মেঘমেদুর দিনে পর্ব-২৮+২৯

0
51

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৮]

ধরিত্রীতে রাত নেমেছে। কিন্তু রাতের এই আঁধার শহরে যেন ভীষণ বেমানান। কৃত্রিম আলোতে আলোকিত হয়ে উঠেছে চারিদিক। অন্ধকার, বদ্ধ ঘরে জানালার কোল ঘেঁষে উদাস যুবতীর ন্যায় বসে আছে সুশ্রী। দৃষ্টি আকাশে জ্বলজ্বল করা তারকামণ্ডলীর পানে। ক্যারিয়ার নিয়ে আত্মসচেতন মেয়ে আজ আর বইয়ে হাত লাগায়নি। নোট পাঠাতে বলা বান্ধবীর কলটাও রিসিভ করেনি। করেনি লম্বা চুলে বেনুনী। রূপে যেন বিষণ্ণতার ছাপ পড়েছে।

হঠাৎ অন্ধকার ঘরে কারো উপস্থিতি টের পাওয়া গেলো। সাবধানে পা ফেলে পাশে এসে দাঁড়াল মিশমি। উশখুশ করতে করতে জিজ্ঞেস করল,“রাতে খাবি না? দুপুরেও তো মনে হয় না খেয়েছিস। নুডলস্ তৈরি করে আনবো?”

“না, ঘুমা গিয়ে।”

“আপু!”

“বিরক্ত করিস না।”

“শিথিল ভাইকে পছন্দই যেহেতু করিস তাহলে এতদিন বলিসনি কেনো? এতদিন যখন বলিসনি এখন কেনো অনশনে বসেছিস?”

স্থির, অনুভূতিশূন্য হয়ে বসে থাকা সুশ্রী হঠাৎ করেই চমকে গেলো। বিস্ফোরিত নেত্রে তাকালো ছোটো বোনের মুখ পানে। এ কথা কখনো কাউকে বলেনি সে। চেপে রেখেছে নিজের মন মস্তিষ্কে। তাহলে ও জানলো কীভাবে? মিশমি হয়তো তা বুঝতে পারলো। বসে পড়ল পাশের ফাঁকা স্থানে। বললো,“জানাটা বোধহয় কোনো কঠিন কিছু নয়। তোর বোন হই আমি‌। তোর চোখের ভাষা, আচরণ, কোন হাসির কী অর্থ সব বুঝতে পারি।”

শরীরটা যেন দুর্বল হয়ে পড়ল সুশ্রীর। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ক্লান্ত, ভঙ্গুর কণ্ঠে বললো,“অথচ উনি বুঝলেন না। আমার তিলতিল করে গড়ে ওঠা অনুভূতি সম্পর্কে কিচ্ছুটি জানলেন না। আবৃত্তির সাথে কীভাবে? কখন হলো এসব? আমি কেনো জানতে পারলাম না?আবৃত্তি কী আমার থেকেও সুন্দরী?”

“ব্যাপারটা সৌন্দর্যের নয়। ব্যাপারটা হচ্ছে অনুভূতি আর মনের মিলের। সবাই কী আর সৌন্দর্যের পূজারী হয়? শিথিল ভাই তো বরাবরই অদ্ভুত মানুষ। তাই উনার কাজকর্ম, পছন্দও অদ্ভুত হবে এটাই তো স্বাভাবিক।”

“এখন আমার কী করা উচিত?”

“যখন করা উচিত ছিল তখন কেনো করিসনি? নিজের অনুভূতি গোপন রেখে লাভ কী হলো?”

“একতরফা অনুভূতি। কীভাবে প্রকাশ করতাম?”

“আমায় তো বলতে পারতি।”

“অত গভীর সম্পর্ক কোনোকালেই আমাদের ছিল না।”

“তার দায়ও কিন্তু তোর। সারাজীবন শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ক্যারিয়ার নিয়েই ভেবে গেলি। কী হবে এসব ক্যারিয়ার দিয়ে? চাকরি, টাকা-পয়সা দিয়ে কী হয়? মানব জীবনের মূল এচিভমেন্ট কখনোই এগুলো হতে পারে না। সবার আগে হচ্ছে মানসিক শান্তি। সেই শান্তি পেতে হলে লাগে একজন আদর্শ জীবনসঙ্গী। সুন্দর একটা সংসার।”

“এত কঠিন, বোঝদার কথা শিখলি কোত্থেকে? ছোটো বোন বলে একদম মনে হচ্ছে না।”

উত্তর দিলো না মিশমি। চুপচাপ বসে থাকলো বেশ কিছুক্ষণ। আজ কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে সুশ্রীর। তাই সে চুপ থাকলো না। বললো,“এখন কী করবো আমি? আবৃত্তিকে গিয়ে বলবো? বল না, বলবো গিয়ে? শিথিল ভাইকে আমি পছন্দ করি। তুই মাঝখানে আসিস না।”

“বোঝদার মানুষদের বাচ্চামো করা উচিত নয়। এখানে আবৃত্তি আপুর কোনো দোষ নেই। সে কখনো মাঝখানে আসেনি। তোর আর শিথিল ভাইয়ের মধ্যে কিছু ছিলই না। তাই তাকে আনা হয়েছে।স্বয়ং শিথিল ভাই এনেছে। তবুও বেচারিকে আম্মুর কটু কথা শুনতে হচ্ছে। আজ তো নানু এসেও যোগ দিয়েছে। হোস্টেলে যেতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। অকারণে বাইরে বের হওয়া নিষেধ। এর মধ্যে তুইও যদি গিয়ে একথা বলিস তাহলে আপুর মনে কী প্রভাব পড়বে ভাবতে পারছিস?”

“তাহলে আম্মুকে গিয়ে বলবো?”

“অশান্তি আরো বাড়বে। সম্পর্কগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।”

ভেঙে পড়ল সুশ্রী,“তাহলে?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিশমি,“সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। এটাই চিরন্তন সত্যি। যখন সময় ছিল তখন কিছু না বলে অপেক্ষা করেছিলি। সে জন্যই আজকের দিনটা দেখতে হচ্ছে। রবের ফয়সালার উপর ছেড়ে দে সব। শিথিল ভাই তোর ভাগ্যে থাকলে নিজ থেকেই তোর কাছে আসবে। আর না থাকলে হয়তো জীবনে উত্তম কাউকে রব পাঠাবেন।”

“আমার শিথিল ভাইকেই লাগবে।”

“কবে থেকে ভালোবাসিস? কতদিনের এই অনুভূতি?”

“তখন আমি টুয়েলভে পড়ি। শিথিল ভাই পড়ে বুয়েটে, ফার্স্ট ইয়ার। তা নিয়ে আম্মুর সেকি গর্ব! আম্মুর ডাকে বাধ্য হয়েই হয়তো মাসে দুই তিনবার এ বাসায় আসতে হতো উনাকে। ওখান থেকেই ভালো লাগা শুরু। আম্মুর মুখে সারাক্ষণ উনার গল্প শুনে ভাবনার শুরু। এরপর এইচএসসি পরীক্ষা এলো। আমার সেকি ভয়! প্রত্যেক বোর্ড পরীক্ষার আগেই এমন হতো।আম্মু বললো, তোর শিথিল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বল। এ বিষয়ে সে ভালো জানে। আমি বললাম। উপলব্ধি করলাম, ভারি সুন্দর করে কথা বলেন উনি। তখনকার মতো আমার ভয় কেটে গেলো। এরপর এলো এডমিশন। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আমার সেই ছোটোবেলার। শাফিন যখন আম্মুর পেটে তখন আম্মুর সঙ্গে কত যে হাসপাতালে যাওয়া হয়েছে! স্টেথোস্কোপ গলায় জড়িয়ে সাদা ইউনিফর্ম পরে ডাক্তারদের দৌড়াদৌড়ি দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমিও ডাক্তার হবো। যেহেতু আমরা দুজনেই সাইন্সের তাই এখানেও শিথিল ভাইয়ের সাহায্য নিলাম। উনিই তো ফরম ফিলাপ করে দিলেন। বুয়েটে পরীক্ষা দিতে গিয়েও উনাকে পেলাম। তখন আমি সদ্য যৌবনে পা দেওয়া এক প্রেমপিপাসু যুবতী। ওই সময়টাতেই সম্ভবত পা পিছলে গিয়েছে। নিজের অনুভূতি সম্পর্কে যখন অবগত হলাম তখন আর পিছু হটার পথ নেই। সমস্ত পুরুষকে অবজ্ঞা করে উনাকে নিয়ে ভেবেছি, ছুতো পেলে দৌড়ে গিয়েছি একপলক দেখার জন্য, কথা বলার জন্য। লজ্জায় লাল হয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারিনি। অপ্রয়োজনে বান্ধবী, সিনিয়রদের ম্যাসেজ সিন না করা আমি বিভিন্ন বাহানায় ম্যাসেজ করেছি, নিজের ছবি দিয়েছি। এরপরেও বুঝলো না? কীভাবে সম্ভব?”

বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ল সুশ্রী। হাতের আজলে মুখ ঢাকলো। আকাশে জ্বলন্ত সুখ তারাটা আচমকাই ঢাকা পড়ল এক খন্ড মেঘের আড়ালে। মিশমি তা দেখলো। মনে হলো বৃষ্টি আসবে। বৃষ্টি আসার আগমনী বার্তায় তার মন ছলাৎ করে ওঠে। আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বড়ো বোনের কান্না আর বিরহের সামনে সেসব বড়োই ফিকে হয়ে উঠল‌। মেয়েটিকে কাঁদতে দিলো। কাঁদলে মন হালকা হয়। সে ছাড়া কার কাছেই বা মনের কথা খুলে বলবে মেয়েটা? কার সামনেই বা ঝরাবে চোখের পানি? অত ভালো বন্ধু আছে কী? যারা আছে তারা নিতান্তই শুভাকাঙ্ক্ষী। বোঝদার মিশমি বোনের মাথায় সস্নেহে হাত বুলাতে লাগলো। যেন আজ দাবার গুটি বদলে গিয়েছে। সুশ্রী নয় বরং মিশমিই যেন আজ বড়ো বোন।
__________

তারপর বহুদিন পেরোলো। বৈশাখ শেষে জৈষ্ঠ্য এলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোদমে শুরু হলো পরীক্ষা। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আড্ডা কমলো। যে যার মতো লেখাপড়ায় ভীষণ ব্যস্ত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একবার রিটেক খেয়েছিল শিথিল। তাতেই দারুণ এক শিক্ষা পেয়েছে সে। মিটে গিয়েছে ফাঁকিবাজির শখ।

স্বাধীন, আরফিন, তুহিন আর শিথিল মিলে গ্ৰুপ স্টাডি করছে। শান্ত আর সজীবের ডিপার্টমেন্ট ভিন্ন হওয়ায় ওরা দুজন হলরুমে বসে পড়ছে। বাকি রুমমেটরা অন্য ঘরে ঘুমাচ্ছে। কয়েল জ্বালানোর পরেও মশার উপদ্রব কিছুতেই কমছে না। লেখাপড়া বাদ দিয়ে এর ওর উপর থেকে মশা মারছে তুহিন। আরফিন আর স্বাধীন মিলে বড়ো এক সাদা কাগজে তৈরি করছে কিছু ডিজাইন। আশেপাশে ছড়িয়ে আছে নষ্ট করা কাগজ।শিথিল বসে একবার ল্যাপটপে কিছু করছে তো আরেকবার মোটা মোটা বইয়ে নজর ঘুরাচ্ছে।

পেন্সিল হাত থেকে ফেলে কৈ মাছের মতো লাফিয়ে উঠল স্বাধীন। পিঠ চুলকাতে চুলকাতে রাগত স্বরে বললো,“এই মশাগুলোর হাতেই হয়তো আমার মরণ হবে। আর ভাল্লাগে না। তোরা পড় আমি নিচ থেকে ঘুরে আসি।”

তুহিন বললো,“নিচে তো আরো বেশি মশা।”

আরফিন মজার ছলে বললো,“জামালপুইরা বিড়ি খাইতে যায়। মশা আবার বিড়ির গন্ধ সহ্য করতে পারে না। কারণ বিড়িতে আছে একশ কয়েলের শক্তি।”

স্বাধীন গর্জে উঠল,“এসব আজাইরা কথা কোত্থেকে শিখেছিস? যা বলবি মেনে নিবো কিন্তু সিগারেট নিয়ে কোনো কটু কথা মানবো না। কী বলিস শিথিল?”

শিথিল সহমত পোষণ করল,“একদম।”

আরফিন ঠাট্টা করে বললো,“আর কিছুতে মিল থাকুক আর না থাকুক দুই বিড়িখোরের এই জায়গায় এসে ঠিকই মিল থাকবে।”

তার কথায় পাত্তা দিলো না দুজন। স্বাধীন নিচে চলে গেলো। কিন্তু শিথিল গেলো না। এই ছাইপাশ খাওয়ার বদঅভ্যাস সে বদলাতে চাইছে। বাধ্য হয়ে দিনে এখন দুয়েকটা খায়। খুব শীঘ্রই এটাও ছেড়ে দিতে পারে।

আবৃত্তির জীবন আবারো আগের মতোই হয়ে গিয়েছে। সেই অন্যের আশ্রয়ে থাকা, দুবেলা কথা শোনা। বাধ্য হয়ে সেজো মামার বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে তাকে। বাবা একবার দেখা করতে এসেছিলেন কিন্তু মোজাম্মেল হোসেন দেখা করতে দেননি। মিথ্যে বলেছেন। শাহিনূর সম্ভবত তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। এছাড়া আর উপায় কী?

মোজাম্মেল হোসেন তখন সকালের নাস্তা করছেন। রুটি আর ঝাল ঝাল লাল মুরগির মাংস। সাথে লেবু চিপতেও ভুললেন না।ভাত হোক কিংবা রুটি দুটোতেই তিনি লেবু চিপে খেতে পছন্দ করেন। শাহিনূর পাশের চেয়ার দখল করে বসে পড়লেন। খেতে খেতে বললেন,“আজ তোমার ভাগ্নিকে দেখতে আসবে।”

মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো ভদ্রলোকের। মাথা তুলে তাকালেন। কিছু মুহূর্ত নিরব থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “দেখতে আসবে মানে?” প্রশ্নটি করেই ফের চট করে বলে উঠলেন,“শিথিলের বাবা? তুমি মেনে নিয়েছো?”

বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নিলেন ভদ্রমহিলা। মুখের খাবার চিবিয়ে বললেন,“প্রশ্নই আসে না।”

“তবে?”

“বিয়ের বয়স হয়েছে। আর কতকাল মামাদের উপর নির্ভর হয়ে থাকবে? মানসম্মান ডুবানোর আগে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই উত্তম। মা এ বিষয়ে মাকসুদার সঙ্গে কথা বলেছিল। পাত্র মাকসুদার জায়ের ছোটো ছেলে। তার বিয়ের জন্যই মেয়ের খোঁজ চলছে। তাই আমিই ওদের আসতে বললাম। দেখে যাক। পছন্দ হলে তো ভালোই।”

“কী করে ছেলে?”

সেই উত্তর দিলেন না তিনি। মোজাম্মেল হোসেন ফের বললেন,“বোনের জায়ের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে কোনো আপত্তি নেই কিন্তু খালাতো বোনের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতেই যত আপত্তি? কেনো নূর? শিথিল, ভাইজান দুজনেই তো রাজি। তবুও এমন করছো কেনো?”

এবারো উত্তর দিলেন না শাহিনূর। চুপ করে খাচ্ছেন। এটা উনার স্বভাব। ভালো করে মিথ্যে বলতে পারেন না তিনি। তাই নিরবতাই শ্রেয়।

বিকেলের দিকে ছেলেপক্ষ এলো। সাথে এলো ছেলের মা, বাবা, বড়ো ভাবি আর শাহিনূরের ছোটো বোন মাকসুদা, বোন জামাই আলামিন। কয়েকদিনের মধ্যেই কীভাবে যে এতকিছু করে ফেললেন শাহিনূর কে জানে? ভাবতেই ভীষণ অবাক হচ্ছেন মোজাম্মেল হোসেন। আবৃত্তি গিয়েছিল কলেজে।গত তিনদিন ধরেই যাচ্ছে। তবে সুশ্রীর সঙ্গে। ফেরার পথে একলা এলেও দুদণ্ড দেরি হলে পড়তে হয় জেরার মুখে। তাকে দেখতে আসার কথাটা সে জেনেছে কলেজ থেকে ফেরার পর। অর্থাৎ দুপুরে। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোতে কখনো কেউ তার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। কারণ সে সকলের জীবনে অপ্রয়োজনীয়। টানা দু’দিন মামীর ভয়ে শিথিলের কল ধরেনি সে। তাও ছেলেটা দমেনি। মিশমির মাধ্যমে কথা বলেছে। এরপর হঠাৎ করেই যোগাযোগ বন্ধ। আবৃত্তি নিজ থেকে দুবার কল দেওয়ার পরেও রিসিভ হয়নি। তার অবজ্ঞার প্রতিশোধ নিচ্ছে নাকি কে জানে?

আজ আর আবৃত্তির সঙ্গে খারাপ আচরণ করলেন না শাহিনূর। সামনে বসিয়ে মিশমিকে দিয়ে সাজালেন তাকে। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,“মাঝেমধ্যে রাগের মাথায় একটু বকাঝকা করেই ফেলি। মিশমিকেও করি। এর থেকে আরো বেশি। আর শাফিনকে তো দুবেলা মারতে হয়। তোমাদের ভালো চাই বলেই এমন করি। তাই খারাপ ধারণা মনে পুষে রেখো না। ছেলে খুব ভালো। নাম সজল। লেখাপড়া বেশি না করলেও নিজের একটা হার্ডওয়্যারের দোকান আছে। তাছাড়া আমার নিজের বোনের জায়ের ছেলে। কোনো সমস্যা হবে না তোমার। সারাক্ষণ চোখে চোখে থাকবে। আমি খবরাখবর নিতে পারবো। একেবারে চিন্তামুক্ত। অতীতে কী হয়েছে না হয়েছে ভুলে যাও। বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো।ওখানে তুমি একটা পরিবার পাবে, মা পাবে, বোনের মতো জা পাবে, আর পাবে বাবা এবং ভরা সংসার।”

আবৃত্তি চুপচাপ শুনলো শুধু। ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভেঙে পড়েছে মেয়েটা। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, এসব তার লাগবে না।কিন্তু বলতে আর পারলো কই? বিমূঢ় দৃষ্টিতে একপলক মিশমির দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। মামীর সঙ্গে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। মিশমি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার এখানে কিছুই করার নেই। বেচারি পড়েছে ফাঁদে। না পারছে নিজের আপন বোনের কষ্ট সহ্য করতে আর না পারছে দুঃখের মধ্যে বড়ো হওয়া মামাতো বোনের কষ্ট সহ্য করতে।

ড্রয়িং রুম ভরা মানুষদের সম্মুখে একেবারে গুটিয়ে গেলো আবৃত্তি। টেনে ধরলো শাহিনূরের আঁচলের এক কোণা। শাহিনূর কিছু বললেন না। অধরে অমায়িক হাসি। বলি দেওয়ার আগেও মানুষের মুখে এমন হাসিই হয়তো থাকে। মুখ থেকে ঝরে পড়ছে আজ মিষ্টি বাক্য। তিনি ধরে আবৃত্তিকে বসালেন ছেলের মা সুলতানার পাশে। মা সুলতানা এবং বড়ো ছেলের বউ মার্জিয়া যেন এতক্ষণ অধীর আগ্রহে বসে ছিল মেয়ে দেখার জন্য। দুজনেই হাসলো। আগাগোড়া ভালো করে দেখে একে অপরকে ইশারা করল। সুলতানা প্রথম জিজ্ঞেস করলেন,“নাম কী, মা?”

“আবৃত্তি।”

“বয়স?”

উত্তরটা শাহিনূর দিলেন,“সবে কুড়িতে পা দিয়েছে।”

“ভালো। তা বড়ো বউ, ছবিতে মেয়েকে একটু বেশিই ফর্সা মনে হয়েছিল না? মনে হয় ইডিট ফিডিট করেছে।”

মার্জিয়া মাথা নাড়াল,“হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। আমরা যে কত মেয়ে বাতিল করেছি! একটামাত্র দেবর আমার। বউ আনলে সুন্দরীই আনবো।”

সুজন ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে আছে আবৃত্তির দিকে। দেখতে স্বাস্থ্যবান, পেটের ভুঁড়িটা শার্টের উপরে ভাসমান। গায়ের রঙ অনুজ্জ্বল। বয়স সাতাশ আটাশ হলেও দেখতে লাগছে পঁয়ত্রিশের। ঠোঁটের উপর মোটা একটা গোঁফ তার। শাহিনূর মনে মনে বিদ্রুপ করলেন, “যেই না একটা ছেলে! তার জন্য আবার সুন্দরী মেয়ে খুঁজছে।”

কিন্তু মুখে বললেন,“শোনেন ভাবি, পৃথিবীতে নিখুঁত মানুষ আপনি পাবেন না। রূপ পেলে গুণ খুঁজে পাবেন না, আর গুণ পেলে রূপ খুঁজে পাবেন না। সংসার রমণীর গুণে হয়, রূপে নয়। আমাদের আবৃত্তি মেয়ে ভালো। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজ একা একা সামলে ফেলতে পারে।লেখাপড়ার দিক থেকে আপনার ছেলের থেকেও এগিয়ে। বাপের বাড়ির কোনো ঝঞ্ঝাট নেই। যেভাবে রাখবেন সেভাবেই থাকবে।”

বলেই ইশারা দিলেন ছোটো বোনকে। মাকসুদা মাথা নাড়িয়ে জায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,“আপা ঠিক বলেছে, ভাবি। এমন মেয়ে লাখে একটা। তাছাড়া বয়সকালে যদি ছেলের বউয়ের সেবা যত্ন না পান তাহলে কীভাবে হবে? সুজনের থেকেও গায়ের রঙ উজ্জ্বল আছে।”

জায়ের সঙ্গে সুলতানার ভীষণ ভাব।মার্জিয়াকেও বড়ো ছেলের বউ হিসেবে তিনিই খুঁজে দিয়েছিলেন। তাই এ কথাও মেনে নিলেন। সংসার সামলানোই তো আসল ব্যাপার। তাই এ বিষয়ে আর কিছু বললেন না।আবৃত্তির হাত দুটো টেনে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন,“মাথার কাপড় সরাও। দেখি, চুলগুলো কত বড়ো?”

আঁতকে উঠল আবৃত্তি। বোঝ হওয়ার পর থেকে বাইরের মানুষের সামনে সে কখনোই মাথায় কাপড় ছাড়া যায়নি। সেখানে চুল খুলবে? হাত দুটো টেনে নিয়ে চেপে ধরলো ওড়না।মার্জিয়া তাল মেলালো,“হ্যাঁ, আগে একটু হেঁটে দেখাও। পা বাঁকা হলে তো আবার সমস্যা।”

মোজাম্মেল হোসেন ওখানেই বসা। চুপ করে এতক্ষণ শুনছিলেন আর দেখছিলেন তাদের কর্মকান্ড। মনে হচ্ছে মেয়ে নয় বরং কিনতে এসেছে কোনো পণ্য। চোখ রাঙিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গমগমে স্বরে ভাগ্নির উদ্দেশ্যে বললেন,“ঘরে যা, আবৃত্তি।”

ভয়ে থিতু হলো শাহিনূরের মন। এমনিতেই স্বামীর উপরে উপরে চলছেন ভদ্রমহিলা। তার উপর এদের কান্ড কারখানা একটু বেশি বেশিই। এখনো পড়ে রয়েছে আগের যুগে। মাকসুদা বোনের পরিস্থিতি বুঝতে পেরে জায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,“আহা, ভাবি! আজকাল এসব চলে না।”

“তাই বলে যাকে তাকে তো আর ছেলের বউ করে নিয়ে যেতে পারি না। একটু দেখতে দাও তো।”

মোজাম্মেল হোসেন ফের ধমকালেন,“তোকে ঘরে যেতে বলেছি না?”

মারজিয়া বলে উঠল,“সেকি! এখনো তো ঠিক করে দেখাই হলো না।”

আবৃত্তি হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কপালের ঘাম মুছে উঠে চলে গেলো ঘরে। মোজাম্মেল হোসেনের এসব পছন্দ নয়। ছেলেটাকেও উনার পছন্দ হয়নি। তার উপর পারিবারিক কার্যকলাপ তো আরো নয়। নেহাৎ শালীর শ্বশুরবাড়ির লোক বলে বেশি কিছু বললেন না। রাগ চেপে বললেন,“একঘর লোকের সামনে একটা মেয়ের সঙ্গে এমন আচরণ করা শোভনীয় নয়।”

সুলতানা গম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলেন,“শোভনীয় নয় মানে? আমাদের বিয়ের সময়ও এসব হয়েছে। তাই বলে আমাদের কী বিয়ে হয়নি? সংসার করছি না?”

শাহিনূর আর মাকসুদা মুহূর্তেই কথা ঘুরিয়ে ফেললেন। মেতে উঠলেন গল্পে। দেখাদেখির পর্ব যখন হয়েছে বিয়েও হতেই হবে। হাতে অত সময় কোথায়? সে জন্যই তো মাকেও এখানে রাখেননি। বৃদ্ধার তো উল্টোপাল্টা কথা বলার বাতিক রয়েছে। মোজাম্মেল হোসেন সেখানে পূর্বের মতো চুপ করে বসে রইলেন। এদের যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলেন।

চলবে _______

#মেঘমেদুর_দিনে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৯]

আঁধার কেটে গিয়ে সূর্যের আলোয় যেমন আলোকিত হয়ে ওঠে ধরণী ঠিক তেমনি সুশ্রীর মনের বিষণ্ণতার মেঘ কেটে গিয়ে ফুটে উঠেছে একফালি আশার আলো। ছেলেপক্ষ সেদিনের মতো বাড়ি ফিরে গেলেও ফোন করে বিয়ের জন্য রাজি হলো তার ছয়দিন পর। মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। না হওয়ার কোনো কারণ অবশ্য নেই। মাকসুদা যা কান পড়া দিয়েছেন না!

এই বিষয় নিয়ে মামা-মামীর মধ্যে একচোট তর্ক বিতর্ক হয়ে গিয়েছে। শাহিনূর নিজের কথায় অনড়। স্বামী আর কোনো ধরণের বিরোধীতা করলে বাড়ি ছাড়ার হুমকিও দিয়েছেন।

আবৃত্তির মনটা আজ একটু বেশিই খারাপ। ক্লাসে মন দিতে পারেনি একটুও। জমা দিতে পারেনি দুদিন আগে দেওয়া এসাইনমেন্ট। বিদিশাকে কোনো মতে এড়িয়ে ক্লাস শেষে নিচে নেমে এলো সে। আজকে তাপমাত্রা বেড়েছে বোধহয়। ঘামের চোটে পরনের বোরকাটাও ভিজে হয়ে গিয়েছে জবজবে। গেট থেকে বেরিয়ে কপালে হাত রেখে আকাশপানে তাকালো। বৃষ্টি আসার সম্ভবনা আপাতত নেই। বা হাতে ললাটের ঘাম মুছে সামনে তাকাতেই চমকালো, থমকালো আবৃত্তি। শিথিল মুচকি হেসে হাত নাড়াল,“হ্যালো, আবৃত্তি!”

কয়েক সেকেন্ড একদৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল আবৃত্তি। শুকনো ঢোক গিলে আশপাশ দেখলো। হঠাৎ করেই তার কান্না পাচ্ছে। অহেতুক, অকারণে। মুখ দিয়ে শ্বাস টেনে নিজেকে সামলে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালালো আবৃত্তি। কোনো মানুষকে একবার মনে জায়গা দিলে তার জন্য বরাবরই তার আবেগ জেগে ওঠে। শিথিলের ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে। ততক্ষণে তার আরো নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে শিথিল। এক হাত পকেটে গুঁজে অপর হাত দিয়ে শার্টের কলার পেছনে ঠেলে দিলো। বললো,“অনেক গরম পড়েছে আজ, তাই না?”

প্রত্যুত্তর করল না আবৃত্তি। শিথিল এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,“কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

অভিমান হয়তো বুঝতে পারলো। মিনমিনে স্বরে বললো,“আমার পরীক্ষা চলছে। তাই কয়েকদিন ধরে যোগাযোগ করতে পারিনি।”

“তো আজ এলেন কেনো? পরীক্ষা শেষ?”

“না, আরো দুটো আছে। আজ এবং কাল বন্ধ। তাই চলে এসেছি। সকালে কল দিয়েছিলাম কিন্তু ধরোনি।”

“এমনি, ধরে আর লাভ কী?”

“লাভ কী মানে? কথা না বললে প্রেমে পড়বে কীভাবে? বিয়ে করবে কীভাবে?”

আবৃত্তি সামনের পথ ধরে হাঁটতে লাগলো। শিথিলও তার পিছু নিলো।হাঁটতে হাঁটতে নিরবতার সমাপ্তি ঘটিয়ে বললো,“ছয়দিন আগে ছেলেপক্ষ আমায় দেখতে এসেছিল। গতকাল রাতে ফোন করে হ্যাঁ বলে দিয়েছে। কাল পরশু পাকা কথা বলতে আসবে। মামী যা তাড়াহুড়ো করছেন তাতে বিয়ে হয়ে যেতেও পারে। ঠিক নেই।”

পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল শিথিল। অধরের হাসিটা নিভে গেলো। মনে হলো বুকে কেউ তীর ছুঁড়ে মেরেছে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,“মানে? বিয়ে ঠিক হয়েছে? কবে? কার সঙ্গে? কে ঠিক করেছে?”

বেশিদূর যেতে পারেনি আবৃত্তি। সেও থামলো। পিছু ফিরে তাকিয়ে জবাব দিলো,“সহজ কথা বিয়ে ঠিক হয়েছে। মানে আবার কী?”

থেমে পুনরায় বললো,“সেজো মামী ঠিক করেছে। মামীর বোনের জায়ের ছেলে। হঠাৎ করেই বলা নেই কওয়া নেই তাদের সামনে নিয়ে আমাকে বসিয়ে দিলো। আজ সকালে শুনি বিয়ে ঠিক।”

“কোন বোন?”

“ছোটো বোন বোধহয়।”

“মাকসুদা আন্টি?”

“হ্যাঁ, চিনেন?”

“না চেনার কী আছে? উনিও তো সম্পর্কে খালা হয়।”

এরপর আবারো দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। শিথিল জিজ্ঞেস করল,“ছেলে কী করে? নাম কী? ডিটেইলস বলো।”

আবৃত্তি মুখ ভার করেই তোতা পাখির মতো সব প্রশ্নের একে একে উত্তর দিলো। শিথিল ঠান্ডা মাথার ছেলে। মাঝেমধ্যে কড়া কড়া অনেক কথাই বলে। তবে সেসব শুনে আজ সে রেগে গেলো। শক্ত হলো চোয়াল। বললো,“আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে যত আপত্তি অথচ বোনের শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে কোনো আপত্তি নেই?”

উদাস কণ্ঠে আবৃত্তি বললো,“আপনি যোগ্য পুরুষ। সম্ভবত নিজের মেয়ের জন্য আগে থেকেই মামী আপনাকে পছন্দ করে রেখেছেন। তাই হয়তো এত আপত্তি। সহজ হিসেব।”

ললাটে চিন্তার ভাঁজ পড়ল শিথিলের। মেয়েটির দিকে ফিরে তাকালো। কণ্ঠে ঝরে পড়ল বিস্ময়,“এতদূর পর্যন্ত চিন্তা করে ফেলেছো? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।”

“কেনো? আমায় বোকা মনে করেছিলেন?”

“তো তুমি বোকা নও বলছো?”

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো আবৃত্তি,“অবশ্যই নই। আল্লাহ বাকি সবার মতো আমাকেও ভাবার জন্য একটা মস্তিষ্ক দিয়েছেন, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়েছেন। দেখার জন্য চোখ দিয়েছেন। বোকা হতে যাবো কেনো?”

“তাহলে এসব মেনে নিচ্ছো কীভাবে? বুদ্ধিমতী হলে তখনি মুখের উপর না করে দিতে।”

“এরপর? যেতাম কোথায়? চলতাম কীভাবে? নোংরা শহরে কোনো অঘটন ঘটে গেলে দায়িত্ব নিতো কে? সব পরিস্থিতিতে নিজের বুদ্ধিমত্তা সবার পক্ষে জাহির করা সম্ভব নয়। আপনি বুঝবেন না এসব। নিজ জায়গা থেকে অন্যের পরিস্থিতি বুঝা সম্ভব নয়।”

“তো পরিস্থিতির জন্য ওই পেট মোটাকে বিয়ে করে নিবে? জড়িয়ে ধরবে কীভাবে? চুমু খেতে গেলে কষ্ট লাগবে না?”

“শিক্ষিত মানুষ হয়ে বর্ণবাদ করছেন? তাহলে আমায় পছন্দ করেছিলেন কেনো?”

“তুমি ওর থেকেও সুন্দর।”

“আপনি ওকে দেখেছেন?”

“হুম, কলেজে থাকতে একবার ছোটো আন্টির বাড়ি গিয়েছিলাম। তখনি দেখা।”

“অথচ ওরা সবার সামনে আমার গায়ের রঙ নিয়ে বিদ্রুপ করেছে। আপনার নানু আর খালাও করেছে।”

শিথিলের ঠোঁটে আবারো রোদের মতো ঝলমলিয়ে উঠল সুন্দর হাসি। কণ্ঠে অগাধ স্নেহ ঢেলে বললো, “তুমি তোমার রঙেই ভীষণ সুন্দর। চোখে কাজল দিলে রূপ যেন তারকামণ্ডলীর মতো ঝলকে ওঠে। আর না দিলে, সমস্যা নেই। তখন অন্যরকম সুন্দর লাগে। মনে হয় এক মায়াপরী। অন্যের কথায় নিজেকে কখনো হীন ভাববে না। আর আমিও কাউকে ছোটো করিনি। আমি শুধু তোমায় বাস্তবতা দেখাচ্ছি।”

“দেখিয়ে লাভ নেই, আর কিছু করার নেই।”

শিথিল এবার ভাবতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর বলে উঠল,“আছে।”

তার উৎফুল্ল মুখশ্রী দেখে ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিলো আবৃত্তি। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,“কী?”

“চলো।”

“কোথায়?”

“তোমার ভোটার আইডি কার্ড আছে না? থাকার তো কথা।”

“আছে।”

“এই মুহূর্তে সঙ্গে আছে?”

“না, বাসায়।”

“মোবাইলে ছবি আছে?”

“আছে।”

“তাতেই হবে, এবার চলো।”

“আহা কোথায়?”

“কাজী অফিসে।”

“কিহ!”

“কোর্ট ম্যারেজ করবো। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এসব মামী, আন্টি ছাড়ো। তাদের সিদ্ধান্ত তারা নিয়ে ঘুমিয়ে থাকুক।”

“মাথা ঠিক আছে?”

“এতদিন ছিল না তবে এখন ঠিক আছে। আগে কোর্ট ম্যারেজ করবো। কাজী অফিসে গিয়ে কথা বলে যা যা প্রয়োজন তখন না হয় দেখে নিবো সেসব। দাঁড়াও বন্ধুদের আগে ম্যাসেজে জানিয়ে নেই। এরপর সোজা তোমার মামাকে জানাবো। তখন বাধ্য হয়ে শরিয়াহ মোতাবেক বিয়ে দিয়ে দিবে।”

“এটা তো সেই পালিয়ে বিয়ের কাতারেই পড়ে! সবাই কী ভাববে? মামী তো আমায়…

তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো শিথিল। পথরোধ করে দাঁড়াল। আবৃত্তির শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। ছলাৎ করে উঠল বুক। এই ছেলেটার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই তার জীবনে কতকিছু যে ঘটছে! কতশত অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে! আবৃত্তির উদ্দেশ্যে কোমল স্বরে বললো,“সবার কথা ছাড়ো, আবৃত্তি। তুমি শুধু আমায় নিয়ে ভাবো। তোমাকে নিয়ে না হয় আমি ভাববো? তুমি শুধু আমায় ভালোবাসো। তোমায় ভালোবাসার জন্য তো আমি আছি।”

আবৃত্তি তাকিয়ে রইল ওই দুটো ঘোলাটে দৃষ্টিতে। দুর্বল হয়ে উঠল দেহ, মন। নাকের পাটাতন ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে শেষ বারের মতো বললো,“আপনার বাবা যদি রাগ করে?”

“করার কথা নয়।”

থামলো শিথিল। কিছু একটা ভেবে ওখান থেকে সরে গিয়ে নির্জন একটি স্থানে তাকে নিয়ে দাঁড়াল। বাবার নাম্বারে কল দিতে দিতে বললো,“তবুও তোমার সংশয় দূর করার জন্য কথা বলে নেই।”

আবৃত্তি চুপচাপ দেখতে লাগলো তার কর্মকান্ড। কল রিসিভ করতে বরাবরের মতোই ‌দেরি করলেন হামিদুল হক। গম্ভীর কণ্ঠস্বর,“সবসময় অসময়ে কল না দিলে ভালো লাগে না? এখন ক্লাস টাইম।”

“জরুরি কথা আছে।”

“সময় আধা মিনিট।”

“বিয়ে করতে যাচ্ছি।”

“বাপের সঙ্গে মশকরা করিস, গর্দভ?”

“আমি সিরিয়াস।”

ওপাশ থেকে পাল্টা জবাব এলো না। ফোনের স্পিকার লাউডে দেওয়া। আবৃত্তির দিকে একপলক তাকিয়ে শিথিল বললো,“আবৃত্তির সঙ্গে কোর্ট ম্যারেজ করতে যাচ্ছি। সত্যি বলছি।”

এবার গমগমে ভারি স্বর ভেসে এলো,“মানসম্মান কিন্তু ডুবাবি না বলে দিচ্ছি। তোর খালার সঙ্গে আমি আবার কথা বলবো।খালুর সঙ্গে আলাদা কথা হয়েছে যদিও।”

“লাভ নেই। উনারা ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। তুমি কথা বলতে বলতে একেবারে বিয়ে হয়ে যাবে। তুমি কী চাও তোমার ছেলে তোমার মতোই দেবদাস হয়ে ঘুরে বেড়াক? তাও তো তোমার দুটো ছেলে-মেয়ে আর একটা নাতি আছে। আমার তো তাও নেই।”

“তোর পরীক্ষা না?”

“আজ বন্ধ। তোমার অনুমতি নিলাম। গোপনে কোর্ট ম্যারেজ করে নিচ্ছি। কাল এসে তুমি আর আঙ্কেল মিলে কাজী অফিসে নিয়ে গিয়ে ধর্মীয় মতে বিয়ে দিয়ে দিও। কারণ ধুমধাম করে বিয়ে করার ইচ্ছে আমার নেই।”

হামিদুল হককে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কাটলো শিথিল। আবৃত্তির উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল, “হয়েছে এবার?‌ শুনেছো?”

“উনি তো হ্যাঁ বলেননি, বকা দিলেন।”

“শিক্ষকদের মাথা সবসময় গরম থাকে। চলো তুমি। ভালো সুযোগ দিচ্ছি, ভালো লাগছে না? এমন ভালো ছেলে পাবে কোথায়? গর্দভ মেয়ে মানুষ।”

ধমক খেয়ে খানিকটা কম্পিত হলো আবৃত্তি। দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর ভয়ের মাঝখানে আটকে আছে মেয়েটা। শিথিল নামক পুরুষটিকে সে খালি হাতে ফেরাতে চায় না। আবার পালিয়ে সুখী হতেও চায় না। আগেরবার পালালেও কোনো ছেলের সঙ্গে সে পালায়নি। বিয়েও তো করেনি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ঘরপোড়া গরু সিদূরে মেঘ দেখলে যে ভয় পায়! নিজেকে সামলাতে আর পারলো না। চোখ দিয়ে ধপ করে বর্ষণ হলো। অতীব কষ্টে দুদিকে মাথা নাড়াল,“পারবো না। আমি আপনাকে চাই কিন্তু এভাবে না। আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

শিথিলের মুখশ্রী হয়ে গেলো ফ্যাকাসে। থম মেরে চেয়ে রইল কতক্ষণ। বললো,“এছাড়া উপায় নেই। পরীক্ষা চলছে। পরে বললেও কিন্তু আসতে পারবো না।”

“আসতে হবে না। যা হচ্ছে হতে দিন।”

“ভেবে বলছো তো? একবার ফিরিয়ে দিলে আর কখনো ফিরে তাকাবো না। আগেই বলে দিয়েছি।”

আবৃত্তির হাত কাঁপছে, বুক কাঁপছে। তার পরিস্থিতি, অনুভূতি কেউ বুঝতে চায় না কেনো? শিথিল দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কিছু একটা ভেবে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “যাও বাসায় যাও। একা যেতে পারবে?”

প্রত্যুত্তর করল না আবৃত্তি। শিথিল রিক্সা ডাকলো। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ঠিকানা বলে তাকে উঠিয়ে দিলো। বললো,“যা ইচ্ছে করো গিয়ে। আমার আর কিছু যায় আসে না। সুযোগ শেষ।”

তারপর সেখানে আর থামলো না সে। পিছু ফিরে তাকালো না। মাথা ব্যথা করছে ভীষণ।
__________

বাসায় ফিরে আবৃত্তির গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। অবশ হয়ে গেলো শরীর। সকালে এক কাপ চা আর একটা পাউরুটি খেয়ে বের হয়েছিল। বাড়ি ফিরে আর খাওয়া হলো না। ঘাম ছুটে গেলো। কী করবে? কীভাবে বিয়েটা আটকাবে? চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে গোসল সেরে বিছানায় শরীর রাখতেই আর উঠার শক্তিটুকু পেলো না যেন। মিশমির আজ নবীন বরণ অনুষ্ঠান। বাড়িতে সে নেই। ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যাও হতে পারে। যে পাড়া বেড়ানো মেয়ে!

বিকেল পর্যন্ত ওভাবেই জ্বর নিয়ে শুয়ে রইল আবৃত্তি। দিনদুনিয়া ভুলে হতে লাগলো ভ্রম। শাফিন খেলতে খেলতে ঘর জুড়ে দৌড়ালো। আয়নার সামনে গিয়ে এলোমেলো করল মিশমির সাজসজ্জার জিনিস। আইসেডো প্যালেট থেকে ফিরোজা আর খয়েরী রঙটা করে দিলো গায়েব। চোরের মতো পালাতে গিয়েও ফিরে এসে আবৃত্তির দিকে ঝুঁকলো। তার কর্মকান্ড দেখে ফেলেনি তো? মিশমি জানলে তুলকালাম বাঁধাবে বাড়িতে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল বিড়বিড়ানি। ছোটো ছোটো হাতে আবৃত্তির হাত স্পর্শ করে ডাকলো,“আবিততি আপু? ঘুমাও তুমি?”

সাড়াশব্দ পেলো না। এবার হাত রাখলো কপালে। সেও এভাবে ঘুমিয়ে থাকলে, সাড়াশব্দ না করলে আম্মু তার কপালে, গলায় হাত রেখে পরীক্ষা করে। আবৃত্তির কপালে হাত রেখে চমকালো শাফিন। একছুটে দৌড়ে গেলো বসার ঘরে। নানুর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে মিতা আপু। আম্মু সোফায় বসে চা খাচ্ছে। সে এসে হাত টেনে ধরে বললো,“আম্মু তাড়াতাড়ি আসো। আবিততি আপুর মনে হয় জ্বর এসেছে।”

ছেলের টানাটানিতে শাহিনূর অর্ধ খাওয়া চায়ের কাপ রেখে দিলেন সেন্টার টেবিলের উপর। ললাটে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। জিজ্ঞেস করলেন,“জ্বর এসেছে? দুপুরে না দেখলাম ঠিক ছিল?”

“তুমি আসো।”

মিতা সেকথা শুনে বলে উঠল,“কলেজ থেকে ফিরেও কিছু খায়নি দেখলাম।”

শাহিনূর ছেলের সঙ্গে ঘরে এলেন। শিয়রে বসে হাত রাখলেন আবৃত্তির কপালে আর গলায়। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। মুখ দিয়ে এখনো বের হচ্ছে অস্ফুট শব্দ। চিন্তিত হলেন ভদ্রমহিলা। ডাকলেন,“আবৃত্তি, শুনছো? অসময়ে জ্বর বাঁধালে কীভাবে?”

উনার প্রশ্নের উত্তর মিললো না। শাফিনকে বললেন, “যা তোর বড়ো আপুকে ডেকে নিয়ে আয়। এই অসুস্থ মানুষ নিয়ে আমি এখন কী করবো?”

শাফিন আবারো ছুটলো। সুশ্রী ঘরেই আছে। বাসায় থাকার ঠিকঠিকানা তার নেই। শাফিনের ডাকে সেও এলো। মায়ের কাছে সমস্ত কথা শুনে ঘর থেকে নিয়ে এলো ফার্স্ট এইড বক্স। তারপর থার্মোমিটারে জ্বর মেপে বললো,“এখনো সেফ জোনে আছে। হঠাৎ জ্বর এলো কীভাবে?”

“জানি না আমি। সকালেও ভালোই দেখেছি। সুস্থ মানুষ কলেজে থেকে ফিরেছে। এইটুকু সময়ে এই অবস্থা কীভাবে হলো? ওদিকে কাল ছেলের বাড়ির লোক আসবে আংটি পরিয়ে বিয়ের পাকা কথা বলতে। কী করি আমি বল তো?”

মায়ের কথায় বিরক্ত হলো সুশ্রী। বললো,“মেয়েটা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে আর তুমি বিয়ে নিয়ে চিন্তা করছো? যাও এখান থেকে। আমি দেখে নিবো। মিতাকে বলো খাবার দিয়ে যেতে। কিছু খাইয়ে ওষুধ দিয়ে দিলেই রাতের মধ্যে জ্বর কমে যাবে কিছুটা।”

মেয়ের কথা শুনলেন শাহিনূর। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে মিতাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন খাবার।সুশ্রী প্রথমে তাকে নিয়ে পানি ঢাললো আবৃত্তির মাথায়। এরপর কোনো মতে চেপে ধরে কিছুটা খাবার খাইয়ে ওষুধ খাওয়ালো। ডাক্তার হিসেবে এতটুকু কর্তব্য তো তার উপরে বর্তায়।

শিথিলের মনটা খারাপ। অধিকাংশ সময়েই তার মন খারাপ থাকে। কখনো উদ্ভট সব চিন্তা করে কখনো বা অন্যের হাহাকার, দুঃখে। তবে আজ মন খারাপের কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজ এই মন খারাপের জন্য দায়ী আবৃত্তি। আবৃত্তির থেকে বিদায় নিয়ে ব্যাচেলর ফ্ল্যাটে আর সে ফিরেনি। রিসিভ করেনি বন্ধুদের কল। ঘুরে বেড়াচ্ছে গন্তব্যহীন পথের বাঁকে। কখনো রিক্সায় চড়ে আবার কখনো বা হেঁটে হেঁটে।এটা তার বহুদিনের অভ্যাস। তবে আজ আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে তার। অনুভূতিতে ফাটল ধরেছে। মনে মনে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।আর কখনো ওই মেয়ের সামনে সে যাবে না। থেকে যাওয়ার অনুরোধও করবে না। যা হওয়ার হোক। ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে সব।

হাঁটতে হাঁটতে মুহাম্মদপুরের সড়কের ফুটপাতে এসে উঠল শিথিল। মুহাম্মদপুরের মহাসড়কের রং সাইডে একটি বাস ঢুকিয়ে দেওয়ায় বেঁধেছে বিশাল জ্যাম। তা নিয়েই চালক আর যাত্রীদের মধ্যে চলছে মহা ঝামেলা। কেউ কেউ বাস থেকে নেমে ফুটপাতের পথ ধরেই ভিড় ঠেলে হাঁটা শুরু করেছে গন্তব্যে। সেই ভিড়ের মধ্যেই আশেপাশে শকুনি দৃষ্টি মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে মলিন পোশাকের এক কিশোর। হালচাল দেখে বুঝার আর বাকি থাকে না যে নিতান্তই ছাপোষা, ধুরন্ধর একজন পকেটমার সে। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কৌশলে বেশ কতক মানিব্যাগ এর ওর পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। তবুও চোখের মণি তার জ্বলজ্বল করছে! মুখশ্রীতে ভয় নেই, ধরা পড়ে যাওয়ার কোনো আশংকা নেই। হাত সাফাইয়ে যেন ভীষণ অভিজ্ঞ সে!

ধীর গতিতে আরো সামনে এগিয়ে গেলো সে। পঞ্চম বারের মতো সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশটা ভালোভাবে দেখে কৌশলে আরেকটি পকেট লুটে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালালো। কিন্তু এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ পেছন থেকে টেনে ধরলো তার মলিন শার্টের কলার। ভিড় ঠেলে একটু ফাঁকা স্থানে টেনে নিয়ে শক্ত হাতে গালে বসিয়ে দিলো থাপ্পড়।

মুহূর্তেই হট্টগোল থেমে গেলো। থেমে গেলো পথচারী। যানজটে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে যাত্রীরাও দেখতে লাগলো সেসব ঘটনা। তখনি উৎসুক জনতার ভিড় থেকে একজন এগিয়ে এলেন। ভারি উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“কী করেছে? কী করেছে? এভাবে ছেলেটাকে মারছেন কেনো?”

মারতে থাকা শিথিল থামলো না। চোখেমুখে তার রাগের পাহাড় জমেছে। সকল উদাসীনতা, রাগ, ক্ষোভ যেন আজ এই চোর ছেলেটার উপরেই ঝাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক হাতে চুলের মুঠি ধরে অপর হাতে কিশোরের পকেট থেকে চুরি করা মানিব্যাগগুলো বের করল। কিছুক্ষণ আগে তার পকেটেও হাত ঢুকিয়েছে। গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো,“এমনি এমনি কেউ কাউকে মারে? ভিড়ের মধ্যে এর ওর পকেট মারছিল শ্লা।”

হইহই রইরই পড়ে গেলো পথচারীদের মধ্যে। নিজেদের পকেট ঠিক আছে কিনা দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সাথে ভিড় থেকে ভেসে আসতে লাগলো একে অপরের কথপোকথন,“এই এলাকা এমনই। দিনদুপুরে ডাকাতি আর ছিনতাই হয়। সেখানে চুরি তো মামুলি ব্যাপার। প্রশাসন কেনো যে বিষয়টা তদারকি করছে না? সব ভোগান্তি শুধু আমাদের।”

সকলের আহাজারিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শিথিল। এই বাঙালি জাতির উন্নতি আর কখনো হবে বলে মনে হয় না তার। কোথায় এসে সাহায্য করবে! ছেলেটিকে ধরে থানায় নিয়ে গিয়ে বয়ান দিবে, সমস্যার কথা জানাবে।তা না, শুধু সমালোচনা আর আহাজারি। বিরক্ত হয়ে নিজের মানিব্যাগটা নিয়ে বাকি মানিব্যাগগুলো কিশোরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভিড় ঠেলে রাস্তা পার হয়ে চলে এলো সে। এই বাঙালি জাতিকে সাহায্য করে লাভ নেই। এরা সাহায্যকারীর মূল্যায়ন করতে জানে না। এদের কাজ শুধু সমালোচনা।

কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই সঙ্গে থাকা মোবাইলটি বেজে উঠল। হাঁটতে হাঁটতে কল রিসিভ করল শিথিল। বাবাকে অবজ্ঞা করার ক্ষমতা যে তার নেই। রিসিভ করে সালাম দিলো। হামিদুল হক সালামের জবাব নিলেন খুবই নরম স্বরে। মোবাইলে এত নরম স্বরে ছেলের সঙ্গে কখনো তিনি কথা বলেছেন বলে মনে হয় না। তবে আজ বলছেন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন,“কোথায় তুই?”

“মুহাম্মদপুর।”

“রাতের বেলা ওখানে কী করিস, বাপ?”

“তেমন কিছু না।”

“মাথা ঠান্ডা হয়েছে?”

“হ্যাঁ, ঠান্ডাই।”

“বিয়ে টিয়ে সত্যি সত্যি করে ফেলিসনি তো আবার?”

“চেয়েছিলাম কিন্তু সে এভাবে রাজি হয়নি।”

“চিন্তা করিস না। আমি আবার ওখানে যাবো। বুঝিয়ে বলবো।”

“উহুম, তুমি আর যাবে না।”

হামিদুল হক অবাক হলেন বোধহয়। প্রশ্ন করলেন, “সেকি কেনো? তোর তো মেয়েটাকে পছন্দ।”

“একবার যখন ও বাড়ি থেকে তোমায় ফিরিয়ে দিয়েছে তাহলে আবার কেনো যাবে? আর যাবে না বলে দিচ্ছি। গেলে তোমার সঙ্গে কথা বন্ধ। যা হচ্ছে হোক। আমি না হয় ভুলে যাবো।”

ছেলের কথার ধরণেই মনের পরিস্থিতি বুঝে গেলেন ভদ্রলোক। প্রসঙ্গ বদলে কণ্ঠে স্নেহ ঢেলে জিজ্ঞেস করলেন,“আর কয়টা পরীক্ষা বাকি আছে?”

“দুইটা।”

“আচ্ছা, বাসায় ফিরে যা। রাতবিরেতে এভাবে পথে ঘাটে ঘুরতে নেই। টাকা আছে সঙ্গে? লাগলে বলবি কিন্তু। পাঠিয়ে দিবো। পরীক্ষা শেষ হলে চুপচাপ বাড়ি চলে আসবি। অনেকদিন গ্ৰামে যাওয়া হয় না। কিছু কাজ আছে। তুই থাকলে ভালো হয়।”

“আচ্ছা, তুমি চিন্তা করো না। নিজের যত্ন নিও। আল্লাহ হাফেজ।”—বলে কল কাটলো শিথিল।হাতের ইশারায় থামালো একটি রিক্সা।
________

রাতের দিকে জ্ঞান ফিরে এলো আবৃত্তির। নিজের এমন অবস্থা দেখে ভারি অবাক হলো সে। অধীর কষ্টে হেলান দিয়ে বসলো। মিশমি অবশ্য এখানেই এতক্ষণ বসা ছিল।তাকে উঠতে দেখেই দৌড়ে গিয়ে খবর দিয়ে এলো বাবাকে। মোজাম্মেল হোসেন একবার এসে দেখে গিয়েছিলেন তাকে। মেয়েকে বলে গিয়েছিলেন, জ্ঞান ফিরলে যেন উনাকে ডেকে দেয়। মিশমি বাবাকে খবর দিয়ে ঘরে এলো। জিজ্ঞেস করল,“এখন কেমন লাগছে আবৃত্তি আপু? হঠাৎ এমন জ্বর বাঁধালে কী করে?”

প্রত্যুত্তর করল না আবৃত্তি। বেছে নিলো মৌনতা। এর মধ্যে মোজাম্মেল হোসেন চলে এলেন। ভেতরে প্রবেশ করার আগে কাশলেন। মামাকে দেখে ঠিক হয়ে বসলো আবৃত্তি। ভয়ে চুপসে গেলো। নত করে নিলো দৃষ্টি। মোজাম্মেল হোসেন অবশ্য অসুস্থতার ব্যাপারে তাকে কিছু বললেন না। মিশমিকে বাইরে যেতে বলে চেয়ার টেনে বসলেন ভাগ্নির মুখোমুখি। সর্বপ্রথম জিজ্ঞেস করলেন,“এখন কেমন লাগছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

এরপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। ভেবেচিন্তে জিজ্ঞেস করলেন,“সত্যি করে বল, সজলকে তোর পছন্দ হয়েছে?”

দুদিকে মাথা নাড়াল আবৃত্তি,“না।”

“বিয়েতে রাজি?”

“না।”

“শিথিলকে পছন্দ?”

এখানে এসেই আবারো ভয়ে চুপসে গেলো মেয়েটা। মোজাম্মেল হোসেন অধৈর্য হয়ে বললেন,“এভাবে চুপ করে থাকবি না। নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে শেখ। আমি তোর মামীর মতো রাগারাগী করবো না। বল, শিথিলকে পছন্দ?”

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল আবৃত্তি। কণ্ঠ ভেঙে গিয়েছে। নাক টেনে বললো,“হ্যাঁ।”

“বিয়ে করবি ওকে?”

ক্রন্দনরত দৃষ্টিতে মামার দিকে একপলক তাকিয়ে উপরনিচ মাথা নাড়াল সে।

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)