপনার ক্লাসে এসেছি।”

“আমি কি তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছি?”

“না, তবুও।”

“বাদ দাও, তোমার খাতার ভেতরে একটা স্ক্যাচ দেখেছি। মেভি আমাকে এঁকেছ, দেখতে পারি?”

মাহি ঘাবড়ে গেল। ধ্রুব স্যারের আদেশ রাখতে খাতাটা বের করল। ধ্রুব স্যার মনোযোগ সহকারে দেখে হাসলেন। জোরে পড়ে শোনালেন, “স্বপ্নের রাজকুমার।
খুব সুন্দর। দেখতে কিছুটা আমার মত। কিন্তু পুরোপুরি নয়। পৃথিবীতে সাতজন দেখতে অবিকল একই রকমের। হয়ত তারা কেউ।”

প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, “আমার অনুপস্থিতিতে কে তোমাদের ক্লাস নিয়েছিল?”

“তিথি ম্যাম।” মৃদু শব্দে।

“কী কী করিয়েছেন তিনি, আমাকে দেখিও একটু বাকিটা ম্যামের সাথে আলোচনা করে..
থেমে গেল তৎক্ষণাৎ। ভার্সিটির মেইন লিড উপস্থিত হলেন। সবাই একদমে উঠে দাঁড়ালেন। বসতে বললেন। ধ্রুবকে একটা খাম দিয়ে বললেন,

“রাগ করো না, তোমার ভালোর জন্যই ইমার্জেন্সিতে এনেছি।”

“তা তো দেখতেই পারছি, আমার বউকে নিয়ে বিয়েতে গেলাম। সুস্থ হয়ে বরযাত্রীতে যাবো, তার আগেই বাড়িতে নিয়ে এলেন।”

স্যার আমার পানে চেয়ে বললেন, “অনেকেই জানেনা, আগামী পরশু অর্থাৎ ৯ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায় অনুষ্ঠিত হবে। ধ্রুব জার্মানে ছিল, একটু ভালো বুঝবে। তাই ইমার্জেন্সিতে তোমাদের এনেছি। পরীক্ষার পর যত খুশি যেও‌।”

ধ্রুব বিদ্রুপ করে বললেন, “ততদিন কি ভাইয়ের বিয়ে আমাদের জন্য আঁটকে রাখবে, না-কি আবার বিয়ে হবে?”

ধ্রুব হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন ক্লাস থেকে। সামনেই অনুষ্ঠান, এরজন্যই ধ্রুবকে ফোন করে এনেছে। কিন্তু সেদিকে মন আমার স্থির নয়, আমার মনে পড়ল সেদিনের ফোনের কথাগুলো। সেই কণ্ঠ। স্যারের মেয়ের জন্মদিনের ঘটনা। কে ফোন করে হুমকি দিয়েছিল আমায়। তারপরেই বা কেন দেয়নি?

ভার্সিটি ছুটি হয়েছে, সবাই নিজনিজ বাড়িতে যাচ্ছে। ছুটি হওয়ার পরে অহেতুক, অকারণে থাকা যাবেনা। উপযুক্ত কারণ দেখাতে না পারলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি ব্যাগ নিয়ে হাঁটছি আর ফোনে নাম্বারটা খুঁজছি। সেভ করা হয়নি। নাম্বরটা চেনা লাগতেই কল করলাম। অপরিচিত কণ্ঠ। তবে বেশ গম্ভীর,

“জানতাম ফোন করবে। গ্ৰামে গিয়েছিলে শুনেছি তোমার বাড়িতে ফোন করে। বিয়ে খেতে গেছ, তাই ডিস্টার্ব করিনি।”

ফিচেল হেসে বললাম, “বিয়ে নিয়ে এত মাথা ব্যথা, ডিস্টার্ব করেননি। অথচ বাকিও রাখেননি। অন্যের ভিডিও করে আবার ভালো সাজার চেষ্টা।
আচ্ছা, আপনি আমাকে জ্বালাতে এমন বলছেন নাতো? কোনো প্রুভ তো পেলাম না।”

কল কে’টে গেল। মিনিট খানেকের ভেতরে একটা ভিডিও এলো। চেক করতেই থমকে গেলাম। দেখার সাহস হলনা। চোখজোড়া টলটল করে উঠল। হাত থেকে ফোনটা ছিটকে পড়ল। বিরবির করে বললাম, “এটা হতে পারেনা।”

হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম নিচে। পুনরায় ফোন বেজে উঠল। আমি নাম্বার চেক না করেই ফোন তুললাম,
“আপনি আদোও মানুষ? একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে এইসব করতে বিবেকে বাঁধল না। আমি কখনো ক্ষমা করব না আপনাকে।”

উচ্চারণ কণ্ঠে বললেন, “আমি বুঝি তোমাকে ক্ষমা করতে বলেছি? ক্ষমা দিয়ে কী করব? এটা আপলোড করলে কত ভিউ হবে ভাবতে পারছ? তোমার বোনকে সবাই চিনবে।”

নত হল কণ্ঠস্বর। “প্লীজ, ভিডিওটা ডিলেট করে দিন। আমার বোনের জীবনের প্রশ্ন। প্লীজ।”

“তাতে আমার কী? আমার শর্ত মানলে, আমি রাজি হবো।”

“কী শর্ত, আমি রাজি।”

“দেখা করতে হবে। আমি ঠিক সময়ে একটা পাঠিয়ে দিবো। কোথায়, কখন, কীভাবে? আপাতত বাই।!”

কল রেখে দিল। আমি বসে রইলাম। কী করা উচিত ভুলে গেলাম। পুনরায় ফোন বাজল। রিসিভ করে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম,

“বলেছি তো, আপনার শর্ত মানব। যাবো দেখা করতে..

“চড়ুই কীসের শর্ত?”

ধ্রুবের বিচলিত কণ্ঠস্বর শ্রবণপথে যেতেই শান্ত হয়ে গেলাম। স্ক্রিনে তার নাম্বারটা জ্বলজ্বল করছে। বাচ্চাদের মত কাঁদতে ইচ্ছে করল। কাদলাম না, নিজের উপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম। তিনি কঠোর গলায় বললেন,
“আমি লাইব্রেরীর দিকে আসছি, তুমি জলদি এসো। নো লেট।”

আমি পড়লাম মস্ত বিপদে। এই অবস্থায় ধ্রুবের সামনে গেলে তিনি সবটা বুঝে যাবেন। কী করব এখন?

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]