#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৬]
আজ বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবারে রাস্তায় জ্যাম থাকে অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি। সেই জ্যাম ঠেলেই নামিদামি এক দোকান থেকে কয়েক পদের মিষ্টান্ন,ফল ফলাদি নিয়ে হামিদুল হক হাজির হলেন মালিবাগে। মোজাম্মেল হোসেনের শান্তিনগরের বাসভবনে।উনাকে দেখে বেজায় খুশি হলেন শাহিনূর। আশ্চর্যও হলেন বটে। গতকাল রাতে ফোনকলে আসার কথা জানিয়ে রেখেছিলেন হামিদুল হক। কিন্তু বিস্তারিত কোনো কিছু বলেননি।
আসমার মৃত্যুর পর তার দিকের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ ভদ্রলোকের তেমন নেই বললেই চলে। যা যোগাযোগ হতো যান্ত্রিক মোবাইলে। তাই হঠাৎ উনার আগমনে আশ্চর্য হওয়াই স্বাভাবিক। শাহিনূর এবং মোজাম্মেল হোসেন উনাকে আপ্যায়ন করে সোফায় বসালেন। সামনে এনে রাখলেন লেবুর ঠান্ডা শরবত।
সৌজন্য সকল কথার সমাপ্তিতে শাহিনূর হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে উঠলেন,“আপনি এসেছেন তাতে কি খুশি যে আমি হয়েছি, দুলাভাই! আসমা মারা যাওয়ার পর বলে কয়েও আপনাকে আর এখানে আনতে পারিনি। শিথিলটাও হয়েছে একেবারে আপনার মতো। আসার কথা বললেই শুরু হয়ে যায় ওর হাজারটা বাহানা।”
“তবে আজ কিন্তু শিথিলের জন্যই আমি এখানে এসেছি। বলতে পারো তোমাদের কাছে কিছু চাইতে এসেছি।”
মোজাম্মেল হোসেন আর শাহিনূর দুজনেই খানিকটা চমকালেন।একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলেন। হামিদুল হকের মতো মানুষ উনাদের কাছে কিছু চাইতে এসেছে! ব্যাপারটা বড়োই অবিশ্বাস্য। মোজাম্মেল হোসেন হাসলেন,“আমাদের সাধ্যে থাকলে অবশ্যই দিবো, ভাইজান।”
“সাধ্যের মধ্যেই আছে।”
একটু থামলেন হামিদুল হক। এর মাঝেই মিতা এসে দিয়ে গেলো কয়েক পদের নাস্তা। হামিদুল হক সেসব ছুঁলেন না। মিতা যেতেই মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “আবৃত্তি কোথায়?”
স্বামী-স্ত্রী আরো একদফা চমকালো বোধহয়। শাহিনূর বললেন,“ঘরে আছে। আপনি ওকে চিনেন, দুলাভাই?”
“চিনি না। শিথিলের কাছে নাম শুনেছি। ছবিও দেখেছি ওর মোবাইলেই। এই জন্যই তো সব কাজকর্ম ফেলে আজ এখানে আসা। কই ডাকো তাকে। আগে সামনা সামনি দেখি।”
অপ্রস্তুত হলেন শাহিনূর। মোজাম্মেল হোসেন স্ত্রীকে ইশারা করলেন,“আবৃত্তি কোথায়? ভাইজান যেহেতু বলছে, যাও ওকে নিয়ে এসো।”
স্বামীর আদেশ অমান্য করলেন না শাহিনূর। বসা থেকে উঠে চলে এলেন ছোটো মেয়ের ঘরে। বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে আছে মিশমি। বাইরে যে কেউ এসেছে সে খেয়াল তার নেই। মোবাইলে কিছু একটা করছে। আবৃত্তিও সেদিকেই তাকিয়ে আছে।ক্ষণে ক্ষণে কিছু নিয়ে দুজনে হাসছে। শাহিনূর চাপা ধমক দিলেন,“দিনদুপুরে এভাবে কে শুয়ে থাকে? বাড়িতে কেউ এলে যে ভদ্রতার খাতিরে সালাম দিতে হয় সেটাও ভুলে গিয়েছিস?”
মায়ের ধমকে হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো মিশমি। চুল ঠিক করতে করতে জিজ্ঞেস করল,“কে এসেছে?”
“তোর খালু।”
“কোন খালু?”
“শিথিলের বাবা।”
মিশমিও অবাক হলো যেন। শাহিনূর এবার তাকালেন আবৃত্তির দিকে। গম্ভীর মুখে বললেন,“পরনের পোশাক বদলে নাও। আমি যেই জামাটা দিয়েছি সেটা পরে এসো।”
“এখন? কিন্তু কেনো?”
“আমি বলেছি তাই। তাড়াতাড়ি করো। জানি না, শিথিল হঠাৎ কী বললো? দুলাভাই তোমাকে দেখতে চাইছেন। এসো তাড়াতাড়ি। গিয়ে সুন্দর করে সালাম দিবে, ঠিক আছে?”
কথাটা শুনেই বুক ধড়ফড় করে উঠল আবৃত্তির। হঠাৎ! তার মানে গতকাল এই জন্যই শিথিল চুপ ছিল? মামীর তাড়ায় পোশাক বদলে এলো আবৃত্তি। চুলে হাত খোঁপা করে মাথায় ঘোমটা টেনে মামীর পিছুপিছু বাইরে এলো। আজ ছাত্রীনিবাসে ফেরার কথা থাকলেও সেজো মামা তাকে যেতে দেয়নি। কাল শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই অযথা আজ গিয়ে হবে কী? এর থেকে শনিবার বিকেলে না হয় চলে যাবে। তাই আবৃত্তিও আর মানা করল না।
আবৃত্তি এসেই মামার দিকে সর্বপ্রথম তাকালো। মামার ইশারায় সালাম দিলো সামনে বসা ভদ্রলোককে। হামিদুল হক সালামের জবাব নিলেন। অধরের হাসি চওড়া করে বললেন,“দাঁড়িয়ে আছো কেনো? এখানে এসে বসো।”
বাধ্য মেয়ের মতো মামার পাশে বসলো আবৃত্তি। দৃষ্টি স্থির করে রাখলো মেঝেতে। মিশমিও কিছুক্ষণ পর এলো। তার আবার রাখঢাক নেই। যেকোনো আত্মীয় স্বজনের সঙ্গেই সে এমনভাবে কথা বলে যেন কত বছরের পরিচয়! তার সালামের জবাব নিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেন হামিদুল হক। কথা শেষ হতেই শাহিনূর কৃত্রিম হেসে জিজ্ঞেস করলেন,“তা দুলাভাই বললেন না তো, হঠাৎ আবৃত্তিকে দিয়ে কী দরকার? আর শিথিল কী বলেছে ওর সম্পর্কে?”
মনে মনে সব কথা গুছিয়ে নিলেন হামিদুল হক। হেসে আসল কথাটা বলেই ফেললেন,“আর বলো না। ওই একটামাত্র ছেলে আমার। একেবারে খুঁতখুঁতে স্বভাবের। আসমা মারা যাওয়ার পর থেকে ছেলে-মেয়েদের আমি নিজে মানুষ করেছি। তাই যখন যা চায় তাই দেওয়ার চেষ্টা করি।”
এরপর কয়েক সেকেন্ডের জন্য তিনি থামলেন। এটা উনার স্বভাব। কথার মধ্যে থেমে বিপরীত মানুষটিকে আকৃষ্ট করার টেকনিক। ফের মুখ খুললেন,“শিথিলের নাকি আবৃত্তিকে খুব পছন্দ হয়েছে। শুধু পছন্দ হলেও না হয় মানা যেতো। কিন্তু ছেলে আমার একেবারে বিয়ে পর্যন্ত ভেবে ফেলেছে। চাঁদ রাতে বাড়ি ফিরে সেকথা আবার আমাকে বললোও সরাসরি। শিথিল কেমন ছেলে তা তো তোমার থেকে আর কেউ ভালো জানে না, নূর। তাই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। তোমরা রাজি থাকলে এই মাসেই দুজনের বিয়েটা না হয় দিয়ে দিলাম। আমার বাড়িটা খালি পড়ে রয়েছে। একজন পুত্রবধূ রূপী মেয়ে ভীষণ দরকার।”
ঝলমলে পরিবেশটা হঠাৎ করেই থমকে গেলো। হয়ে গেলো ছিমছাম, ঠান্ডা। আবৃত্তি শক্ত হয়ে বসে রইল নিজ স্থানে। এমন কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। শাহিনূর শুকনো ঢোক গিলে বলতে চাইলেন, “কিন্তু দুলাভাই ও তো…
উনাকে কথাটা সমাপ্ত করতে দিলেন না ভদ্রলোক। বললেন,“আবৃত্তি মায়ের সম্পর্কে আমি সমস্ত কথাই জানি। শিথিল বলেছে। আমার সেসবে আপত্তি নেই। ছেলের উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তাই আমি রাজি।”
বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইল সকলে। এমন কিছু স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না শাহিনূর। শিথিলকে তিনি নিজ সন্তানের দৃষ্টিতে দেখেন। ছেলেটার জন্য উনার কষ্ট হয়, চিন্তা হয়। তাই এ বিষয়ে ভাবা উনার পক্ষে অসম্ভব। আবৃত্তির উদ্দেশ্যে কড়া কণ্ঠে বললেন,“তুমি আর মিশমি ঘরে যাও।”
মিশমি বুঝলো মা কোনো কারণে রেগে গিয়েছে। তাই আর দাঁড়াল না সেখানে। আবৃত্তি উঠে দাঁড়াল। চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। তখনি হামিদুল হক তাকে আটকে দিয়ে বললেন,“যেই প্রয়োজনে এতোদূর থেকে এসেছি, সেই প্রয়োজন না মিটিয়েই ও চলে গেলে তো হবে না। ওর সঙ্গে আমার আরেকটু কথা আছে।”
ভয়ে হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে আবৃত্তির। আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছে। শাহিনূর বললেন,“ও থেকে কী করবে, দুলাভাই? ওর যাবতীয় সব দায়িত্ব ওর মামার। ওর মামা যা বলবে তাই ওর সিদ্ধান্ত।”
“এটা ভুল বললে। ছেলে-মেয়েদের উপর কখনো কিছু চাপিয়ে দিতে নেই। নিজেদের জীবন নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে। বিয়ে নিয়ে মতামত প্রকাশের অধিকারও রয়েছে। কারণ সংসার তো তারাই করবে। আমরা নই। এ কথা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। তাই কখনো সন্তানদের উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেইনি।”
শাহিনূর বিপরীতে আর কিছু বলতে পারলেন না। বাকি সবার মতো তিনিও হামিদুল হককে মান্য করে চলেন। হামিদুল হক এবার আবৃত্তির উদ্দেশ্যে সোজাসুজি প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“তোমাকে এখন আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করবো। ভেবেচিন্তে মন থেকে উত্তর দিবে। মনে রাখবে, এই প্রশ্নের উত্তরের উপরেই তোমার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এবার বলো, শিথিলকে তুমি চেনো?”
আবৃত্তি নিচের দিকে তাকিয়েই মাথা নাড়ল,“হ্যাঁ।”
“কেমন আমার ছেলে?”
“ভালো।”
“কেমন ভালো? নির্দ্বিধায় বিয়ে করা যায়? একসঙ্গে জীবনের বাকিটা পথ পাড়ি দেওয়া যায়?”
শরীরের ঘাম ছুটে গেলো আবৃত্তির। প্রশ্নগুলো সহজ হলেও মামা-মামীর সামনে উত্তর দিতে শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠছে। এবার আর মুখে কিছু উচ্চারণ করল না সে। উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে আশানুরূপ উত্তর দিলো। অধরের হাসি চওড়া হলো হামিদুল হকের। এবার মূল প্রশ্নটি করলেন,“তুমি কী আমার ছেলের বউ হতে রাজি, মা?”
শাহিনূরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আবৃত্তির উপরেই স্থির।তাই এবার আর চট করে উত্তর দিতে পারলো না আবৃত্তি। বেশ কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষায় বসে থেকে ভদ্রলোক ফের বললেন,“আমার ছেলেকে বিয়ে করলে ঠকবে না তুমি। যদিও বেকার তবুও ছেলে ভালো। সারাজীবন কী আর কেউ বেকার থাকে? আমিও কিন্তু বেকার অবস্থাতেই বিয়ে করেছিলাম। এখন তুমি রাজি হলেই হবে। আমার অত বড়ো বাড়ি যে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
ভদ্রলোকের ব্যবহার অমায়িক। আবৃত্তি তা খেয়াল করল। উনার আচরণের সঙ্গে শিথিলের আচরণেরও বেশ মিল পেলো যেন। তাই উনাকে অপেক্ষা করাতে মোটেও ইচ্ছে হলো না তার। কিন্তু ভয়ে কোনো শব্দ সে উচ্চারণ করতে পারলো না। এরপরের ঝড় যে তার উপর দিয়েই বইবে! তার হাবভাবে যা বুঝার বুঝে গেলেন হয়তো হামিদুল হক। নরম স্বরে বললেন, “আচ্ছা তুমি এবার যেতে পারো।”
হাফ ছেড়ে বাঁচলো আবৃত্তি। বড়ো বড়ো কদম ফেলে দ্রুত প্রস্থান করল। মোজাম্মেল হোসেন পুরো সময়টা নিরব দর্শক হয়ে শুধু দেখলেন এবং শুনলেন। উনার অবশ্য এসবে কোনো আপত্তি নেই। শিথিলকে তিনি বরাবরই পছন্দ করেন। অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই। এমন যোগ্য, ভালো ছেলেদের কে অপছন্দ করে? যদি উনার নিজের মেয়ের জন্য প্রস্তাব আসতো তাও হয়তো রাজি হয়ে যেতেন। তাছাড়া তিনি আবৃত্তির ভালো চান। দ্রুত বিয়েটা দিয়ে দিতে চান। তাহলে আর চাইলেও আইয়ুব আলী এসে মেয়ের উপর অধিকার ফলাতে পারবেন না। বললেন, “আবৃত্তি মা মরা মেয়ে। ছোটো থেকে আমাদের কাছেই মানুষ, ভাইজান। শিথিল নাকি আপনাকে সব জানিয়েছে। তাই বিস্তারিত আজ না হয় না-ই বললাম। সারাটা জীবন মেয়েটা কষ্ট করেছে। খুব করে চেয়েও একটা পরিবার, সুস্থ পরিবেশ আমরা ওকে দিতে পারিনি। সেই আফসোসের আমার শেষ নেই। আপনাদের উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস আছে। তবুও, যদি আর একবার ভালো করে ভেবে দেখতেন। হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।”
“আপনার পরিস্থিতি বুঝতে পারছি, ভাই। আমি কিন্তু হুটহাট সিদ্ধান্ত নেই না। শিথিলও নেয় না। আমার মতোই হয়েছে। সমস্ত দায়িত্ব আমি নিলাম। নিজের মেয়ের মতো যত্ন করে রাখবো।”
সন্তুষ্ট হলেন মোজাম্মেল হোসেন। বুঝাই গেলো তিনি যে রাজি। কিন্তু রাজি হলেন না শাহিনূর। বোঝানোর ভঙিতে বললেন,“শিথিল বাচ্চা ছেলে, দুলাভাই। ওর কী এখনো সংসার করার বয়স হয়েছে?অদূর ভবিষ্যৎ পড়ে রয়েছে সামনে। এখন লেখাপড়া, ক্যারিয়ারের পেছনে ওর দৌড়ানোর সময়। ওর জীবনে মেয়ের কী অভাব পড়েছে নাকি? আপনি অন্তত ওর সঙ্গে তাল মেলাবেন না। হাল শক্ত করে ধরুন। এই বিয়ের চক্করে সুহাসিনীর লেখাপড়াটাও সম্পন্ন হলো না। মেহমাদ নিতান্তই ভালো ছেলে বলে তা না হয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু তাই বলে আবৃত্তি! ও শিথিলের সঙ্গে যায়? আমি ওই বাঁদরের সঙ্গে কথা বলবো। ওকে ভালো করে বুঝাবো। আমি নিশ্চিত, ও বুঝবে। এই বয়সে ছেলে-মেয়েরা এমন একটু আধটু ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। ও লেখাপড়া শেষ করুক। ওর বিয়ের দায়িত্ব আমার। পুরো বাংলাদেশ খুঁজে ওর জন্য যোগ্য মেয়ে নিয়ে আসবো। যদি না পাই তারপরেও চিন্তা নেই। আমার সুশ্রী তো আছেই। আপনাদের চোখের সামনে বড়ো হয়েছে।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলেন শাহিনূর। স্ত্রীর কথায় বিরক্ত হলেন মোজাম্মেল হোসেন। কিছু বলার চেষ্টা করলেন,“প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ে। আমি, তুমি না করার কে?”
স্বামীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন তিনি।চাপা ক্ষোভ ঝাড়লেন,“তুমি চুপ করো। তোমার ভাগ্নিকে আমার ভাগ্নের ঘাড়ে ঝুলাতে চাইছো? আমি তা কখনোই হতে দিবো না।”
হামিদুল হক হতাশ শ্বাস ফেললেন। ব্যাপারটা যে এত জটিল হবে তা তিনি ভাবতে পারেননি।তবুও শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে গেলেন। বুঝলেন, শাহিনূরের মত বদলানো কিছুতেই সম্ভব নয়। তবে এর মত বদলানো না গেলে বিয়েও তো সম্ভব নয়। অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া কী আর মেয়েদের বিয়ে হয়? সেদিনের মতো আলাদাভাবে মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে কথা বলে বিদায় নিলেন হামিদুল হক। যদিও শাহিনূর সেদিন রাতটা ও বাড়িতে থাকার অনুরোধ করলেন কিন্তু তিনি থাকলেন না। এমনকি এতোদূর এসেও ছেলের সঙ্গে দেখা করলেন না। ফিরে এলেন বাড়ি।
__________
বাড়িতে এত বড়ো একটা কান্ড যে ঘটে গেলো তা সুশ্রী জানলো না। সে বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার একটু আগে। নিজ ঘরে প্রবেশ করেই গোসল সেরে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল। চঞ্চল মিশমিও আজ বড়ো বোনকে এসে কিছু বললো না।
হামিদুল হক যাওয়ার পর থেকেই শাহিনূর ভীষণ রেগে আছেন। উনার সমস্ত রাগ আবৃত্তির উপর। রাতের খাওয়ার পর আবৃত্তির ডাক পড়ল উনার ঘরে। আবৃত্তি এলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল দরজার পাশ ঘেঁষে। তার দিকে রূষ্ট দৃষ্টিতে তাকালেন শাহিনূর। রাখঢাক না রেখেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“তোমার আর শিথিলের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে? কতদিনের সম্পর্ক? কীভাবে হয়েছে? সত্যি কথা শুনতে চাই।”
“কোনো সম্পর্ক নেই।”
“সম্পর্ক ছাড়াই কেউ বিয়ে করতে চায়? চোখ ধাঁধানো রূপও তো নেই যে পুরুষ মানুষ পাগল হয়ে যাবে।”
কণ্ঠে বিদ্রুপ ঝরে পড়ল। আবৃত্তি চুপ রইল। শাহিনূর কঠিন স্বরে বললেন,“লেখাপড়ার নাম করে হোস্টেলে গিয়ে এসবই করা হচ্ছে? ছেলে নাচানো হচ্ছে?”
“আমি কোনো ছেলে নাচাইনি। উনি নিজেই এসে কথা বলেছেন। বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। এখানে আমার দোষ কোথায়?”
“একদম মুখে মুখে তর্ক করবে না।তোমার বাপ তোমায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এসে পড়েছো মামাদের ঘাড়ে।আর এসেই কিনা এসব করে বেড়াচ্ছো? যাই হোক, আমি এসব ভুলে যেতে চাই। তুমিও ভুলে গেলেই ভালো। হোস্টেলে ফেরার প্রয়োজন নেই। তুমি এখানেই থাকবে। এখান থেকে গিয়ে ক্লাস করবে। যাওয়ার পথে সুশ্রীর সঙ্গে যাবে। শিথিল ছেলেমানুষ। দুনিয়া সম্পর্কে কতটুকু জানে? ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখবে না। এটাই তোমার জন্য ভালো হবে। বুঝতে পারছো?”
হ্যাঁ না কিছুই বললো না আবৃত্তি। তার নিরবতায় বিরক্ত হলেন শাহিনূর। রাগত স্বরে বিদায় দিলেন, “যাও এখন।”
আবৃত্তি চুপচাপ চলে এলো ঘরে। মিশমি গালে হাত রেখে বিছানায় বসে ছিল। কোনো এক ভাবনায় মগ্ন। আবৃত্তিকে দেখেই ললাটে ভাঁজ পড়ল তার। টেনে এনে বসালো বিছানায়। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলে উঠল, “আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, আপু। এ তুমি কী ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে?”
মিশমিও যে এমনভাবে প্রশ্ন করবে তা ভাবতেও পারেনি আবৃত্তি। নিজেকে তার হীন মনে হচ্ছে। সবাই কী তাকে নিচু দৃষ্টিতে দেখছে? বোধহয়। মিশমির উত্তেজনা কিছুতেই কমছে না। শিথিল আর আবৃত্তি নাম দুটো একত্রে উচ্চারণ করতেই তার বাঁধছে। সেখানে বিয়ে! মারাত্মক ব্যাপার। চিন্তায়ও আনতে পারে না। পুনরায় বললো,“আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। শিথিল ভাই আর তুমি কীভাবে?”
“কেনো?”—কণ্ঠে কিছুটা ক্ষোভ ঝরে পড়ল যেন আবৃত্তির।
মিশমি ভড়কে গেলো,“না, আসলে এটা কীভাবে হয়? শিথিল ভাই কীভাবে তোমাকে পছন্দ করতে পারে?”
“আমি কালো বলে আমায় কেউ পছন্দ করতে পারবে না? তোমাদের বাড়িতে এতোকাল থাকতাম বলে কারো যোগ্য নই? নাকি তোমারও ধারণা তোমার শিথিল ভাইকে আমি ফাঁসিয়েছি?”
স্তব্ধ হয়ে গেলো মিশমি। এমন কিছু সে ভাবনায় আনেনি। সে তো শুধুই নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছে। তাছাড়া আরো একটি কারণ অবশ্য রয়েছে। মিশমির ধারণা, সুশ্রীও শিথিলকে পছন্দ করে। তার হাবভাবে এমন ধারণা আসা অসম্ভব কিছু নয়। বড়ো বোনকে মিশমি খুব ভালো করেই চেনে। সে যদি একবার জানতে পারে এ বিষয়ে! তাহলে কী হবে কে জানে? ভাবলেই দেহ শীতল হয়ে ওঠে মিশমির। তাই এ বিষয়ে তার বিস্তারিত না জানলেই নয়।
আবৃত্তির সারা দেহে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে। হাত-পা ঘেমে একাকার। কয়েক মুহূর্তে কি থেকে যে কি হয়ে গেলো! তার জীবনটা এত জটিলতায় ভরা কেনো? এই মুহূর্তে এসেও বাবার প্রতি প্রচন্ড রাগ হলো। ওই একটা লোকের জন্য তার আজ এই দশা।
তখনি মোবাইলে রিং হলো। স্ক্রীনে তাকাতেই বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। আরেক সমস্যার মূল কল করেছে। মোবাইলটা নিয়ে বারান্দার দিকে হাঁটা ধরলো আবৃত্তি। মিশমির উদ্দেশ্যে বলে গেলো,“সত্য বললেও আমার কথা তোমাদের বিশ্বাস হবে না। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের কথা কেই বা বিশ্বাস করে? এরচেয়ে তুমি তোমার ভাইকেই জিজ্ঞেস করো, কীভাবে তাকে ফাঁসিয়েছি।”
চলবে _______
#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৭]
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন প্রথম দুই বছরই স্বর্গীয়। এরপর জীবনে নেমে আসে ধোঁয়াশা, ব্যস্ততা। কেউ বন্ধু হারায়, কেউ হয় নিঃসঙ্গ আবার কেউ বা বিচ্ছেদের অতল সমুদ্রে ডুবে গিয়ে মানসিক বিপর্যস্ততার মুখোমুখি হয়। শিথিলের বন্ধুমহলে লেখাপড়ার ভীষণ ব্যস্ততা। বিশেষ করে শান্ত আর সজীবের। আর কদিন পর তাদের ফাইনাল। যেকোনো মুহূর্তে কর্তৃপক্ষ থেকে নোটিশ চলে আসতে পারে। তাই বিভিন্ন আড্ডায় কিংবা শতশত দুষ্টুমিতে তাদের উপস্থিতি কমে গিয়েছে। শিথিলদের অবস্থাও অবশ্য আহামরি ভালো নয়। তাদেরও পরীক্ষা। চতুর্থ বর্ষ থেকে পঞ্চম অর্থাৎ শেষ বর্ষে ওঠার অসহ্যকর পরীক্ষা।
শিথিল আর আরফিনের পরীক্ষা দিতে ভালো লাগে না। প্রয়োজন হলে সারাবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে কানাচে তারা ঘুরে বেড়াতে রাজি কিন্তু পরীক্ষা দিতে রাজি নয়। তবুও দিতে হয়। বাধ্য হয়ে। তবে রোজার মধ্য থেকে চাপটা যেন একটু বেশিই পড়েছে। স্বাধীন আঙুলে কলম ঘুরাতে ঘুরাতে প্রফেসরের দিকে দৃষ্টি রেখেই বই দিয়ে মুখ ঢেকে বিরক্তি নিয়ে বললো, “শান্তিমতো একটু ঘুমাতেও পারি না। এত সকালে কে ক্লাস নেয়, ভাই? রোজ এত কষ্ট করে ক্লাস করেও আবার লাভ নেই। সিজিপিএ মেরে দেয়।”
আরফিন তার মতো করেই বললো,“রমজান মাস হলো ইবাদতের মাস। সারা বছরের সকল পাপ ধুয়ে সওয়াব কামানোর মাস। ওই পবিত্র মাসেই তো এই মগাগুলো ক্লাস করিয়েছে। একটুও ছাড় দেয়নি। সেখানে এটা তো সাধারণ মাস। দূর ভাল্লাগে না।”
শিথিল তার মতো করেই বললো,“এরা হচ্ছে মানুষরূপী শয়তান। আল্লাহ মাফ করুক। সঠিক বোঝ দান করুক এই দুনিয়া আঁকড়ে বেঁচে থাকা বলদদের।”
আরফিন আর স্বাধীন চোখ বন্ধ করে করুণ সুরে বলে উঠল,“আমিন!”
দূর থেকে স্যার হয়তো দেখলেন। কলম উঁচু করে ধমক দিলেন স্বাধীনকে। দাঁড় করিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভরা ক্লাসে কথা শোনালেন। সারা রাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি স্বাধীনের। ফজরের নামাজটা পড়ে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই বেজে উঠেছিল সাড়ে সাতটার অ্যালার্ম। চোখে ঘুম নিয়ে অযথা কথা শুনতে ভালো লাগলো না তার। তবুও ভান করল যেন বিশাল একটা ভুল করে ফেলেছে! শেষ মুহূর্তে প্রফেসরদের চেতানো উচিত নয়। সিজিপিএ তো এদের হাতেই!
সবগুলো ক্লাস শেষ করে বিল্ডিং থেকে নিচে নেমে এলো ওরা চারজন। চারিদিকে ছেলে-মেয়েদের গল্পের আসর বসেছে। শান্ত, সজীব না থাকায় আজ আর ওরা আড্ডায় বসলো না। স্বাধীন প্রস্তাব রাখলো,“চল দুপুরের খাবারটা কাছেপিঠে কোথাও খেয়ে রমনা থেকে ঘুরে আসি।”
আরফিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“বহুদিন সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখি না।”
তুহিন চমকালো,“তুই আবার এমন লুচ্চা হলি কবে থেকে? এসব তো শান্ত, সজীবের কথা।”
“ব্রেকাপের পর থেকে। মেয়ে না দেখলে বিয়ে করবো কীভাবে?”
“আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়ের অভাব আছে?”
“না, ওদিকে আর যেতে চাই না।”—হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠ তার।
কথার এক ফাঁকে আরফিন শিথিলের পানে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন ছুঁড়ল,“তুই বিয়ে করছিস কবে? ভাবি রাজি হয়েছে?”
“ধারণা অনুযায়ী তো আজ কালকের মধ্যেই করার কথা ছিল। গতকাল বাবা প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরপর কী হলো কে জানে? বাবাও ঠিকমতো কিছু বললো না, ওদিকে ভবিষ্যৎ বউও কল ওঠাচ্ছে না। এই ঝামেলা ভালো লাগে?”
তুহিন বললো,“রিজেক্ট হয়েছিস? কেমনে সম্ভব? তার মামী না তোর আন্টি?”
“এখানেই মূল সমস্যা। গতকাল রাতে ফোন করে আজ আন্টি যেতে বলেছে। জরুরি তলব। তোরা কোথায় যাবি যা। আমি বাসায় ফিরবো। ফ্রেশ হয়ে ওখানে গিয়ে দেখি কী অবস্থা!”
স্বাধীন ভরসা দিয়ে বললো,“একদম চিন্তা করবি না। তোর আন্টি যদি ভিলেন হয় তাহলে ভাবিকে তুলে নিয়ে কাজী অফিসে গিয়ে তোদের বিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। প্রয়োজনে ভাবির বাপ হবে আমাদের ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র তুহিন।”
তুহিন বাদে সকলে হাসলো। তেতে উঠে বললো, “আমি বাপ হবো মানে? মেজাজ গরম করবি না, স্বাধীন। আমার কী বাপ হওয়ার বয়স হয়েছে?”
“উকিল বাপ হবি।”
“তুই হ গিয়ে।”
“আমি উকিল বাপ হলে দেবর হবে কে?”
“আমি আর আরফিন হবো।”
স্বাধীন হায় হায় করে উঠল,“দেখ বন্ধু শিথিল, দেখ। এই পোলার মাথায় তোর বউ নিয়ে কী চলছে দেখ। বন্ধুর বউ মানে নিজের বউ নামক পোস্ট দেখে তোর মাথায়ও এসব আসেনি তো?”
তাদের ঝগড়ার মধ্যে আর থাকলো না শিথিল। যেতে যেতে বলে গেলো,“তোদের একটাকেও আমি আমার বউ দেখাবো না। যা ইচ্ছে কর।”
তিনজনেই আহাম্মক বনে গেলো। স্বাধীন চেঁচালো, “বউ না দেখালে তুই দাম্পত্য জীবনে অসুখী হবি, মগা।”
সেকথায় বিশেষ পাত্তা দিলো না শিথিল।
________
সাবেরা বিবি ছোটো কন্যার বাড়ি থেকে মেজো কন্যার বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন সকাল দশটার আশপাশ সময়ে। মাকে পেয়ে ভীষণ খুশি হলেন শাহিনূর। পেটের মধ্যে চেপে রাখা সমস্ত কথা গড়গড় করে মায়ের কানে উগলে দিলেন। এই জন্যই মূলত শিথিলকে আজ তিনি আসতে বলেছেন। দুজনে মিলে বুঝালে অবশ্যই শিথিল বুঝবে।
আবৃত্তিকে সাবেরা বিবির একদম পছন্দ নয়। বিশেষ করে যেদিন মেয়েটা উনার সঙ্গে তর্ক করে বিরুদ্ধাচরণ করেছে সেদিন থেকেই। কথাগুলো শোনার পর থেকে রাগে গজগজ করছেন বৃদ্ধা। তেড়ে যেতে চেয়েছিলেন আবৃত্তির কাছে। কয়েকটা কড়া কথা না শোনালে হবে না। কিন্তু শাহিনূর বুঝিয়ে সুঝিয়ে আটকে রেখেছেন মাকে। স্বামী জানলে রেগে যাবেন। সর্বদা কী আর স্বামীকে নারাজ করা যায়?
শিথিল এলো ঠিক তিনটা বেজে পাঁচ মিনিটে। গেটের পাহারায় বসে দারোয়ান আজিজ পুরোনো আমলের গান শুনতে শুনতে গুনগুন করছেন। তাকে দেখে হেসে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক। শিথিলও বিপরীতে হাসলো। ঠান্ডা মিল্ক সেকের বোতল ধরিয়ে দিয়ে বললো,“আজ অনেক গরম পড়েছে! নিন মিল্ক সেক খেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠুন।”
খুশি হলেন আজিজ। সবার মতো উনার সঙ্গেও সম্পর্ক বেশ ভালো শিথিলের। যতবার আসে ততবারই কিছু না কিছু দিবেই। মুখের ললিপপটা ডাস্টবিনে ফেলে উপরে উঠে এলো শিথিল। কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো মিশমি। শিথিল ভ্রু কুঁচকালো। তেতো মুখে প্রশ্ন করল,“পড়াশোনা নেই? অসময়ে বাড়িতে কী?”
“কলেজে এপ্লাই করেছি।”
“ফলাফল কী?”
“আজ সন্ধ্যায় আসবে।”
“সরো সামনে থেকে।”
“আকাম কুকাম ঘটিয়ে এত চিল মুডে কীভাবে আছেন? লজ্জা করছে না?”
“না, লজ্জা থাকলে পৃথিবীর জনসংখ্যা এত বেশি কী করে হতো?”
“আপনার থেকে এসব আশা করিনি। কে কাকে পটালো?”
“বলবো না। জানলে কীভাবে?”
“না জানার কিছু নেই। আমার সামনেই ঘটেছে।”
“ভালোই হয়েছে। তা সে কোথায়?”
“কে?”
“তোমার ভাবি।”
হতভম্ব হয়ে গেলো মিশমি।যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও নির্লজ্জ এই ছেলে। বোনকে ভাবি বানিয়ে দিলো? হাত থেকে পলিথিন দুটো টেনে নিলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,“দুদিন ধরে মনটা আইসক্রিম আইসক্রিম করছিল। জানলেন কীভাবে, ভাইয়া? চকলেট ফ্লেভার আমার বেশি পছন্দ। ওটাই আনতেন।”
তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে এসে সোফায় বসলো শিথিল। মুখ কুঁচকে বললো,“যা এনেছি তা নিয়ে খুশি থাকো।” এরপর আস্তে করে বললো,“কল ধরছে না মেয়েটা। এখান থেকে গিয়ে ভিডিও কল দিলে রিসিভ করে ওর সামনে ধরবে কিন্তু।”
“ভালোবাসা উতলে পড়ছে।”
“স্বাভাবিক। আন্টিকে ডেকে আনো তাড়াতাড়ি।”
মিশমি সর্বপ্রথম শাফিনকে ডেকে পিরিচ আর চামচ আনতে পাঠিয়ে খবর পৌঁছে দিলো মায়ের কাছে। এরপর চলে গেলো নিজের ঘরে। আবৃত্তি বই পড়ছিল। তার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আইসক্রিমের বাটি দেখিয়ে দেখিয়ে বললো,“কে এসেছে জানো?”
“কে?”
“তোমার প্রিয়তম।”
“মানে?”
“শিথিল ভাই।”
অবাক হলো আবৃত্তি। মিশমি ফের বললো,“তোমার জন্য নয়। আম্মু ডেকে এনেছে। যাবে নাকি একবার? কালো শার্টে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে।”
প্রত্যুত্তর করল না আবৃত্তি। মিশমি গিয়ে ফ্যান বন্ধ করে দিলো। ড্রয়িং রুমের আওয়াজ তার ঘর পর্যন্ত পরিষ্কার আসে না। তবে সুশ্রীর ঘরে বসে আবার সেসব ভালো করেই শোনা যায়। কিন্তু সেখানে আপাতত আবৃত্তিকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। পথে শিথিলের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শাহিনূর আর সাবেরা একসঙ্গে এসে বসলেন। বৃদ্ধাকে দেখে অধরে হাসি ফুটে উঠল শিথিলের,“আরে বড়ো নানু যে! আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?”
“ ওয়া আলাইকুমুসসালাম, আলহামদুলিল্লাহ ভালা। তোর কী খবর?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তা হঠাৎ জরুরি তলব?”
“এইডা তোর বিয়ার বয়স? তাও আবার বেহায়ার মতো বাপেরে পাডাইছোস বিয়ার প্রস্তাব লইয়া। এই যুগের পোলা হইয়া রুচি এত খারাপ কেমনে হয়? শেষমেশ ওই কাল্লিরে পছন্দ হইছে?”
অধরের হাসি নিভে গেলো শিথিলের। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইল বৃদ্ধার পানে। শেষ কথাটা বুঝতে পারলো না যেন। মায়ের কথায় শাহিনূর বিরক্ত হলেন। কোথায়, কার সামনে কী বলতে হয় এখনো শিখেননি। শিথিল কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কৌতূহলী হয়ে বললো, “বিয়ে হালাল এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। সবাইকেই একসময় না একসময় করতে হয়। তাহলে বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাঠাতে লজ্জা কীসের? তাছাড়া রুচি খারাপ মানে? আর কাল্লি কে?”
শাহিনূর জোরপূর্বক হাসলেন,“রাখ তো তোর নানীর কথা। কী বলতে কী বলে ফেলেছে।”
মেয়ের কথায় মুখ বাঁকালেন সাবেরা বিবি। পুনরায় বললেন,“ভুল কী কইছি? মাইয়ার মা নাই, বাপের ঠিক নাই, অন্যের কাছে থাইক্কা বড়ো হইছে। একেবারে বিয়া করার মতন চেহারা সুরতও তো নাই। তাইলে এমন সিদ্ধান্ত নিলি কেমনে? আর তোর বাপেও বা কেমনে নাচতে নাচতে চইল্লা আইলো?”
বাবার নামে কোনো কথা শুনতে পারে না শিথিল। এবারো পারলো না। গম্ভীর মুখে বললো,“আমার বাবা আপনার চেয়েও জ্ঞানী এবং রুচিশীল মানুষ। তিনি কখনো কারো অবস্থান এবং গায়ের রং নিয়ে খোঁটা দেন না। কিংবা সন্দেহবশত গীবত করেন না। তিনি সৎ, বুদ্ধিমান মানুষ। উনার সম্পর্কে একটা শব্দ উচ্চারণ করার আগেও ভেবে নিবেন।”
শাহিনূরের বুক ধড়ফড় করে উঠল। চাপা ধমক দিলেন মাকে,“তোমাকে এসব বলার জন্য এখানে এনেছি? তুমি বেশি কথা বলো, মা। ছেলে-মেয়ের আবদার দুলাভাই ফেলতে পারেন না তাই এসেছেন। খারাপ কিছু তো করেননি। আমাদের উচিত শিথিলকে সঠিকটা বোঝানো।”
মিইয়ে গেলেন বৃদ্ধা। শাহিনূর নমনীয় হয়ে ভাগ্নের উদ্দেশ্যে বললেন,“মায়ের কথা ধরিস না, বাবা। আমরা কী তোর খারাপ চাই? তুই জানিস না আমি তোকে কত ভালোবাসি? সারাক্ষণ তোর চিন্তায় থাকি।”
“জানি।”
“তোর মা আমার নিজের বোনের থেকেও বেশি ছিল। নিজের বোনদের কাছে আমি যা বলতে পারতাম না তোর মায়ের কাছে তা অনায়াসে বলে দিতাম। আমার বিয়েটা পর্যন্ত হয়েছে তোদের বাড়ি থেকে। আজ সে বেঁচে থাকাকালীন তুই ভুল করলে এভাবেই তো তোকে বুঝাতো, তাই না?”
“হ্যাঁ, সব মানছি। কিন্তু ভুল কী করেছি?”
তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারলেন না শাহিনূর। যুবক ছেলেদের সঙ্গে একটু বুঝেশুনে, বুদ্ধি করে কথা বলতে হয়। তা তিনি জানেন। উনার নিরবতায় শিথিলও নরম স্বরেই বললো,“হারাম পন্থা অবলম্বন না করে হালাল পথ বেছে নিয়েছি। মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছে বিধায় বাবাকে বলে রাজি করিয়েছি। তোমরা ওর অভিভাবক তাই তোমাদের কাছেই প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এটা কী ভুল, আন্টি? তোমার কী মনে হয় একদিনে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি?”
“সেকথা আমি বলিনি। আমরা জানি তুই ভালো ছেলে। তোর সিদ্ধান্ত একদম যথাযথ। ভুল হচ্ছে, ভুল মানুষকে বেছে নেওয়া। সবার সঙ্গে কী সবাইকে মানায়? তুই তো সব জানিস। পৃথিবীতে ভালো মেয়ের অভাব পড়েছে?”
“আবৃত্তি মেয়েটা ভালো না বলছো?”
“তা না, কিন্তু ওর পারিবারিক ব্যাপারটা তো জানিস? ও তোর জন্য সঠিক মানুষ নয়। বরং তোর জন্য একজন ভালো সাংসারিক মেয়ে প্রয়োজন। যে তোকে আগলে রাখতে পারবে। সংসারটা শক্ত হাতে সামলাতে পারবে।”
“আমি কী বাচ্চা ছেলে যে আমাকে আগলে রাখতে হবে? নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়া আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছেন। তাছাড়া মেয়ে কী রান্নাবান্না জানে না?”
“তা জানে।”
“চরিত্র খারাপ?”
“এ কী বলছিস? এদিক থেকে ভালো।”
“শারীরিক সমস্যা আছে? কানে কম শোনা, মানসিক ভারসাম্যহীন টাইপ?”
“তা নেই।”
“তাহলে সমস্যা আসলে কোথায়? এমন মেয়েই তো স্ত্রী হিসেবে পারফেক্ট। মা তো আমারো নেই। মা ছাড়া বড়ো আমিও হয়েছি। পৃথিবীতে কত মানুষেরই মা নেই। তাই বলে ওদের বিয়ে হয় না?তোমরা কী ওকে কখনো বিয়ে দিবে না? তাহলে আমার সঙ্গে দিলে কী সমস্যা?”
সাবেরা বিবি কাঁচুমাচু মুখে বললেন,“মা নাই তো কী হইছে? তুই আর ওই মাইয়া এক?”
“এক অবশ্য নই। পার্থক্য হচ্ছে, আমি ছেলে আর সে মেয়ে। আমি বয়সে বড়ো, সে ছোটো। আমি একজন ভালো বাবা পেয়েছি কিন্তু সে পায়নি।”
শিথিলকে বোঝানো যতটা সহজ শাহিনূর ভেবেছিলেন ততটা সহজ যেন নয়। এই ছেলের সঙ্গে যুক্তিতর্কে জেতা অসম্ভব। শিথিল মৃদু হেসে বললো,“গায়ের রঙের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষের মনের রঙ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং চিন্তা-ভাবনা। শ্যামলা আর কালোর মধ্যে বহু পার্থক্য রয়েছে। তার থেকেও সত্য কথা হচ্ছে, আমার মাও ছিলেন শ্যামলা। তাই বলে কী বাবা ভুলে গিয়েছিলেন মাকে? অন্য কাউকে ঠাঁই দিয়েছিলেন মায়ের স্থানে? নাকি আমার মাকে নিয়েও আপনার মস্তিষ্কে এমন কুৎসিত চিন্তা-ভাবনা ছিল, নানু? যা আজ অন্যভাবে প্রকাশ করলেন?”
সাবেরা বিবি মিইয়ে গেলেন। এমন কিছু ভেবে কথাটা বলেননি। বোনঝিকে তিনি ভীষণ আদর করতেন। শাহিনূর চঞ্চল কণ্ঠে বললেন,“ভুল বুঝিস না, বাবা। বয়স হয়েছে তাই কী বলতে যে কী বলে ফেলে না!”
ঠিক সেই সময়ে এসে উপস্থিত হলো সুশ্রী। ক্লান্ত তার দেহ। দুপুরে ভারি কিছু পেটে পড়েনি। মিতা তার হাত থেকে দ্রুত ব্যাগ আর সাদা ইউনিফর্মটা নিয়ে চলে গেলো ঘরে। সোফায় বসে থাকা শিথিলকে দেখে অবাক হলো সুশ্রী। ক্লান্ত শ্রান্ত মুখশ্রীতে সূর্যের মতো উদিত হলো ঝলমলে হাসি। এগিয়ে এসে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো,“আরে শিথিল ভাই যে! হঠাৎ কী মনে করে? আপনার তো আজকাল দেখা মেলা ভার।”
মেয়ের আগমনে কিছুটা খুশি হলেন শাহিনূর। শেষ ভরসা এবার যেন উনার বড়ো কন্যা। বললেন,“ভালো সময়ে এসেছিস। বোস তুই। ওকে একটু বুঝা। যদি তোর কথা শোনে।”
শিথিল নিরব রইল। ব্যাপারটা ধরতে পারলো না সুশ্রী। মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,“কী হয়েছে আবার?”
“কী হয়নি সেটা বল। তোর ভাইয়ের মাথায় বিয়ের ভূত চেপেছে। লেখাপড়া শেষ হয়নি অথচ তিনি বিয়ে করবেন। তাও না হয় মানা যায়। বিয়ের বয়স হয়েছে যখন করুক। কিন্তু কাকে করতে চাইছে জানিস?”
মনে হলো বুকে যেন কেউ তীর ছুঁড়ল। বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল সুশ্রী। ভুল শুনলো সে? জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে জিজ্ঞেস করল,“কাকে?”
“আবৃত্তিকে। তোর খালু গতকাল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল।”
বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সুশ্রী। শরীর রীতিমতো কাঁপছে। ক্লান্তিতে নাকি এমন জঘন্য এক সত্য শুনে? তবুও বিশ্বাস হলো না। এক টুকরো আশা নিয়ে কান পেতে রইল শিথিলের মুখ থেকে সত্যটা শোনার জন্য। শিথিল ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হচ্ছে। নিজের ব্যক্তিগত জীবনে বাবা ছাড়া আর কাউকে সে হস্তক্ষেপ করতে দিতে নারাজ। এমনকি নিজের বড়ো বোনকেও। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মেলা প্রয়োজন।তাই হাতঘড়িতে সময় দেখলো। চাপা শ্বাস ফেলে বললো,“যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি অনেক ভেবেই নিয়েছি। তাই আমার সিদ্ধান্তে আমি অনড়। আমার অভিভাবক হচ্ছে আমার বাবা। আর বাবা সব জানে এবং মেনেও নিয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ে আমরা। তাই কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। আশা করি তুমি এ বিষয়ে আরেকবার ভাববে, আন্টি। তাছাড়া এতে আবৃত্তিরও কোনো দোষ নেই। আমি নিজেই ওকে পছন্দ করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। তাই এ বিষয়ে ওকে কিছু বলো না।”
এরপর টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে গলা ভেজালো। নত স্বরে বললো,“কয়েকদিন পর পরীক্ষা আমার।তাই লেখাপড়ার ভীষণ ব্যস্ততা। টিউশন আছে। এখন যেতে হবে। আসি তবে?”
মূল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে ভাগ্নের মন থেকে নিজের জন্য তৈরি খারাপ ভাবনা দূর করতে চাইলেন শাহিনূর। আরো মিনিট পাঁচেক কথা বলে এরপর বিদায় দিলেন।
সুশ্রী সেই নিরবতা বজায় রেখে উঠে দাঁড়াল। বড়োই বেখেয়ালি কদমে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। পথে মিতার হাত থেকে ঠান্ডা পানির বোতলটা নিয়ে দরজা আটকে সেই অবস্থাতেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। আজ দিনটি ভীষণ খারাপ।
চলবে ________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)