#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৫]
পবিত্র মাহে রমজান শেষে চলে এলো সেই বিশেষ দিন। অর্থাৎ ঈদুল ফিতর।চাঁদ রাত থেকে বাড়ির ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়েলি এক গন্ধ। আজ বহুদিন পর বাড়ির রান্নাঘরটা পেয়েছে মমতাময়ী স্পর্শ। রাতে সেই হাতে মেহেদী উঠল। প্রতিবেশী মেয়েরা এসে রাত পর্যন্ত আড্ডা জমালো। সকালে তৈরি হলো কয়েক পদের সুস্বাদু পায়েস, সেমাই, পিঠা। সুহাসিনীর রান্না বরাবরই ভালো। হামিদুল হকের তো ভীষণ প্রিয়। সেসব খেয়ে বাপ, ছেলে নাতি আর জামাতা মিলে একসঙ্গে গিয়ে পড়ে এলো ঈদের নামাজ।
স্বামী সন্তান নিয়ে সুহাসিনী বাপের বাড়ি এসেছে গতকাল দুপুরে। গত তিন বছর ধরে বাবার বাড়ি ঈদ করা হয় না তার। সাংসারিক ব্যস্ততায়। তবে মেহমাদ এবার যেন স্ত্রীর কষ্টটা বুঝলো। তাছাড়া নানা বাড়ি আসার জন্য ছেলেও খুব বায়না ধরেছিল। তাই চলে এলো।
ঈদের নামাজ শেষে শান্তকে নিয়ে সারা গাজীপুর ঘুরে বেড়ালো শিথিল। দেখা হলো স্কুল, কলেজের বিভিন্ন বন্ধুর সঙ্গে। একদফা ঘুরা শেষ করে বাড়ি ফিরলো সে ঠিক দুপুরে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক তাদের ভালো। সুহাসিনীর আগমনে বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধা পর্যন্ত দেখা করতে চলে এসেছে বাড়িতে। মিথিন সেই বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছে। খেলার ছলে মামাকে দেখেও যেন দেখলো না। ভাগ্নে আর বোনের জন্য আইসক্রিম কিনে এনেছে শিথিল। মানুষ থাকায় তা ফ্রিজে রেখে দিয়ে চলে এলো ঘরে।
ফেসবুকে আপলোডকৃত ছবিতে ঝড় উঠেছে। একেক বন্ধুর একেক রকমের তেলতেলে সব কমেন্ট। কেউ কেউ তো তাকে বানিয়ে দিয়েছে জাতীর ক্রাশ। সেসবে বিরক্ত হলো শিথিল। ওরা যে তাকে রোস্টিং করছে তা খুব ভালো করেই বুঝে গেলো। ম্যাসেঞ্জারে সুশ্রী, মিশমির আইডি থেকে এসেছে অজস্র ছবি। তার মধ্যে ছবির সাথে লেখা মিশমির ম্যাসেজটা দেখেই হাসি পেলো ভীষণ। চাঁদ আর নিজের ছবি দিয়ে মিশমি লিখেছে,“কে বেশি সুন্দর? আকাশের চাঁদ নাকি জমিনের চাঁদ?”
সাথে মেহেদী রাঙা তিন জোড়া হাতের ছবিও রয়েছে। শিথিল বুঝলো এর মধ্যে এক জোড়া আবৃত্তির হাত। এবং কোনটা সেই হাত তাও চিনে ফেললো মুহূর্তেই। প্রত্যুত্তরে লিখলো,“চাঁদ তো একটাই দেখছি। তাই নিঃসন্দেহে আকাশের চাঁদটাই সুন্দর।”
কয়েক মিনিট বাদে সেই ম্যাসেজে পড়ল এংরি রিয়েক্ট। এলো ভিডিও কল। অন্য কোনো সময় হলে হয়তো শিথিল একদম রিসিভ করতো না সেই কল। তবে এখন করল। যদি একপলক অনাকাঙ্ক্ষিত মুখখানা দেখতে পায়! মিশমি আজ ভীষণ সেজেছে। মোবাইলটা উঁচু কোনো স্থানে রেখে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দু গালে হাত রেখে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে? ডানা কাটা পরী, তাই না?”
“উহুম, তেঁতুল গাছের ডাইনি। কি ভয়ানক!”
চোখমুখ কুঁচকে গেলো মিশমির। ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। বললো,“বোনদের প্রশংসা করতে শিখুন। আমি ডাইনি হলে তো আপনি হবেন ভূত।”
“আমি সুন্দর একটা ছেলে।”
“বাড়িতে আয়না নেই, ভাই?”
“না, নেই।”
“এই জন্যই নিজেকে সুন্দর মনে করছেন।”
“সুন্দর না হলে তোমরা ক্রাশ খেতে?”
“আমরা মানে? আর কে ক্রাশ খেয়েছে? এই আবৃত্তি আপু, তুমি এই ব্যাটার উপর ক্রাশ খেয়েছো?”
পাশ ফিরে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল মিশমি। শিথিলের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। বললো, “এমন করে জিজ্ঞেস করলে হবে? ক্যামেরা ঘুরাও। আই টু আই দেখে তারপর না হয় বলবে।”
মিশমি সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা ঘুরালো। আবৃত্তি পাশেই বসেছিল। পরনে জর্জেট থ্রি পিস আর চোখে হালকা কাজল ছাড়া তেমন কোনো সাজ তার নেই। হঠাৎ তার মুখের সামনে মোবাইল ধরায় ভড়কে গেলো আবৃত্তি। অপরপ্রান্তে শিথিলকে দেখে গলা শুকিয়ে এলো। তাকে দেখে চমৎকার হাসলো শিথিল। কিছুই হয়নি এমন ভং ধরে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,“ঈদ মোবারক, আবৃত্তি।”
তৎক্ষণাৎ প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারলো না আবৃত্তি। অশান্ত হয়ে উঠল চোখের মণি। ফুলে উঠল নাকের পাটাতন। সেদিনের পর এক মাস দুজনার দেখা হয়নি। যদিও এখন মোবাইলে ভিডিও কলে কথা হচ্ছে তবুও হঠাৎ চোখাচোখি হওয়ায় সেদিনের কথাই বারবার মনে পড়ছে তার। লজ্জায় মুখ ঢেকে দৌড় দিতে ইচ্ছে করছে। তার হাবভাব হয়তো বুঝে গেলো শিথিল। মৃদু হেসে মনে মনে আওড়াল,“মিষ্টি মেয়ে আবৃত্তি! তুমি এত আদুরে কেন? নাকের ডগায় প্রেম নিয়েই বা ঘুরো কেনো? আচ্ছা, তুমি কী চোখের পাতায় দুঃখ পোষো? যখনি দেখি মলিন চেয়ে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে বাঁচো।”
নিজের ভাবনাতে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো শিথিল। তাই কেটে দিলো কল। মিশমি এতে বেজায় চটলো। বললো,“এই ব্যাটার কপালে নির্ঘাত কোনো ডাইনি জুটবে, দেখো তুমি। হুট করে কে কল কাটে? ঈদের সালামি না দেওয়ার বাহানা যত্তসব।”
আবৃত্তি কিছু বললো না। মিশমি হুমকি স্বরূপ ফের ম্যাসেজ পাঠালো,“সালামি না দিয়ে আপনি এভাবে কল কাটতে পারেন না, শীতল ভাই। সালামি চাই, সালামি চাই। ঈদের চাঁদ আকাশে সালামি দিন বিকাশে।”
চট করে রিপ্লাই এলো,“সবার ছবি পাঠাও। ভালো করে দেখে তারপর সালামি দিবো।”
“আর কত পাঠাবো?”
“তাহলে দিলাম না সালামি।”
মিশমি আর কোনো প্রশ্ন করল না। সালামি না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই এই ব্যাটাকে চ্যাতানো যাবে না। তাই গ্যালারি ঘেঁটে আজকের তোলা সমস্ত ছবি পাঠালো। মা, বাবা, শাফিন, সুশ্রী, আবৃত্তি এবং তার একসঙ্গে তোলা বেশ কিছু ছবি।”
শিথিল এতক্ষণ এর জন্যই অপেক্ষা করছিল যেন। চট করে যে যে ছবিতে আবৃত্তি আছে সেগুলো সেভ করল। মিশমি, সুশ্রীকে এডিট করে সরিয়ে দিলো। মিশমির বিকাশ বা নগদ অ্যাকাউন্ট নেই। তাই সুশ্রীর অ্যাকাউন্ট এ পাঠিয়ে দিলো সালামি। তা আবার ম্যাসেজে লিখেও দিলো মিশমিকে।
ঈদের নামাজের পর জামাতাকে নিয়ে এলাকা ঘুরে বেড়িয়েছেন হামিদুল হক। পরিচিত সমবয়সীদের সঙ্গে দেখা করিয়েছেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে উনাদেরও দুপুর হলো। ততক্ষণে টেবিলে খাবার দাবার সাজিয়ে গুছিয়ে ফেলেছে সুহাসিনী। এতে অবশ্য শিথিলও তাকে সাহায্য করেছে। বাবা, স্বামী আসতেই সবাইকে সে বসিয়ে দিলো খেতে।
অনেকদিন পর টেবিলটা ভরে উঠেছে। এবার মনে হচ্ছে আদর্শ এক পরিবার। হারুন চাচা তাড়াহুড়ো করে ঢুকেই হাত ধুয়ে আরেকটা চেয়ার টেনে বসলেন। উপরে রাখলেন দুই লিটারের সেভেন আপের একটি বোতল। শিথিল পোলাও মাংস একত্রে ছোটো ছোটো লোকমা বানিয়ে মিথিনকে খাওয়াতে খাওয়াতে বললো,“আমি তো দই এনেছিলাম। আবার সেভেন আপের কী দরকার ছিল, চাচা?”
হারুন চাচা এক লোকমা খেয়েই তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে নিলেন। প্রত্যুত্তরে বললেন,“পোলাও মাংস খাওয়ার পর আমার আর ভাইজানের আগে সেভেন আপ লাগে।” এরপর সুহাসিনীর উদ্দেশ্যে বললেন, “বহু বছর পর হাসি আম্মার রান্না খাইলাম। কি স্বাদ!”
সুহাসিনী হাসলো। আরো দুই পিস গোশত তুলে দিলো চাচার প্লেটে। প্রশংসা শুনতে তার ভীষণ ভালো লাগে। গল্প করতে করতে মেহমাদ হঠাৎ করেই বলে বসলো, “শিথিলের মাথায় যে বিয়ের ভূত চেপেছে সেকথা জানেন, বাবা?”
হামিদুল হক চমকালেন না। পূর্বের মতো করেই তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছেন।খেতে খেতে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,“ভূত চাপবে কেনো? বিয়ের বয়স হয়েছে। শুভ কাজে দেরি করতে নেই।”
মেহমাদ অবাক হলো যেন,“আপনি রাজি?”
“হ্যাঁ, একদম। ছেলের মেয়ে পছন্দ হয়েছে। প্রেম না করে হারামে না জড়িয়ে বাবার কাছে এসে বলেছে, বিয়ে করবে। এটা ভালো গুণ। ঈদ যাক তারপর বিয়ের কথা পাকা করে আসবো।”
সুহাসিনী শব্দ করে হাতের বাটিটা টেবিলের উপর রাখলো।দ্বিমত পোষণ করে বললো,“লেখাপড়া এখনো শেষ হয়নি। চাকরি বাকরি করে না। এর মধ্যে বিয়ে করবে মানে? তুমি অন্তত ওকে প্রশ্রয় দিও না, বাবা। এতে লেখাপড়ার ক্ষতি হবে।”
হামিদুল হক ছেলের দিকে তাকিয়ে আচমকাই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“কী রে, মেয়ে আবার ছোটো বাচ্চা নয় তো? বইখাতা ছিঁড়ে ফেলার রোগ থাকলে কিন্তু বিয়ে ক্যান্সেল।”
বাবার কথায় শিথিল হেসে ফেললো। তাকে দেখে কিছু না বুঝেই মিথিনও হাসলো। সুহাসিনী রেগে গেলো। রাগ নিয়েই বললো,“তোমরা দুজন আমার সঙ্গে মজা করছো?”
“মজা করবো কেনো? তুই খেতে বোস।”
“তার মানে বিয়ে দিচ্ছো?”
“হ্যাঁ, তোকেও তো লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু করলি কী? ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়েই লেখাপড়া ছেড়ে দিলি। ও তো আর ছাড়ছে না। শুধু বিয়ে করবে। ছাত্রজীবনে বেকার অবস্থায় আমিও তোদের মাকে বিয়ে করেছিলাম। কই কোনো ক্ষতি কী হয়েছে?”
থামলেন হামিদুল হক। তারপর রয়ে সয়ে বললেন, “রমণী ছাড়া সংসার চলে না। এবার বাড়িতে একটা বউ খুবই প্রয়োজন। তুই তো বছরে একবারও আসিস না বললেই চলে। তিন বছর পর এলি ঈদ করতে। যত্ন ছাড়া আর কতকাল এই বাড়ি টিকবে?”
এরপর আর বলার মতো কিই বা থাকে? যেখানে বাবা নিজেই রাজি। শ্বশুরের চিন্তাভাবনায় বরাবরের মতো এবারও মুগ্ধ হলো মেহমাদ। খাওয়া শেষে যে যার মতো চলে গেলো বিশ্রাম নিতে।
শিথিল সোজা চলে এলো বাবার ঘরে। মোবাইল থেকে ছবি বের করে দেখিয়ে বললো,“এই যে তোমার হবু ডটার ইন লো। কেমন?”
“মাশাআল্লাহ। রাজি হয়েছে?”
“জিজ্ঞেস করিনি। এখান থেকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো। হ্যাঁ বললে এর পরেরদিনই তুমি সোজা নূর আন্টির বাড়ি যাবে।”
“না বললেও যাবো।”
শিথিল অবাক হলো,“না বললেও?”
“হ্যাঁ, তোর মাও প্রথম আমায় বিয়ে করতে চায়নি। কি কান্নাকাটিই না করেছিল! কিন্তু বিয়ের পর ঠিকই সব ভুলে গেলো। আমায় ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না।”
শিথিল হাসলো। নিশ্চিন্ত হলো কিছুটা।
________
মুসলিমদের প্রিয় উৎসব ঈদুল ফিতর অবশেষে শেষ হয়েছে। তবে গুরুজনদের মতে, ঈদ শেষ হলেও ঈদের আমেজ থাকে প্রথম সাতদিন। আর আজ হচ্ছে ঈদের তৃতীয়দিন। বাবার থেকে বিদায় নিয়ে সকাল সকাল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল শিথিল। ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়েছে। রাস্তায় কি জ্যাম! সবাই যেন আজকেই হচ্ছে ঢাকামুখী।
বাসায় ফিরে বিশ্রাম নিলো না শিথিল। দুপুর আর রাতের খাবার হারুন চাচা জোর করে সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছেন। গোসল করে খেয়েদেয়ে পরিপাটি হয়ে সে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। রাস্তার জ্যাম ঠেলে ফার্মগেট থেকে মালিবাগ পৌঁছাতে পৌঁছাতেও বিকাল হলো।
আবৃত্তি তখন জানালার ধারে বসে বই পড়ছিল। ঈদের কারণে অনেকদিন বই থেকে দূরে ছিল সে। তার উপর আগামীকাল আবার ফিরতে হবে ছাত্রীনিবাসে। তার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বেজে উঠল মোবাইল। স্ক্রীনের নাম্বার অচেনা হওয়ায় প্রথমেই রিসিভ করল না। বরং রিসিভ করল দ্বিতীয়বার। কথা না বলে চুপ করে কানে ধরে রাখলো। অপরপাশ থেকে ভেসে এলো পুরুষালি কণ্ঠ,“আসসালামু আলাইকুম, আবৃত্তি।”
থতমত খেয়ে গেলো আবৃত্তি। ফের নাম্বারটা দেখলো। না, এই নাম্বার তো সে চিনে না। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে প্রত্যুত্তর করল,“ওয়া আলাইকুমুসসালাম। কে বলছেন?”
শিথিল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিরস মুখে বললো,“আমি শিথিল। ভয়েস চেঞ্জ হয়ে গেছে? চেনা যাচ্ছে না?”
“আসলে নাম্বারটা…
“এটাও আমারই। এখন বলো, কোথায় তুমি?”
“কোথায় মানে? বাড়িতে।”
“সুশ্রীদের বাড়ি নাকি হোস্টেলে?”
“সুশ্রী আপুদের বাড়ি।”
“মালিবাগ মোড় চেনো?”
“হ্যাঁ, চিনি।”
“চলে এসো।”
আবৃত্তি চমকায়,“কিহ! চলে আসবো মানে?”
“বাংলা বোঝো না? অপেক্ষা করছি। চলে এসো। বিশ মিনিট সময় দিলাম।”
“কী বলে বের হবো? মামী বের হতে দিবেন না।”
“আচ্ছা, তাহলে আমি আসি। অপেক্ষা করো।”
বুক ধড়ফড় থেমে গেলো আবৃত্তির। দম আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা প্রায়। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, “আপনি আসবেন মানে? মাথা ঠিক আছে?”
“তুমি আসতে না পারলে তো আমাকেই আসতে হবে। দেখো, মেয়েদের পেছনে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। আমি ভীষণ ব্যস্ত। যা কথা হবে মুখোমুখি হবে। তাছাড়া তোমার মামী আমার খালা হয়।”
আবৃত্তি ভাবার জন্য সময় নিলো কিছুটা। যদি মামীর সামনেই উল্টাপাল্টা কিছু বলে দেয় এই ছেলে? তখন তো ঝামেলা হয়ে যাবে। মামী তাকে ছাড়বে না। অনেক ভেবে তারপর বললো,“আচ্ছা, দাঁড়ান। আমি কিছু একটা বলে আসছি।”
শিথিল শান্ত হলো এবার। আবৃত্তি বোরকা আর হিজাব পরে তৈরি হলো। সাইড ব্যাগটা নিয়ে এসে হাজির হলো মামার ঘরে। মোজাম্মেল হোসেন আর সুশ্রী বাড়িতে নেই। মিশমি, শাফিন ঘুমিয়ে আছে। শাহিনূর বসে ফোনকলে গল্প করছিলেন নিজের মায়ের সঙ্গে। বৃদ্ধা কাল পরশু আসতে পারে। আবৃত্তি মনোযোগ আকৃষ্টের জন্য গলা ঝাড়ল। কাজ দিলো তাতে।কল কেটে সামনে তাকিয়ে তাকে দেখতেই জিজ্ঞেস করলেন শাহিনূর,“কোথাও যাচ্ছো?”
“এক ফ্রেন্ড ফোন করেছিল, মামী। দেখা করে আসি? সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো।”
আবৃত্তির ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে শাহিনূর সঙ্গে সঙ্গেই অনুমতি দিয়ে দিলেন। সাথে এও বললেন,“বেশি দূরে যেও না। তোমার মামা জানলে রাগ করবেন। টাকা আছে সঙ্গে? নিয়ে যাও।”
“না, না আমার কাছে আছে।”
শাহিনূর আর কিছু বললেন না। আবৃত্তি বের হতেই মিতাকে দিয়ে দরজা লাগালেন।
শিথিল দাঁড়িয়ে আছে মালিবাগ মোড়ের সামনে। তাই তাকে পেতে বেগ পেতে হলো না আবৃত্তিকে।পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। শিথিল একপলক তার দিকে তাকিয়ে চমৎকার হাসলো। একটা রিক্সা ঠিক করে উঠে বসলো। বললো,“চলো টিএসসি ঘুরে আসি।”
“এখন?”
“হুম, সমস্যা কোথায়? চিন্তা নেই, আবার পৌঁছে দিয়ে যাবো।”
উঠে বসলো আবৃত্তি। রিক্সাচালক বেছে নিলো শর্টকাট রাস্তা। ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া বদলে দেখা মিলেছে বিকাল রোদের গা ঝলসানো গরম। তবে টিএসসিতে সেই গরমের অস্তিত্ব মিললো না।সবুজ অরণ্যের হিমেল হাওয়ায় বইলো যেন মন ভোলানো সুর। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ সেখানে ভিড় কম।
বট গাছের নিচে আবৃত্তিকে বসিয়ে দুই কাপ চা নিয়ে এলো শিথিল। দুধ চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিতেই আবৃত্তি তা হাতে নিলো। শিথিলের কাপের দিকে তাকিয়ে বললো,“দুধ, চিনি ছাড়া চা খেয়ে কী মজা পাওয়া যায়?”
“খেয়ে দেখো।”
বলেই নিজের কাপটাও এগিয়ে দিলো শিথিল। আবৃত্তি তা নিলো না। মুখ ঘুরিয়ে নিজের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,“অখাদ্য খাই না।”
শিথিল কিছু বললো না। এ কথা বন্ধুরা বললে এতক্ষণে দু ঘা পিঠে পড়ে যেতো। জিজ্ঞেস করল, “ঈদ কেমন কাটলো?”
“খারাপ না। আপনার?”
“ভালো।”
এরপর শিথিল পুনরায় বললো,“রাখঢাক না রেখে এবার আসল কথায় আসি।”
“কী কথা?”
“আমাকে বিয়ে করার জন্য রাজি?”
চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও আর দিলো না আবৃত্তি। চুপ রইল। দৃষ্টি মাটিতে স্থির। শিথিল আড়চোখে তাকে দেখে নরম স্বরে বললো,“সময় নষ্ট করো না। এখানে আমি ছাড়া তোমাকে কেউ চিনে না। কথাও শুনবে না। তাই লজ্জা না পেয়ে মনের কথা বলে ফেলো। আর হ্যাঁ মনে রেখো, শিথিলকে হারালে কাঁদতে হবে আড়ালে।”
“সেজো মামী আমাকে পছন্দ করেন না।”
“সেজো মামী এলো কোত্থেকে?”
“তিনি আপনার খালা। তাই মনে হয় না তিনি রাজি হবেন বিয়েতে।”
“তিনি রাজি হওয়ার কে? তোমার অভিভাবক তোমার মামা। আমার অভিভাবক আমার বাবা। তাছাড়া আমার বাবা তো রাজি।”
“রাজি! আপনার বাবা জানেন?”–আশ্চর্য হলো সে।
“হ্যাঁ, বলেছিলাম না? আমি বাবার বাধ্যগত সন্তান।”
আবৃত্তি আবারো চুপ হয়ে গেলো। শিথিলও কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর হঠাৎ করেই উদাস কণ্ঠে ডেকে উঠল,“আবৃত্তি! আবার জিজ্ঞেস করছি, আমাকে তোমার কেমন লাগে? পছন্দ নয়? অনেস্টলি বলো। আমি কিছু মনে করবো না। তবুও তুমি বলো। নিজের মনের কথা বলতে শিখো। অনুভূতি প্রকাশ করতে শিখো। দুনিয়া ভুলে নিজেকে নিয়ে ভাবতে শিখো। আল্লাহ ছাড়া তোমার আর কেউ নেই। সবাই তোমার জীবন ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবে কিন্তু ভালো থাকা কিংবা স্বস্তি পাওয়ার জায়গা খুঁজে দিতে পারবে না। এসব খোঁজার দায়িত্ব একান্তই তোমার নিজের।”
কণ্ঠস্বর কেমন যেন শোনালো। আবৃত্তি ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর কী হলো কে জানে? লাজ লজ্জা ভুলে মুখ খুললো,“আমি সহজে মানুষকে বিশ্বাস করতে পারি না। তার অনেক কারণ রয়েছে। তবে আপনাকে করি। সেজো মামা বলেন, একদেখায়, স্বল্প পরিচয়ে মানুষকে বিশ্বাস করতে নেই। মানুষ পরিবর্তনশীল। তবে আপনাকে অবিশ্বাস কিংবা অপছন্দ করার কোনো কারণ আমার কাছে নেই। তবুও বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে কীভাবে হ্যাঁ বলি বলুন তো? যদি হ্যাঁ বলিও তারপর মামীর কথায় মামা রাজি হলেন না। তখন? কথা রাখতে না পারার দায়ে আপনার কাছে সারাজীবন আমি অপরাধী হয়ে থাকবো। তাছাড়া পালানোও সম্ভব নয়। একবার খালাতো বোনের প্ররোচনায় পালিয়েছিলাম। সেই কলঙ্ক এখনো চরিত্র থেকে মুছেনি। সুযোগ পেলেই শুনতে হয় কটু কথা। আসলে আমি করবোটা কী?”
“কিছু করার প্রয়োজন নেই। আমি বুঝেছি।”
“কী?”
“যা বুঝার বুঝেছি।”
“মামা সম্ভবত খুব শীঘ্রই আমার বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছেন। আপত্তি করার কোনো কারণ নেই। তবুও আমি সময় চেয়েছি।”
শিথিল শুধু শুনলো। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মৌন রইল। তার মাথায় কী চলছে কে জানে? সন্ধ্যা নামতেই যেভাবে তাকে নিয়ে এসেছিল ঠিক সেভাবেই পৌঁছে দিয়ে এলো মালিবাগ মোড় পর্যন্ত।
চলবে _________