মেঘমেদুর দিনে পর্ব-১১+১২

0
65

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১১]

আজকের ভোর এলো খুব আয়োজন করে। ঘুম থেকে উঠেই আজ নিজ হাতে চা বানাতে হলো না হামিদুল হককে। খেতে হলো না হারুনের তৈরি ঝাল, নুনে পুড়া আধ সিদ্ধ খাবার। বাড়িতে বাবা আসার আনন্দে সেই কাক ডাকা ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করেই রান্নাবান্নার কাজে লেগে পড়ল সুহাসিনী। গরম গরম ফুলকো রুটি আর সাথে করল কষা মাংস। আহা কি তৃপ্তিদায়ক খাবার! তাও নিজ কন্যার হাতে, বহুদিন পর।

মেহমাদের বাবা-মা গতকাল রাতটা আদনানের ফ্ল্যাটে কাটিয়েছেন। আদনান আবার বউ সন্তান নিয়ে একই বিল্ডিংয়ে থাকে। উপরতলার ফ্ল্যাটটাই তাদের। নাস্তা সেরে নাতিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলেন হামিদুল হক। সকালের আবহাওয়া উনার ভীষণ প্রিয় কিনা।

“বুঝলে নানা, ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে খোলা আকাশের নিচে হাঁটার মজাই আলাদা। প্রতিদিন নিজে নিজে উঠে বাবার সাথে মসজিদে যাবে, ঠিক আছে?”

মিথিনের হাতে বিট লবণ মাখানো আস্ত একটা শসা।নানার কাছে চিপস চাইতেই নানা তাকে কিনে দিয়েছে শসা। সেটাই সে ইঁদুরের মতো সামনের ছোট্ট ছোট্ট দাঁত দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। খেতে খেতে বললো, “বাবা তো মসদিদে যায় না। আম্মু দাকলে বলে ইকতু গুমাতে দাও।”

“তুমি ডাকতে পারো না? ডেকে বলবে, চলো বাবা মসজিদে যাই।”

“আমিও উততে পারি না। পচুল গুম থাকে।”

“তাহলে তো হলো না, নানা। আল্লাহ তোমার উপর রাগ করবেন।”

“ক্যানো? আমি তো গুড বয়।”

“গুড বয়রা অত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় না। তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।”

“দাদা বলেছে আমার নামাজ পলার বয়ছ হয়নি।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হামিদুল হক। নামাজ ফরজ হয়নি বলে এসব শিখাবে বাচ্চাকে? এ তো গোঁড়ায় গলদ! নাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। অদূরে এক কিশোর রঙ বেরঙের বেলুন বিক্রি করছে। যা নজর এড়ালো না মিথিনের। বেলুন তার প্রিয়। ঘরের ভেতর উড়িয়ে দিয়ে খেলতে ভালো লাগে। তৎক্ষণাৎ সে চেঁচিয়ে উঠল,“নানাভাই নানাভাই, ওই যে বেলুন! কিনে দাও।”

কিছু বললেন না হামিদুল হক। মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের কিছু আবদার পূরণ করতে হয়। তাই মিথিনের হাতটা ধরে রাস্তা পার হলেন।রঙ বেরঙের পাঁচটা বেলুন কিনে হাঁটা ধরলেন বাড়ির পথে। মিথিনের খুশি আর দেখে কে?

সংসারের কাজের চাপে দুদণ্ড বসার সময়টুকুও নেই সুহাসিনীর। শ্বশুর-শাশুড়ি তার এখানেই খায়। বড়ো পুত্রবধূর রান্না আবার উনাদের মুখে রোচে না। বড়ো জন কোনো কাজের নয়। বাচ্চাদের দোহাই দিয়ে রান্নাসহ সবকিছু ছুটা বুয়াকে দিয়েই করায়। বুয়ার রান্না খাওয়া যায়? ছোটো ছেলের সংসারে আবার কাজের লোক নেই। মেহমাদ বললেও সুহাসিনী রাখেনি। অযথা বাড়তি টাকা খরচের কী প্রয়োজন? তবে সেই সুযোগে পারভিন তাকে দিয়ে বাড়তি কাজও করিয়ে নেন। তিনবেলা রান্না, রোজ সব ঘর ঝাড়ু দেওয়া, বাচ্চা সামলানো, কাপড় চোপড় ধোয়া থেকে শুরু করে বুড়ো বুড়িকে একটু পরপর চা বানিয়ে দেওয়ার ঝামেলা। একা হাতে আর কত করা যায়? অসহ্যকর।

মেহমাদ অফিসে গেলো না। তিনদিনের ছুটি নিয়েছিল। তাই দিনের অর্ধেকটা পরিবারের সাথেই কাটলো তার। শ্বশুরকে ছেলেটা আবার ভীষণ ভয় পায়। প্রেমিকার বাপকে ভয় পায় না এমন কোনো প্রেমিক আদৌ আছে নাকি পৃথিবীতে? যদিও এখন সে স্বামী হয়েছে তবুও সেই ভয় কাটাতে পারেনি।

দুপুরের ভোজন শেষে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে গল্প করছেন হামিদুল হক, আদনান আর মেহমাদ। রফিকুল জামান হা হু করে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন শুধু।

শিথিল এসে উপস্থিত হলো ঠিক দুপুর দুইটা ত্রিশ মিনিটে। কাঁধে বিশাল এক ব্যাগ ঝোলানো। ভাইকে হঠাৎ এভাবে দেখে ললাটে ভাঁজ পড়ল সুহাসিনীর। দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,“কী রে? নায়ক সেজে এলি যে? আর এই ব্যাগে কী?”

বোনের প্রশ্নের জবাব দিলো না শিথিল। ব্যাগ মেঝেতে রেখেই বাবার পাশ ঘেঁষে বসলো। হাফ ছেড়ে বললো, “ট্রেন তিনটা পনেরোতে ছাড়বে। চলো বাড়ি ফিরে যাই।”

সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন হামিদুল হক। মাঝেমধ্যে ছেলেকে চিনতে পারেন না তিনি। এই মুহূর্তে এর মতলব ঠিক সুবিধার লাগছে না। মুখে গাম্ভীর্য এঁটে জিজ্ঞেস করলেন,“কাল থেকে শুরু করে আজ দুপুর দুইটা পর্যন্ত কোথায় ছিলি?”

“কাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ক্লাসে ছিলাম। দুপুর থেকে সন্ধ্যা মিথিনের সাথে ছিলাম। সন্ধ্যা থেকে রাত নয়টা টিউশনে ছিলাম। সাড়ে নয়টা থেকে বারোটা পর্যন্ত মন দিয়ে লেখাপড়া করেছি। এরপর ঘুমিয়েছি। সকালেও ক্লাসে গিয়েছিলাম। একটায় ফিরে নামাজ পড়ে বাসায় গিয়ে সব গুছিয়ে এখানে চলে এসেছি, তোমাকে নিতে।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে দম ছাড়লো শিথিল। অবাক হওয়ার ভান ধরে নাটকীয় ভঙিতে আচমকাই বলে উঠল,“কত ভদ্র, বাধ্যগত ছেলে আমি! এই বয়সে এসেও বাবাকে সব বলে দেই।”

মেহমাদ চাপা শ্বাস ফেলল। শ্যালক যে কতটা ভদ্র তার চেয়ে ভালো আর কে জানে? সুহাসিনী বললো,“এসব নিয়ে পরে কথা হবে। খাবার বাড়ছি, খেতে আয়।”

“খাবো না, খেয়ে এসেছি।”

“খেয়ে এসেছিস মানে?”

“রুমমেট রান্না করেছিল। তাই খেয়ে এসেছি।”

সুহাসিনীর রাগ হলো। ভীষণ রাগ! রাগত স্বরে বাবার কাছে অভিযোগ জানাল,“দেখো বাবা। নিজ চোখে তোমার ছেলের কাজ কারবার দেখো। ওকে কল দিলে ঠিকমতো ধরে না। মাঝেমধ্যে নিজ থেকে কল দিলেও মিথিনের সাথে কথা বলেই রেখে দেয়। বাসায় আসতে বললে আসে না। ওর যে একটা বড়ো বোন আছে তা মনে আছে বলে তো মনে হয় না। আজ এলো তো এলো তাও আবার নাকি খেয়ে এসেছে। ওর আসলে সমস্যা কোথায়?”

হামিদুল হক ছেলেকে চোখ রাঙালেন। বাহুতে থাপ্পড় বসিয়ে মিছেমিছি ধমক দিয়ে বললেন,“বড়ো বোনের কথা শুনিস না কেনো, গর্দভ? ছোটো থেকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে এইদিন দেখার জন্য?”

নিরুত্তর রইল শিথিল। কিছু বলার প্রয়োজন মনে করল না যেন। তার নিরবতায় কষ্ট পেলো সুহাসিনী। ঘোলাটে হলো আঁখি। পল্লব ঝাপটে বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে স্থান ত্যাগ করল সে। মেহমাদ উঠে দাঁড়ালো। নম্র স্বরে বললো,“আপনারা বসুন, আমি দেখে আসছি।”

কথা শেষ করে স্ত্রীর পিছুপিছু ঘরে চলে গেলো সে। এই মুহূর্তে মেহমাদ ছাড়া কেই বা ভুলাবে সুহাসিনীকে? এরপর বেশ কিছুক্ষণ পাল্লা দিয়ে ড্রয়িং রুমে নিরবতা চললো। শিথিল পুনরায় বললো,“এখানে বসে থাকলে হবে না। দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাড়ি চলো।”

“তোর লেখাপড়ার কী হবে?”

“কিছু হবে না। কাল বন্ধ। এরপর বৃহস্পতি আর শুক্রবার।”

“তোকে নিয়ে আর পারি না। মাঝেমধ্যে কী যে হয়? বাচ্চামি শুরু করে দিয়েছে। কী প্রয়োজন ছিল হাসির মন খারাপ করে দেওয়ার?”

“আপুর কথা বাদ দাও। এখানে ওর বাবা-মা, ভাই, বোন, স্বামী, সন্তান সব আছে। একটু পর মন আবার ভালো হয়ে যাবে।”

তার নির্লিপ্ত ভাবভঙ্গি দেখে আর কিছু বললেন না হামিদুল হক। ছেলে-মেয়েদের তিনি অযথা কিছু বলেন না। তবে ওদের মা বেঁচে থাকলে হয়তো বাবা হিসেবে অনেক কিছুই বলতেন, ভয় দেখাতেন। কিন্তু সে তো আর নেই। তাই উনাকেই এই গুরু দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। বসা থেকে উঠে চলে গেলেন তিনি। প্রয়োজনীয় সবকিছু নিতে হবে। তার আগে মেয়ের সাথে কথা বলতে হবে, রাগ ভাঙাতে হবে।

শিথিল ছেলেটা কেমন যেন। অদ্ভুতও অবশ্য বলা যায়। অল্পতেই তাকে ভেতর থেকে চিনে ফেলা মুশকিল। তার প্রকৃতি বর্ণনা করাও হয়তো অসম্ভব। তবে এতটুকু বলা যায় যে প্রেম, ভালোবাসা, মায়ার থেকেও শিথিলের সব থেকে বড়ো এবং দামি সম্পদ হচ্ছে তার আত্মসম্মান। তার জীবনের এমন অনেক স্বভাবই সে পেয়েছে বাবার থেকে।

তখন জানুয়ারি মাসের মধ্যভাগ। তারিখ কত? উমম চৌদ্দ কিংবা পনেরো হবে হয়তো। নাকি সতেরো? সঠিক মনে নেই শিথিলের। তারিখ সে কখনোই মনে রাখতে পারে না। এর জন্য বন্ধুদের কাছে প্রায়শই বকা খায়। মিথিনের তখন ভীষণ অসুখ। জ্বর, সর্দি, কাশি।ডাক্তার দেখিয়ে নিয়মিত ওষুধ খাওয়ানোর পরেও সেরে ওঠার নাম নেই। সেই খবর পেয়ে ভাগ্নের পছন্দের সব খাবার নিয়ে ছুটে এলো শিথিল। বোনকে সে যতটা ভালবাসে মিথিনকেও ঠিক ততটাই ভালোবাসে। বাচ্চাটা যে ভীষণ আদরের।

মামাকে পেয়ে অসুখ ভুলে দুর্বল ছোট্ট দেহে মামার গলা জড়িয়ে ধরে বসে রইল মিথিন। ছেড়ে দিলেই যেন চলে যাবে মামা। শিথিল তাকে জড়িয়ে নিলো নিজের বাহু ডোরে। গরম কপালে চুমু খেলো। কোলে করে এদিক সেদিক হাঁটলো। মেহমাদ অফিসে। ইতোমধ্যেই ছেলের পেছনে দৌড়ে চারদিন অফিসে যাওয়া হয়নি।কর্পোরেট অফিসারদের আবার এমনিতেই খুব ব্যস্ততা।তার উপর এতদিন অফিস না গেলে চাকরি আদৌ থাকবে?চাকরি না থাকলে পরিবার চলবে কীভাবে?

সুহাসিনীর অবস্থা নাজেহাল। জোয়ান শাশুড়ি ঘরের কাজে ভুলেও সাহায্য করে না। বরং সময় অসময়ে ভুল ধরতে ওস্তাদ। অসুস্থ ছেলেকে নিয়েই সব কাজকর্ম একা হাতে সামলাতে হচ্ছিল তাকে। নাতিকে নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির আহ্লাদ শুধু মুখ দিয়েই। সরাসরি এক মুহূর্তের জন্যও সামলাতে পারে না। বিরক্তি নিয়ে বলে,“আর পারছি না, বউমা। তোমার কাছে যেতে চায়।”

মিথিন শিথিলের কোলে থাকায় সব কাজ শেষ করে হাফ ছেড়ে বাঁচলো সুহাসিনী। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো দুপুরে, খাবার টেবিলে। বাড়িতে যে কেউ এলেই অনেক আয়োজন করে সুহাসিনী। রাঁধতে, যত্ন করে খাওয়াতে তার ভীষণ ভালো লাগে। সেখানে শিথিল তার ভাই। নিজের মায়ের পেটের ভাই। বাড়িতে ভালো মন্দ রান্না হলে ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে সুহাসিনীর। ভাই বাসায় এলেও ভাইয়ের পছন্দসই রান্না করার চেষ্টা করে।

ব্যাচেলর থাকে সে। বুয়া কীভাবে রাঁধে না রাঁধে কে জানে? অসব খেয়ে মানুষ সুস্থ থাকতে পারে? শিথিল আবার সবার হাতের রান্না খেতে পারে না। তাই সেদিনও মোটামুটি আয়োজন করল সুহাসিনী। চার পদের লোভনীয় তরকারি আর সাদা ভাত। কিন্তু পারভিনের তা একদম সহ্য হলো না। ভদ্রমহিলা লোভী প্রকৃতির মানুষ। বিয়ের সময় একটা স্বর্ণের চেইন ছাড়া বাপের বাড়ি থেকে কিছুই সঙ্গে আনেনি সুহাসিনী। আসল কথা হচ্ছে, মেহমাদ আনতে দেয়নি। হামিদুল হক অনেক কিছুই মেয়েকে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু মেহমাদ মানা করেছে। অস্বীকৃতি জানিয়েছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে পণ নেওয়া তার অপছন্দনীয়। এতে সম্মান ক্ষুন্ন হয়। পুরুষের মেরুদণ্ড অকেজো হয়ে যায়। এসকল গুণাবলীর কারণেই তো নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে তাকে বেছে নিয়েছিল সুহাসিনী। আর হামিদুল হকও মেনে নিয়েছিলেন তাদের সম্পর্ক।

পারভিনের বিশেষ লোভ হামিদুল হকের গাজীপুরের বাড়িটির উপর। এই লোভ উনার মনে ঢুকিয়েছে স্বামী রফিকুল জামান। বেশ কয়েকবার ওখানে ঘুরতে যাওয়ায় তখনি মনে ধরেছিল। সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে দুতলা বাড়ি। জমিসহ এমন বাড়ির দাম আজকাল আকাশ ছোঁয়া! হামিদুল হক পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন তা। উনার বাবা সেকালে অনেক ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তখন তো জায়গা জমির দামও খুব কম ছিল। তাছাড়া আজকে যা শহর তখনকার আমলে তা ছিল ঘন জঙ্গল।

সেসব কথা যাক, সুহাসিনী একমাত্র মেয়ে। তার কী ওই বাড়ির উপর কোনো অধিকার নেই নাকি? আলবাত আছে। আর সুহাসিনীর যা তার সবই তো মিথিনের। সেটাই অনেকবার ছেলে, বউকে বুঝিয়েছেন পারভীন। সুহাসিনীর এক উত্তর,“আমি বিবাহিতা। স্বামীর যা আছে তা নিয়েই আমি খুশি এবং সুখী। বাবার ওই বাড়ির একমাত্র ভাগীদার আমার ভাই। তাই এ ব্যাপারে আর কিছু শুনতে চাই না, মা।”

মেহমাদ স্ত্রীর সাথে একমত,“সুহা যা চায় তাই হবে। আমাদের তো এখানে একটা ফ্ল্যাট রয়েছে। অযথা অসব ব্যাপারে কথা বলার কী প্রয়োজন, মা? এত লোভ ভালো নয়।”

এরপর এ ব্যাপারে কথা না বললেও শিথিলের উপর চাপা একটা ক্ষোভ উনার রয়েছে। সেই রাগটাই সেদিন উগড়ে দিলেন,“বিয়ের সময় তো বোনকে কিছু দিতেও পারেনি তোমার বাবা। অথচ দুদিন পরপর গাণ্ডেপিণ্ডে গিলতে চলে আসো?”

হতভম্ব হলো শিথিল। চমকাল, থমকাল। পারভীনের ঠোঁটের কোণে তখন বিশ্বজয়ের হাসি। সুহাসিনী চাপা স্বরে বললো,“এসব কী বলছেন, মা? ও আমার ভাই। ছোটো মানুষ। এ ধরণের কথা বলা কী খুব জরুরি ছিল?”

“তুমি তোমার ভাইয়ের সামনে আমায় অপমান করছো? আজ আসুক আমার ছেলে।”—হায় হুতাশ করতে লাগলেন পারভীন।

সুহাসিনী এরপর আর কিছু বললো না। তিলকে তাল বানাতে ভালো পারেন ভদ্রমহিলা। ভাইয়ের উদ্দেশ্যে আমতা আমতা করে বললো,“বাদ দে। গায়ে মাখিস না। খা তুই।”

পারভিন চলে যেতে যেতে বিদ্রুপ করে বলে গেলেন, “হ্যাঁ খাও, খাও। আবার কবে না কবে ভালো মন্দ খেতে পাও।”

কথাগুলো সূচের মতো শিথিলের গায়ে গিয়ে বিঁধলো যেন। তাদের অবস্থা বরাবরই ভালো ছিল। আহামরি ধনী না হলেও গরীব তারা নয়। বরং উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা যায়। মা ব্যতীত জীবনে আর কোনো কষ্ট বাবা তাদের পেতে দেননি। সেখানে এত বড়ো একটা অপমান! তাও খাওয়ার সময়? শিথিলের ইচ্ছে করল উঠে চলে যেতে। কিন্তু উঠতে পারলো না। বাবা ছোটোবেলায় শিখিয়েছিলেন,“আর যা কিছুর উপরেই রাগ করিস না কেনো, খাবারের উপর রাগ একদম করবি না। রিজিকের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ।”

তাই চুপচাপ খেয়ে শেষবারের মতো মিথিনের সঙ্গে দেখা করে সেই যে চলে এসেছিল এরপর আর কখনো এ বাসায় শিথিল আসেনি। এমনকি এ বাসার এক গ্লাস পানিও পান না করার শপথ নিয়েছিল। গতকালও না আসারই ইচ্ছে ছিল কিন্তু মিথিনের জন্য বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছিল।ছেলেটা মায়ের মোবাইল থেকে তাকে ভয়েস ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল,“মামা কালকে আমার দন্মদিন। বাবা বলেছে বড়ো কেক আনবে। তুমি না এলে আমি কান্না কলবো।”

এই সুন্দর আধভাঙা বাক্যে বলা কথাগুলো প্রত্যাখ্যান করার মতো দুঃসাহস কী তার আছে?
____________

লিলির বিয়ে হলো ঠিক দুপুর দুইটার এদিক ওদিক সময়ে। বিকেলের দিকে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে তাকে বিদায় দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে নয়টা বাজলো সুশ্রীদের। মেয়েদের উপর ভীষণ রেগে আছেন শাহিনূর। কোনো ভালো পরিবারের মেয়ে এত রাত পর্যন্ত বাইরে দিয়ে টো টো করে ঘুরতে পারে না। এ শিক্ষা মেয়েদের তিনি দেননি।

মোজাম্মেল হোসেন চোটপাট করলেন। আড়চোখে স্ত্রীর রাগত চেহারা দেখে কৃত্রিম ধমকের সুরে সুশ্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,“ফিরতে এত রাত হলো কীভাবে? বিয়ে তো সেই দুপুরেই শেষ হয়েছে। তুই সবার বড়ো। তোর কোনো কান্ড জ্ঞান নেই?”

বাবার সাথে সুশ্রীর সম্পর্ক ভালো। মায়ের হাতে মার খেলেও বাবার কাছে কখনো বকাটাও পর্যন্ত খায়নি। অপরাধীর ন্যায় মুখ করে নত স্বরে বললো,“অনেক দিন পর কলেজের বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ব্যস্ততার কারণে তো দেখাই হয় না। তাই ওদের সাথে একটু ঘোরাঘুরি করে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। সবসময় কী আর এমন হয়, বলো বাবা?”

“আচ্ছা আচ্ছা, যাও মায়ের কাছে গিয়ে স্যরি বলো।”

ইশারা করলেন মোজাম্মেল হোসেন। সুশ্রী সেই ইশারায় মাথা নাড়ল। কিছু বলার পূর্বেই শাহিনূর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“প্রয়োজন নেই। যা ইচ্ছে করুক গিয়ে। এখন বড়ো হয়েছে। কোনো কিছুতে মায়ের অনুমতি নেওয়ার আর দরকার আছে?”

মন খারাপ হলো সুশ্রীর। সত্যি বলতে সব দোষ এই মিশমির। মাঝপথে ডিনারটা রেস্টুরেন্টে করার জন্য সে-ই আবদার জুড়ে দিলো। অনলাইনে কয়েকদিন আগে এক নতুন রেস্টুরেন্টের সন্ধান পেয়েছে নাকি। শাফিনটাও হয়েছে এই মেয়ের মেল ভার্সন। এত করে অনুরোধ করল না! সুশ্রী আর না করতে পারলো না। আবৃত্তি তো আবার চুপচাপ মানুষ। তাকে যে পথে যেতে বলা হবে ও সে পথেই দৌড়াবে। গতকাল গায়ে হলুদে না গেলেও আজ তাকে জোরজবরদস্তি করেই নিয়ে যেতে হয়েছে।

ছেলে-মেয়েদের অপেক্ষায় রাতে দেরি করে খেতে বসলেন মোজাম্মেল হোসেন। সুশ্রী, শাফিন আর খেলো না। কিন্তু মিশমি যথা আজ্ঞা খেতে বসে পড়ল। বাইরে যতই গলা পর্যন্ত গিলে আসুক না কেনো, বাড়িতে এসে এক প্লেট ভাতে লেবু চটকে না খেলে সে স্বস্তি পায় না। আবৃত্তির অবস্থা আবার ভিন্ন। মানুষের ভিড়ে সে খেতে পারে না। লজ্জা পায়। তাই সেও বসলো একটি চেয়ার টেনে।

শাহিনূর গম্ভীর মুখে সবাইকে খাবার বেড়ে দিলেন। মিশমি মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে আচমকাই বলে উঠল,“মেয়েটা ভীষণ সুন্দর না, বাবা?”

মোজাম্মেল হোসেনের ভুঁড়িটা বেড়েছে। তাই আজ রাতে রুটি খাচ্ছেন তিনি। খেতে খেতে উত্তর দিলেন, “সুন্দর বলেই তো বিয়ে করেছিলাম।”

“কাজকর্মও তো ভালোই পারে।”

“আগে পারতো না। বিয়ের পর ধরে ধরে সব আমি শিখিয়েছি।”

“তবে রাগলে ভয়ংকর লাগে।”

“ইচ্ছে করে মুখে কস্টেপ লাগিয়ে দেই।”

বাবা, মেয়ে একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল। শাহিনূর রান্নাঘর থেকে খুন্তি হাতে দৌড়ে এলেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,“খাবার খাবে নাকি খুন্তির বাড়ি?”

দুজনেই ভড়কে গেলো। একে অপরকে ইশারা করে খেতে লাগলো। আবৃত্তি বিরস মুখে সেসব দেখে গেলো শুধু। ভেতরে কোথাও ভালো লাগা কাজ করল। কিছু মুহূর্ত অতিক্রম হতেই সেই ভালো লাগা বদলে গেলো আফসোসে। আজ নিজের মা বেঁচে থাকলে বাবার সাথে তার সম্পর্কটাও হয়তো এমন সুন্দর হতো। সুন্দর একটা পরিবার পেতো সে।

চলবে _________

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১২]

‘জমিনে অযত্নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা
চন্দ্রপ্রভার ভাঁজে,
মেঘহীন নীলাম্বরে ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে থাকা তীর্যক সূর্য রশ্মির পারদে,
তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো খুঁজে ফিরি
এক হরিণী চোখের শান্ত, জীবন্ত নারী মূর্তি।

এই তো সেদিন—
ভ্যাপসা গরমে, নরম আঁচলে ললাটের ঘাম মুছতে থাকা শ্যামবর্ণের মায়াবতী মেয়েটি!
হঠাৎ কোথায় গেলো চলে?

এতো এতো ভালোবাসা,
স্নিগ্ধ হাসি আর মায়ায় গড়া সুন্দর সংসার—
পারলো না তার পথ রোধ করে কি দাঁড়াতে?
নাকি স্রোতেরও থাকে এক গন্তব্য—
যেখানে থেমে থাকে মৃত্যু নামক শ্বেত বসনার নিয়তি?

তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে কি মৃত্যু?
মৃত্যুই কি তবে ভবিতব্য?’

গলা ধরে আসে শিথিলের। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে আজো হলদে চন্দ্রপ্রভা ফোটেছে গেটের কাছে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটিতে। কিছু আবার জমিনে লুটোপুটিও খাচ্ছে। সফেদ ডায়েরির ভাঁজে আটপৌরে শাড়ি পরা এক রমণীর সাদাকালো ছবি। এই রমণী শিথিলের মা।সেই ছেলেবেলায় সামনাসামনি দেখেছিল হয়তো। এখন আর চেহারাটা স্পষ্ট মনে পড়ে না তার। তবে সুহাসিনীর মনে থাকলেও থাকতে পারে।

পেছন থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল কেউ। শিথিল না তাকিয়েই বুঝতে পারলো মানুষটি কে। ছবিটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উদাস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“মাকে ভীষণ ভালোবাসতে, তাই না?”

হামিদুল হক জবাব দিলেন না। ছেলের হাত থেকে ব্যক্তিগত ডায়েরিটি নিয়ে রেখে দিলেন বুকশেলফে, ভারি ভারি বইয়ের নিচে। জবাবের আশা করল না শিথিল। দু হাত বুকে গুঁজে জানালার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। দৃষ্টি নীলাম্বরে স্থির। নিরেট কণ্ঠে বললো, “তোমায় দেখলে মাঝেমধ্যে আমি খুব অবাক হই। এত সুযোগ থাকার পরেও একজন পুরুষ এক নারীতে মজে, ভালোবেসে কী করে গোটা একটা জীবন পাড়ি দিতে পারে?”

হামিদুল হক না হেসে পারেন না। ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন গতকাল সন্ধ্যায়। আর আজ এবং এখন বিকেলের মধ্যভাগ। তবে বাইরের রোদ্দুরের ঝলকানি দেখে তা ঠাহর করা যাচ্ছে না। বিছানায় বসে প্রিয়তমার ছবিটা চোখের সামনে ধরেন হামিদুল হক। বলেন,“এই ছবিটা তোর মায়ের অজান্তে তুলেছিলাম। লুকিয়ে, চুপিয়ে। বিয়ের পাঁচ মাস চলছিল তখন। এমনই একটি দিন ছিল সেদিন। তোর মায়ের আবার ছবি তোলার ভীষণ শখ! কিন্তু সবার হাতে হাতে তখন আর এমন স্মার্টফোন ছিল না। যোগাযোগ হতো টেলিফোন কিংবা পত্রের মাধ্যমে। পাশের বাড়ির রফিক ভাইয়ের একটা ভাঙাচোরা ক্যামেরা ছিল। প্রতি পিস ছবির জন্য দুই টাকা করে নিতেন। তা অবশ্য সমস্যা ছিল না তবে বউকে অন্য পুরুষের সামনে ছবি তোলার জন্য দাঁড় করিয়ে রাখা আমার অপছন্দনীয় ছিল। আমার বউ আমিই দেখবো। অন্য কেউ কেনো দেখবে? তাই এক কাজের সুবাদে ঢাকায় গিয়ে কিনে আনলাম রিল আর ক্যামেরা। সেই রিলে প্রথম ছবিটা ছিল তোর মায়ের। আর সেই ছবিটাই হচ্ছে এটা।”

“সারা বাড়ি নিজ হাতে সামলে রাখা মায়ের একবারও চোখে পড়ল না?”

“না, আমার এক ইংরেজি বইয়ের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছিলাম। তোর মায়ের আবার বই দেখলেই মাথা ঘুরতো। প্রচুর ফাঁকিবাজ ছিল কিনা! বিয়ের পর পড়াতে চাইলাম। বললাম, মেট্রিক পাসটা অন্তত করো। নাহ, সে কিছুতেই পড়বে না। বই ধরলে নাকি তার ঘুম পায়। ভাব, কত বড়ো ফাঁকিবাজ!”

“তুমি কবিতা লিখতে পারো? কই বলোনি তো কখনো। চাইলে তো প্রকাশ করতে পারো। ভালো সুনাম পাবে।”

“এটাও তোর মায়ের জন্যই শেখা। তার আবার বই পড়তে ভালো না লাগলেও আবৃত্তি ভালো লাগতো। আমার কাছে সময় পেলেই বায়না ধরে বলতো, একটা কবিতা আবৃত্তি করো না। পারলে আমায় নিয়ে একটা কবিতা তৈরি করো দেখি।”

“করেছিলে? এটাই কি তবে?”

অধর থেকে হাসি মিলিয়ে গেলো ভদ্রলোকের। চোখের ঘোলাটে চশমা পাঞ্জাবিতে মুছলেন। উত্তর দিতে সময় নিলেন কিছুটা,“আরে না। এটা বছর দশেক আগের লেখা। তোর মা বেঁচে থাকতে আমি অসব কবিতা লিখতে পারতাম না। তবে একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছিলাম।”

“এরপর?”

“সমাপ্তি টানার আগেই আমাকে, তোদেরকে ছেড়ে চলে গেলো সে! যেভাবে এক মেঘমেদুর দিনে আমার সংসারে এসেছিল ঠিক সেভাবেই এক মেঘমেদুর দিনে চলে গেলো। আমার ‘মেঘমেদুর দিনে’ নামক উপন্যাস পড়ে রইল অর্ধ সমাপ্ত।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রস্থান করলেন হামিদুল হক। শিথিল নিজ স্থানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। ফুলে ফুলে রাঙা হয়ে ওঠা চন্দ্রপ্রভার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে। টুনটুনি পাখি কিচিরমিচির করছে চারিদিকে। ভাগ্যবতী নারীরা বুঝি এভাবেই প্রেমিক পুরুষের ভালোবাসার অমৃত সুধা পান না করে দুনিয়া ত্যাগ করে?

উত্তর পেলো না শিথিল। তবে তাই যদি হয় তাহলে সে নিজের কাছেই নিজে শপথ করে। অত্যধিক ভালো সে কাউকে বাসবে না। অতি ভালোবাসা মানুষকে ঠেলে দেয় একাকিত্বে। কষ্ট দেয়। যা তার বাবা প্রতিনিয়ত পাচ্ছে।

হারুন চাচা ড্রয়িং রুমে বসে লোহা আর বালুতে ঘষে বঁটি ধার দিচ্ছেন। হামিদুল হক এখন হাঁটতে বের হবেন। মাগরিবের নামাজ পড়ে টং দোকানে চা খেয়ে তারপর বাড়ি ফিরবেন। এটাই দৈনন্দিন রুটিন। সদর দরজার দিকে যেতে যেতে ধমকের সুরে বললেন, “বঁটি ধার দিচ্ছিস কেনো, আহাম্মক? কাটাকাটি তো ছুরি দিয়েই সহজ।”

হারুন চাচা হাসলেন। হামিদুল হক কিছু বললেই তিনি শুধু হাসেন। উনার হাসি সুন্দর।পান খাওয়া ঠোঁটগুলো দেখতে যেন একেবারে টিয়া পাখির রঙিন ঠোঁটের মতন লাগে। বললেন,“আমি ছুরি কাঁচি দিয়া কাটতাম পারি না, ভাইজান। ছুডু বেলায় মা, চাচী গো তো এই বঁটি দিয়াই কাটতে দেখছি।”

“এসব বাদ দিয়ে বাইরে আয়। একটু আলো বাতাস গায়ে মাখ।”

হারুন চাচা প্রত্যুত্তর করলেন না। একটা কাজ ধরলে তা শেষ না করে তিনি উঠেন না সহজে। তাই এবারো উঠবেন বলে মনে হলো না।

হারুন চাচা হামিদুল হকের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। পাশাপাশি গ্ৰামে বাড়ি। একই স্কুলে পড়েছেন। অভাবের সংসারে মা রাতের বেলা পরপুরুষের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে ঘর বেঁধেছিলেন অন্যত্র। এরপর বাবা করলেন আরেক বিয়ে। সৎ মায়ের সংসারে খেতে পেতেন না বেচারা। প্রায় প্রায়ই চলে আসতেন হামিদুল হকদের বাড়ি। উনার বাবা ছিলেন আবার দয়ার সাগর। ছোট্ট হারুনের কষ্ট সহ্য করতে পারলেন না। হারুনের বাবার সঙ্গে কথা বলে রেখে দিলেন নিজের কাছেই।

হারুন চাচা বোকা কিছিমের মানুষ। উনাকে যা বলা হবে তাই হাসিমুখে মেনে নিবেন। যদি ভুলেও বলা হয়, কারওয়ান বাজার থেকে আলু কিনে নিয়ে আয়। উনি কোনো কিছু না ভেবে তাই করবেন। আর এই বোকা স্বভাবের কারণেই লেখাপড়াটা উনাকে দিয়ে আর হলো না। প্রাইমারির গণ্ডি ঠিকমতো পেরিয়েছেন কিনা সন্দেহ। এরপর ধার দেনা করে উনার বাবা উনাকে বিদেশ পাঠালো। দালালের খপ্পরে পড়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারলেন না ওখানে। এরপর আর কী? চলে এলেন দেশে। এর ওর ক্ষেতে খামারে, বাড়িতে কামলা খেটে ঋণ শোধ করলেন। বাপের যা সম্পত্তি ছিল তা আবার দখল করে নিয়েছিল সৎ ভাই-বোনেরা।

হামিদুল হকেরা দুই ভাই দুই বোন। বোনেরা পরিবার নিয়ে আমেরিকা, জার্মানিতে থাকে। বছরে একবার দেশে আসে হয়তো। তখন দেখা হয়। আর ভাইটার সাথে দণ্ড চলছে। সেই দণ্ডের সূচনা হয়েছিল বাবা মারা যাওয়ার পর। সম্পত্তি নিয়ে। উনার ভাই প্রচুর লোভী। সব সম্পত্তি একাই শোষণ করতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে গাজীপুরের এই বাড়িটা। দুর্ভাগ্যবশত পারেননি। কলেজে শিক্ষকতার সুবাদে বাবা বেঁচে থাকতেই এই বাড়িটা উনার নামে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন। তবে এই দিক দিয়ে তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। ছোটো ছেলেকে শহরের বাড়িটা দিলেও গ্ৰামের বাড়িটা আবার লিখে দিয়েছিলেন বড়ো ছেলের নামে। সেই বাড়িতে কি নেই? বিশাল নারিকেল, আম, জাম, লিচু আর কাঁঠালের বাগান। পাশেই ছোট্ট একটা মাছ চাষের পুকুর। কিন্তু বাকি জমিজমা ভাগ করে দেওয়ার আগেই মারা গেলেন। এরপর সেই সুযোগে চাষের জমিগুলো দখল করে নিলেন বড়োজন। সব ভাই-বোনদের ভাগের জমি রাক্ষসের মতো একাই ভক্ষণ করা শুরু করলেন।

এ নিয়ে অবশ্য কম ঝামেলা হয়নি। বোনেরা মামলা পর্যন্ত করেছিল। সেই মামলা এখনো চলছে। হামিদুল হক বেশিদূর আর যাননি। স্ত্রীর মৃত্যুতে অনেক শোকাহত হয়েছিলেন ভদ্রলোক।মা মরা সন্তান দুটোকে নিয়ে সংসার সামলে আবার চাকরি!এরপরেও ভাইয়ের সাথে সম্পদ নিয়ে কোর্ট কাছারি করার সময় কোথায়? তখনি গ্ৰামে গিয়ে হারুন চাচাকে পেলেন। বেচারা বিয়ে করেননি। বাবা-মায়ের সংসার দেখে নিজের সংসারের শখ ঘুচে গিয়েছে। তবে বাচ্চাদের প্রতি উনি ভীষণ উদার। সহজেই ভাব জমিয়ে ফেলতে পারতেন। শিথিলের সাথেও অল্প কদিনেই জমিয়ে ফেলেছিলেন ভাব।

তা দেখেই উনাকে নিজের কাছে এনে রাখলেন হামিদুল হক। ভরণ পোষণের সমস্ত দায়িত্ব তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। এরপর থেকে হারুন চাচা এই পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এখানেই থাকেন। তবে মাঝে মধ্যে মাথার তার ছিঁড়ে গেলে কয়েকদিনের জন্য গা ঢাকা দিতেও ভুলেন না।
________

সন্ধ্যার দিকে বাড়ি থেকে বের হলো শিথিল। গাজীপুর তার নিজের শহর। এখানকার প্রতিটি আনাচে কানাচে তার চেনা। ঢাকা শহরে যেমন তার অনেক বন্ধু আছে। চায়ের দোকানের পাশে বসে থাকা ভুলু আছে ঠিক তেমনি এখানেও তার অনেক বন্ধু আছে। স্কুল, কলেজ এর বন্ধু। যাদের সাথে একসঙ্গে সে লেখাপড়া করেছে। ছোটো থেকে বড়ো হয়েছে। টিফিন ভাগাভাগি করে খেয়েছে। কিংবা পিরিয়ড মিস দিয়ে দেয়াল টপকে শহীদ মিনার, স্টেডিয়ামে বসে আড্ডা দিয়েছে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে আজকেও স্টেডিয়ামে গিয়েই বসলো শিথিল। ছেলেরা তখন মাঠে ক্রিকেট অনুশীলন করছে।কয়েকদিন বাদে তাদের একটা টুর্নামেন্ট আছে। সেখানে যেতেই পরিচিত মানুষদের সাথে দেখা হয়ে গেলো। এখানকার বেশিরভাগ ছেলে শিথিলকে চিনে। ছাত্র থাকাকালীন স্কুল, কলেজের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে সে জয়ী হয়ে পুরষ্কার নিয়ে ফিরেছে। তার উপর তার ব্যাচে যে তিনজন বুয়েটে চান্স পেয়েছিল তাদের মধ্যে শিথিল ছিল একজন। তাই মুখটা হয়তো কেউ ভুলেনি। সত্যি বলতে, সফলদের ভুলে যাওয়ার মতো মানুষ আছে নাকি আজকাল?

পরিচিত জুনিয়রদের থেকে মাঠে ডাক পড়ল তার। না করার পরেও জোর করে নিয়ে যাওয়া হলো খেলার জন্য। অনেকদিন খেলাধুলা হয় না। ব্যাট দিয়ে মারা হয় না ছক্কা। আজ সেই শূন্যতা পূরণ করে দিলো শিথিল। পরপর তিনটে ছক্কা মেরে। মুহূর্তেই মাঠে হইহই রইরই পড়ে গেলো। উল্লাসে ফেটে পড়ল সকলে।

মাঠ থেকে বের হওয়ার অভিমুখে হঠাৎ কেউ এসে পথ রোধ করে দাঁড়াল। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো, “চিনতে পেরেছিস? আমি সিফাত। এক কলেজে, এক ব্যাচে পড়তাম।”

পরিচয় না দিলেও ছেলেটিকে চিনতে অসুবিধা হতো না শিথিলের। এর পেছনে অবশ্য কারণ একটা রয়েছে। বলা চলে,কলেজ লাইফে সিফাতের সাথে প্রতিযোগিতা পূর্ণ সম্পর্কই তার ছিল। একে অপরের থেকে কীভাবে এগিয়ে যাবে সেই চিন্তাতেই মশগুল থাকতো। অথচ এইচএসসির পর আর দেখা হলো না তাদের। নিজ নিজ জীবনের ব্যস্ততায় হয়তো কেউ কাউকে মনে করার সুযোগই পেলো না।

শিথিল তার সাথে কোলাকুলি করল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,“হ্যাঁ, চিনেছি। তোকে না চিনলে হয়? তা কেমন কাটছে দিনকাল?”

“আলহামদুলিল্লাহ চলছে। আর তোর? কী করছিস আজকাল? কোথায় পড়ছিস? অনেকদিন দেখা হয় না। কারো সাথে যোগাযোগও নেই। তাই জানা নেই কিছু।”

“আমারো আলহামদুলিল্লাহ ভালোই চলছে। আমি অবশ্য পুরোনো বন্ধুদের কাছে বেশ কয়েকবার তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তারা বলেছিল যোগাযোগ নেই। তা কী খবর বল? ক’দিন পর বড়ো ডাক্তার হয়ে যাবি বলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে ইজ্জতের ফালুদা হওয়ার চান্স ছিল নাকি?”

মলিন হাসলো সিফাত। দুদিকে মাথা নাড়ল,“আর বড়ো ডাক্তার হওয়া! সেই স্বপ্ন দেখা অনেক আগেই ছেড়ে দিতে হয়েছে।”

“কেনো?”

“টিকিনি। আসলে কোথাও চান্স হয়নি।”

অবাক হলো শিথিল। সে জানে, ছোটো থেকেই সিফাতের স্বপ্ন ছিল মস্ত বড়ো ডাক্তার হওয়া। ডাক্তার হয়ে সে বিনা পয়সায় গরীবদের সেবা করবে। তার কোন এক চাচাও নাকি ডাক্তার ছিল। সেখান থেকেই তার স্বপ্ন দেখা শুরু। এই গল্প বহুবার শুনেছে শিথিল। সিফাতের মুখ থেকেই। তার জন্য রাতদিন এক করে ছেলেটা পড়েছেও। অথচ! জোরপূর্বক হাসলো শিথিল। বললো,“আরে মন খারাপ করিস না তো। হয়তো তোর ভাগ্যে লেখা ছিল না। আল্লাহর সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য আমাদের চেয়েও উত্তম এবং সুন্দর। মানিস তো?”

“মানি বলেই বেঁচে আছি।”

“তা এখন কোথায় পড়ছিস?”

“ন্যাশনালে, পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে।”

করুণ শোনালো সিফাতের কণ্ঠস্বর। থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“প্রথমবার কোথাও হলো না। ন্যাশনালেও আবেদন করিনি। এরপর দ্বিতীয়বার দিলাম। পোড়া কপাল! দ্বিতীয়বারও হলো না। ভাগ্যিস এবার ন্যাশনালে আবেদন করে রেখেছিলাম!”

সিফাতের জন্য চট করেই মন খারাপ হলো শিথিলের। সে তো জানতো ছেলেটা কত পরিশ্রমী ছিল! এভাবে জলজ্যান্ত এক মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ! কতটা কষ্টকর হয়? পুরো সন্ধ্যাটা সে সিফাতের সাথেই কাটালো। সময় নিয়ে, মনোযোগ দিয়ে শুনলো ব্যর্থতার গল্প। এত এত সফলতার ভিড়ে এই ব্যর্থতার গল্পগুলো যে কতটা ভয়ংকর তা টের পেলো।

গাজীপুরে রাত নামে ভীষণ আয়োজন করে। এখানে সন্ধ্যা মানেই চারিদিক ছিমছাম। বাড়ি ফিরে কোথাও বাবাকে দেখতে পেলো না শিথিল। নিরবে হাত-পা ধুয়ে মোবাইল হাতে বাবার ঘরে এসে এলোমেলো হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। গোটা বাড়িটার মধ্যে বাবার ঘর আর ছাদটাই ভীষণ প্রিয় তার‌। একটা শান্তি শান্তি গন্ধ পায়।

ওয়াইফাই অপশন কানেক্ট করতেই ম্যাসেজের চক্করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মোবাইলটা হ্যাং হয়ে গেলো। বিরক্ত হলো শিথিল। দুদিন ধরে অনলাইনে যাওয়া হয়নি। তাই বলে এত ম্যাসেজ? মরে গিয়েছে নাকি যে এত ম্যাসেজ পাঠাতে হবে? ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে ধীরে ধীরে ম্যাসেজগুলো চেক করল। প্রত্যেক বন্ধুর থেকেই ম্যাসেজ এসেছে। তার মধ্যে জ্বলজ্বল করা মাইমুনা হক সুশ্রী নামটা দেখে দু ভ্রুয়ের মাঝখানে ভাঁজ পড়ল। ওপেন করতেই চোখে পড়ল সুন্দর একটি মেয়ের ছবি। শিথিল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে বার কয়েক মনোযোগ দিয়ে দেখলো তা।

সুশ্রীর সৌন্দর্যের সঠিক ব্যাখ্যা শিথিলের কাছে নেই। কাব্যিক ভাষায় ভীষণ অপটু সে।তবে এই মুহূর্তে ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে এ যেন মনুষ্য বেনে বউ। চট করে টাইপ করল,“এত সেজে কোথায় গিয়েছিলে?”

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। পুনরায় লিখলো,“সুন্দর লাগছে। তবে মেকআপটা মনে হচ্ছে একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে।”

এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের ম্যাসেজের ত্যাড়া বাঁকা রিপ্লাই দিলো। ওদিকে তৌসিফ তাকে ইনভাইট দিয়ে রেখেছে গেমে। ম্যাসেজও ওখানেই দিয়েছে। তৌসিফের ম্যাসেজ মানে গেম সম্পর্কিত যত কথা। গেম নিয়ে ছেলেটা ভীষণ সিরিয়াস। লেখাপড়ার পর যত সময় থাকে সবটা গেমের পেছনেই নষ্ট করে। এ নিয়ে তার একটা ইউটিউব চ্যানেলও রয়েছে। জোর করে শিথিলকে দিয়ে সাবস্ক্রাইব করিয়ে নিয়েছিল। ক’দিন আগে চ্যানেলে ঢু মেরে দেখে এসেছে শিথিল। ফলোয়ার লাখ ছুঁতে আর কিছুটা বাকি।

আজকের দিনটা সুশ্রীর বাড়িতেই কেটেছে। তার দিন বাড়িতে কাটা মানে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকা। বই পড়ে কি সুখ যে সে পায় কে জানে? অনেকক্ষণ চেয়ারে বসে থেকে কোমরে ব্যথা ধরেছে। এবার একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। মোবাইলটা নিয়ে বিছানায় শুয়ে অনলাইনে ঢুকতেই বিস্ময় আর আনন্দ একত্রে জেঁকে বসলো তার উপর। উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলো শরীর। অবশেষে শিথিলের ম্যাসেজ এসেছে! ম্যাসেজগুলো বার কয়েক পড়ল। দৃষ্টি শুধু ঘুরঘুর করল সুন্দর উপমা জুড়ে। এরপর গায়ে হলুদের রাত থেকে শুরু করে বিয়েতে তোলা সমস্ত ছবি পাঠিয়ে দিলো। কি কি হয়েছে লিখে গেলো নিজ থেকে।

এমন স্বভাব সুশ্রীর সাথে যায় না। সে বোঝদার মেয়ে। কিন্তু শিথিল নামটা এলেই সেই বোঝ যে কোথায় চলে যায় কে জানে? যদি জানতে পারতো মেয়েটা, যদি পারতো নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে তাহলে হয়তো!

বাইরে থেকে বাবার ডাক এলো। তৎক্ষণাৎ শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াল শিথিল। ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোতেই দেখা মিললো বাবার। হারুন চাচা রাতের খাবার বাড়ছেন। রাত নয়টার মধ্যে আহার করে ঘুমাতে যাওয়া হামিদুল হকের দৈনিক রুটিনের একটি নিয়ম। তাই বাড়িতে থাকাকালীন বাবার সেসব নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলে শিথিল। যদিও নিয়ম ভঙ্গের কোনো কারণ নেই। তার বাবা ভীষণ ভালো। পৃথিবীর সব বাবাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। শিথিল তাই মনে করে।

হামিদুল হক হাত ধুয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,“তাড়াতাড়ি খেতে বোস। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।”

টেবিলে উঁকি দিলো শিথিল। বিফ বিরিয়ানি, বোরহানি, সালাদ, চিকেন চাপ বেড়ে হারুন চাচাও বসেছেন। সেও হাত ধুয়ে এলো দ্রুত। বললো,“ওয়াও, এত সুস্বাদু সব খাবার! হঠাৎ বাইরে থেকে আনলে? কী উপলক্ষ্যে?”

“রমজান স্যারের সাথে রাস্তায় দেখা হলো। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে শিববাড়ি চলে গিয়েছিলাম। আসার পথে নাকে ঘ্রাণ এলো। তাই নিয়ে এলাম। তোর তো আবার এসব পছন্দ।”

বিপরীতে চমৎকার হাসলো শিথিল। মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরা বের করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলতে তুলতে বললো,“তোমার মেয়েকে পাঠাই আগে।”

“একদম ওকে বিরক্ত করবি না। কাল তুই ওকে কষ্ট দিয়েছিস।”

“আজ সকালেই কথা বলে নিয়েছি। অনলাইন পেইজ থেকে স্যরি কেকও পাঠিয়েছি। এতক্ষণে খেয়ে ফিনিশ করে দিয়েছে হয়তো।”

অবাক হলেন হামিদুল হক। মনে মনে হাসলেন। সন্তুষ্ট হলেন। যাক মান অভিমান মিটেছে তবে। ভাই-বোনের সম্পর্ক এমন হওয়াই তো উচিত।

খেতে খেতে শিথিল বলে উঠল,“অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবার সবাই মিলে সেন্টমার্টিন যাবো। কেমন হবে, বাবা?”

হামিদুল হক মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছিলেন। ছেলের কথায় মাথা তুলে তাকালেন,“সবাই মিলে মানে? সপ্তাহ দুয়েক পর ইদ। ভুলে গিয়েছিস?”

“সবাই মিলে মানে আমি, তুমি আর হারুন চাচা। আর ট্যুর দিবো হাইস্ট তিনদিনের জন্য। আজ বুধবার। কাল দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা দিবো। শুক্র, শনি, রবি, ঘুরে সোমবার ভোরে চলে আসবো।”

“বললেই যাওয়া যায় নাকি? আমার কলেজ আছে। ক্লাস নিতে হবে। কদিন পর এমনিতেই তো বন্ধ দিয়ে দিবে। তার উপর টিকেট কাটা, হোটেল বুকিং করার ঝামেলা। আর আমরা তিনজন যাবো মানে? হাসি, মেহমাদ, মিথিন ওদের ছাড়া যাই কীভাবে?”

“শুক্র, শনি এমনিতেই বন্ধ। কলেজ থেকে বাকি এক দুদিনের ছুটি নিলে কিছু হবে না। তুমি ছাড়াও আরো অনেক টিচার সেখানে রয়েছে। মিথিনকে অবশ্য সঙ্গে নেওয়া যেতো কিন্তু আপু আর দুলাভাই তাকে একা ছাড়বে না। আর তারা এলে তাদের শ্বশুর-শাশুড়িও পিছু নিবে। প্রয়োজন নেই। ওই মানুষ দুটোকে আমার সহ্য হয় না। একদম ফালতু, ব্যক্তিত্বহীন।”

“কাউকে নিয়ে কটু কথা বলতে নেই। খারাপ হলে এর বিচার আল্লাহ করবেন।”

“তাহলে কাল আমরা যাচ্ছি। আমাদের ব্যাচেলর ট্যুর কনফার্ম। ট্রেনে করে যাবো। টিকেট আমি অনলাইন থেকে কেটে ফেলেছি। খাওয়া শেষে আমার ঘরে চলে আসবেন, চাচা। আমরা বসে সব প্ল্যান করবো।”

মুখে খাবার নিয়েই হারুন চাচা হাসলেন। মুখশ্রী জুড়ে আনন্দ চিকচিক করছে উনার। হামিদুল হক বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। এরপর ফের বললেন, “এখন এত খরচা করা যাবে না। কোরবানি তো দিতে হবে নাকি?”

“কোরবানি দিবে তোমার টাকায়। আর ট্যুর দিবো আমার টাকায়। ট্যুরের জন্য অনেকদিন ধরে টাকা জমিয়ে রেখেছি।”

“অযথা খরচ না করে রেখে দে নিজের কাছে। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।”

“ভবিষ্যৎ ভেবে বর্তমান নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। টাকা জমিয়ে ধনী হওয়ার চেয়ে দুনিয়া ঘুরে গরীব হওয়া ঢের ভালো।”

এক মুহূর্তের জন্য অবাক হলেন হামিদুল হক। বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে। হঠাৎ করেই মনে হলো, চোখের পলকে ছেলেটা খুব বড়ো হয়ে গিয়েছে। মাঝেমধ্যে কত বড়ো বড়ো কথা বলে ফেলে! উনি নিজেই সেসব শুনে চমকে যান।

খাওয়া শেষে টেবিল ছেড়ে উঠে ঘরের দিকে কদম ফেলতেই কলিং বেল বেজে উঠল। পথিমধ্যে থেমে দাঁড়াল শিথিল। ঘুরে হাঁটা ধরল সদর দরজার দিকে। কৌতূহলী কণ্ঠে বললো,“এখন আবার কে এলো?”

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)