#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(১১)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
এর মাঝে কেটে যায় অনেকগুলো দিন। সায়ান ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসে, কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে আর একবারও ভাবতে চায় না। সে নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে, যেন অতীতের ঘটনা গুলো তাকে আর না তাড়িয়ে বেড়ায়। তবে মাঝেমধ্যে নাবিহার কথা মনে হলে আল্লাহ তাআলা বিধিনিষেধের জন্য মন থেকে মুছে দেয় সে।
অন্যদিকে, ফারিস অনুভব করতে থাকে বোনের আচরণের পরিবর্তন। তার মনে প্রশ্ন জাগে—হঠাৎ করে কেন সে বদলে গেল? কেনই বা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হলো তাকে? উত্তর খুঁজতে সে একরকম উঠে-পড়ে লাগে। বোনের জীবনে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের রহস্য উদঘাটন করাই যেন তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
একদিন ফারিস তার এক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারে যে, কোনো এক অজানা কারণে সায়ানের বিয়েটা হয়নি। খবরটা শুনে তার মনে একধরনের অস্বস্তি কাজ করে—কেনো হলো না সেই বিয়ে? এর পেছনে কি কোনো বিশেষ কারণ আছে?
মনের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। কোনোভাবেই সে বিষয়টা এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই আর দেরি না করে সে সায়ানকে কল দেয়। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সায়ানের ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
“হ্যালো?”
ফারিস সরাসরি বলেই ফেলে,
“তোর সঙ্গে দেখা করতে চাই। সময় কবে দিতে পারবি?”
সায়ান কিছুক্ষণ চুপ থাকে, যেন কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তারপর গম্ভীর স্বরে উত্তর দেয়,
“কাল সন্ধ্যায় কফি শপে আসতে পারবি?”
ফারিস রাজি হয়ে যায়। সে ঠিক করে নেয়, এই দেখা হওয়ার পর সায়ানের কাছ থেকে সব সত্য জানতে হবে—কোনো কিছুই আর ধোঁয়াশায় রাখবে না।
.
.
এরপর ফারিস নির্দিষ্ট সময়ে কফি শপে যায়। সায়ান সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, চোখের নিচে কালি জমেছে। ফারিস লক্ষ্য করে, সায়ান একসময় প্রাণোচ্ছল থাকলেও এখন যেন একেবারে বদলে গেছে—একটা চাপা বিষণ্নতা তাকে গ্রাস করে রেখেছে।
“কেমন আছিস?”
ফারিস বসেই সরাসরি প্রশ্ন করে।
সায়ান একপাশে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই?”
“তোর বিয়েটা হলো না কেন?”
ফারিস কোনো ভূমিকা না করেই মূল প্রসঙ্গে চলে আসে।
সায়ান মৃদু হাসে, তবু সেই হাসির মধ্যে গভীর কষ্ট লুকিয়ে থাকে। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“সব বিয়েই কি শেষ পর্যন্ত হয়, ফারিস?”
“মানে?”
ফারিস ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
সায়ান এবার ফারিসের দিকে তাকিয়ে বলে,
“যে মেয়েটাকে আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, সে নিজেই বিয়েটা করবে না বললো।”
ফারিস অবাক হয়ে বলল,
“কেন? বিয়ে না করার কারণ কি বলেছিল?”
সায়ান কফির কাপের গরম ধোঁয়ায় দৃষ্টি রেখে বলে, “হুম বলেছে।”
“কি সেই কারণ? বলা যায়?”
“বলতে পারছি না মাফ করিস।”
ফারিস এবার আরও গভীরভাবে ভাবতে শুরু করে। তার বোনও তো হঠাৎ করেই বদলে গিয়েছিল, বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে হোস্টেলে থাকতে শুরু করে। তবে কি এই দুই ঘটনার মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে?
তার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে!
ফারিস জানে, সায়ানের কাছ থেকে আর কিছু জানা সম্ভব নয়। তাই এই প্রসঙ্গ আর না বাড়িয়ে সে অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকে। কিছুক্ষণ অফ-টপিক আলোচনার পর তারা কফি শপ থেকে বের হয়ে যায়। ফারিস বাড়ি ফিরে আসে, কিন্তু মনের কোণে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি রয়ে যায়।
কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায়, নাদিয়া ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে ফারিসের কাছে এসে বসল। গম্ভীর মুখে সে বলল, “আচ্ছা, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছো তুমি?”
ফারিস তখন নিজের চুলে বিলি কাটছিল। চোখ বন্ধ রেখেই জবাব দিল,
“কোন ব্যাপারের কথা বলছো?”
নাদিয়া একটু সামনে ঝুঁকে বলল,
“নাবির শিক্ষিকা তাসনিয়া ম্যাডামের কথা বলছি। নাবির সঙ্গে তার দারুণ সম্পর্ক ছিল, কিন্তু যেদিন থেকে উনার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সেদিন থেকেই ওদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ দেখছি না। এটা কি স্বাভাবিক?”
ফারিস ভ্রু কুঁচকে নাদিয়ার দিকে তাকাল।
“হয়তো বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এখন আর সময় পান না, তাই কথাবার্তা কম হচ্ছে।”
নাদিয়া মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না, আমার কিন্তু ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তাছাড়া, নাবিও কিছু বলতে চায় না, যেন ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যায়।”
ফারিস একটু ভাবল, তারপর বলল,
“তাহলে তুমি একবার তাসনিয়া ম্যাডামের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখো। যদি কিছু জানার থাকে, নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে।”
নাদিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে হালকা গলায় বলল, “হ্যাঁ, আমি কথা বলব। আমার মনে হচ্ছে, এখানে কিছু একটা আছে যা আমরা এখনো জানি না।”
নাদিয়া শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে তাসনিয়া ম্যাডামের ফোন নম্বর সংগ্রহ করল। একটু দ্বিধা নিয়েই সে নম্বরটি ডায়াল করল। রিং বাজতেই সঙ্গে সঙ্গে ফোনটি রিসিভ হয়। মনে হলো, ফোনটা তার হাতেই ছিল।
“হ্যালো?” তাসনিয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে।
“আসসালামু আলাইকুম, ম্যাডাম, আমি নাবিহার ভাবি বলছি।
তাসনিয়া চিনতে পারলো। কুশল বিনিময়ের পর জিজ্ঞাসা করলো,
“নাবিহা কেমন আছে?”
নাদিয়া একটু নীরব থেকে বলল,
“ও ভালো নেই, ম্যাডাম। ওর কিছু হয়েছে, কিন্তু আমরা কেউ বুঝতে পারছি না। জিজ্ঞাসা করেও কোনো উত্তর পাচ্ছি না। আপনি কি কিছু জানেন? যদি কিছু জানেন, দয়া করে বলুন। এতে আমাদের অনেক উপকার হবে।”
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর তাসনিয়া গভীর শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করলেন। একে একে সবটা বলে দিলেন।
সব শুনে নাদিয়া হতবাক হয়ে গেল। ফোন হাতে নিয়েই স্থির হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। মনে হলো, মাথার ভেতর ঝড় বইছে। বাস্তবতা যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেছে তার সামনে…
ফোন কেটে যাওয়ার পরও নাদিয়া কিছুক্ষণ নিথর হয়ে বসে রইল। তাসনিয়ার বলা প্রতিটি শব্দ যেন এখনো কানে বাজছে। ধীরে ধীরে সে ফারিসের দিকে তাকাল।
ফারিস তার চোখের ভাষা পড়তে পেরে ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
“কী বলল তাসনিয়া ম্যাডাম?”
নাদিয়া গভীর শ্বাস নিয়ে সবটা বলল। প্রতিটি কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফারিসের চোখেমুখে অবিশ্বাস আর ক্রো°ধ একসঙ্গে ফুটে উঠল। সে হতভম্ব হয়ে বলল,
“এত বড় ব্যাপার সায়ান জানত! তবু সে আমাকে কিছুই বলেনি?”
তার কণ্ঠ ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠল, চোখে জ্বলছিল ক্ষো°ভ। “আমাকে কেন কিছু জানালো না? আমি কি ওর বন্ধু না?”
ফারিসের গলার স্বর ক্রমেই উচ্চ হয়ে যাচ্ছিল, রা°গে তার মুষ্টি শ°ক্ত হয়ে এলো। মাথার ভেতর যেন আ°গুন জ্বলছে।
নাদিয়া দ্রুত তার হাত চেপে ধরল। শান্ত কণ্ঠে বলল, “দয়া করে শান্ত হও। আমার মনে হয়, সায়ান ভাই তোমার ভালোর কথা ভেবেই বলেননি। যদি তুমি তার কাছ থেকে এসব জানতে, তুমি কীভাবে নেয়ার চেষ্টা করতে? তুমি কি তখন শান্ত থাকতে? আমি জানি, তখনই তোমাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরত।”
ফারিস নাদিয়ার কথায় কিছুটা থমকে গেল। সত্যিই তো! সে যদি সায়ানের কাছ থেকে এটা জানতে পারত, তাহলে কি স্বাভাবিক থাকতে পারত? হয়তো না… কিন্তু তবুও, সায়ানের উপর অভিমান হচ্ছিল তার।
সে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথার ভেতর একরাশ চিন্তা আর অনুভূতি গুছিয়ে নিতে পারছিল না। নাদিয়া তার দিকে সান্ত্বনাদায়ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, যেন বলতে চাইছে— “এই মুহূর্তে রাগ নয়, বরং বোঝার চেষ্টা করো।”
.
.
একদিন ফারিস সায়ানের সঙ্গে দেখা করে হাসিমুখে বলল,
“আমার বোনকে বিয়ে করবি, বন্ধু?”
তার কণ্ঠে ছিল মিশ্র আবেগ—অর্ধেক মজা, অর্ধেক সিরিয়াস। সায়ান প্রথমে চমকে গেল, তারপর একটু হেসে বলল,
“হঠাৎ এ কথা কেন, ফারিস?”
ফারিস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“কেন, তুই কি আমার ভগ্নিপতি হতে পারিস না?”
সায়ান এবার গম্ভীর হয়ে গেল। কথাটা প্রথমে মজা হিসেবে নিলেও, এর পেছনে যে গভীর কোনো অর্থ লুকিয়ে আছে, তা সে ভালোভাবেই জানে। তবুও তার মনে এক ধরনের দ্বিধা কাজ করল—এটা কি সত্যিই এক সহজ প্রশ্ন, নাকি ফারিসের মনে কিছু পরিকল্পনা আছে?
সায়ান কে চুপ করে বসে থাকতে দেখে ফারিস চিন্তিত হয়ে পড়ে। বলে,
” আমার বোনকে কি তোর পছন্দ নয়? তুই পর্দাশীলা মেয়ে পছন্দ করিস নিশ্চয়ই। জানিস আমার বোনটা না হঠাৎ খুব পরিবর্তন হয়ে গেছে। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিধিনিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করে সর্বদা।”
সায়ান এবার মুখ খুলল, বলল,
” প্লিজ আর কিছু বলিস না। আমি মাকে তোদের বাসায় যেতে বলবো। সবকিছু এরেঞ্জ কর।”
এরপর ফারিস খুশি হয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে। এবং সায়ান এর সাথে পরিকল্পনা করে নাবিহাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার।…..
#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।