#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৫]
দুই রাত, একদিনের ব্যবধানে হঠাৎ করেই এলাকা থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে বুয়া। না বলে কয়েই কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। কল দিলে ধরছে না। তার অনুপস্থিতিতে এবার বিশাল এক সমস্যায় পড়ে গেলেন শাহিনূর। সকাল সকাল একা হাতে পঁচিশটার মতো রুটি বেলে সাথে রেঁধেছেন এক কড়াই ঝোল ঝোল আলু ভাজি। আর ছেলে-মেয়েদের জন্য করেছেন তাদের পছন্দের ডিম ভাজা।
মিশমি শব্দহীন হেঁটে মায়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখলো সেসব। হঠাৎ করেই অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে উঠল,“হায় আল্লাহ! এ সবকিছু তুমি একা একা নিজ হাতে রান্না করেছো, আম্মু? কীভাবে সম্ভব? আর সায়দা খালাই বা কোথায়?”
চমকে গেলেন শাহিনূর। বুকে কয়েক দলা থুথু ছিটিয়ে পেছন ফিরে তাকালেন। রাগত স্বরে সাবধান করে বললেন,“আমার মেজাজ এমনিতেই খুব খারাপ। মার খেতে না চাইলে শাফিনকে নিয়ে নাস্তা করে স্কুলে যা।”
“বাইরের আবহাওয়া দেখেছো? সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে থেমেছে মাত্র। আজও যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কে স্কুলে যায়? আমি তো একদমই যাবো না।”
“নাটক করবি না। এখান থেকে স্কুল কয়েক মিনিটের পথ। ছাতা নিয়ে যা।”
মুখ ভার হলো মিশমির।সুবিধা করতে না পেরে শুকনো একটা রুটি চিবোতে চিবোতেই বড়ো বোনের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। যাই হয়ে যাক, আজ সে স্কুলে যাবে না। বান্ধবীরা ম্যাসেঞ্জার গ্ৰুপে জানিয়ে দিয়েছে, তারাও আসবে না। বান্ধবী বিনা একা একা ক্লাস করার কোনো মজা আছে?
মোটা একটা ডাক্তারি বই খুলে টেবিলে বসে গুনগুন শব্দে পড়ছে সুশ্রী। মিশমির ধারণা মতে, সুশ্রীর মাথায় বড়ো ধরণের কোনো সমস্যা রয়েছে। সঙ্গে আবার জ্বীন থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে। বছর চারেক আগে দাদার বাড়ি থেকেই এই জ্বীন তার সঙ্গে এসেছে। তবে মিশমির এমন ধারণার কারণও অবশ্য রয়েছে। পারিবারিক কোনো কিছুতেই সুশ্রী থাকে না। সারাক্ষণ ঘরের কোণে ভুতের মতো বসে বই পড়তে থাকে। জীবনে এতো পড়ে হবেটা কী? লেখাপড়া করবে ছেলেরা। ইহ জগতের যত চিন্তা আছে সব থাকবে ছেলেদের মাথায়। ভবিষ্যতে তাদেরই তো বউ-বাচ্চা আর পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে, নাকি? মেয়েদের এতসব চিন্তা করে লাভ কী? ভেবে পায় না মিশমি।
লেখাপড়া করতে তার ভালো লাগে না। বাবা-মায়ের একমাত্র কিংবা বড়ো কন্যা হলে নিশ্চিত এতদিনে বাবাকে বলে কয়ে বিয়ে করে সংসার ধর্মে মন দিতো সে। কিন্তু ছোটো কন্যা হওয়ার বদৌলতে তা পারছে না। বড়ো বোন রেখে ছোটো বোনের বিয়ে হওয়া অসম্ভব!
আবৃত্তি জানালার পাশ ঘেঁষে নিরবে বসে আছে। মামার বাড়ি আসার পর থেকে তার মন ভালো নেই। একটা ঘরের ভেতরেই হয়ে আছে বন্দিনী। কাল সারাদিনে একবারও মামী তার সাথে কথা বলেনি। তার আগমনে যে ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছেন তিনি তাও আর বুঝার বাকি থাকে না। সুশ্রীকে আজ আর বিরক্ত না করে আবৃত্তির পাশ ঘেঁষে বসলো মিশমি। গতকাল স্কুল, কোচিং আর হোমওয়ার্কের চক্করে মেয়েটার সাথে কথা বলা হয়নি।
“আজও মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। তোমার বৃষ্টি পছন্দ, আবৃত্তি আপু?”
নড়েচড়ে বসলো আবৃত্তি। ঘাড় বাঁকিয়ে একপলক মামাতো বোনকে দেখে প্রত্যুত্তর করল,“হুম, ভালো লাগে।”
“আমারো ভালো লাগে। তবে বৃষ্টি দেখার চেয়ে ভিজতে ভালো লাগে বেশি।”
প্রত্যুত্তর করার মতো শব্দ খুঁজে পায় না আবৃত্তি। মৃদু হেসে চুপ থাকে। অন্তর্মুখী স্বভাবের মেয়ে হওয়ায় হুট করে কারো সাথে মন খুলে কথা বলা তার পক্ষে যেন কঠিন এক পরীক্ষা। তাই আশানুরূপ কোনো প্রত্যুত্তর করে ভাব জমানোতে এবারো সে ব্যর্থ হলো।অপরদিকে মিশমি তার সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের এক কিশোরী। যে কারো সাথেই সে ভাব জমাতে ভীষণ পটু। এবারো নিজ থেকেই বায়না ধরলো,“ছাদে যাবে, আবৃত্তি আপু? আমাদের বিল্ডিংয়ের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হচ্ছে ছাদ। তোমার মন খারাপ একেবারে ভালো হয়ে যাবে। চলো।”
পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না সুশ্রী। আশেপাশে কেউ কথা বললে কিংবা চলাফেরা করলে তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠল,“সমস্যা কী তোর? এতো কথা বলছিস কেনো? তৈরি হয়ে স্কুলে যা।”
মুখ বাঁকালো মিশমি। আবৃত্তিকে টেনে নিয়ে বাইরে যেতে যেতে ফিসফিস করে বললো,“ওর মাথায় সমস্যা আছে। পড়তে পড়তে কয়েকটা তারও হয়তো ছিঁড়ে গিয়েছে। একদম পাত্তা দিবে না।”
দুই বোনের রসায়ন আবৃত্তি বুঝতে পারে না।ফ্যালফ্যাল নয়নে শুধু তাকিয়ে থাকে তার পানে।
প্রকৃতি ভীষণ গম্ভীর। নীলাম্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছাই রঙা মেঘদল। বাতাসের তালে তালে ছাদ বাগানের গাছগুলো এপাশ ওপাশ দুলছে। শেষ সিঁড়ি পেরিয়ে ছাদে উঠেই লাফালাফি শুরু হয়ে গেলো মিশমির। এক ছুটে এপাশ থেকে ওপাশে গিয়ে লাল গোলাপটি ছিঁড়ে কানে গুঁজে মুচকি হাসলো। জিজ্ঞেস করল,“কেমন লাগছে আমাকে?”
বাড়ির তুলনায় ছাদটা যেন একটু চওড়া মনে হলো আবৃত্তির নিকট। ঘরের ভেতরে গরম লাগলেও ছাদে শীত শীত ভাব। মিশমির চঞ্চলা কণ্ঠে ফিরে তাকালো সে। আগাগোড়া তাকে দেখলো। মেয়েটি অত্যন্ত ফর্সা। সুশ্রীর মতোই। তবে নাকটাই যা একটু বোচা। কালো চুলে গোলাপ গুঁজতেই সৌন্দর্য যেন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে আশানুরূপ উত্তর এলো, “মাশাআল্লাহ!”
উত্তর শুনে বেজায় খুশি হলো মিশমি। কানের পেছনে চুল গুঁজে লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে ফের জিজ্ঞেস করল,“কে বেশি সুন্দর? আমি নাকি আপু?”
বোকা বনে গেলো আবৃত্তি। অবুঝের মতো পাল্টা প্রশ্ন করল,“মানে?”
হতাশ হলো মিশমি,“কিছু না। এদিকে এসো। এটা হচ্ছে আমার বাগান। আমি নিজ হাতে এই গাছগুলোর যত্ন নেই রোজ।”
ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দুটো গোলাপ গাছে ভিন্ন রঙের তিন তিনটি ফুল ফোটে আছে। তার মধ্যে একটি শোভা পেয়েছে মিশমির কানে। পাশেই আবার রয়েছে বেলী, গন্ধরাজ, মালতীসহ নাম না জানা আরো অনেক ফুলের গাছ। আবৃত্তির দৃষ্টিতে ছড়িয়ে গেলো মুগ্ধতা। পৃথিবীর সব মেয়ের মতো তারও ফুল ভীষণ প্রিয়। মিশমি একটি গন্ধরাজ ছিঁড়ে নাসারন্ধ্রে টেনে নিলো তার সুগন্ধি। কণ্ঠে রহস্য এনে বললো,“আপু আবার ফুল পছন্দ করে না। ফুলে তার ভয়ানক এলার্জি। ফুলের ঘ্রাণ নাকে গেলেই কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীদের মতো মোচড়া মুচড়ি করে। হাঁচি দিতে দিতে ঝড় তুলে ফেলে। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার, ভাবতে পারছো?”
ভাবতে পারলো না আবৃত্তি। কথাটা তার কাছে নতুন মনে হলো। অবাক নয়নে তাকিয়ে দুদিকে ঘাড় নাড়ল। তাতেই উৎসাহিত হয়ে উঠল মিশমির মন। বড়ো বোনকে তেমন একটা পছন্দ করে না সে। তার যেটা প্রিয় সুশ্রীর সেটা অপ্রিয়। আবার তার যেটা অপ্রিয় সেটা আবার সুশ্রীর প্রিয়। যেমন লেখাপড়া আর কম কথা বলা! তাই সুযোগ পেতেই আবৃত্তিকে আবারো টেনে নিয়ে বসালো দোলনায়। এখন ঘণ্টা ধরে চলবে বোনের নামে নিন্দা। যত রকমের অদ্ভুত এবং উদ্ভট কথা আছে সব সে বলবে। তরকারিতে মসলা কষানো হয় যেভাবে ঠিক সেভাবেই নিজের কথায়ও মসলা কষিয়ে উপভোগ্য করে তুলবে।
____________
মোজাম্মেল হোসেন ব্যবসায়ী গোছের মানুষ।মালিবাগে রড, সিমেন্ট আর রেস্তোরাঁর রমরমা ব্যবসা রয়েছে। বেশ কয়েক বছর জমিয়ে ব্যবসা করে এখন বিশ্বস্ত সব কর্মচারীদের দিয়েই তা সামলান। সকালে নাস্তা শেষে উনার প্রথম কাজ সেসব স্থান ঘুরে ঘুরে দেখা। দুপুরের দিকে বাড়িতে ফিরে গোসল সেরেই জম্পেশ খাওয়া দাওয়া করে তারপর নাক ডেকে ঘুম।
দুপুরে খাওয়ার ঘণ্টা দেড়েক পেরোলেই শাহিনূরের চা খাওয়ার বাতিক। কাজের বুয়া না আসায় গতকাল এই বাতিকের অনিয়ম ঘটেছে।
মিশমি ঘুমাচ্ছে।সুশ্রী দুপুরের খাবার না খেয়েই কোথাও বেরিয়েছে। এই অবেলায় আবার আবৃত্তির ঘুম আসে না। তাই ভাত ঘুম কখনোই তার দেওয়া হয়ে ওঠে না। ঘর থেকে বেরিয়ে টেবিলের কাছে এসে পানির জগটা হাতে নিতেই রান্নাঘরে শাহিনূরের দেখা মিললো। আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে খুঁজছেন কিছু। পানি দিয়ে গলা ভিজিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো আবৃত্তি। ক্যাটলিতে পরিমাণ মতো চায়ের পানি ভরে চুলার কাছে এগোতেই কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পিছু ঘুরলেন শাহিনূর। আবৃত্তিকে দেখে ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিলেন। সেই রাতের পর থেকে মেয়েটির সাথে একবারের জন্যও তিনি কথা বলেননি। স্বামীকেও অবশ্য এড়িয়েই চলছেন। গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন,“কিছু লাগবে?”
“না।”
“চা বানাবো, তুমি খাও?”
“হ্যাঁ।”
ফিরে গিয়ে আরো এক কাপ পানি বাড়িয়ে আনলেন তিনি। আবৃত্তি সাহস করে বলে বসলো,“আমি বানাবো?”
এই মেয়ের সাথে বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না উনার। তবুও একপ্রকার বাধ্য হয়েই বললেন,“বানাতে পারো?”
“হ্যাঁ, আমি খুব ভালো চা বানাই। খালা-খালুর তো আমার হাতের চা ছাড়া চলেই না।”
প্রবল আত্মবিশ্বাসের সহিত কথাটা বলে নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকলো আবৃত্তি। যা একদম সহ্য হলো না শাহিনূরের। যেখানে মেয়েরা তো দূরে থাক বরং তিনি নিজেই ভালো চা বানাতে পারেন না সেখানে এইটুকু মেয়ে এতো ভালো পারে? কথাটা মোটেও বিশ্বাস হলো না। তাই শব্দ করে পা ফেলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন,“বানাও তবে। দেখি কত ভালো চা বানাতে পারো। আমি কিন্তু দুই চামচ চিনি খাই।”
হাস্যোজ্জ্বল মুখে আবৃত্তি মাথা নাড়াল। ভেতরে ঢুকে শুরু করে দিলো নিজের কাজ। রান্নাঘরটা একেবারে গোছানো। তাই কোনোকিছুই খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলো না তার।
ড্রয়িং রুমে এসে টিভি ছেড়ে রিমোট হাতে সোফায় সবে বসেছিলেন শাহিনূর। কিন্তু কারো যেন তা একদম সহ্য হলো না। হঠাৎ করে সশব্দে বেজে উঠল কলিংবেল। বিরক্ত হলেন শাহিনূর। এ অসময়ে কে এলো? সুশ্রী? হবে হয়তো। হেলেদুলে গিয়ে দরজা খুললেন। বাইরে অপেক্ষারত মানুষটিকে দেখতেই খুশিতে হয়ে উঠলেন আত্মহারা। ললাটের বিরক্তির ভাঁজ মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল চওড়া হাসি। কণ্ঠেও প্রকাশ পেলো তা,“শিথিল! বাবা আমার! ঠিক দেখছি তো?”
মুচকি হাসলো শিথিল। ভেতরে প্রবেশ করতে করতে সালাম দিলো,“আসসালামু আলাইকুম, ভুল দেখছো।”
সালামের জবাব নিয়ে ভাগ্নের মুখোমুখি বসলেন তিনি। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ভুলে বসলেন সবকিছু। মুখ ফুলিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বললেন,“সেই মাস দুয়েক আগে থেকে আসতে বলছি। অথচ আজ আসার সময় হলো তোর? কাছাকাছি থেকেও একটু দেখে যাওয়ার সুযোগ হয় না? নাকি আপন খালা নই বলে দেখতে ইচ্ছে করে না?”
কিছুটা ভড়কে গেলো শিথিল। তবে বাইরে তা প্রকাশ করল না। সঙ্গে নিয়ে আসা ফল আর মিষ্টির প্যাকেট সেন্টার টেবিলের উপর রেখে বললো,“ইদানিং খুব ব্যস্ততা চলছে। ভার্সিটির ক্লাস, টিউশন, লেখাপড়া সব মিলিয়ে আরকি আসতে পারিনি। আপুর সাথেও এই কারণেই অনেকদিন দেখা হয় না।”
“সুহাসিনীরা কয়েকদিন আগে এসেছিল। বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান ছিল। তুই তো এলিই না। তাই ওর মুখেই শুনেছি সব।”
সব অভিমান দূর হলো এবার। থেমে ধমকের সুরে বললেন,“এসব আবার কেনো এনেছিস? কতবার বলেছি, এটা নিজের বাড়ি মনে করবি।”
“আঙ্কেল কোথায়?”—-সে কথায় গুরুত্ব দিতে দেখা গেলো না তাকে।
“কোথায় আবার? নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। দাঁড়া ডেকে নিয়ে আসি। তোকে দেখলে খুশি হবে।”
বাঁধা দিলো শিথিল,“থাক, ডাকতে হবে না। বসো তুমি। বাড়ির বাচ্চাকাচ্চারা কোথায়?”
তার কথাই রইল। শাহিনূর আর গেলেন না। কতদিন পর বোন ছেলেকে পেলেন! তাই বসলেন গল্পের ঝুড়ি নিয়ে। শিথিলের মা আবার শাহিনূরের আপন খালাতো বোন ছিলেন। যৌবনকালে দুজনার ছিল গলায় গলায় ভাব। সংসার জীবনে প্রবেশ করার পরেও সম্পর্কের ঘনত্ব যেন একটুও কমেনি। বরং আরো গাঢ় হয়েছিল। এরপর হঠাৎ করেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দু দুটো ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে রেখে ইহকাল ত্যাগ করলেন আসমা। হামিদুল হকের পর বলতে গেলে শাহিনূরই হয়তো খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে দু দুবার জ্ঞান হারিয়েছিলেন। সেসব মনে পড়লে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে উনার।
মাথায় ঘোমটা দিয়ে চায়ের ট্রে হাতে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে আবৃত্তি। ড্রয়িং রুমের কথোপকথন শ্রবণালী এড়ায়নি তার। বাইরে যাবে কি যাবে না? দুটানায় ভুগতে লাগলো। অপরিচিত মানুষের সামনে সহজে যেতে পারে না সে। ভেতরে জড়তা কাজ করে। কখনো সখনো তো অঘটনও ঘটিয়ে ফেলে।
কতগুলো পলিথিন ব্যাগ হাতে রান্নাঘরে এলেন শাহিনূর। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাঁকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন,“এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
“আপনার চা, মামী।”
“আচ্ছা, দাও। আরেক কাপ কড়া লিকারের চিনি ছাড়া চা বানিয়ে দিয়ে যাও ড্রয়িং রুমে।”
নিজের কথা শেষ করে আবারো সোফায় এসে বসলেন শাহিনূর। দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবৃত্তি। কয়েক মিনিট সময় নিয়ে নতুন করে আবারো চা বানালো। তবে লিকার চা বানানোর জন্য এবার পদ্ধতি বদলালো। থেঁতো আদা, এলাচ, দারুচিনি দিতেও ভুললো না।
শাফিনের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। চোখ ডলতে ডলতে ঘরের বাইরে এসে শিথিলকে দেখতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো তার। দৌড়ে এসে পাশ ঘেঁষে বসলো, “শিথিল ভাইয়া!”
মুচকি হেসে পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিলো শিথিল। শাফিনের চকলেট প্রিয়। শিথিল তা জানে। তাই প্রতিবারই আসার পথে ছেলেটার জন্য সঙ্গে করে চকলেট নিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করল,“কেমন আছে ছোটো মিয়া?”
“ভালো, কিন্তু তুমি এখন আর আসো না কেনো? তোমায় কত মিস করি জানো?”
“তুই আবার মিসও করিস? তা তোর সামনের দাঁত দুটো কোথায় গেলো?”
“রাতে তো আমি মুখ খুলে ঘুমাই, তখন ইঁদুরে নিয়ে গেছে।”
“কে বললো এ কথা?”
“ছোটো আপু।”
কথার মধ্যেই চা হাতে আগমন ঘটলো একটি মেয়ের। শিথিল একপলক তাকালো তার পানে। চোখাচোখি হলো দুজনার। ফ্যালফ্যাল নয়নে আবৃত্তিও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে বিস্ময়। দুদিন আগে দেখা হওয়া সেই রাতের অপরিচিত ছেলেটা না এটা? হ্যাঁ, সেই ছেলেটাই তো! চিনতে বেগ পেতে হলো না তার। এ এখানে কী করছে? ভেবে পেলো না। শাহিনূর ইশারা করে বললেন,“তুমি ঘরে যাও।”
দৃষ্টি সরিয়ে নিলো শিথিল। মেয়েটিকে আদৌ সে চিনতে পেরেছে কিনা বুঝা গেলো না। শাফিন মনোযোগ দিয়ে চকলেটের প্যাকেট ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললো,“ও আমার নতুন আপু। ওর সাথে পরিচিত হবে না?”
আবৃত্তি ততক্ষণে চলে গিয়েছে ঘরে। কথার ফাঁকে শিথিল জিজ্ঞেস করল,“এই মেয়ে আবার কে, আন্টি?”
শাফিনকেও সেখান থেকে তাড়ালেন শাহিনূর। মুখের হাসিটা অদৃশ্য হয়েছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শ্বাস ফেললেন। মেয়েটা তবে মিথ্যে বলেনি। সত্যিই চা টা সে ভালোই বানায়। দুঃখ প্রকাশ করে ফিসফিস করে বললেন,“আর বলিস না। তোর খালুর ছোটো বোনের মেয়ে। খালার বাড়িতেই মানুষ। ওরা নাকি বিয়ে ঠিক করেছিল কার সাথে। ছেলে পছন্দ না হওয়ায় এ মেয়ে পালিয়ে এসে এখানে উঠেছে। কি এক ঝামেলা বল তো?”
চুপচাপ সমস্ত ঘটনা শুনলো শিথিল। বিপরীতে কিছু বললো না। অন্যের পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে অবশ্য তার বলাও সাজে না। তবে শাহিনূর বলে গেলেন। বোন ছেলেকে বলে মন হালকা করবেন না তো আর কাকে বলবেন?
মোজাম্মেল হোসেনের ঘুম ভাঙল শাফিনের দুষ্টুমিতে। শিথিলের আসার সংবাদে তিনিও খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলেন। এটা অবশ্য শিথিলের বিশেষ প্রতিভা বলা চলে। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার সাথেই সে সহজে মিশে যেতে পারে। পাতিয়ে ফেলতে পারে বন্ধুত্ব। তাকে টেনে নিয়ে বারান্দায় বসালেন মোজাম্মেল হোসেন। সাজাতে লাগলেন দাবার গুটি।
দাবা, ক্যারাম খেলতে ভীষণ ভালোবাসেন ভদ্রলোক। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন বিভিন্ন ক্লাবে যুক্ত হওয়ার সুবাদে শিখেছেন সেসব। তাই উনার সাথে জেতা কঠিন একটি কাজ! অথচ এই কঠিন কাজটাই শিথিলের জন্য সহজ।ছেলেটা দারুণ খেলে। কোত্থেকে যে শিখেছে কে জানে? প্রতিপক্ষ এমন শক্তিশালী হলে খেলা জমে ভালো। তাই যতবার শিথিল আসে ততবারই তাকে নিয়ে খেলতে বসেন মোজাম্মেল হোসেন। শাহিনূর অবশ্য এ নিয়ে স্বামীর সাথে ভীষণ রাগারাগী করেন তবুও পাত্তা দেন না তিনি।
চলবে __________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)