#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৮
“তোরই বউ” শব্দটা শোনামাত্র রাহাত স্যার পলক ফেলতে ভুলে গেলেন। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ধ্রুব স্যারের হাস্যকর মুখপানে চেয়ে রইলেন। রাহাত স্যারের অসহায় দৃষ্টিতে যোগদান করলাম আমি। দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই নিজেকে সংযত করে বললেন, “তোর মাথা খা’রাপ ধ্রুব? কীসব বলছিস? আমরা উভয়েই ছেলে। ছেলে হয়ে ছেলেকে বিয়ে? কীভাবে সম্ভব?”
ধ্রুব স্যার কোনোরুপ না ভেবে বললেন, “কেন সম্ভব নয়। অন্য বউয়ের হাতে চুমু খেতে চাস। তাহলে আমাকে কেন খেতে পারবি না।
তাছাড়া তোর মা চড়ুইকে বউ করবে বলেই হাতে রিং পড়িয়েছে। এখন রিংটা আমার হাতে। অতএব আমি তোর বউ। সময় নেই,কাজ আছে। তাড়াতাড়ি চুমু খা! ”
ধ্রুব তার হাতটা রাহাত স্যারের আরেকটু কাছে আনতেই ছিটকে সরলেন তিনি। চেয়ার থেকে ধপাস করে নিচে। কোলের উপর রাখা কাগজপত্রগুলো অবিলম্বে নিচে পড়ল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রাহাত স্যারের কাণ্ড দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। তিনি কাগজ গোছানো শুরু করলেন। ধ্রুব রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল। হাসি থামিয়ে দিলাম পরক্ষণে। ডানহাতটা উঁচু করে পরপর দু’বার ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শে ভরিয়ে দিলেন। হাত ছাড়িয়ে টাওয়াল মেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যালকেনির দিকে পা বাড়ালেন। আমি পূর্বের ন্যায় হাত শূন্যতায় তুলে দাঁড়িয়ে আছি। ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ বিচ্ছিন্ন একে অপরের থেকে। হাত নামাতে ভুলে গেলাম। স্থির ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। ধ্রুব ফিরে এলেন। পূর্বের ভঙ্গিতে দেখে বললেন, “ঘরে যাও, দাঁড়িয়ে আছো কেন? পরপর দুইচুমুতে হয়নি? আরও চাই?”
হাত নেমে গেল। নিজের ভেতরে ফিরলাম আমি। মাথা ঘুরছে। প্রচণ্ড ঘুরছে। লজ্জা ঘিরে ধরল সবাঙ্গ। নুইয়ে গেল মাথা। দ্বি মুহূর্ত অপেক্ষা না করে মাথা নিচু করে ছুটে বেরিয়ে এলাম। ধ্রুবের ঘরে এসে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লাম। এখনও ক্রমাগত কাঁপছে শরীর। কী ঘটলো একটু আগে।
_____
সূর্য ঝুলেছে পশ্চিম প্রান্তে। হলদেটে রক্তিম আভা ছড়িয়েছে। তীক্ষ্ণ রশ্মি নেই। আকাশে দুই চারটে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। যার রং নীলচে। জলহীন। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা নেই। ওয়াশরুমের ভেতর থেকে পানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। হাতে নুডুলসের বাটি আর এক কাপ কফি। নুডুলসটা আমার জন্য, তবে তৈরি করা হয়েছে বাবুইয়ের জন্য। প্রথমবার এই বাড়িতে এসেছে, তাই। আমি টেবিলের উপর কফির কাপটা রেখে ওয়াশরুমের দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। হুটহাট, সময় অসময়ে শাওয়ার নেওয়ার অভ্যাসটা বিদেশ থেকে শিখে এসেছি। আমি দীর্ঘশ্বাস নিলাম। তার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি কিন্তু কফি তো রাজি নয়। মিনিট পেরুবার আগেই ঠান্ডা বরফের টুকরার রুপ ধারণ করবে। দরজায় দুই টোকা দিলাম। পরবর্তী টোকা দেওয়ার পূর্বেই ওয়াশরুমের দরজা খুলে দিলেন। মাথা বের করে দিলেন। সাবান ফেনা দিয়ে ভর্তি সমস্ত মাথা। চুসে চুসে পড়ছে কপাল বেয়ে। তিনি চোখের কাছের ফেনা পরিষ্কার করে বললেন,
“এসো।”
“কোথায় আসব?”
“কেন, ভেতরে।”
“ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! কীসব বলছেন? আমি কেন ভেতরে যাবো।”
“তাহলে নক করেছ কেন?”
“আপনার কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বিভ্রান্ত হলাম। তৎক্ষণাৎ ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ শব্দ পেলাম। পানির কারণে বেশি শব্দ শোনা গেল না। দরজার কড়া নাড়বার সাহসটুকু আর নেই। দরজার বাইরেই পদচারণ শুরু করলাম। মিনিট দশেক অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ধ্রুব। পড়নে শুকনো টাওয়ার ছাড়া কিছু নেই। কালচে দাগগুলো হালকা হয়েছে। কিছুটা মিলিয়ে গেছে শরীরে। ডান পাশের পেটের উপর কুচকুচে কালো তিল। বেশ আকর্ষণীয় লাগছে তাকে। আচ্ছা তিলটার উপর যদি কামড় দেই, ব্যথা পাবেন? নিজের ভাবনায় নিজেই আনমনে বিস্মিত হলাম। ধীরে ধীরে শুধালাম, “দ্বিতীয়বার।”
হাত দিয়ে মাথা ঝসতে ঝসতে বেরিয়ে এলেন। আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, “সাবানে স্লিপ করে পড়ে মাথায় লেখেছে। দেখো তো জখম হয়েছে কি-না।”
অসহায় দৃষ্টিতে ধ্রুবের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার এই হাইট নিয়ে তার কান অবধি দেখা যায়। কিন্তু মাথার জখম কীভাবে দেখব। বিরক্তিকর কণ্ঠে বললাম,
“ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আমি পড়াশুনা করব না। আপনি নিচু হয়ে দাঁড়ান।”
মৃদু হাসলেন ধ্রুব। আমি বিছানায় বসলাম। হাঁটু ভাঁজ করে বসলেন। পেছনের চুলগুলো সরাতেই বাজ পড়ল। বেশ কিছুটা ফুলে গেছে। এমনিতেই শরীরে ব্যথা, মাথাটাই বাকি ছিল। এখন ষোল কলা পূর্ণ হয়েছে। অস্ফুট স্বরে বললাম, “একটু দেখে শুনে কাজ করবেন না। কতটা ফুলে গেল।”
“একটু লেগেছে ঠিক হয়ে যাবে।”
বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কাবার্ড থেকে কাপড় নামিয়ে রুমেই পড়তে শুরু করলেন। লহমায় দৃষ্টি সরিয়ে ফেললাম
তড়িগড়ি করে বললাম, “কফি! কফি এনেছিলাম। ঠান্ডা হয়ে গেছে মনে হয়। আরেক কাপ নিয়ে আসছি..
“দরকার নেই, খেতে ইচ্ছে করছে না। নুডুলসটা খাইয়ে দাও। হালকা ক্ষুধা লেগেছে। কফিতে সাড়বে না। [আমাকে নড়তে না দেখে পুনরায় বললেন] তাড়াতাড়ি করো, দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
দ্বিধাগ্ৰস্থ থাকার সত্বেও বাধ্য হয়ে খাইয়ে দিতে লাগলাম।
______
রাতের অন্ধকারে নিমজ্জিত দিনের আকাশ। তারারা মিটিমিটি জ্বলছে। চাঁদ ঝুলছে আকাশের কোণে। ধ্রুব বাড়িতে ফেরেননি। এখনো শেষ হয়নি তাদের সম্মেলন।
আমি বাবুই আর রমিলা আন্টি বসে বসে টেলিভিশন দেখছি। চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে গিয়ে থামল একটা ভিন্নরকম চ্যানেলে। ধ্রুবের চিন্তিত মুখ দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই লাইভ বিশ্ববিদ্যালয় সম্মেলনে দেখানো হচ্ছে। প্রতিবছরই হয়, তবে এতটা আগ্রহ প্রকাশ করিনা। ধ্রুব আছেন বলেই হয়ত একটা কৌতুহল। তাছাড়া এই প্রথমবার আমাদের ভার্সিটি যোগ হয়েছে। আমাদের প্রতিক্ষার ইতি টেনে অনুষ্ঠান শেষের দিকে। প্রথমে পুরো অনুষ্ঠানের স্থান দেখানো হল। অতঃপর ভেতরটা। গোল টেবিলের আয়োজন করা হয়েছে। একেক ভার্সিটির জন্য একেক গোল টেবিল। ধ্রুব রাহাত স্যার পাশাপাশি। কিছু একটা আলোচনা করছে। ক্ষণে ক্ষণে কুঁচকে যাচ্ছে কপাল। টিসু দিয়ে মুছছেন জমে থাকা জলকণাগুলো।
বক্তব্য দিলেন একজন চল্লিশ উর্ধ্বের ভদ্রলোক। সম্মান করে বললেন, “এবারে নতুন একটা বিশ্ববিদ্যালয় যোগ হয়েছে আমাদের সাথে। তাদের শিক্ষা দিক্ষা বেশ উন্নত মানের। যথেষ্ট পরীক্ষা নীরিক্ষা করে অংশ দেওয়া হয়েছে। আশা রাখছি, ভালো কিছু উপহার পাবো।
তাদের স্টেজে আসার অনুরোধ করছি। প্লীজ কাম।”
স্যার স্টেজের দিয়ে এগিয়ে গেলেন। করতালির আওয়াজ শোনা গেল। ছোট একটা ট্রফি স্যারের হাতে দিতে নিলেই বাঁধ সাধলেন কেউ। অপরিচিত লোকটি তৃতীয় নং টেবিল থেকে দাঁড়িয়ে চ্যাঁচিয়ে বললেন, “এই ভার্সিটিতে শিক্ষার মান ভালো থাকলেও শিক্ষকদের মান ভালো নয়। চরিত্রের ঠিক নেই। ছাত্রীদের সাথে চিপকে থাকতে দেখা যায়।”
ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললেন তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ধ্রুব বোতলের ছিপি খুলে পানি পান করলেন। ঠোঁট কামড়ে নিচু হয়ে রইলেন। গতকালের ঘটা ব্যাপারটা আলোচনায় স্থান পেয়েছে। লোকটি দম নিয়ে পুনরায় বলতে শুরু করলেন,
“আমরা সবাই জানি, কালকে ধ্রুব নামের স্যারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কেন নিয়ে গেছে, তা অজানা নয়। তারই ছাত্রীর জন্য।”
ধ্রুব ফোড়ন দিয়ে বললেন, “স্যার, আপনি অভিজ্ঞ একজন শিক্ষক। আপনার কাছ থেকে এমন কিছু আশা করিনি। আপনার কাছ থেকে আমরা শিখব, জানব। সত্যিটা না জেনে ডিল ছুড়াটা ভালো দেখায় না।”
তৎক্ষণাৎ লাইন ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। ঝামেলা হচ্ছে সেখানে। আমাকে নিয়ে যত ঝামেলা। আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারটা কেন পাবলিকে আসছে। এখানে এক মুহুর্ত থাকা ঠিক নয়। এক্ষুনি যেতে হবে সেখানে। ঠিকানাটা জানা ছিল। অপেক্ষা করলাম না। তড়িগড়ি করে পার্স নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রমিলা আন্টি যেতে বারণ করলেন। তার কথা শুনলাম না। বাধ্য হয়ে বাবুইকে পাঠালেন সাথে।
বাড়ি থেকে বের হতেই সিএনজির দেখা পেলাম। তবে রাত বেশি হওয়াতে যেতে নারাজ। ব্যাগ নিয়ে পায়ে হাঁটা দিলাম। সময় ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ। জনমানবহীন রাস্তাঘাট। বাবুইয়ের হাত ধরে হাঁটা দিলাম। কিছুদূর অগ্ৰসর হতেই সিএনজি পেলাম। দ্বিগুণ ভাড়ার নিচে যাবে না। উপায়হীন হয়ে উঠে বসলাম। ক্রমাগত ফোনে সময় দেখছি। মনে হচ্ছে, চোখের পলকের পূর্বেই সেখানে পৌঁছে যাই। রাহাত স্যারকে ফোন করলাম। যদি তিনি সামলে নিতে পারেন। কিন্তু রিসিভ হলনা। শরীর কাঁপছে। অবশেষে পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত জায়গায়। পাঁচতারা হোটেলের সামনে। গার্ডরা ঢুকতে দিবেন না। ভেতরে গন্ডগোল হচ্ছে, কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া যাবেনা।
বাবুইকে নিয়ে হোটেলের পেছনে গেলাম। পাঁচিল টপকে ঢুকে গেলাম ভেতরে। বাবুইকে নিরিবিলি শান্ত জায়গায় দাঁড় করিয়ে ভেতরের দিকে অগ্ৰসর হলাম।
[চলবে