মেঘমেদুর দিনে পর্ব-০৩

0
47

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৩]

আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ক্ষণে ক্ষণে দূর আকাশ থেকে ভেসে আসছে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ। সাথে বইছে মৃদু ঠান্ডা বাতাস। তখন প্রায় রাত। দিনের আলো বিলীন হয়ে পথেঘাটে জ্বলে উঠেছে কৃত্রিম সব বৈদ্যুতিক আলো। রাস্তার এখানে সেখানে জমে থাকা ভোরের বৃষ্টির পানি এখনো শুকায়নি। তার মধ্যেই রাতের বৃষ্টির আয়োজন শুরু করে দিয়েছে প্রকৃতি।

পথেঘাটে যানবাহনের বিশাল জ্যাম। গাজীপুর শিববাড়ি থেকে মহাখালী পৌঁছাতে পৌঁছাতে লেগে গিয়েছে ঘণ্টা দেড়েকেরও বেশি। বিকেলের ট্রেন মিস করায় যাতায়াতের জন্য শেষ অপশন হিসেবে বাসকেই বেছে নিয়েছিল শিথিল। কিন্তু শেষমেশ জ্যামে আটকে গিয়ে সময় নষ্ট হলো তার। ড্রাইভার লোকটা সম্ভবত আজ সোজা পথ ছেড়ে ধরেছে অন্য পথ। লোকাল বাসের এই এক সমস্যা! যখন তখন, যেখানে সেখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠাতে গিয়ে জ্যাম বাঁধায়। সিট খালি না থাকলেও ভেতরে মানুষ দিয়ে বোঝাই করে। একজন আরেকজনের গায়ে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! কত বড়ো বোকা হলে শুক্রবারের মতো শান্তিপ্রিয় সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও মানুষ এভাবে বাসে ঝুলে যাতায়াত করে? ভেবে পায় না সে।

জ্যামে বিরক্ত হয়ে একসময় বেশ কয়েকজন নেমে পড়ল মাঝরাস্তায়। এয়ারপোর্ট, তেজগাঁও পেরোতে পেরোতে ভিড় কমতে লাগলো বাসের। এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শিথিল। রাত তখন সাড়ে আটটা। আরো কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেই পুরোপুরি খালি হয়ে গেলো বাস।

গৌঢ় হেল্পার বাসের পিঠে জোরে জোরে আঘাত মেরে ভেতরে উপস্থিত যাত্রী দুজনের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত স্বরে বলে উঠল,“গাড়ি আর সামনে যাইবো না। নাইম্মা পড়েন আপনেরা।”

ললাটে ভাঁজ পড়ল শিথিলের। গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “উঠানোর সময় তো বলেছিলে গুলিস্তান পর্যন্ত যাবে। তাহলে এখন আর যাবে না কেনো?”

হেল্পার ছেলেটার কণ্ঠস্বরে বিনয় দেখা গেলো,“গাড়ি একেবারে খালি হইয়া গেছে, ভাই। আকাশের অবস্থাও ভালা না। এই দুইজন যাত্রী লইয়া অতদূর গেলে লস হইয়া যাইবো। একটু ম্যানেজ কইরা লন। নাইম্মা সামনে একটু হাঁটা দিলেই গাড়ি পাইয়া যাইবেন।”

অন্য সময় হলে আচ্ছা মতো হেল্পারকে সাইজ করে দিতো শিথিল। কিন্তু আজ আর বিপরীতে কিছু বললো না। ঢাকা শহর হিসেবে এখন সন্ধ্যা। তাই ঘরে ফেরার অত তাড়া নেই। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নেমে যাওয়ার জন্য এগিয়েও থেমে দাঁড়াল শিথিল।পিছু ফিরে চাইলো। ডান পাশের একটি সিটে দু হাতে ব্যাগ আঁকড়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে একটি নববধূ রূপী মেয়ে। মাস্কের আদলে মুখ ঢাকা। কথা বলার সময় হেল্পার ছেলেটার দৃষ্টি ঘুরেফিরে বারবার ওদিকে গিয়েই স্থির হচ্ছিল তা বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করেছে শিথিল। সে বুদ্ধিমান, প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ। দীর্ঘদিন রাজধানীতে বাস করায় অমন দৃষ্টি, ফাঁকা বাসে একা একটা মেয়ে থাকার ফল তার অজানা নয়। বিরক্ত কণ্ঠে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললো,“শুনেননি, বাস আর সামনে যাবে না? যেখান থেকে এসেছি সেদিকেই আবার ফিরে যাবে, নামুন।”

“ভাই, আপনের পরিচিত?”—-হেল্পার প্রশ্ন করল।

প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না শিথিল। ললাটে উদিত বিরক্তির ভাঁজ এখনো কাটেনি। গম্ভীর কণ্ঠেই অধিকারের স্বরে বললো,“কী হলো?”

মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। নামবে কী নামবে না বুঝতে পারছিল না যেন। চোখে তার অগাধ ভয়। শেষ কথাটায় খানিকটা কেঁপে উঠল। পাশ কাটিয়ে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। তার পিছুপিছু শিথিলও নামলো। হাঁটতে গিয়েও আবার কিছু একটা ভেবে পিছু ফিরে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললো,“রাতের বেলা মেয়ে মানুষ একা একা যানবাহনে কখনো চলাচল করবেন না। যখনি দেখতে পাবেন গাড়িতে ভিড় কমে যাচ্ছে ঠিক তখনি চুপচাপ নেমে পড়বেন। সবার আগে নিজের নিরাপত্তা।”

নিজের কথা শেষ করে সে সামনের পথ ধরে হাঁটা ধরলো। এখান থেকে সোজা সিএনজি নিবে। এই মুহূর্তে বাসে চড়া আর সম্ভব নয়। শরীর ব্যথা করছে। জ্বর জ্বর ভাবটা কাটলেও দুর্বল লাগছে খুব।

“এই যে, ভাইয়া! শুনছেন? ভাইয়া!”

চারিদিকে পথচারীদের কোলাহল। মৃদু বাতাসের সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।যেকোনো মুহূর্তে তা বিশাল আকার ধারণ করতে পারে। একই ডাক! ধীরে ধীরে প্রখর হতে লাগলো। শ্রবণালী পর্যন্ত মেয়েলি রিনরিনে কণ্ঠস্বর পৌঁছাতেই হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরে চাইলো শিথিল। বাসের সেই মেয়েটি! হ্যাঁ, সেই মেয়েটিই তো! তার পিছুপিছু আসছে। হাত নাড়িয়ে ডাকছে। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। মেয়েটি বড়ো বড়ো কদম ফেলে এগিয়ে এসে দাঁড়াল তার সম্মুখে। চঞ্চল কণ্ঠে বলে উঠল,“আপনাকে অনেকক্ষণ ধরে ডাকছিলাম।”

“কী প্রয়োজনে?”

“আপনি ঢাকার সব জায়গা চিনেন?”

“মোটামুটি।”

চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল যেন মেয়েটার। দ্রুত ব্যাগ থেকে একটি কাগজ বের করে ধরলো শিথিলের সামনে। ভড়কে গেলো শিথিল। কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো। মাথায় চলে এলো আজেবাজে সব চিন্তা। দিনকাল ভালো নয়। এভাবেই তো আজকাল কাগজে অজ্ঞান করার ওষুধ বা নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে ভিড়ের মধ্যে অপহরণ করা হচ্ছে মানুষ।এই মেয়েটিও সেসব দলের নয় তো? তাকেও কী অপহরণ করার ফন্দি এঁটেছে? চোখেমুখে উপচে পড়া কৌতূহল আর সন্দেহ নিয়েই অপ্রস্তুত ভঙিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল,“সমস্যা কী? কী চাই?”

“এই ঠিকানাটা কোথায় বলতে পারবেন? আমি ভালো করে কিছু চিনি না। বাসে ওঠার সময় হেল্পার বলেছিল ঠিকানায় এলে নামিয়ে দিবে। কিন্তু বাকিটা তো আপনি দেখলেনই। যদি একটু সাহায্য করতেন?”

আপাদমস্তক মেয়েটিকে দেখলো শিথিল। পরনে লাল রঙের বেনারসি। দু হাতে জ্বলজ্বল করছে সোনার চিকন বালা। মাথায় লাল রঙেরই বাঁধা একটি হিজাব। চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছেনা তার। শুধু চোখ দেখে আবার মানুষ চিনতে শিথিল পারে না। বিরক্তি নিয়েই বললো,“দেখতে পারবো না, মুখে বলুন। কোন এলাকা?”

“বেইলী রোড।”

“কত নাম্বার রোড?”

“তা তো জানি না তবে ভিকারুননিসা কলেজের কাছাকাছি বোধহয়।”

“শান্তিনগর? খুব ভালো করেই চিনি।”

“একটু যদি পৌঁছে দিতেন?”

“ওদিক থেকে বাস আসবে। হাত নাড়িয়ে থামিয়ে বলবেন, শান্তিনগর যাবো। নামিয়ে দিবে।”

আঙুল তাক করে দেখালো। তারপর আর কথা বাড়ালো না শিথিল। মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে এমনিতেই তার ভেতরে বিরক্তি আর জড়তা কাজ করে। তার উপর সাহায্য! কস্মিনকালেও করবে না। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর যখন ঢাকা শহরে এসে থাকা শুরু করেছিল তখনি অনেক শিক্ষা পেয়েছে। আর শিক্ষা পেতে সে চায় না।

কিন্তু মেয়েটি তাকে ছাড়লো না। হাঁটতে লাগলো পিছু পিছু। শিথিল তা খেয়াল করল। দু হাত পকেটে গুঁজে হাঁটতে হাঁটতে বললো,“আমি ফার্মগেটে থাকি। এখন সেখানেই যাবো। এই রাতের বেলা আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছি। আরো পথ যেতে হবে। তাই আমার উপর কোনো আশা রাখবেন না। রাস্তায় অনেক মানুষ আছে তাদের বলুন।”

আশাহত হলো মেয়েটি।নিখুঁতভাবে চোখের মণি ঘুরিয়ে দেখে নিলো আশপাশ। সকলকেই ব্যস্ত দেখাচ্ছে। যে যার মতো দ্রুত হেঁটে চলেছে নিজস্ব গন্তব্যে। কাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করবে সে? বাসে ওভাবে কথা বলায়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে জ্ঞান দেওয়ায় ছেলেটাকে নেহাৎ ভালো মানুষ বলেই মনে হয়েছিল। তাই না হয় একটু সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু!

হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামলো শহরে। পথচারীরা কেউ কেউ ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মাথা ঢেকে দ্রুত পথ চলতে লাগলো।কেউ বা উঠে পড়ল চলন্ত গাড়িতে। মুখ দিয়ে চ বর্গীয় শব্দ করে একটি দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়ল শিথিল। আসার পথে বাবা বারবার বলেছিলেন,“ছাতাটা নিয়ে যা গর্দভ। নইলে পথিমধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে আবার কাল রাতের মতো ভিজতে হবে।”

অথচ শিথিল সে কথা শোনেনি। উফ কি মহাঝামেলা! বেঞ্চে ব্যাগটা রেখে দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরালো শিথিল।টুকটাক ধূমপান করার অভ্যাস আবার তার আছে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ধরেছিল কোনো এক দিন। সেই দিন ক্ষণ ঠিকঠাক মনে নেই তার। দোকানের বাইরে মুখ ফিরিয়ে বাতাসের সাথে ধোঁয়া মিশিয়ে দিয়ে পাশে তাকাতেই চমকে উঠল। সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে! চোখাচোখি হলো দুজনার। মেয়েটি মিনমিনে স্বরে সাফাই গাইলো,“বৃষ্টি পড়ছে তাই দাঁড়িয়েছি।”

শিথিল বুঝলো, মেয়েটা তার পিছু আজ ছাড়বে না। নিশ্চয়ই খারাপ কোনো মতলব আছে! তবে তার এই ভাবনাকে আবার হারিয়ে দিতে চাইছে মন। কড়া কণ্ঠে বলতে চাইছে,“কারো সম্বন্ধে সঠিক না জেনে খারাপ ধারণা করা অন্যায়। মারাত্মক অন্যায়।”

জ্বলন্ত সিগারেটটা আর ফুঁকতে ইচ্ছে হলো না। নেহাৎ ভদ্রতার খাতিরে। রাস্তায় ছুঁড়ে মারতেই বৃষ্টির পানিতে নিভে চুপসে গেলো তা।কি মনে করে যেন পুনরায় ফিরে তাকালো মেয়েটার দিকে। বেচারাকে ভীষণ দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছে। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,“নাম কী?”

“হু?”—-বিস্ময় খেলে গেলো মেয়েটির মুখশ্রীতে।

শিথিল দ্বিতীয়বার প্রশ্নটি করল না। মুখ ফিরিয়ে বাইরে চাইলো। মেয়েটি ঢোক গিললো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কিছু। মিনমিনে স্বরে উত্তর এলো খানিক বাদে,“আবৃত্তি।”

“রাস্তাঘাট না চিনলে এই রাতের বেলা একা বেরিয়ে এসেছেন কেনো?”

এবার আর উত্তর দিলো না। চোরা দৃষ্টিতে আশপাশ দেখতে লাগলো। যেন অপরিচিত মানুষের সামনে সত্যি বলতে অনিচ্ছুক সে। শিথিল জিজ্ঞেস করতে চাইলো,“বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন?”

কিন্তু করল না। প্রশ্নটা ঠোঁটের ডগায় এসে আটকে গেলো। কিছু একটা ভাবলো। মেয়েটিকে কী এই মুহূর্তে সাহায্য করা উচিত? ভেতর থেকে হঠাৎ করেই যেন পরোপকারী আত্মাটা বেরিয়ে আসতে চাইলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে শ্বাস ফেলে বললো,“আমি ফার্মগেট পর্যন্ত যাবো। মগবাজার পেরিয়ে যেতে হবে। ওখান থেকে আপনার ঠিকানায় যেতে দশ পনেরো মিনিট লাগবে সম্ভবত। ওইটুকু পথ চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন। এরপর নিজের পথ নিজে ধরবেন।”

জ্বলজ্বল করে উঠল মেয়েটির চাহনি। বুক থেকে ভারটা কমলো। ছোট্ট করে জবাব দিলো,“আচ্ছা।”

“আকাশের অবস্থা ভালো নয়। কখন বৃষ্টি থামবে তাও বলা যাচ্ছে না। তার উপর একা একটা মেয়ে মানুষ তাই বিশ্বাস করে সাহায্য করছি। মনে অন্য চিন্তা থাকলে ঝেড়ে ফেলুন। আমি কিন্তু ভালো মারপিট করতে পারি।”

“অন্য চিন্তা মানে?”—-বোকা চাহনিতে দৃষ্টি মেলালো আবৃত্তি।

“কিছু না, চলুন।”

বৃষ্টি মাথায় নিয়েই এগিয়ে গিয়ে একটা সিএনজি ঠিক করে মেয়েটিকে নিয়ে উঠে পড়ল শিথিল।
__________

রাত এগারোটা বেজে আটত্রিশ মিনিট। বর্ষণ থেমে গেলেও ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ধূ ধূ মরুর প্রান্তের মতো নিস্তব্ধ পরিবেশ। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চারিদিক সুস্পষ্ট। দু হাতে শাড়ি উঁচিয়ে ধরে স্যাঁতস্যাঁতে কর্দমাক্ত রাস্তা পেরিয়ে নির্দিষ্ট ভবনের সামনে এসে দাঁড়াল আবৃত্তি। কথামতো শিথিল তাকে মগবাজারেই নামিয়ে দিয়েছিল। সাথে অবশ্য একটি রিক্সা ঠিক করে উঠিয়েও দিয়েছিল তাতে। তারপর দুজনার গন্তব্য হয়েছে আলাদা।

রিক্সাওয়ালা ভদ্রলোক সম্ভবত এলাকায় নতুন।নিজেও সঠিক ঠিকানা সম্পর্কে অবগত নন। তাই তো দশ, পনেরো মিনিটের রাস্তায় পরপর দুইবার ভুল করে লাগিয়ে দিয়েছেন আধা ঘণ্টা। এরপর আবার বাড়ি খুঁজে পেতে পেতে আরো দেরি হয়ে গিয়েছে আবৃত্তির। এই মুহূর্তে পা-টা খুব ব্যথা করছে। এতোটা পথ সে কখনো হাঁটেনি। এমনকি সেজো মামার এই বাড়িতেও তেমন একটা আশা হয়নি। শেষ যেদিন এসেছিল তখন তার বয়স নয়-দশ হবে হয়তো।

মাস শেষে ভাগ বাটোয়ারা করে খালার কাছে তার জন্য দেড় দুই হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েই দায়িত্ব থেকে পিঠ বাঁচিয়ে নেন মামারা। তাই সঠিক ঠিকানা সম্পর্কে তার না জানাটাই স্বাভাবিক। বদ্ধ গেইটের অদূরে মধ্য বয়স্ক দারোয়ান তখন দেয়ালের কাছে পেতে রাখা ছোট্ট চকিতে শুয়ে নাক ডেকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন।

হঠাৎ করাঘাতের শব্দ হলো। তাতেই ঘুম ছুটে গেলো উনার। বুকে কয়েক দলা থুথু ছিটিয়ে লাঠি হাতে বদ্ধ গেইটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলেন। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় অপরিচিত মেয়েটিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“কাকে চাই?”

আবৃত্তির চোখেমুখে আতঙ্ক, ভয়। মাথায় টানা ঘুমটাটা বাতাসের তালে তালে নড়ছে। আতঙ্কিত স্বরেই জবাব এলো,“এটা মোজাম্মেল হোসেনের বাড়ি?”

“হ্যাঁ, কেনো কী দরকার? যা দরকার কাল এসে মিটিয়ে নিবেন। এগারোটার পর গেইট খোলা নিষেধ।”

“আমি আবৃত্তি। মোজাম্মেল হক আমার সেজো মামা। অনেক দূর থেকে এসেছি। প্লিজ গেইটটা খুলুন।”

নিজ স্থান থেকে এক পাও নড়লেন না দারোয়ান। মনে তীব্র সন্দেহ নিয়ে ত্যাছড়াভাবে বললেন,“পারবো না। স্যারকে ফোন করে অনুমতি নেন।”

গলা শুকিয়ে এলো আবৃত্তির। বা হাতের উল্টো পিঠে কপালের ঘাম মুছে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো। ফোন করে অনুমতি নিবে? কীভাবে? নিজস্ব কোনো মোবাইল তার নেই। প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে খালার মোবাইলটা ব্যবহার করতো। হতাশ দৃষ্টিতে আকাশপানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চাঁদ, তারা কোনো কিছুর অস্তিত্বই আজ সেখানে নেই। কালো মেঘের আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে বেরিয়ে আসছে প্রাকৃতিক আলোকরশ্মি‌। সন্ধ্যার মতোই যেকোনো মুহূর্তে রাতেও ঝুমঝুম বৃষ্টি নামতে পারে। অনুনয় করে দারোয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,“সেই মহাখালী থেকে এখানে এসেছি। অনেক রাত হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। এই সময় আমি কোথায় যাবো? এখানে আমার মামা ছাড়া আর কোথাও কোনো পরিচিত কেউ নেই। আপনি একবার ফোন করুন না উনাকে। আবৃত্তি এসেছে বললেই ঠিক চিনতে পারবেন।”

চোখেমুখে বিরক্তি ঝুলিয়ে কিছুক্ষণ নিরব রইলেন ভদ্রলোক। দিনকাল ভালো না। শহরের বিভিন্ন দালানে পরিচয় গোপন করে কত খারাপ মানুষ ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে। কেউ কেউ সফল হয়ে ক্ষতিও করে বসে। এমনটা আজকাল অহরহ ঘটছে। তাই তিনি সতর্ক রইলেন। পকেট থেকে নিজের পুরোনো মডেলের বাটন মোবাইলটা বের করে কারো নাম্বারে কল দিয়ে দূরে সরে গেলেন।ফোনে হওয়া কথোপকথন আবৃত্তির শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো না। তাই নিভৃতে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিজ স্থানে।

এভাবেই মিনিট দশেক পেরোলো। নিস্তব্ধ নিশিথে হঠাৎ কারোর পায়ের ভারি আওয়াজ শোনা গেলো। আবছা আলো পেরিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ। ভারিক্কি, বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন,“এতো রাতে ফোন দিয়ে বিরক্ত করার মানে কী, আজিজ? তোমায় বলেছি না, এগারোটার পর কেউ এলে গেইট খুলবে না।”

দারোয়ান কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে জবাব দিলেন,“বললো তো আপনার ভাগ্নি হয়।”

কণ্ঠস্বর শুনে ভদ্রলোককে চিনতে অসুবিধা হলো না আবৃত্তির। এটাই তার সেজো মামা! মুহূর্তেই মুখশ্রী আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মনের ভেতরে জমে থাকা সকল ভয়, ডর নিরাময় হলো। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল,“সেজো মামা!”

এই মাঝরাতে কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় ভীষণ বিরক্ত মোজাম্মেল হোসেন। তার উপর দারোয়ান আজিজের এহেন জবাবে উনার বিরক্তি কণ্ঠস্বর পেরিয়ে ললাটেও উদিত হলো। মুখ বাঁকিয়ে গেইটের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে রুক্ষ কণ্ঠে বললেন,“এই রাতবিরেতে আমার ভাগ্নি কোত্থেকে আসবে?”

মুখের কথা শেষ করতে না করতেই দৃষ্টিতে বিস্ময় জমা হলো উনার। মেয়েটিকে দেখে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে উঠলেন,“আবৃত্তি!”

মালিকের বিব্রতকর কণ্ঠস্বরে ব্যাপারটা সহজেই বুঝতে পেরে গেলেন আজিজ। দৌড়ে এসে পকেট গেইটটা খুলে দূরে সরে দাঁড়ালেন। মোজাম্মেল হোসেন বাইরে মাথা বের করে উঁকিঝুঁকি মেরে চারিদিকে নজর ঘুরালেন। জিজ্ঞেস করলেন,“এতো রাতে তুই এখানে? আপা কই?”

পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল আবৃত্তি। বিভ্রান্ত দেখালো তাকে। মিনমিনে স্বরে প্রত্যুত্তর করল,“আমি একা এসেছি।”

বিস্ময়ের প্রভাবে তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারলেন না তিনি।হুঁশ ফিরতেই আজিজকে গেইট আটকে ঘুমানোর নির্দেশ দিয়ে ভাগ্নিকে নিয়ে চলে গেলেন উপর তলায়। নিজস্ব ফ্ল্যাটে।

ড্রয়িং রুমে টিমটিমে হলদে আলো জ্বলছে। ঘর থেকে ভেসে আসছে কারো নাক ডাকার বিদঘুটে আওয়াজ। সোফায় বসে মুষ্টিবদ্ধ হাতে থুতনি ঠেকিয়ে ঘুমে টলছে শাহিনূর। সদর দরজায় লাগানো ক্রিস্টাল ঝুনঝুনির শব্দে হঠাৎ করেই ঘুম ছুটে গেলো উনার। লাফিয়ে উঠে সোজা হয়ে বসলেন। সম্মুখে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নববধূ রূপী কিশোরীকে। কণ্ঠে বিস্ময় নিয়ে উচ্চারণ করলেন,“আবৃত্তি!”

মোজাম্মেল হক এগিয়ে গিয়ে ল্যাম্প নিভিয়ে বৈদ্যুতিক সাদা লাইটটা জ্বেলে সোফায় বসে পড়লেন। হাত নাড়িয়ে ভাগ্নিকে ডাকলেন,“এখানে এসে বোস।”

মামার কথায় বাধ্য মেয়ের মতো ধীর গতিতে এগিয়ে সোফায় বসলো আবৃত্তি। সঙ্গে আনা কাপড়ের ব্যাগটি রাখলো মেঝেতে। শাহিনূর প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“এতো রাতে তুমি এখানে?”

ভয়ে জড়সড় হয়ে চুপচাপ বসে রইলো আবৃত্তি। কী উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারলো না। মামীদেরকে সে বরাবরই কিছুটা ভয় পায়। এখনো তাই পাচ্ছে। কিন্তু তার নিরবতায় শাহিনূর দমলেন না। মেয়েটিকে উপর নিচ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “তোমার পোশাকের এই অবস্থা কেনো? কার বিয়ে ছিলো আজ? আর, আর এই বেনারসি?”

এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলো না মেয়েটি। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বা হাতে মুঠো করে আঁকড়ে ধরলো পরনের শাড়িটি। মোজাম্মেল হোসেন আর স্ত্রী শাহিনূর আরো একদফা চমকে গেলেন। এই মেয়ে কাঁদছে কেনো হঠাৎ? কয়েক সেকেন্ড নিরবতার পর এ বিষয়ে মোজাম্মেল হোসেনই প্রশ্ন করলেন, “কাঁদছিস কেনো? কী হয়েছে? আমাদের বল। তুই একা একা এতোটা পথ কীভাবে এলি? আপা কিছু বলেছে?”

নাক টেনে এবার প্রত্যুত্তর করল আবৃত্তি,“আমি ওখান থেকে পালিয়ে এসেছি, মামা।”

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)