#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৬
“ধ্রুব স্যার তোর হাসব্যান্ড, ও.মাই.গড। আমি একদমই ভাবতে পারছি না। তুই এই কথাটা আমাদের থেকে লুকিয়েছিস, কেমনে পারলি দোস্ত।”
হতাশাগ্ৰস্থ কণ্ঠে বলে আঁখি। আমি দূর্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। না, আমার সহ্য হচ্ছেনা। ওদিকে ধ্রুব মাহিদের নিয়ে গেল আর ফিরল না, কী হলো সেটাও জানতে পারছি না। চিন্তায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এখানে আবার এদের তদন্ত চলছে। আমাকে টুলে বসিয়ে গোল করে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। আমি বিরক্ত প্রকাশ করে উঠে গেলাম। সেখানে গিয়েই দেখতে হবে। চাইলেই কী যাওয়া যায়? টেনে চেয়ারে বসালো আমায়। প্রিয়া কর্কট কণ্ঠে বলে, “কী সমস্যা তোর। কিছু জিজ্ঞাসা করছি তো। একপা বাড়ালে ঠ্যাং ভেঙে বসিয়ে রাখব।”
ফোড়ন দিয়ে বললাম, “বসিয়েই তো রেখেছিস, এবার ঠ্যাঁ ভাঙাই বাকি আছে।”
তারিফ প্রশ্ন করল, “আমরা ভাঙি আর স্যার আমাদের ঠ্যাং ভাঙুক। সত্যি করে বলতো, ধ্রুব স্যারের সাথে তোর বিয়ে কবে হল?”
এর মাঝেই একদল ছেলে-মেয়ে ঢুকে গেল লাইব্রেরীতে। দূরে দাঁড়িয়ে আমাকে ইশারা করছে। অতঃপর ফিসফিসিয়ে বলছে কিছু। কানে এলো কিছু কথা। সামনের মেয়েটা আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে বলে, “ঐমেয়েটা ধ্রুব স্যারের ওয়াইফ।”
আরেকটা মেয়ে নাক ছিঁচকে বলে, “না এর সাথে ধ্রুব স্যারকে একদম মানাবে না। কেমন একটা গাইয়া গাইয়া টাইপ।”
আরেকজন বলছে, “ওদের বিয়ে হয়েছে কবে? ধ্রুব স্যার দেশে ফিরেই ভার্সিটিতে জয়েন করেছে। তখন তো মনে হয়নি তারা পরিচিত।”
গায়ে লাগল কথাটা। তেজ দেখিয়ে বললাম, “লাইব্রেরীতে কতগুলো মাছি ঢুকেছে, ভনভন করছে। মাছিগুলো তাড়িয়ে দরজা ভিড়িয়ে দে নিরব।”
নিরব সন্তর্পণে এগিয়ে গেল। মেয়েগুলো বেজায় ক্ষেপেছেন। দ্বি’মত পোষণ করার পূর্বেই বিনাবাক্যে প্রস্থান করল। শান্তিপূর্ণ শ্বাস নিলাম। চেয়ার ভেবে ভর দিলাম সম্পূর্ণ। মুহূর্তের মাঝে ভুলে গেলাম টুলের কথা। বিনিময়ে টুল উল্টে পড়লাম মেঝেতে। ঘর্ষণ সৃষ্টি হল মেঝেতে। মাথার পেছন অংশে আঘাত পেলাম। পিঠে আলতো ঘর্ষণ লাগল। পুড়ে উঠল জায়গাটা। আমি উবুত হয়ে পিঠ ধরলাম। কাতরাচ্ছি ক্রমাগত। তৎক্ষণাৎ ধ্রুব উপস্থিত হলেন। আমার এরুপ অবস্থা দেখে ছুটে এলো। গালে মৃদু শব্দে চপল দিয়ে বিষণ্ণ গলায় ডাকল। অকস্মাৎ ঘটা ঘটনায় নির্বাক আমি। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সবকিছু অবলোকন করছি। ধ্রুবের বিষণ্ণময় কণ্ঠ কর্ণকুহরে হানা দিলেও সাড়া দিতে ব্যর্থ হলাম। ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন করতে পারলাম না। বন্ধুরা এগিয়ে আসার প্রয়াস করলে ধ্রুব বারণ করলেন। নিজেই প্রচেষ্টা করলেন। ধরে ধরে উঠে বসালেন হেলান দিয়ে। পিঠের ক্ষত তীব্র আকার ধারণ করেছে। হেলান দেওয়া ছাড়াই বসলাম। তিক্ত কণ্ঠে বললেন, “একটু সাবধানে বসবে না। সবসময় ছটফট ছটফট করো। বেশি লেগেছে?”
অস্বস্তি নিয়ে বললাম, “না, জাস্ট পিঠে।”
প্রত্যুত্তর দেওয়ার পরক্ষণেই অন্য প্রশ্ন টানলেন, “পড়লে কী করে?”
টেনে টেনে জবাব, “হঠাৎ মাথাটা ধরে গেছিল। সামলাতে পারিনি, তার আগেই।”
মাথার প্রসঙ্গ টেনে অতিশয় ভুল করলাম। দ্রুত তার ডানহাতটা কপালে ঠেকালেন। এপিঠ ওপিঠ করে জ্বর মাপার চেষ্টা করলেন হাতের সহায়তায়। আমি সৌজন্য হাসলাম। চোখে অজস্র ভীতি। ধ্রুবের চোখের ভাষা অনুভব করতে পারলাম। “ভালো আছেন?”
ভ্রু কুঁচকে ধ্রুব বললেন, “কালকের ঘটনার পর বাড়িতে যাওনি। ফুড কমপ্লেক্সে ছিলে। তা খাওয়া-দাওয়া করেছ?”
এই ধারণাই করেছি। আপনাআপনি হাত চলে গেল মুখে। সরল মুখশ্রী করে দাঁত দিয়ে নখ ছোট করার প্রয়াস করলাম।
“নখ খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করিনি, অন্যকিছু খেয়েছ কি-না সেটা? নখে জীবাণু থাকে, ওগুলো খেলে এমনিতেই শরীর খা’রাপ করবে। তুমি বসো, আমি দেখছি কী পাওয়া যায়।”
ধ্রুব বলেই উঠে দাঁড়ালেন। অশান্ত মন নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। পরক্ষণেই ভয়ংকর ঝামেলা ঘাড়ে ঝুটল। ধ্রুবের চেয়েও কড়া হয়েছে বন্ধুমহল। বুকে হাত গুঁজে সন্দিহান স্বরে বলে, “মাথা ঘুরল কেন তোর? সত্যি করে বল।”
না বোঝার স্বরে বললাম, “মাথা কেন ঘুরে, কখন ঘুরে আমি বলব কীভাবে? আমি কি ডাক্তার?”
প্রিয়া প্রশ্ন করল, “এবার বল, তোদের বিয়ে কবে হয়েছ?”
“যে সপ্তাহে শুক্রবার নেই।” এড়িয়ে।
“মানে তোদের বিয়ে হয়নি। ধ্রুব স্যার মিথ্যা বলেছে, কিন্তু স্যার তো মিথ্যা বলেনা। আচ্ছা স্যার তোকে চুমু খেয়েছে?”
“হ্যাঁ।” সংক্ষিপ্ত জবাব।
“তোরা একসাথে ছিলি কখনো?”
“হ্যাঁ। কয়েকদিন ছিলাম। উনি ছুটি নিয়েছিলেন-না তখন। একসাথে গিয়েছিলাম এবং একসাথেই ছিলাম।”
হতাশাগ্রস্থ কণ্ঠে বলে আঁখি, “দোস্ত তুই প্রেগন্যান্ট না তো?”
হতভম্ব হলাম। পরক্ষণেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। এই সামান্য কথাটা জিজ্ঞেস করতে এত কথার পাহাড় সাজিয়েছিল। দমে গেল সবাই। আঁখি কপাল চাপড়াতে লাগল। তার ভারাক্রান্ত মন। ধ্রুব স্যারের পেছনে লাইন দেওয়ার পরেও কাজ হয়নি।
অতিবাহিত হল দু’মাস। বদলে গেছে সবকিছু। আমার আর ধ্রুবের সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই। বেশ বদলে গেছে। ভার্সিটিতে যাওয়া আসা চলতে থাকে কিন্তু ধ্রুবের সাথে কথা হয়না। শা’স্তি দিচ্ছি তাকে। এতগুলো বছর অবহেলার করার জন্য। বাবুইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। একটা কথা তো বলাই হয়নি।
আজ শুক্রবার। রাহাত স্যারের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ের তোরজোর চলছে।
ধ্রুব নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছে, এতেই সন্তুষ্ট আমি। কিন্তু তার মা রমিলা অসন্তুষ্ট নয়। তাকে এড়িয়ে চলা, আমাকে অবহেলা করার জন্য বিয়ের বন্দোবস্ত করেছে। শেষ পর্যন্ত তার ছেলে কী করে, সেটাই দেখতে চান।
চারিদিকে উৎসব মুখর পরিবেশ। পুরো বাড়ি সাজানো হয়েছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব দিয়ে ভর্তি বাড়ি। ফুলের হালকা সাজ, গায়ে হলুদের শাড়ি। তার উপরে লাল হলুদের মিশ্রণে গামছা জড়ানো। মুচকি হেসে গাঁদা ফুল গাছের পাশে দাঁড়ালাম। ফটোগ্ৰাফার ছবি তুলে দিলেন। বন্ধু আঁখি আর ধ্রুবের চাচাত বোন আঁখিকে নিয়ে ছবি তুললেন। আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল ধ্রুবের পানে। পড়নে হলুদ পাঞ্জাবি। চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে এগিয়ে এলো আমার পানে। ঈর্ষা জাগল ঈষৎ। বউ অন্যের হয়ে যাচ্ছে, তার এত সাজ কীসের? আশ্চর্য! পকেট থেকে শুকনো বেলি ফুলের মালা বের করলেন। অনেক আগের দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মৃদু হেসে বললেন, “সেদিন তোমার মাথায় গাদা ফুলের মালা গুঁজে দিছে দিয়েছিলাম-না, তখন এটাও কিনেছিলাম। নিজের কাছে যত্নে রেখে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সময় করে গুঁজে দিবো, তা আর হবে না। এখনই গুঁজে দেই।”
অনুমতির প্রয়োজন বোধ করলেন না। নিজেই যত্নসহকারে খোঁপায় ফুল গুঁজলেন। হেসে বললেন, “খুব সুন্দর লাগছে, মা-শা-আল্লাহ। তবে পায়ে আলতা নেই কেন? শুধু মুখে ময়দা মাখলেই চলবে, পা’কে একটু সাজাতে হবে তো না-কি!
শুভ কামনা আগামী জীবনের জন্য।”
কাগজে মোড়ানো আলতার বোতলটা এগিয়ে দিল বড় চাচির কাছে। তিনি অবিলম্বে ব্যস্ত হলেন আলতা পড়াতে। আমাকেও বাধ্য করলেন। আলতায় হলুদ হলুদ রং ফুটে উঠল। তবে তীক্ষ্ণ নয়। হলুদের অনুষ্ঠান ভেবে অগ্ৰাহ্য করলাম।
যেভাবে ধপাধপ পা ফেলে এসেছিলাম তেমনি ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলেন। একটু দূরে গিয়ে গোল করে দাঁড়ালেন। প্রিয়া, নিরব, আঁখি, তৌফিক এমনকি দাদিমাও আছেন সেখানে। কৌতুক দমাতে না পেরে সেদিকে অগ্ৰসর হলাম। ধ্রুব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, “দেখ, প্লান যাতে কিছুতেই ফ্লপ না করে। তাহলে কিন্তু সব শেষ।”
“আচ্ছা স্যার।” সবাই একসাথে।
“এখানে স্যার ডাকার প্রয়োজন নেই। কেমন জানি লাগে। ভাইয়া বলেই ডেকে।”
“আচ্ছা, স্যার [ ধ্রুব বিস্ফোরিত চোখে তাকাতেই] ভাইয়া..
আমিও পেছন থেকে বললাম, “আচ্ছা, ভাইয়া। তো কীসের প্লান?”
“তোমার বিয়ের..
হলুদের জন্য ডাক পড়ল। প্রথম হলুদ মামুনিই ছোঁয়ালেন। অতঃপর এক এক করে সবাই ছুঁয়ে দিলেন। আমি মাথা নিচু করে রইলাম। হলুদে ‘হলুদ গাছের’ চাষ করলাম।
ঘরে আনা হল। একদল লোক হুরমুড়িয়ে চলে এলো। আমাকে ওয়াশরুমের দিকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,
“ভাবী তোমরা দুইজন আহো শুধু। এত ছোট ওয়াশরুমে এত মানুষ আটত না। এত কইরা কইলাম, বাইরেই গোসলটা সেরে ফেলতে, শুনলই না। একসাথে দুই মাইয়ারে গোসল করান যাইত, এখন এক এক কইরা।”
“আপনারা কেন গোসল করাবেন?” একরোখা প্রশ্ন।
“বিয়ের গোসলে একটু নিয়ম আছে। তুমি একা পারবনা মা, আমাদের লাগবে। ভাবী আসো।”
বললে বলতে জোরপূর্বক আমাকে ঠেলে ঢুকল তারা। এই গোসল সেরে বের হতে হতে পাঁচটা বাজল। আমি পুরাতন একটা জামা পড়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। এখন হালকা লাগছে। বাইরে সবাই আনন্দ করছে। গ্ৰামের চাচিরা রং নিয়ে একে অপরের গায়ে ছুঁড়ছে।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
আগামী পর্বেই শেষ..😇