#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৭
“মামা শ্বশুর বাড়িতে গিয়েছি। একটু আদর যত্ন করবে না, এটা হতে পারেনা। লাঠির পিটুনি দিয়ে সেই আদর যত্ন করেছে। প্রথমবার গিয়েছে বলে কথা।”
ধ্রুব মলমটা রেখে আয়েশ ভঙ্গিতে বসলেন। আমি স্থির দৃষ্টিতে তার পিঠের দিকে চেয়ে রইলাম। মামা শ্বশুর বাড়ি বলতে থানাকে বুঝিয়েছে, তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কীভাবে নির্দয়ভাবে আঘাত করেছে। কালচে হয়েছে প্রতিটি আঘাত। আলতো হাতে স্পর্শ করলাম পিঠ। অবিলম্বে সব অভিমান অভিযোগ অদৃশ্য হয়ে গেল শূন্যতায়। ছলছলিয়ে উঠা চোখজোড়া নিরবে নিভৃতে রক্তক্ষরণ ঘটাল। সৌজন্য হাসি দিলাম। দ্রুত মলম লাগিয়ে দিতে ব্যস্ত হলাম। ব্যথার্ত স্থানে মলম লাগতেই জ্বলে উঠল জায়গাটা। ‘আহ্’ করে আর্তনাদ করলেন। দ্রুত কণ্ঠে বললাম, “লেগেছে আপনার, বুঝতে পারিনি।”
“একটু তো লাগবেই, তাড়াতাড়ি লাগিয়ে মাকে ডেকে দিও।”
অব্যক্ত স্বরে বললাম, “কেন?”
“মাথা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, একটু চুলগুলো টেনে দিতে বলতাম আর-কি।”
হাত চালালাম দ্রুত। ফুঁ দিয়ে ধীরে ধীরে পুরো পিঠে স্বযত্নে মলম লাগানো শেষ করলাম। বালিশ কোলের উপর রেখে মুখ কুঁচকে বললাম, “আন্টিকে ডাকার দরকার নেই। আপনি শুয়ে পড়ুন, আমি টেনে দিচ্ছি।”
ধ্রুব গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মুখে উচ্চে পড়া সেই হাসি। বাধ্যবাধকতা নেই। বালিশ সরিয়ে কোলে মাথা রাখলেন। কোমর জড়িয়ে ধরল। মুখ গুঁজে দিল। কেঁপে উঠলাম আমি। লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। শীতলতা ছড়িয়ে গেল সবাঙ্গে। তিনি সেভাবে থেকেই চোখ বন্ধ শুধালেন,
“আমাদের মাঝে কোনো দেয়াল রেখো না, তোমার শরীরে অনুভব করা, ‘তুমি নামক সুবাসটা’ আমার কাছে আসতে বাধা পায়।তোমাকে ছোঁয়ার অধিকার শুধু আমার, বালিশের কোনো অধিকার নেই।”
আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। তার কথার ধরণ বুঝতে পারছি না। আমাকে স্থির দেখে তিনি পুনরায় বললেন, “তাড়াতাড়ি কর..
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। হাত বাড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে তেলের বোতল নিলাম। ধীরে ধীরে তেল লাগিয়ে দিতে লাগলাম চুলে। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলে হাতের বাঁধন হালকা করলেন। বুঝতে পারি, তিনি ঘুমিয়েছেন। আমি বিন্দু পরিমাণ নড়াচড়া করলে তার ঘুম ভেঙে যাবে, তাই নড়লাম না। পেছনে বালিশ দিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলাম। তখনও ধ্রুব মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল কথপোকথন শুনে। আমি হাই তুলে তাড়াতাড়ি চোখ খুলে তাকালাম। ধ্রুব তো ঘুমিয়ে ছিল কোলে মাথা রেখে। কোনো জিনিস প্রয়োজন পড়ল না-কি। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অন্যকিছুর সাক্ষী হলাম। ধ্রুব নেই। আমি বিছানার মাঝ বরাবর ঘুমিয়ে আছি। গেলেন কোথায় তিনি। নিশ্চয় আমাকে ঠিক করে শুইয়ে রেখে গেছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে নেমে যাওয়ার প্রয়াস করতেই পেছনে ধ্রুবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। কর্ণপথে মুঠোফোন ধরা। আমাকে দেখেই ফোন নামিয়ে ফেললেন। “রাখছি পরে কথা বলব।” সংক্ষেপে বলেই ফোন রেখে দিলেন। ওপাশের উত্তরের অপেক্ষায় রইল না। ফোন পকেটে রেখে কোলে তুলে নিলেন আমায়। অগ্ৰসর হল সামনের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। চেয়ার টেনে বসতে বললেন। খাবার সাজিয়ে দিলেন। মামুনি, রমিলা আন্টি আর রাহাত স্যার খাচ্ছেন। আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলেন দু’জনে। খাবার মুখে দেওয়ার মত শক্তি অবশিষ্ট নেই। হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। খাবার সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ধ্রুব হাত ধরে ফেললেন। মুখের খাবারটুকু চিবিয়ে বললেন, “কিছুই তো খেলে না, উঠে যাচ্ছ কেন?”
“আমার ক্ষুধা নেই।” সংক্ষিপ্ত জবাব।
“ফিনিস ইট। কুইক।”
“প্লীজ, যেতে দিন।”
“ঠিক আছে, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
ধ্রুব হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। নিজের প্লেট থেকে খাবার তুলে জোরপূর্বক মুখে তুলে দিলেন। আমি ধীরে ধীরে খাবার চিবুতে লাগলাম। বিষম খেলাম। কেশে উঠলাম। চোখ মুখ রক্তিম হয়ে এলো। দম বন্ধ হল। পানি ভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই চুমুক বসালাম। পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। ধ্রুব ধমকের সুরে বলল, “ঘরে জামাই রেখে এসেছ? খাবার গিলছ কেন? চিবিয়ে চিবিয়ে ধীরে ধীরে খাও।”
ধ্রুব কথায় সায় দিয়ে খাবারে হাত দিলাম। মনযোগী হলাম খাওয়াতে। ধীরে ধীরে পুরোটা খাওয়া শেষ করে ঝুটো প্লেটেই হাত ধুয়ে নিলাম। বেসিন একটু ভেতরের দিকে অবস্থিত। পায়ে বেসামাল অবস্থা নিয়ে হাত ধোঁয়ার জন্য বেসিনে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। আমার দেখাদেখি ধ্রুবও ঝুটো হাত ধুয়ে নিলেন প্লেটে। ততক্ষণে সবার খাওয়া শেষ। রমিলা আন্টি অবশিষ্ট খাবার গুছিয়ে রাখছেন। ধ্রুব মুখ মুছে অতঃপর হাত মুছতে মুছতে রমিলা আন্টিকে ডেকে টেবিলে বসার অনুরোধ করল। রমিলা আন্টি নিকটে আসতেই ধ্রুব বিগত দিনে ঘটা যাওয়া ঘটনাগুলো ধীরে ধীরে খুলে বলতে আরম্ভ করলেন। স্যারের মেয়ের জন্মদিন থেকে শুরু করে আজ অবধি ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা। যেমন, আমাকে মেসেজ দিয়ে ব্লাকমেইল করা, ভিডিও, দেখা করা সবকিছু। সবকিছু শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। এমন কিছুর প্রত্যাশা করেনি। মামুনি অনুতপ্ত হয়ে বলেই ফেললেন, “এতকিছু হয়েছে, তুই আমাকে কেন কিছু বলিস্ নি।”
“আমি কাউকে জানাতে চাইনি।” নত কণ্ঠে।
“আমি ওর মা, তোরও মা। তোরা দু’জনেই আমার কাছে সমান। এক মেয়ের জন্য অন্য মেয়েকে বিপদে ঠেলে দিবো, এমনটা হতে পারেনা। আমরা আইনি ব্যবস্থা নিতাম।”
“আইনি ব্যবস্থা নিলে ব্যাপারটা পাবলিক হত মামুনি। মামার সম্মান এবং বাবুইও জেনে যেত। সামনে ওর পরীক্ষা। ভেঙে পড়ত মানুষিক ভাবে।”
রমিলা আন্টি বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলেন, “কিন্তু তোকে যে ভুল বুঝলাম। কথা বলা বন্ধ করে দিলাম, এড়িয়ে চললাম। তার বেলায়..
ক্ষমা করিস মা। ছেলেকে পুলিশে ধরে নিয়ে মে’রেছে। মা হিসেবে সহ্য করতে পারিনি। তাই রাগে তোর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি।”
সরল ভাষায় বললাম, “ক্ষমা চেও না। আমি একটু অবাক হয়েছি বটে কিন্তু..
_____
চুলোয় চায়ের পানি টগবগিয়ে ফুটছে। মাঝারি আঁচে আগুন ঝরছে। পরিমাণ মত চা’পাতা দিতেই মৃদু রঙিন হল উত্তপ্ত পানি। ধীরে ধীরে গাঢ় হতে লাগল। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ানো আমি। আগুনের তাপ লাগছে না।
ধ্রুব আর রাহাত স্যার উপরে আলোচনা করছে। কালকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায়’ অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন। রাতে দু’জনে পরিকল্পনা করে সকাল সকাল ভার্সিটিতে যাবেন। ঘুম কাটানোর জন্য রাহাত স্যার চা করতে বলেছিলেন। পায়ের অবস্থা শোচনীয় থাকায় বাড়িতে যাওয়া হয়নি, মামুনি একা চলে গেছেন। কালকে সকাল সকাল বাবুই আসবে।
আমি কেতলিতে ঢেলে ট্রেতে সাজিয়ে নিলাম। ধীরে ধীরে পা ফেলে স্টার্ডি রুমের দিকে অগ্ৰসর হলাম। ধ্রুব আর রাহাত স্যার উল্টো ঘুরে কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন। আমাকে দেখামাত্রই থেমে গেলেন। ‘আসব’ বলার আগেই হাতের ইশারায় প্রবেশের অনুমতি দিলেন।
চা ঢেলে এগিয়ে দিলাম। ধ্রুব চা নিয়ে রাখলেন। রাহাত স্যার চুমুক দিলেন কাপে। দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার পূর্বে বললেন, “সুপার! একদম সুপার ডুপার। কী স্বাদ! ইচ্ছে করছে তোমার হাতে চুমু খেতে।”
প্রশংসাটা মোটেও পছন্দ হলনা আমার। তবে এই কথাটা ধ্রুব দেখিয়ে বললেন, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ অবশিষ্ট নেই। ধ্রুব শান্ত অথচ গম্ভীর। গরম চা’টুকু ফুঁ ছাড়াই খেয়ে ফেললেন। যেন ঠান্ডা শরবত তৈরি করেছি। থেমে রইলেন না ধ্রুব স্যার। জোরপূর্বক রাহাত স্যারের কাপ এনে সেটাও শেষ করলেন। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“চা খেতে না পারলে চুমু খাবি কেমনে? চা নেই, চুমু খাওয়ার দরকারও নেই।
অন্যের বউকে চুমু খেতে এসেছে।”
প্রত্যুত্তরে রাহাত স্যার বললেন, “তোর বউ কীসের হ্যাঁ? ও আমার বউ।”
“তোর বউ, কোনো প্রমাণ আছে?”
“দিব্যি আছে। ওর অনামিকা আঙুল দেখ। মা সেদিন রিং পড়িয়ে দিয়েছে। ডায়মন্ডের রিং, সিটি গোল্ড কিংবা গোল্ড নয়।” ভাব নিয়ে বললেন।
তৎক্ষণাৎ ধ্রুব আমার বা’হাত ধরলেন। একটু উঁচুতে তুলে পরখ করে নিলেন। রিংটা খুলে নিজের কনিষ্ঠা আঙুলে পড়ে নিলেন। পুরোপুরি ঢুকল না। প্রথম কড় অবধি গেল। কড় বাকিয়ে সামলে নিল কোনোরকমে। টাওয়াল দিয়ে মাথা ঢেকে নিলেন। কেতলি থেকে চা ঢেলে রাহাত স্যারের দিকে এগিয়ে দিলেন। রাহাত স্যার ধ্রুবের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ধ্রুব কাপ ধরিয়ে দিয়ে হাতের উল্টো পিঠ মেলে দিল। বিদ্রুপ করে বললেন,
“নে এবার চুমু খা! একদম হাত ছাড়বি না। খেতে থাক, খেতে খেতে খেয়ে ফেল। তোরই বউ।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]