মেঘমেদুর দিনে পর্ব-০১

0
24

#সূচনা_পর্ব
#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই

বৈশাখের সপ্তাহ দুয়েক পেরিয়েছে। সূর্যের লাগামহীন তেজে রাস্তার পিচ গলে পড়ার মতো অবস্থা! কোথাও মেঘের ছায়া নেই, স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই, নেই শীতল হাওয়া। গাছের পাতারা যেন কদিন ধরে ঝিমিয়ে আছে। রাস্তায় বৃহস্পতিবার দুপুরের জ্যাম, বিচ্ছিরি সব কোলাহল আর তীব্র তাপদাহে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত ঠিক তখনি প্রকৃতি বদলে ফেললো নিজস্ব রূপ। গগন বিদারক শব্দে গর্জে উঠল আকাশ। শুভ্র মেঘের দল ছাই রঙে রাঙা হয়ে আড়াল করল আগুন ঝরানো রাগী সূর্য্যি মামাকে।

রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নিচে গড়ে ওঠা সারি সারি পুরোনো বইয়ের দোকানে তখন উপচে পড়া ভিড়। বৃষ্টি আসার শঙ্কায় নীল পলিথিনের আস্তরণে বইগুলো ঢেকে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল দোকানির দল। তখনি ভিড় ঠেলে পুরুষালি একটি হাত তুলে নিলো পুরোনো, ধুলো জমে থাকা কভারের একপার্শ্ব ছেঁড়া বইটি।

“অপ্রিয় মলি শুনছো?
চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি, তোমাকে হারিয়ে ফেলার দুদিন পর। আমাদের বাদল দিনের অলস পথ ফুরোলো। প্রণয়ের অসমাপ্ত কাব্যটি চাপা পড়ে গেলো বিভীষিকার অতলে। তাতে কী? জীবনের বাঁকে, বাস্তবতার মোড়ে ভুলে যেও না হয় হেরে যাওয়া এক বেকার প্রেমিককে। পুড়িয়ে ফেলো অনুভূতির শব্দে বুনা চিঠি। পুরোনো স্মৃতি মুছে ফেলে ঠাঁই দিও নতুনকে। তবুও আমায় তুমি ভেবো না, রেখো না জীবনের কোথাও।”

ইতি……

মলিন বইয়ের প্রথম পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা একগুচ্ছ নির্মম বিচ্ছেদের শব্দমালা পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিথিল। বইটি নাড়িয়ে এপাশ ওপাশ দেখে। অল্প বয়সী দোকানি ছেলেটা তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটিয়ে বলে ওঠে,“আজ সকালেই এই বইটা হাতে পেয়েছি। আর এর মধ্যেই আপনার নজরে পড়ে গেলো, ভাই?”

মৃদু হাসে শিথিল। বলে,“এটা আমার জন্যই মনে হয় ছিল। তা কত নিবি?”

ছেলেটা অনাগ্রহ প্রকাশ করে নরম স্বরে বললো,“ভাই এটা আসলে অন্য একজনের জন্য ছিল। না নিলে হয় না? আপনার কাছে তো এমনিতেই এসব বইয়ের অভাব নেই।”

প্রত্যুত্তর করার আগেই বাঁধ সাধলো প্যান্টের পকেটের ভেতর অবাধ্য সুরে বেজে ওঠা মোবাইলটি। সেই শব্দে ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো শিথিলের। স্ক্রিনে ভালোভাবে লক্ষ্য না করেই রিসিভ করে কানে ধরল। সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো চমকায়িত, বিদ্রুপ পুরুষালি কণ্ঠস্বর,“ওহ, তুই তবে মরোস নাই শ্লা?”

“কী প্রয়োজন?”

“পার্সেল এসেছে।”

“আমার?”

“নইলে কার? আমি বুঝি না ভাই,ছেলেদেরকে পার্সেলে করে চিঠি কে পাঠায়? কত আশা নিয়ে আমি আর শান্ত মিলে পার্সেলটা খুললাম। শেষমেশ কিনা চিঠি?”

মুখশ্রীতে লেগে থাকা বিরক্তি মুহূর্তেই বিলীন হয়ে স্থান পেলো প্রশ্ন। হুমকি দিয়ে বললো,“শান্তর টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দে। আমি আসছি। আর একদম খুলবি না বলে দিচ্ছি। নইলে মেরে নাক ফাটিয়ে দিবো।”

“গলার এতো তেজ! প্রেম করছিস নাকি? সিরিয়াসলি! আমাদের শীতল প্রেম করছে?”

নামের বিকৃত রূপ শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো শিথিল। হা হু না করে মুখের উপরেই কেটে দিলো কল। প্রশান্ত দৃষ্টিতে আকাশপানে চাইলো। বৈশাখের আকাশে তখন আষাঢ়িয়া মেঘ জমেছে। রাস্তার ধুলোকণা বেসামাল উড়ে চলেছে বাতাসের বেগে। নীলক্ষেতের সারি সারি বইয়ের স্তুপ ততক্ষণে নীল পলিথিনের দখলে।

ধূলো জমা বইটি বন্ধ করে বাকি বইয়ের স্তুপের উপর রাখলো সে। উপরের প্রচ্ছদে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ‘অপেক্ষা, হুমায়ূন আহমেদ।’ এই বইটি তার প্রিয়। বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন পড়েছিল। পরপর তিনবার, ছয় রাতের নিদ্রা বিসর্জন দিয়ে। তাই দামদর করার আর ইচ্ছে হলো না। ছেলেটার উদ্দেশ্যে ভারিক্কি কণ্ঠে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,“দাম কত?”

ছেলেটা এবার আর বাঁধা দিলো না। মুখ ভার করেই বললো,“দেড়শ দিয়েন।”

নিঃশব্দে মানিব্যাগ বের করল শিথিল। চকচকে বেশ কতক পাঁচশ টাকার নোটের ভেতর মলিন তিনটা একশ টাকার নোট পড়ে রয়েছে। সেখান থেকেই দুইটি একশ টাকার নোট বের করে ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে পঞ্চাশ টাকা ফেরত নিলো। তারপর বই হাতে নেমে পড়ল সে রাস্তায়। নীলক্ষেত পেরিয়ে উদাস মনে হাঁটা ধরলো কোথাও।

প্রকৃতির নতুন এক ক্ষণে রিক্সার হ্যান্ডেলের টিং টিং শব্দে পরিবেশটা হয়ে উঠেছে রোমাঞ্চকর। চায়ের টং দোকানের সামনে অর্ধেক জিভ বের করে বসে আছে এক কমলা রঙের কুকুর। ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে আছে দোকানের সামনে ঝোলানো পাউরুটির পানে। তাও দৃষ্টি এড়ালো না শিথিলের।এ পথে সপ্তাহে তিনদিন তাকে আসতে হয়‌। উচ্চ মাধ্যমিকের দুজন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর জন্য। হাতঘড়িতে সময় দেখে দোকানের কাছে এসে থামলো সে। কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন, মামা?”

দোকানি ভদ্রলোক কোমরে গামছা বেঁধে ব্যস্ত হাতে রং চায়ে দুধ মেশাচ্ছেন। সামনের বেঞ্চিতে অপেক্ষারত বসে থাকা তিনজন কাস্টমারের জন্য। শিথিলকে দেখতেই পান খাওয়া রঙিন দাঁত বের করে হাসলেন তিনি। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ ভালা, মামা। অনেকদিন পর আপনারে দেখলাম।”

থেমে জিজ্ঞেস করলেন,“চা দিমু?”

“এখন না। টিউশনটা পড়িয়ে আসি। তারপর আরামছে বসে খাবো।”

থামলো শিথিল। ক্ষুধার্ত কুকুরটি এসে ততক্ষণে তার পা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। চা দোকানি আব্দুলের মতো কুকুরটিও তাকে চিনে। বিনে পয়সায় যে তাকে রুটি খাওয়ায় তাকে না চিনলে হয়?

এগিয়ে গিয়ে একটি পাউরুটি নিয়ে কয়েক টুকরো করে কুকুরটির সামনে দিলো শিথিল। পিঠে হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। দোকানির উদ্দেশ্যে বললো,“এখন ভাংতি নেই, মামা। আমি বরং পড়িয়ে আসি। চা খেয়ে একসাথে না হয় বিল মিটিয়ে যাবো।”

এবারো আব্দুল মিয়া হাসলেন। লাজুক কণ্ঠে বললেন, “সমস্যা নাই, মামা। আমনে তো আমার রেগুলার কাস্টমার।”

শিথিল আর সেখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করল না। পায়ে হেঁটেই চলে এলো নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে। আজকাল পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে তার খুব ভালো লাগে। পথের বাঁকে অচেনা পথিকের মতো ঘুরে বেড়াতে কি যে শান্তি!

কলিং বেলের শব্দে মনোয়ারা বেগমের কান সজাগ হয়ে উঠল। লুকিং গ্লাসে বাইরে দাঁড়ানো পরিচিত মুখটা দেখেই দরজা না খুলে দৌড়ে গেলেন মেয়ের শয়ন কক্ষে। মেয়ে তখন বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে উপন্যাসের বই পড়ছে। মনোয়ারা ধমকে উঠলেন,”তোর স্যার এসেছে। তাড়াতাড়ি বই, খাতা গুছিয়ে টেবিলে বোস।”

কথা শেষ করে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালেন না তিনি। সদর দরজার দিকে ছুটলেন। দরজা খুলতেই সৌজন্য হেসে সবসময়কার মতো বিনয় নিয়ে সালাম দিলো শিথিল,“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।”

“ওয়া আলাইকুমুসসালাম। ভেতরে এসো। এতক্ষণ ধরে ইভা তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিল।”

প্রত্যুত্তর করল না শিথিল। গত দুই সপ্তাহ ধরে পড়ানোর সুবাদে এই ফ্ল্যাটে যাতায়াত তার। তাই এখানকার সবই যেন এ কয়েকদিনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। সোফায় তাকে বসতে বলে মেয়ের ঘরে পুনরায় যাওয়া ধরলেন মনোয়ারা। হাঁক ছেড়ে কাজের মেয়েকে ডাকলেন,“ইভার স্যার এসেছে। নাস্তা, পানি দিয়ে যা।”

মালকিনের আদেশ পাওয়ামাত্র ট্রে হাতে ছুটে এলো আকলিমা। সেন্টার টেবিলের উপর ট্রে থেকে একে একে পানির গ্লাস আর তিন পদের মিষ্টি ভর্তি পিরিচটা রেখে লাজুক হাসলো। জিজ্ঞেস করল,“কেমন আছেন, স্যার?”

তার দিকে তাকালো না শিথিল। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে উত্তর দিলো,“আলহামদুলিল্লাহ, আপা। আপনি?”

উত্তরটি মোটেও পছন্দ হলো না আকলিমার। অধরের হাসি ঝট করে নিভে গেলো। মুখ ভার করে বললো, “আমনেরে কইছি না আমারে আপা ডাকবেন না। আমার নাম আকলিমা। আমি বয়সে আপনের থাইক্কা অনেক ছুডো।”

সম্মতি সূচক মাথা নাড়লো শিথিল। গ্লাসের অর্ধেকটা পানি শেষ করে রেখে দিলো পাশে। মিষ্টি তার তেমন একটা পছন্দ নয়। তার উপর স্টুডেন্ট পড়াতে গিয়ে খাওয়া দাওয়া তো আরো পছন্দ নয়। ভেতর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মনোয়ারা। হেসে বললেন,“যাও গিয়ে পড়ানো শুরু করো।”

এবারো প্রত্যুত্তর করল না শিথিল। বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। প্রবেশ করল ঘরের ভেতর।

আজকের আবহাওয়া বিশেষ ভালো নয়। যেকোনো মুহূর্তেই বৃষ্টি নামতে পারে। বাইরের মৃদু হাওয়া আর ক্ষণে ক্ষণে আকাশের তর্জন গর্জন তারই জানান দিচ্ছে। তাই ইভা ভেবেছিল আজ হয়তো গৃহশিক্ষক পড়াতে আসবেন না। তাই ঘর না গুছিয়ে কলেজ থেকে ফিরেই সে বসেছিল উপন্যাসের বই নিয়ে। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে সময় মতো হাজির হয়ে গেলো শিথিল। অগত্যা অল্প সময়ে মায়ের আদেশে সবকিছু গোছগাছ করে বসে বসে সে হাঁপাচ্ছে।

শিথিল চেয়ার টেনে বসলো। গম্ভীর মুখে বললো, “আজ গতিবিদ্যা ধরার কথা ছিল। বেসিক পড়েছো?”

ইভা মুখ ভার করে প্রত্যুত্তর করল,“জ্বি ভাইয়া।”

“বই খোলো। সোজা ম্যাথে ঢুকবো।”

“ভাইয়া আজ না পড়লে হতো না?”

ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে এলো শিথিলের। প্রশ্ন ছুঁড়ল, “কোন আনন্দে?”

“আবহাওয়া দেখেছেন, কি সুন্দর? এই আবহাওয়ার সঙ্গে লেখাপড়া একদম যায় না।”

“তো কী যায়?”

“অবশ্যই খিচুড়ি খেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা নয়তো উপন্যাস পড়া। এই দেখুন, এই বইটা গতকাল অনলাইন থেকে আনিয়েছি। রাতে অবশ্য পড়তে পারিনি আপনার আর ইংলিশ স্যারের হোম ওয়ার্কের চক্করে। ভেবেছিলাম আজ পড়ব কিন্তু আপনি!”

একনাগাড়ে গড়গড় করে কথাগুলো বলে বইটি শিথিলকে দেখালো ইভা। মেয়েটি বরাবরই ভীষণ বাঁচাল প্রকৃতির। মনে যা আসে মুখেও তাই বলে। কোনো রাখঢাক নেই। টেবিলে শিথিলের বা হাতের নিচে আরেকটি বইয়ের দেখা পেয়ে ইভা উৎসুক হয়ে পুনরায় বলে উঠল,“এই বইটা কার ভাইয়া? আপনার? আমি অবশ্য পড়েছিলাম একবার। তবে আমার বইয়ের মলাট নতুন ছিল।”

মেয়েটির দিকে তাকালো না শিথিল। মুখভঙ্গিও তার বদলালো না। নিজ উদ্যোগে পদার্থ বিজ্ঞান বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে উত্তর দিলো,“আমিও নতুন মলাটেই পড়েছিলাম। কিন্তু এটা পুরোনো দেখে আজ আবার কিনেছি।”

“তাই বলে পুরোনো বই কিনেছেন? কেনো ভাইয়া?”

শহরের টিউশন পড়ানোর এই এক সমস্যা। ছেলে- মেয়েগুলো গৃহ শিক্ষকদের তেমন একটা সম্মানের চোখে দেখে না। এমনভাবে ভাইয়া ভাইয়া করছে যেন এটা তার নিজের ভাই। এতে ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও সরাসরি প্রকাশ করে না শিথিল। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো,“পুরোনো বইয়ে অনেক স্মৃতি এবং ছোটোখাটো চিরকুট থাকে। যা আমার কাছে খুব ভালো লাগে। তাই মাঝেমধ্যেই সংগ্ৰহ করি।”

ব্যাপারটা ইভার কাছে নতুন লাগলো। ছোটো থেকেই পোশাক, খেলনার মতো যাবতীয় সবকিছু বাবার থেকে বেস্টটাই সে পেয়েছে। তাই এ নিয়ে তার ধারণা কম। আহ্লাদী স্বরে বললো,“তাহলে বইটা আমায় গিফট হিসেবে দিয়ে দিন।নস্টালজিক বিষয়টা আমিও একটু অনুভব করতে চাই।”

“এটা আমার নিজের জন্য। তোমার এসব পড়ার বয়স হয়নি। এই ম্যাথটা দেখিয়ে দিচ্ছি ভালো করে বুঝো। এমনিতেও তুমি এই সাবজেক্টে ভীষণ কাঁচা। তাই মনোযোগ দাও। আজ আমার একটু তাড়া আছে।”

মন খারাপ হলো ইভার। চুপচাপ ম্যাথ বুঝায় মনোযোগ দিলো। কিন্তু সেই মনোযোগ আর বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না। আধ ঘণ্টা পার হতেই আচমকা প্রশ্ন ছুঁড়ল,“আচ্ছা ভাইয়া, পৃথিবীতে এতো এতো নাম থাকতে আপনার নাম শিথিল কে রেখেছে বলুন তো? শিথিল কোনো নাম হলো?”

গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অহেতুক প্রশ্নে বিরক্ত হলো শিথিল। তবে ধমক দিতে পারলো না। এতো বড়ো মেয়েকে ধমক দেওয়া উচিত হবে না। বাবা-মায়ের আহ্লাদী মেয়ে বলে কথা! তার উপর টিউশনটাও নতুন। তাই মুখশ্রীর গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললো,“এই নিয়ে তিনবার এই প্রশ্নটা তুমি আমায় করেছো।”

“তো বলে দিলেই তো হয়। ফিউচারে আর একই প্রশ্ন বারবার করতে হবে না।”

“আমার বাবা রেখেছেন।”

“এই নামই কেনো?”

“জানি না কেনো রেখেছেন। বাবাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।”

“এখনো জিজ্ঞেস করেননি? এটা তো একদম ঠিক করেননি। জিজ্ঞেস করতে হবে, এতো নাম থাকতে শিথিল-ই কেনো? শীতল কেনো নয়?”

“তোমার নাম ইভা কেনো? রিভা কেনো নয়?”

পাল্টা প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো ইভা। ব্যাকরণে সে ভীষণ কাঁচা।‌ সারাক্ষণ উপন্যাসের বই নিয়ে বসে থাকলেও অনেক শব্দের অর্থই সঠিক জানা নেই। তাই ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইল। তার চাহনি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শিথিল। উদাস কণ্ঠে বললো,“প্লিজ ইভা, ডোন্ট মেক মি এংরি। পড়ায় ফোকাস করো। সামনে তোমার এক্সাম। যত দ্রুত পারবে আজ ততো তাড়াতাড়ি ছুটি পাবে।”

উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে পুনরায় পড়ায় মনোযোগ দিলো ইভা। শিথিল তাকে নিজের সবটা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা চালালো।

পড়ানো শেষে একটু আগে আগেই বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এলো শিথিল। আজ সকাল থেকেই খুব উদাস লাগছে তার। মনটা কি খুব খারাপ? তাও যেন বেচারা বুঝতে পারছে না। ফিরতি পথে সেই চায়ের দোকানে এসেই বসলো সে। কুকুরটি কোথাও নেই। পেট ভরতেই সঙ্গী সাথীদের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে। আব্দুল মিয়া চিনি ছাড়া রং চা এনে ধরিয়ে দিলেন তার হাতে। তাতে চুমুক দিয়ে আজ আর তেমন স্বাদ পেলো না শিথিল। ভীষণ বিরক্ত হলো। দুদিন ধরে মেজাজটা খিটখিটে। ইংরেজি মাস শেষ হয়েছে সপ্তাহ পেরোলো। পাঁচটা টিউশনির মধ্যে দুইটা টিউশনির এখনো মাস দুয়েকের বকেয়া বাকি। চক্ষু লজ্জায় বারবার চাইতেও পারছে না বেচারা। এটাই কি তবে তার উদাসীনতার কারণ?

দূর থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। আছরের নামাজের সময় হয়েছে। ভাবনা বাদ দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। চায়ের কাপে অর্ধেক চা বাকি রেখে দোকানির বিল মিটিয়ে পাশের মসজিদের দিকে হাঁটা ধরলো।
_____________

শ্রাবণের মেঘগুলি জড়ো হলো আকাশে
অঝোরে নামবে বুঝি শ্রাবণে ঝরায়ে
শ্রাবণের মেঘগুলি জড়ো হলো আকাশে
অঝোরে নামবে বুঝি শ্রাবণে ঝরায়ে

আজ কেন মন (আজ কেন মন) উদাসী হয়ে (উদাসী হয়ে)
দূর অজানায় (দূর অজানায়) চায় হারাতে (চায় হারাতে)
আজ কেন মন (আজ কেন মন) উদাসী হয়ে (উদাসী হয়ে)
দূর অজানায় (দূর অজানায়) চায় হারাতে (চায় হারাতে)

শ্রাবণের মেঘগুলি জড়ো হলো আকাশে
অঝোরে নামবে বুঝি শ্রাবণে ঝরায়ে…….

বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে শাঁ শাঁ করে ভেতরে বাতাস প্রবেশ করে দেহে ধরিয়ে দিচ্ছে কাঁপন। হলরুমে এলোমেলো বসে ছেলেরা গলা ছেড়ে গান গাইছে। তাদের মধ্যমণি হয়ে দক্ষ হাতে গিটারে সুর তুলছে আরফিন। তার থেকে কিছুটা দূরে বসা স্বাধীন হাত দিয়ে কাঠের টেবিলে বাজাচ্ছে ঢোল।

“বৈশাখের বৃষ্টিতে শ্রাবণের গান? এমন অনুচিত একটা কাজের জন্য তোদের নামে তো মামলা ঠুকে দেওয়া উচিত, মীর জাফরের দল!”

কারো বিদ্রুপে থেমে গেলো সকলের গলা। নতুন রং করা কাঠের দরজায় দৃষ্টি যেতেই উৎসুক হয়ে উঠল সকলে। স্বাধীন উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল,“ওইতো শীতল চলে এসেছে!”

বাঁকা দৃষ্টিতে স্বাধীনের দিকে একবার তাকালো শিথিল। ভেতরে প্রবেশ করে চেয়ার টেনে বসলো। তুহিন মুখ ভার করে আবদার জুড়ল,“তাহলে তুই একটা গেয়ে শোনা।”

“ইচ্ছে করছে না, তোরাই গা।”

“তাইলে মাঝখানে বাম হাত ঢুকালি ক্যান শ্লা?”–মুখ বাঁকিয়ে বললো স্বাধীন।

শক্ত হাতে তার পিঠে কিল বসিয়ে দিলো শিথিল। চোয়াল শক্ত করে বললো,“আমার বোন এক বাচ্চার মা। শালা বলা বাদ দে।”

“আর আমি ওই বাচ্চার বাপ।”—-নির্লজ্জের মতো ভেটকি মেরে পিঠ ডলতে লাগলো স্বাধীন।

কৃত্রিম রাগ দেখালো শিথিল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,“নিশু এবার নাইনে পড়ছে না? আহ পারফেক্ট একেবারে। আজ থেকে তুইও আমার শ্লা।”

মুহূর্তেই যেন চুপসে গেলো স্বাধীন। কিছুক্ষণ নিরব থেকে প্রসঙ্গ বদলে পাঁশুটে মুখে বললো,“এই মেঘলা দিনে কে পথে পথে ঘুরে বেড়ায় শুনি? তোকে আমি ঘণ্টা তিনেক আগে কল করেছিলাম আর তুই এলি এখন?”

“টিউশন ছিল।”

“এবার একটা গান ধর দেখি।”—-আরফিন বললো।

“তার আগে বল আমার পার্সেল কোথায়? খুলিসনি তো?”

সজীব দাঁত বের করে হাসলো,“ড্রয়ারে আছে দেখ। সাথে এক বাটি পাটিসাপটা পিঠা ছিল। যদিও মিষ্টির বদলে লবণ একটু বেশি হয়েছিল। তবুও ভালো ছেলের মতো খেয়ে নিয়েছি।”

ললাটে ভাঁজ পড়ল শিথিলের। ড্রয়ার খুলে বের করল একটি খাম। এপাশ ওপাশ দেখে বুঝলো, বন্ধু নামের বেয়াদব ছেলেগুলো খোলেনি। খাম ছিঁড়ে ভেতরে দেখা মিললো একটি ভাঁজ করা সাদা কাগজের। কৌতূহলী কণ্ঠে বললো,“আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পার্সেল আসে! কই জানতাম না তো? সবসময় তো সুন্দরবন অফিসে গিয়েই আনতে হয়।”

“ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের এক ফ্রেসার দিয়ে গিয়েছে। তার হাত দিয়েই তোর পরিচিত কে নাকি পাঠিয়েছে।”

মনে সন্দেহ নিয়েই কাগজের ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলো শিথিল। গোটা গোটা অক্ষরে সম্বোধন বিহীন এক চিঠি,
-“ভোরে আরদে গিয়ে বিশাল সাইজের এক ইলিশ চোখে পড়ল। মনে হচ্ছে আজ বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টির দিনে ইলিশ আর বেগুন ভাজার সাথে খিচুড়ি হলে মন্দ হয় না। তাই রেঁধে ফেললাম। কিন্তু একা একা কি এসব কখনো খেয়েছি আমি?”

দেহ, মন শিউরে উঠল শিথিলের।চোখ হলো ঘোলাটে। অধরের বিরক্তি, বিষণ্ণতা আর সকল মন খারাপ বিলীন হয়ে ঠাঁই পেলো এক চিলতে হাসি। হঠাৎ করেই তার মনে হলো, আজকের মন খারাপের কারণ সে জানে। কাউকে দেখার তেষ্টা তার মন খারাপের কারণ। কারো দীর্ঘশ্বাস, একাকিত্ব এই উদাসীনতা।

আড়চোখে বন্ধুরা তার হাবভাব লক্ষ্য করল ঠিকই। শান্ত খোঁচা মেরে বললো,“আয়হায়! আমাদের শিথিল প্রেম করছে?”

তুহিন তাল মেলালো,“নিশ্চয়ই প্রেমিকার চিঠি!”

তাদের কথায় পাত্তা দিলো না শিথিল। বিড়বিড় করে বললো,“তারচেয়েও বেশি।”

চিঠিটি পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভার্সিটির হলে সে থাকে না। নিয়ম-কানুনের মধ্যে থাকতে শিথিলের ভালো লাগে না। সে বরাবরই স্বাধীনচেতা মানুষ। তবে মাঝেমধ্যে আসে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। যেতে যেতে শুধু বলে গেলো,“তোরা থাক, আমি আসছি।”

তার কথায় সকলে চমকালো। পেছন থেকে স্বাধীন চেঁচালো,“মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। মেঘ ডাকছে। এই বৈরী আবহাওয়ায় যাচ্ছিস মানে? এই শিথিল!”

তাদের ডাক আটকাতে পারলো না ছেলেটিকে। ততক্ষণে সে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছে নিচে। ধীরে ধীরে মাঠ পেরোলো, গেট পেরোলো, রাস্তা পেরোলো‌। তারপর মিলিয়ে গেলো অদৃষ্টে।

চলবে _________