মেঘমেদুর দিনে পর্ব-২১+২২

0
72

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২১]

“তোমার জীবনে সুস্থ একটা পরিবার নেই, বুকে মাথা রেখে কাঁদার মতো কিংবা নিশ্চিন্তে ঘুমানোর জন্য নিজস্ব কোনো মানুষ নেই, স্বস্তিদায়ক ঘর নেই, অপেক্ষা করার জন্য কেউ নেই। আর আমার ঘর থাকলেও ঘর সামলে রাখার মতো মমতাময়ী কোনো নারী নেই, মাথায় হাত রেখে ভরসা যোগানোর মতো মেয়েলি নরম হাত নেই। তাই আমরা একে অপরের হয়ে গেলে লাভ বৈকি কোনো ক্ষতি কিন্তু হবে না।”

আবৃত্তির দৃষ্টি সরলো না। বরং স্থির এবং গাঢ় হলো। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“মজা করছেন?”

“তাই মনে হচ্ছে?”

“না।”

“তবে?”

“প্রপোজ করছেন?”

“ধরে নিতে পারো।”

“এগুলো নিছক আবেগ। প্রেমের সম্পর্ক আমার পছন্দ নয়।”

“আমারো না।”

“তাহলে?”

“সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি।”

“হ্যাঁ!”—-অবাক হলো আবৃত্তি।

“চলো একেবারে বিয়ে করে নেই। প্রেম, ভালোবাসার জন্য বাকি জীবন তো পড়েই আছে। এসব না হয় বিয়ের পরে হবে।”

“কী বলছেন এসব?”

“ভুল কী বলছি? বিয়ের আগে মেয়েদের পেছনে ঘুরা কিংবা প্রেম করার মতো অহেতুক সময় আমার নেই। বিয়ের বয়স হয়েছে, তাই চলো বিয়ে করে নেই। এটা হঠকারিতা বা হঠাৎ করে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়। তোমাকে আমি পছন্দ করি। কবে থেকে তা নিশ্চিত নই। তবে যতবার মস্তিষ্কে এসেছিলে ততবারই বিভিন্ন বাহানায় সরিয়ে দিয়েছি। কখনো ভেবেছি হয়তো তোমার জীবনের জটিলতা সম্পর্কে জেনে মায়া হচ্ছে, কখনো বা ভেবেছি এটা নিছকই আবেগ।কখনো জোর করে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি আবার কখনো বা! মেয়ের চক্করে আমি কখনো পড়তে চাইনি। তাই দেড় বছর আগে যখন তৃতীয়বার আমাদের দেখা হলো তখন থেকেই আমি পুরোপুরি তোমায় এড়িয়ে যেতে চাইলাম। যতবার আন্টির বাড়ি গিয়েছি ততবারই এমনভাবে গিয়েছি যাতে তোমার মুখোমুখি না হতে হয়‌ কখনো। এভাবে একসময় ভুলেও বসেছি। তবে সেদিন চন্দ্রিমা উদ্যানে আবার আমাদের দেখা হলো। শুধু দেখা হলেও না হয় মানা যেতো। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার ভেতরে যে কী চলছিল তা একমাত্র আমিই জানি। চেয়েও আর তোমায় এড়িয়ে যেতে পারলাম না। এ কদিন অনেক ভেবেচিন্তে আমি গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিজের অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছি। দেখো আবৃত্তি, আমি সোজাসাপ্টা মানুষ। মনে যা মুখেও তা। অত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পারি না। তাই সোজাসুজি বলছি, বিয়ে করবে আমায়? ঠকবে না কিন্তু।”

হাতের তালু ঘেমে উঠল আবৃত্তির। অবাধ্য অনুভূতির তান্ডবে ধুকপুক করছে বুক। অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটির থেকে এমন কিছুর সম্মুখীন যে তাকে হতে হবে তা কস্মিনকালেও যেন ভাবতে পারেনি মেয়েটা। এই মুহূর্তে ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। শিথিল তার মুখ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষাও অবশ্য করল না। আজ নিজের মনের কথা জানানোর সময়। নিজেকে মেলে ধরার সময়। জিজ্ঞেস করল,“আমায় পছন্দ নয়? ভালো করে দেখো। আমি কী দেখতে খারাপ?”

কখন ধরেই তো তাকে দেখছে আবৃত্তি। কথাটায় যেন সম্বিৎ ফিরে পেলো। আরো ভালো করে লক্ষ্য করল। বাদামী রঙের চোখ দুটো তার দিকেই নিবদ্ধ, স্থির। আহামরি ফর্সা না হলেও সুন্দর বলা চলে। চাপ দাড়িতে পৌরষত্ত্ব দারুণভাবে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। হ্যাংলা পাতলা, লম্বাটে দেহ। অপছন্দ হওয়ার কোনো কারণই থাকে না। তাই মাথা নাড়াল।শিথিল সন্তুষ্ট হয়ে বললো, “ছেলে হিসেবে আমি কিন্তু খারাপ নই। বাজে কোনো সঙ্গ নেই। মাঝেমধ্যে ওই একটু আধটু স্মোক করি, যা আজকাল সবাই করে। তবে তোমার যদি ভালো না লাগে তাহলে না হয় ছেড়ে দিবো। লেখাপড়ায়ও আমি খারাপ নই। রোজা আর ইদ শেষ হলে পরীক্ষা। চতুর্থ বর্ষ শেষ করে ফাইনাল বর্ষে উঠবো।তখন ইন্টার্নশিপের পেছনে দৌড়াবো। উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরেও যেতে পারি ঠিক নেই। এ বিষয়ে বাবা ভালো জানেন। কারণ বাবার খুব বাধ্যগত ছেলে আমি। বিয়ের পর অত বিলাসিতা দিতে না পারলেও কখনো দুঃখ দিবো না। না খাইয়ে মারবো না। কোনো কিছুতে জোর করবো না। নির্দ্বিধায় লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে। যদিও আমি এখন বেকার! বাবার টাকায় চলি তবুও তোমার সব দায়িত্ব আমার নিজের। বেশ কয়েকটা টিউশন পড়াই। রোজগার অসম্ভব ভালো। তুমি এলে না হয় আরো কয়েকটা বাড়িয়ে নিবো।”

বিস্ময় কাটছে না আবৃত্তির। সারা শরীর শুধু নিস্তেজ হওয়া বাকি। শিথিল যেন আগে থেকেই সবকিছু ভেবে রেখেছে। শীতল কণ্ঠে বললো,“আগেরবার বিয়ে থেকে পালিয়েছিলে কারণ ছেলে বয়সে তোমার থেকে দ্বিগুণ, দুই বাচ্চার বাপ আর ডিভোর্সী ছিল। কিন্তু আমি তার একটাও নই। আমার বর্তমান বয়স চব্বিশ চলছে। আর তোমার? তোমার কত? উনিশ নাকি বিশ?”

“উনিশ, মাস দুয়েকের মধ্যে বিশ হয়ে যাবে।”

“পারফেক্ট। ভালো করে ভেবে সিদ্ধান্ত নাও, আবৃত্তি। তোমার হাতে মাত্র এক মাস সময় আছে। রোজার মধ্যে আমাদের আর দেখা হবে না। পরনারীর সঙ্গে দেখা করে রোজা হালকা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। ঈদের পর না হয় দেখা করবো। উত্তর হ্যাঁ হলে সোজা বাবার সঙ্গে দেখা করিয়ে তারপর বিয়ে। কোরবানির ঈদ পালন করবো তোমার শ্বশুরবাড়িতে। ভাবো ভাবো আবৃত্তি, এমন যোগ্য ছেলে হারালে কিন্তু কাঁদতে হবে আড়ালে।”

কথা শেষ করে চমৎকার একটা হাসি উপহার দিলো শিথিল। আবৃত্তি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইল। বুক এখনো কাঁপছে। কী এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো সে? অনেক কষ্টে এলোমেলো বাক্যে শুধু জিজ্ঞেস করল,“উত্তর যদি না হয়?”

“তাহলে তোমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো একটা ভুল হবে। আমার সেল্ফ রেসপেক্ট বরাবরই হাই লেভেলের। না বললে মেনে নিবো। ইগোতে লাগবে। ছ্যাঁচড়ার মতো পেছনেও অবশ্য ঘুরবো না। তোমার দিকে ফিরেও তাকাবো না। কারণ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে আমি জানি। মেয়েদের পেছন পেছন ঘুরঘুর করার মতো ছেলে আমি নই।”

কোথাও যেন তীরের মতো বিঁধলো কথাটা। শিথিল ছেলেটাকে আজ নিজের কাছেই ভীষণ অপরিচিত লাগছে। এবার সত্যি সত্যিই ভাবতে বসলো আবৃত্তি। নিজেকে নিয়ে, এই পুরুষটিকে নিয়ে। তার চাহনি দেখে নিজের বুকে একহাত ছুঁইয়ে গুনগুন করে গেয়ে উঠল শিথিল,

‘আমার ভাঙ্গা ঘরে
ঝিমঝিমিয়ে বৃষ্টি নামবে যখন
আমি বুকটা পেতে আগলে রাখতে জানি
তুমি এই বুকেতে রাখবে মাথা মানি…
_________

আরফিনের পায়ের ব্যথা কিছুটা কমেছে। এখন আপাতত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে পারে সে। কলেজের সামনে আবৃত্তিকে নামিয়ে দিয়ে তাদের হলরুমে এসে বসলো শিথিল। বাকিরা তখন ওখানে বসেই আড্ডা দিচ্ছিল। শিথিলকে দেখে উৎসুক হয়ে উঠল সকলে। সজীব সোজাসুজি প্রশ্ন ছুঁড়ল,“কী রে, কোথায় ছিলি? আজ টিউশন নেই?”

“দুইটা ছিল। তার মধ্যে একটা বন্ধ। ছাত্রের ডায়রিয়া হয়েছে। আরেকটা সন্ধ্যার পর।”

“তো ছিলি কোথায়? কতবার ফোন দিয়েছিলাম? ইদানিং কেমন যেন বদলে গিয়েছিস।”

সরু দৃষ্টিতে সকলকে দেখলো শিথিল। স্বাধীন খোঁচা মারলো,“প্রেমে পড়লে এমন একটু আধটু হয়।”

সকলে একযোগে চমকালো,“প্রেম আর শিথিল!”

স্বাধীন রহস্যময় হেসে মাথা নাড়ল। শিথিল প্রথমে চোখ রাঙাল এরপর মেনে নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে চোখ বুঁজলো। স্বাধীনের মুখ একবার খুলেছে মানে সব আজ ফাঁস করে দিয়েই তার নিস্তার মিলবে। সত্যটা জেনে সবার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। চার জোড়া দৃষ্টি এসে স্থির হয়ে রইল শিথিলের দিকে। সেসবে পাত্তা দিলো না শিথিল। ঘাড় চুলকে পা নাচাতে লাগলো। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব। আরফিন দাঁতে দাঁত পিষে বললো,“আমি একটু প্রেম করেছি বলে কত কথা শুনালি। আর এখন কিনা নিজেই প্রেম করছিস?”

তুহিন রাশভারী কণ্ঠে বললো,“তোকে আমি নিজের রোল মডেল ভাবতাম। শেষমেশ তুইও ধোঁকা দিলি?”

“তোদের এতকাল বন্ধু ভেবে সব কথা শেয়ার করলাম। অথচ জামালপুইরার কথা তোরা বিশ্বাস করে আমার উপর প্রেমের মতো খারাপ জিনিসের অভিযোগ দায়ের করছিস?”

শিথিলের কথায় সকলে দম ফেলল। স্বাধীনের দিকে তাকালো তির্যক দৃষ্টিতে। সেসব দৃষ্টিতে থতমত খেয়ে গেলো স্বাধীন। বিলীন হলো অধরের হাসি। শিথিল ফের দাম্ভিক কণ্ঠে বললো,“বিয়ের আগে প্রেম পিরিতি করে বোকারা। তারপর ছ্যাঁকা খেয়ে বাঁকা হয়ে কান্নাকাটি করে। কিন্তু আমি তো বোকা নই বরং ভীষণ চালাক। তাই সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে এসেছি।”

হতভম্ব হয়ে গেলো সকলে। সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব? সজীব আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“বলছিস কী? কাকে দিয়েছিস? কীভাবে কী?”

ধীরে ধীরে সমস্ত কাহিনী বন্ধুদের খুলে বললো শিথিল। সকলেই যেন ঘোরের মধ্যে ডুবে গেলো। পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে হুঁশ ফেরালো। স্বাধীন চোখমুখ কুঁচকে বললো,“তুই তো শ্লা কামিনা নিকলা! জাস্ট ভালো লেগেছে বলতে বলতে একেবারে দেখা টেখা করে সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে এলি? আমাদের ভাবনার চেয়েও তুই পাক্কা খেলোয়াড়।”

বাহবা শুনে শিথিল দাম্ভিক হাসলো। আরফিন জিজ্ঞেস করল,“মেয়ে রাজি?”

“সরাসরি জানায়নি কিছু। জানানোর অবশ্য সুযোগ দেইনি। পুরো রোজার মাস ভাবার জন্য দিয়ে এসেছি। মনে হয় না হতাশ করবে।”

“যদি করে? যদি না বলে?তোর আন্টি রাজি না হলে?”

“ও না করবে বলে মনে হয় না। যদি করেও তাহলে শেষ একটা চেষ্টা আমি করবো। তবে আন্টি যে রাজি হবে না সেটা শিওর। ওই দিক বাবা সামলে নিবে।”

“তোর বাবাও জানে?”

“আরে না এখনো বলিনি।”

সবাই এবার শান্তি পেলো কিছুটা। কিন্তু ঝটকা কমলো না কিছুতেই। নারীদের থেকে একশ হাত দূরে থাকা তাদের প্রিয় বন্ধু সিঙ্গেলের খাতা থেকে নাম কেটে সোজা একটা মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে এলো! ভাবা যায়?

আবৃত্তির শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে। সম্ভবত জ্বর আসবে। বাইরে থেকে এসে কোনোমতে হাত-মুখ ধুয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে সে। ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। বিদিশা আজ আর বের হয়নি কোথাও। নতুন এসাইনমেন্ট দিয়েছে কলেজ থেকে। সেগুলোই বসে বসে করছে। আবৃত্তির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,“এই অসময়ে শুয়ে আছিস যে? এসাইনমেন্ট করবি না?”

“পরে করবো।”

“কিছু হয়েছে? কোথায় গিয়েছিলি?”

“একজনের সঙ্গে দেখা করতে।”

“টিউশন ফিউশনে যাস না যে? এমন করলে তো ওরা তোকে আর রাখবে না।”

“দুইটা টিউশন করাতাম। তার মধ্যে একটা ছেড়ে দিয়েছি। আরেকটায় সম্ভবত ওরাই আমায় ছাড়িয়ে দিবে।”

“সে কী, কেনো?”

“ছাত্রটা কেমন যেন। পড়তে বললে ঠিকঠাক পড়ে না। কথা শোনে না। সারাক্ষণ মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সেদিন তো সোজা চিঠি দিলো। খুলে দেখি আই লাভ ইউ লেখা।”

হাসলো বিদিশা,“ইউনিক ব্যাপার স্যাপার তো! শেষে কিনা ছাত্র ম্যামের প্রেম?”

“এই জন্যই ছেড়ে দিয়েছি।”

“আর দ্বিতীয়টা?”

“জানি না। ওদের হাবভাব সুবিধার ঠেকছে না।”

“আমার কাছে আরো দুইটা টিউশনি আছে। লাগলে বলিস। প্রয়োজন হলে ফ্রেন্ডদের বলে আরো জোগাড় করে দিবো না হয়।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ, টেনশন নিস না।”

কৃতজ্ঞতায় চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল আবৃত্তির। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করল,“আচ্ছা, হঠাৎ কেউ যদি বিয়ের প্রস্তাব দেয় তাহলে কী করা উচিত?”

“ছেলে ভালো, যোগ্যতাসম্পন্ন এবং ভালো পরিবারের হলে রাজি হয়ে যাওয়া উচিত।”

“সত্যি?”

“বিয়ে তো একদিন না একদিন করতেই হবে। বিয়ে, স্বামী, সংসার, সন্তান এগুলোই নারী জীবনের আসল সফলতা। মাঝখানে লেখাপড়া করো, চাকরি করো এগুলো তো আমাদের উপর মানুষের চাপিয়ে দেওয়া কিছু উদ্ভট নিয়ম।তাই সুযোগ এলে বিয়ে করে নেওয়াই উচিত। সবসময় মনের মতো ভালো মানুষ পাওয়া যায় না। আর যদি ওই তিন গুণ না থাকে তবে মুখের উপর না বলে দেওয়াই উত্তম। তোকে আবার কেউ প্রস্তাব দিয়েছে নাকি?”

আবৃত্তি ছোট্ট করে উত্তর দিলো,“হু।”

বিদিশার হাত থেমে গেলো। চমকিত দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকালো,“কে দিয়েছে? আগে থেকে চিনিস? একদম এসব ফাঁদে পা দিবি না বলে দিচ্ছি। এখনো তুই মানুষ চিনতে শিখিসনি। পারলে আমার সঙ্গে দেখা করা। কথা বলে দেখি।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো সে। আবৃত্তি মিহি স্বরে বললো,“ছেলে আমার পরিচিত। সেদিন বললাম না, মামাতো বোনের দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই।”

“বলিস কি!”

“ছেলে মন্দ নয়। মামা মামীর খুব প্রিয় সে। আমার সেজো মামা খুব চৌকস লোক। খারাপ মানুষদের তিনি পছন্দ করেন না। হেসেও তাদের সঙ্গে কথা বলেন না। সুশ্রী আপুর থেকেও উনার অনেক প্রশংসা শুনেছি অবশ্য।”

“ওহ, সেদিন চেহারা অত ভালো করে দেখতে পারিনি। ডিটেইলস বল। ছেলে কী করে? বাড়ি কোথায়? কেমন দেখতে?”

ধীরে ধীরে সমস্তটাই তাকে বলে দিলো আবৃত্তি। মুখ হা হয়ে গেলো বিদিশার। বাহবা দিয়ে বললো,“ওরে ওরে, ভেজা বিড়াল হয়ে থাকার পরেও তোর কপাল তো একেবারে খুলে গেলো রে!”

আবৃত্তি জানতো এমন কিছুই যে মেয়েটা বলবে তাকে। কিন্তু বিয়ের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হুটহাট তো আর নিয়ে নেওয়া যায় না। শিথিলের কথা বারবার তাকে ভাবাচ্ছে। ছেলেটা যে ভালো তা আবৃত্তি জানে। কিন্তু কতটা ভালো? এ খবর তার জানা নেই। একজন পুরুষ কেমন তা তখনি জানা যায় যখন তার সঙ্গে এক ছাদের নিচে, একই বিছানায় থেকে সংসার করা যায়।

শিথিলের কথাবার্তা আবৃত্তির ভালো লাগে। ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গি ব্যতিক্রম। যখন বলে তখন মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শোনা ছাড়া উপায় থাকে না। মিশমিকে জিজ্ঞেস করবে? ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপে এড আছে। মাঝেমধ্যে কথাও হয়। এই মেয়েটার সাথে থেকে থেকেই অবশ্য আবৃত্তির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কাটিয়ে উঠতে পেরেছে জড়তা। সব স্থানেই নিজেকে জাহির করতে পারার আত্মবিশ্বাস পেয়েছে। তবে মেয়েটা চতুর। সহজেই অন্যের মন পড়তে পারে। যদি তার উদ্দেশ্যও বুঝে যায়? উফ কী এক মুসিবতে শিথিল তাকে ফেলল?
___________

কয়েকদিন ধরে মিশমির ভীষণ মন খারাপ। তুহিনকে তার একটু বেশিই ভালো লেগে গিয়েছিল।অথচ সেদিন শিথিলের সঙ্গে কথা বলার কিছুক্ষণ পরেই ছেলেটা তাকে ব্লক মেরে দিলো। কত বড়ো অপমান! মিশমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, এসব শিথিল বজ্জাতটার কারসাজি।

শাফিন বেশ কিছুক্ষণ পিছুপিছু ঘুরছে। স্কুল থেকে কিছু আঁকতে দিয়েছে। আঁকাআঁকি শাফিন ভালো পারে না। সুশ্রী এসবে বেশ অভিজ্ঞ। কিন্তু সুশ্রীর ইদানিং ব্যস্ততা চলছে। দিনে বাসায় থাকে না আর রাতে হয় ঘুমায় নয়তো বই নিয়ে বসে থাকে। তাই মা কড়াকড়ি ভাবে দুই ভাই-বোনকে বলে দিয়েছেন, একদম বড়ো বোনকে বিরক্ত করবি না। মায়ের কথা সবসময় অমান্য তারা করে না। মার খাওয়ার ভয়ে। বিরক্ত সহ্য করতে না পেরে ভাইয়ের পিঠে শক্ত একটা কিল বসিয়ে দিলো মিশমি। ধমকালো,“দেখছিস না আমার মন খারাপ? বিরক্ত করছিস কেনো? নিজের ছবি নিজে গিয়ে এঁকে নে।”

মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলো শাফিন। খানিক বাদে ঘরে ফিরে এলো মাকে নিয়ে। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বললো,“ছোটো আপু আমাকে মারছে, আম্মু!”

শাহিনূরের হাতে বিছানা ঝাড়ু। চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। মিশমি এক লাফে উঠে পড়ল বিছানায়।আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল,“আজব! ঝাড়ু এনেছো কেনো?”

“শাফিনকে মেরেছিস কেনো? একটামাত্র ছোটো ভাই অথচ একটু সহ্য করতে পারিস না? সারাক্ষণ টো টো করে ঘুরতে ভালো লাগে, তাই না? ওর সব হোমওয়ার্ক আজ তুই করাবি। সুন্দর করে বোঝাবি। আরেকটা শব্দ যদি পাই তাহলে সত্যি সত্যি এই ঝাড়ু দিয়ে ঠেঙাবো।”

কথা শেষ করে শাহিনূর চলে গেলেন। রাগে দুঃখে নিজ মাথার চুল টেনে ধরলো মিশমি। অসহ্যকর! এই বাসায় আর কোনোভাবেই টিকা যাচ্ছে না। কোথাও চলে যেতে পারলে ভালো হতো। শাফিন ব্যাগ নিয়ে এসে বসলো ছোটো বোনের পড়ার টেবিলে।চোখেমুখে তার বিজয়ী হাসি। মিশমি বিড়বিড় করল,“আম্মুর চামচা একটা। একবার শুধু বাগে পাই তারপর তোর এই হাসি আমি বের করবো।”

চলবে _______

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২২]

বনানীর একটি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আবৃত্তি। সারা দেহ উত্তেজনায় শিউরে উঠছে তার। বুকে যেন হাতুড়ি পেটা করছে কেউ। কপালের ঘাম মুছে ভেতরে প্রবেশ করল সে। আজ সিঁড়ির ধাপগুলো কিছুতেই যেন শেষ হতে চাইছে না।নিজের কাছেই নিজের দেহটা ভীষণ ভারি ঠেকছে। কপালের দুপাশ ব্যথায় টলছে। মোবাইলে দৃষ্টি বুলিয়ে শেষমেশ এসে দাঁড়াল সে নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটটির সামনে। কলিং বেলের দিকে হাত বাড়িয়েও কিছু একটা ভেবে ফের গুটিয়ে নিলো। নিজেকে এত দুর্বল লাগছে কেনো আজ? এখানে তো সমস্ত হিসাব-নিকাশ চুকানোর জন্যই সে এসেছে। এসেছে এতোকাল জমে থাকা প্রশ্নের উত্তরের জন্য। চোখ বন্ধ করে লম্বা লম্বা বেশ কতক শ্বাস ফেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনলো আবৃত্তি। নিজের চোখের পানি আর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সে পারে।

চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে কলিং বেল চাপলো আবৃত্তি। মিনিট দুয়েক পর দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ালেন একজন ভদ্রমহিলা। জিজ্ঞেস করলেন,“কে আপনি?”

অচেনা ভদ্রমহিলাকে একপলক দেখে সৌজন্য অথচ কঠোর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“এখানে আইয়ুব আলী থাকেন?”

“জ্বি থাকেন। আমি উনার মিসেস। আপনি কে?”

ক্ষণকালের জন্য থমকালো আবৃত্তি। ভালো করে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলাকে দেখলো। ঘৃণায় রি রি করে উঠল সারা দেহ। এই মহিলার জন্যই তো বাবার সঙ্গে এত দূরত্ব তার! রাগ হলো ভীষণ। সেই রাগ ভেতরে চাপা দিয়ে বললো,“আপনি আমায় সম্ভবত চিনবেন না। তবে আপনার স্বামী চিনবেন। খুব ভালো করেই চিনবেন। উনার সঙ্গে দেখা করার জন্যই আমি এসেছি। ডেকে দিন।”

প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রমহিলা। চেহারা দেখে কোনো এক সন্দেহ ডানা বাঁধলো মনে। অপ্রস্তুত ভঙিতে বললেন, “এই মুহূর্তে আমরা ব্যস্ত আছি। হাসপাতালে যেতে হবে।”

“বেশি সময় আমি নিবো না। দেখা করা খুব প্রয়োজন। বহু বছর ধরে এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। দয়া করে এত নিষ্ঠুর হবেন না।”

আর কিছু বলতে পারলেন না ভদ্রমহিলা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনি বসুন আমি ডেকে আনছি। আপনার নাম কী? না মানে তাকে জানাতে হবে তো।”

“উনাকেই না হয় বলবো। আপনি শুধু গিয়ে বলবেন উনার পরিচিত একজন এসেছে। উনার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক।”

চমকালেন ভদ্রমহিলা।মস্তিষ্কে বিভিন্ন প্রশ্ন উঁকি দিলেও জিজ্ঞেস করতে পারলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেতরে চলে গেলেন।আবৃত্তি শক্ত হয়ে ঠাঁয় বসে রইল সোফায়। মনকে আজ সে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। আসার আগে যতটা কঠিন ছিল ততটাই নরম হয়ে যাচ্ছে যেন। চোখ জোড়া ভিজে উঠতে চাইছে বারবার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শক্ত হয়ে থাকার বোঝ দিতে লাগলো। বাবার সামনে কিছুতেই সে কাঁদবে না। কিছুতেই আবেগপ্রবণ বা দুর্বল হওয়া যাবে না।লোকটা সম্পর্কে বাবা হলেও বাবার কোনো দায়িত্ব এতোকাল পালন করেননি। অবহেলা করে এসেছে তাকে। বসারত অবস্থায় পুরো ড্রয়িং রুম পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো আবৃত্তি। আচমকা চোখ গিয়ে আটকালো দেয়ালে ঝুলে থাকা একটি ছবির ফ্রেমে। একটু আগে সাক্ষাৎ হওয়া সেই কৌতুহলী ভদ্রমহিলা আর পাশে দাঁড়ানো একটি ভদ্রলোক। কে এই ভদ্রলোক? আবৃত্তির বাবা? তাই তো মনে হচ্ছে। চেহারায় কত পরিবর্তন ঘটেছে! তাদের সামনে দাঁড়ানো দু দুটো জমজ ছেলে। এরা কারা? বাবার ছেলে? তার মানে মায়ের মতো তার স্থানটাও দখল করে নিয়েছে অন্য কেউ? শুকনো ঢোক গিলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো আবৃত্তি। যতটুকু চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল তাও এখন বিলীন হয়েছে। অনুভূতিশূন্য হয়ে গিয়েছে সারা দেহ।

কিছুক্ষণ বাদে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন ভদ্রলোক। চোখের চশমাটা ঠিক করে এসে বসলেন সোফায়। আবৃত্তির মুখোমুখি। ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“আহান মিরানের আম্মু বললো আমার পরিচিত কেউ নাকি এসেছে। কিন্তু আপনাকে তো আমি ঠিক চিনলাম না।”

লোকটার উপস্থিতি এতোক্ষণ খেয়াল করেনি আবৃত্তি। নিজের ধ্যানেই মগ্ন ছিল। সোজা হয়ে বসে লোকটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। বড়ো মামার মুখে শুনেছিল, সে দেখতে নাকি একেবারে বাবার মতো হয়েছে। উচ্চতা, খাড়া নাক, টানা টানা চোখ আর শ্যামলা গায়ের রঙ। সবই একেবারে বাবার ফটোকপি। সেগুলোই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো আবৃত্তি। কিন্তু বাবা তাকে দেখে চিনতে পারলো না বলে আহত হলো তার ভগ্ন হৃদয়। দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে বললো, “না চেনাটাই স্বাভাবিক। সেই কোন ছোটোবেলায় দেখেছিলেন? মনে থাকার কথা নয়।”

ভদ্রলোক অবাক হলেন কিছুটা। আপনি থেকে নেমে এলেন তুমিতে,“ছোটোবেলায় দেখেছি? কার মেয়ে তুমি? বাবার নাম কী?”

“ফারজানার মেয়ে।”

কঠোর, নিষ্প্রাণ শোনালো আবৃত্তির কণ্ঠ। ভদ্রলোক ভ্যাবলার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।যখনি কথার অর্থ দ্বার বুঝতে পারলেন তখনি মাথায় বাজ পড়ল যেন। ছলাৎ করে উঠল অন্তরাত্মা। মুখ দিয়ে বের হলো না কোনো শব্দ। উনার মুখভঙ্গি দেখে মৃদু হাসে আবৃত্তি। যেই হাসিতে মিশে আছে তাচ্ছিল্য। বললো,“হয়তো চিনতে পারছেন না। স্বাভাবিক, মৃত মানুষদের চিরকাল কেউ মনে রাখে না। তবে আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমার মায়ের নাম ফারজানা। যিনি বাইশ বছর আগে নিজের পরিবার, সুন্দর এক জীবন ত্যাগ করে আপনার মতো এক গরীব পরিবারের বেকার পুরুষের হাত ধরে বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে এক কাপড়ে চলে এসেছিল। খারাপ সময়ে আপনার পাশে ঢাল হয়ে ছিল। আমি উনার-ই সেই মেয়ে আবৃত্তি। যাকে পনেরো বছর আগে নিজের নতুন সংসারের জন্য ত্যাগ করেছিলেন আপনি। কাপুরুষের মতো বাবার সকল দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে নতুন স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার শুরু করেছিলেন। এখনো না চিনলে আর কিছু বলার নেই আমার।”

থমকালেন, চমকালেন ভদ্রলোক। অবাক চাহনিতে সামনে বসে থাকা অল্প বয়সী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। এই মেয়েটি উনার সেই ছোট্ট আবৃত্তি? নিজের রক্ত? প্রিয় স্ত্রীর প্রথম সন্তান? এত বড়ো হয়ে গিয়েছে সে! ভাবতেই বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো। পূর্বের সেই ভদ্রমহিলা নাজমা অদূরে দাঁড়িয়ে আছেন। উনার চোখেও বিস্ময়। সমস্ত কথাই যে শুনেছেন! ভেতর থেকে অল্পবয়সী ছেলে কণ্ঠস্বর থেকে ভেসে আসছে আম্মু আম্মু ধ্বনি। যা উনার শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা বুঝা গেলো না।

আইয়ুব আলীর কণ্ঠস্বর কাঁপছে।আনন্দে নাকি বিস্ময়ে তা অবশ্য বুঝতে পারলো না আবৃত্তি। তবে আনন্দ যে উনি পাবেন না তা সে জানে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে শব্দ আওড়ালেন,“আবৃত্তি! আমার সেই ছোট্ট আবৃত্তি?”

সেই কণ্ঠে কী ছিল কে জানে? আবৃত্তির চোখ দুটো ভারি হয়ে উঠল। নাক টেনে অধীর কষ্টে সামলে নিতে চাইলো নিজেকে। এই মুহূর্তে কিছুতেই সে কাঁদবে না। ভুল জায়গায় ভুল সময়ে দুর্বলতা প্রকাশ করা অন্যায়। ঠোঁট দুটো ভাঁজ করে প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বললো,“চিন্তা করবেন না, অধিকার আদায়ের জন্য আজ আমি আসিনি। আমাকে নরকে ঠেলে দিয়ে, আমার জীবন ক্ষুদ্র পোকার চেয়েও তুচ্ছ বানিয়ে আপনি আপনার নতুন পরিবার নিয়ে ঠিক কতটা সুখে আছেন তাই শুধু দেখতে এসেছি। দেখতে এসেছি একজন পাষাণ, বাবা নামের কলঙ্ক লোককে।”

এই বয়সে এসে নিজ সন্তানের মুখে এত কঠিন কঠিন শব্দ শুনে ভদ্রলোকের লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। নাজমা এগিয়ে এলেন,“তুমি আবৃত্তি? আমি তো শুরুতে চিনতেই পারিনি।”

“নিজের বাবাই চিনতে পারলো না আর আপনি কোথাকার কে?”—বিদ্রুপ ঝরে পড়ল তার কণ্ঠে।

নাজমা রাগ করলেন না। নরম স্বরে বললেন,“তোমার বাবাকে ভুল বুঝো না।”

আবৃত্তি আজ উত্তেজিত হয়ে একটা কথাও বললো না। তার কণ্ঠস্বর থেকে কঠোর বাক্য বের হলেও বাহ্যিক ভাবে সে ভীষণ শান্ত। শান্ত হয়েই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,“আপনার থেকে তা শিখবো না। সন্তান নিয়ে তো খুব সুখেই আছেন। আমার পরিস্থিতি বুঝবেন কীভাবে আপনি?জেনেবুঝে বিয়ে করেছিলেন এক সন্তানের বাপকে। অথচ বিয়ের পর সেই সন্তান নিয়েই আপনাদের মতো নারীদের যত সমস্যা! এখানে আপনার দায় কী কোনো অংশে কম? পারবেন আজ এই দায় এড়াতে?”

নাজমা দৃষ্টি সরিয়ে চুপ রইলেন। আইয়ুব আলী নিষ্পল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটির দিকে। শেষ যেদিন মেয়েটিকে কোলে নিয়েছিলেন তখনো এই মেয়ে স্পষ্ট কথা বলতে শিখেনি। বাবা বাদে ভুলভাল শব্দ উচ্চারণ করতো। সেই মেয়ে এভাবে যে উনার সামনে অভিযোগ এর থালা সাজিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়াবে কে জানতো? কখনো কী ভাবতে পেরেছিলেন তা? কথা বলতে বেশ সময় কাটিয়ে দিলেন তিনি, “বাবাকে ভুল বোঝে না মা। এই সবকিছু তোর নানা করেছে। তোর নানা জোর করে আমার থেকে তোকে আলাদা করেছে।”

এই মুহূর্তে আবৃত্তির ভীষণ হাসি পেলো। কতটা নিষ্ঠুর হলে এমন একটি সময়ে এসেও অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দায়মুক্ত হতে চায় মানুষ? বললো,“আইন অনুযায়ী অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের উপর মায়ের অধিকার থাকে সবচেয়ে বেশি। আর মায়ের পর থাকে বাবার অধিকার। কিন্তু আমার মা তো সেই ছোটোবেলাতেই মারা গিয়েছিল। তাহলে নানা কীভাবে জোর করে নিয়ে যায়?কেনো বাবা তখন আটকাতে পারলো না উনাকে? তাও কথার প্রেক্ষিতে না হয় মেনেই নিলাম। কিন্তু নানা যখন মারা যায় তখন আমার বয়স সবে ছয়। সেই সময় তো বাঁধা দেওয়ার মতো নানা ছিলেন না, তবে? নাকি তখন মামার দোষ? বড়ো মামা মারা গিয়েছিলেন আমার নয় বছর বয়সে। এরপর আমার সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল মেজো মামার উপর। অথচ উনারা কেউ মন থেকে আমার দায়িত্ব নিতে চাননি। প্রতি পদে পদে কত কটু কথা, খাওয়ার খোটা, অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। মামাতো ভাইদের মার খেতে হয়েছে। ওখান থেকে ঠাঁই হলো খালার বাড়ি। খালু দুচোখে সহ্য করতে পারতেন না। বাড়ির সমস্ত কাজ করাতেন। নিজ স্বার্থের জন্য বিয়ে দিতে চাইলেন বয়স্ক, দুই সন্তানের বাবার সঙ্গে। ওখান থেকে পালিয়ে এলাম সেজো মামার কাছে। কিন্তু ওখানেও সমস্যা। সেজো মামীর দু’চোখের বিষ আমি। না পারতেন সহ্য করতে আর না পারতেন মামার জন্য কিছু বলতে। এরপর বাড়িতে উনার মা এলো। মানসিক অত্যাচার শুরু হলো। দেড় বছর সেসব সহ্য করলাম। কেনো করলাম? শুধু দু মুঠো খাবার আর মাথার উপরের ছাদটার জন্য? ওখান থেকে মুক্তি পেতে অনার্সে ওঠার পরপরই উঠলাম কলেজ হোস্টেলে। পেট চালানোর জন্য শুরু করলাম টিউশন। কিন্তু তারপরেও দুঃখ আমার পিছু ছাড়ছে না। সমস্ত কথা কত অবলীলায় বলে দিলাম, তাই না? অথচ এই দিনগুলো পেরিয়ে আসতে আমাকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে।কতশত খারাপ দিন পাড়ি দিতে হয়েছে। একেকটা দিন যেন সহস্র বছর! এর দায়ভার আসলে কার? আপনার নয় কী? হ্যাঁ, এই সমস্ত দায়ভার আপনার। আমার জীবনের সমস্ত খারাপ মুহূর্তের দায়ভার আপনার। শুধুই আপনার। সব বিচার আমি আমার রবের কাছে আগেই দিয়ে রেখেছি। এর বিচার তিনিই করবেন। শ্বাস যতদিন চলবে ততদিন আপনি আমার ঘৃণায় বাঁচবেন। তবে আজ শুধু আমি এসেছি আমার প্রশ্নের উত্তরের জন্য। কেনো এমনটা করলেন? দায়িত্ব নিতে না পারলে পৃথিবীতে আনার কী প্রয়োজন ছিল?”

এত কঠিন প্রশ্নের উত্তর হুটহাট দেওয়া যায় না। পূর্ব প্রস্তুতি লাগে। সেই প্রস্তুতি আইয়ুব আলীর নেই। মেয়ের দিকে তাকাতে তিনি ভয় পাচ্ছেন। গলা কাঁপছে। এসির নিচে বসে থেকেও ঝরঝর করে ঘামছেন। সেসব দেখে নিজেকে নিয়ে উপহাস করতে ইচ্ছে হলো আবৃত্তির। এখানে আসার আগেও ক্ষণ সময়ের জন্য সে ভেবেছিল, সব দোষ তার নানা আর মামাদের। বাবা তাকে দেখে খুশি হবেন। আদরে আটখানা হয়ে উঠবেন। কিন্তু তার সেই আশা চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলেন ভদ্রলোক। আবৃত্তির এই মুহূর্তে সত্যি সত্যি মনে হতে লাগলো, এই পৃথিবীতে সে তুচ্ছ। এই বিশালাকার ব্রহ্মাণ্ডে তার নিজের কোনো মানুষ নেই। তার জন্য দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দেওয়ার মতো কেউ নেই। কেউ না।

স্লান হাসলো সে। হতাশ কণ্ঠে বললো,“আমার মা আর আমাকে কখনো আপনি ভালোবাসেননি, তাই না? এই জন্যই তো সামান্য উত্তর দিতে এত সময় লাগিয়ে দিচ্ছেন। খালু আমায় বহুবার বলেছিলেন, তোর বাবা স্বার্থপর মানুষ। সে নিজের দ্বিতীয় সংসার আর সন্তান নিয়ে মহা সুখে আছে। সেখানে তোর স্থান নেই। তুই শুধুই পৃথিবীর আবর্জনা মাত্র।খালুর কথা আমি বিশ্বাস করিনি কখনো। অথচ আজ মনে হচ্ছে, তিনিই ঠিক ছিলেন, আর আমি ভুল।”

আইয়ুব আলী আহত স্বরে বলে উঠলেন,“তোর বাবা তোকে ভীষণ ভালোবাসে, মা। আমি জানি না তোকে কী জানানো বা বোঝানো হয়েছে কিন্তু সেসব ভুল। আমি মানছি সব দোষ আমার। সেদিন আমি প্রতিবাদ করলে হয়তো আজ এই দিনটি কখনোই আসতো না। কিন্তু আমি তোর সাথে দেখা…

উনাকে আর কথাটা সম্পূর্ণ করতে দিলো না আবৃত্তি। উঠে দাঁড়াল। এখানে দম বন্ধ লাগছে। মাথা ভার ভার লাগছে। বোধহয় জ্বর আসবে।অতিরিক্ত আঘাত পেলে কিংবা চিন্তা করলে গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে আবৃত্তির। বাইরে যতই নিজেকে কঠিন দেখাক না কেনো, প্রকৃত পক্ষে তার মন নরম। নরম মনের মেয়ে সে। অল্পতেই ভেঙে পড়ে। দুমড়ে মুচড়ে যায়। দূরে নাজমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে একটা ছেলে। ছবির ছেলেটাই। বয়সে ছাড়াতে না পারলেও উচ্চতায় আবৃত্তিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাকে ফ্যালফ্যাল নয়নে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশারায় নিজের কাছে ডাকল আবৃত্তি। জিজ্ঞেস করল,“নাম কী?”

ছেলেটি এগিয়ে এলো। ছোট্ট করে জবাব দিলো, “আমি মিরন।”

আবৃত্তি বিদ্রুপ হেসে প্রত্যুত্তর করল,“আর আমার নাম আবৃত্তি। আমি কে জানো?”

মিরন দুদিকে মাথা নাড়াল। সে জানে না। নাজমা ছেলেকে ধমকালেন,“ঘরে যা তুই। বাইরে আসতে নিষেধ করেছি না?”

আবৃত্তি বাঁধা দিলো,“ঘরে যাবে কেনো? তার সত্যিটা জানতে হবে না?” এরপর মিরনের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“আমি তোমার সৎ বোন। সৎ বোন কাকে বলে জানো?”

“হ্যাঁ, জানি।”

“গুড, আমি তোমার বাবার প্রথম স্ত্রীর মেয়ে। যাকে কিনা তোমার মা আর তোমাদের ভবিষ্যতের জন্য তোমাদের বেস্ট বাবা ত্যাগ করেছেন। সকল দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছেন।”

এরপর আর সেখানে এক মুহূর্তও দাঁড়াল না আবৃত্তি। ফিরে তাকালো না কারো দিকে। যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই ঝরের গতিতে বেরিয়ে এলো। আইয়ুব আলী পেছন থেকে ডাকলেন হয়তো কিন্তু সেসবে কান দিলো না আবৃত্তি। উঠার সময় সিঁড়ি ব্যবহার করলেও নামার জন্য ব্যবহার করল লিফট।বাড়ি থেকে বের হয়ে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আজ থেকে সত্যিই সে একা। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ নেই তার। কেউ না। নেই কোনো পিছুটান। খালি রিক্সা পেতেই উঠে বসলো তাতে। এরপর কয়েক সেকেন্ডে হারিয়ে গেলো অদৃষ্টে।

আইয়ুব আলীর প্রেশারের সমস্যা আছে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে পারেন না। অথচ সেই সাত তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন তিনি। তবে মেয়েকে আর পেলেন না কোথাও। মাটিতে বসে পড়লেন। ভঙ্গুর হয়ে বিড়বিড় করলেন,“আমি বাবা হিসেবে খারাপ। খুব খারাপ। আবার নিজের মেয়েকে হারিয়ে ফেললাম!”

আহান, মিরনও ছুটে এলো বাবার পিছুপিছু। বাবাকে তারা ভীষণ ভয় পায়। তাদের কাছে বাবা মানুষটা নিতান্তই খুব রাগী। অথচ সেই বাবা আজ কাঁদছেন? তারচেয়ে বড়ো কথা, তাদের একটা বড়ো বোন আছে। কি অবাক কান্ড!
__________

প্রথম তারাবীহ, সেহরি এবং প্রথম রোজা আর ইফতার সব সময় বাবার সঙ্গেই করে শিথিল। তা যাই হয়ে যাক না কেনো। হারুন চাচাকে নিয়ে রমাদান উপলক্ষ্যে মাস কাবারি বাজার করে এনেছেন হামিদুল হক। বাইরের খাবার সর্বদা তিনি এড়িয়েই চলেন। তবে মাঝেমধ্যে ছেলের চক্করে যা একটু আধটু খেতে হয়। কিন্তু রোজার মাসে বাইরে থেকে কোনো ইফতারি বাড়িতে আসে না। সব ঘরে তৈরি করেন হারুন চাচা। এসবে তিনি দক্ষ।

শিথিল বাড়ি ফিরল ঠিক সন্ধ্যায়। এসেই ব্যাগটা রেখে মাগরিবের নামাজ আদায় করে শুরু করে দিলো চিৎকার চেঁচামেচি,“বাবা! চাচা! খিদে লেগেছে। কী আছে? খেতে দাও তাড়াতাড়ি।”

হামিদুল হক ইজি চেয়ারে বসে সন্ধ্যার চা আজ ঘরেই খাচ্ছেন। ছেলের ডাকে সাড়া দিলেন না। হারুন চাচা সেয়ই পিঠা রেঁধেছেন। গতকাল গ্ৰামে গিয়ে ভাবীর থেকে নিয়ে এসেছেন। ভাবী বলতে হামিদুল হকের বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী। স্বামী বর্বর, লোভী হলেও ভদ্রমহিলা মন্দ নন। প্রায়শই হারুন চাচাকে ফোন করে এটা ওটা নিয়ে যেতে ডাকেন। শিথিলের সেয়ই পিঠা ভীষণ প্রিয়। মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চললেও এই খাবারটা সে না খেয়ে পারে না। হারুন চাচা এসে এক বাটি পিঠা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। বললেন,“দেখ তো মিষ্টি ঠিক আছে কিনা।”

শিথিল এক চামচ মুখে পুরলো। আমোদিত হয়ে বললো,“দারুণ হয়েছে, চাচা।”

হারুন চাচা খুশি হলেন। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রাতের রান্নার আয়োজন করতে। শিথিল একটি চেয়ার টেনে বসলো বাবার সামনে। হামিদুল হক জিজ্ঞেস করলেন, “থাকবি ক’দিন?”

“দ্বিতীয় সেহরি খেয়েই সকালের ট্রেনে ফিরে যাবো।”

“এবার এত জলদি?”

“ইদের পর যেকোনো মুহূর্তে পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিবে তাই ক্লাস মিস দেওয়া যাবে না।”

“ওহ, মন দিয়ে পড়িস তবে।”

শিথিল মাথা নাড়ল। এরপর বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে হঠাৎ বলে উঠল,“একটা কথা ছিল, বাবা।”

“বল।”

“খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। মনোযোগ দিয়ে শুনবে কিন্তু।”

হাতের বইটি রেখে সোজা হয়ে বসলেন হামিদুল হক। সায় দিলেন,“আচ্ছা।”

“লজ্জা লাগছে।”

“তোর লজ্জাও লাগে? বাহ! এবার দ্রুত বল।”

“পরীক্ষার আগেই যদি বিয়ে টিয়ে করতে চাই, তাহলে দিবে?”

“মেয়ে পছন্দ থাকলে দিয়ে দিবো। আছে কোনো পছন্দ?”

সিরিয়াস ভঙিতে উপরনিচ মাথা নাড়াল শিথিল। ললাটে ভাঁজ পড়ল হামিদুল হকের। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে উঠলেন,“বিশ্বাস হচ্ছে না কেনো?”

“করতে হবে, সত্যি বলছি।”

“তোর মতো গর্দভও প্রেম করতে পারে?”

“প্রেম করিনি।”

“তো?”

“মেয়ে শুধু পছন্দ হয়েছে। তাই সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে এসেছি। অযথা প্রেমের পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট করে লাভ আছে? বিয়ের উপরে কিছু নেই।”

প্রশান্তির শ্বাস ফেললেন হামিদুল হক। বাহবা দিয়ে বললেন,“একেবারে আমার ছেলের মতো কাজ করে এসেছিস। তোর মাকেও পছন্দ হওয়ার সাথে সাথে তোর দাদাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম।”

“তোমার বয়স কত ছিল তখন?”

“কত আর? বাইশ, তেইশ হবে।”

“তাহলে তো বাবা হিসেবে তোমার আপত্তি থাকার কথা নয়।”

বাঁকা দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন হামিদুল হক। গলা ঝেড়ে কাশলেন,“বেকার হলেও আমি তোর মাকে কখনো কষ্ট পেতে দেইনি। কখনো ঝগড়া করিনি। গোটা একটা জীবন তার জন্য কাটিয়ে দিয়েছি। তোরা আজকালকার ছেলেরা পারবি সেসব? অল্পতেই তো ঘরের বউয়ের উপর থেকে তোদের মন উঠে যায়। বিয়ে কিন্তু একটা মানুষের সারা জীবনের ব্যাপার।”

“আমি জানি সেসব। হুটহাট আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ যে আমি নই তা তুমি জানো। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দায়িত্ব আমি নিতে পারবো। সেই বয়স আমার হয়েছে। ওর সমস্ত দায়িত্ব আমার। কিন্তু আমার দায়িত্ব তোমার। চাকরি পাওয়ার আগ অবধি।”

ছেলের কথায় হামিদুল হক সন্তুষ্ট হলেন। তিনি নিজেও ছেলের বিয়ে দিতে চান। ভেবেছিলেন লেখাপড়ার পাট চুকলে এ নিয়ে এগোবেন। কখন কী উনার হয়ে যায় তার তো আর ঠিকঠিকানা নেই। ছেলের জীবন গুছিয়ে না দিয়ে মরে গেলে কীভাবে হয়? তবুও ফের বললেন,“এত দ্রুত চাকরি করবি? আমি তো তোর বড়ো ফুফুর সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। বিএসসি কমপ্লিট হলে তোকে জার্মানি পাঠাবো।”

মুখশ্রী চুপসে গেলো শিথিলের।অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। হামিদুল হক কিছুক্ষণ ভাবলেন,“বাংলাদেশে ভালো ভবিষ্যৎ নেই। চারিদিকে শুধু অসুস্থ রাজনীতি আর দুর্নীতি। উচ্চশিক্ষা নিয়ে বাইরে স্যাটেল হয়ে গেলে আর কোনো চিন্তা থাকবে না। মাঝেমধ্যে আমিও না হয় গিয়ে ঘুরে আসবো।”

সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করতে পারলো না শিথিল। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর বললো,“তো? লেখাপড়া শেষ হতে এখনো বছর দেড়েক বাকি। বউ দেশে রেখে যাবো। যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। অভিভাবক হিসেবে তো তুমি আছোই। শ্বশুর বাবার মতো। এরপর সুযোগ হলে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো।”

মনে মনে হাসলেন হামিদুল হক। ছেলে পরীক্ষায় পাস। জিজ্ঞেস করলেন,“মেয়ের নাম কী? বয়স কত? বাবা- মা কেমন? বিস্তারিত বল আগে।”

“নাম আবৃত্তি। এবার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে বাংলা বিভাগে পড়ছে। মা নেই।আমাদের মতো ছোটোবেলায় মারা গিয়েছে। বাবা চরিত্র তোমার বিপরীত। দ্বিতীয় বিয়ে করে মেয়েকে বহু বছর আগেই ত্যাগ করেছেন। এরপর থেকে ওর ঠাঁই হয়েছে কখনো নানা, কখনো মামা আবার কখনো বা খালুর কাছে।দুর্ভাগ্যবশত তারা কেউ মন থেকে তাকে ভালোবাসে না। বোঝা মনে করে। বাধ্য হয়েই পালন করে দায়িত্ব। তবে মেয়ে ভীষণ ভালো। সব দিক দিয়েই।”

সমস্ত কথাই শুনলেন হামিদুল হক। বললেন, “একেবারে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ এবার বুঝতে পারছি। ভালো সিদ্ধান্ত। তা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কোথায় যেতে হবে? মামার বাড়ি নাকি খালার বাড়ি? তাদের বাড়ি কোথায়?”

“ওর সেজো মামা, মামীকে তুমি চেনো।”

“চিনি?”—অবাক হলেন তিনি।

“হ্যাঁ।”

“কে?”

বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় কখনো তাড়াহুড়ো করে না শিথিল। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলার সময় খুব ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয়।এবারো সময় নিয়ে বললো,“আমি সরাসরি আবৃত্তিকে প্রস্তাব দিয়েছি। ও এখনো হ্যাঁ, না কিছু বলেনি। আপাতত রোজার মাস পর্যন্ত সময় দিয়েছি। ইদের পর দেখা করে ওর মতামত নিবো। জোরজবরদস্তিতে আমি নেই। যদি হ্যাঁ বলে তবেই তুমি গিয়ে কথা বলবে। যদিও না বলার কোনো কারণ নেই। বিয়ে হবে ঘরোয়া পরিবেশে বা মসজিদে। তোমার ইচ্ছে আরকি।”

“আচ্ছা।”

“ওর সেজো মামী হচ্ছে নূর আন্টি। সুশ্রী, মিশমির মা।”

সম্মতি প্রকাশ করলেও বেশ অবাক হলেন হামিদুল হক। ওখানে গিয়েই তবে ছেলে এই কান্ড বাঁধিয়েছে!

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)