#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৮]
সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে আরফিন। পায়ে তার গভীর এক জখম হয়েছে। উপরের চামড়া ছিঁলে বেরিয়ে এসেছে মাংসপেশী। সাদা ব্যান্ডেজে ক্ষতস্থান আবৃত করে কিছু পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে কেবিন থেকে বিদায় নিয়েছেন ডাক্তার। নার্স বদলে দিচ্ছেন স্যালাইন। তখনি হুড়মুড় করে একে একে ভেতরে ঢুকে পড়ল বন্ধুরা। যে যেখানে পারলো গিয়ে বসলো।
শিথিল আর শান্ত গিয়ে একেবারে বসলো রোগীর দুই পাশে। ব্যথা ভুলে গেলো আরফিন। সব কয়টা ইতর, বদমাইশের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। উপস্থিত নার্স মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে আগত ব্যক্তিদের দেখে কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন,“এই, এই আপনারা কারা? এভাবে ভেতরে ঢুকে পড়েছেন কেনো?”
তুহিন সৌজন্য হেসে বললো,“আমরা পেশেন্টের বন্ধু। গার্ডিয়ানও বলতে পারেন।”
“তাই বলে একসঙ্গে সবাই ঢুকে পড়বেন?হাসপাতালের কিছু রুলস আছে সেসব জানেন তো?”
নার্সের কথায় কাউকে পাত্তা দিতে দেখা গেলো না। সজীব আচমকাই বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল অহেতুক কথা,“দোস্ত মেয়েটা কি সুন্দর না! আমাদের পা ভাঙা আরফিনের কী ভাগ্য বল? শুয়ে শুয়ে কিনা এই পরীর সেবা নিবে!”
নার্স অবাক হলো। অধৈর্য হয়ে ধমকালো,“কী বললেন আপনি? এই অসভ্য!”
শিথিলও ধমকালো,“হতচ্ছাড়া, হাসপাতালে এসেও ইভটিজিং করছিস? পাবলিক পিটিয়ে রক্তাক্ত করলে যাবি কোথায়? কে সেবা করবে?”
কথাটা হেলায় উড়িয়ে দিয়ে ভাবলেশহীন উত্তর দিলো সজীব,“কেনো? অন্য হাসপাতালের নার্স।”
মুহূর্তেই বাকিরা শব্দ করে হেসে উঠল। বাহবা দিলো। যেন এটা কোনো হাসপাতাল নয় বরং মাছের বাজার। নার্স রাগে কাঁপতে কাঁপতে দ্রুত হেঁটে চলে গেলেন বাইরে।
আরফিন প্রতিক্রিয়াহীন বললো,“আমার বাড়ি পর্যন্ত যে খবরটা না যায়। মা চিন্তা করবে।”
কথাটা এড়িয়ে গেলো সকলে। শান্ত’র কণ্ঠে বিদ্রুপ খেলে গেলো,“চোখ কী পাছায় রেখে হাঁটছিলি শ্লা? এক্সিডেন্ট হয় কেমনে?”
স্বাধীন কেড়ে নিলো সেই কথা,“পাছায় থাকলেও পেছনটা দেখা যায়। বরং বল পাখিতে ছিল।”
আরফিন চোখ রাঙালো,“তগো দুইটার মুখে কিছু আটকায় না? বেয়াদব।”
শিথিল বিদ্রুপ করে বললো,“প্রাক্তনের চিন্তায় এক্সিডেন্ট করে বসে আছে। মাথামোটা পোলাপাইন।”
“তুই অন্তত এই অসভ্যগুলোর সঙ্গে তাল মেলাস না।”
সজীব প্রতিবাদ করল,“প্রেম করলি তুই, লুতুপুতু করে ছ্যাঁকাও খাইলি তুই। আর অসভ্য আমরা? কেমনে? বুঝা তাড়াতাড়ি।”
শান্ত মাথা নাড়াল,“না বুঝাইলে বাম পা আমরা ভাইঙা দিয়া যামু।”
শিথিল আয়েশ করে বললো,“বলেছিলাম মেয়ে ভাগিয়ে আনি। কিন্তু রাজি হলি না। অন্তত বিয়েটা তো গিয়ে খেয়ে আসতে পারতাম? বহুদিন পুরান ঢাকার বিয়ে খাই না। অথচ সেই সুযোগটাও দিলি না। তুই তো বন্ধু না, চিরশত্রু।”
বাকিরাও শিথিলের সঙ্গে সহমত পোষণ করল। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরফিন। কপাল করে পাবনা ফেরত পাগল পেয়েছে কয়েকটা। দুঃখের দিনে মানসিক মনোবল না দিয়ে মজা নিচ্ছে। বিরক্ত হয়ে বললো,“যা তোরা। নিজেদের কাজে যা। একটু শান্তি দে।”
সজীব নাকোচ করল,“উহুম, নার্সকে তোদের ভাবি হিসেবে পছন্দ হয়েছে। আগে পটিয়ে ফোন নাম্বার নিবো তারপর যেখানে যেতে বলবি যাবো।”
স্বাধীন, শান্ত উঠে দাঁড়াল। বন্ধুর কাঁধে ভরসার হাত রেখে বললো,“চল তোকে সাহায্য করি।”
সজীব খুশি হলো। তুহিনের দিকে তাকিয়ে বললো,“কী রে হাবাইত্তা? চল।”
একবার শিথিলের দিকে তাকিয়ে বাধ্য ছেলের মতো উঠে দাঁড়াল তুহিন। জিজ্ঞেস করল,“শিথিল যাবে না?”
শান্ত বললো,“ও তো উত্তম পুরুষ। শুভ কাজে উত্তম পুরুষের কোনো কাম নাই।”
স্বাধীন ঠাট্টা করে বললো,“আর কদিন পর নষ্ট পুরুষ হয় যাবে।”
সকলে একসঙ্গে প্রশ্ন ছুঁড়ে,“কাহিনী কী?”
স্বাধীন এড়িয়ে গেলো,“পরে বলবো। আগে আমাদের সজীবের লাইন ক্লিয়ার করি।”
তারপর চারজন সত্যি সত্যি বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। শিথিল শীতল দৃষ্টিতে দেখে গেলো অসভ্যদের কাজকর্ম। এরা আর কখনো শোধরাবে না।
নার্স মেয়েটি সর্বপ্রথম রিসেপশনে এসে নালিশ করল। সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। সাথে একটু বাড়িয়ে বলতেও ভুললো না। কথা বলতে বলতে ছেলেগুলোকে নজরে পড়তেই চোয়াল শক্ত করে রিসেপশনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে বললো,“ওই যে ওই ছেলেগুলো।”
শান্ত, স্বাধীন, সজীব পাশে এসে দাঁড়াল। তুহিন তাদের পিছনে। রিসেপশনের লোকটি বিনীত স্বরে বললেন, “এটা হাসপাতাল, স্যার। এখানে অনেক পেশেন্ট রয়েছে। আর তাদের সেবার জন্য রয়েছে আমাদের এই নার্স আপু আর ভাইয়ারা। এখন আপনারাই যদি হুট করে তাদের অপমান করেন তাহলে কী হবে বলুন তো? যাবে কোথায় উনারা?”
শান্ত মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। বললো,“আপনি আমাদের ভুল বুঝছেন। এই ম্যামের সঙ্গে আমরা কোনো খারাপ আচরণ করিনি। হঠাৎ বন্ধুর দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছুটে এসেছি। অলরেডি তা আপনাদের আমি জানিয়েছি। উনিই বরং আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন। এমন আচরণ তো একজন ডাক্তারও করে না।”
ভদ্রলোক তাকালেন নার্সের দিকে,“কথা কী সত্যি, রিপা? পেশেন্টের বাড়ির লোকদের সঙ্গে এ কেমন আচরণ?”
রিপা আমতা আমতা করল,“আমি মানছি আমি না হয় ওভার রিয়েক্ট করে ফেলেছি। কিন্তু উনারা যে আমায় খারাপ ইঙ্গিত দিয়েছে এর কী হবে?”
এর উত্তর সজীব দিলো,“খারাপ ইঙ্গিত? আমরা ভদ্র ঘরের ছেলে। খারাপ অভিযোগ আনবেন না। শুধু বলেছি আপনি সুন্দর। কাউকে সুন্দর বলা খারাপ ইঙ্গিত? তাহলে কাল থেকে মুখ ঢেকে আসবেন।”
বলেই স্থান ত্যাগ করার জন্য উদ্যত হলো সে। বন্ধুরাও তার পিছু চলতে থাকলো। স্বাধীন ফিসফিসিয়ে বললো, “পটাতে এসে অপমান করে গেলি?”
“মেয়ে পটানোর প্রথম ধাপ এটা, বুঝলি? সব মেয়ে রোমান্টিক কথায় পটে না।”
বাকিরা অবাক হলো। প্রশংসা করল তার বুদ্ধির। আজ রাতটা হাসপাতালেই থাকতে হবে আরফিনের। আরো কিছু পরীক্ষা বাকি আছে। যা কাল হবে। দুপুর পর্যন্ত সকলে হাসপাতালেই থাকলো। জমিয়ে আড্ডা দিলো। মন ভালো করে দিলো আরফিনের। ঘুমের ওষুধ খেয়ে এখন ঘুমাচ্ছে সে। সেই সুযোগে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো সকলে। স্বাধীন সুযোগ বুঝে ফিসফিস করে শিথিলের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,“পেয়ে গিয়েছি, শীতল!”
“কী?”
“মেয়ের রুম নাম্বার।”
“ভুলে যা।”
“কেনো?”
“এমনি। এ বিষয়ে আরেকটা কথা বললে তোকে আমি ছুঁড়ে মারবো।”
“তোর মতো মাথামোটা আমি আর দুটো দেখিনি।”
মুচকি হাসলো শিথিল। তারপর কাছেপিঠের একটি রেস্তোরাঁয় গিয়ে সবাই একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেলো।
_________
ফেব্রুয়ারি শেষ হতে আর দুদিন বাকি কেবল। এই সময়ে মশার উৎপাত বাংলাদেশে একটু বেশিই থাকে। কোথাও শান্তিতে দাঁড়ানো কিংবা বসার উপায়টুকু নেই। গরম এখনো পুরোপুরি পড়েনি। শেষরাতে ঠান্ডার তেজ প্রকট। তার উপর গতরাতে আকাশে মেঘ ডাকার শব্দ হয়েছে। সকাল থেকে বইছে ঠান্ডা বাতাস। বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা। বৃষ্টি এলে অবশ্য ভালোই হবে। মশার উৎপাত থেকে খানিকটা নিস্তার মিলবে।
বন্ধুদের বিদায় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কার্জন হল পেরিয়ে বদরুন্নেসা কলেজের সামনে এসে থামলো শিথিল। গেটের সামনে টানানো বিশাল সাইনবোর্ডের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল। কয়েকদিন ধরে মনের সঙ্গে তার যুদ্ধ চলছে। খুব হাড্ডাহাড্ডি যুদ্ধ। কিন্তু সেই যুদ্ধের সঙ্গে কোনোভাবেই পেরে উঠছে না যেন। এই যে আজ! আজও তো যুদ্ধে হেরে গিয়ে মনকে জিতিয়ে দিয়ে চলে এলো। কিন্তু লাভটাই বা হলো কী?
“কাউকে খুঁজছেন?”
ভড়কে গিয়ে পেছন ফিরে তাকালো শিথিল। পরিচিত মুখ দেখে অপ্রস্তুত হলো। দৃষ্টিতে খেলে গেলো বিস্ময়। আবৃত্তি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো। কাঁধের ব্যাগ টেনে ঠিক করে ফের জিজ্ঞেস করল,“হঠাৎ এদিকে? আপনি তো সম্ভবত বুয়েটে পড়েন, তাই না?”
নিজেকে সামলে নিলো শিথিল। কৃত্রিম হেসে চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো,“তো? বুয়েট ছাড়া কী অন্য কোথাও আসা যাবে না?”
“না, তা বলতে চাইনি।”
“ঢাকা মেডিকেলে এসেছিলাম বন্ধুকে দেখতে। এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কী করবো? তাই ভাবলাম হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে এদিকে এসেছি।”
“আমি ভাবলাম মেয়ে দেখতে এসেছেন হয়তো।”
হাসি চওড়া হলো শিথিলের,“কেনো? বুয়েটে কী মেয়ের আকাল পড়েছে?”
“তা তো জানি না।”
“তুমি বাইরে কী করছো?”
“তেমন কিছু না।”
“ব্যস্ত?
“না।”
“চলো হাঁটি তবে।”
আবৃত্তি হা না কিছু করল না। শিথিল নিজের কথা শেষ করেই হাঁটতে লাগলো সামনের পথ ধরে। এখন বিকাল চারটা। আবৃত্তিও পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে তার সাথে। নিরবতা ভেঙে বললো,“কোথায় যাচ্ছি?”
“জানি না।”
“গন্তব্যহীন পথ?”
“হ্যাঁ, পছন্দ নয়?”
“জানি না।”
“নিজের সম্বন্ধে জানো না?”
“জানি তবে পছন্দ অপছন্দের খবর রাখি না। কখনো এভাবে কারো সঙ্গে হাঁটাও হয়নি।”
“রাখা উচিত। মানুষের দুনিয়াবি জীবন তো একটাই। তাই নিজের পছন্দ অপছন্দের খবর রাখা উচিত। সাথে গুরুত্বও দেওয়া উচিত।”
শুনেও এ বিষয়ে আর কিছু বললো না আবৃত্তি। প্রসঙ্গ বদলালো,“মনে হয় বৃষ্টি নামবে।”
“হতে পারে।”
“বইমেলা এখনো চলছে?”
“হ্যাঁ, আরো দুদিন চলবে।”
“গিয়েছিলেন?”
“না, অনেকদিন যাওয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর একবার গিয়েছিলাম।”
“মাত্র একবার?”
“ছোটোবেলায় বাবার সাথে অবশ্য অনেকবার যাওয়া হয়েছে কিন্তু বড়ো হয়ে আর যাওয়া হয়নি। ইচ্ছে করেই যাইনি। ভালো লাগে না। তুমি গিয়েছো এবার?”
“আমি কোনোকালেই যাইনি।”
অবাক দৃষ্টিতে তাকালো শিথিল,“কিহ! কখনো না?”
“না, যাওয়া হয়নি।”
“কেনো?”
“একা একা কখনো তেমন কোথাও যাওয়া হয়নি আমার। তার মধ্যে বইমেলাও একটি।এখন অবশ্য হলে থাকি। যখন যেখানে ইচ্ছে যাওয়াই যায়। তবে শুনেছি বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত মেলা জমে ভালো। কিন্তু ওই সময় একা একা যাওয়া!মেয়েদের জন্য রিস্কি ব্যাপার।”
“একা কেনো? ফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড নেই?”
“অত ভালো ফ্রেন্ড নেই। আমি ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের তো তাই সহজে কারো সঙ্গে মিশতে পারি না।”
“আর বয়ফ্রেন্ড?”
“অসব কিছুও নেই। স্কুল লাইফে এসব বুঝতাম না। কলেজ লাইফ কেটেছে গার্লসে। আর এখন ভার্সিটি লাইফও কাটছে সেই গার্লসেই। স্যোশাল মিডিয়ায় তেমন একটা এক্টিভও নই। তাই আমি পুরোপুরি একা।”
ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল শিথিলের। বুক থেকে ভার কমলো যেন। আবৃত্তি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল, “আর আপনার? আপনার গার্লফ্রেন্ড কোথায়? একা একা ঘুরতে বের হন যে?”
“নেই।”
“নেই? ব্রেকআপ হয়েছে?”
“জীবনে প্রেমই করিনি গার্লফ্রেন্ড আসবে কোত্থেকে আর ব্রেকআপ হবেই বা কীভাবে?”
“কীভাবে সম্ভব?”—ভীষণ অবাক হলো আবৃত্তি।
“সম্ভভ নয় কেনো? তোমারও তো নেই। আমি কি অবাক হয়েছি?”
“আমার কেনো নেই তা তো জানিয়েছি। কিন্তু আপনার না থাকার কারণ কী? দেখতে তো মাশাআল্লাহ! সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তবুও?”
“তাই না? ব্যাপার না। আমার বাবা কিংবা বন্ধুরাও এ কথা বিশ্বাস করে না। মাঝেমধ্যে তো বাবা গর্দভ বলে ঠাট্টাও করে।”
“আপনার বাবা?”
ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছে আবৃত্তি। হাতের ইশারায় রিক্সা দাঁড় করালো শিথিল। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“এক রিক্সায় বসতে অসুবিধা হবে না তো? হলে বলে দাও। আরেকটা ডাকি।”
“আবার কোথায় যাবো?”
“বইমেলায়।”
“এখন?”
“হ্যাঁ, মেয়ে নিয়ে কখনো যাওয়া হয়নি। চলো তোমাকে দিয়ে শুরু করি। এশার আজানের আগ পর্যন্ত ঘুরবো। এরপর পৌঁছে দিয়ে যাবো। অসুবিধা কোনো?”
“অসুবিধা কীসের?”
বলেই উঠে বসলো রিক্সায়। শিথি নিজেও উঠে পড়ল। রিক্সা চালককে নির্দেশ দিয়ে আবৃত্তির উদ্দেশ্যে বললো,“দিনকাল ভালো নয় তো তাই বললাম। যুবক ছেলের সাথে যেতে যদি আপত্তি থাকে!”
কথাটা হেলায় উড়িয়ে দিয়ে গাছাড়া উত্তর দিলো আবৃত্তি,“দিনদুপুরে কিই বা আর করবেন? যখন রাতে শুনশান রাস্তায় অঢেল সময় সুযোগ ছিল তখনি তো কিছু করতে পারেননি।”
“বিশ্বাস করছো?”
“সম্ভবত।”
“হঠাৎ বদলে গেলে কীভাবে? প্রত্যেক কথার উত্তর যেন মুখস্থ। মিশমি পাগলীর থেকে ট্রেনিং নিয়েছো নাকি?”
“কিছুটা। একটু চালাক না হলে, নিজের হয়ে কথা বলতে না পারলে দুনিয়াতে চলা যায় না।”
প্রত্যুত্তর করল না শিথিল। চমৎকার হাসলো শুধু। গন্তব্যে পৌঁছে রিক্সা থেকে নামলো দুজন। ভাড়া মিটিয়ে প্রবেশ করল মেলার ভেতরে।
মেলা তখন জমজমাট। বিভিন্ন স্থানে স্যোশাল মিডিয়ার সেলিব্রিটি আর সাংবাদিক দিয়ে ভরপুর। কেউ বিভিন্ন স্টলের সামনে গিয়ে বই হাতে শুধু সেলফি তুলছে আবার কেউ বা তৈরি করছে ব্লগ ভিডিও।মানসম্মত বই আর লেখক রেখে সাংবাদিকরা লাইট ক্যামেরা নিয়ে ভিড় জমিয়ে ইন্টারভিউ নিচ্ছে নামমাত্র ফেমাস লোকদের। মাঝেমধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে নারী পুরুষের যুগল। এ যেন বইমেলা নয় বরং প্রেমমেলা।
আবৃত্তি অধীর আগ্রহে শিথিলের সাথে হাঁটতে হাঁটতে চারিদিক দেখছে। আর শিথিল দেখছে শুধু আবৃত্তিকে। এমন একটি সময়ে হঠাৎ করেই তার মস্তিষ্কে বেজে উঠল একটি গান,“তার চোখে যেন দেখলাম
আজ দিনটা বড়ো মেঘলা…
বুঝি বৃষ্টি নামবে বললো
সে আমায়…..
কেনো মেঘ সরে না রত্তি?
কেনো গল্প হয় না সত্যি?
আমি মত্ত তারই তৈরি
দোটানায়….
শিথিল অবাক হলো ভীষণ। এমন একটি সময়ে গানটা একেবারে পারফেক্ট লাগলো তার কাছে। ইচ্ছে করল মেয়েটিকে সামনে বসিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে গলা ছেড়ে গাইতে। কিন্তু পূরণ করতে পারলো না সেই ইচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“বই পড়তে পছন্দ করো?”
“হ্যাঁ, ভালোই লাগে।”
“কেমন বই পছন্দ?”
“সামাজিক আর ধর্মীয়।”
“আর রোমান্টিক?”
“পড়ি না।”
“কেনো?”
আমতা আমতা করল আবৃত্তি,“লজ্জা লাগে।”
মজা পেলো শিথিল। আবৃত্তিকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখতে দেখতে কিনে ফেলল বিভিন্ন লেখকের ভালো ভালো বেশ কিছু বই। তার মধ্যে অধিকাংশ বই রোমান্টিক আর ধর্মীয়। কেনা শেষে সবকটা ধরিয়ে দিলো আবৃত্তির হাতে। নিজের হাত দুটো পকেটে গুঁজে ভিআইপির মতো হাঁটতে হাঁটতে বললো,“ছবি টবি তুলবে? তুলে দিবো?”
“না, ছবি তুলি না।”
“কেনো? তুমি কী মেয়ে না?”
“জ্বী?”
“কিছু না। তুমি ভারি অদ্ভুত।”
“আপনিও।”
পথিমধ্যে থেমে দাঁড়াল শিথিল,“আমিও?”
“হুম।”
আবৃত্তি দাঁড়াল না। আগে আগে হাঁটতে লাগলো। শিথিল পুনরায় জিজ্ঞেস করল,“কীভাবে?”
“জানি না। আপনাকে বুঝতে পারি না।”
“দুদিনের পরিচয়ে শিথিলকে বুঝা সম্ভব নয়।”
“তাহলে? অনেকদিনের পরিচয় লাগবে?”
“উহুম, বিয়ে করে সংসার করতে হবে।”
বলেই পূর্বের মতো হাঁটতে লাগলো শিথিল। আবৃত্তি থমকালো, চমকালো। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইল। তাকে থামতে দেখে পেছন ফিরে চাইলো শিথিল। সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারলো সহজেই। শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে বলে উঠল,“মজা করেছি। সিরিয়াসলি নিও না।”
আবৃত্তি কিছু বললো না। তাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফুচকার দোকানের সামনে এসে থামলো শিথিল। বইগুলো আবৃত্তির হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,“ফুচকা পছন্দ?”
“হ্যাঁ।”
“ঝাল নাকি ঝাল ছাড়া?”
“ঝাল বেশি।”
শিথিল ফুচকাওয়ালাকে ইশারা করল। একটি টুল টেনে আবৃত্তির সামনে রেখে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বিল দিতে দিতে বললো,“এখানে বসে শান্তিতে খেতে থাকো। খাওয়া শেষে এখানেই বসে থাকবে। আমি ওদিক থেকে আসছি।”
আবৃত্তি অপ্রস্তুত ভঙিতে বললো,“আমি বিল দিয়ে দিবো, ভাইয়া। আপনি দিবেন না, প্লিজ।”
“তোমাকে খেতে বলেছি। বিল দিতে বলিনি। যত ইচ্ছে খেতে পারো। তোমার জন্য আনলিমিটেড।”
বলেই দোকানদারকে বিল ধরিয়ে দিয়ে প্রস্থান করল শিথিল। হঠাৎ করেই আবৃত্তির ভীষণ লজ্জা লাগছে। কি এক পরিস্থিতিতে পড়তে হলো আজ! শিথিল গিয়ে আরো বেশ কয়েকটা স্টল ঘুরে আরো দুটো বই কিনল। সম্ভবত একটা নতুন লেখকের বই।ভূমিকা পড়েই ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছে। সাথে অবশ্য একটা অটোগ্রাফ নিয়ে নিজ দায়িত্বে রঙিন কাগজে লিখে ফেলল একটি চিরকুট। তারপর রেখে দিলো বইয়ের ভেতরে।
আবৃত্তি এক প্লেটের বেশি খেতে পারলো না। খাবার সে একটু কমই খায়। বেশি খেলে বমি আসে। তার হাতে দুটো হাওয়াই মিঠাই ধরিয়ে দিয়ে আরো কিছুক্ষণ পুরো মেলার এ মাথা থেকে ও মাথা চক্কর দিলো দুজনে। এরপর সাড়ে সাতটা বাজার আগেই বেরিয়ে এলো। রিক্সা এসে থামলো একেবারে কলেজ গেইটের সম্মুখে। আবৃত্তি নামলো সাবধানে। মিষ্টি হেসে বললো,“এত সুন্দর মুহূর্ত দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, ভাইয়া।”
“আমি তোমার ভাই নই। ভাইয়া ভাইয়া করবে না।”
ফের অপ্রস্তুত হলো আবৃত্তি। মিনমিনে স্বরে বললো, “ভাইয়ের মতোই তো। তাছাড়া আমার কোনো ভাই নেই, তাই!”
“তোমার ভাই নেই বলেই তো আর যাকে তাকে ভাই বানাতে পারবে না। পৃথিবীতে একমাত্র যাকে তাকে ধরে জামাই কিংবা বউ বানানো যায় কিন্তু ভাই, বোন বা বাবা-মা বানানো যায় না। নিজের মায়ের পেট থেকে যে বের হবে সে-ই একমাত্র ভাই বা বোন হতে পারবে, বুঝলে?”
আবৃত্তি দুদিকে মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সে বোঝেনি। শিথিল বইগুলো সব আবৃত্তির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,“এখন রিক্সায় বসে তোমাকে বোঝানোর মতো সময় আমার হাতে নেই। আমি অনেক ব্যস্ত। তোমার নাম্বার দাও দেখি। বাসায় ফিরে ঠান্ডা মাথায় ফোন দিয়ে বোঝাবো।”
“হ্যাঁ?”
“তোমার নাম্বার।”
বোকা বনে গেলো আবৃত্তি। বোকার মতোই দিয়ে দিলো নিজের নাম্বার। শিথিল মনে মনে হাসলো। বাহির এঁটে রাখলো গাম্ভীর্যে। বিদায় নিলো,“ভেতরে যাও, আল্লাহ হাফেজ।”
“এই বইগুলো?”
“সব তোমার।”
“আমার?”
“হুম, গিফট। আসি, ভালো থেকো।”
এরপর আর দাঁড়াল না সেখানে। রিক্সা চালককে তাড়া দিয়ে মুহূর্তেই প্রস্থান করল শিথিল। আবৃত্তি ফ্যালফ্যাল নয়নে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। কি থেকে কি হয়ে গেলো বুঝতেই পারলো না।
চলবে________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)