মেঘলা দিনের রোদ্দুর পর্ব-১২

0
179

#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(১২)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সায়ান হঠাৎ চমকে যায়। নাবিহার ডুকরে কেঁদে ওঠা দেখে সে বিস্মিত হয়। কী হয়েছে বুঝতে না পেরে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে যায়। নাবিহার কান্না থামার নাম নেই। গভীর উদ্বেগে সায়ান আরেকটু কাছে গিয়ে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কাঁদছো কেন, নাবিহা?”

নাবিহা এক হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেলে। কিন্তু তার কণ্ঠে এখনও কান্নার সুর লেগে আছে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে ধীরে ধীরে বলে,
“আমি খুব বড় একটা অন্যায় করে ফেলেছি। না বুঝেই তাসনিয়া আপুর সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আপনার সাথে আপুর বিয়ে হয়েছে… তাই ইচ্ছে করেই দূরে সরে গিয়েছিলাম। অথচ আপু আমার জন্য আপনাকে বিয়ে করলো না, ভেঙ্গে দিল বিয়েটা। নিজের অন্ধকার ভবিষ্যৎ এর কথা একবার‌ও চিন্তা করলো না। আমি কীভাবে এতটা ভুল বুঝলাম?”

বুকের ভেতর একরাশ যন্ত্রণা জমে থাকা কান্না নাবিহার কণ্ঠে ফুটে ওঠে। অপরাধবোধে তার চোখ আবারও ভিজে ওঠে। সায়ান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণের জন্য কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায় না।

সায়ান কিছুক্ষণ নীরবে নাবিহার কথা শোনে। তার চোখেমুখে গভীর চিন্তার ছাপ পড়ে। এরপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলে,
“তাসনিয়ার সঙ্গে আমার বিয়েটা সত্যি হওয়ার কথা ছিল, নাবিহা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে নিজেই সিদ্ধান্ত বদলেছিল।”

নাবিহা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।
“আপু নিজেই বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছিল?”

সায়ান ম্লান হেসে মাথা ঝাঁকায়।
“হ্যাঁ। আমি তখনও জানতাম না কেন সে এমন করল। আমরা দু’জনই পরিবারের পছন্দে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন আগে তাসনিয়া নিজেই জানিয়ে দিল যে সে এই বিয়েটা করতে পারবে না। কারণ জানতে চাইলে তোমার কথা বলে।”

নাবিহা হতবাক হয়ে যায়। এতদিন সে যা ভেবে এসেছে, তার একটুও সত্যি নয়? তার মনে একরাশ অপরাধবোধ জমতে থাকে।
“আমি তো ভেবেছিলাম আপনাদের বিয়ে হয়ে গেছে… সেই ভুল ধারণা নিয়েই আপুর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আপু হয়তো ভেবেছে আমি ওর উপর রাগ করেছি! এখন কীভাবে ওর সামনে যাবো?”

সায়ান গভীরভাবে নাবিহার দিকে তাকায়। তার কণ্ঠে অনুরণিত হয় মৃদু সান্ত্বনা।
“উনি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে, নাবিহা। তুমি উনার ছোট বোনের মতো ছিলে। উনি যদি সত্যিই তোমার এই ভুল বোঝাবুঝি জানে, তাহলে নিশ্চয়ই তোমাকে ক্ষমা করে দেবে। সম্পর্কগুলো ভুলের কারণে ছিন্ন হয় না, কিন্তু ভুল স্বীকার করে না নিলে দূরত্ব তৈরি হয়।”

নাবিহা চোখের পানি মুছে ফেলে। সত্যিই, এতদিন এক ভুল ধারণার জন্য সে কত বড় অন্যায় করে ফেলেছে! এখন আর দেরি করা যাবে না। সে দ্রুত মোবাইল বের করে তাসনিয়া আপুর নাম্বার খুঁজতে থাকে…

কিন্তু আফসোস নাম্বার সেই কবেই ফোন থেকে ডিলিট করে দিয়েছিল নাবিহা। এখন মনে পড়ে আরো কান্না করতে ইচ্ছা করছে তার।

নাবিহা হতাশ চোখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তালিকায় শতবার খুঁজেও তাসনিয়া আপুর নাম খুঁজে পায় না। এক মুহূর্তের জন্য মনে পড়ে— সে তো সেই কবে রাগের মাথায় আপুর নাম্বার ডিলিট করে দিয়েছিল! এখন কী করবে? কীভাবে কথা বলবে আপুর সাথে?

তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। আরও বেশি কান্না পেতে থাকে। যদি আপুর নাম্বার মুছেই না ফেলত, তাহলে এতদিন পর হলেও ক্ষমা চাওয়ার একটা উপায় থাকত। কিন্তু এখন?

সায়ান নাবিহার ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, সে আবার ভেঙে পড়ছে। নরম গলায় জিজ্ঞেস করে,
“কি হলো? নাম্বার পাচ্ছো না?”

নাবিহা ফোঁপাতে ফোঁপাতে মাথা নাড়ে।
“আমি… আমি তো রাগের মাথায় আপুর নাম্বার ডিলিট করে দিয়েছিলাম! এখন তো ওর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায়ই নেই!”

সায়ান এক মুহূর্ত নীরব থাকে। তারপর শান্ত স্বরে বলে,
“তুমি সত্যিই চাইলে তাসনিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে, নাবিহা। সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার জন্য যেমন ভুল বোঝাবুঝিই যথেষ্ট, সম্পর্ক আবার জোড়া লাগানোর জন্যও আন্তরিকতা আর চেষ্টা থাকলেই হয়।”

নাবিহা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়,
“কিন্তু আমি কীভাবে আপুকে খুঁজব? আপুদের বাসায় ও তো যেতে পারবো না। নিশ্চয়ই আপুর বাবা মা সবকিছু যেনে গেছেন এতো দিনে। আমি তো তাদের সামনে মাথা তুলে তাকাতে পারবো না।”

সায়ান একটু হাসে।
“উনি তো আর হারিয়ে যায়নি, নাবিহা।”

নাবিহার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সত্যিই তো! সে কেন এতটা হতাশ হয়ে পড়েছিল? যদি আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইতে চায়, তবে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো উপায় বের হবে।

সে গভীর শ্বাস নিয়ে বলে,
“আপনার কাছে কি আপুর নাম্বার আছে?”

সায়ান ফোন বের করে নম্বর খুঁজে দেখে। তারপর মাথা নাড়ে,
“না, আমার কাছেও নেই। মায়ের কাছে উনার পরিবারের ফোন নাম্বার থাকার কথা। তুমি চাইলেই মায়ের কাছ থেকে নাম্বার নিতে পারো। চাইলে আমিও সাহায্য করতে পারি।”

নাবিহার মুখে খানিকটা আশা ফুটে ওঠে।
“তাহলে দয়া করে একটু খোঁজ নিয়ে দেবেন? আমি আর দেরি করতে চাই না। আপুর কাছে নিজের ভুল স্বীকার করতে চাই।”

সায়ান মাথা নাড়ে,
“ঠিক আছে, আমি খুঁজে বের করব। তবে তার আগে তুমি একবার ভেবে নাও— শুধু ভুল স্বীকারই নয়, উনার কাছে তোমাকে সত্যিকারের ভালোবাসা আর আন্তরিকতাও দেখাতে হবে। সম্পর্ক শুধু দুঃখ প্রকাশেই মজবুত হয় না, বরং বিশ্বাস আর যত্নেও গড়ে ওঠে। তুমি প্রস্তুত তো?”

নাবিহা দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
“আমি প্রস্তুত। এবার আমাদের সম্পর্কটা আর ভুল বোঝাবুঝির কারণে হারিয়ে যেতে দেব না।”

সায়ান প্রশান্ত মনে হাসে। আর নাবিহা মনে মনে দোয়া করতে থাকে— যেন আল্লাহ তার ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ দেন, যেন আপুর হৃদয়ে তার জন্য জায়গা এখনও অবশিষ্ট থাকে…
.
.
এশার নামাজ শেষ করে সায়ান ও নাবিহা শান্ত মনে জায়নামাজ গুটিয়ে রাখে। নামাজের পর তাদের মন অনেকটাই হালকা অনুভব করে। যেন মনের ওপর জমে থাকা ভার কিছুটা কমে গেছে। নাবিহা হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করে। এবং শুকরিয়া আদায় করে, আজকের এই পাওয়া শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলা জন্য। তিনি যদি না চাইতেন তাহলে কখনোই নাবিহা এই সুন্দর নতুন জীবন পেত না।

সায়ান ধীর পদক্ষেপে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে রাতের নরম বাতাস বইছে। মনে এক ধরনের প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে।

ঠিক তখনই সানজিদা দরজায় কড়া নাড়ে। তারপর অনুমতি পেয়ে রুমে এসে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“তোমরা নামাজ শেষ করেছ? চলো, এবার খেতে এসো!”

সায়ান নরম হেসে বলে,
“হ্যাঁ, আসছি।”

নাবিহাও মাথা কাত করে সম্মতি জানায়। সারাদিনের নানা ঘটনায় মন এতটাই ব্যস্ত ছিল যে, খাওয়ার কথা একদমই মনে ছিল না!

তারপর ধীরে ধীরে সায়ানের সঙ্গে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যায় নাবিহা।
.
.
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সায়ান ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। তার চলার পথ অনুসরণ করে নাবিহাও নিঃশব্দে পেছন পেছন হাঁটতে থাকে।

কিন্তু যতই সামনে এগোচ্ছে, ততই যেন লজ্জা রাঙা প্রজাপতি গুলো তার বুকের ভেতর কাঁপতে কাঁপতে মিইয়ে পড়ছে।

পা দুটো এগোচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মন যেন দ্বিধায় দুলছে। কিছু বলতে চায়, আবার কেমন যেন সংকোচে জড়িয়ে যাচ্ছে।

সায়ান দরজার কাছে এসে একটু থামে। অনুভব করে, নাবিহা এখনও তার পিছু পিছু আসছে। একবার পেছনে ফিরে তাকায়। চোখে প্রশ্ন—
“কিছু বলবে, নাবিহা?”

নাবিহা চমকে ওঠে, মুখ নিচু করে ফেলে। তারপরও ঠোঁট কাঁপে, যেন বলতে চায় কিছু… কিন্তু শব্দগুলো আটকে যায় বুকের ভেতর!

সায়ান বুঝতে পারে, নাবিহা নতুন পরিবেশে কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করছে। এটাও স্বাভাবিক, কারণ আজ প্রথমবারের মতো তারা এক‌ই রুমে থাকবে। একটু অস্বস্তি তো লাগবেই। তাই নাবিহার বিব্রত ভাব দেখে সে আর কিছু বলল না।

নাবিহা ধীরে ধীরে রুমে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকায়। সবকিছু যেন তার কাছে আবারো নতুন মনে হচ্ছে। সায়ান নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল, যেন কোনো অপ্রিয় পরিস্থিতি তৈরি না হয়।

নাবিহা খাটের এক পাশে শোয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল। লজ্জা ও অস্বস্তিতে তার সমস্ত শরীর যেন কুঁকড়ে আসছে। ঠিক তখনই সায়ানের নরম কণ্ঠ শোনা গেল,
“লাইট জ্বালিয়ে রাখবো? নাকি…”

নাবিহা দ্রুত বলে উঠল,
“বন্ধ করে দিন।”

তার কণ্ঠের তাড়াহুড়ো স্পষ্ট। সায়ান এক মুহূর্ত চুপ থেকে লাইটের সুইচ বন্ধ করে দিল। ঘর মুহূর্তেই অন্ধকারে ঢেকে গেল।

নাবিহা মনে মনে ভাবল,
“লাইট জ্বালিয়ে রাখলে তো আমি আরও লজ্জায় শেষ হয়ে যাব! তার চেয়ে এই অন্ধকারই ভালো… অন্তত নিজের লাল হয়ে যাওয়া মুখটা উনার চোখে পড়বে না।”

অন্ধকার ঘরের নিস্তব্ধতায় শুধু দু’জনের নরম শ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যায়। এক নতুন সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হলো… অচেনা এক অনুভূতির সঙ্গে।…

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।