#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৮]
ব্যস্ততম একটি শহর। দিনরাত মানুষ ছুটে চলেছে নিজ নিজ গন্তব্যে। ভ্যাপসা গরমে পরনের পোশাক জবজবে ভেজা। তারপরেও কেউ থামছে না। থামলেই পিছিয়ে পড়বে যেন। ইভা মেয়েটা দুরন্ত আর ফাঁকিবাজ। খোলা বই সামনে রেখে পৃথিবীর নানাবিধ চিন্তায় মগ্ন থাকে আধ বেলা। পরীক্ষার আগের রাতেই শুধু মনে পড়ে সে যে একজন ছাত্রী। এই যে শিথিল আজ দেড় ঘণ্টা ধরে দুইটা সৃজনশীলের মোট ছয়টা অংক এত সুন্দর করে তাকে বুঝিয়েছে সেসব কিছুই তার গোল মাথায় ঢোকেনি।
শিথিল ধৈর্য্যহীন যুবক। এক কাজ বারবার করতে তার ভালো লাগে না। অল্পতেই ধৈর্য হারিয়ে বিরক্ত হয়ে যায়। আর সে কারণেই প্রথম বর্ষ শেষ করে দ্বিতীয় বর্ষে উঠে কান ধরে শপথ নিয়েছিল, উচ্চ মাধ্যমিক ব্যতীত অন্য কোনো শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের আর সে পড়াবে না। স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েগুলোকে পড়াতে বহুত ঝামেলা পোহাতে হয়। বুঝালেও বুঝতে চায় না। ওদিক দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে আবার তেমন একটা ঝক্কি নেই। অল্পতেই বুঝে যায়। তাই যেই ভাবনা সেই কাজ। স্কুল পড়ুয়া যে কজনকে পড়াতো তাদের মধ্যে একজন বাদে বাকি সবাইকেই পড়ানো ছেড়ে দেয় সে। সেই একজন ছাত্রটি আবার দশম শ্রেণীর। সপ্তাহে তিন দিন তাকে পড়ায় শিথিল। এর পেছনে বিশেষ কারণ রয়েছে। ছেলেটা অত্যন্ত শান্তশিষ্ট, ভদ্র এবং মেধাবী। শিথিলকে খুব মান্য করে। একেবারে বড়ো ভাইয়ের মতো। নবম শ্রেণিতেও ওর কাছেই পড়েছিল। তাই মায়ায় জড়িয়ে আর ছাড়তে পারেনি।
সে যাই হোক, ইভাকে পড়ানোর মাস দেড়েক হয়েছে। তাতেই সব ধৈর্য, আগ্ৰহ হারিয়ে ফেলেছে শিথিল। এই মেয়েকে পড়ানো কিংবা সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এক পড়া বারবার বোঝাতে হয়। ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে গত সপ্তাহে। বাংলা ব্যাকরণ আর আইসিটি বিষয়ে ফেইল করেছে মেয়েটা। তাও যে সে ফেইল নয় বরং লাজ লজ্জার মাথা খাওয়া ফেইল। বাংলা ব্যাকরণের জন্য তার আলাদা গৃহশিক্ষক রয়েছে। সেই শিক্ষক আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আইসিটিসহ উচ্চতর গণিত আর পদার্থ বিজ্ঞান এখন শিথিল পড়ায়। তাও শুরু করেছিল পরীক্ষার দশদিন আগে থেকে। এখন মেয়ে যদি ফেইল করে বসে থাকে তাহলে তার দোষটা কোথায়? অথচ দু দিন আগে তাকে ডেকে নিয়ে হতাশ কণ্ঠে মনোয়ারা বললেন,“ইভা তো ফেইল করেছে, বাবা। কী পড়ালে এতদিন?”
শিথিল অপমানিত বোধ করল। নম্র স্বরে বুঝালো,“ওর পরীক্ষার দশদিন আগে থেকে আমি এসেছি, আন্টি। তাই ফেইল কেনো করেছে তা তো ও আর ওর প্রাক্তন শিক্ষক-ই ভালো জানবে নিশ্চয়ই। তাছাড়া বাংলা আমি পড়াই না।”
ভদ্রমহিলা সেকথা বুঝলেন না। নিজের মতোই বলে গেলেন শুধু। শিথিল ভীষণ বিরক্ত হলো। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে তেমন কিছু বলতেও পারলো না। টিউশনির কী তার অভাব পড়েছে নাকি? যত্তসব। বাবার কথাতে এই মাসের শুরুতেই সে দুইটা টিউশনি ছেড়েছে। তারপরেও কত জায়গা থেকে অফার আসছে! তবে এটা সত্য, শিক্ষক হিসেবে শিথিল যথেষ্ট ভালো। দারুণ বোঝায়।
টেবিলের উপর মোটা বইটা শব্দ করে রাখলো শিথিল। চাপা ধমক দিয়ে বললো,“সমস্যা কী তোমার? আর কত বোঝাতে হবে? এইভাবে বুঝালে ছোটো বাচ্চাও বুঝে যেতো এতক্ষণে।”
ইভার শ্রবণালীতে সে কথা পৌঁছেছে কিনা কে জানে? মুখ ফুলিয়ে বললো,“আমার কী মনে হয় জানেন, ভাইয়া? আমার প্যারেন্টস নিশ্চিত আমায় কোথাও থেকে এডোপ্ট করে এনেছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল শিথিল। বকলেও ইভার গায়ে লাগে না। নির্লজ্জের মতো উদ্ভট সব কথা সে বলবেই। হাতের বই বন্ধ করে সাদা পৃষ্ঠায় কিছু বাড়ির কাজ লিখে দিতে দিতে শিথিল জিজ্ঞেস করল,“হঠাৎ এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”
“আমার পাপার নাক খাঁড়া, মামণির নাকটাও খাঁড়া। এমনকি ইফতির নাকটাও খাড়া কিন্তু আমার নাক কেনো বোচা, ভাইয়া? বংশের একমাত্র নাক বোচা লিজেন্ড আমি। তার উপর আমার কোনো স্বাধীনতা নেই। সারাক্ষণ পড় পড় করতেই থাকে। কলেজ, বাড়ি, টিউশন, হোম ওয়ার্ক করতে করতেই আমার দিন যায়। আ’ম সো টায়ার্ড! এতকিছুর পরেও কী মনে হয় আমি এ বাড়ির মেয়ে?”
কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে দুদিকে মাথা নাড়ায় শিথিল। গুরু গম্ভীর কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে,“ঠিক, আমারো তাই মনে হয়। তুমি ডিএনএ টেস্ট করে শিওর হতে পারো।”
মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটে উঠল ইভার। সহমত পোষণ করে বললো,“আইডিয়া ভালো। কিন্তু মনে হয় না পাপা রাজি হবে। মামণি জানলে তো আমায় ঝাটা পেটা করবে।”
“তাহলে আর কী? যেই হোমওয়ার্কগুলো দিয়ে যাচ্ছি সেগুলো মনোযোগ দিয়ে করে ফেলো। তারপর সারা রাত না ঘুমিয়ে না হয় দুঃখ সেলিব্রেট করো।”
ইভা হতাশ হয়ে টেবিলে মাথা ঠুকলো। ব্যাপারটা এবার সত্যি সত্যি সে বিশ্বাস করে নিয়েছে। আজকের দিনটা এই দুঃখেই কাটবে হয়তো। শিথিল এই সুযোগে বেরিয়ে এলো বিল্ডিং থেকে।
গ্ৰীষ্ম, বর্ষা, শীত আব্দুল মিয়ার চা দোকানে সারাক্ষণই উপচে পড়া ভিড় লেগে থাকে। চা ছাড়া কারোর চলেই না। এত কাস্টমার একা একা সামলাতে না পেরে সপ্তাহ দুয়েক আগে নতুন একটা ছেলেকে কাজে রেখেছেন তিনি। ঘামে ভেজা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বেঞ্চে এসে বসলো শিথিল। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজলো হয়তো। জিজ্ঞেস করল,“ভুলু কোথায় মামা?”
আব্দুল মিয়া এঁটো চায়ের কাপ ধুতে ব্যস্ত। খানিক বাদে বাদে গলায় প্যাঁচানো লাল গামছা দিয়ে ঘাম মুছছেন। বললেন,“কেডায় জানে কই? পেডে টান না পড়লে হেরে দেহা যায় নাকি?”
ভুলু হচ্ছে কমলা রঙের কুকুরটির নাম। এই নামের পেছনে অবশ্য বিশাল এক ইতিহাস রয়েছে। ভুলু যখন ছোটো ছিল তখন সে হারিয়ে যায়। ঘুরতে ঘুরতে এই চা দোকানে এসেই গেঁড়ে বসে আস্তানা। কয়েক বছর আগে কোনো এক কাস্টমারই খুব আদর করে তার নাম রেখেছিল ভুলু। এরপর থেকে ভুলু নামেই সে পরিচিত। যেখানেই থাকুক না কেনো, ভুলু বলে ডাক দিলেই সে হয়ে যায় হাজির।
এখন বিকেল। চারিদিকের রৌদ্রজ্জ্বল পরিবেশ দেখে তা অবশ্য বোঝার উপায় নেই। হ্যাংলা পাতলা ছেলেটি চা দিয়ে গেলো। চায়ে চুমুক দিয়ে শিথিল প্রশ্ন ছুঁড়ল, “দিনে কত টাকা রোজগার করেন, মামা?”
আব্দুল মিয়া ভারি লাজুক লোক। ঠোঁটের ডগায় সর্বদা হাসি লেগেই থাকে। মাথা নিচু করে লাজুক হেসে উত্তর দিলেন,“আল্লাহর রহমতে আলহামদুলিল্লাহ ভালাই হয়, মামা।”
“আহা, তা তো আপনার সহকারী রাখা দেখেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কত হয়? বলুন।”
“উমম, ধরেন ছয় সাত হাজার তো হইবোই।”
“এত! শুধু চা বিক্রি করে?”
“আরে না, মামা। সাথে কলা, রুডি, বিস্কুট, সিগারেট, পান মিলাইয়া।”
অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল শিথিল। মনে মনে হিসেব কষলো। বিড়বিড় করে বললো, “মাসে দুই লক্ষ দশ হাজার কামায়!”
দ্রুত পকেট থেকে মোবাইল বের করে বাবার নাম্বারে ডায়াল করল শিথিল। হামিদুল হক সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করলেন। ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,“মিটিং এ আছি। একটু পরে ফোন দেই।”
“এদিকে চা দোকানি আব্দুল মিয়া মাস শেষে লাখ লাখ টাকা রোজগার করে ধনী হয়ে যাচ্ছে আর তুমি নিজের ছেলেকে মিটিং এর ব্যস্ততা দেখাচ্ছো? এসব বাদ দিয়ে ঢাকা শহরে চলে এসো। বাপ-ছেলে মিলে চায়ের ব্যবসা করবো।”
“গরমে মনে হয় মাথার মগজে ঝামেলা দেখা দিয়েছে। বিরক্ত না করে ডাক্তার দেখা গিয়ে।”–ধমক দিয়ে কল কাটলেন হামিদুল হক।
শিথিল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও আর দিলো না। একটা সিগারেট ধরিয়ে কোনো এক ভাবনায় মগ্ন হলো। বাবা তার কোনো ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে গুরুত্ব দেন না কখনোই।
“স্মোক করা শুরু করলে কবে থেকে?বাবা জানেন?”
ললাটে ভাঁজ পড়ল শিথিলের। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ভাঁজের সংখ্যা বাড়ল। ঠোঁটের ভাঁজে চেপে রাখা সবে জ্বালানো আস্ত সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে জিজ্ঞেস করল,“হঠাৎ কোত্থেকে টপকালেন?”
“এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে দেখে ভাবলাম, শিথিল নাকি? এসে দেখি ভাবনা সঠিক।”
“এদিকে কেনো এসেছিলেন? সুবিধার লাগছে না।”
“অফিসের কাজেই এসেছিলাম। তোমার বোন জানে কিন্তু।”—–হাসলো মেহমাদ।
সে কথায় বিশেষ পাত্তা দিতে দেখা গেলো না শিথিলকে। হাঁক ছেড়ে ডাকলো,“মামা, দুধ আর চিনি বেশি করে দিয়ে আরেক কাপ চা পাঠান তো। আজকে আমার সমস্ত বিল আমার দুলা ব্রো দিবে।”
আব্দুল মিয়া হ্যাবলার মতো প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“দুলা বুরু আবার কী?”
“বোনের জামাই।”
“ওহ, দুলাভাই।”
“উহুম, উনাকে আমার পছন্দ নয় তাই ইংরেজিতে ডাকি।”
মেহমাদ হাসলো শুধু। হাসলে তার গালে টোল পড়ে। শিথিল আড়চোখে দেখলো তা। বিড়বিড় করে বললো, “এইভাবেই আমার সুন্দর বোনটাকে ফাঁসিয়েছে।”
“শুনে নিয়েছি।”
এবারো পাত্তা দিলো না শিথিল। মেহমাদ চায়ের অর্ডার ক্যান্সেল করে বিল মিটিয়ে এলো। বললো, “রাস্তার খোলামেলা দোকানে আমি চা খাই না। আনহাইজেনিক যত্তসব।”
“আপনার মতো কর্পোরেট আফিসার হলে আমিও একদিন এভাবেই মানুষের সামনে ভাব মারবো।”
সেসব কথা গায়ে মাখলো না মেহমাদ। আর পাঁচটা শালা দুলাভাইয়ের সম্পর্ক যেমন হয় তাদের সম্পর্কটা তেমন নয়। কিছুটা ব্যতিক্রম। প্রসঙ্গ যদি হয়, না ছুঁয়েও খোঁচা মেরে দেওয়া তাহলে সেই সুযোগটা মেহমাদের বেলায় কখনোই হাতছাড়া করে না শিথিল। মেহমাদকে ব্যক্তিগতভাবে সে ভীষণ অপছন্দ করে। তার অবশ্য বিশেষ কারণ রয়েছে। বড়ো বোন সুহাসিনীর সাথে ভদ্রলোকের ভালোবাসা বাসির বিয়ে। ফেসবুক প্রেম। একমাত্র বোনকে অতদূর যেতে দিতে নারাজ ছিল শিথিল।বিয়ে ভাঙার কম প্রচেষ্টা করেনি। কিন্তু পারেনি। ব্যাটা ঠিকই বিয়ে করে সুহাসিনীকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল সুদূর ঢাকায়।
মেহমাদই কথা বললো,“তা বাসায় আসো না কেনো? তোমার বোন তো তোমার চিন্তায় চোখের নিচে কালি বসিয়ে ফেলেছে।”
“নিজের দোষ আমার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।”
“সারাদিন ঘুরে বেড়াতে পারো অথচ বোনের সাথে দেখা করার সময় নেই?”
“উপাচার্য তো আপার শ্বশুর লাগে তাই আমি সারাদিন ঘুরে বেড়াই।”
“সব কথার উল্টো মিনিং বের করার উস্তাদ।”
“আপনার সব কথাই উল্টা।”
“তোমরা দুই ভাই-বোন আমাকে শান্তি দিবে না একটু? এই যে এখানে এসে বসে আছো। এর থেকে বোনের সাথে দেখা করে আসলেও তো পারো।”
“আমি আগেই সাবধান করেছিলাম। শুনেননি তাই এখন পস্তাচ্ছেন।”
“পস্তাবো কেনো? আমি তো হ্যাপি।”
“হ্যাপি কে? আপু জানে?”
“তুমি তো শালা আমার সংসার ভাঙতে চাইছো।”
“মিথিন হওয়ার পর সেসব ছেড়ে দিয়েছি।”
হতাশ হলো মেহমাদ। চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ করেই গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“আমার মা কিছু বলেছে?” সাথে সাথে প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ফের বললো,“বয়স্ক মানুষ, কী বলতে কী বলে ফেলে। ওসব ধরতে নেই।”
শিথিল সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,“এমন কথা কী আমার আপুকেও বলেন?”
“মানে?”—বুঝলো না সে।
“এই যে বয়স্ক মানুষ তাই যা ইচ্ছে বলতে পারবে কিন্তু বিপরীত মানুষের তা ধরা নিষেধ।”
মেহমাদ চটজলদি উত্তর দিতে পারলো না। শিথিল বললো,“একজন বলে যাবে আর অপরজন শুনবে, সহ্য করবে এ আবার কেমন কথা? তার কী মন নেই, অনুভূতি নেই? মুখ দিয়ে ভালোবাসি বললেই কিংবা ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে বাচ্চার বাপ হলেই সব জয় করে নিয়েছি ভেবে ফেলা উচিত নয়। প্রতি মুহূর্তে তার পাশে ঢাল হয়ে থাকতে হয়। এই বোঝ নিজের মাকে দিলে আজ বাইরের মানুষের কাছে নত স্বরে এসব বলার প্রয়োজন হতো না।”
মুখশ্রীতে মলিনতা ভর করল মেহমাদের। নিরব রইল। পরিবেশ হালকা করতে প্রসঙ্গ বদলে ফেলল শিথিল, “তা দুলা ব্রো, মাস শেষে কত টাকা বেতন পান আপনি?”
“হঠাৎ ব্যক্তিগত প্রশ্ন?”
“আহা, বলুন তো।”
“টেনেটুনে লাখের কাছাকাছি।”
“ছ্যাহ্! ওই দেখুন আব্দুল মামাকে। জীবনে প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। অথচ মাস শেষে চায়ের ব্যবসা করে দুই লাখের বেশি রোজগার করে।”
“সত্যি?”—-অবাক হলো মেহমাদ।
“তো কী মিথ্যে নাকি? বাবাকে ফোন করে বললাম, চলো চায়ের ব্যবসা শুরু করি। শুনলো না। ধমক দিয়ে ফোন কেটে দিলো। বোকা লোক একটা। যাই হোক, আপনি সঠিক সময়ে এসেছেন। চলুন আমরা দুজন মিলে শুরু করি। দোকানের নাম হবে, দ্য গ্ৰেট শালা দুলাভাইয়ের চায়ের দোকান। নামটা সুন্দর না?”
উপরনিচ মাথা নাড়ায় মেহমাদ,“সুন্দর। কিন্তু এই ছোটো একটা দোকান এতো বেচা কেনা হয়?”
“হুম হয়, হুদাই লেখাপড়া করছি। আপনি তো তবুও মাস শেষে লাখ খানিক পান। কিন্তু আমার বাবা তাও পায় না। কী এক অবস্থা! লেখাপড়ার কোনো দাম নেই।”
ছেলেটার আফসোস দেখে ঠোঁটের কোণে বিদ্যমান হাসিটা চওড়া হলো মেহমাদের। উঠে দাঁড়ালো। পকেটে হাত গুঁজে বললো,“পৃথিবীতে এত ধরণের খাবার থাকতে সিগারেট কেনো খেতে হবে? আজকের পর থেকে আর খাবে না। নইলে শ্বশুরমশাই অবধি খবর পৌঁছে যাবে।”
“আপনি তো বিশাল ব্ল্যাকমেইলার মিয়া! সোজা বাবার ভয় দেখান?”
“এটাই তো দুর্বল জায়গা।”
“দুলা ব্রো হয়ে ভাইগিরি দেখাবেন না। সংসারে গিট্টু লাগিয়ে দিবো।”
“লাভ হবে না। তোমার বোনকে জড়িয়ে ধরলেই সব ভুলে যাবে।”
“ছ্যাহ্, এই জন্যই বিবাহিত মানুষ আমার পছন্দ নয়। যান যান, বাড়িতে যান।”
“অফিস যাবো। কিছু রিপোর্ট জমা দিতে হবে।”
“তো যান, বিরক্ত করবেন না।”
“শালা না হয়ে যদি শালী হতে তাহলে তোমার অবস্থা খারাপ করে ছাড়তাম।”
“কত বড়ো লুচ্চা!”
হো হো করে হেসে উঠল মেহমাদ। আর আড়াল রাখতে পারলো না নিজস্ব সত্তা। শিথিল তার কাছে নিতান্তই বাচ্চা একটা ছেলে। তবে একটা কথা মানতে হবে, এই ছেলের কাছাকাছি যে থাকবে সেই প্রাণ খুলে হাসতে বাধ্য।
_____________
দুঃখের সংজ্ঞা মিশমির জানা নেই। জীবনে নেই কোনো চিন্তা। সর্বক্ষণ তার মন আনন্দে, হাসিতে নেচে বেড়ায়। বাবা-মায়ের ছোটো কন্যা হওয়ায় কোনোকিছুতেই তার বাঁধা নেই। ভালো, বাধ্যগত সন্তান হওয়ারও বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই। বড়ো বোন সুশ্রী থাকায় হয়তো বেঁচে গিয়েছে এতসব জটিলতা থেকে।
আবৃত্তি সবে কলেজ থেকে বেরিয়েছে।দুপুর পর্যন্ত ক্লাস করিয়ে কলেজ কর্তৃক আয়োজন করা হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এখনো অবশ্য সেই অনুষ্ঠান চলছে। শেষ হতে হতে সন্ধ্যা পেরোবে। গেইটের বাইরে পা রাখতেই ভীষণ চমকালো আবৃত্তি। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্কুল ইউনিফর্ম পরা মিশমি। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। এগিয়ে এসে খপ করে দু হাত দিয়ে আবৃত্তির বাহু জড়িয়ে ধরে দোলাতে দোলাতে বললো,“চলো যাই।”
“তুমি এখানে? স্কুল তো আরো আগে ছুটি হয়ে গিয়েছে।”
“তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। এবার চলো তো তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যে নামলে আর যেতে পারবো না।”
“কোথায়?”
“ঘুরতে।”
আরো প্রশ্ন করতে চাইলো আবৃত্তি। কিন্তু সেই সুযোগ তাকে দিলো না মিশমি। টানতে টানতে তাকে নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে একটা রিক্সা ঠিক করে উঠে পড়ল তাতে।
সেজো মামার বাড়িতে আসার প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গিয়েছে আবৃত্তির। শেষ পর্যন্ত হোস্টেলে তাকে আর পাঠাননি মোজাম্মেল হোসেন। তার বদলে প্রাক্তন কলেজ থেকে বদলী করিয়ে আশেপাশেরই একটি কলেজে ভর্তি করেছেন। আবৃত্তির কলেজ থেকে মিশমির স্কুলের দূরত্ব পায়ে হেঁটে তিন মিনিট মাত্র।
সকাল, বিকাল আর রাত্রির মধ্যভাগে ঢাকা শহরের পথে প্রান্তরে মানুষের আনাগোনা থাকে একটু বেশিই। চলার ফুরসৎ নেই। অসাবধান হলেই পড়তে হয় পকেট মারের খপ্পরে।আবৃত্তিকে নিয়ে নীলক্ষেতের বইভাণ্ডারে এসে হাজির হলো মিশমি। চোখেমুখে তার উপচে পড়া আনন্দ সমুদ্রের পানির মতো ঢেউ খেলছে। জায়গাটা আবৃত্তির অচেনা। আগে কখনো আসেনি। আশেপাশের মানুষদের দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল,“এখানে কেনো এসেছি? বই কিনতে?”
“না, বিক্রি করতে।”
বলতে বলতে ব্যাগের ভেতর থেকে বেশ কিছু বই করল মিশমি। পুরোনো বই। একেবারে প্রথমসারির প্রচ্ছদের। দোকানী ছেলেটার সামনে বইগুলো রেখে চঞ্চল কণ্ঠে বললো,“ফার্স্ট ক্লাস বই। প্রথম মলাটের। এমন বই আজকাল চাইলেও কোথাও পাওয়া যাবে না। কত দিবেন?”
ছেলেটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখলো বইগুলো। চকচক করে উঠল আঁখি। জিজ্ঞেস করল,“সত্যিই তো! পেলে কোথায়?”
“বলবো না। কত দিবেন?”
“কেজিতে কিনবো। দাঁড়াও মেপে নেই।”
মিশমি নাকোচ করল,“উহুম, তা হবে না আঙ্কেল। বাণিজ্যের ছাত্রী আমি। বোকা বানানো অত সোজা নয়। এখানে চারটা আছে। প্রতি পিচ দেড়শ নিবো।”
“আঙ্কেল? আমি?”—কণ্ঠস্বরে বিস্ময় খেলে গেলো ছেলেটির।
“সময় কম। রাজি থাকলে টাকা দিন, বই নিন। রাজি না থাকলে ঘাড় নাড়ুন। চলে যাবো অন্য দোকানে।”
“একটু বেশিই বলে ফেললে। এই পুরোনো বই এত দাম দিয়ে কে কিনে?”
“কেনার মানুষের অভাব পড়েছে নাকি? গেলাম চলে।”
বইগুলো হাতছাড়া করতে মন সায় দিলো না ছেলেটার। পুরোনো বই অধিক দাম দিয়ে সংগ্রহ করার মতো মানুষের অভাব সত্যিই নেই। তার নিজস্ব অনেক ক্রেতা রয়েছে। যারা প্রতি মাসে একবার হলেও এসে খোঁজ করে। আমতা আমতা করে বললো,“আচ্ছা, রাজি।”
“আটশ’র নিচে বেচবো না।”
মেয়েটির সুর পাল্টাতেই কপালে ভাঁজ পড়ল তার। সাথে সাথে প্রতিবাদ করল,“আটশ মানে? এখনি তো বললে প্রতি পিচ দেড়শ করে মোট ছয়শ নিবে। তাহলে দুশো বাড়লো কীভাবে?”
“সময়ের সাথে সাথে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের পরিমাণ বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবে তার সাথে টাকার মানও বাড়ছে। তাই যত দেরি করবেন দাম আরো বাড়বে। এখন কী করবেন দ্রুত বলুন। আমি খুবই ব্যস্ত মানুষ, আঙ্কেল।”
“আবার আঙ্কেল? কিন্তু টাকার মান তো মুদ্রাস্ফীতি হলে বাড়ে।”
“এবার আরো পঞ্চাশ টাকা……
ছেলেটা ভয় পেলো ভীষণ। দ্রুত বইগুলো নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলে উঠল,“না, না আমি রাজি। আর বাড়াতে হবে না।”
কুটিল হেসে আবৃত্তির দিকে তাকিয়ে চোখ মারলো মিশমি। আটটা একশ টাকার চকচকে নোট হাতে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে আনন্দিত কণ্ঠে বললো, “দেখলে আমি কত বুদ্ধিমতি? ব্যবসায় বিভাগের ছাত্রী হওয়ার এই এক ফায়দা।”
“এই বইগুলো কার? সুশ্রী আপুর বুকশেলফেই তো দেখেছিলাম মনে হচ্ছে।”
“মনে হওয়ার কিছু নেই। এগুলো সব আপুরই। কে জানে কোত্থেকে পেয়েছে?”
“আপু জানে?”
“এসব গোপন কথা কাউকে জানাতে হয়?”
“তার মানে!”—-আবৃত্তির কণ্ঠস্বরে বিস্ময় খেলে গেলো।
“আহা! মানে আবার কী? বুকশেলফ ভরতি বই রাখলে ঘরে তেলাপোকার বাচ্চা হয়। তাই ছোটো বোন হিসেবে ঘর পরিষ্কার করে দায়িত্ব পালন করেছি। সওয়াব হবে আমাদের। এখান থেকে দুইশ টাকা তুমি নাও। আর আজকের কথা ভুলে যাও।”
কী বলবে বুঝতে পারলো না আবৃত্তি। বইগুলো রোজ নিজ হাতে সুশ্রীকে যত্ন করতে দেখেছে সে। এই খবর জানতে পারলে কী হবে কে জানে? হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মিশমি,“মারহাবা, পেয়ে গেছি!”
“কী?”
“আমার আটাশ নাম্বার ক্রাশ অর্থাৎ আমার প্রাণপ্রিয় খালাতো ভাইকে। অনেক খিদে লেগেছে। চলো, ব্যাটার পকেট খালি করে আসি।”
“আটাশ নাম্বার ক্রাশ!”
হতভম্ব হলো আবৃত্তি। এ কার পাল্লায় পড়েছে ও? কেনো আসতে গিয়েছিল এই আধ পাগলির সঙ্গে? সুশ্রী আগে থেকেই ভালো করে সাবধান করে দিয়েছিল তাকে। অথচ ও কিনা!
চলবে ________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)