মেঘলা দিনের রোদ্দুর পর্ব-০৩

0
499

#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(৩)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

বারান্দায় বসে গরম কফির মগ হাতে নিয়ে সায়ান ভাবছে, রাতের আকাশে তাকালে যেন এক অন্য জগতের দরজা খুলে যায়। আকাশের গাঢ় নীল চাদরে অসংখ্য তারার ঝিকিমিকি আলো যেন হীরের গয়নার মতো ঝলমল করছে। চাঁদটি আজ পূর্ণিমার—একদম গোল, যেন কেউ রূপার থালাটা আকাশে তুলে ধরেছে। তার আলো চারপাশের প্রকৃতিকে স্নিগ্ধ, মৃদু এক উজ্জ্বলতায় ভরিয়ে দিয়েছে। বাতাসে হালকা শীতের আমেজ, গায়ে যেন মৃদু স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে। দূরে কোনো পাখির ক্ষীণ ডাক শোনা যাচ্ছে, আর একপাশে কফির উষ্ণ ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে এই রাতের ঠান্ডা বাতাসে। যেন সময় থেমে গেছে, এই মুহূর্তটা শুধু সায়ান, আকাশের আর নির্জনতার।

ফারিসের কথামতো, বিয়ের কার্ড সায়ানের কাছে পৌঁছে যায়। সায়ান যখন কার্ডটি দেখে, তার মন আনন্দে ভরে ওঠে। কারণ, সে জানে যে, হারাম সম্পর্কে থাকার চেয়ে হালাল উপায়ে বিয়ে করা অনেক উত্তম। এই সিদ্ধান্তে সে খুশি হয়, কারণ বিয়ে করা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ আদেশ, যা মানুষের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।

বিয়েতে ফারিস এর সব বন্ধুরা আসলেও সায়ান আসেনি দেখে ফারিস ভেবে নেয় সায়ান তাকে হিংসা করে, সে জন্য বিয়েতে আসেনি। এদিকে সায়ান ভাবে এখনকার বিয়ে বাড়ীতে ছেলে মেয়েদের অবাধে মেলামেশা চলে। চাইলেও নিজের দৃষ্টি নিচে রাখা যায় না। এরচেয়ে না যাওয়া ভালো।ফারিস কে না হয় পরে বুঝিয়ে বলবে। কফি পান করতে করতে সে সব ও ভাবলো সায়ান।

ফারিস ও ছাড়বার পাত্র নয় বিয়ের দু’দিন পর ব‌উ ভাত এর অনুষ্ঠান সেখানে সায়ান কে আসতে বলেছে। এবার আর কোন অযুহাত শুনবে না সে, তার সাথে এও বলেছে যে, সায়ান না আসলে তার সাথে কোন সম্পর্ক রাখবে না।

ফারিসের এই কঠোর সিদ্ধান্ত সায়ানকে এক গভীর দ্বিধায় ফেলে দিল। সায়ান তার বন্ধু ফারিসকে খুব ভালোবাসে, কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার বিষয়ে তার মনে কিছুটা অস্বস্তি কাজ করে। সায়ান একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ এবং এই ধরনের বড় পারিবারিক অনুষ্ঠানের কিছু দিক তার মনঃপূত নয়। তবে ফারিসের কথাগুলো তাকে ভাবতে বাধ্য করল।

অবশেষে, সায়ান তার মনে দ্বিধা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, সে অনুষ্ঠানে যাবে, কিন্তু এক শর্তে—সে সেখানে অতি সংক্ষিপ্ত সময় থাকবে এবং কোনোরকম বাড়াবাড়ি থেকে নিজেকে দূরে রাখবে। সে ফারিসকে ফোন করে তার সিদ্ধান্ত জানায়।

অনুষ্ঠান এর দিন ফারিস খুব খুশি হয় কারণ তার বন্ধু সায়ান আসছে তাই। সায়ান অনুষ্ঠানে পৌঁছে হাসিমুখে ফারিস কে শুভেচ্ছা জানায়। ফারিসের বউ নাদিয়া ও সায়ানকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায়। সায়ান সৌযন্ন মূলক মাথা নাড়ায়।

কিন্তু সায়ানের উপস্থিতি সেখানে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। অনুষ্ঠানে একজন অতিথি, সায়ানের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে বিস্ময়, কৌতূহল আর একধরনের অজানা অনুভূতি। সায়ান এদিকে মেয়েটির উপস্থিতি টের পেয়ে অস্বস্তিতে পড়ে যায় এদিকে ফারিস তাকে না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বার পাত্র নয়।

ফারিস সায়ানের সঙ্গে মেয়েটির পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু সায়ান কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। এদিকে মেয়েটির নাম আনিকা, এবং তার চোখে সায়ানের জন্য এক ধরনের অনুরাগ দেখা যায়, যা নাবিহা খেয়াল করে খুব বিরক্ত হয়।

সায়ানের প্রতি আনিকার চোখে যে অনুভূতি ফুটে উঠেছে, তা নাবিহার নজরে পড়েছে। আনিকার এই আচরণ নাবিহাকে ভীষণ বিরক্ত করে।

অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে নাবিহা ফারিসের কাছে গিয়ে বলে,
“দেখো ভাইয়া, ওই আনিকা আপুটা আমার একদম ভালো লাগছে না। ও সায়ান ভাইয়ার দিকে কেমনভাবে তাকাচ্ছে, দেখেছ?”

ফারিস সন্দিহান চোখে চেয়ে বলে,
“এতে তোর কি সমস্যা? আনিকা ভালো মেয়ে, আর সায়ান তো এমনিই সিরিয়াস মানুষ। ওসব নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই।”

নাবিহা ভ্রু কুঁচকে বলে,
“তুমি বুঝতে পারছো না ভাইয়া! আমি মেয়েদের চোখের ভাষা বুঝি। তাই আগেই সাবধান করছি।”

এদিকে আনিকা সায়ানের সাথে আরেকবার কথা বলার চেষ্টা করে। যখন সায়ান এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল, আনিকা তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আপনি এত চুপচাপ কেন? সবার সঙ্গে তো মিশছেন না।”

সায়ান অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল,
“আমি স্বাভাবিকভাবেই কম কথা বলি।”

আনিকা একটু ইতস্তত করে বলে,
“আপনার ব্যক্তিত্ব খুব ইন্টারেস্টিং।”

সায়ান মাথা নাড়ে, আনিকার কথাগুলো শালীন হলেও তার ভেতরের ইঙ্গিত সায়ান বুঝতে পারে।

শেষে নাবিহা সায়ানের কাছে গিয়ে বলে,
“ওহ তুমি এখানে, আমি আরো তোমাকে খুঁজছি।”

নাবিহার তুমি সম্বোধন শুনে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে যেন সায়ান। নাবিহার কথার ধরন এমন মনে হচ্ছে যেন তারা বহুদিনের পরিচিত আর সায়ান নাবিহার বিশেষ কেও‌। এদিকে আনিকা ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নাবিহা তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” ওর সাথে কি কথা বলছো আপু?”

আনিকা বলে,
” উনি তোমার কি হয়?”
নাবিহা লজ্জা পাওয়ার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলল,
” আরে বুঝ নাই আপু?”

আনিকার আর কিছু বুঝতে অসুবিধে হলো না। সে জন্য এখান থেকে চলে গেল।
সায়ান তখন রাগি লুক নিয়ে বলল,
” এই মেয়ে কি বুঝালেন আপনি উনাকে?”
“ওই আনিকা আপুকে আমি একদম পছন্দ করিনা। আপনি সাবধান থাকবেন।”
“আপনার এতো চিন্তা করার কারণ দেখছি না। আমি নিজের সীমা জানি এবং বুঝি।”
” যাহ বাবা! এ জন্যই বলে যেচে কারো উপকার করতে নেই। আপনি আনিকা আপুকে চিনেন? উনি বাবার আদরের দুলারি। আজকে যদি আপনাকে পছন্দ করে বাবাকে গিয়ে বলতো তাহলে উনার বাবা দরকার হলে আপনাকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেয়ের সামনে হাজির করতো!”

এমন অদ্ভুত কথায় কেশে উঠে সায়ান। তারপর গম্ভীর মুখে বলে,
” আমাকে নিয়ে আপনার এতো ভাবতে হবে না। আপনি নিজের কথা ভাবুন। কি সব পোশাক আশাক পরেছেন? মৃত্যুর ভয় নেই আপনার? তাছাড়া আপনি আপনার স্বামীর আমানত। এভাবে পরপুরুষের সামনে নিজেকে প্রদর্শন করে বেড়াবেন না।”

এসব বলে সায়ান চলে যেতে নিলে নাবিহা পিছন থেকে বলল,
” আপনি ও তো আপনার ব‌উ এর আমানত তাহলে এভাবে কোর্ট প্যান্ট পড়ে সেজেগুজে মেয়েদের আকৃষ্ট করেন কেন?”

নাবিহার এমন আজব কথায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যায় সায়ান তারপর সোজা খেয়ে দেয়ে ফারিস এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে যায়।
.
.
একদিন হসপিটালে যাওয়ার সময় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সায়ান তার চুল চিড়নী করছিল এমন সময় নাবিহার কথাটা মনে পড়ে তার। নাবিহা বলেছিল, আপনি ও তো আপনার ব‌উ এর আমানত তাহলে এভাবে কোর্ট প্যান্ট পড়ে সেজেগুজে মেয়েদের আকৃষ্ট করেন কেন?

সায়ানের মনে নাবিহার কথাগুলো গভীর দাগ কাটে। চিরুনিটা হাতে ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নাবিহার কথাগুলো তার কাছে শুধু তর্কের বা উপদেশের মতো মনে হয়নি, বরং নিজের ভেতরের একধরনের অপরাধবোধ জাগিয়ে তুলেছিল।

সে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, “আমি কি সত্যিই এমন কাজ করছি যা আমার স্ত্রীর আমানতের সঙ্গে অন্যায়? আমি কি অন্যদের কাছে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করছি যা আমার চরিত্রের সঙ্গে যায় না?”

এরপর সায়ান হসপিটালে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতে ঠিক করে আজকে চিড়নী করবে না। হাত দিয়ে চুল গুলো একটু ঠিক করে নেয়। তারপর আবার শার্ট পড়তে গিয়ে ভাবে, এই শার্ট গুলো পড়লেও তো একটা নতুনত্ব ভাব আসবে। তাহলে কি আমি এখন শার্ট পড়ে হসপিটালে যাব না?

শার্ট হাতে নিয়ে বসে বসে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর উঠে গিয়ে শার্ট গায়ে দিতে দিতে বলল, দূর ঐ মেয়েটা একটা পাগল সাথে আমাকেও পাগল বানানোর ফন্দি আঁটছে। ছেলেদের জন্য পর্দার মূলনীতি:
১. শালীন দৃষ্টি, পরিচিত-অপরিচিত নারীদের দিকে অহেতুক দৃষ্টি না দেওয়া।
২. শালীন পোশাক, শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ঢেকে রাখা এবং এমন পোশাক পরিধান না করা যা নারীদের মতো বা অশালীন।
৩. আচরণ,নিজের কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও চলাফেরায় নম্রতা এবং সম্মান বজায় রাখা।
৪. সংযোগের সীমা, নারীদের সঙ্গে অহেতুক মেলামেশা ও হাসি-ঠাট্টা এড়িয়ে চলা।
আমি তো এগুলোর কোনটাই করছি না তাহলে অহেতুক দুশ্চিন্তা করার কোন মানে হয় না।

তারপর সায়ান পূর্বের মতোই রেডি হয়ে হসপিটালে চলে যায়।
.
.
অপরদিকে নাবিহার মধ্যে অমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করে চলেছে তার সহপাঠীরা। ইদানিং ছেলে বন্ধুদের সাথে মেলামেশা তো দূরের কথা তাদের সাথে কথা ও বলছে না। যারা নিজ থেকে কথা বলতে আসছে তাদের এরিয়ে চলছে সে….

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।