মেঘমেদুর দিনে পর্ব-১৯+২০

0
72

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৯]

রাতটা আরফিনের সঙ্গে থাকার জন্য হাসপাতালে এসে উপস্থিত হলো স্বাধীন আর শিথিল। শান্ত, সজীব আছে হলরুমে। তুহিনকে রেখে এসেছে ফ্ল্যাটে। অযথা এত মানুষ এসে ভিড় বাঁধিয়ে করবে কী? থাকার মতো জায়গাও নেই। পাশের সিটটা খালি। শিথিল ওখানেই বসলো। আবৃত্তিকে নামিয়ে দিয়ে সোজা বাসায় গিয়ে গোসল সেরে খেয়েদেয়ে তারপর হাসপাতালে এসেছে সে। স্বাধীন বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে। আরফিনের এক্সিডেন্টের খবরটা শুনে মা ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। ছেলের বন্ধুদের সঙ্গে উনার আবার ভীষণ ভাব। মাসে এক দুইবার হলেও বাড়িতে আড্ডা দিতে চলে যায় তারা। আর উনি যত্ন করে নতুন নতুন রেসিপি ফলো করে রেঁধে খাওয়ান সকলকে। খাওয়া শেষে তাদের মুখে নিজ প্রশংসা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন ভদ্রমহিলা। তাই হাসপাতালে স্বাধীনের থাকার খবর শুনেই তিনি টিফিন বক্স ভরতি খাবার দিয়ে দিলেন সঙ্গে।

খাবারগুলো বের করল স্বাধীন। প্রথমে একটি প্লেটে বেড়ে আরফিনের হাতে ধরিয়ে দিলো। শিথিলের উদ্দেশ্যে বললো,“জমিদারের মতো বসে আছিস কেনো? ধর, নিজেরটা নিজে বেড়ে খা।”

শিথিল ব্যস্ত হাতে টাইপ করছে। একপলক স্বাধীনের দিকে তাকালো। তারপর আবারো নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বললো,“আমি খেয়ে এসেছি।”

“খেয়ে এসেছিস? আর আমি যে খাবারগুলো নিয়ে এলাম?”

“নতুন রুমমেট এসেছে। ওরাই রান্না করেছে। জোর করে বললো টেস্ট করে রিভিউ দিতে। মুখের ওপর না করা যায় বল?”

রাগ করতে গিয়েও রাগ করল না স্বাধীন। বিষয়টা সে বুঝেছে। তাই চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। টাইপ শেষে উঠে দাঁড়াল শিথিল। যেতে যেতে বললো,“তোরা খেতে থাক। তোদের জন্য ঠান্ডা কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে আসি।”

আরফিন খেতে খেতে বললো,“আমার জন্য মোজো আনিস।”

স্বাধীন নাকোচ করল,“আমার জন্য লাচ্ছি ঠিক আছে। কালা জিনিস খাই না।”

“কালো জিনিস কী করল আবার?”

“এমনিতেই কালো আমি। তার উপর জিনিস কালো খেলে আরো কালো হয়ে যাবো। তাছাড়া আম্মাও নিষেধ করেছে।”

শিথিল আর আরফিন হাসলো। শিথিল আর কিছু না বলে চলে এলো বাইরে। আরফিন খোঁচা মেরে বললো,“আর সিগারেট খাওয়া ছাড়বি না? ধোঁয়া গিয়ে তো ফুসফুসসহ সব কালা করে দিচ্ছে।”

“ওইটা বিয়ের পর ছেড়ে দিবো। তুই চুপচাপ খা, মগা।”

“শ্লা, জীবনেও ভালো হবি না তুই।”

“শালা বলবি না। আমার বোন তোরও বোন।”

“আর তুই যখন বলিস?”

“আমার একটাই বোন। বাকি সব বউ।”

আরফিনের ইচ্ছে করল উঠে গিয়ে দুটো লাথি মারতে। কিন্তু ভাঙা পা নিয়ে তা আর পারলো না। তাই ভবিষ্যৎ এর জন্য তুলে রাখলো লাথিটা।

বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির থেকে বাতাসের তেজটাই বেশি। হাসপাতালের পাশের দোকানটাতে আর যেতে পারলো না শিথিল। অসময়ে হওয়া বৃষ্টিতে ভিজলে রোগ বাঁধার সম্ভাবনা রয়েছে বেশি। পোশাক বদলানোর কোনো সুযোগ নেই। তাই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। হাঁসফাঁস করতে লাগলো মন। দুপুর থেকে এখনো পর্যন্ত সিগারেটে সুখটান দিতে পারেনি বেচারা। দিনে দুই থেকে তিনটা না খেলে তার আবার হয় না। আবৃত্তির সাথে পুরো সময়টা কাটানোর চক্করে ভুলে বসেছিল সেসব। তবে এখন না খেলেই যেন নয়। হাসপাতালের আশেপাশে ধূমপান করাটাও রিস্ক। ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে ভেতরের একটি দোকান থেকে পানীয় কিনে তৃষ্ণার্তের মতো ঢক ঢক করে গিলে ফেলল। আর উপায়ান্তর না পেয়ে শেষমেশ স্বাধীন আর আরফিনের জন্য তাদের পছন্দের পানীয় নিয়ে চলে আসার জন্য উদ্যত হলো।

দুদিন ধরে ওয়ার্ড আর ল্যাব পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট তৈরির জন্য হাসপাতালে আসা যাওয়া বেড়েছে সুশ্রীর। একনাগাড়ে বেশ কয়েক ঘণ্টা সিনিয়র ডাক্তারের পিছু পিছু ঘুরে রোগী দেখে খাতায় নোট করতে করতে ঘাড় আর পা ব্যথা হয়ে গিয়েছে তার। অবশেষে কাজ সমাপ্ত হলো। বান্ধবী জুথি কোত্থেকে যেন দৌড়ে এসে হাতে ধরিয়ে দিলো ওয়ান টাইম সাদা চায়ের একটি কাপ। চমৎকার হেসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সুশ্রী,“এই মুহূর্তে এটারই প্রয়োজন ছিল খুব। জানলি কীভাবে?”

জুথি ঘাড় চুলকে প্রত্যুত্তর করল,“আমি না, আরাফাত স্যার পাঠিয়েছেন। তোর জন্য স্পেশাল চা। আমি তো শুধু বাহক মাত্র।”

“আরাফাত স্যার?”

“হ্যাঁ, তো আর কে? তোদের প্রেম দেখে মাঝেমধ্যে আমার খুব হিংসে হয়।”

অধরের হাসি বিলীন হয়ে গেলো সুশ্রীর। মুখভঙ্গি দেখেই বুঝা গেলো কথাটা যে তার পছন্দ হয়নি। চা আর খেলো না। জুথির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “তোদের নয়। আমি উনাকে পছন্দ করি না। কখনো ভাবিনি পর্যন্ত। তাই নেক্সট টাইম এসব কথা বলবি না।”

“রাগছিস কেনো? আমি তো মজা করলাম শুধু।”

“এমন মজা আমার পছন্দ নয়।”

“স্যার কিন্তু ছেলে হিসেবে খারাপ নয়। সেম প্রফেশন। ভালো ফ্যামিলি থেকে বিলং করে। উচ্চপদে রয়েছে। সমস্যা কোথায়?”

“সেসব তুই বুঝলে তো ভালোই হতো।”

হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেলো জুথি। দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো সামনে। সুশ্রীকে থামিয়ে ইশারায় দেখিয়ে ফিসফিস করে বললো,“বলতে না বলতেই আরাফাত স্যার হাজির।”

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সুশ্রীও সেদিকে তাকালো। আরাফাত ভদ্রলোক এদিকেই আসছেন। পরনে সাদা ডাক্তারি ইউনিফর্ম। কিছুক্ষণ আগেই রোগী দেখা শেষ করে বিরতি নিয়ে সোজা বাইরে চলে এসেছে। সুশ্রী সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। হঠাৎ দৃষ্টিগোচর হলো কাউকে। বেশ অবাক হলো। আশপাশ ভুলে বড়ো বড়ো কদম ফেলে এগিয়ে এসে উঁচু গলায় ডাকলো, “শিথিল ভাই!”

ডাক শুনে পথিমধ্যে থেমে দাঁড়াল শিথিল। সবেমাত্র সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসেছে সে। সম্মুখে তাকাতেই হাস্যোজ্জ্বল মুখে হেঁটে আসতে থাকা সুশ্রীকে দেখে তার অধরেও দেখা মিললো হাসির। এগিয়ে এসে দূরত্ব কমালো,“আরে, ডাক্তার আপা!”

লাজুক হাসলো সুশ্রী। জিজ্ঞেস করল,“কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ, তুমি?”

“আমিও আলহামদুলিল্লাহ। হঠাৎ হাসপাতালে? কার কী হয়েছে? আঙ্কেল ঠিক আছেন?”

“হুম একদম ঠিক। বন্ধু এক্সিডেন্ট করেছে। পরিবারের লোক গ্ৰামে থাকে। তাই গার্ডিয়ান হিসেবে হাসপাতালে দৌড়াতে হচ্ছে।”

“ওহ, তাই বলুন।”

“তুমি এ সময় এখানে? নাইট ডিউটি পড়েছে?”

“না, এখনি কীসের? সন্ধ্যায় এসেছিলাম একটা কাজে। আম্মু প্রায় প্রায় আপনার কথা বলে। আপনি এখন আসেন না কেনো?”

“সামনে সেমিস্টার, তাই দিনকাল ভীষণ ব্যস্ততায় কাটছে।”

“বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার সময় তো ঠিকই পান। শুধু আমাদের বাসায় আসতে আর আমার কমেন্ট ম্যাসেজের রিপ্লাই দিতে আপনার যত ব্যস্ততা।”

কণ্ঠে অভিমান আর অভিযোগ ঝরে পড়ল যেন সুশ্রীর। শিথিল খানিকটা ভড়কে গেলো। বললো, “তোমরা দুই বোন মিলে আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছো?”

“ইগ্নোর করেন?”

“বোনদের শুধু ভালোবাসতে হয়, বেশি পাত্তা দিতে হয় না। সুহাসিনী আপুকেও অলওয়েজ ইগ্নোর করে চলি।”

“আমি আপনার বোন?”

সরু দৃষ্টিতে তাকালো শিথিল,“তো কী? লেখাপড়ার চাপে কী এটাও ভুলে বসেছো? তুমি নিজেই তো হাফ ডাক্তার। তোমাকে এখন কার কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিবো?”

“আপাতত ইঞ্জিনিয়ার হলেই চলবে।”

হাসলো শিথিল। দুষ্টুমি ভেবে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো কথাটা। আরাফাত দূর থেকে দুজনকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে বিরক্ত হলো। চোখেমুখে ফুটে উঠল কৌতূহল। বাধ বিচার না করেই এসে দাঁড়াল দুজনের মুখোমুখি। কৃত্রিম হেসে সুশ্রীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “উনি কে?”

হঠাৎ অপ্রত্যাশিত লোকটাকে দেখে ঘাবড়ে গেলো সুশ্রী। একপলক শিথিলের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো। শিথিল সহজভাবে উত্তর দিলো,“কাজিন হই।”

“কেমন কাজিন?”

“খালাতো ভাই, আপনি?”

সুশ্রী তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো,“উনি পুরোপুরি ডাক্তার। আমার অনেক সিনিয়র।”

আরাফাত সেই উত্তেজিত মুখশ্রী খেয়াল করল। মৃদু হেসে বললো,“ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিবে না, সুশ্রী?”

অন্যের মুখে ভাই শব্দটা শুনে কান গরম হয়ে উঠল সুশ্রীর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। উত্তর দিতে পারলো না। ইচ্ছে করল লোকটার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। তার থেকে আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে আরাফাত নিজেই হাত বাড়িয়ে দিলো শিথিলের দিকে। পরিচয় দিলো, “আমি ইয়াছিন আরাফাত। পেশায় নিউরোসার্জন। এই তো বছর দুয়েক হবে জয়েন করেছি। বাড়ি চট্টগ্রাম, তবে থাকি বনানী।”

হাত মেলালো শিথিল। নিজের পরিচয় দিলো,“নাম শিথিল হামদাদ। বুয়েটে আর্কিটেকচার পড়ছি। চতুর্থ বর্ষের শেষ প্রান্তে আছি। বাড়ি গাজীপুর।”

হাত বুকে ছুঁইয়ে মৃদু হাসলো আরাফাত। সুশ্রীর থেকে বিদায় নিলো শিথিল। যাওয়ার আগে আরাফাতের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ করে বলে গেলো,“আসি তবে? আর হ্যাঁ, অতদূরে এত বয়স্ক লোকের সঙ্গে কিন্তু বোন বিয়ে দিবো না।”

অধরের হাসি ঝট করে নিভে গেলো আরাফাতের। বোকা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ছেলেটার যাওয়ার পথে। সুশ্রী ঠোঁট চেপে হাসছে। মুখের উপর এভাবে অপমান করে কে?

খাওয়া দাওয়ার পর্ব অনেকক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে। শিথিলকে ভেতরে ঢুকতে দেখে স্বাধীন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,“কোথায় গিয়ে মরেছিলি? ফিরতে এত দেরি হলো কেনো?”

“বৃষ্টি পড়ছে। গেইট পর্যন্ত গিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে ফিরে এসেছি। মাথা ব্যথা করছে। একটা সিগারেট না খেলেই নয়।”

“সিগারেটখোর অথচ পকেটে সিগারেট থাকে না?”

“ধরা পড়লে আমার বাপ আমারে বয়রা করে দিবে। তাই পকেটে এসব রাখি না।”

“অভ্যস্ত হওয়ার আগে মনে ছিল না?”

“কৈশোরে মানুষ কত ভুলই করে। তার মধ্যে এটা ছিল আমার প্রথম ভুল। ভাবছি ছেড়ে দিবো।”

“নাটক কম কর। আমার কাছে মনে হয় তিনটা আছে। আয় দুইজনে মিলে একটা ভাগাভাগি করে খাই।”

“তিনটা থাকতে একটা ভাগাভাগি করে কেনো খাবো? ভাই কি ফকিন্নি নাকি?”

“তুই ফকিন্নি। এই জিনিসে কোনো কম্প্রোমাইজ নয়।”

“লাগবে না। তোরটা তুই খা। বৃষ্টি থামলে নিচে যাবো।”

“আচ্ছা নে, গোটা একটাই নে। জানালার বাইরে মুখ নিয়ে ধোঁয়া ছাড়িস। দজ্জাল নার্সগুলো দেখলে আবার সমস্যা।”

কথামতো শিথিল গিয়ে তাই করল। আরফিন এদের কান্ড দেখে বিরক্ত হয়ে বললো,“তোরা দুইটাই আসলে একরকম। কীসব বাল খাস।”

“তোর মতো প্রেম তো আর করি না।”—শিথিল ধমকের সুরে বললো।

স্বাধীন ঠাট্টা করল,“এই আজকে তোর এক্সের বাসর না? নাম্বার দে। কল দিয়ে বিরক্ত করি।”

আরফিন আর একটা কথাও বললো না। বালিশে মাথা রেখে সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে মুখ ঢাকলো।
___________

সারারাত আর ঘুম হলো না আবৃত্তির। ফোনের অপেক্ষায় ছটফট করতে করতে রাত্রিযাপন করল। শিথিল বলেছিল রাতে ফোন করবে। যে কথাটা আবৃত্তি বোঝেনি সে কথাটাই বিশ্লেষণ করে বুঝাবে। তাহলে ফোন করল না যে? ভুলে গেলো? সম্ভবত ভুলেই হয়তো গিয়েছে।

রাতটা নির্ঘুম কাটলেও ফজরের নামাজের পর ঘুমিয়ে পড়েছিল আবৃত্তি।সেই ঘুম ভাঙলো গিয়ে বেলা বারোটা নাগাদ। রুম তখন পুরোপুরি ফাঁকা। যে যার মতো ক্লাসে গিয়েছে।কিন্তু মাঝখানে তার ক্লাসটাই মিস হয়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে বাইরে বের হলো আবৃত্তি। খুব খিদে পেয়েছে। সকালের নাস্তা সকাল আটটা সাড়ে আটটার মধ্যেই রুম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। দুপুরেরটা আসতে আসতে দুই বা দেড়টা বাজে। এতক্ষণ ধরে না খেয়ে থাকা একদমই সম্ভব নয়। পাশের একটি হোটেল থেকে পরোটা আর তরকারি কিনে এনে ক্ষুধা নিবারণ করল আবৃত্তি।তারপর টেবিলে বসে সমাপ্ত করল ক্লাসে দেওয়া অর্ধ সমাপ্ত এসাইনমেন্টটা।

শরীরটা বেশ ঝরঝরে ফুরফুরে লাগছে তার। বেলা করে ঘুমানোর জন্যই হয়তো। মোবাইল হাতে নিতেই চোখে পড়ল একটি নোটিফিকেশন।ছাত্রীনিবাসে উঠার পর থেকেই বাবাকে সে খুঁজছে। শুধু একবারের জন্য দেখা করার উদ্দেশ্যে। ভদ্রলোকের সাথে অনেক হিসাব নিকাশ বাকি রয়েছে। সেই হিসাব নিকাশ না চুকালে এ জীবনের অর্থই বা আর থাকলো কই? এমন অর্থহীন জীবন আর ভালো লাগছে না আবৃত্তির। অন্যায় না করেও প্রতি মুহূর্তে শাস্তি ভোগ করতে ভালো লাগছে না। খালার সঙ্গে তার আর যোগাযোগ নেই। নিজ থেকে খালা নিলুফা কখনোই আর আবৃত্তির সাথে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেননি। তাছাড়া মামাদের কাছে বাবা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর পাবে না বলেই নিশ্চিত সে।

তাই নিজের জন্ম সনদ ঘেঁটে দাদার ঠিকানা খুঁজে বের করেছে। বাবার ছবি আর পুরো নামটাও সেখান থেকেই পেয়েছে। এরপর স্যোশাল মিডিয়া ঘেঁটে ঘুঁটে বের করেছে ভদ্রলোকের আইডি। সেখান থেকেই আবার সন্ধান পেয়েছে লোকটার বোন ছেলের। সেই বোন ছেলের নাম পাভেল। বর্তমানে সে ঢাকা কলেজে মাস্টার্স পড়ছে। তার সঙ্গে দেখা করতেই তো সেদিন চন্দ্রিমা উদ্যানে গিয়েছিল আবৃত্তি। পাভেলের থেকে জানতে পেরেছে বাবা এখন আর বাংলাদেশে থাকেন না। স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুদূর কানাডায় বাস করেন। বছরে দুইবার আসেন। তাও পরিবারের সঙ্গে ইদ পালনের উদ্দেশ্যে। এসেই এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সর্বপ্রথম উঠেন ঢাকায় নিজেদের ফ্ল্যাটে। ওখান থেকে গ্ৰামের বাড়ি নরসিংদী যান।

এখনকার ম্যাসেজটাও পাভেলের থেকেই এসেছে। সেই ম্যাসেজে নজর ঘুরালো আবৃত্তি। তাতে লেখা, “এবার মামা বোধহয় রমজানের ইদটা আর দেশে পালন করবেন না। নানু ভীষণ অসুস্থ। গতকাল দুপুরে ঢাকার একটি হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়েছে। তাই কাল পরশুর মধ্যে মামার আসার সম্ভাবনা বেশি। এসে এক সপ্তাহ থাকবেন নিশ্চিত। এ খবর যে আমি তোমাকে দিয়েছি তা আবার কাউকে বলো না প্লিজ।”

এতটুকুই লেখা। তার নিচে দেওয়া একটি ঠিকানা আর হাসপাতালের নাম।ঠিকানাটা আবৃত্তির বাবার। সেদিকে তাকিয়ে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আবৃত্তির। জানালার বাইরে তাকিয়ে বিষণ্ণ হাসলো। কতটা নিষ্ঠুর হলে একজন লোক এত সহজে নিজের রক্তকে এভাবে ভুলে যেতে পারে?ওই নিষ্ঠুর লোকটার মুখোমুখি হতে চায় আবৃত্তি। চোখে চোখ রেখে সব প্রশ্নের উত্তর চায়। এভাবে তো আর লোকটাকে সুখে থাকতে দিতে পারে না সে।

ক্লাস সেরে বিদিশা এলো ঠিক দুপুরে। পরনের পোশাক না বদলেই বিছানায় ছেড়ে দিলো শরীর। মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে যায় অল্পতেই। ক্লান্ত কণ্ঠেই বললো, “আধ বেলা একা একা ঘরে বসে থাকতে কেমন লাগলো?”

“খারাপ না। তুমি আমায় ডাকলে না কেনো?”

“ডাকিনি মানে? কুম্ভকর্ণের মতো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলি তুই। ডাকলাম, চিমটি কাটলাম তারপরেও উঠিসনি।”

“রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি তাই। আগে তুমি তোমার এসব বদভ্যাস দূর করো তো। বাইরে থেকে ফিরেই হাত মুখ না ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড় কেনো? নোংরা।”

“আসছে আমার পরিষ্কার ওয়ালী।”

ভেংচি কেটে উঠে গেলো বিদিশা। পোশাক বদলে সেরে এলো একেবারে গোসল। দুপুরের খাবার এলো তার কিছুক্ষণ পর। খেতে খেতে বিদিশা বললো,“কাল নাকি বইমেলার লাস্ট ডেট। চল আজ গিয়ে ঘুরে আসি। সব ট্রিট তোর দুলাভাইয়ের।”

আবৃত্তি নাকোচ করল,“তোমরাই যাও। আমি আজ আর বের হবো না। গতকাল গিয়েছিলাম।”

“কার সঙ্গে গিয়েছিলি? আমি ছাড়া তো তোর আর কোনো বান্ধবীও নেই। আর অতগুলো বই কে কিনে দিলো?”

তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো না আবৃত্তি। রয়ে সয়ে বললো, “এক ভাইয়ার সাথে। উনিই উপহার দিয়েছেন।”

অবাক হলো বিদিশা। আতঙ্কিত কণ্ঠে চেঁচালো,“কিহ! একটা ভাইয়া! মানে একটা ছেলে! একটা ছেলের সঙ্গে তুই বইমেলা ঘুরে এসেছিস? তাও রাতবিরেতে? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না কেনো? চিমটি কাট।”

শঙ্কিত হলো আবৃত্তি। চোখ রাঙাল,“আসতে বলো। যা ভাবছো তেমন কিছু নয়। অনেকদিনের পরিচয়।”

“কতদিনের? কেমন করে পরিচয় যে একেবারে বিশ্বাস করে ঘুরতে চলে গিয়েছিস? কই আমার সঙ্গে তো কখনো সন্ধ্যার পরে বের হসনি।”

“আমার মামাতো বোনের দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই।”

“অ্যা! এটা আবার কেমন সম্পর্ক?”

বিদিশা ভেবে পেলো না। খাওয়া রেখেই ভেঙে ভেঙে মিলাতে লাগলো সম্পর্ক। কিন্তু কিছুতেই মিলাতে পারলো না। দুপুরের খানিক বাদে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো। আবৃত্তি রিসিভ করতেই বিপরীত পাশ থেকে কথা বলে উঠল একটি পুরুষ কণ্ঠ, “আসসালামু আলাইকুম। ফ্রি আছো, আবৃত্তি?”

আবৃত্তির গলা কাঁপলো। সালামের জবাব নিয়ে জিজ্ঞেস করল,“কে?”

“আমি শিথিল। ফ্রি থাকলে বাইরে এসো।”

উত্তরের অপেক্ষা না করেই কেটে দিলো কল।

চলবে ________

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২০]

মাধ্যমিক পরীক্ষার চক্করে দিনগুলো ভীষণ ব্যস্ততায় কেটেছে মিশমির। আপাতত সেই ব্যস্ততার সমাপ্তি ঘটে জীবনে ফিরে এসেছে শান্তি। এক দুপুর ঘুমিয়ে তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে খাবার খেয়ে গোসল সেরে সাজতে বসলো সে। পরিধান করল গাঢ় কমলা আর লালের মিশেলে একটি শাড়ি। সাজগোজে ভীষণ এক্সপার্ট সে। ইউটিউব দেখে শিখেছে। হাত ভরতি কাঁচের চুড়ি আর পায়ে চিকন দুটো ছন্দহীন পায়েল পরে সাজের সমাপ্তি ঘটিয়ে আয়না দেখলো। মাকে বলেছে বান্ধবীদের সঙ্গে আজ রমনায় ঘুরতে যাবে। শাহিনূর অবশ্য এ নিয়ে কিছু বলেননি। নিরব সম্মতি দিয়েছেন।

মিশমির ভেতরটা উত্তেজনায় ছেয়ে যাচ্ছে। মাকে সে মিথ্যে বলেছে। আসলে বান্ধবী নয় বরং কোনো এক বন্ধুর সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছে।ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে মুখশ্রী। বিছানায় বসে পা ঝুলিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে ম্যাসেজ চেক করল। এরপর কন্ট্রাক্ট থেকে খুঁজে বের করে কল দিলো শিথিলের নাম্বারে। পরপর তিনবার। রিসিভ হলো না। বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নিলো মিশমি।ইচ্ছে করল ব্যাটাকে বেশ কয়েকটা গালি দিতে। চোয়াল শক্ত করে ফের ডায়াল করার আগেই শিথিলের কল এলো। রিসিভ করতেই গম্ভীর কণ্ঠ থেকে ভেসে এলো প্রশ্নের ঝুলি,“সমস্যা কী? বিরক্ত করছো কেনো?”

“কল রিসিভ করতে দেরি করছিলেন কেনো? আমি কী পিরিত করার জন্য আপনাকে কল দিয়েছি?”

“কে জানে কীসের জন্য কল দিয়েছো? তোমার তো মতলব ভালো নয়।”

“যাক, আজ আর রাগ করলাম না।”

“গলা ঝেড়ে কাশো, ব্যস্ত আছি।”

“ঘটনা তো একটা ঘটিয়ে ফেলেছি, ভাইয়া।”

“জীবনে ঘটনা ছাড়া আর কিই বা ঘটাতে পেরেছো? মূল কথা বলো।”

“কীভাবে বলি? লজ্জা করছে।”

“লজ্জা কেটে গেলে কল দিও, আল্লাহ হাফেজ।”

“না না কাটবেন না, ভাইয়া। শুনুন না।”

“বলো।”

“আসলে.. ইয়ে.. মানে।”

“ন্যাকামি তোমার সঙ্গে যায় না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিশমি। দাঁত দিয়ে বুড়ো আঙুলের নখ কামড়ালো। এরপর ঢোক গিলে শাড়ির আঁচল আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বললো,“একটা ছেলের উপর ত্রিশ নাম্বার ক্রাশ খেয়েছি। মাস তিনেক আগে অনলাইনে পরিচয়।”

অবাক হলো শিথিল,“ত্রিশ নাম্বার ক্রাশ? মানে কী? ঊনত্রিশ কে?”

“কোচিংয়ের এক ভাইয়া।”

“আটাশ কে?”

“আপনি।”

“আমিই!”

“হ্যাঁ।”

“সাতাশ?”

“চাচাতো ভাই।”

“আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। এক থেকে ছাব্বিশ পর্যন্ত লিস্ট করে পাঠাও তো।”

“সবার কথা মনে নেই। আপনাদের চারজনের কথাই মনে আছে। আসল কথা শুনুন।”

“বলো।”

“কথা বলতে বলতে প্রেমে পড়ে গিয়েছি। ছেলেটা খুব চমৎকার। কথা ছিল পরীক্ষা শেষে দেখা করবো। আজ ফেব্রুয়ারির শেষ দিন। তাই আজকেই আমরা দেখা করছি।”

“এখন কী বলবো আমি? তুমি তো একটা এঁচড়ে পাকা মেয়ে। বয়সের আগেই পেকে গিয়েছো। এটা কী প্রেমের বয়স?”

“অতকিছু বুঝি না। প্রেমের বয়স না হলেও বিয়ের বয়স হয়েছে। আপনি কোথায় এখন? রমনা আসুন।”

“পারবো না। বললাম তো ব্যস্ত আছি।”

“ভাইয়া! আপনি ছাড়া আমি একা একা যাবো কীভাবে?”

“তোমার বোনকে নিয়ে যাও।”

“ও তো পেত্মী। তাছাড়া ছেলে আপনার পরিচিত। ও গিয়ে কী করবে?”

“আমার পরিচিত? কীভাবে?”

“বললাম না অনলাইনে পরিচয়? আপনার ফ্রেন্ডলিস্ট থেকেই তো এড হয়েছি। তারচেয়ে বড়ো কথা ওই ছেলেও বুয়েটে পড়ে।”

এতক্ষণ কথায় গুরুত্ব না দিলেও এবার সিরিয়াস হয়ে উঠল শিথিল। ভ্রু দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো। কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে প্রশ্ন ছুঁড়ল,“নাম কী?”

“তুহিন আহমেদ।”

মুহূর্তেই শরীরটা কেঁপে উঠল শিথিলের। মনে হলো যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, “আমার ব্যাচে পড়ে?”

“হ্যাঁ।”

“দেখতে ফর্সা? চোখে চশমা?”

“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। আপনি তো দেখছি খুব ভালো করেই চিনেন। তা ছেলে কেমন?”

“একদম ভালো না। প্লেবয় টাইপ।অলরেডি বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। তোমার মতো একটা চালাক চতুর মেয়ে এমন ফাঁদে পা দিলে কীভাবে? ছিঃ! বাসা থেকে একদম বের হবে না। দ্রুত ওকে ব্লক মারো। বোকা পোলাপাইন।”

অধরের হাসি ঝট করে নিভে গেলো মিশমির। ঠোঁট উল্টে এলো। বুকের ভেতর উথাল পাতাল করা সকল অনুভূতি থেমে গেলো। এক ফাঁকে হয়ে গেলো শূন্য। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। শিথিল মিশমির কল কেটে তুহিনের নাম্বারে কল দিলো। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হতেই ধমকালো,“এই, এই কোথায় তুই?”

“কেনো? রুমে।”

“কোথাও বের হচ্ছিস?”

“হ্যাঁ, একটা কাজ ছিল।”

“একদম বের হবি না। আমি আসছি। অপেক্ষা কর। বের হলে পা ভেঙে লুলা বানিয়ে দিবো।”

বলেই কল কাটলো সে। আশেপাশে তাকিয়ে রিক্সা খুঁজলো। আবৃত্তির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু দেখা আর হলো না। মুডটাই নষ্ট করে দিলো দুই গাধা। গেটের দিকে একপলক তাকিয়ে সেখান থেকে চলে এলো।

তৈরি হয়ে বাইরে আসতে আসতে প্রায় মিনিট পনের লেগে গেলো আবৃত্তির। তৈরি হতে সর্বদাই তার একটু সময় লাগে। বিশেষ করে হিজাব বাঁধতে। গেটের বাইরে এসে আশেপাশে তাকিয়েও কাউকে না পেয়ে ভীষণ অবাক হলো সে। এখানেই তো শিথিলের দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল। কিন্তু কোথায় গেলো ছেলেটা? চলে গেলো? বেশ কিছুক্ষণ ওখানেই একা একা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল আবৃত্তি। অপেক্ষায়। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির দেখা না পেয়ে শেষমেশ ফিরে এলো ভেতরে। বিদিশা তখন হেসে হেসে কথা বলছে মোবাইলে। তাকে ফিরে আসতে দেখে কল কাটলো। জানতে চাইলো,“এইতো লাফিয়ে লাফিয়ে গেলি। তাহলে আবার ফিরে এলি কেনো?”

“এমনি।”

“যে ফোন করেছিল সে কোথায়?”

“জানি না, কোথাও পেলাম না তো।”

“তাহলে কল দে। জিজ্ঞেস কর।”

বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে কল দিলো আবৃত্তি। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আর রিসিভ হলো না সেই কল। মুখ ভার করে বসে রইল সে। হঠাৎ করেই অনুভব করল আজ দিনটি খারাপ। ভীষণ খারাপ। চারিদিকে মন খারাপের গন্ধ।

মনে ভয় নিয়ে তুহিন পা তুলে বসে আছে খাটে। ডান হাতের নখ কামড়াতে কামড়াতে খুঁজে ফিরছে নিজের করা কোনো ভুল। কিন্তু নাহ! কিছুতেই কোনো ভুল সে খুঁজে পেলো না। তাহলে শিথিল হঠাৎ রেগে গেলো কেনো? কোনোভাবে ফেসবুকে পরিচয় হওয়া মেয়েটির কথা কী জেনে গিয়েছে? কিন্তু কীভাবে সম্ভব? তখনি হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করল শিথিল। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, কোথা থেকে ছুটে এসেছে যেন। এসেই তুহিনের মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলো সে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিলো ধীরস্থির হতে। সিরিয়াস ভঙিতে জিজ্ঞেস করল,“কোনো ধরণের প্রেমের সম্পর্কে আছিস তুই?”

তুহিন চমকালো, থমকালো। মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো,“একদম না।”

“তাহলে রমনা যাচ্ছিলি কার সঙ্গে দেখা করতে?”

“তুই জানলি কীভাবে?”

“পাল্টা প্রশ্ন করবি না। যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে শুধু।”

“এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে।”

“কে সেই ফ্রেন্ড? কোনো মেয়ে? নাম কী? মিশমি?”

“জানলি কীভাবে?”—-অবাকের চক্করে চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো তুহিনের।

শিথিল বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করল,“মিশমি আমার খালাতো বোন।”

“কিহ!”

“সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। বয়স ষোলো। আর তোর বয়স কত?”

“চব্বিশ।”

“আট বছরের পার্থক্য। তার উপর তোর লেখাপড়া শেষের পথে। চতুর্থ বর্ষ শেষ হলে ইন্টার্নশিপ শুরু হবে। পার্মানেন্ট চাকরি পেলে তোর বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিবে। ওই বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে লাভ কী? আরফিনের মতো ছ্যাঁকা খেতে চাস?”

“ও যে বাচ্চা মেয়ে আমি জানতাম না। কথাবার্তায় তো বুঝাই যায় না। বলেছিল এবার বোর্ড এক্সাম দিবে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো এইচএসসি। বিস্তারিত জিজ্ঞেসও করিনি। তাছাড়া দেখতেও মাশাআল্লাহ। সাথে কণ্ঠস্বরটাও। প্রচুর কথা বলে। তাই একটু মনে ধরে গিয়েছিল। তুই তো জানিসই আমি নরম মনের সিঙ্গেল মানুষ।”

হতাশ হলো শিথিল,“রূপ দেখেই গলে পড়তে হবে? এই মেয়ে কতটা ভয়ানক ধারণা আছে তোর? আমাকেই তো জ্বালিয়ে খায়। তোকে তাহলে কী করবে? জীবন ছারখার করে দিবে একদম। কথা বলতে গিয়েছিলি কেনো?”

“তোর সঙ্গে মিউচুয়াল ছিল। তোর ছবির কমেন্ট বক্সেও দেখেছি অনেকবার। ওখান থেকেই এড হয়েছি। এরপর ও নিজ থেকেই ম্যাসেজ দিলো। তোর কোনো পরিচিত ভেবে রিপ্লাই করেছিলাম। এরপর আরকি!”

“ভুলে যা। ওর বড়ো বোন আছে। সেটারও এখনো বিয়ে হয়নি। ডাক্তারি পড়ছে। এরপর সিরিয়াল ওর। তাই দেরি আছে। তার উপর ধনী বাপের মেয়ে। সংসার জীবনে সুখী হতে হলে সমানে সমানে কিংবা নিজের থেকে কম যোগ্যতা সম্পন্ন মেয়েদের বিয়ে করতে হয়। আশা করি তোদের সম্পর্ক বেশিদূর এগোয়নি। তাই এই সমস্যার সমাধান এখানেই করে ফেল। ব্লক মেরে দে।”

তুহিন শুধু মাথা নাড়াল। শিথিলকে সে বরাবরই বাকি বন্ধুদের থেকে একটু বেশিই বিশ্বাস করে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বুঝদার, বাস্তবিক চিন্তা করা ছেলে শিথিল। তাই সে যেহেতু বলছে নিশ্চয়ই ভালোর জন্যই বলছে। শিথিল বন্ধুর কাঁধে হাত রাখলো। আশ্বস্ত করে বললো,“বিয়ে, জীবনসঙ্গী মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটি। এখানে একবার ভুল করে ফেললেই সব শেষ। বহু আফসোস করতে হবে। তোর ভালোর জন্যই বলছি। মিশমি চঞ্চল মেয়ে। যা ইচ্ছে হয় তাই করে। বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞান কম।সবকিছু আবেগ দিয়ে ভাবে। আবেগ কেটে গেলে মুখ ফিরিয়ে নিতেও দুবার ভাবে না। তাই রূপের চেয়ে ব্যক্তি এবং ব্যক্তিত্বের মোহে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ।”

তুহিন দ্বিমত করল না। কথাগুলো ভুল নয়। মেয়েটির প্রতি তার আকর্ষণ ছিল কিন্তু বেশিদূর তো আর ভাবেনি। প্রেম, ভালো লাগা, ভালোবাসা মানুষের জীবনে কখন, কীভাবে, কার প্রতি যে চলে আসে সেসব আগে থেকেই কেউ জানতে পারে নাকি?
_________

আবৃত্তির সঙ্গে শিথিলের দেখা হলো ঠিক দুদিন পর। ধরণীর আনাচে কানাচে তখন বসন্তের ছোঁয়া।বাতাসের তালে পুরোনো পত্র ঝরে গাছের নব্য পত্ররা ঝলমলিয়ে দোল খাচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে কোকিল কণ্ঠের সুমধুর সুর। হাঁটতে হাঁটতে রমনাতে এসে পৌঁছেছে দুজন। বসন্ত, শরৎ আর বর্ষায় রমনার চিত্র বদলে যায়। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন নেমে আসে এই স্থানটিতে।

ঢাকা শহর আবৃত্তির কাছে বরাবরই নতুন। অভিভাবক ছাড়া একলা জীবনে সব নতুন থাকাটাই স্বাভাবিক। এতদিন আবৃত্তির ধারণা ছিল ঢাকা শুধু জনমানব আর ধূলোবালির শহর।এ কদিনে তার সেই ধারণা বদলেছে। শিথিল হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গিয়েছিল কোথাও। মিনিট তিনেক পর এসে আবারো হাজির হলো। হাঁটতে লাগলো পাশাপাশি।বাড়িয়ে দিলো একটি চকোডিলাইট আইসক্রিম। আবৃত্তি একপলক মাথা তুলে শিথিলের দিকে তাকিয়ে আইস্ক্রিমটা হাতে নিলো। প্রশ্ন ছুঁড়ল শিথিল,“আমার উপর রেগে আছো?”

“কই না তো। রাগবো কেনো?”

“পরশু ফোন করে আসতে বলে অপেক্ষায় রেখে চলে গিয়েছিলাম তাই।”

“আমি কারো উপর রাগ করি না।”

“স্যরি।”

প্রত্যুত্তরে শুধু মৃদু হাসলো আবৃত্তি। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই আরেকটা প্রশ্ন করে বসলো শিথিল,“ভালো আছো, আবৃত্তি?”

কণ্ঠটা কেমন যেন শোনালো। চমকে গেলো আবৃত্তি। উপলব্ধি হলো অদ্ভুত এক অনুভূতির। অধরের হাসি মিলিয়ে গেলো। থেমে রইল অনেক্ষণ। গলা কাঁপলো বোধহয়। বহু বছর ধরে কেউ তাকে এই প্রশ্নটি করেনি। শিথিলের হাতে যেন আজ অবাধ সময়। প্রশ্নটি করে উত্তরের আশায় অপেক্ষা করে রইল। একসময় বহুল প্রতীক্ষিত উত্তর এলো,“সম্ভবত না। তবুও সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ।”

“অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছো।”

বলে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল শিথিল। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে বসলো খোলামেলা ফাঁকা একটি স্থানে। গাছের নিচে। আবৃত্তি নিজ থেকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,“আর আপনি? আপনি ভালো আছেন?”

“বরাবরই আলহামদুলিল্লাহ।”

তৃপ্ত হেসে উত্তর দিলো শিথিল। একটু থেমে বললো, “ভালো থাকা খারাপ থাকা নির্ভর করে জীবনের ধারাবাহিকতা, লক্ষ্য, সফলতা আর পরিবারের উপর। এদিক থেকে আমাদের পার্থক্য অবাধ। তাই সম্ভবত আমি ভালো আছি।”

তারপর পুনরায় জিজ্ঞেস করল,“তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?”

ভাবার জন্য আবৃত্তি সময় নিলো। কিন্তু ভেবে পেলো না কোনো উত্তর। উদাস দৃষ্টিতে দোল খাওয়া গাছের পাতাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো,“জানি না।”

“জানো না?”

অবাক শোনালো শিথিলের কণ্ঠস্বর। আবৃত্তি দুদিকে মাথা নাড়াল,“উহু, এসব নিয়ে কখনো ভাবিনি। ভাবার ফুরসৎ পাইনি। জীবনে সমস্যার অভাব নেই। বলতে গেলে নিজেই সবার জীবনে একটা সমস্যা হয়ে বিঁধে আছি। তাই উনিশ বছরের জীবনে শুধু ভেবে এসেছি সবার জীবন থেকে আমি নামক সমস্যার সমাধান করার কথা। লক্ষ্য নিয়ে ভাববো কখন? সেসব ভাবনা তাদের, যাদের নিজস্ব পরিবার রয়েছে।”

“পৃথিবীতে সবাই সবকিছু নিয়ে জন্মায় না। সবার জীবনে সুখ থাকে না। জীবন শুধুমাত্র একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যাদের অবস্থা তোমার থেকেও খারাপ। তার উদাহরণ তোমার সামনেই রয়েছে। ওই দেখো ফুল বিক্রি করা মেয়েটার দিকে। অথবা দেখো সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য অদূরে পথচারীদের পায়ে ধরে, পিছুপিছু ঘুরে বেড়ানো বস্ত্রহীন বাচ্চা ছেলেটার দিকে। এদিক থেকে জীবনটা কী সুন্দর নয়?”

শিথিলের ইশারা মতো সেদিকে তাকিয়ে একদৃষ্টিতে সব দেখলো আবৃত্তি। থমকে গেলো বোধহয় কয়েক মুহূর্ত। শিথিল নরম স্বরে বললো,“সবকিছু মানুষের জন্য তৈরি হয়ে থাকে না। তৈরি করে নিতে হয়। জন্মের পর কী আমরা হাঁটতে পেরেছিলাম? নাকি কথা বলতে পেরেছিলাম? কিছুই পারিনি। অথচ এখন সব পারি। খুব ভালো করেই পারি। তাই জীবনে লক্ষ্য থাকাটা জরুরি। নইলে বেঁচে থাকার স্বাদ পাবে কীভাবে? সুন্দর একটা পরিবার তুমি চাইলেই কিন্তু গড়তে পারবে।”

“কীভাবে?”

“বিয়ে করে।”

কণ্ঠে দুষ্টুমির ছাপ স্পষ্ট। হেসে ফেলল আবৃত্তি। বললো,“তা করাই যায় কিন্তু মনমতো পাবো কোথায়? মানুষ তো আজকাল মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। আসল রূপ দেখা যায় বিয়ের পর।”

“তাও ঠিক। তোমার মামা খালারাই দিয়ে দিবে।”

“একবার তো দিচ্ছিলই। আধ বুড়ো, দুই বাচ্চার বাপের সঙ্গে। শেষমেশ পালিয়ে বেঁচেছি। তার আংশিক সাক্ষী আপনি নিজেই। পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কেউ সন্তানের ভালো চায় না, বুঝলেন?”

“কি জানি? এ ব্যাপারে আমার তেমন ধারণা নেই।”

“কেনো?”

“কারণ আমার মা নেই।”

অবাক চোখে তাকালো আবৃত্তি। বললো,“আপনারও মা নেই?”

“না, মা যখন মারা গিয়েছেন তখন আমার বয়স ছয়, আর আমার আপুর বয়স নয়। মাকে যা দেখেছি তাও সাদাকালো ছবিতে।”

“একই পরিস্থিতি তবে।”

“মোটেও না। আমাদের মধ্যে শুধু মিল হচ্ছে আমাদের উভয়ের মা নেই। আর অমিল হচ্ছে, আমার বাবা আর বিয়ে করেননি। একা হাতে আমায় আর আপুকে বাবা-মায়ের আদর দিয়ে এত বড়ো করেছেন। তাই হয়তো আমার জীবনে আহামরি কোনো দুঃখ নেই। মায়ের শূন্যতা কখনো টেরও পাইনি। মায়ের মতো একটা বড়ো বোনও তো ছিল‌।”

শিথিল সম্পর্কে গভীরভাবে তেমন কিছুই জানা নেই আবৃত্তির। কখনো মিশমিকেও জিজ্ঞেস করেনি। মিশমি যতটুকু বলেছে শুধু ততটুকুই সে জানে। তবে সেই বলার মধ্যে শিথিলের পারিবারিক জীবন কখনো ছিল না। কণ্ঠে বিস্ময় খেলে গেলো তার,“একজন লোক স্ত্রী মারা যাওয়ার পরেও বিয়ে করেননি?”

“না, আমার চাচা ফুফুরা অবশ্য চেয়েছিলেন বাবা বিয়ে করুক। অনেকবার বুঝিয়েছিলেন পর্যন্ত। কিন্তু বাবার এক কথা, আমাদের মায়ের জায়গায় অন্য কাউকে তিনি স্থান দিতে পারবেন না। আর সন্তানদেরকেও সৎ মায়ের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠতে দিতে চান না। যদিও আমি এখন উপলব্ধি করতে পারি, বাবার জন্য ওই সময়টা ভীষণ কষ্টের আর চ্যালেঞ্জিং ছিল। নইলে ভাবো দু দুটো ছেলে-মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব পালন করে, সংসার সামলে আবার কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো একজন পুরুষের জন্য কতটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়? সেই কঠিন কাজটাই আমার বাবা করেছে। আমি যখন স্কুলের গণ্ডি পার হলাম তখনো ফুফুরা আবার চেপে ধরলেন বাবাকে। নইলে বাকি জীবন বাবার কাটবে কী করে? বাবা হেসে বললেন, এই তো আছি বেশ। ছেলে আর ছেলের বউয়ের সেবা যত্ন দিয়েই কেটে যাবে বাকি জীবন।”

আঁখি পল্লব ভারি হয়ে উঠেছে আবৃত্তির। অধীর কষ্টে সামলে নিলো নিজেকে। পৃথিবীতে এমন বাবাও হয়? জানা ছিল না তার। তবে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য বাবার প্রতি তার কোনো রাগ নেই।এটা বাবার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু তাকে কেনো ছেড়ে দিলো? কেনো ভাসিয়ে দিলো অথৈ সাগরে? আবৃত্তির ক্ষোভটা মূলত এখানেই। জিজ্ঞেস করল,“উনি কী এখন একা থাকেন নাকি আপনার সঙ্গেই ঢাকায়?”

“আমাদের বাড়ি গাজীপুর। বাবাও গাজীপুরে থাকেন। ওখানকার একটি সরকারি মহিলা কলেজের সিনিয়র শিক্ষক। একা থাকেন না। সঙ্গে হারুন চাচা থাকেন। হারুন চাচা আবার আমার বাবার গ্ৰামের এক দূর সম্পর্কের ভাই। বাস্তব জীবনে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে বিয়ে করার সাহস পাননি। তবে উনার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কখন কোথায় চলে যান কে জানে?”

ধীরে ধীরে প্রসঙ্গ বদলে গেলো। দুজনার মধ্যে কত কথা যে হলো! এত কথা হয়তো এই ছোট্ট জীবনে কখনো বলেনি আবৃত্তি। তবে ছেলেটা যে ভীষণ গুছিয়ে কথা বলে এটা মানতেই হবে। যেন আস্ত এক মন ভালো করে দেওয়ার ওষুধ। দূরের এক ফুল বিক্রেতা দেখে আচমকাই শিথিল প্রশ্ন ছুঁড়ল,“তোমার প্রিয় ফুল কী? গোলাপ নাকি রজনীগন্ধা?”

“চন্দ্রপ্রভা।”

এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো শিথিল। ঘোর লেগে গেলো যেন। জিজ্ঞেস করল,“এত ফুল থাকতে এটাই কেনো?”

“পেছনে বড়ো একটা ঘটনা তো অবশ্যই আছে।”

“কী ঘটনা?”

বলবে কী বলবে না দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলো আবৃত্তি। শিথিল তার মুখভঙ্গি দেখে বুঝতে পেরে বললো,“খুব খারাপ কিছু হলে বলার প্রয়োজন নেই। তবে চাইলে নির্দ্বিধায় বলতে পারো।”

ছেলেটাকে কোনো এক অদ্ভুত কারণেই হয়তো বিশ্বাস করে আবৃত্তি। মন খুলে এর সামনে কথা বলাই যায়। মনে হয় নিরাপদ কোনো স্থান। উদাস কণ্ঠে বললো, “আমি তখন খুব ছোটো। থাকি মেজো মামার বাড়ি।ক্লাস ফাইভ, সিক্সে সম্ভবত পড়ি। আমার সব মামারাই অনেক ধনী। শহরে নিজেদের বাড়িতে থাকেন। মেজো মামার বাড়ির ছাদবাগানে ছিল বিশাল একটি গাছ। বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে সেই গাছ ভর্তি হলুদ রঙের ফুল ফুটতো। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। একদিন সেই মুগ্ধতা থেকেই ফুল ছিঁড়তে গিয়ে একেবারে ডালসহ ছিঁড়ে ফেললাম। সেটা আবার দেখে ফেলল মেজো মামার ছোটো ছেলে ফায়াজ ভাই। সে দেখেই দৌড়ে গিয়ে নালিশ করল তার বড়ো ভাই ফারিশ ভাইকে। গাছটা ফারিশ ভাইয়ের-ই ছিল। কলেজে প্রথম আসায় এক স্যারের থেকে উপহার পেয়েছিল। ভাইয়া ভীষণ রাগী ছিলেন। উনার কোনো কিছুতে কেউ হাত দিলে খুব রেগে যেতেন। তাছাড়া আমার উপর উনার আর উনার মায়ের রাগটা একটু বেশিই ছিল। ব্যস, সেদিন তিনি আমায় প্রচুর বকলেন। সারাদিন কান ধরিয়ে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন উনার ঘরের বারান্দায়। রাতে মামা আসার পর অবশ্য মুক্তি মিলেছিল। তবে ভয়ের চোটে রাতে এসেছিল গা কাঁপিয়ে জ্বর। তার জন্য মামার কাছে তিনি বকাও খেয়েছিলেন অনেক। এরপর থেকে সুযোগ পেলেই সারাক্ষণ আমায় বিরক্ত করতে লাগলেন। ওখান থেকেই ওই ফুল আমার একটু বেশিই প্রিয়। যতবার দেখি ততবারই ওই ঘটনা মনে পড়ে যায়।”

সবটা শুনে মেয়েটার জন্য খারাপ লাগলো শিথিলের। কোনো কিছু না ভেবেই সহজ কণ্ঠে বলে উঠল, “আমার মায়েরও এই ফুল ভীষণ প্রিয় ছিল। তাই বাবা আমাদের বাড়ির গেটের কাছে ছোট্ট একটি চন্দ্রপ্রভা গাছের চাড়া লাগিয়েছিলেন। সেই গাছ এখন অনেক বড়ো হয়েছে। বছরে বছরে অনেক ফুল দেয়। সেই গাছ থেকে ফুল কিংবা ডাল ছিঁড়ে ফেললেও তোমায় কেউ কিছু বলবে না। এ ঘর থেকে ও ঘর ছুটে বেড়ালে কেউ বকবে না। রান্নাঘরে গিয়ে জিনিসপত্র এলোমেলো করে রাখলেও দেখার মতো কেউ থাকবে না। ওখানে কোনো ভয় কিংবা শাস্তি নেই, আছে শুধু ভালোবাসা আর স্নেহ।”

আবৃত্তি হা করে তাকিয়ে রইল শিথিলের পানে। অবাক তার চাহনি। কথার মানে বুঝেও যেন বুঝলো না। শিথিল পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে মেয়েলি চোখের দিকে তাকিয়ে শব্দহীন হাসলো।

চলবে ________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)