মেঘমেদুর দিনে পর্ব-১৩+১৪

0
71

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৩]

মাঝারি আকারের একটি লাগেজ হাতে রাতের বেলা শিথিলদের গাজীপুরের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে স্বাধীন। হঠাৎ অসময়ে বন্ধুর আগমন যেন দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেনি শিথিল। তাই মুহূর্তেই সে অবাক হলো ভীষণ। বিস্ময়ে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারলো না কোনো শব্দ। তাকে দেখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই হাসলো স্বাধীন। হাত নাড়িয়ে মশা তাড়াতে তাড়াতে বললো,“বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবি নাকি? চারিদিকে কি মশা রে, ভাই!”

শিথিল সরে দাঁড়িয়ে ভেতরে আসার জন্য জায়গা করে দিলো। লাগেজ টানতে টানতে প্রবেশ করল স্বাধীন। ঘামে নেয়ে পরনের শার্টটা হয়ে গিয়েছে স্যাঁতস্যাঁতে। হামিদুল হক হাত ধুয়ে এলেন। হাঁক ছেড়ে জিজ্ঞেস করলেন,“কার সাথে কথা বলিস? কে এসেছে?”

তখনি স্বাধীনকে দেখতে পেলেন। লম্বা সালাম দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে স্বাধীন জিজ্ঞেস করল,“কেমন আছেন, আঙ্কেল?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি স্বাধীন না?”

দরজা আটকে এগিয়ে এলো শিথিল। বাবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,“তুমি ওকে চিনলে কীভাবে? আগে কখনো দেখা হয়েছে বলে তো মনে হয় না।”

“বলেছিলাম না, ও আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।”

স্বাধীন মাথা নাড়িয়ে সোফায় বসলো। শার্টের উপরের বোতাম দুটো খুলে সহজভাবে বললো,“আঙ্কেল বলেছিলেন, সময় সুযোগ পেলে যেন এখানে চলে আসি। আজকে সময় পেলাম তাই চলে এসেছি। ঠিক করেছি না, আঙ্কেল?”

হামিদুল হক প্রথমে অপ্রস্তুত হলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিলেন। অমায়িক হেসে সোফায় বসতে বসতে বললেন,“একদম ঠিক করেছো। বাড়ি চিনতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?”

“তা একটু হয়েছিল। কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়েই পেয়ে গেলাম একটা ট্রেন। ট্রেন থেকে জাংশনে নেমে তো আর কিছু চিনি না। শিথিলকে কল দিলাম কিন্তু সেও কল ধরল না। এরপর মনে পড়ল আঙ্কেল তো একজন টিচার! সঙ্গে সঙ্গে রিক্সা নিয়ে কলেজের সামনে চলে এলাম। আশেপাশে জিজ্ঞেস করতেই এক লোক বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন।”

শিথিল নিজের মোবাইল চেক করল। অগত্যা মিউট করা ছিল তার মোবাইল। হামিদুল হক আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। স্বাধীন ছেলেটা বছর দুয়েক আগে নিজ থেকেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ম্যাসেজ দিয়েছিল উনাকে। ছেলের সাথে গ্ৰুপ ফটোতে দেখে চেহারা চিনতে অসুবিধা হলো না হামিদুল হকের। তাই ছেলের পরিচিত ছিল বিধায় ম্যাসেজের রিপ্লাই দেন। এরপর থেকে ছেলের যত খোঁজ খবর স্বাধীনের থেকেই নেওয়া হয়।

স্বাধীনকে নিয়ে নিজের ঘরে এলো শিথিল। ছেলেটা ভীষণ ক্লান্ত। ঘরে এসেই দ্রুত পোশাক বদলে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে শুয়ে পড়ল।শিথিল সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বললো,“বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ এখানে কী করতে এসেছিস? যা বলবি সত্য বলবি বলে দিলাম।”

মুখে বিরক্তি নেমে এলো স্বাধীনের। উঠে বসলো। দুই হাতে বিছানায় ভর দিয়ে বললো,“আর বলিস না। বাপের সাথে ঝামেলা হয়েছে।”

“ঝামেলা?”

“দাঁড়া ডিটেইলসে বলি। গতরাতে টাকা চেয়েছিলাম কিন্তু দেয়নি। তাই মাঝরাতে পকেট মেরেছিলাম। সেটা আবার জানতে পেরেছে আজ সকালে। তখন তো আমি বাসায় ছিলাম না। বিকেলে যেতেই শুরু করে দিলো ঝামেলা। ওদিকে উনার টাকা-পয়সার আবার অভাব নেই। কালো টাকা বলে ব্যাংকেও রাখতে পারে না। তো আমায় দিলে সমস্যা কোথায়? এসবের মালিক তো আমি আর নিশু, তাই না? এরপর এলো ফুফু। ফুফুকে আবার আমার মা একদম সহ্য করতে পারে না। ব্যস লেগে গেলো বাবা-মায়ের কথা কাটাকাটি। আমার ভাই এসব ঝামেলা ভালো লাগে না। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাই তোর কাছে চলে এলাম। তুই ছাড়া আমার আছেটাই বা কে?”

শেষ কথাটা মুখ ভার করে বললো স্বাধীন। শিথিল প্রশ্ন করল,“কতদিন থাকার প্ল্যান?”

“যতদিন তুই থাকবি।”

“কাল বিকেলে সবাই মিলে ট্যুরে যাবো।”

“কোথায়?”

“সেন্টমার্টিন।”

“তু তো শ্লা মির জাফর নিকলা! ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিস অথচ আমাদের জানাসনি?”

“তোদের সাথে গত বছর সাজেক গিয়েছিলাম। এবার ভেবেছিলাম ফ্যামিলি ট্যুর দিবো। বর্তমানে ফ্যামিলির সবাই আমরা ব্যাচেলর কিনা!”

“তাহলে আমিও যাবো, আমিও ব্যাচেলর। হে হে।”

“কিছু খেয়েছিস নাকি নিয়ে আসবো?”

“আনলে তো ভালোই হয়। আসার পথে হোটেলে খেয়েছিলাম কিন্তু আবার খিদে পেয়ে গেছে।”

“নুডলস ছাড়া কিছু পারবো না কিন্তু।”

“ব্যাপার না, নুডলস আমার প্রিয়।”

শিথিল আর কিছু বললো না। তার বন্ধুরা অভিনয়ে ভীষণ পাকা। তা সে জানে। তার উপর স্বাধীনকে না করেও লাভ হবে না। এরপর সব ক্লান্তি ভুলে নুডলস খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে ওই রাতের বেলাতেই স্বাধীন বসে পড়ল ঘুরতে গিয়ে কি কি করবে সেসব নিয়ে শলা পরামর্শ করতে। খানিক বাদে কাজ শেষ করে হারুন চাচা এসেও যোগ দিলেন তাদের সঙ্গে।
___________

সকাল নয়টা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত সময়টা শাহিনূরের নিরিবিলি শান্তিতেই কাটে। বাড়িতে তখন তিনি আর মিতা ছাড়া কেউ থাকে না। ছেলে-মেয়েদের দুষ্টুমি সহ্য করতে হয় না। তবে সকাল থেকে মাথাটা ভীষণ ধরেছে উনার। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি। তাই চায়ের কাপ হাতে সোফায় বসে আছেন তিনি। চা উনার প্রিয়। সর্বনিম্ন চার কাপ তো দিনে অন্তত লাগেই। তবে চা টাও এই মুহূর্তে বিষাদ ঠেকছে।

টিভিতে নাটক চলছে। নাটকটা মিতার প্রিয়। গতকাল রাতে কাজের ব্যস্ততায় দেখা হয়নি। তাই সকালের সব কাজ শেষ করে আজকে দেখে নিচ্ছে। দেখতে দেখতে বললো,“আপনার কী হ্যাডেচ, আন্টি?”

“হ্যাডেচ কী?”

“মাথা ব্যথা।”

“এসব ইংরেজি তুমি শিখেছো কোথায়, মিতা? কতদূর লেখাপড়া করেছো?”

মিতা লজ্জা পেলো। ওড়নার আঁচল কামড়ে মোচড়া মুচড়ি করতে করতে বললো,“শরমের কথা কীভাবে যে বলি?”

ভ্রু কুঁচকে নিলেন শাহিনূর। কণ্ঠস্বরে নমনীয়তা এনে বললেন,“লজ্জা কীসের? বলে ফেলো।”

“সেভেন পর্যন্ত, আন্টি। এরপর আর লেখাপড়া করা হয়নি। ফ্যামিলি প্রবলেমের কারণে।”

চমকান শাহিনূর,“তারপরেও এত শুদ্ধ ভাষা, সাথে আবার ইংরেজিও!”

“আমি পনেরো বছর বয়স থেকেই আম্মার সাথে বাড়ি বাড়ি কাজ করি। আগে যেই তিন বাসায় কাজ করেছি সেই বাসার ছেলে-মেয়েরা অনেক শিক্ষিত। তাদের থেকেই টুকটাক শেখা আরকি।”

“ওহ!”

এবার ব্যাপারটা ধরতে পারলেন শাহিনূর। এটাই তবে আসল কাহিনী! মিতা পুনরায় বললো,“মাথা টিপে দিবো, আন্টি? আমি আবার এসব খুব ভালো পারি।”

“দাও তবে।”

টিভিতে চোখ রেখেই উঠে গেলো মিতা।সোফার পেছনে দাঁড়িয়ে লেগে পড়ল কপাল মালিশের কাজে। আবেশে চোখ বুজলেন শাহিনূর। কিছু সময় অতিক্রম হতেই বুঝতে পারলেন বাঁচাল হলেও মেয়েটা ভীষণ কাজের।

বেলা এগারোটা বাজতেই কলিং বেল বেজে উঠল। মিতার হাতটা সরিয়ে দিলেন শাহিনূর। বললেন,“দেখো তো কে এসেছে? আগে লুকিং গ্লাসে দেখে নিবে। পরে গিয়ে দরজা খুলবে।”

আচ্ছা বলে দরজা খুলতে চলে গেলো মিতা। কয়েক মিনিট বাদে আবার ফিরেও এলো। চেঁচিয়ে বললো, “একটা বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে, আন্টি। খুলবো?”

“বুড়ি?”

নিজেই এবার উঠে এলেন শাহিনূর। লুকিং গ্লাসে দেখে দ্রুত খুলে দিলেন দরজা। উৎফুল্ল হয়ে সালাম দিলেন, “আসসালাম আলাইকুম, মা।”

সাবেরা বিবি ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিলেন। মেয়েকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,“সামনে থাইক্কা সর। এত দেরি লাগে ক্যান দরজা খুলতে? আমার পা দুইডা বিষ করতাছে।”

দ্রুত মায়ের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিলেন শাহিনূর। মিতাকে ইশারা করলেন বাইরে থাকা বাকি ব্যাগগুলো নিয়ে আসার জন্য। সাবেরা বিবি সোফায় এসে বসলেন। মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে শ্বাস ছাড়লেন। কি গরম বাইরে! শাহিনূর মায়ের জন্য নিজে গিয়ে ঠান্ডা পানি নিয়ে এলেন।হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি যে আজ আসবে বললে না তো, মা? একা একা এসেছো?”

“সোহেল গেইট পর্যন্ত দিয়া গেছে। এরপর আজিজে সব ব্যাগ লইয়া দরজা পর্যন্ত রাইখা গেছে।”

“তা সোহেল ভেতরে এলো না কেনো? তুমি আসতে বলোনি?”

“বাদ দে ওইগুলার কথা। কোন মুখে আইবো? বাপে সেই মুখ রাখছে? দুই দুইডা ঢ্যামনা পোলা থাকতে মাইয়ার বাড়ি পইড়া থাকতে হয়। দেখবি ওর পোলাও ওর লগে এমন করবো। দুইদিনের চাঁন দুয়ারে দেহা যায়।”

শাহিনূর এ বিষয়ে কথা বাড়ালেন না। বছরের নয় মাস তিন মেয়ের বাড়িতে ভাগ বাটোয়ারা করে থাকেন সাবেরা বিবি। বাকি তিন মাস ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি। ছেলে অবশ্য দুইটা আছে তবে নিজের কাছে মাকে রাখতে তারা অপারগ। বৃদ্ধা মায়ের জন্য রোজ রোজ স্ত্রীর সাথে কে ঝগড়া করতে চায়?তাই জন্মদাত্রীকেই তারা পাঠিয়ে দিলো একেবারে বৃদ্ধাশ্রমে। এরপর খবর পেয়ে স্বামীর থেকে অনুমতি নিয়ে শাহিনূর গিয়েই ওখান থেকে মাকে নিয়ে আসেন নিজের কাছে। বোনদের নিয়ে বৈঠক বসান। এরপর থেকে বৃদ্ধা মেয়েদের উপরেই নির্ভরশীল।

মিতাকে দিয়ে মায়ের পছন্দের সব রান্নাবান্না করালেন শাহিনূর। দুপুরের দিকে এসে হাজির হলেন মোজাম্মেল হোসেন। ভদ্রলোক ডায়াবেটিসের রোগী। শুধু উনি একা নন। সাথে স্ত্রীও আছেন। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তিনবেলা বাসায় এসেই খান।শাশুড়িকে দেখে বেজায় খুশি হলেন। মাকে হারিয়েছেন বহু বছর আগে। তাই শাশুড়িকে ভীষণ সম্মান করেন ভদ্রলোক। শাফিন এসেই দৌড়ে গিয়ে নানীকে জাপটে ধরে আহ্লাদী হয়ে উঠল। স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে ডাকল,“নানু!”

সাবেরা বানু হাসলেন। নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,“নানাভাই, কেমন আছেন?”

“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

“আমিও বালা আছি। ইসকুল থাইক্কা আইছেন?”

“হ্যাঁ।”

“যান আগে গিয়া কাপড় চোপড় পাল্টান। গায় গোসল দিয়া তাপ্পরে খাইতে আহেন।”

একমাত্র নানীর কথাই বিনা বাক্যব্যয়ে শাফিন শোনে। তাই দৌড়ে চলে গেলো ঘরে। এবার সে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ইংলিশ মিডিয়ামে। মিতাকে টেবিলে খাবার বাড়ার নির্দেশ দিয়ে ছেলেকে গোসল করাতে গেলেন শাহিনূর। এই ছেলেকে একা একা গোসল করতে দেওয়া মানে জ্বর বাঁধানো। বাথরুমে ঢুকেই পানি নিয়ে খেলা করে সে। গত বছর শপিং মলে গিয়ে দুটো ছোটো ছোটো খেলনা হাঁস কিনে এনেছিল। সুইচ অন করে পানিতে ছেড়ে দিলেই প্যাক প্যাক করে সাঁতার কাটে সেই হাঁস। সেগুলো থেকে একটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বাকি যেটা ঠিক আছে সেটা নিয়েই রোজ গোসলের নাম করে বাথরুমে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলা করে শাফিন।

মাকে দেখে মুখ ভার হলো তার। গোল গোল চোখে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বললো,“আমি বড়ো হয়ে গেছি, আম্মু। আজ একা একা গোসল করবো।”

বাথটাবের কল বন্ধ করলেন শাহিনূর। ছেলেকে টেনে কৃত্রিম ঝর্নার নিচে দাঁড় করিয়ে ধমকের সুরে বললেন, “কত বড়ো হয়েছো তা তো দেখতেই পাচ্ছি। যেদিন খেলনা ছাড়া বাথরুমে ঢুকে ঠিকমতো গোসল করে দশ মিনিটের মধ্যে বের হতে পারবি সেদিন বুঝবো বড়ো হয়েছিস।”

“রাতুল একা একা গোসল করে। ওর আম্মু কখনো ওকে জোর করে গোসল করিয়ে দেয় না।”

“রাতুলের রোল এক। তোর কত?”

মাথা নত করে নিলো শাফিন। মিনমিনে স্বরে প্রত্যুত্তর করল,“নয়।”

“যেদিন এক নাম্বারে যেতে পারবি সেদিন রাতুলের সাথে নিজের তুলনা দিস।”

ঠোঁট উল্টালো শাফিন। তার কোনো যুক্তি আর খাটলো না। সব কথাতেই মা শুধু রোল নাম্বার আর পরীক্ষার রেজাল্ট টেনে আনে। যা তার একদম ভালো লাগে না।

বৃহস্পতিবারের দিনটি অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আলাদাই যেন। বিকেলের দিকে একে একে এসে হাজির হলো বাড়ির মেয়েরা। মিশমির সাথে তার নানীর সম্পর্ক একেবারে দুই সতীনের মতো। সারাক্ষণ এদের মধ্যে দুষ্টু মিষ্টি ঝগড়া লেগে থাকবে। সাবেরা বানু সঙ্গে করে অনেক কিছুই নিয়ে এসেছেন। যেমন ফলমূল, শাকসবজি, পিঠা, নাড়ু, খাজা ইত্যাদি। নাড়ু আর পিঠা মিশমির পছন্দ। অপরদিকে সুশ্রী নাড়ু খেলেও পিঠা খায় না। খাবার নিয়ে তার যত তালবাহানা।

নানীর হাত থেকে নাড়ুর বয়ামটা নিয়ে খেতে লাগলো মিশমি। তিন পদের নাড়ু আছে। নারিকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু আর গুড়ের নাড়ু। মিশমির সবচেয়ে বেশি পছন্দ নারিকেলের নাড়ু। তৃপ্তি করে খেতে খেতে বললো,“কি মজা! কার থেকে বানিয়ে এনেছো, বলো? তোমায় দিয়ে তো এসব সম্ভব নয়।”

সাবেরা বানু মুখ বাঁকালেন,“আমি তোর মতো অকর্মা নাকি? জামিলের বউরে লইয়া বানাইছি।”

“এই জন্যই তো তোমার মেয়ে রাঁধতে জানে না। একটা কথা জানো তো? মা যেমন হয় মেয়েও তেমনি হয়।”

“আমার নূরে রান্না পারে না? সব পারে। আমি নিজে ওরে শিখাইছি। তোর বাপেরে জিগা গিয়া। বিয়ার পর আমার নূরেই সবাইরে রান্না কইরা খাওয়াইছে।”

“তাইলে এহন পারে না ক্যান?”—নানীর মতো করেই বললো মিশমি।

“তোরা হওনের পর পেট লইয়া রানবো কেমনে? তহন থাইক্কা না রানতে রানতে সব ভুইল্লা গেছে।”

“হয়েছে, মেয়ের নামে আর গুণগান করতে হবে না।”

তীর্যক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নাতনির দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেললেন সাবেরা বানু। আবৃত্তিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,“ওই মাইয়াডা কেডা?”

মিশমি খেতে খেতে উত্তর দিলো,“ওইটা আবৃত্তি আপু।আমার ফুফাতো বোন।”

“বেড়াইতে আইছে?”

“না, এখানেই থাকে। চার মাস প্রায় হতে চললো।”

“এইখানে ক্যান থাকবো? বাপ-মা কই?”

“তুমি জানো না? ছোটো ফুপি অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। তখন আবৃত্তি আপু ছোটো ছিল। এরপর থেকে বড়ো ফুপির কাছে থাকতো। বাকিটা আম্মুর কাছ থেকে জেনে নিও।”

মস্তিষ্কে প্রশ্নরা নাড়া দিচ্ছে। তাই উঠে মেয়ের ঘরে চলে এলেন সাবেরা বানু। শাহিনূর চুলে তেল দিচ্ছেন। মাকে দেখে হাসলেন। ইশারায় বসতে বললেন। সাবেরা বানু বসলেন। বিছানায় ভর করে বললেন,“তুই তো আমারে কিছু জানাইলি না।”

“কী ব্যাপারে, মা?”

“এই যে তোর মরা ননদের মাইয়া এহন থাইক্কা এনেই থাকবো। প্রত্যেকদিন ফোনে কথা কইছি এরপরেও কইলি না?”

“বলবো বলবো করেও বলা হয়নি।”

“এতদিন তো খরচ দিতাছিলি এইডাই ঠিক আছিল। অযথা বাড়তি ঝামেলা এনে আইনা রাখতে হইবো ক্যান? বাকি মামারা কই?”

“হঠাৎ করেই মেয়েটা চলে এসেছে। ওর খালা এখন আর ওকে নিজেদের কাছে রাখতে চান না। তাই সবাইকে নিয়ে বৈঠক বসেছিল। ওখানে সুশ্রীর বাবাই হঠাৎ করে সব দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলো। আমি আর কী বলবো? সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমার পরামর্শ পর্যন্ত নেয়নি।”

“এত বছর কীসের সংসার করলি তাইলে?”

“মেয়েটা ভালো। খুব কাজের।এতিম মেয়ে তাই থাকছে যখন থাকুক। এটা সওয়াবের কাজ।”

কিছু একটা ভেবে পরক্ষণেই মেয়ের বিপরীতে মাথা নাড়লেন সাবেরা বানু।
_________

আজ অনেকদিন বাদে গ্যারেজ থেকে মোটরসাইকেল বের করল শিথিল। এইচএসসিতে এ+ আর এডমিশনে বুয়েটে চান্স পাওয়ায় উপহার হিসেবে বাবা তাকে কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে নিতে দেননি। হামিদুল হকের ভাষ্যমতে,“একটামাত্র ছেলে আমার। পথে ঘাটে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে? আমার কী হবে তখন? দরকার নেই। এলাকা দিয়ে চালাবি।”

শিথিল অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু হামিদুল হক নিজের কথায় অনড়। তাই স্বাধীন আসার উসিলায় আজ সেটা বের করল। সকালের নাস্তা না করেই বন্ধুকে নিয়ে চললো ঘুরতে। সবার প্রথমে গেলো হানকাটা ব্রিজে। এই ব্রিজটা গাজীপুরে একটু বেশিই বিখ্যাত। কেনো যে বিখ্যাত তা শিথিলের জানা নেই। গাজীপুরে এরচেয়েও সুন্দর সুন্দর অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তবুও আশেপাশে মানুষের ভিড়। একেকজন ফটোশুটে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে কলেজ ইউনিফর্ম পরিধেয় ছেলে-মেয়ের সংখ্যা যেন একটু বেশিই!

ওখানে বেশি একটা স্বস্তি পেলো না শিথিল। তাই স্বাধীনকে নিয়ে এবার এলো কানায়া। কানায়া আবার বেলাই, শাপলা বিল, নান্দনীয় রিসোর্টের জন্য বেশ বিখ্যাত। এর আগে এসব জায়গায় সশরীরে ঘুরা হয়নি স্বাধীনের। বেশ কতগুলো ছবি তুললো সে। স্থানটির, নিজের এবং শিথিলের। এরপর সর্বপ্রথম ফেসবুকে গিয়ে শিথিলকে ট্যাগ করে ছবিগুলো আপলোড দিয়ে ক্যাপশন লিখলো,“শহর থেকে বহুদূরে। বন্ধুর সঙ্গে তার এলাকায় সুন্দর কিছু সময় কাটানো। কানায়া, গাজীপুর।”

ছবি আপলোড দিতে না দিতেই কমেন্টের ঝড় উঠল। জুনিয়রদের কত তেলতেলে ম্যাসেজ! সিনিয়রদের হাহাকার। আর মেয়েদের আফসোস,“আহ কত সুন্দর জায়গাটা! আজ কেউ নেই বলে!”

স্বাধীনের দৃষ্টি মেয়েদের কমেন্টের উপরে নিবদ্ধ। মুচকি মুচকি হাসছে সে। হঠাৎ করেই কমেন্ট বক্সে জ্বলজ্বল করে উঠল শান্ত নামের আইডিটা। কমেন্টটা দেখেই মেজাজ খারাপ হলো,“হ্লারপুত আমগো রাইখা আমার এলাকায় গিয়া একলা একলা মজা করো? জীবনেও বিয়া হইবো না তোর। একবার আসিস খালি। মাঠে ফালাইয়া পিডামু।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্বাধীন। শিথিলের দিকে তাকিয়ে বললো,“এই শান্তডা আমারে একটু শান্তি দেয় না। কত সুন্দর সুন্দর মেয়েরা কমেন্ট করছে তার মধ্যে ও এসে আজাইরা প্যাঁচাল পারে।”

“কেনো? কী লিখেছে?”

“তুই নিজেই দেখ।”

সেই কমেন্ট দেখে শিথিল হাসলো। স্বাধীন পুনরায় বললো,“তুইও বাকিগুলো আপলোড দে।”

“পরে।”

“না, এখনি দিবি। রাত থেকে তো আবার ট্রেন, সমুদ্র, সেন্টমার্টিনের ফটো ছাড়তে হবে।”

শিথিল হাসলো। ছবিগুলোর মধ্য থেকে অনেক বাছাই করে সুন্দর সুন্দর চারটা ছবি আপলোড দিলো। গতকাল রাতে তারা ঘুমায়নি। প্রয়োজনীয় সবকিছু হারুন চাচাকে নিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। এরপর দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেলো। বেরিয়ে পড়ল একটু আগে আগেই। সর্বপ্রথম কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যেতে হবে। তারপরে সোজা কক্সবাজারে যাওয়ার ট্রেন।

চলবে _________

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৪]

ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হলো শিথিলদের। চারিদিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে কাঁপন ধরিয়ে দিলো দেহে। হামিদুল হক গায়ের চাদরটা টেনে নিলেন। হারুন চাচা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলেন,“সমুদ্দের গর্জন না এইডা?”

স্বাধীন মাথা নাড়ল,“হ্যাঁ, ভিউটা সুন্দর না? আসেন চাচা কয়েকটা ছবি তুলি।”

হারুন চাচা সবকিছুতেই উৎসুক আর মিশুক লোক। ট্রেনে বসেও স্বাধীনের সাথে অনেক ছবি তুলেছেন।মুড়ি খেতে খেতে গল্প করেছেন। স্বাধীন কাঁধের ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করল। ক্যামেরাটা শিথিলের। তবে এই মুহূর্ত থেকে ক্যামেরা ব্যবহারের গুরু দায়িত্ব পালন করছে স্বাধীন।

সমুদ্রের নীল জলরাশি বাতাসের তালে ঢেউ খেলছে। ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে পানির গর্জন। হামিদুল হক মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখছেন সেসব। বিয়ের এক মাসের মাথায় স্ত্রী আসমাকে নিয়ে একবার এখানে ঘুরতে এসেছিলেন তিনি। মাত্র ত্রিশ বছরে কিনা এতোটা পরিবর্তন ঘটেছে চারিদিকে?

সবাইকে সমুদ্রের পাড়ে রেখে শিথিল গিয়েছিল অটো ভাড়া করতে। এখান থেকে তারা যাবে নুনিয়ারছড়ার বিআইডব্লিউটি ঘাটে। ওখান থেকেই জাহাজে করে পৌঁছে যাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপে। তবে ফিরে এলো খালি হাতে। হামিদুল হক জিজ্ঞেস করলেন,“পেয়েছিস গাড়ি? এলাকার বাইরের লোক শুনলে ভাড়া কিন্তু ওরা বেশি চায়।”

“আজ বৃহস্পতিবার। ঘাটে যেতে যেতে আধ ঘণ্টার মতো লাগবে। এই সময় জাহাজ পাওয়া মুশকিল, বাবা। আর পেলেও ভিড় থাকবে বেশি। ট্রলার পাওয়া গেলেও যেতে পারে। তবে ট্রলারে যাওয়াটা একটু রিস্কি। পাশেই একটা হোটেল দেখলাম। তাই আজকের রাতটা এখানেই থেকে যাই চলো। কাল ভোরে না হয় সোজা টেকনাফে যাবো। ওখান থেকে জাহাজে উঠে সেন্টমার্টিন।”

হামিদুল হক সায় জানালেন। ছেলের সঙ্গে একমত তিনি। কথার ফাঁকে তার দিকে নজর যেতেই ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,“গায়ে পাতলা শার্ট কেনো? সঙ্গে মোটা কোনো জ্যাকেট আনিসনি?”

“এনেছি, ব্যাগের ভেতরে।”

চোখ রাঙিয়ে শেষবারের মতো ছেলের দিকে তাকালেন হামিদুল হক। শরীরে জড়ানো চাদরটা খুলে শিথিলের কাঁধে দিয়ে হারুন চাচাকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটা ধরলেন। শিথিল ফ্যালফ্যাল নয়নে একপলক বাবার দিকে তাকিয়ে তাড়া দিলো স্বাধীনকে। এরপর সকলে মিলে চলে গেলো ঠিক করা সেই হোটেলে।
__________

রাতে হামিদুল হকের ঘুম হলো না। নিজের ঘর, বিছানা ছাড়া অন্য কোথাও উনি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন না। অস্থির লাগে। অপরদিকে বাড়ির জন্যও চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। অত বড়ো বাড়ি মানুষহীন পড়ে রয়েছে! যদি চোর ডাকাত ঢুকে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। নিস্তব্ধ রাতে সমুদ্রের গর্জন ঐশ্বরিক সুন্দর।

ত্রিশ বছর আগে স্ত্রী আসমার সঙ্গে এদিকেই কোনো এক হোটেলে উঠেছিলেন সম্ভবত। কাঠের তৈরি ছিল সেই হোটেল। এখন তার অস্তিত্ব নেই। থাকার কথাও নয়। তবে সব বদলালেও সমুদ্রের ঢেউ বদলায়নি। তার গর্জন বদলায়নি।সেসব সেদিনের মতোই রয়ে গিয়েছে। আজ হঠাৎ করেই আসমার কথা মনে পড়ছে হামিদুল হকের। সাধারণ কোনো দিনে যে মনে পড়ে না এমন নয়। রোজই মনে পড়ে। কিন্তু আজ একটু বেশিই মনে পড়ছে যেন।

আসমাকে হামিদুল হক প্রথম দেখেছিলেন গাজীপুরের মারতা গ্ৰামে। ওখানে ছিল উনার বড়ো বোনের শ্বশুর বাড়ি।মায়ের আদেশে বোনকে ব্যাগ ভরতি বাতাবি লেবু আর নারিকেল দিতে গিয়েছিলেন তিনি। উনার পৈতৃক নিবাসে তখন ফলাফলাদির বিশাল বিশাল বাগান! বিশেষ করে নারিকেল, বাতাবি লেবু, আমলকি, কলা, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারাসহ আরো কত কত ফল! লিস্ট করতে বসলে লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না।

হামিদুল হক তখন যুবক। লেখাপড়ার খাতিরে শহরে থাকেন। বেশভূষাও তাই শহুরে। গ্ৰামের দিকে তখন অত গাড়ি চলাচল করতো না। এ গ্ৰাম থেকে ও গ্ৰামে ধানের আইল কিংবা বর্ষার দিনে নৌকায় করেই যাতায়াত করতো সকলে। আর গ্ৰাম থেকে শহরে যেতে হলে তো মাইলের পর মাইল পথ হাঁটতে হতো।

তখন ছিল বর্ষাকাল। নৌকা থেকে নেমে পেয়ারা খেতে খেতে মাটির রাস্তা দিয়ে বোনের শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন তিনি। যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই মাথার উপর ভারি কিছু পড়ল। পথিমধ্যে থেমে দাঁড়ালেন তিনি। ব্যথায় আচমকা আর্তনাদ করে উঠলেন। হাতের তালুতে ব্যথাতুর স্থান ডলতে ডলতে হঠাৎ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠা মেয়েলি কণ্ঠ বেজে উঠল শ্রবণালীতে। লাফিয়ে উঠলেন হামিদুল হক। বুকে থু থু দিয়ে উপরে তাকাতেই নজরবন্দি হলো গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা এক কিশোরীর।

হামিদুল হক মেয়েটির হাসি দেখে রেগে গেলেন। নিচ থেকে হাতে তুলে নিলেন গাছের শুকনো ডাল। ধমক দিলেন প্রচন্ড,“বাঁদর মেয়ে! লজ্জা করে না অন্যায় করেও এভাবে ভেটকি মেরে হাসতে? নিচে নামো। কী হলো শুনতে পাচ্ছো না? নামো বলছি।”

কিশোরীর হাসি অধর থেকে ঝট করে নিভে গেলো। অপরিচিত যুবকের মুখে শুদ্ধ বুলি আর রাগত চেহারা ভয় ধরিয়ে দিলো মনে। গ্ৰামে গঞ্জে শুদ্ধ ভাষা সে সময় দিনের বেলা আকাশে উদিত চাঁদের মতো। মেয়েটি একলাফে সেই উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়ল মাটিতে। তবুও ব্যথা পেলো না। যেন এসব কাজে প্রশিক্ষিত। মুখ ভার করে বললো,“জাম পারতে গিয়া ডাইল পইরা গেছে। ইচ্ছা কইরা ফেলি নাই।”

“ইচ্ছে করে না ফেললে হাসছিলে কেনো? অন্যের ব্যথা পাওয়া দেখলে খুব হাসি আসে? পরিবার থেকে কোনো শিক্ষা পাওনি?”

ব্যস এই কথাটাই যেন কিশোরীর সকল নমনীয়তা, ভয় ভীতি অদৃশ্য করে দিয়ে ধারণ করল রণমূর্তি। এরপর আর দেখে কে? কি ঝগড়া! কি ঝগড়া! ওই দিনের কথা মনে পড়লে হামিদুল হকের হাসি পায়। উনার মতো মানুষ সেদিন কীভাবে এত ঝগড়া করেছিল? বহুবার এ নিয়ে ভেবেছিলেন তিনি কিন্তু উত্তর পাননি।

ঝগড়ার তালে শ্যাম বর্ণের মেয়েটির কাজল কালো ডাগর ডাগর চোখে কখন যে হারিয়ে গিয়ে এক ঝাঁক মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন তাও তখন তিনি বুঝতে পারেননি। যখন বুঝতে পারলেন ততদিনে আর ফিরে আসার উপায় রইল না। বেকার অবস্থাতেই লাজ লজ্জা ভুলে মায়ের কাছে বিয়ের আবদার জুড়ে দিলেন। আসমার বয়স তখন চৌদ্দ কি পনেরো হবে। সচ্ছল পরিবারের ডাঙর মেয়ে। বাড়িতে ঘটকের আনাগোনা লেগেই আছে। এটাই সেই সময়কার বিয়ের উপযুক্ত বয়স।

মা গিয়ে বাবাকে বললেন। বাবা রাজি হয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। নিজেদের জমিজমার অভাব নেই। লেখাপড়া শেষে সরকারি চাকরির আসা কে করতো তখন? ঘটকের মাধ্যমে মেয়ের বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠালেন। এরপর চললো একে অপরের বংশ সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া। ব্যস, সবকিছু মনমতো হতেই দুই পরিবারের সম্মতিতে কোনো এক বৃহস্পতিবারে ধুমধাম করে দশ গ্ৰামের লোক খাইয়ে হয়ে গেলো বিয়ে। বিয়ের প্রথম দুই বছর গ্ৰামে শ্বশুরবাড়িতেই ছিলেন আসমা। সেই দুই বছরে হামিদুল হক লেখাপড়া শেষ করে চাকরি নিলেন ঢাকার কোনো এক কলেজে। স্ত্রীকেও গ্ৰাম থেকে নিয়ে গেলেন নিজের কাছে।

সুহাসিনী দুনিয়ার আলো দেখতেই ভাড়া বাড়ির ছোটো ছোটো দুই কামড়ায় আর মন টিকে না আসমার।গ্ৰামীণ খোলামেলা পরিবেশে বড়ো হওয়া নারীর কী আর জিঞ্জির শহরে মন টিকে? স্ত্রীর ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য দিতেন ভদ্রলোক। তাই ট্রান্সফার হয়ে ফিরে এলেন গাজীপুর শহরে। এতে অবশ্য উনার বাবা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। গ্ৰামে না আসুক, পুত্র নিজের জেলায় তো ফিরে এসেছে! এই অনেক। সেই খুশিতে উপহার স্বরূপ লিখে দিলেন গাজীপুরের ওই বাড়িটা।

কয়েক বছর ভালোই কাটলো। সুহাসিনীর বয়স যখন সাড়ে তিন ঠিক সেই সময় ঘর আলো করে এলো শিথিল। সুখী পরিবার উনাদের। কিন্তু তার বছর ছয়েক পরেই আসমা আক্রান্ত হলেন হৃদরোগে। কীভাবে যে এমনটা হলো? কখন হলো? কে জানে?হাসপাতাল ঘুরে ডাক্তার দেখিয়েও আর বাঁচানো গেলো না নারীটিকে।

রাতের আঁধার কেটে আজ একটু তাড়াতাড়িই ভোর হলো বোধহয়। শিথিলের ঘুম ভেঙেছে সেই ফজরের আজানের শব্দে। হোটেল থেকে মসজিদটা মনে হয় বেশ কাছে। আজানের শব্দেই বুঝা গিয়েছে। ফজরের নামাজ আদায় করে নাস্তা সেরে সকলে রওনা দিলো টেকনাফে। জাহাজের টিকেট কেটে উঠে পড়ল নির্দিষ্ট বগিতে। যাত্রী নিয়ে জাহাজ ছাড়তে ছাড়তে বেলা হলো। ধরিত্রীতে নেমে এলো ঝলমলে রোদ।

প্রকৃতির মৃদুমন্দ বাতাসে সাগর উত্তাল হয়ে উঠেছে। নীল জলরাশিতে ক্ষণে ক্ষণে বইছে ছোটো, বড়ো অসংখ্য ঢেউ। বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে অবস্থিত ছোট্ট ব-দ্বীপ হচ্ছে সেন্টমার্টিন। দ্বীপটির সঙ্গে বাংলাদেশের সড়ক পথের কোনো ধরণের যোগাযোগ না থাকায় সেখানে যাওয়ার একমাত্র উপায় জলপথ।

স্বাধীন বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও কলে। আড্ডা দিচ্ছে না। বরং সকলকে ভিউ দেখিয়ে অদৃশ্য খোঁচা দিচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে বিভিন্ন পোজ দিয়ে, চুল নাড়িয়ে ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। শিথিল উঁকি দিয়ে দেখলো। মাথায় চাটি মেরে ধমকালো,“এত ফাতরামি কেনো, শহরের চাচাতো ভাই?”

চোখমুখ কুঁচকে নিলো স্বাধীন। মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে শান্ত চেঁচালো,“হ্লারপুত! জামালপুইরা, গাজীপুইরা! তোদের মাথায় ঠাডা পড়ুক। সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়া মর। আমাদের রেখে ঘুরতে গিয়েছিস না? আয় একবার ক্যাম্পাসে।”

মোবাইলটা কেড়ে নিলো শিথিল। বসে বললো,“এই ইতরের কথা বিশ্বাস করে তোরা গালাগালি করছিস? আমি তো ভাই ফ্যামিলি ট্যুরে এসেছি। স্বাধীন নিজের বাপের সাথে ঝামেলা করে, না বলে কয়ে হঠাৎ আমার সাথে চলে এসেছে।”

শান্ত আর সজীব থেমে গেলো। তুহিন মুখ ভার করে বললো,“স্বাধীনের মোবাইলটা পারলে ফেলে দে তো, ভাই। একটু শান্তি চাই।”

“ও আরেকবার আমাদের জ্বালালে আমি ওরে ব্লক দিমু।”—-সজীব বললো।

শিথিল হাসলো,“গত বছর আমি তোদের বলেছিলাম, চল ঘুরে আসি। কিন্তু তোরাই রাজি হসনি।”

ঝট করে নিভে গেলো সকলের তেজ। আরো কিছুক্ষণ কথা চললো একে অপরের মধ্যে। এরপর নেটওয়ার্ক না পেয়ে কল কাটলো শিথিল। মোবাইল স্বাধীনকে ফেরত দিয়ে বললো,“এই মুহূর্তগুলো এনজয় কর। কল দিয়ে ওদের বিরক্ত করার প্রয়োজন নেই।”

কিন্তু কে শোনে কার কথা? কুকুরের লেজ যেমন সোজা হয় না তেমনি স্বাধীনের মতো বাঁদর ছেলেও ঠিক হয় না। বরং শিথিলকে টেনে নিয়ে সে অগনিত ছবি তুললো। জাহাজ মাঝ সাগরে আসতেই দেখা মিললো উড়তে থাকা সহস্র গাঙচিলের। হারুন চাচা ব্যাগ থেকে পাউরুটি বের করে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন খোলা আকাশের নিচে। সঙ্গে সঙ্গে উড়ে এসে সরু ঠোঁট দিয়ে হাত থেকে খাবার নিয়ে গেলো চিলে।

হারুন চাচা হো হো করে হেসে উঠলেন। কি সুন্দর সেই হাসি! হামিদুল হককে উৎসুক কণ্ঠে ডাকলেন, “ভাইজান! ভাইজান! দেহেন, দেহেন চিলে আমার হাতে খাওন খাইছে।”

স্বাধীন সেই দৃশ্যগুলোও ক্যামেরাবন্দি করল। হামিদুল হক মুচকি হাসলেন। পরিবারের মানুষদের এই আনন্দ, উচ্ছ্বাস দেখে সুখ সুখ অনুভব করছেন তিনি। চলন্ত জাহাজে বাতাসের তেজ বেশি। হারুন চাচার জোরাজুরিতে রেলিং ঘেঁষে হামিদুল হকও দাঁড়ালেন।

জাহাজের অপরপ্রান্তে গোল হয়ে বসে আছে ছেলেদের দল। একজনের হাতে গিটার, একজনের হাতে ছোট্ট ঢোল, আরেকজনের হাতে একতারা। সম্ভবত বন্ধু হবে। সাগরের বুকে চলন্ত জাহাজে হঠাৎ করেই তারা গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল সমুদ্রের গান,

‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি
সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ
আমি শুনেছি সেদিন তুমি
নোনাবালি তীর ধরে বহুদুর বহুদুর হেঁটে এসেছ

আমি কখনও যাই নি জলে কখনও ভাসিনি নীলে
কখনও রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাংচিলে
আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে
আমাকেও সাথে নিও নেবে তো আমায় বল নেবে তো আমায়……

এই গানটা হামিদুল হকের ভীষণ প্রিয়। তিনিও মুগ্ধ হয়ে শুনলেন। এমন একটি পরিবেশে এই গানেরই যেন খুব প্রয়োজন ছিল। উনি চোখ বন্ধ করে স্মরণ করেন নিজ ছাত্রজীবন। এমন বন্ধুদের দল তো উনারও ছিল এক সময়! কিন্তু এখন তারা কোথায়? নেই। কোথাও নেই। সময়ের সাথে সাথে আমরা কত কাছের মানুষ যে হারিয়ে ফেলি! তার হিসেব কোথায়?

গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হলো। গুগল থেকে এখানকার কোথায় কি আছে সব ভালোভাবেই জেনে নিয়েছিল শিথিল। তাই কোনো সমস্যা হচ্ছে না তার। সবাইকে নিয়ে কাছেপিঠেই এক রাতের জন্য একটা হোটেলে উঠল। বিকেলে বা সন্ধ্যার পর ভালো মানের হোটেল খুঁজে দেখবে না হয়।

হোটেলে গিয়ে একে একে গোসল সারলো সকলে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল শিথিল। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তার! এই মুহূর্তে খাওয়ার চেয়ে ঘুমটাই গুরুত্বপূর্ণ। হামিদুল হক আশেপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললেন,“হারুন কই? এই আহাম্মক আবার কোথায় চলে গেলো?”

“মনে হয় হোটেলের রুফটপ ঘুরে দেখছে। স্বাধীনের সাথে উনার যা ভাব হয়েছে না!”

“স্বাধীন ওর ঘরে শুয়ে আছে। তোর মতোই ক্লান্ত ও।”

প্রত্যুত্তর করল না শিথিল। হামিদুল হকের চিন্তা হলো। হারুন চাচা চঞ্চল মানুষ। এক জায়গায় বেশিক্ষণ টিকতে পারেন না। নিশ্চয়ই পাকনামি করে কোথাও গিয়েছেন। একবার আসুক সে। আচ্ছামতো ব্যাটাকে ধমকাবেন হামিদুল হক।

হারুন চাচা এলেন ঘণ্টা খানেক পর। দু হাতে দুটো বিশাল সাইজের বাজারের ব্যাগ। এর মধ্যে শিথিল না খেয়েই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। স্বাধীন নিজের ঘর ছেড়ে বন্ধুর ঘরে চলে এসেছে। হামিদুল হক যতটা না রাগ আর চিন্তা নিয়ে বসে ছিলেন তার চেয়েও বেশি অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন,“কোথায় গিয়েছিলি হঠাৎ? আর এই ব্যাগগুলো কীসের?”

ঘরে খোলা লাগোয়া একটা বারান্দা রয়েছে। হারুন চাচা নিজের কাপড়ের ব্যাগ থেকে আরেকটা চটের ব্যাগ নিয়ে বারান্দার পাশ ঘেঁষে বসলেন। বাজারের প্রথম ব্যাগ থেকে বের করলেন তিনটি ডাব। এরপর চটের ব্যাগ থেকে বের করলেন একটা ধারালো বঁটি আর ছুরি। অল্প সময়ের মধ্যে দুইটা ডাব কেটে একটা হামিদুল হক আর অপরটি ধরিয়ে দিলেন স্বাধীনের হাতে। এরপর পুনরায় গিয়ে পূর্বের স্থানে বসে শেষ ব্যাগ থেকে বের করলেন ছোটো ছোটো চারটা রূপচাঁদা মাছ।

উনার এসব কর্মকাণ্ড স্বাধীন আর হামিদুল হক বিস্ময় নিয়ে দেখলেন। বললেন,“এসব কোত্থেকে নিয়ে এলি? আর এই বঁটি, ছুরি?”

“বঁটি, ছুরি বাড়ি থাইক্কা আওয়ার সময় লগে আনছি। আর এই মাছ কেয়ারটেকারের লগে বাজার থাইক্কা গিয়া আনছি। দোকানদার ব্যাডা আমারে বলদ ভাইবা শুরুতে অনেক দাম চাইছিল। এরপর আমিও শুরু কইরা দিলাম দামদর। আর না পাইরা কমে দিয়া দিছে। শিথিল বাজানের কাছে হুনছিলাম, এনে নাকি সোনার মতো দেখতে চান্দা মাছ পাওয়া যায়! আর ডাব আনছি পাড় থাইক্কা।”

বিস্ময় ভাব কাটলো না কারো। স্বাধীন বললো,“কিন্তু দুপুরের খাবার তো হোটেল থেকেই দিবে, চাচা। এখানে তো রান্নার কোনো ব্যবস্থা নেই।”

“তুমি চিন্তা কইরো না। এই বঁটি দেখতাছো না? এইডা দিয়া এনেই সব কাটাকাটি করমু। আর রান্না করমু নিচে গিয়া। এক কর্মচারীর লগে কথা হইছে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হামিদুল হক। হতাশ কণ্ঠে বললেন, “তাই বলে তুই সঙ্গে করে ছুরি বঁটি আনবি, হারুন? কেউ যদি চেক করতো? তাহলে তো ধরা পড়ে যেতি। তোর জেল হয়ে যেতো।”

হারুন চাচার মুখশ্রীতে ক্ষণকালের জন্য কিছুটা ভয়ের দেখা মিললো। আসার পথে তো এমনটা তিনি ভাবেননি!

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)