মেঘমেদুর দিনে পর্ব-০২

0
48

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০২]

ঢাকা যতটা না কোলাহল আর ভিড়ে আচ্ছন্ন, গাজীপুর তার থেকেও গম্ভীর, শান্ত। কোথাও কোনো হইচই নেই, বিচ্ছেদ নেই, নেই হিংসা বিদ্বেষ। নিজ রূপে সদা জাগ্ৰত হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। ঘড়ির কাটায় এগারোটা বাজলেই গাজীপুরে নামে গভীর রাত। রাস্তা-ঘাট হয়ে ওঠে জনমানবশূন্য। তার মধ্যে বৃষ্টি নামলে তো কোনো কথাই নেই। মনে হয়, এ যেন এক পাতালপুরী।

বিকেলে শুরু হওয়া বৃষ্টি আর থামলো না। বরং বৃষ্টির তেজ বাড়তে বাড়তে রাতে গিয়ে আকাশ পাতাল ফাটিয়ে ঝুমঝুমিয়ে পুরো জেলা ভিজিয়ে দিতে লাগলো। দূরে কোথাও মটমট শব্দে ভেঙে গেলো আস্ত গাছের ডাল। বিচ্ছিন্ন হলো বিদ্যুৎ সংযোগ। তাতে অবশ্য এলাকাবাসীর কিছু এলো গেলো না। ভ্যাপসা গরম কেটে বৃষ্টি নেমেছে ধরিত্রীতে, শীতল হয়েছে পরিবেশ। এতেই তারা রবের নিকট সন্তুষ্ট।

গাজীপুর সদরের কিছুটা ভেতরে অবস্থিত এলাকাটির নাম দক্ষিণ ছায়াবিথী। নামের সাথে মিলে এলাকাটিও যেন ছায়ায় ঘেরা এক নিরিবিলি সুন্দর স্থান। চারিদিক নিস্তব্ধ নিশিথে ডুবে আছে। মানুষ তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। দূরের দোকানটা আজ এশার আগেই বন্ধ করে ছাতা মাথায় ঘরে ফিরেছে দোকানদার। বৃষ্টির ঝনঝন শব্দে চারিদিকে সৃষ্টি হয়েছে ভুতুড়ে পরিবেশ।

আভিজাত্যে তৈরি শ্যাওলা পড়া দুতলা বাড়িটির নিচ তলায় তখনো হলদে আলো জ্বলছে। দক্ষিণের বিশাল জানালার পাশে ইজি চেয়ারে কারো অপেক্ষায় বসে আছেন এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক। চাতকের ন্যায় চেয়ে আছেন সামনের রাস্তায়। পরনে সফেদ পাঞ্জাবি আর ছাপা লুঙ্গি। চুলে অবশ্য পাক ধরেছে। তবে থুতনির দুই ইঞ্চি লম্বা দাড়িতে তা লক্ষ্য করা গেলো না। মেহেদীর গাঢ় খয়েরী রঙে চাপা পড়েছে।

ঘড়ির কাটায় দশটা বেজে ছাপ্পান্ন মিনিট। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে বুক ভার হলো ভদ্রলোকের। বসা থেকে যখন উঠতে যাবেন ঠিক তখনি গেইট পেরিয়ে দূরের সেই রাস্তায় নজরবন্দি হলো পরিচিত কেউ। মুহূর্তেই ভদ্রলোকের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। দৌড়ে গিয়ে কেবিনেটের পাশ থেকে হলুদ ছাতাটা তুলে নিলেন হাতে। সদর দরজা খুলে চলে এলেন গেইটের বাইরে।

পরনের পোশাক আশাক ভিজে একদম যাচ্ছে তাই অবস্থা হয়েছে শিথিলের। হাতের ব্যাগটা বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষার জন্য পলিথিন দিয়ে কোনোমতে বাঁধা। ছাতা আর টর্চ হাতে বাবাকে গেইটের বাইরে আসতে দেখে পা জোড়া থমকে দাঁড়াল তার। আপাদমস্তক ছেলেকে পরখ করে তার মাথার উপরে ছাতা ধরলেন হামিদুল হক। ধমকের সুরে বললেন,“এতো ভিজেছিস কেনো গর্দভ? আসার পথে একটা ছাতা কিনতে পারলি না? ভেতরে চল তাড়াতাড়ি।”

প্রত্যুত্তর করল না শিথিল। দ্রুত হেঁটে বাবার সাথে চলে এলো ভেতরে। ছাতা বন্ধ করে ছুটে গিয়ে ঘর থেকে গামছা নিয়ে এলেন হামিদুল হক। লম্বায় ছেলের থেকে দুয়েক ইঞ্চি খাটো হবেন হয়তো। হাত বাড়িয়ে সযত্নে মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “এতক্ষণ লাগে বাড়ি ফিরতে? আর এভাবেই বা কে ভিজে? বছরের প্রথম বৃষ্টি। অসুখ বিসুখ না বাঁধালেই হচ্ছে না?”

মুখশ্রীতে রাগ স্পষ্ট হলেও বাবার চোখে অগাধ স্নেহ। যা দৃষ্টি এড়ালো না শিথিলের। মুখ ভার হলো তার। সাফাই গাওয়ার ভঙিতে বললো,“ট্রেনে করে এসেছি। বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় জাংশনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েও থেকেছি। আমার কী দোষ? ছাতা কিনতে হলে সেই বাজারের ভেতরে যেতে হতো। ওভাবেও তো ভিজেই যেতাম।”

“তো বৃষ্টির মধ্যে আসতে গেলি কেনো?”

“তুমিই বা জেগে অপেক্ষা করছিলে কেনো?”

মিইয়ে গেলেন ভদ্রলোক। আমতা আমতা করে বললেন,“ঘরে যা। মাথা ভেজানোর আর প্রয়োজন নেই। পোশাক বদলে হাত-মুখ ধুয়ে আয়।”

“ভেবো না তোমার জন্য এসেছি। বুয়ার হাতের খিচুড়ি একদম জঘন্য। তাই খিচুড়ি খেতে এসেছি।”—যেতে যেতে বলে গেলো সে।

গাম্ভীর্য বিলীন হয়ে অধরে হাসি ফুটে ওঠল হামিদুল হকের। বাড়িতে কারেন্ট নেই। সাতটা নাগাদ চলে গিয়েছে। আজ রাতে আদৌ আসবে কিনা তাও সন্দেহ। ঝড়ের দিনে প্রায় প্রায়ই এমন হয়। তাই আগে থেকেই তিনি মোমবাতি সংগ্রহ করে রাখেন বাড়িতে। খাবার টেবিলে জ্বলতে থাকা মোমবাতি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তাই নতুন আরেকটি মোমবাতি জ্বালালেন। খাবার বেড়ে টেবিলে বসতেই পোশাক বদলে হাজির হলো শিথিল। খাবারে হাত দিয়েই টের পেলো, বেশ গরম! ব্যগ্ৰ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,“তুমি এতক্ষণ না খেয়ে বসে ছিলে, বাবা?”

গলা ঝেড়ে কাশলেন হামিদুল হক। ছেলের পাতে ডিম সহ গরম গরম আরেকটা ইলিশ মাছের টুকরো তুলে দিয়ে গমগমে কণ্ঠে বললেন,“বলেছি না, একা খেতে ভালো লাগে না।”

“তা লাগবে কেনো? তার আগে বলো, মোবাইলের যুগে ছেলেকে আজকাল চিঠি পাঠায় কে? বন্ধুরা ভাবছে, হবে হয়তো কোনো প্রেমিকা।”

“তুই যে একটা গর্দভ তা তোর বন্ধুরা জানে না?”

“আমার মতো স্মার্ট ছেলে ফ্রেন্ড সার্কেলে দ্বিতীয়টি নেই, বুঝলে?”

থামলো সে। কয়েক লোকমা খেয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,“যাকে দিয়ে চিঠি পাঠালে তাকে তো আমিই চিনি না। তুমি চিনলে কীভাবে?”

“সকালে বাজারে গিয়েছিলাম, তখন এক পরিচিতর সাথে দেখা। তারই ছেলে ও। কথা বলার এক পর্যায়ে তোর নাম বলতেই চিনে ফেলল। রাতে তোর হারুন চাচা আবার বোনের বাড়ি থেকে গরম গরম পিঠা নিয়ে এসেছিল। তোর তো আবার পিঠা খুব পছন্দ।”

“তা হারুন চাচা কোথায়?”

“কে জানে কই? সকাল থেকে পাচ্ছি না তাকে। যাক গে যেখানে ইচ্ছে।”

“তার মানে রান্না তুমি করেছো? বাহ, তোমার রান্নার হাতটা তো আগের থেকে বেশ ভালো হয়েছে! এতদিনে একটা হোটেল খুলে ফেললে রমরমা ব্যবসা চলতো।”

“তুই খোল গিয়ে।”

“টাকা দাও।”

“গাছে ধরে নাকি যে ছিঁড়ে দিবো?”

মুখ পাঁশুটে করল শিথিল। হামিদুল হক খেতে খেতে বললেন,“বিশ্ববিদ্যালয়ে তো তুই ভালোই জনপ্রিয়! কীভাবে কী? জুনিয়রদের র‍্যাগ দেস না তো আবার?”

“আমি খুবই ভালো এবং ভদ্র একটা ছেলে। এসবের ধারের কাছেও নেই। সত্যি বলতে, তুমি আমার যেই একটা নাম রেখেছো! বেশিরভাগ মানুষ এই ইউনিক নামের জন্যই আমায় চিনে। তা বলো এবার, পৃথিবীতে এতো নাম থাকতে এই নামটাই কেনো রেখেছিলে? ছাত্রীর প্রশ্ন।”

“তোর মা রেখেছিল। কেনো রেখেছিল জানি না। আর জানলেও হয়তো মনে নেই।”

খেতে খেতে মাথা নাড়ল শিথিল। বাবা-ছেলের গল্প আজ আর শেষ হওয়ার নয়। লেখাপড়া, টিউশনির চাপে সহজে বাড়ি ফেরা হয় না তার। শেষ বাবার সঙ্গে যেদিন খেতে বসেছিল সেদিন ছিল সম্ভবত ফাল্গুন মাস। তবে বাবা টিউশনির ব্যাপারটা তেমন জানেন না। ছেলে লেখাপড়ায় ব্যস্ত এতটুকুই জানেন শুধু। খাওয়া শেষে ছেলের দিকে ওষুধের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন হামিদুল হক,“নে, নাপা খা। বৃষ্টিতে ভিজলে তো তোর আবার জ্বর আসে।”

বাধ্য ছেলের মতো নাপা খেয়ে নিলো শিথিল। বাবার খুব বাধ্যগত ছেলে না হলেও অবাধ্য সে নয়। ছেলেবেলায় মা মারা যাওয়ায় তথাকথিত বাঙালি রাগী পিতা কেমন হয় তা সে জানে না। মায়ের শূন্য স্থান পূরণ করার যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন ভদ্রলোক। কিন্তু সেই চেষ্টায় কী আর সফল হওয়া যায়? মায়ের শূন্য স্থান পূরণ করা কী কারো পক্ষে সম্ভব? তবে মায়ের অভাব আবার অতটাবোধ করেনি শিথিল। বাবা হিসেবে হামিদুল হক যথেষ্ট দায়িত্বশীল। তার উপর তার একজন বড়ো বোনও তো আছে! যে এখন শ্বশুরবাড়িতে মনোযোগ দিয়ে সংসার করছে।
_________

শুক্রবার মানেই ভিন্ন কিছু। অন্যান্য দিনের তুলনায় এই দিনের ব্যস্ততা খানিকটা অন্যরকম। শেষ রাতে হালকা জ্বর এলেও সকালের নাস্তা শেষে ওষুধ সেবন করতেই শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠেছে শিথিলের। সারারাত বৃষ্টির পর সকালে ধরিত্রীতে নেমে এসেছে ঝলমলে রোদ। বিদ্যুৎও চলে এসেছে সেই ভোরেই। তারপর থেকে হাত-পা ছড়িয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় শুয়ে ব্যস্ত ভঙিতে টিভি দেখছে শিথিল।

সকাল সাড়ে আটটা। হারুন চাচা কোত্থেকে যেন একটি কলার কান্দা কাঁধে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলেন বাড়িতে। শিথিলকে দেখতেই দাঁত কেলিয়ে হাসলেন,“আরে শিথিল বাজান দেহি! আইলি কবে?”

“গতকাল রাতে। আপনি কোথায় ছিলেন?”—-শোয়া অবস্থাতেই জবাব দিলো শিথিল।

কাঁধ থেকে কলার কান্দাটা নামিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে রাখলেন হারুন চাচা। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসলেন,“বন্দান গেছিলাম। কাম আছিল একটা। তোর বাপে কই?”

“ বাজারে গেছে।”

“খাইছোস সকালে?”

“হ্যাঁ, গতকাল রাতে বাবা খিচুড়ি রান্না করেছিল। রান্না ঘরে এখনো আছে, একজনের হবে হয়তো।খিদে পেলে খেয়ে নিন গিয়ে।”

হারুন চাচা খেলেন না। বরং যেভাবে ঝড়ের গতিতে এসেছিলেন ঠিক সেভাবেই বসা থেকে উঠে চলে গেলেন কোথাও।

হামিদুল হকের ফিরতে ফিরতে বেলা দশটা বাজলো। বাজার থেকে গরুর কলিজা কিনে এনেছেন। ছেলের আবার খুবই পছন্দের। যখনি সে বাড়িতে আসে তখনি তার পছন্দের খাবারগুলো তৈরি করার চেষ্টা করেন তিনি। রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগ রেখে ছেলেকে ডাকলেন,“শিথিল! কোথায় গেলি?”

বিপরীত থেকে কোনো উত্তর এলো না। বাথরুম থেকে পানির ঝনঝন শব্দ আসছে। তাই সেদিকেই এগিয়ে গেলেন হামিদুল হক। চাপানো দরজা ঠেলে উঁকি দিতেই দু ভ্রুয়ের মাঝখানে ভাঁজ পড়ল। রুষ্ট কণ্ঠে বললেন,“এসব করতে কে বলেছে তোকে? নিউমোনিয়া হয়ে যাবে তো!”

হারুন চাচা যেতেই বাবার আলমারি থেকে অধৌত কাপড়গুলো এনে ভিজিয়েছিল শিথিল। বাথরুমে বসে এখন সেগুলোই ধুয়ে দিচ্ছে। পাঞ্জাবী কাচতে কাচতে বললো,“কতদিন ধরে কাপড় চোপড় ধোও না, বলো তো? এই সব পোশাক পরে ক্লাস নিতে গেলে স্টুডেন্টরা তো গন্ধের চোটে ক্লাস ছেড়েই পালিয়ে যাবে।”

“তোকে পাকনামি করতে বলেছি আমি? শরীর এখনো গরম। এর মধ্যে কাপড় কাচতে বসেছিস? মনে তো হয় না আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ফিরতে পারবি।”

“আমি ছাড়া কে করবে এসব? তোমার তো একটা বউও নেই।”

“আয় তোকে বিয়ে করিয়ে দেই। তোর বউ এসে করবে।”

“তা চাইলে দিতেই পারো। কিন্তু খরচা তোমার।”

“পছন্দের কেউ আছে?”

“না, নেই।”

“নেই?”—অবাক হলেন তিনি।

“না, আমি তো আরো তোমার আশায় বসে ছিলাম।”

“থাকবিই তো, গর্দভ কী আর এমনি এমনি বলি?”

নিঃশব্দে হাসলো শিথিল। হাত চালিয়ে কাপড়গুলো ধুয়ে বালতি নিয়ে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। ছাদে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল,“দুপুরে কী রাঁধবে?”

“সাদা ভাত, আলু দিয়ে গরুর কলিজার তরকারি আর মসুর ডাল।”

“আহা, শুনেই জিভে পানি চলে এসেছে!”

মুচকি হেসে রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন হামিদুল হক। ছাদের ঝকঝকে রোদে কাপড় মেলে দিয়ে এসে গোসল করে শিথিলও চলে এলো রান্নাঘরে। বাবা তখন কোমরে গামছা বেঁধে কলিজা ধুয়ে সিদ্ধ বসিয়েছেন। দীর্ঘ বছর স্ত্রী ছাড়া থাকায় রান্নাবান্নায় ভদ্রলোক ভীষণ পটু। ছেলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “কলার কান্দা কোত্থেকে এলো?”

“হারুন চাচা এনেছেন।”

“কোথায় সে? দেখলাম না তো।”

“কে জানে? হঠাৎ করে এলো, বসলো, কথা বললো তারপর আবার বেরিয়ে গেলো।”

“বয়সের সাথে সাথে ওর মাথায় মনে হয় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। সময় থাকতে থাকতেই বলেছিলাম, বিয়ে করে সংসার কর হারুন। তা না করে আমার সাথেই থেকে গেলো। আহাম্মক একটা।”

পেঁয়াজ, মরিচ কাটা শেষ করে আলু ছিঁলতে লাগলো শিথিল। কাটাকাটি, টুকটাক রান্নাবান্না সেও ভালোই পারে। মা না থাকায় বাবা আর বড়ো বোনের সাথে থেকে থেকে সেসব শিখেছে।

রাঁধতে রাঁধতে পুনরায় হামিদুল হক বললেন, “সুহাসিনীর সাথে দেখা করতে যাস না কতদিন?”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য হাত থেমে গেলো শিথিলের। ঘাড় ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকালো। চুলার তাপে ফর্সা মুখে ঘাম জমেছে।ললাট থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম কপোল বেয়ে দাড়িতে গিয়ে মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। বয়স পঞ্চাশের উপরে হলেও ভদ্রলোক তাগড়া যুবকের মতো এখনো মাথা তুলে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করেন। চোখেমুখে সর্বদা আঠার মতো লেগে থাকে গাম্ভীর্য। ছেলের থেকে আশানুরূপ কোনো জবাব না পেয়ে হামিদুল হক নিজ থেকেই বললেন, “ওর শাশুড়ি কিছু বলেছে?”

“না, কী বলবে?”—-দীর্ঘশ্বাস আড়াল করল শিথিল।

“বাপের সামনে মিথ্যা কথা?”

“বাদ দাও তো, বাবা।”

“কে কী বললো তা গায়ে মাখতে নেই।”

“তুমিই তো বলেছিলে, অপমানিত স্থানে দ্বিতীয়বার যেতে নেই।”

থতমত খেয়ে গেলেন হামিদুল হক। ধোঁয়ার সাথে উড়িয়ে দিলেন দীর্ঘশ্বাস। উদাস কণ্ঠে বললেন, “আপনজনদের ক্ষেত্রে এই নীতি মানতে নেই। যতই হোক, তোর বড়ো বোন হয়। তোর জন্য সর্বক্ষণ চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকে। মিথিনও সেদিন ফোনে জিজ্ঞেস করছিল, মামা কই? মামা আসে না কেনো? তাই এখান থেকে ফিরেই সময় করে বোন আর ভাগ্নের সাথে দেখা করবি। বুঝেছিস?”

হ্যাঁ, না কিছুই বললো না শিথিল। বাবা যখন বলেছেন তার মানে তাকে যেতেই হবে। হামিদুল হক পুনরায় বললেন,“ইদানিং নাকি খালার ফোন ধরছিস না? গত মাসে যেতে বলার পরেও যাসনি। সমস্যা কী?”

“নিজের খালা তো আর নয়। তাছাড়া অত বড়লোক মানুষ আমার পোষায় না।”

এবার শান্তশিষ্ট লোকটার মেজাজ চটে গেলো।কড়াইয়ে ঢাকনা দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের পানে চাইলেন,“তোর মায়ের আপন খালাতো বোন। খালার চেয়ে কম কীসে? তোকে নিজের ছেলের মতো ভাবে। তাই আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত নয়। তোর মা মারা যাওয়ার পর ওই এক খালা আর নানীই আমাদের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল। তোর নিজের মামারা তো তখন ফিরেও তাকায়নি।”

থেমে একটু সময় নিলেন। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,“আজ থাকবি?”

“না, পরশু পরীক্ষা আছে।”

“পরীক্ষা নাকি রিটেক খাওয়া সাবজেক্টে পাস মার্ক উঠাতে যাবি?”

চমকে গেলো শিথিল। বিস্ফোরিত নেত্রে পিতার পানে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,“জানলে কীভাবে?”

“কারণ আমি তোর বাপ।”

“স্বাধীন বলেছে নিশ্চয়ই?”

“ও আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।”

হতাশ হলো শিথিল। ছেলেটা তার জীবন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাচ্ছে। হামিদুল হক বললেন,“বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়েছি, টিউশন পড়িয়ে অর্থ রোজগারের জন্য নয়। মন দিয়ে লেখাপড়া কর। আমি এখনো বেঁচে আছি।”

“সবাই পড়ায়।”

“তোর মতো এতো পড়ায় না। সত্যি করে বল, কয়টা পড়াস?”

“উম আগে ছিল পাঁচটা। এই মাসে নতুন আরেকটা শুরু করেছি তাই মোট ছয়টা।”

“কিহ!”—কণ্ঠে রাগ ঝরে পড়ল যেন।

“রিটায়ার্ড করবে কবে?”

“যেদিন লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি পাবি।”

পুনরায় বললেন,“এই মাস শেষ হলে সব টিউশন ছেড়ে দিবি।”

“টিউশনি করালে পুরোনো পড়াগুলো অনুশীলন হয়, বাবা। আর তাছাড়া একেকটা টিউশনি সপ্তাহে তিনদিন করে পড়াই।”

“তাহলে দুইটা রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দিস। অযথা লেখাপড়ার ক্ষতি করিস না। ভবিষ্যতে যেন আফসোস করতে না হয়।”

কথা বাড়ালো না শিথিল। চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে বাধ্য ছেলের মতো মেনে নেওয়ার ভং ধরলো। সত্যি বলতে তো সেসব ও ছাড়বে না।

রান্নাবান্না শেষ হতে হতে যোহরের আজান পড়ে গেলো। শুক্রবারের আজান অন্যদিনের তুলনায় একটু আগে আগেই হয়। গোসল আগে করায় পাজামা, পাঞ্জাবী পরে তৈরি হয়ে হাতে টুপি নিয়ে সোফায় বাবার অপেক্ষায় বসে রইল শিথিল। হামিদুল হক ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ঠিক দশ মিনিট পর। উনি আসতেই আতরের তেজি ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। পরনের নতুন পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করে ছেলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,“এবারের পাঞ্জাবীর ফিটিংটা একেবারে পারফেক্ট হয়েছে। তোর পছন্দ ভালো।”

এ মাসের টিউশনির টাকা দিয়ে বাবার জন্য পাঞ্জাবীটা কিনেছিল শিথিল। কিন্তু বাড়িতে না আসার কারণে তৎক্ষণাৎ দেওয়াও হয়নি। তাই গতকাল রাতে ফেরার পথে সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল। আর সকালে রেখে এসেছিল বাবার ঘরের বিছানায়। ভেতরে ভেতরে আনন্দে ফেটে পড়লেও বাইরে প্রকাশ করল না তা। তালা, চাবি হাতে নিয়ে তাড়া দিলো, “চলো এবার। দেরি হলে কিন্তু ছাদে গিয়ে বসতে হবে।”

হামিদুল হকও নিজের উত্তেজনা ছেলের সম্মুখে প্রকাশ করলেন না। গাম্ভীর্যের আদলেই বাইরেটা শক্ত রেখে ছেলেকে নিয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলেন। এদের বাবা-ছেলের সম্পর্কটা বরাবরই এমন। ভালোবাসা অনেক কিন্তু একে অপরের কাছে প্রকাশ করতে যেন অনিচ্ছুক।

খুতবা শেষে জুম্মার নামাজ আদায় করে দুজনেই মসজিদ থেকে বের হলো। গাজীপুর সদরে হামিদুল হক মোটামুটি পরিচিত, সম্মানিত এবং নিতান্তই ভালো একজন ব্যক্তি। বিভিন্ন স্কুল, কলেজের শিক্ষক থেকে শুরু করে দোকানদার, রিক্সাওয়ালা,পথচারী সবাই উনাকে চিনে। তার উপর চাকরিরত কলেজের ছাত্রীরা তো আছেই। সবার ক্ষেত্রেই ভদ্রলোকের ব্যবহার খুবই নমনীয়।

শিথিলের মায়ের কবরটা হাড়িনালে হামিদুল হকের পারিবারিক কবরস্থানে। প্রতি শুক্রবারে হামিদুল হক সেখানে যান। প্রথমে বাবা-মা তারপর স্ত্রীর কবর সময় নিয়ে জিয়ারত করে বাড়ি ফিরেন। তবে আজকের শুক্রবারটা অন্যান্য দিনের তুলনায় ভিন্ন। কারণ সঙ্গে আজ উনার ছেলে রয়েছে। তাই একা একা যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

জুম্মা শেষে ছেলেকে নিয়ে অত দূরেই গেলেন তিনি। কবর জিয়ারত করতে করতে বাড়ি ফিরতে দেরি হলো দুজনার। গেইট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই দেখা মিললো সদর দরজার সামনে বসে থাকা হারুন চাচার।স্বভাবসুলভ ভদ্রলোক হাসলেন।

তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল শিথিল। হামিদুল হক দুহাত পেছনে রেখে গুরুগম্ভীর মুখে শুধালেন,“রাত থেকে কোথায় ছিলি?”

“বন্দান গেছিলাম।”

“কেনো?”

“চাচতো ভাইয়ের মাইয়া জামাই মইরা গেছে। সকালে জানাজা পইড়া মাডি দিয়া আইছি।”

“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। কলাও কী ওখান থেকে এনেছিস?”

“হ, একেবারে দেশী কলা।”

“নামাজ পড়িসনি কেনো?”

“পড়ছি।”

“আবার মিথ্যা বলছিস? তুই তো গোসলই করিসনি।”

“হাছা কথা, ভাইজান। মসজিদেই গোসল করছি।”

“আচ্ছা ভেতরে আয়, ক্ষুধা লেগেছে।”
_______

দুপুরে খাওয়ার পর বিশ্রাম নিলো শিথিল। আছরের নামাজ আদায় করে বাবার সঙ্গে বসে চা খেলো। এরপর সন্ধ্যাবেলা বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে রওনা দিলো।
ঝলমলে রোদ বিলীন হয়ে ততক্ষণে নীলাম্বরে পুনরায় ছাই রঙা মেঘের দেখা মিলেছে। প্রকৃতি হয়ে উঠেছে গুমোট। যেন আবারো ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামবে!

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)