#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১০]
আজ মিথিনের জন্মদিন। পরিবারের একমাত্র ছেলে হওয়ায় সকলেরই ভীষণ আদরের সে। তাই বছরের বিশেষ এই দিনটি দাদা আর বাবা মিলে বেশ ধুমধাম করে, লোক খাইয়েই পালন করেন।
শহরের বেশ নামকরা একটি কমিউনিটি সেন্টারে ছেলের জন্মদিনের সমস্ত আয়োজন করেছে মেহমাদ। অতিথি বলতে তারই কিছু কলিগ, বন্ধু, ভাই-বোনের পরিবার, প্রতিবেশী আর বাবা-মায়ের দিকের আত্মীয়-স্বজনেরা এসে যোগদান করেছে। মিথিনের খুশি যেন আজ আর ধরছে না। সমবয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি আর দুষ্টুমি করছে সে। মাথায় বার্থডে ক্যাপ পরা। পরনে নতুন স্যুট ব্যুট।
“মিথিন!”
হঠাৎ কারো ডাকে পথিমধ্যে থেমে দাঁড়াল মিথিন।মেইন গেটের দিকে তাকাতেই উৎফুল্ল হয়ে উঠল তার দৃষ্টি।
“মামু!”
একপ্রকার চিৎকার করতে করতেই দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো শিথিলকে। শিথিল মুচকি হেসে কোলে তুলে নিলো ভাগ্নেকে। গালে গাঢ় চুমু দিয়ে বললো,“হ্যাপি বার্থডে, বুলবুলি।”
মিথিন গলা জড়িয়ে ধরলো মামার।আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজলো। জিজ্ঞেস করল,“মামু, নানাভাই কোতায়?”
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো শিথিল। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধুদের দল। তারাও এসে সমস্বরে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো মিথিনকে। তাদেরকে মিথিন চিনে না। তবুও খিলখিলিয়ে হাসলো। ফের জিজ্ঞেস করল, “গিফত কোতায়? দাও।”
শিথিল অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো,“এতদিন পর আমার কোলে চড়ছিস। এটা কী গিফটের চেয়ে কোনো অংশে কম?”
মিথিন মাথা নাড়ায়। ঠোঁট উল্টায়,“গিফত দাও।”
স্বাধীনের হাত থেকে বিশাল গিফটের প্যাকেটটা অন্য হাতে টেনে নিলো শিথিল। মিথিনের চোখের সামনে নাড়াতে নাড়াতে বললো,“এই যে তোর গিফট। এতে কী আছে জানিস?”
“না।”
“রিমোর্ট কন্ট্রোল কার। তবে একশর্তে এটা তোকে দিতে পারি।”
“কী সত্ত?”
“রিমোর্ট কন্ট্রোল কার আগে উচ্চারণ কর।”
মিথিনের কাছে ব্যাপারটা খুব সহজ মনে হলো। চঞ্চল কণ্ঠে সময় না নিয়েই বলে উঠল,“লিমট কনটল কার।”
তুহিন, শান্ত, সজীব শব্দ করে হেসে উঠল। আরফিন মুচকি হেসে এলোমেলো করে দিলো তার মাথার চুল। কিন্তু শিথিল হাসলো না। নাক খিচে বললো,“তোকে দিয়ে এ বছর আর এসব হবে না। থাক নে মামু, এমনিতেই এটা তোকে দিয়ে দিলাম আমি।”
শাশুড়ির সাথে অদূরে দাঁড়িয়ে অতিথিদের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করলেও ছেলের দিকে সতর্ক দৃষ্টি সদা ঘুরা ফেরা করছিল সুহাসিনীর। আচমকা ভাইকে দেখে চমকে গেলো সে। কতদিন পর শিথিলকে দেখলো তার হিসেব নেই যেন। দ্রুত হেঁটে এগিয়ে এসে ডাকল, “শিথিল!”
বোনের দিকে তাকালো শিথিল। হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছো, আপু?”
উত্তর দিলো না সুহাসিনী। ঠোঁট জোড়া কাঁপলো তার। মেয়েটা ভীষণ আবেগপ্রবণ। অল্পতেই কেঁদে ফেলা তার স্বভাব। শিথিল তা বুঝতে পারলো। আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফিসফিস করে বললো,“এখন আবার কেঁদো না। লোকে দেখলে বলবে কী? এক বাচ্চার মা কাঁদছে, ছিঃ!”
নাক ফুলিয়ে ভাইয়ের বাহুতে কিল বসালো সুহাসিনী। অভিমানী কণ্ঠে বললো,“তোর যে একটা বোন আছে সে কথা কি আদৌ তোর মনে আছে? আজই বা আসতে গেলি কেনো? বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তো তোদের পর হয়ে গিয়েছি আমি।”
শিথিল মুখ বাঁকালো,“দাওয়াত ছাড়া এসেছি বলে এমন করছো? তোমার জন্য আসিনি। আমার মিথিনের জন্য এসেছি। তাই না বুলবুলি?”
মিথিন মাথা নাড়ায়। মামাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। তাই মামার কথা কিছু বুঝুক আর না বুঝুক সহমত পোষণ সে করবেই। তাই স্পষ্ট করে বলে উঠল,“হুম, হুম। আমার জন্ন এসেচে।”
সুহাসিনী মুখ ভার করল,“অভিযোগ করছিস? আমার দোষ দিচ্ছিস? তোকে চারদিন ধরে ফোন দিচ্ছি। আজ সকালেও দিয়েছি কিন্তু ধরিসনি। ম্যাসেজ দিয়েছি, সিন করে রেখে দিয়েছিস। বাবাকে বললাম আসতে, কিন্তু বাবাও বলে দিলো আসতে পারবে না। এসব আমার পছন্দ নয়। তোরা আমায় পেয়েছিসটা কী?”
“গাধি।”
বিদ্রুপ করে সামনে এগোলো শিথিল। স্বাধীন, শান্ত, তুহিন, আরফিন, সজীব সালাম দিলো সুহাসিনীকে। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলে তাদের ভেতরে আমন্ত্রণ জানালো সুহাসিনী।সেসব দেখে মেহমাদের মা পারভিনের হাস্যোজ্জ্বল মুখে যেন আঁধার নামলো। তা দেখে শিথিল হাসলো। লম্বা সালাম দিয়ে বললো, “চারিদিকে এত আলো থাকার পরেও আপনার মুখে অমাবস্যা কেনো, আন্টি?”
পারভিন মুখ বাঁকিয়ে টেনে টেনে বললেন,“ওহ, তুমি এসেছো তবে? আমি তো ভাবলাম বোধহয় আসবেই না।”
“কি যে বলেন না, আন্টি! আমি না এলে আপনার থোতা মুখ ভোঁতা করবে কে?”
চোখমুখ কুঁচকে দাঁতে দাঁত চাপলেন ভদ্রমহিলা। চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন,“বেয়াদব।”
শিথিলের খুশি যেন আর ধরে না। মিথিনের গাল টেনে বললো,“এই কেক কাটা হয়ে গেছে?”
“না, এততু পর কাতবো।”
“এততু আবার কী? একটু বল ব্যাটা।”
“এততু।”
“আবার তোতলায়! লোকে শুনলে তো হাসবে। আমায় নিয়ে মজা উড়িয়ে বলবে, শিথিলের ভাগ্নে একটা তোতলা। মানসম্মান ডুবাতে চাস?”
কি বুঝলো কে জানে? আবারো খিলখিলিয়ে হাসলো মিথিন। তার হাসিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শিথিল। মেয়ে মানুষের মতো এত হাসির কী আছে? মেহমাদ তার ঘাড়ে হাত রাখলো,“আরে প্রিয় শালা যে!”
শিথিল হাতটা সরিয়ে দিলো। হাই তুলে বললো,“সব বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আপনার ব্যান্ড বাজাতে চলে এসেছি। আজ নিশ্চিত খাবারে কম পড়বে।”
“আগে থেকেই জানতাম, তাই সেই অনুযায়ী আয়োজন করে রেখেছি।এবার তুমি আমার ব্যান্ড বাজাতে পারবে না, শালা।”
“তাহলে তো আর হলো না, অপ্রিয় দুলা ব্রো। মনে হচ্ছে না আসাই বোধহয় উচিত ছিলো।” মন খারাপের ভান ধরলো শিথিল। মিথিনের দিকে তাকিয়ে উদাস কণ্ঠে বললো,“তোর বাপ তো অনেক চালাক হয়ে গিয়েছে রে প্রিয় ভাগ্নে। এখন আমার প্ল্যানের কী হবে?”
মামা আর বাবার খুনসুটিতে শরীর ঝাঁকিয়ে হাসলো মিথিন। ভ্রু কুঁচকে নিলো শিথিল। অভিযোগের সুরে বললো,“এই জিনিস কথায় কথায় এত হাসে ক্যান? আপনার মাল আপনার মতো হলে তো সমস্যা। বড়ো হয়ে আবার কার ভোলাভালা বোনকে না জানি ফাঁদে ফেলবে।”
“আমি তোমার বোনকে ফাঁদে ফেলেছি?”
“আলবাত ফেলেছেন।”
“এমন ভাব যেন বোনকে কখনো বিয়ে দিতে না। সারা জীবন ঘরে বসিয়ে রাখতে?”
“ঘরে বসিয়ে না রাখলেও আপনার সাথে দিতাম না।”
“এমন ভালো, হ্যান্ডসাম একটা দুলাভাই কজন পায় আজকাল? তোমরা গাজীপুরের মানুষেরা ভালো জিনিসের কদর করতে জানো না।”
“যদি ভালো হতেন!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে মিথিনকে কোল থেকে নামিয়ে অন্য দিকে হাঁটা ধরলো শিথিল। একপাশে দাঁড়িয়ে সফট ড্রিঙ্কস পান করছে স্বাধীন। শিথিলকে দেখে দাঁত কপাটি বের করে হেসে বললো,“ফাইনালি আমার না হওয়া বউয়ের সাথে সামনাসামনি দেখা হয়ে গেলো। কি যে ভালো লাগছে না!”
শিথিল বুঝতে পারলো না তার কথা। প্রশ্ন করল,“কার কথা বলছিস?”
“তোর বোনের কথা।”
বিরক্ত হলো শিথিল। ইশারায় মেহমাদকে দেখিয়ে বললো,“ওই যে আমার বোনের জামাই। প্রেম করে বিয়ে করেছে। ভালো করে দেখ, তোর থেকেও লম্বা চওড়া আর ফর্সা। বড়ো বড়ো মাসালও আছে। যদি জানতে পারে, ব্যাটার বউকে নিয়ে তুই এসব চিন্তা ভাবনা করিস তাহলে তোর নাক বরাবর ঘুষি মেরে আধমরা করে দিবে।”
মলিন দৃষ্টিতে একপলক মেহমাদের দিকে তাকালো স্বাধীন। এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের বাকি ড্রিঙ্কসটুকু পান করে নাক ছিটকে বললো,“শত্রুজ ইগ্নোর!”
তারপর মিথিনের মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করল, “শুভ জন্মদিন আমার না হওয়া বাচ্চা।”
___________
আজ বহুদিন পর আয়নার সামনে সাজতে বসেছে সুশ্রী। অলংকার আর শাড়িতে অগোছালো হয়ে আছে তার বিছানা। লেখাপড়ার চাপে নিজের সামান্যতম যত্ন নেওয়াটাও হয়ে ওঠে না মেয়েটার। রাত জেগে পড়তে পড়তে চোখের নিচে জমেছে ডার্ক সার্কেল। সেই ডার্ক সার্কেল ঢাকতে নিখুঁত হাতে লেপ্টে দিচ্ছে কনসিলার। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মিশমি। তাকিয়ে তাকিয়ে বোনের সাজ দেখছে বললে অবশ্য ভুল হবে। বরং কোথাও ভুল হচ্ছে কিনা সেই খেয়ালই রাখছে। সাজগোজে সে ভীষণ পারদর্শী কিনা!
কলেজে একসঙ্গে পড়া কোনো এক বান্ধবীর গায়ে হলুদ আজ। মেহেদীতে অবশ্য সুশ্রী যেতে পারেনি। সারা রাত জেগে রিপোর্ট তৈরি করে আজ আবার তা জমা দিতে গিয়েছিল। তাই অগত্যা বান্ধবী তার উপর ভীষণ রেগে আছে।
কাঁচা হলুদ রঙের একটি শাড়ি পরেছে সুশ্রী। মায়ের শাড়ি। এসব শাড়ি ফাড়ি পরতে সে পারে না। এমনকি সামলাতেও পারে না। ওরিয়েন্টেশনে একবার পরে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কুচি খুলে যা তা অবস্থায় ভুগতে হয়েছে। এরপর আর শাড়ি পরার চিন্তা মাথায় আনেনি। তবে আজ না পরে উপায় নেই। বান্ধবী লিলি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ‘শাড়ি পরে আসবি। সবাই মিলে গ্ৰুপ ফটো তুলবো।’ কী আর করার? নতুন বধূর কথা না শুনলে হয়?
আটপৌরে শাড়িটা শাহিনূর পরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। মেকআপ শেষে ঘন কালো চুলগুলো হিজাবের নিচে বন্দি করে সাজের সমাপ্তি ঘটিয়ে উঠে দাঁড়াল সুশ্রী। মিশমি চটজলদি তুলে ফেলল বেশ কতক ছবি। গম্ভীর মুখে বললো,“উহুম, এই সাজে একদম সুন্দর লাগছে না।”
বরাবরের মতো এবারো বোনের কথায় গুরুত্ব দিলো না সুশ্রী। বিছানায় বসে শাড়ি ভাঁজ করতে থাকা আবৃত্তির দিকে তাকালো। উচ্ছ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল,“আবৃত্তি তুই বল, কেমন লাগছে আমায়?”
মাথা তুলে সুশ্রীর দিকে তাকালো আবৃত্তি। দৃষ্টিতে জমলো মুগ্ধতা।নামের সাথে সাথে মেয়েটিও যে অত্যন্ত রূপবতী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। টানা টানা আঁখি, ঘন পল্লব, সরু নাক, চিকন ঠোঁট, ফর্সা মুখশ্রী। এ যেন স্বপ্নে দেখা এক পরী! প্রশংসা অথবা বর্ণনা করার মতো তেমন কঠিন কোনো শব্দ খুঁজে পেলো না আবৃত্তি। অস্ফুট স্বরে ছোট্ট করে বললো,“সুন্দর!”
লাজুক হাসলো সুশ্রী।মোবাইলে তোলা ছবিগুলো থেকে মাত্র একটি ছবি বাছাই করে সেন্ড করল কাউকে। এরপর বসে রইল অপেক্ষায়। সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে সেসব অবলোকন করল মিশমি। ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করল,“তোর তো বয়ফ্রেন্ডও নেই। তাহলে কাকে আবার ছবি পাঠালি?”
আঁচলের নিচে মোবাইল লুকিয়ে ফেলল সুশ্রী। শুকনো ঢোক গিলে মিথ্যে বললো,“এক ফ্রেন্ডকে। তুই চিনবি না।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিশমি। ভাবলেশহীন ভাবে বললো, “শিথিল ভাইকে, তাই না? চাপ নিস না। সিন করলেও শ্লা রিপ্লাই দিবে না। সেদিন আমি ছাদবাগানের বেলী ফুল কানে গুঁজে সেলফি তুলে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সিন করেনি।“
সুশ্রীকে দ্বিধান্বিত দেখালো। মুখ ফুলিয়ে মোবাইল বের করে আরেকবার চেক করল। ফলাফল শূন্য। তাদের কথা বুঝতে পারলো না আবৃত্তি। বুঝার চেষ্টাও করল না। অন্যের ব্যাপারে আগ্ৰহ তার বরাবরই কম। সে নিজের মতো একে একে শাড়িগুলো ভাঁজ করল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অলংকার, ব্যাগগুলো গুছিয়ে রেখে দিলো আলমারির ভেতরে। তারপর ভাঁজ করা শাড়িগুলো তুলে নিলো হাতে। এগুলো সব সেজো মামীর শাড়ি। সুশ্রী আর মিশমি মিলে নিয়ে এসেছিল পরার জন্য। সুশ্রী মুখ ভার করে বললো,“আমার একা যেতে ইচ্ছে করছে না। তুইও চল না, আবৃত্তি। কতবার করে বলছি। একা একা বাড়িতে থেকে লাভ কী?”
মিশমি ফুঁসে উঠল,“একা! একা কোথায়? আমাকে চোখে লাগছে না?”
“তুই হলি আমার জাত শত্রু। কোনো উপকারে তো আসবি না। ড্যাং ড্যাং করে শুধু ঘুরবি।”
ভেংচি কাটলো মিশমি। শুকনো হাসলো আবৃত্তি।অজস্র মানুষের কোলাহল তার পছন্দ নয়।নির্জনতা, একাকিত্ব তার রক্তে মিশে গিয়েছে। এসবেই সে অভ্যস্ত। হুটহাট অভ্যাস বদলানো যায় নাকি? বরাবরের মতো এবারো বললো,“তোমরা যাও। আমার এসব ভালো লাগে না।”
সেখানে আর দাঁড়াল না আবৃত্তি। শাড়ি নিয়ে চলে এলো সেজো মামার ঘরে। সেজো মামা বাড়িতে নেই। মালিবাগে নিজের দোকানে গিয়েছেন। পৌঁছে আবার গাড়িও পাঠিয়ে দিয়েছেন মেয়েদের জন্য। নিচে দাঁড়িয়ে আছে সেই গাড়ি।
সেজো মামী শাহিনূর বিছানায় বসে স্বর্ণের গহনাগুলো একটার থেকে আরেকটা আলাদা করে রাখছেন। অনেকদিন ধরে এগুলো বের করা হয়নি। মেয়ের উছিলায় আজ বের করেছিলেন। তবে কয়েকটায় বেশ ময়লা জমেছে। পালিশ করতে হবে। আবৃত্তি হাতের শাড়িগুলো বিছানার উপর রাখলো। বললো,“আপনার শাড়ি, মামী।”
“আচ্ছা।”
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পিছু ডাকলেন শাহিনূর। আবৃত্তি দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই বসা থেকে উঠে শাহিনূর চলে গেলেন আলমারির কাছে। দরজা খুলে কিছু একটা বের করে এনে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,“ধরো, এটা তোমার।”
ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো আবৃত্তির। হাতে নিয়ে বক্সটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে আশ্চর্য হলো ভীষণ। বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল,“মোবাইল!”
“হ্যাঁ, সেদিন মিশমির বলার পর আমিও ভেবে দেখেছি। আজকাল মোবাইল না থাকলেই নয়। তাই তোমার মামাকে বলে গত রাতে কিনিয়ে আনলাম। সকালে দিবো ভেবেও ভুলে গিয়েছিলাম।”
আনন্দে নেচে উঠল আবৃত্তির মন। একটা মোবাইলের খুব প্রয়োজন ছিল তার। কলেজে সবার মোবাইল থাকলেও তার নেই। ব্যাপারটা পীড়াদায়ক। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললো,“ধন্যবাদ, মামী।”
শাহিনূরের মুখভঙ্গির পরিবর্তন হলো না তেমন। পূর্বের মতো নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন তিনি। শুধু বললেন,“সুশ্রী, মিশমি বেরিয়ে গেলে দরজা আটকে দিও। আর আমার জন্য বেশি করে দুধ, চিনি দিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে দিয়ে যেও।”
আবৃত্তি মাথা নাড়াল। যেতে যেতে বলে গেলো,“দুধ না হয় বেশিই দিলাম। কিন্তু চিনি বেশি দেওয়া যাবে না। মামার নিষেধ।”
চট করে তার যাওয়ার পথে তাকালেন শাহিনূর। কিছু বললেন না। মেয়েটার প্রতি এখন আর তেমন একটা রাগ উনার নেই। বেশ কাজের মেয়ে। কিছু বলার পূর্বেই নিজ থেকে সব করে ফেলে শাহিনূরকে চিন্তামুক্ত করে দেয়।
_____________
সারাদিনের ঝক্কি ঝামেলায় সুহাসিনী ক্লান্ত। ছেলেটা ভীষণ দুষ্টু হওয়ায় বেশ বেগ পোহাতে হয় তার। একটা ধমকও আবার দেওয়া যায় না। শাশুড়ি চোখ রাঙান, কটু কথা বলেন, ছেলের কানে বিষ ঢালেন। শিথিল অবশ্য অনুষ্ঠান শেষে কমিউনিটি সেন্টার থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে ফিরে গিয়েছে নিজের গন্তব্যে। বাড়িতে আসার কথা বললেও শোনেনি।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হলো বেশ। সবাইকে পেছনে রেখে আগে আগে ফ্ল্যাটে ঢুকতেই সামনে তাকিয়ে চমকালো সুহাসিনী। কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থেকে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলো বিস্ময় ভরা শব্দ,“বাবা!”
হামিদুল হক বসে আছেন সোফায়। মেয়েকে দেখে মুচকি হাসলেন। আচমকাই সুহাসিনী দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরল বাবাকে। চোখের কোণে অশ্রু জমেছে তার। বাপ, ভাইয়ের উপর জমে আছে অনেক অনেক অভিযোগ। হামিদুল হক পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,“এখনো বাচ্চাই রয়ে গেলি।”
“একদম আমার সাথে কথা বলবে না। তোমার উপর আমি রেগে আছি।”
হামিদুল হক কিছু বললেন না। মেয়ের রেগে থাকার কারণ তিনি জানেন। এমনকি এটাও জানেন, একটু পর এই মেয়ের সব রাগ গলে যাবে। হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে যাবে অদৃষ্টে।
“নানাভাই!”
হাতের খেলনা দাদীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে উৎফুল্ল হয়ে ছুটে এলো মিথিন। সুহাসিনী নাক টেনে সরে বসলো। হামিদুল হক নাতিকে একটানে কোলে বসিয়ে গালে চুমু খেলেন। কতদিন পর দেখছেন তাকে! নাতিকে তিনি আবার ভীষণ ভালোবাসেন। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললেন,“শুভ জন্মদিন, নানা। কেমন আছো?”
“বালো। তুমি ওকানে এলে না ক্যানো?”
শিশু কণ্ঠে অভিযোগ ঝরে পড়ল। হামিদুল হক এসব পরিস্থিতি খুব সুক্ষ্মভাবেই সামলাতে জানেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে কথা! হেসে বললেন, “তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য বলিনি। তুমি সারপ্রাইজড হয়েছো, নানা?”
মিথিন উপরনিচ মাথা নাড়ায়। এমন ছোটোখাটো ইংরেজি শব্দ সে খুব ভালো করেই বুঝে। মাঝেমধ্যেই বাবা তার সাথে বলে। সোফায় রাখা সঙ্গে আনা ব্যাগটি মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে হামিদুল হক বললেন,“বছরে বছরে টাকা খরচা করে শুধু জন্মদিন পালন করলেই সন্তানের প্রতি সব দায়িত্ব পালন করে আদর্শ বাবা-মা হওয়া যায় না। এখানে সিফারা, আমপাড়া, ছোটোদের বর্ণমালাসহ সব বই রয়েছে। কাল থেকে পড়ানো শুরু করবি।”
সুহাসিনী বাবার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে খুলে দেখলো। সঙ্গে আনা ফল, মিষ্টি, মিথিনের জন্য সুস্বাদু সব খাবার নিয়ে এগিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। ভাসুর আদনান একটু আগে আগেই বাড়িতে চলে এসেছিল।আদনানের সাথে আবার হামিদুল হকের সম্পর্কটা বেশ ভালো। ভদ্রলোককে আদনান ভীষণ সম্মান করে। তাই হামিদুল হকের ফোনকল পেয়ে যখন জানতে পারলো, তিনি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তখনি মায়ের থেকে কায়দা করে চাবিটা নিয়েই চলে এসেছে এখানে।দরজা খুলে ভেতরে বসিয়েছে হামিদুল হককে।
পারভিন আর রফিকুল জামান এসে উনার মুখোমুখি বসলেন।স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আবার একরকম স্বভাবের। অহংকারে যেন মাটিতে পা পড়ে না। রফিকুল জামান মুখশ্রীতে অহংবোধ নিয়ে বললেন,“বাচ্চা মানুষ। এই বয়সে লেখাপড়া করলে বাকি জীবন কী করবে? এখন চাপ দেওয়া উচিত হবে না। আরেকটু বড়ো হোক।”
হামিদুল হক বুদ্ধিমান মানুষ। প্রত্যুত্তরে সহজভাবে বললেন,“ছোটো থেকেই ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। এখন যদি বাচ্চার হাতে খেলনা ধরিয়ে দেন, ছাড় দেন তাহলে সারাজীবন এসবেই মজে থাকবে। আবার এর বদলে যদি পাঁচবার নামাজের জন্য মসজিদে নিয়ে যান, ধর্মীয়, সামাজিক শিক্ষা দেন তাহলে বড়ো হয়ে নিজ থেকেই এসব করবে। এই যে আমার শিথিল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। খারাপ সঙ্গ নেই। কেনো নেই? সুশিক্ষার কারণেই তো। তাই বাচ্চাদের ছোটো থেকেই সঠিক শিক্ষা দিতে হবে। জ্ঞানের আবার বয়স কীসের? এখন শুরু করলে দশ এগারো বছরেই কোরআন তেলাওয়াত করতে শিখে যাবে।”
রফিকুল জামান দমে গেলেন। বেয়াই উনার শুরু থেকেই খুব চতুর। আজ পর্যন্ত উনার সঙ্গে কোনো কথাতেই জিততে পারেননি তিনি। তাই এই লোকের সাথে উনার তেমন বনে না।কথার শুরুতেই অপমানিত বোধ করেন।
চলবে ________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)