#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৭]
মা’ হীনা পৃথিবী যেন দাবানলের মতো জ্বলন্ত এক অগ্নিকুণ্ড। যা সন্তানের জীবন একটু একটু করে প্রতি মুহূর্তে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে সক্ষম। সতেরো বছরের আবৃত্তি সেই দাবানলেই পুড়ছে। পুড়তে পুড়তে বেঁচে থাকার সমস্ত আশার আলো ফুরিয়ে চৌচির হয়েছে। লোকে বলে, মা মরলে বাবা হয় তালই। লোকের কথা কেউ বিশ্বাস না করলেও আবৃত্তি করে। না করেও অবশ্য উপায় নেই। তার প্রমাণ তো সে নিজ জীবনেই পাচ্ছে।
আবৃত্তির মা ফারজানা যখন মারা যান তখন আবৃত্তির বয়স ছিল সাড়ে চার। দ্বিতীয়বার সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে গর্ভের বাচ্চাসহই তিনি দুনিয়া ত্যাগ করেন। তার মাস চারেক পেরোতেই দাদী, ফুফুদের প্ররোচনায় বাবা দ্বিতীয়বার বিবাহ করে ঘরে তুলেন নতুন বউ।
মা ফারজানা ছিলেন শিক্ষিতা নারী। নব্বই দশকের মতো একটি সময়ে করেছিলেন বাংলায় বি.এ পাস। এরপর পিতার ঠিক করা উচ্চবিত্ত পাত্রকে ছেড়ে সবার অমতে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন আবৃত্তির বাবাকে। সেই বিয়ে মন থেকে কখনোই মেনে নেননি নানাজান। গ্ৰামে তখন অধিক শিক্ষিত,ডিভোর্সী আর পরিবারের অমতে প্রেম করে বিয়ে করা মেয়েদেরকে সমাজের মানুষেরা পাপীষ্ঠদের কাতারেই ধরতো। সমাজ ছাড়া করা হতো সেই পরিবারবর্গদের। নানা মোতালেব হোসেন ছিলেন গ্ৰামের সচ্ছল মাতবর গোছের লোক। তাই সামনা সামনি কেউ কিছু বলতে না পারলেও আড়ালে আবডালে ফারজানার কাজটিতে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেলো গ্ৰামে। তিলকে তাল বানিয়ে দশ গ্ৰামে এ সম্পর্কেই হতে লাগলো চর্চা। যা কঠোর হৃদয়ের মোতালেব হোসেন কিছুতেই সহ্য করতে পারেননি। উনার অহংবোধ আর সম্মানে খুব ভালোভাবেই আঘাত হানলো সেসব। তাই ব্যাপারটাকে ওখানেই ধামাচাপা দিতে দুজনকে ডেকে নিয়ে লোক খাইয়ে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে তারপর মেয়েকে করেছিলেন ত্যাজ্য কন্যা।
এরপর আর মেয়ের মুখ কখনো দেখেননি তিনি। মৃত্যুর সংবাদ শুনেও শেষ দেখা দেখতে যাননি।মেয়ের শোকে অসুস্থ স্ত্রী মারা গেলেন। বাড়ি বসেই খবর পেলেন মেয়ে জামাতার নতুন বিয়ের। এরপর উনার কী হলো কে জানে? কাউকে কিছু না বলেই ভদ্রলোক চলে এলেন শহরে, প্রথম মৃত মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে। মেয়ের শেষ চিহ্নকে কোলে নিয়ে খুব আদর করলেন।
আবৃত্তির বাবা সেদিন চমকালেন। ভীষণ চমকালেন। নতুন বউকে নিয়ে উঠে পড়ে লাগলেন প্রাক্তন শ্বশুরের খাতির দারিতে। সেই খাতির দারি গ্ৰহণ করেননি মোতালেব হোসেন। এমনকি ও বাড়ির এক ফোঁটা পানিও পান করেননি। বুক ফুলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধু বলেছিলেন,“আমার নাতনিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এসেছি। ইচ্ছে করলে মাসে দুইবার করে দেখে যেতে পারবে। সেই অধিকার তোমার আছে। চিন্তা করো না, ওর সব খরচ ওর নানার।”
বাবা অবাক হলেন। মেয়েকে নাকি খুব ভালোবাসতেন তিনি। মিনমিনে স্বরে বললেন,“এ সম্ভব নয়, আব্বা। ও আমার মেয়ে। ফারজানার শেষ স্মৃতি।”
“স্ত্রী মারা গেছে মাস দুয়েক পেরোলো না ঠিক করে। অথচ আরেকটা বিয়ে করে দিব্যি তো সংসার করছো। মেয়ে মা মা করে কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছে। অথচ কোথাকার না কোথাকার এক মহিলাকে এনে তার মায়ের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছো? আগামীকাল নাকি শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাবে? তা তখন মেয়ের প্রতি ভালোবাসা কোথায় ছিল? ছয় বছর আগে তোমার হাত ধরে আমার মেয়ে ঘর ছাড়ার আগে ওকে বলেছিলাম, যার হাত ধরে যাচ্ছো সে একটা কাপুরুষ, বেকার। খাওয়াবে কী তোমায়? সে বড়ো মুখ করে বলেছিল, মানুষ না খেয়ে মরে না আব্বা। রিজিকের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। ও একদিন অনেক সফল হবে। সফল তো হয়েছো ঠিকই কিন্তু সফলতার সময় যে পাশে ছিল তাকে সামলে রাখতে পারোনি। তার জায়গায় অন্য কাউকে বসিয়ে দিয়েছো। সৎ মায়ের সংসারে নাতনি রেখে যেতে পারি না। নিয়ে গেলাম ওকে।”
বাবা সেদিন মাথা নত করে নিরবে সব শুনেছিলেন। বাঁধা দেননি মোতালেব হোসেনকে। ছোট্ট আবৃত্তি কত কেঁদেছিল! সেই কান্নার শব্দ উনার কান পর্যন্ত পৌঁছে ছিল কিনা কে জানে? হয়তো পৌঁছায়নি। পৌঁছালে কী আর নিজের মেয়েকে কেউ ওভাবে ছেড়ে দেয়? ভুলে যেতে পারে? নানা তার ঠিক বছর তিনেক পর মারা যান। তখনো বাবা আসেননি। বাবার আদর কেমন হয়, বাবা দেখতে কেমন আবৃত্তি জানে না। বাবাকে দেখার জন্য কত অপেক্ষা যে করেছে সে! তার হিসেব নেই। পাষাণ বাবা।
বড়ো মামা ছিলেন নিঃসন্তান।সমস্যাটা উনার থাকলেও গ্ৰামের সহজ, সরল মেয়ে বড়ো মামী উনাকে ছেড়ে যাননি। মোতালেব হোসেন বড়ো পুত্রবধূর কোলেই তুলে দিয়েছিলেন আবৃত্তিকে। বলেছিলেন,“তোমার মৃত ননদের মেয়ে।আজ থেকে ওর সমস্ত দায়িত্ব তোমাদের। নিজ সন্তানের মতো যত্ন নিও।”
মামী তাই করেছিলেন। ওই সময়টা ছিল আবৃত্তির জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর সুখের দিন। কিন্তু সুন্দর আর সুখ শব্দ দুটো তার জীবনে অস্থায়ী। তাই তো এক সপ্তাহ ডেঙ্গু জ্বরে ভুগে বড়ো মামাও মারা গেলেন।তাতে মামী ভীষণ ভেঙে পড়লেন। এক বছরের মাথায় জোর করে উনার ভাইয়েরা মিলে অন্যত্র বিয়ে দিলেন। অমন এক জোয়ান, নিঃসন্তান নারী এই সমাজে বিধবা হয়ে বেঁচে থাকতে পারে নাকি? মামী সঙ্গে করে তাকে নিয়ে যেতে চাইলেন। চাইবেন না-ই বা কেনো? সাত সাতটি বছর ধরে নিজ হাতে খাইয়ে, গোসল করিয়ে, অ, আ শিখিয়ে যেই মেয়েকে বড়ো করেছেন সেই মেয়েকে ছাড়া থাকা সম্ভব? তবে মামীর নতুন শ্বশুরবাড়ি আর বাপের বাড়ির লোকেরা তা মানলো না। নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধন হলেও না হয় মানা যেতো কিন্তু প্রাক্তন স্বামীর ভাগ্নিকে মানবে কে? অত দয়াবান লোক পৃথিবীতে আদৌ আছে?
এরপর আবৃত্তির স্থান হলো মেজো মামার বাড়িতে। মেজো মামী ওকে সহ্য করতে পারেন না। মেজো মামার দুই ছেলে। প্রথমটা ওর থেকে বয়সে অনেক বড়ো। ছোটোটার সাথে বয়সের পার্থক্য চার পাঁচ হবে হয়তো। তারা তাকে সুযোগ পেলেই চিমটি দিতো, ভয় দেখাতো। মামার কাছে নালিশ জানালে মামা তাদের বকতো। এইটাই পছন্দ ছিল না মেজো মামীর। ছোটো মামা স্ত্রী নিয়ে বিদেশে থাকেন। কোন দেশে থাকেন তা আবৃত্তি সঠিক জানে না। দুবার দেখা হয়েছিল। স্মৃতির পাতা উল্টালে মনে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তা মনে করা তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই মেজো মামা বাড়িতে ওকে নিয়ে বৈঠক বসান। সেই বৈঠক শেষে নিলুফা নিজেই প্রস্তাব দিয়ে বোনঝিকে নিয়ে রেখে দেন নিজের কাছে।
নিলুফার এক মেয়ে, এক ছেলে। বউ নিয়ে ছেলে আলাদা থাকে। ভাড়া বাসায়। এর কারণ আছে অবশ্য। খালামণি সারাদিনই এর বাড়ি, ওর বাড়ি ঘুরে বেড়ান। এলাকার মহিলা গ্ৰুপের সভাপতি তিনি। কার বাড়ি কী হচ্ছে সব খবরাখবর উনার কাছেই থাকে। তাই বাড়ির কাজ করার সময় পান না। ছেলের বউ বাড়ি আসতেই কাজের ছুটা বুয়া ছাড়িয়ে দেন। বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে সে। এতো কাজ একার পক্ষে করা সম্ভব? তার উপর ঘরে জোয়ান শাশুড়ি আছে। মায়ের কাছে এ কথা বলতেই মা ফোনে পরামর্শ দিলেন,“নাসিরকে বুঝিয়ে আলাদা হয়ে যা। অমন শাশুড়ির সাথে থাকতে হবে না।”
মায়ের স্বভাব নাসিরের অজানা নয়।তাই বউ, শাশুড়ির কথায় কাজ দিলো। বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেলো সে। এরপর আর কী? ধরে মেরে চৌদ্দ বছরের ছোট্ট আবৃত্তিকেই সব শিখিয়ে পড়িয়ে কাজে লাগিয়ে দিলেন নিলুফা। এ বুদ্ধি খালুই দিয়েছিলেন। অন্যের মেয়েকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর দায় কী উনার পড়েছে নাকি? এ মেয়ে কী বড়ো হয়ে উনাকে দেখবে? কখনোই না।
নবম শ্রেণিতে ওঠার পর থেকেই বাড়ির সমস্ত কাজের পাশাপাশি আশেপাশের বেশ কতক ছোটো ছোটো বাচ্চাদের পড়াতো সে।সেখান থেকে যা টাকা পেতো তা দিয়েই লেখাপড়ার খরচ উঠে যাওয়ার কথা। সরকারি স্কুলে লাগেই বা কত? মানবিক শাখার শিক্ষার্থী হওয়ায় প্রাইভেটও কখনো পড়তে হয়নি। গণিত, ইংরেজি স্কুল থেকেই এর ওর নোট সংগ্রহ করে স্যারদের থেকে বুঝে আসতো। স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে কলেজে যাওয়ার পর প্রাইভেটের সংখ্যা দুটো বাড়লো। দুই মামা মাস শেষে দু হাজার করে মোট চার হাজার টাকা পাঠিয়ে দিতেন খালামণির কাছে। যা কখনো চোখে দেখেনি আবৃত্তি। শুধু শুনেছে যা। প্রাইভেট থেকে প্রাপ্ত টাকাটাও খালামণিই নিয়ে যেতেন। ছোটো মানুষ টাকা দিয়ে করবেটা কী? অথচ এখন কিনা বলে, আবৃত্তি স্বার্থপর মেয়ে? ভাবা যায়!
আবৃত্তির কোনো আবদার কিংবা চাহিদা নেই। মানুষ আবদার করে বাবা-মা বা নিজের মানুষের কাছে। তার কী সেসব আছে নাকি? নেই তো। তাহলে কার কাছে আবদার করবে? সবার কাছেই ও বোঝা। একদিন ছোট্ট আবৃত্তি অনেক বড়ো হবে। কারো সাহায্য তার লাগবে না। কারো জীবনে সে আর বোঝা হয়ে থাকবে না। সেদিন সে বাবার সাথে দেখা করবে। তাকে ছাড়া বাবা কেমন ভালো আছে তা নিজ চোখে দেখবে। চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করবে,“এমনটা কেনো করলে, বাবা? আমি তো তোমারই মেয়ে ছিলাম।”
হঠাৎ করেই শক্ত হয়ে ওঠে আবৃত্তির মন। না, সে ওই পাষাণ লোকটাকে বাবা বলে ডাকবে না। বাবা না বলে ডাকাটাই হবে উনার শাস্তি। আশেপাশে সে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকায়। ঘরটা সুশ্রীর। অগোছালো হলেও আভিজাত্যে ঠাসা। এমন একটি ঘর, একটি দক্ষিণা জানালা, পড়ার টেবিল, বুক শেলফ আর আরামদায়ক স্থায়ী বিছানা কী তারও প্রাপ্য ছিল না? ছিল তো। কিন্তু কোথায়? কোথায় তার ঘর? কোথায় তার পরিচয়?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবৃত্তি। ওড়না দিয়ে ঘোলাটে চোখ দুটো মুছে আলগোছে নাক টানে। কান পাতে বাইরের সমস্ত কথা শোনার আশায়।
বাইরে এখনো বৈঠকের সমাপ্তি ঘটেনি। কে কার ঘাড়ে মেয়েটির দায়িত্ব চাপিয়ে দিবে তার প্রতিযোগিতা চলছে। মোজাম্মেল হোসেন মনে মনে চাইছেন নিজের কাছেই রেখে দিবেন ভাগ্নিকে।অর্থ বিত্তের অভাব উনার নেই। নিজেরও দুটো মেয়ে আছে। তারা আবৃত্তিকে যথেষ্ট পছন্দ করে। তাদের সাথেই না হয় থাকবে। সমস্যা কী তাতে? কিন্তু সরাসরি সেই প্রস্তাব রাখতে পারছেন না। মেয়েটা আসার পর থেকেই স্ত্রী ঠিকমতো কথা বলছেন না। রেগে আছেন বুঝাই যায়। তাই এই মুহূর্তে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।
নিজেকে শক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করল আবৃত্তি। কিন্তু পারলো না। নরম মনের কিশোরী মেয়ে সে। কখনো কারো সাথে তেমন একটা কথা বলার প্রয়োজন হয়নি। বড়োদের সাথে তো একদমই নয়। তাই কথা বলতে গেলে অনেক সময় জড়তা কাজ করে। শব্দ অস্পষ্ট হয়। বাক্য বিন্যাসও ভুল হয়। আড়ষ্ট হয় লজ্জায়। কিন্তু আজ কিছু না বললেই নয়। আজ তার বলার উপরেই নির্ভর করবে তার জীবন, ভবিষ্যৎ।
মাথায় ওড়না জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে। সুশ্রী, মিশমির ঘর ভিতরের দিকে। ড্রয়িং রুমে বসে দেখা যায় না সহজে। সে এগিয়ে এসে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল। বা হাত দিয়ে ডান হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলো। শাহিনূরের নজর পড়ল তার উপর। ওখান থেকেই কঠিন গলায় বললেন,“তুমি এখানে কেনো? বলেছিলাম না ঘরে থাকতে?”
সবার দৃষ্টিও এবার সেদিকে স্থির হলো। মোজাম্মেল হোসেন জিজ্ঞেস করলেন,“কিছু বলবি?”
উপরনিচ মাথা নাড়াল আবৃত্তি। তিনি অনুমতি দিলেন, “বল।”
বুকে সাহস সঞ্চয় করে দম আটকে বলেই ফেলল আবৃত্তি,“আমি বিয়ে করতে চাই না। আরেকটু সময় আপনারা আমায় দিন। উচ্চ মাধ্যমিকটা শেষ করি না হয়। এই তো ক’দিন আগে ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা শেষ হলো। পরের বছর উচ্চ মাধ্যমিক। এরপর আমার পথ আমি নিজেই খুঁজে নিবো। আর কাউকে জ্বালাবো না।”
এতটুকু বলতে গিয়েই যেন কণ্ঠনালী কাঁপলো। সাইফুল আলম দাঁতে দাঁত চাপলেন। মেয়ের সাহস কত! এ কদিনে মুখে বুলি ফুটে গেছে? বললেন,“যা ইচ্ছে কর। আমার বাড়িতে তোর আর জায়গা নেই।”
“আমাদের কলেজে হোস্টেল আছে। ওখানে ব্যবস্থা করে দিলে আমি থাকতে পারবো। একটা বছরই তো।”
শরীর জ্বলে উঠল সাইফুল আলমের। নিজ বাড়ি হলে এতক্ষণে দু চার ঘা মেয়েটার গালে নির্ঘাত পড়ে যেতো। মোজাম্মেল হোসেন গলা ঝেড়ে সবার দৃষ্টি নিজের দিকে টেনে নিলেন,“কথা তো সব মিটেই গেলো। আমি ওর দায়িত্ব নিলাম। মৃত্যুর আগে বড়ো ভাইজানকে বাবা বলে গিয়েছিলেন, মেয়েটার দেখাশোনা করতে। বড়ো ভাইজান তো এখন আর নেই তাই আমাদের উপরেই সেই দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু এতদিন সেই দায়িত্ব আমরা এড়িয়ে গিয়ে নিলু আপা আর দুলাভাইয়ের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলাম। এখন আপনারা যেহেতু আর পারছেন না এবং মেজো ভাইজানও পারবে না তাহলে না হয় পরেরটা আমিই দেখে নিবো। কী বলো সবাই?”
আসাদুল ইসলাম আর ফাতিমা সায় জানালেন। আপদ থেকে নিস্তার পেয়েছেন এতেই উনারা খুশি। কিন্তু খুশি হতে পারলেন না নিলুফা। আবার নতুন করে কাজের লোকের সন্ধান করতে হবে।মাস শেষে আবারো বাড়তি খরচা! প্রাইভেট আর ভাইদের থেকে যেই টাকাটা বাড়তি আসতো তাও এখন হাতছাড়া হয়ে গেলো। তাই স্বামীর উপর ভীষণ রাগ হলো উনার। লোকটা কী যে এক ভুল করলেন তা বুঝতেই পারলেন না। শাহিনূরও হজম করতে পারলেন না এমন সিদ্ধান্ত। আজ নতুন কোনো ঘূর্ণিঝড় আসতে চলেছে।তারপর সেই বৈঠকের সমাপ্তি ঘটলো সেখানেই।
____________
বিকেল পাঁচটা। লেখাপড়ায় ভীষণ মনোযোগী শিথিল আর তার বন্ধুরা। আজ সবগুলো ক্লাসই ওরা করেছে।
এমনকি লাইব্রেরী থেকে কতগুলো বই এনে আস্তানা গেড়েছে আরফিন আর সজীবের হলরুমে। এই রুমে বর্তমানে ওরা চারজন থাকে। বাকি দুজন জুনিয়র। সন্ধ্যার আগে ফিরবে বলে মনে হয় না।
টপারকে ভয় দেখিয়ে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ নোটস হাতিয়ে এনেছে স্বাধীন। ক্লাসের সবার খুঁটিনাটি তথ্য ওর জানা। সুযোগ পেলে প্রমাণও রেখে দেয় কাছে। কখন কীভাবে কাজে লাগে তা তো আর বলা যায় না। এই যে সেদিন নাঈমুর চিপায় গিয়ে প্রেমিকার সাথে প্রেম করছিল। তা ঠিকই ওর নজরে পড়ে গেলো। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ক্যাচ করে নিলো মোবাইলে। যা আজ ভালো মতন কাজে লেগেছে।
সবাই লিখলেও শিথিল লিখছে না। বন্ধুদের মধ্যে ও বুদ্ধিমান। আসার পথে ফটোকপি করে নিয়েছে। ফ্ল্যাটে গিয়ে রাত জেগে কমপ্লিট করবে। যদিও স্বাধীনকেও বুদ্ধিমান বলা যায় তবে ছেলেটার সব বুদ্ধি শয়তানির।
আরফিনের গিটারে ভুলভাল সুর তুলছে শিথিল। সে আবার গিটার বাজাতে পারে না। আরফিনকে বললে বিনা বাক্যব্যয়ে শিখিয়ে দিবে। কিন্তু তার-ই কখনো শেখার আগ্ৰহ জাগেনি। সজীব বিরক্তিতে হাত নাড়ছে। তার আবার হাত ঘামার রোগ আছে। মাথার উপর ধুলো জমা ফ্যানটা শব্দ করে চলার পরেও তার হাত ঘেমেই চলেছে।
শান্ত অতীষ্ঠ হয়ে বললো,“বাল এই লেখাপড়া কে আবিষ্কার করেছে, বল তো? হুদাই জীবনে রাত জেগে পড়ে ভালো রেজাল্ট করে এতদূর এসেছি। এর থেকে আব্বার সাথে ক্ষেতে কামলা দিলে কিংবা ভাইয়ের সাথে প্রবাসে গেলেও ভালো হতো। এতদিনে সফল তো হতামই সাথে সুন্দরী, অল্প বয়সী একটা বউও পেয়ে যেতাম। আহা, কী সুখের জীবন!”
ভীষণ মজা পেলো সকলে। তুহিন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। তার মাথায় লেখাপড়া ব্যতীত অন্য কোনো চিন্তা নেই। সে মাথা নাড়িয়ে বললো,“লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে। মন দিয়ে লেখাপড় কর।”
স্বাধীন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,“তোকে কে বলেছে এসব নোংরা কথা? নামটা বল শুধু। মুখ ভেঙে দিয়ে আসি।”
নাক ফোলালো তুহিন,“আমার বাবা বলেন।”
শিথিল হাসলো,“তোর বাপের কয়টা গাড়ি আছে?”
নিভে গেলো তুহিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল,“একটাও না।”
“এসব হচ্ছে মিথ্যা কথা। আমার বাবা জীবনে অনেক লেখাপড়া করেছেন। এখনো সময়, সুযোগ পেলেই চোখে চশমা লাগিয়ে মোটা মোটা বই পড়েন। তারও কোনো গাড়ি নেই। ওদিকে স্বাধীনের বাপে দুই দুইবার মেট্রিক ফেইল করেছে। তৃতীয়বার পাস করলেও টুকলি করে পাস করেছে। অথচ ব্যাটার ঢাকা শহরে দুই দুইটা বাড়ি, ব্যক্তিগত গাড়িও আছে। এর মানে হচ্ছে, অসৎ পথে চলে যারা, পরীক্ষায় ফেইল করে যারা গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে তারা। বুঝেছিস?”
তুহিন মাথা নাড়ল। শিথিলকে সে মান্য করে। ও যা বলে তাই সঠিক। তাই এবারো মেনে নিলো। কিন্তু স্বাধীন কৃত্রিম রাগ দেখালো,“হারামজাদা! তুই আমার বাপের নামে এত্ত বড়ো কথাডা কেমনে কইলি? আমার বাপের অসৎ পয়সা? বাপের গাড়ি দিয়া তগোরে ট্রিপ দেওয়ার কোনো দামই দিলি না!”
“সর শ্লা, ধান্দাবাজ। তেলের টাকা তো কড়ায়গণ্ডায় হিসেব করে নিস।”
হো হো করে হেসে উঠল সকলে। শিথিলের মোবাইল বাজলো। কল এসেছে। পরিচিত নাম্বার দেখে, আসছি বলে সে উঠে গেলো। বাইরে এসে রিসিভ করে লম্বা একটা সালাম দিয়ে বললো,“আরে হাতুড়ে ডাক্তার আপা যে! কী খবর?”
ওপাশ থেকে কিছু বললো বোধহয়। শিথিলকে অবাক হতে দেখা গেলো। সিঁড়ি বেয়ে নেমে বেশ সময় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গেইট পেরিয়ে বাইরে এলো। আশেপাশে তাকাতেই দেখা পেলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটির।
সুশ্রী দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপারে। বুয়েট মেইন গেটের সোজাসুজি। শিথিলকে এদিকে এগিয়ে আসতে দেখে বুকটা খানিক কেঁপে উঠল তার। কানের পিঠে চুল গুঁজে হাতের মোবাইলে নিজেকে একবার দেখে নিলো সব ঠিকঠাক আছে কিনা। ছেলেটার সাথে বহুদিন দেখা হয় না। গতকাল নাকি নিজেই বাড়িতে গিয়েছিল। মিশমি আর শাফিনের থেকে জানতে পেরেছে। তখনো দেখা হয়নি। ক্লাস শেষে বান্ধবীর বাড়ি গিয়েছিল। ফিরতে ফিরতে হয়েছিল রাত।
শিথিল হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে এলো। পকেটে হাত গুঁজে বললো,“আমি তো অবাক হচ্ছি। তুমি আমার সাথে দেখা করতে এসেছো! ব্যাপার কী? ভুলে চলে আসোনি তো?”
হাতের সাদা ব্যাগটি বাড়িয়ে দিলো সুশ্রী। ললাটে ভাঁজ পড়ল শিথিলের। জিজ্ঞেস করল,“কী আছে এতে?”
“বাসায় অতিথি এসেছিল। তাই আজ অনেক রান্নাবান্না করেছে আম্মু। আপনাকে অনেকবার ফোন করেছিল কিন্তু আপনি নাকি ব্যস্ত। তাই আরকি আমিই বললাম, দাও আমি গিয়ে দিয়ে আসি। আম্মুর দুঃখ তো আর দেখতে পারি না।”
“এই জন্য এতোটা পথ তোমার আসতে হবে? আন্টিকে কতবার বলেছি, এসব যেন না পাঠায়। আমার ভালো লাগে না।”
গলা শুকিয়ে গেলো সুশ্রীর। অত্যন্ত রূপবতী মুখশ্রীতে ঘাম জমলো। সরু নাকের ডগায়, থুতনিতে। নিভে গেলো সে। ভালো করে তার দিকে তাকালো না শিথিল। রূপবতী এবং কিশোরী মেয়েদের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে নেই। অঘটন ঘটে যেতে পারে। কোথায় যেন পড়েছিল সে। সঠিক মনে নেই।তাই অকারণে মেয়েদের দিকে তাকায় না শিথিল। দ্বিধাবোধ করে। জিজ্ঞেস করল,“সঙ্গে গাড়ি এনেছো?”
“না, রিক্সায় করে এসেছি।”
“চলো তবে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
মন নেচে উঠল। ভেতর ছেয়ে গেলো উত্তেজনায়। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করতে অপারগ সুশ্রী। সৌজন্যতার খাতিরে বললো,“না, না ভাইয়া। আমি নিজেই যেতে পারবো। সবই তো আমার চেনা।” অথচ মন বিদ্রোহ করল,“পৌঁছে দিন। আমি একা একা অতদূর যেতে পারবো না। খুব ক্লান্ত লাগছে।”
শিথিল জোর করল না। মন না চাইলেও ব্যাগটা গ্ৰহণ করল। কোনোভাবে বাবা জানতে পারলে নারাজ হবেন। একটা রিক্সা ডেকে চালকের হাতে ভাড়া গুঁজে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“আমার বোন হয়। সাবধানে পৌঁছে দিবেন কিন্তু।”
এরপর বিদায় নিয়ে সে হাঁটা ধরলো নিজের গন্তব্যে। অথচ একবার! একবার যদি ছেলেটা পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখতো! যদি দেখতো ঘামে স্নান করা এক অপরূপা যুবতী ঘোলাটে চোখে তার দিকে তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় তাকিয়ে আছে। তাহলে হয়তো নির্ঘাত আজ সর্বনাশ হতো শিথিল নামক যুবকটির!
চলবে _________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)