#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৬]
সন্ধ্যা সাতটা। চারিদিকে নেমেছে রাতের অন্ধকার। আশেপাশের কোনো এক বিল্ডিংয়ে কান ঝালাপালা করে দেওয়ার মতো শব্দে হিন্দি গান বাজছে। কোমরে গামছা বেঁধে বিরিয়ানি রাঁধতে রাঁধতে মন খুলে তাদের গালি দিচ্ছে ইমন। পুরোনো বাংলা গান ছাড়া আর কোনো গানই তার ভালো লাগে না। তার উপর এমন জোরে জোরে গান বাজিয়ে শব্দ দূষণ করা মানুষদের তো আরো ভালো লাগে না।
এই সুযোগে কড়াইয়ে কষানো পেঁয়াজ, মরিচের উপর হলুদ গুঁড়া আর মরিচ গুঁড়া ছিটিয়ে দিলো স্বাধীন। সাথে দিলো গোটা কতক এলাচ। পাশ থেকে হইরই করে চেঁচিয়ে উঠল শান্ত,“আরে করলি কী, করলি কী? বিরিয়ানিতে কখনো কেউ হলুদ, মরিচের গুঁড়া দেয়? বলদার ঘরের বলদা! এখন তো এইডা খিচুড়ি হইয়া যাইবো।”
ইমনও খেয়াল করল তা। চোখমুখ কুঁচকে তাকালো স্বাধীনের পানে। ধমকের সুরে বললো,“হ্লারপুত! যেইডা পারোস না সেইডা করতে আসিস ক্যান?”
নিজের দোষটা স্বীকার করল না স্বাধীন। প্রতিবাদ করে বড়ো গলায় পাল্টা জবাব দিলো,“তুমি বুঝি অনেক ভালা পারো? পেঁয়াজ বেরেস্তা করো নাই, মরিচের মাঝখানে ফাড়ো নাই। আবার আমার দোষ দেও? হলুদ ছাড়া কালার হইবো কেমনে? মরিচ গুঁড়া ছাড়া ঝাল হইবো কেমনে?”
“কত্তগুলা কাচাঁ মরিচ দিছি, দেখোস না চোখে? মরিচ না ফাড়লেও হয়। আর কালারিং বিরিয়ানি তোরে খাওয়াইছে কেডায়? শ্লা জামালপুইরা।”
রাগে গজগজ করে উঠল স্বাধীন। জেলা নিয়ে কিছু বললে মেজাজ ঠিক থাকে না তার। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,“ঢাকা শহরে আমার বাপের বড়ো বড়ো দুইটা বিল্ডিং আছে। আমরা স্থানীয়। একদম জামালপুইরা কইবা না।”
“শাক দিয়া মাছ ঢাকিস না।”—-শান্ত বললো।
স্বাধীন রান্নাঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললো, “মফিজের লগে পিকনিক আমি করমু না। তোমার রান্না তুমি গিলো।”
ইমন পাত্তা দিলো না তার কথায়। কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ধুয়ে রাখা মুরগির মাংস কষাতে লাগলো। শান্ত পাশে দাঁড়িয়ে সালাদ তৈরির জন্য শসা আর টমেটো কাটছে। স্বাধীন ফিরে এলো আবার। হাত পাতলো ইমনের সামনে। ইমন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,“কী চাই?”
“আমার দেড়শ টাকা ফেরত দাও।”
“কীসের দেড়শ টাকা?”
“পিকনিকের জন্য যে বিকাল বেলা নিলে সেই টাকা।”
শান্ত পাশ থেকে হাসতে হাসতে বলে উঠল,“পাছায় দুইডা লাত্তি মাইরা দাও, ভাই।”
ইমনের মুখে হাসি নেই।। কাজকর্ম সে আবার খুবই গুরুত্ব সহকারে করে। তখন হাসা তার জন্য নিষিদ্ধ। আশানুরূপ কোনো জবাব না পেয়ে শান্তর পিঠে কিল মেরে দৌড়ে আবারো বাইরে চলে গেলো স্বাধীন। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল শান্ত। মুখ দিয়ে অকথ্য গালি দিয়ে নামের মতোই শান্ত হয়ে গেলো একসময়।
ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বিছানো তোশকের উপর বসে গিটারে টুং টাং সুর তুলছে আরফিন। তার পাশে বসে আড্ডায় মেতে উঠেছে রিজভী, তুহিন, সজীব, ইকবাল আর তৌসিফ। মাসে দুবার শিথিলদের ব্যাচেলর ফ্ল্যাটে পিকনিক না দিলে আবার তাদের চলে না। তবে এটাই এই মাসের প্রথম পিকনিক। এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন আর পরীক্ষার জ্বালায় পুরো মাসটা কেটেছে ব্যস্ততায়।
ওদের বন্ধুত্বটা খুবই গোলমেলে। যার বিশ্লেষণ দিতে গেলে কিংবা শুনতে গেলে যে কারোরই মাথা আউলে যেতে পারে।ইমন, রিজভী, তৌসিফ আর ইকবাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। অপরদিকে শিথিল, স্বাধীন, আরফিন, তুহিন হচ্ছে বুয়েটের আর্কিটেকচার বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। শান্ত, সজীব একই বিশ্ববিদ্যালয় এবং একই বর্ষের হলেও তাদের দুজনের আবার বিভাগ ভিন্ন। প্রোগ্রামিং নিয়ে পড়ে তারা। শিথিল আর শান্ত একই কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করায় তাদের বন্ধুত্বটা অনেক আগে থেকেই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দুজনের মাঝখানে আরফিন আর তুহিনের জায়গাটাও একসময় ভালো ভাবেই হয়ে যায়। শিথিলের সাথে একই বিভাগের ছাত্র কিনা! আরফিন আর সজীব আবার শান্তর সঙ্গে এক হলরুমে থাকতো। সজীবের বন্ধু ছিল স্বাধীন। ওরাও একই কলেজে পড়েছে। বন্ধুদের সাথে সাক্ষাতের জন্য আসা যাওয়ার পথে তাদের সাথেও কখন যে বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়ে গেলো, কে জানে?
ইমন, রিজভী, তৌসিফ, ইকবালের সাথেও সম্পর্কের শুরু কিছুটা অমনভাবেই হয়েছে বলা যায়। শিথিল মিশুক ছেলে। সৃষ্টিকর্তা যেন তার কণ্ঠ আর চেহারায় মায়া ঢেলে দিতে কার্পণ্য করেননি। একটি প্রাইভেট হোস্টেলে ওঠার পর আলাপ হয়েছিল তৌসিফের সাথে। মাস তিনেক যেতেই ছেলেটা হঠাৎ একদিন এসে দাম্ভিক কণ্ঠে বললো,“হোস্টেল ফোস্টেল আর ভালো লাগছে না। ভাবছি ব্যাচেলর থাকবো। আমরা তিনজন আছি। আরো দুজন লাগবে। ফ্ল্যাট দেখে এসেছি। কে কত দিবো তা পরে ঠিক করে নিবো। তুই যাবি আমার সঙ্গে?”
প্রস্তাবটা পছন্দ হয়ে গেলো শিথিলের। রাজিও হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। সাথে যোগ করল তুহিনকে। এরপর তিন তিনটে বছর কেটে গেলো একসঙ্গে। ইকবাল আবার তৌসিফ, ইমনদেরই বন্ধু। মাঝেমধ্যে এসে থাকে। ছেলেদের এই এক সমস্যা নাকি ভালো দিক আপাতত বলা যাচ্ছে না। তবে তাদের বন্ধুত্বে আবার বয়স, ক্লাসটা তেমন একটা বড়ো করে দেখা হয় না। শিথিলদের ক্ষেত্রেও এটাই ঘটেছে। কে কখন কার সাথে থাকছে, ঘুরতে যাচ্ছে, তুই তুকারি করছে তার কোনো নিয়ম-কানুন নেই।
শিথিল বাড়ি ফিরে তাদের সাথে যোগ দিলো ঠিক সাড়ে আটটায়। মাগরিবের কিছুক্ষণ আগেই খালার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। শাহিনূর, মোজাম্মেল হোসেন যদিও রাতের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু সে শোনেনি। বিভিন্ন বাহানা দিয়ে চলে এসেছে।
তাকে পেয়ে পিকনিক জমে উঠল। কিন্তু হঠাৎ হওয়া পিকনিকের কথা শিথিলের অজানা। রান্নাবান্না প্রায় শেষের পথে। পাতিলে উঁকি মেরে বাম ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল,“এইটা কী রান্না করেছিস? ভুনা খিচুড়ি? কিন্তু এমন কেনো? আরেকটু শুকনো হওয়া উচিত ছিল।”
মুখশ্রী মলিনতায় ছেয়ে গেলো ইমনের। চাপা স্বরে বললো,“বিরিয়ানি এটা।”
থ মেরে গেলো শিথিল। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলে উঠল, “কী বললি? বিরিয়ানি! এটা বিরিয়ানি?”
কথাটুকু বলতে বলতে শব্দ করে হেসে উঠল সে। যেন কৌতুক শুনেছে। পাশ থেকে শান্ত বললো,“হাসছিস কেনো পাডা? পরাধীনের বাচ্চা হলুদ, মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে এই আকামটা করেছে। শ্লা রান্নার র জানে না অথচ মাতলামি করার বেলায় সবার আগে।”
হাসি থামলো না শিথিলের। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ধপ করে বসে পড়ল স্বাধীনের পাশ ঘেঁষে। পিঠে শক্তপোক্ত কিল বসিয়ে দিয়ে বিদ্রুপ করে বললো,“কী রে পরাধীন এটা কোনো কাজ করলি? হলুদ রঙের বিরিয়ানি কোন দোকান থেকে খেয়েছিলি? আন্টিও কী বিরিয়ানিতে হলুদ দেয়?”
“কথা বলবি না, চুপ থাক।”—–মুখ ফুলিয়ে বললো স্বাধীন।
আরফিন গিটারে সুর তুললো। চিকন কণ্ঠে টান দিলো গানে,“দ্বীপ জ্বলা সন্ধ্যায়, হৃদয়ের জানালায়, কান্নার খাঁচা শুধু রেখেছি…… ও পাখি সে তো আসেনি তুমি ভালবাসোনি, স্বপ্নের জাল বৃথা বুনেছি!”
তৌসিফ বিরক্ত হলো,“রুবি রায়ের গান তোর ব্যক্তিগত রুবি রায়কে গেয়ে শুনাস। এখন অন্য গান ধর।”
আরফিন দাঁত বের করে হাসলো। নতুন করে গাইলো, “বন্ধু তিনদিন তোর বাড়িত গেলাম দেখা পাইলাম না, বন্ধু তিনদিন!”
রিজভী দীর্ঘশ্বাস ফেলল,“এই তোরা কেউ ওর পাছায় লাথি মেরে বের করে দে তো। আমাদের বাড়িতে বসে বলে আমাদের নাকি দেখা পায় না? শ্লা মমিনসিংগা!”
‘পুরো পৃথিবী এক দিকে আর আমি অন্য দিকে,
সবাই বলে করছো ভুল আর তোরা বলিস ঠিক
তোরা ছিলি তোরা আছিস, জানি তোরাই থাকবি..’
আচমকা খালি গলায় ইকবালের গেয়ে ওঠা গানে এক মুহূর্তের জন্য নিরব হয়ে গেলো সকলে। কয়েক সেকেন্ড অতিক্রম হতেই একসঙ্গে উৎসুক হয়ে চেঁচিয়ে উঠল সম্মিলিত কণ্ঠে—
‘বন্ধু…… বোঝে আমাকে,
বন্ধু আছে হে হে হে, আর কি লাগে?
সুসম্পর্ক দুঃসম্পর্ক আত্মিয় অনাত্মিয়,
শত্রু মিত্র রক্ত সম্পর্কে কেউ বা দ্বিতীয়
শর্ত সব দূরে কাছে বৈধ অবৈধ,
হাজারো এসব সম্পর্ক ভাঙ্গে থাকে বন্ধুত্ব!
তোরা ছিলি তোরা আছিস জানি তোরাই থাকবি
বন্ধু বোঝে আমাকে,বন্ধু আছে আর কি লাগে?’
আড্ডা এবার জমে উঠল। গান আর আড্ডার মধ্যে বিরতি টেনে খাওয়ার পর্ব শেষ করল। ঝাল বেশি, লবন কম, আধ সিদ্ধ চালের বিরিয়ানি নামক খিচুড়ি খেয়েই যেন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো সকলে। এই আড্ডা চলবে আজ। সারারাত ধরে চলবে। গান হবে, ঝগড়া হবে, প্রকাশ পাবে হৃদয়ে জমে থাকা সকল কথা। কারণ বন্ধুত্বের কোনো বয়স হয় না, সময় অসময় হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কের আরেকটি নাম হচ্ছে বন্ধুত্ব।
___________
গ্ৰীষ্মের সকাল হয় খুব জলদি। ভোর সাড়ে পাঁচটা বা ছয়টা বাজতেই পুরো ধরিত্রী আলোয় আলোয় ভরে ওঠে। দারোয়ান আজিজকে দিয়ে গতকালই নতুন কাজের লোকের সন্ধান করেছেন মোজাম্মেল হোসেন। গৃহ কর্ত্রী আবার বাবার খুব আহ্লাদী মেয়ে ছিলেন। যেমন আহ্লাদে রেখেছেন তিনি নিজের মেয়েদের? ঠিক তেমনি। বিয়ের পর নিজ হাতে সংসারটা সামলালেও বছর ঘুরে যখন সুশ্রী এলো শাহিনূরের পেটে তখন শাশুড়ির কথায় বাড়িতে নতুন কাজের লোক রেখে দিয়েছিলেন মোজাম্মেল হোসেন। এরপর স্ত্রী হয়ে উঠলেন পটের বিবি। চুলার তাপ উনার সহ্য হয় না। রান্নাবান্না ততদিনে ভুলে বসেছেন। স্বামীর মন রাখতে যা একটু খুন্তি নাড়তেন ওই আরকি। তাই বুয়ার অনুপস্থিতে বড়োই সমস্যায় পড়ে গেলেন ভদ্রমহিলা।
এবারের কাজের মেয়েটি অল্প বয়সী। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ আজিজের সাথে হাজির হলো ফ্ল্যাটের দোরগোড়ায়। মিশমি সবে ব্রাশ করছে। ব্রাশ করতে করতে ঘর থেকে ছাদ ঘুরে আসা তার স্বভাব। শাহিনূর তার ডাকেই হাতের কাজ ফেলে রান্নাঘর থেকে বাইরে এসে উপস্থিত হলেন। মেয়েটিকে উপরনিচ পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞেস করলেন,“নাম কী?”
মেয়েটি একগাল হাসলো। হাসলে তার গালে টোল পড়ে। দুই হাতে মাথার দুই বেনুনী ঘুরাতে ঘুরাতে চঞ্চল কণ্ঠে উত্তর দিলো,“আমার নাম মিতা, চুলে পড়ি ফিতা কানে পড়ি দুল, ভালোবাসার ফুল।”
তার কবিতা শুনে মুখশ্রীতে বিরক্তি দেখা গেলো শাহিনূরের। মিশমি শব্দ করে হেসে উঠল। ভারি মজা পেয়েছে যেন। তার মতো করেই বলে উঠল,“ওই বাড়ির সেলিনা, তার সাথে খেলি না। তার সাথে আড়ি, যাই না তাদের বাড়ি, তাদের বাড়ি দুতলা…
খুশিতে চোখ দুটো চকচক করে উঠল মিতার। কিন্তু বাকিটুকু শেষ করতে পারলো না মিশমি। রামধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলেন শাহিনূর। মিতার উদ্দেশ্যে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“সত্যিই তোমার নাম মিতা?”
“ইয়েস আন্টি।”
ইয়েস আন্টি শুনে একদফা চমকালেন শাহিনূর। গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস বললেন,“রান্নাবান্না থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়া, ঘর পরিষ্কার সব পারো তো?”
“কি পারি না শুধু সেটা জিজ্ঞেস করেন, আন্টি। এই মিতা পারে না এমন কিছুই নেই। মিতার রান্না একবার যারা খেয়েছে তারাই শুধু বুঝেছে।”
বেশি কথা শাহিনূরের পছন্দ নয়। কেমন কাজ পারে তা সময় হলেই দেখা যাবে। বললেন,“আগের বুয়াকে মাস শেষে ছয় হাজার দিতাম। তোমাকেও তাই দিবো। এক সপ্তাহ কাজ করো। ভালো লাগলে চাকরি কনফার্ম।”
“এক সপ্তাহ তো বহুত দূরকি বাত আন্টি জি! আপনি জাস্ট দুইদিনেই আমার উপর ফিদা হয়ে যাবেন। আর বেতন আন্টি দুই হাজার বাড়িয়ে আট হাজার করে দিয়েন। আজকালকার যুগে এতো কম টাকায় ভালো ওয়ার্কিং গার্ল পাবেন না।”
মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল শাহিনূরের। কি যুগ এলো? কাজের মেয়েরা ইংরেজিও জানে? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। আজিজের মাধ্যমে তার সব খোঁজখবর নিয়ে পরিচয়পত্রের ফটোকপি রাখলেন নিজের কাছে। এরপর বুঝিয়ে দিলেন বাড়ির সব কাজকর্ম।
দুপুরের দিকে বাসায় এসে পৌঁছালেন আবৃত্তির মেজো মামা, মামী আর খালা, খালু। খালু সাইফুলের মুখ ভার। এই ভদ্রলোককে কখনো মন খুলে হাসতে দেখেনি আবৃত্তি।কাছের মানুষদের কাছে তিনি সর্বদাই ককটেল এর মতো। উপরের ঢাকনা খুললেই যে কোনো মুহূর্তে ফেটে পড়ে পরিবেশ নষ্ট করতে পারেন।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই ড্রয়িং রুমে বসলো। মেজো মামা আসাদুল ইসলাম আগেই মোজাম্মেল হোসেনের থেকে সবটা জেনে নিয়েছিলেন। তাই তিনিই প্রথমে শুরু করলেন,“সময় নষ্ট না করে মূল কথায় আসি। আমাদের না জানিয়েই আবৃত্তির বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলে, সাইফুল? এটা কী ঠিক করছিলে, বলো? ওর সব খরচ আমরা মামারা দেই। অভিভাবকও আমরা। নিলুফা চাইলো বলে তোমাদের ওখানেই থাকে ও। খালা তো মায়ের মতোই।তাই বলে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমি আমাদের অপমান করলে?”
গম্ভীর সাইফুল আলম নড়েচড়ে উঠলেন। মোজাম্মেল হোসেন সম্পর্কে উনার শ্যালক হলেও আসাদুল ইসলাম আবার সম্বন্ধী হয়। স্ত্রীর বড়ো ভাই। তাছাড়া ভদ্রলোক আবার গোয়েন্দা শাখার হেড ছিলেন। বছর তিনেক আগে রিটায়ার্ড করেছেন। তাই উনাকে একটু বেশিই মান্য করে চলেন সাইফুল। কথাও বলেন ভেবেচিন্তে, বুঝেশুনে। উত্তর দেওয়ার জন্য কিছুটা সময় নিলেন তিনি। ধীর, স্থিরভাবে বললেন,“আসলে ছেলে আমার অফিসেরই। সিনিয়র কর্মকর্তা। বিয়ের জন্য মেয়ের খোঁজ করছিল। তাই আবৃত্তির কথা জানালাম। দেখতে এসে এতোটাই পছন্দ হলো যে! তাই আরকি হাত ছাড়া করতে চাইছিলাম না। মামা খালার বাড়ি বেড়ে ওঠা বাপ-মা ছাড়া মেয়েকে আজকাল ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়া যায়?”
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন। কথা ভুল নয়। পাশে বসা স্ত্রী ফাতিমা সহমত পোষণ করলেন,“ঠিকই তো।আজকাল বিয়ে হওয়া অত সহজ নাকি? পাত্রের বাবা-মায়েদের ডিমান্ড বেশি। তার মধ্যে যদি শুনে, মা মরা মেয়ে। বাপ নিজের মেয়েকে ত্যাগ করে আরেকটা বিয়ে করে অন্য জায়গায় সংসার পেতেছে। তাহলে তো আর কথাই নেই। সেই মেয়েকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়। তাই ওর জন্য এটাই বিয়ের উপযুক্ত সময়।”
মোজাম্মেল হোসেন গলা ঝাড়লেন,“বিয়ে হচ্ছে ভাগ্য। কার ভাগ্যে কী লেখা আছে সেটা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ভালো জানেন। এখন কথা হচ্ছে, জোর করে তো আর বিয়ে দেওয়া যায় না। আর দুলাভাই যেই ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছিলেন সে তো আবৃত্তির থেকে বয়সে অনেক বড়ো। শুনেছি আগের পক্ষের ছেলে-মেয়েও নাকি আছে?”
“পুরুষ মানুষের অমন একটু আধটু সমস্যা থাকতেই পারে, মোজাম্মেল। সোনার চামচ বাঁকাও ভালো।”
বলে উঠলেন সাইফুল আলম। কণ্ঠে এবার উনার দাম্ভিকতা প্রকাশ পেলো। মোজাম্মেল হোসেন সে কথা মানলেন না। দম্ভ ভেঙে চুরমার করে দিয়ে বললেন, “সব পরিস্থিতির সাথে এসব কথা মানায় না, দুলাভাই। ঘরে নিজেদেরও বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে। বোনের মেয়ে তো নিজেদের মেয়ের মতোই। বাপ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলে আমরা তো আর মুখ ফিরিয়ে নিতে পারি না। এখন না হয় বিয়েটা দিয়ে দিলেন। কিন্তু পরে যখন সমস্যা হবে তখন কী করবেন? তখন আমাদের কাছেই তো ফিরে আসবে।”
ললাটে বিরক্তির রেখা প্রকাশ পেলো সাইফুলের।ত্যাছড়া স্বরে বললেন,“তো তুমি নিজের কাছেই রেখে দাও না ওকে। আমার বাড়ির দরজা ওর জন্য বন্ধ। মানসম্মান সব নষ্ট করে দিয়েছে। যেই পাতে খেয়েছে সেই পাতেই কিনা ফুটো করেছে? খারাপ মেয়ে মানুষ। ওর ব্যাপারে আমার আর কোনো কথা নেই। যা ইচ্ছে তোমরা করো গিয়ে। তোমার এক বোনকে বিয়ে করেছি বলে আরেক বোনের মেয়েকে সারাজীবনের মতো বয়ে চলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার নিজেরও সংসার আছে, সংসারের খরচ আছে।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে নিজের বক্তব্য শেষ করলেন তিনি। নিলুফা চুপচাপ বাধ্য শ্রোতার মতো সব শুনছেন। অযথা কথা বলে স্বামীর বিরুদ্ধাচরণ করে সংসার ভাঙার মতো বোকা নারী তিনি নন।
চলবে ___________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)