মেঘমেদুর দিনে পর্ব-০৪

0
52

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৪]

“এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন,
কাছে যাবো কবে পাবো, ওগো তোমার নিমন্ত্রণ….

বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। চুলার উপর বসানো ক্যাটলিতে ফুটন্ত চায়ের পানি। দু রুমের ছোট্ট বসার ঘরে পুরোনো আমলের আধ ভাঙা ক্যাসেটে হাই ভলিউমে গান ছেড়ে গুনগুন করছে ইমন। গানের গলা তার ভালো। বিশেষ করে বাংলা গান গাইতে গেলে শরীরে কোত্থেকে যেন একটা জোশ খেলে যায়।

কিছুটা দূরে উদোম গায়ে বিন ব্যাগের উপর বসে গেম খেলছে তৌসিফ। অনলাইন গেমের সুবাদে ওখানেও বেশ কতক বন্ধু জোগাড় হয়েছে তার। মাঝেমধ্যে রাত নেই, দিন নেই হঠাৎ করেই সে চেঁচিয়ে ওঠে,“রিভাইব দে, রিভাইব দে!”

ঘর থেকে বেরিয়ে তাকে এমন অবস্থায় দেখে ভ্রু দ্বয় কুঁচকে নিলো শিথিল। মাথায় চাটি মারলো জোরে। বললো,“আধ ল্যাংটা হয়ে বসে আছিস কেনো, বলদ?”

তৌসিফ কিছু বললো না। বাম হাতের তালুতে ব্যথাতুর স্থান ঘষে খেলায় মন দিলো পুনরায়। দুই হাতে বিস্কুটসহ দুটো চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হলো ইমন। ঠোঁটের ডগার গুনগুন এখনো থামেনি। শিথিল বিরক্ত হলো। জিজ্ঞেস করল,“মনে রঙ লেগেছে? মেয়েদের মতো গুনগুন করছিস কেনো?”

সেকথা গায়ে মাখলো না ইমন। কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললো,“সিনিয়রদের সাথে বেয়াদবি! নেহাৎ ভালো মানুষ বলে কিছু বললাম না। চা খেয়ে পড়তে বসে গিয়ে।”

ভোঁতা মুখে চায়ে চুমুক দিলো শিথিল। প্রশান্তি নিয়ে বললো,“আহা শান্তি! আব্দুল মামার মতোই ভালো চা বানাস তুই। টিএসসিতে চায়ের দোকান খুললে ভালো সেল হবে। চেহারা সুরৎও তো মাশাআল্লাহ!”

“আব্দুল মামা কে?”

“নীলক্ষেতের চা দোকানি।”

“চা বানানোর সাথে চেহারার কী সম্পর্ক?”

“মেয়েরা ভিড় জমাবে প্রচুর।”

“তুই দে গিয়ে। কাস্টমার বেশি পাবি।”

“আমি কী তোর ক্যাম্পাসের নাকি?”

“ক্যাম্পাসের না হয়েই বেঁচে গিয়েছিস। নইলে এমন র‍্যাগ দিতাম যে বাপের জন্মেও আর সিনিয়রদের সাথে বেয়াদবি করতি না।”

“বেয়াদবি? তাও আমি? ভালোবাসাটা দেখলি না ইমইন্না।”

“হে হে, ভালোবাসা! যেই আদর যত্নে তোকে পালছি এমন আদর যত্ন তোর বউও তোকে দিতে পারবে না।”

“আর বউ যা দিতে পারবে তা আবার তুই দিতে পারবি না।”

গলায় চা আটকে গেলো ইমনের। কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একটা চেয়ার টেনে আধ খোলা জানালার সামনে বসলো। শিথিল আর কিছু বললো না। চায়ে দ্বিতীয় চুমুক বসিয়ে চলে এলো ঘরে। চায়ের কাপ পড়ার টেবিলের উপর রেখে বসলো চেয়ারে। বই, খাতা, ল্যাপটপ সব অগোছালো হয়ে পড়ে রয়েছে। কাল আবার পরীক্ষা তার। গত সেমিস্টারে এক সাবজেক্টে ফেইল করায় রিটেক খেয়েছিল বেচারা। যে সে ফেইল নয়, একেবারে লজ্জাজনক ফেইল। সব পারি ভেবে লেখাপড়ায় ফাঁকি দিয়েছিল। আর সেই ফাঁকির ফল-ই হচ্ছে রিটেক।

অর্ধ সমাপ্ত ডিজাইনটা সমাপ্ত করে গামছা নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো সে। গোসল শেষে তৈরি হয়ে ক্যাম্পাসে একটা ঢু মেরে আসবে। তারপর বাড়িতে এসে সারাদিন পড়বে।
___________

রাত থেকে শাহিনূরের মেজাজটা খারাপ।আরামদায়ক নরম বিছানায় শুয়েও ঘুম হয়নি একটুও। ওদিকে বলা নেই কওয়া নেই বুয়াও আবার আজ কাজে আসেনি। গতদিনের এঁটো বাসন থেকে শুরু করে সকালের নাস্তা, দুপুরের রান্না একা হাতেই সামলাতে হচ্ছে শাহিনূরকে। বুয়া ছাড়া একা হাতে কাজ করতে অনভ্যস্ত তিনি। মেয়েরা যে মাকে এসে একটু হাতে হাতে সাহায্য করবে সেটুকু আশা করাও বোকামি।তারাও সাংসারিক কাজে হয়েছে একেকটা ঢেঁড়স!

মোজাম্মেল হোসেন দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন টেবিলে। মনোযোগ সহকারে ছোটো চিংড়ি দিয়ে ভাজি করা তেতো করলায় লেবু চিপে ভাতের সঙ্গে মাখাচ্ছেন। উনার কর্মকাণ্ডে শাহিনূর বড়োই অসন্তুষ্ট। গতকাল রাতে ভাগ্নির থেকে মূল ঘটনা শুনে খুব রেগে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। দুলাভাইকে একশ একটা গালি দিয়ে সেই রাগ ঝাড়তে মেজো আর ছোটো ভাইকেও ফোন করে জানিয়েছিলেন সবটা। এরপর কী হলো কে জানে? রাত পেরিয়ে সকাল হলো।ভদ্রলোকের হম্বিতম্বি হয়ে গেলো একেবারে স্বাভাবিক।

শাহিনূর অসন্তুষ্ট চিত্তেই বলে উঠলেন,“তোমার ভাগ্নি সকলের মান সম্মান নষ্ট করে বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে পালিয়ে চলে এসেছে এখানে। সেই সমস্যার সমাধান না করে তুমি নিশ্চিন্তে বসে খাবার খাচ্ছো? বাড়িতে তো নিজেরও তিন তিনটে ছেলে-মেয়ে আছে। তারা এর থেকে কী শিখবে?”

খাবার খাওয়ার সময় কথা বলা মোজাম্মেল হোসেনের মোটেও পছন্দ নয়। তাই স্ত্রীর প্রশ্নে উনার মুখশ্রীতে ফুটে উঠল বিরক্তি। মনোযোগে বিঘ্ন না ঘটাতে চুপ রইলেন।

স্বামীর এমন হঠকারিতায় শাহিনূর বেগম নিজের রাগটাকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না বলেই মনে হলো। টেবিলের ওপর সশব্দে পানির গ্লাসটা রেখে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,“এড়িয়ে যাচ্ছো আমায়? ও কী এখন এ বাড়িতেই থাকবে নাকি?”

এবারো স্ত্রীর কথায় তেমন একটা গুরুত্ব দিলেন না মোজাম্মেল হোসেন। করলা ভাজি দিয়ে খাওয়া শেষে পাতে তুলে নিলেন শিং মাছের ঝোল। বাকি অর্ধেক ভাত সেই ঝোল দিয়ে মাখিয়ে মুখে এক লোকমা তুলে তৃপ্তি নিয়ে চিবোতে চিবোতে আয়েশ করে বললেন, “রান্নাটা দারুণ হয়েছে নূর! হাত পাতো দেখি।”

প্রত্যুত্তরে এমন গাছাড়া উত্তরে রাগে ক্ষোভে আগুনের ফুলকির ন্যায় জ্বলে উঠলেন শাহিনূর। দিগ্বিদিক ভুলে তেজি স্বরে বলে উঠলেন,“শুধু আমি বলেই তোমার সংসার করছি। বাড়িটাকে সেবাকেন্দ্র পেয়ে বসেছো? যখন তখন যে যার ইচ্ছামতো অঘটন ঘটিয়ে এসে পড়ে থাকবে এখানে? আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম হওয়ার আগে এই ঝামেলা শেষ করো তুমি।”

খাওয়া থামিয়ে স্ত্রীর পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মোজাম্মেল হোসেন। ছেলে-মেয়ে থেকে শুরু করে বাবা-মা, ভাই-বোন কেউই উনার মুখের উপর চিৎকার করে কথা বলার দুঃসাহস রাখে না। এমনকি উনার স্ত্রীও না। তবে মাঝেমধ্যে রেগে গেলে ভদ্রমহিলাকে মোজাম্মেল হোসেন নিজেই ভীষণ ভয় পান। কিন্তু এই মুহূর্তে ধৈর্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হলেন। চাপা স্বরে বললেন,“কীসের ঝামেলা? ও কোনো বাইরের মেয়ে নয়। ও আমার নিজের বোনের মেয়ে। সেই বোন যার পাওনা সম্পত্তি আমরা ভাইয়েরা মিলে ভোগ করছি। আমার বোন যদি বেঁচে থাকতো তাহলে আজ কী এই দিন দেখা লাগতো ওর? এই নিয়ে আর একটা কথাও আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই না, নূর। বউ বউয়ের মতো থাকো।”

স্বামীর এমন কথায় হতভম্ব হয়ে গেলেন শাহিনূর। এ ধরণের শক্ত কথা কখনো শুনেননি তিনি। অথচ আজ কিনা! খাওয়া শেষ করে এঁটো প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। যাওয়ার আগে সাবধান করে বলে দিয়ে গেলেন,“বাড়িতে ছেলে-মেয়েরা আছে। ওদের সামনে নিজের হীন সত্তার পরিচয় দিয়ে ইমেজটাকে নষ্ট করো না। আপা আর মেজো ভাইজান এই সপ্তাহেই এখানে আসছেন। ছোটো জন তো দেশের বাইরেই। এসব নিয়ে ওর কোনো মাথাব্যথা নেই।”

বিপরীতে বলার মতো আর কোনো শব্দ খুঁজে পেলেন না শাহিনূর। নিরবে অপর চেয়ারটি টেনে নিজের প্লেটে ভাত বাড়ায় মনোযোগী হলেন।

দিনের বেলাতেই ঘর অন্ধকার করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে উদাস মনে বসে আছে আবৃত্তি। মেঘহীন নীল আকাশ সূর্যের আলোয় তখন ঝলমল করছে। মাথার উপরে বৈদ্যুতিক ফ্যান চলার পরেও গরমের তীব্রতা বেশ প্রকাশ পাচ্ছে কপালে, নাকের ডগায় জমে থাকা অযাচিত ঘাম হিসেবে। সেসবে আবৃত্তির ধ্যান নেই। কান খাড়া করে বাইরে থেকে ভেসে আসা মামীর বলা কথা শুনতে ব্যস্ত সে। সেসব শুনতে শুনতেই চোখের কোণে অশ্রু জমেছে তার। চক্ষু লজ্জায় ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস।

হঠাৎ করে ঘরের দ্বার খুলে গেলো। অন্ধকার কেটে গিয়ে দেখা মিললো স্বল্প আলোর। কারো আগমন টের পেয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল চোখের পানি আড়াল করতে।

“এভাবে এখানে বসে আছিস কেনো? গোসল, খাওয়া- দাওয়া হয়েছে কিছু?”

মেয়েলি প্রশ্নে সম্মুখে তাকাতেই দেখা মিললো রূপবতী এক কন্যার। সম্পর্কে আবৃত্তির মামাতো বোন হয়। মোজাম্মেল হোসেনের বড়ো কন্যা। আবৃত্তির কণ্ঠস্বর বড়োই মিহি, লাজুক। প্রত্যুত্তর করল,“গোসল করেছি।”

জানালার পর্দা সরিয়ে রোদ আসার জায়গা করে দিলো সুশ্রী। বিছানার চাদর টানটান করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“বাইরে যা রোদ পড়েছে না? কি গরম, কি গরম! সকালে যে বৃষ্টি হয়েছে বুঝাই যাচ্ছে না একদম। আমি তো দুটো ক্লাস করেই অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি।”

নিজের মতো কথা বলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ রইল সে। তারপর পুনরায় বললো,“ভালোই হয়েছে খাসনি। নইলে আমাকে এখন আবার একা একা বসেই খেতে হতো। চল আমার সাথে। খুব খিদে পেয়েছে।”

“আমি খাবো না, আপু। খিদে নেই।”

বাঁকা দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সুশ্রী। রূপ মায়ের থেকে পেলেও স্বভাব হয়েছে একেবারে বাবার মতো। দুটো প্লেটে ভাত বেড়ে প্রয়োজনীয় সবকিছু একটি ট্রে তে করে নিয়ে চলে এলো নিজের ঘরে। আবৃত্তিকেও ডেকে আনলো পাশের ঘর থেকে। একপ্রকার জোর করেই। গতকাল রাতে ওই ঘরেতেই সুশ্রীর ছোটো বোনের সঙ্গে ঘুমিয়েছিল মেয়েটা।

আবৃত্তি এই প্রথম এলো সুশ্রীর ঘরে। মেয়েটি অত্যন্ত সুন্দর, পরিপাটি হলেও ঘরের অবস্থা জঘন্য! বই, খাতা টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে এলোমেলো হয়ে। এক কোণে দেয়ালের সাথে লাগানো অত্যন্ত সুন্দর বুকশেলফে জমেছে ধুলো। বিছানার চাদর কুঁচকানো। শোয়ার বালিশও এলোমেলো। সুশ্রী শব্দহীন হাসলো। তার হাসিটাও ভীষণ সুন্দর ঠেকলো। হাসলে দু গালে টোল পড়ে।বিছানা ঠিক করতে করতে বললো, “সকাল হতেই খেয়েদেয়ে কলেজে ছুটেছি। তাই আর ঘর গোছানোর সময় পাইনি। আজ মনে হয় সায়দা খালা আসেনি। নইলে উনিই সব করেন।”

এবারো প্রত্যুত্তর করল না আবৃত্তি। কথার বিপরীতে কি বলা উচিত তার জানা নেই। কোনোরকম গুছিয়ে ট্রে নিয়ে বিছানায় বসলো সুশ্রী। খাবার গোছাতে গোছাতে বললো,“না খেয়ে থাকা হচ্ছে বোকাদের কাজ। চুপচাপ হাত ধুয়ে খেতে বোস।”

খিদে যে লাগেনি এমন নয়। বরং অনেক আগেই খিদে লেগেছিল আবৃত্তির। ভীষণ খিদে! ভয় আর লজ্জায় শুধু বলতে পারছিল না সে। এবার আর দ্বিমত করল না আবৃত্তি। দ্বিমত করার সুযোগ সুশ্রী রাখেনি। খাবার ভরতি প্লেট ধরিয়ে দিয়েছে তার হাতে।

খেতে বসে কয়েক লোকমা মুখে চালান করতেই সুশ্রী বলে উঠল,“শুনেছি এই সপ্তাহের মধ্যেই মেজো চাচা আর ফুফুরা আসবে।বাড়ি থেকে যে পালিয়ে এসেছিস সেটা নিয়েই সম্ভবত কথা বলবে। একদম ভয় পাবি না। তুই কোনো ভুল করিসনি। জোর করে যার তার সাথে ধরে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে অপরাধ।”

মাথা নাড়ল আবৃত্তি। রাত থেকেই ভয় তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। গতকাল তার বিয়ে ছিল। কথাটা সে জানতে পেরেছিল বিকেল চারটা সাড়ে চারটায়। তাও আবার পাত্রপক্ষের সামনে বসে। দুপুরে খালামণি শুধু বলেছিলেন,“আজ তোকে দেখতে আসবে। তোর খালুর-ই পরিচিত।”

সেকথা শুনে আবৃত্তির ভীষণ মন খারাপ হলো। তা নজরে পড়তেই তিনি পুনরায় বলেছিলেন,“মুখ ভার করতে হবে না। দেখতে এলেই কারো বিয়ে হয়ে যায় না।”

খালামণির কথা মেনে নিয়েছিল আবৃত্তি। কিন্তু সেই মেনে নেওয়াটা আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। যখন শুনলো পাত্রপক্ষের তাকে পছন্দ হয়েছে। ঘরোয়াভাবে আজই ছেলেকে বিয়ে করিয়ে ঘরে বউ তুলতে চান ছেলের বাড়ির লোকেরা। খালু তা শুনে বেজায় খুশি হলেন। আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন এমন একটা হাবভাব।

খালাতো বোন শিশির ঘরে এলো সন্ধ্যায়। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সে। তাই গত দশদিন ধরে বাপের বাড়িতেই পড়ে আছে। বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবে বলে মনে হয় না। তবে এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও ঘর থেকে সে বের হয়নি। তাই এ বিষয়ে ঠিক কতটা সে জানে তা আবৃত্তির জানা নেই।

উঁচু পেট ধরে খাটের মাঝখানে উঠে বসলো শিশির।হাতে বাটি ভর্তি ছোলা আর মটরশুটি সিদ্ধ। শব্দ করে চিবোতে চিবোতে বললো,“পাত্রের বয়স পঁয়ত্রিশ। এর বেশিও হতে পারে। আসার পথে চুলে দুয়েকটা পাক ধরেছে দেখলাম। আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। সেই ঘরে দুটো বাচ্চাও আছে। প্রাক্তন বউয়ের সাথে ডিভোর্স হয়েছে বছর চারেক আগে। আব্বার অফিসেই কাজ করে। তবে আব্বার থেকে পদে মনে হয় বড়ো। যেভাবে তোষামোদ করছিল! দেখে তাই মনে হলো।”

ছেলেপক্ষের দুজনকে সাথে নিয়ে খালু কাজী আনতে গিয়েছেন। এতেও অবশ্য আবৃত্তির মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। বাবা-মাহীনা আবৃত্তি নিতান্তই বাধ্য, নরম, চাপা স্বভাবের মেয়ে। বড়োদের মুখের উপর না করতে পারে না। যেমন তখন পারেনি। কিন্তু কথাগুলো শুনে কানে দুল পরতে গিয়েও হাত থেমে গেলো তার। ঘাড় ঘুরিয়ে খালাতো বোনের দিকে তাকালো। শিশির সজাগ কণ্ঠে বললো,“দেখতে এসেই বিয়ে করার জন্য এতো তাড়াহুড়ো! তোর কী মনে হয়, লোকটা আদৌ বউ খুঁজতে এসেছে?”

“তো কী খুঁজতে এসেছে?”—-আবৃত্তির সরল প্রশ্ন।

“বাচ্চাদের নামধারী মা আর বাড়ির জন্য কাজের মেয়ে খুঁজতে এসেছে।”

চমকায় আবৃত্তি। শিশির ফের বলে,“বয়স কত তোর? এখনো আঠারো-ই তো ছুঁতে পারলি না। সবে কলেজে পড়ছিস। ওই বয়স্ক লোককে বিয়ে করে সংসার করবি নাকি অন্যের বাচ্চা সামলাবি? বিয়ের পর লেখাপড়া বন্ধ করে দিবে। আব্বার সাথে এ বিষয়ে আগেই কথা হয়ে গিয়েছে। এখন তুই বল, এ বিয়ে করে জীবন নষ্ট করবি? শ্বশুরবাড়ির ভাত খাওয়া কিন্তু অত সহজ নয়। তার উপর যদি হয় এমন অবস্থা! তোর সারাটা জীবন পড়ে আছে, আবৃত্তি। তাছাড়া বিয়ের পর যদি কোনো সমস্যা হয়, তখন? তোর বাবা-মাও তো নেই যে গিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে দিয়ে আসবে।”

“তো কী করবো আমি? খালুর সামনে গিয়ে কথা বলার সাহস আমার নেই। আর খালামণি! সবকিছু জেনেও একবার আমায় জানায়নি পর্যন্ত।”

“তোর জায়গায় আমি থাকলে এতক্ষণে পালিয়ে যেতাম। আগে নিজের ভবিষ্যৎ তারপর অন্যের মান সম্মান।”

আরো এক ধাপ অবাক হয় আবৃত্তি। শিশিরের সাথে তার সম্পর্কটা তেমন একটা ভালো নয়, আবার খারাপও নয়। খালার বাড়িতে সে থাকছে গত পাঁচ বছর ধরে। এই পাঁচ বছরে কখনোই বিশেষ একটা পাত্তা শিশির তাকে দেয়নি। প্রয়োজন ব্যতীত কথাই বলে না। অথচ আজ এতো কথা বলে দিলো? শিশির তার হাবভাব লক্ষ্য করল। বললো,“হঠাৎ তোর উপকার করতে এসেছি কেনো তাই ভাবছিস? উপকার আমি করছি না। এতে আমার লাভ কী? তবে তোর খারাপ হোক সেটাও আমি চাইছি না। আমার আব্বা স্বার্থবাজ মানুষ। তোর ভালো কিংবা মন্দে তার কিছু যায় আসে না। আর ছেলেপক্ষ তোর সম্বন্ধে সব জেনে বুঝেই ফায়দা লুটতে এসেছে। তাই তুই এখন কী করবি তা তোর উপর নির্ভর করছে। তুই বললে, আমি না হয় সাহায্য করবো। অযথা জীবন নষ্ট করে লাভ কী?”

“কোথায় যাবো?”

“সেজো মামার কাছে। এখান থেকে যেতে দেড় দুই ঘণ্টা লাগবে। ঠিকানা আমি লিখে দিবো।”

ভাবতে বসলো আবৃত্তি। এই বিয়ে করার ইচ্ছে তার নেই। কী করা উচিত? সত্যিই পালিয়ে যাবে? খালু জানতে পারলে কী হবে? তার ভাবনার মধ্যেই নিলুফা বেগম পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলেন ঘরে। ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,“কাজী নিয়ে তোর খালু এই এলো বলে। তৈরি হয়ে নে তাড়াতাড়ি। এলেই বিয়ে পড়ানো শুরু হবে।”

কথা শেষে আর দাঁড়ালেন না নিলুফা। রান্নাবান্নায় ভীষণ ব্যস্ত তিনি। অতিথিরা রাতের খাবার এখানেই সারবে। শিশির মুখ বাঁকালো। ভারি পেটটা নিয়েই উঠে গিয়ে ব্যাগ গোছালো। পড়ার টেবিল থেকে কাগজ, কলম নিয়ে কিছু লিখলো তাতে। তারপর আঁচলের গিঁট থেকে ভাঁজ করা দুটো পাঁচশ টাকার নোট বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,“এই যে কাপড়ের ব্যাগ। এই কাগজে ঠিকানা লেখা আছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলি দিয়ে মেইন রাস্তায় গিয়ে লোকাল বাসে উঠে পড়বি। হেল্পারকে জায়গার নাম বললেই নামিয়ে দিবে। আমি বাইরে গিয়ে ওদের ব্যস্ত রাখছি। তুই ওই সুযোগে বেরিয়ে যাবি। ঠিক আছে?”

উপরনিচ মাথা নাড়াল আবৃত্তি। শিশির মাথায় ঘোমটা টেনে বাটি হাতে ঘর থেকে বের হলো। এরপর কাঙ্ক্ষিত সুযোগ এলো দুয়ারে। মাথায় হিজাবটা বেঁধে মুখ ঢেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল আবৃত্তি। ওদের থেকে দূরে। বহুদূরে!

সুশ্রী তাকে আর কোনো প্রশ্ন করল না। শুধু বললো, “যতদিন এখানে আছিস ততদিন আমার সাথে আমার ঘরেই থাকবি। মিশমির ঘরে যাওয়ার দরকার নেই। ও লেখাপড়ায় ফাঁকিবাজ, বাঁচাল প্রকৃতির মেয়ে। তোকে পেয়ে কানের পোকা বের করে দিবে একদম।”

আবৃত্তির শ্রবণালী পর্যন্ত কথাগুলো পৌঁছাল কিনা বুঝা গেলো না। সে অনিশ্চিত কিছু চিন্তায় মগ্ন। হলুদ ঝোল মাখানো ভাতের দানার দিকে দৃষ্টি স্থির থাকলেও মন পড়ে আছে অন্য কোথাও।

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)