মেঘলা দিনের রোদ্দুর পর্ব-০৪

0
395

#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(৪)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

নাবিহা আর সাদিক একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া, পড়াশোনা, হাসি-ঠাট্টায় দিনগুলো আনন্দে কাটতো। সাদিক মনে মনে নাবিহাকে ভালোবাসত, কিন্তু কখনো তা প্রকাশ করেনি। সে ভাবত, কলেজে ভর্তি হওয়ার পর উপযুক্ত সময়ে নাবিহাকে প্রপোজ করবে। এরপর যখন সাদিক পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে তখন নাবিহাকে বিয়ে করে নিবে। কিন্তু ইদানিং এসে নাবিহা সাদিকের সাথে কথা বলে না, সাদিক নিজ থেকে কথা বলতে আসলেও নাবিহা কৌশলে এড়িয়ে চলে।
নাবিহার আচরণে বড় পরিবর্তন এসেছে। সাদিক যখনই কথা বলতে চায়, নাবিহা কৌশলে এড়িয়ে যায়। এমনকি নাবিহার সেই চঞ্চল হাসিটাও যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।

একদিন সাদিক আর সহ্য করতে না পেরে নাবিহাকে জিজ্ঞাসা করল,
“তুই এভাবে দূরে দূরে থাকছিস কেন? আমি কি কিছু ভুল করেছি?”

নাবিহা একটু থেমে বলল,
“তুই কিছু ভুল করিস নাই, সাদিক। আমি শুধু আমার জীবনের এক নতুন পথে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

সাদিক অবাক হয়ে বলল, “কিসের নতুন পথ? তুই কি আমাকে আর বন্ধু মনে করিস না?”

নাবিহা মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বলল,
“আমি ইসলামের পথে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি এখন থেকে পর্দা করব এবং ছেলেদের সঙ্গে অহেতুক মেলামেশা বন্ধ করব। আমাদের ধর্মে এই সম্পর্কগুলোকে অনুমতি দেয়া হয় না। তাই আমি তোর সঙ্গে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছি।”

সাদিক চুপ করে রইল। কিছু বলার ভাষা তার ছিল না। সে জানত, নাবিহা খুব মর্ডান মেয়ে সে ধর্মের বিষয় কম ই মানে। কিন্তু এত বড় সিদ্ধান্ত সে এত তাড়াতাড়ি নেবে, তা ভাবতে পারেনি।

“তুই তো জানিস, আমি তোকে কতটা…,”
সাদিকের কথা শেষ করার আগেই নাবিহা তাকে থামিয়ে দিল।
“দয়া করে আমাকে কঠিন অবস্থায় ফেলিস না, সাদিক। আমি জানি তুই আমার ভালো চাস, কিন্তু এই ভালোবাসা আমার জন্য হালাল নয়। আমি চাই, তুই আমার এই সিদ্ধান্তকে সম্মান করবি।”

সাদিকের মন ভেঙে গেল। কিন্তু নাবিহার কথাগুলো তার হৃদয়ে গভীরভাবে প্রভাব ফেলল। সে বুঝতে পারল, নাবিহা এখন অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।

নাবিহা আর সাদিকের পথ দুটো ভিন্ন হয়ে গেল। কিন্তু সাদিক কিছুতেই নিজেকে বুঝাতে পারছে না, সারাক্ষণ নাবিহার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো তাড়া করে বেড়ায় তাকে।
.
.
অপরদিকে সায়ান একজন মেডিসিন স্পেশালিস্ট।
যার জীবনের প্রতিটি দিকেই ধর্মীয়তা ও নৈতিকতার ছোঁয়া স্পষ্ট। সে কেবলমাত্র একজন দক্ষ চিকিৎসকই নয় বরং একজন সৎ, নীতিবান, এবং ধর্মপ্রাণ মানুষ। তার কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে।

রোগীদের প্রতি সায়ানের আচরণ অসাধারণ। সে রোগীদের শারীরিক সমস্যা নিরাময়ের পাশাপাশি তাদের মানসিক শক্তি জোগানোর চেষ্টা করে। সায়ান বিশ্বাস করে, সৌন্দর্য শুধু বাহ্যিক নয়, এটি একজন মানুষের আত্মা এবং চরিত্রেও নিহিত। তাই সে কখনো রোগীদের প্রতি অবহেলা করে না এবং সর্বদা তাদের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকে।

সায়ান তার পেশাগত জীবনে কোনো অন্যায় বা ভুল পথে পা বাড়ায় না। অর্থলিপ্সা বা খ্যাতির পেছনে ছুটে সে নিজের নীতিবোধ বিসর্জন দেয় না। বরং প্রতিটি কাজ সে ন্যায় ও সততার সঙ্গে করে। তার এই নৈতিকতা তাকে অন্য চিকিৎসকদের থেকে আলাদা করে তোলে এবং রোগীদের মনে বিশেষ স্থান করে দেয়।

ধর্মীয়তার এই গভীর সংযোগ তার চরিত্রকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। রোগীদের সেবা করার মাধ্যমে সায়ান আল্লাহর কাছে তার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করে। এই বিশ্বাস তাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শক্তি ও অনুপ্রেরণা দেয়।
তবে তার পেশাগত জীবনের সাফল্যের আড়ালে একটি গভীর চিন্তা সবসময়ই তাকে তাড়া করে—তার বৈবাহিক জীবন কেমন হবে? সৎ মা কামিনী বেগমের কঠোর এবং নিয়মতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে সে বেশ চিন্তিত। তার মায়ের একটাই শর্ত, যে মেয়েকে বউ হিসেবে নিয়ে আসবে, তাকে মায়ের পছন্দমতো হতে হবে।

সায়ান মনে মনে ভাবে, “যে মেয়ে আমার মায়ের কঠোর স্বভাবের সাথে মানিয়ে চলতে পারবে না, তাকে নিয়ে তো ঘরে যুদ্ধ শুরু হবে। আমার মা হয়তো কঠোর, কিন্তু তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমি কি তার ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারি?”

এই দ্বিধা তাকে প্রতিনিয়ত পীড়া দেয়। একদিন তার এক বন্ধু তাকে পরামর্শ দেয়, “শুধু মায়ের শর্ত পূরণ করার জন্য বিয়ে করতে যাস না। তোর নিজের পছন্দকে ও গুরুত্ব দিস।”

তবে সায়ান জানে, তার মা কখনোই তাদের নিয়ম-নীতি ভাঙতে রাজি হবেন না। তাই সে ঠিক করে, এমন একজন মেয়েকে খুঁজবে, যে তার মায়ের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে এবং একইসঙ্গে তার নিজের মনের মানুষ হবে।
.
.
একদিন নাবিহার বান্ধবী শেলী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে, পেটে তার খুব ব্যাথা শুরু হয়। নাবিহা তাকে জানায় তার পরিচিত একজন ভালো ডাক্তার আছে।
শেলীর বাবা বিদেশে থাকেন এদিকে শেলীর ছোট ছোট যমজ দুটো বোন আছে তাদের কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া সম্ভব নয় বলে শেলীর মা নাবিহাকে দায়িত্ব দিল। আর তাই নাবিহা শেলী কে নিয়ে সায়ান এর হসপিটালে আসে।

নাবিহা যখন শেলীকে নিয়ে ডা. সায়ানের চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করছিল, তার ভেতরে অদ্ভুত এক উত্তেজনা কাজ করছিল। বুকের ধুকপুক শব্দ যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল সে। কেন এমন হচ্ছে, তা বোঝার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।

সে মনে করার চেষ্টা করল সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা, যেখানে তাদের শেষ দেখা হয়েছিল। কতকিছু বদলে গেছে সেই দিনের পর থেকে। সেদিনের নাবিহা আর আজকের নাবিহার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। তখন সে ছিল প্রাণবন্ত, সাজগোজ পছন্দ করা এক সাধারণ মেয়ে। আর আজকের নাবিহা? সে এখন আরও সংযত, আরও পরিণত—নিজেকে ইসলামের পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছে।

নাবিহা মনে মনে ভাবল, সায়ান যদি চিনেও থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই অবাক হবে। আর যদি চিনতে পারে না, তবুও কোনো আক্ষেপ নেই তার। কারণ সে জানে, আল্লাহর প্রশংসাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। যদি সায়ান চিনতে পারত, তাহলে হয়তো সে মুচকি হেসে বলত,
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের ভালো কিছু হতে পথ দেখিয়েছেন।”

এই চিন্তা নাবিহাকে শান্তি দেয়, কিন্তু তার মনের ভেতরে সায়ানকে দেখার সেই পুরনো অনুভূতিগুলো আবারও উঁকি দিতে শুরু করে। নাবিহা দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। কারণ সে জানে, দুনিয়ার সব সম্পর্কের ঊর্ধ্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাই তার লক্ষ্য।

এদিকে, সিরিয়ালের ডাক আসতে দেরি হচ্ছিল। অপেক্ষার মুহূর্তগুলো যেন নাবিহার মনে আরও হাজারো প্রশ্ন জাগিয়ে তুলছিল।

অতঃপর,
ড. সায়ান খুব শান্ত এবং দায়িত্বশীল একজন চিকিৎসক। তিনি শেলীর সব লক্ষণ ভালোভাবে শোনেন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য নির্দেশ দেন। ঠিক তখন নাবিহা নিজের অজান্তেই সায়ানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সায়ান বেশ কয়েকবার লক্ষ্য করে নাবিহাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” চোখের ও পর্দা আছে আপনি হয়তো জানেন না?”

নাবিহা লজ্জায় মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে পড়ে। সায়ানের কণ্ঠের দৃঢ়তা এবং কথার স্পষ্টতা তার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। সে নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, সায়ান একজন নীতিবান এবং চরিত্রবান মানুষ।

এর দুদিন পর, শেলীর প্রাথমিক পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন হলে সায়ান রিপোর্ট দেখে এবং বলে,
“রিপোর্ট দেখে বলা যাচ্ছে, সমস্যাটি গুরুতর নয়। ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। তবে খাদ্যাভ্যাসে নিয়ম মানতে হবে।”

নাবিহা খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। শেলীও আনন্দিত হয় যে তাকে বড় কোনো ঝামেলায় পড়তে হবে না। সায়ান পেশাগতভাবে সবকিছু ব্যাখ্যা করেন এবং তাদের বিদায় জানান।

কেবিন থেকে বের হওয়ার পর শেলী নাবিহার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“তোর পরিচিত ডাক্তার তো বেশ রাগী, তাই না?”
নাবিহা একটু হেসে জবাব দেয়,
“রাগী না, উনি সৎ আর নীতিবান। তাই সবাইকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে চান।”

শেলী বোঝে নাবিহার মনে কিছু একটা চলছে, কিন্তু সে আর কিছু বলে না।

এদিকে, নাবিহার মনে সায়ানের কথাগুলো ঘুরতে থাকে। সে ভাবে, সায়ানের মতো একজন মানুষের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ পাওয়া তার জন্য এক সৌভাগ্য। তবে নিজের অজান্তেই সে অনুভব করে, সায়ানের প্রতি তার এক ধরনের মুগ্ধতা তৈরি হয়েছে।

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।