মেঘলা দিনের রোদ্দুর পর্ব-০৯

0
271

#মেঘলা_দিনের_রোদ্দুর(৯)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
#সারপ্রাইজ_পর্ব

নাবিহা মাগরিবের নামাজ পড়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, সে নিজেই জানে না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে—রাত নয়টা বাজে। বুঝতে পারে, এশার আজান অনেক আগেই হয়ে গেছে।

ঘুমের ঘোর কাটাতে কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বাথরুমে যায়, ফ্রেশ হয়ে অজু করে এসে নামাজে দাঁড়ায়।

নামাজ শেষ করে ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে যায় নাবিহা। সেখানে গিয়ে দেখে মা, বাবা, ভাই, ভাবি সবাই মিলে গভীর আলোচনায় মগ্ন। বিষয়টা বুঝতে না পারলেও আলোচনার গুরুত্ব তার চোখে পড়ে।

নাবিহা গিয়ে চুপচাপ এক পাশে বসে। কিন্তু তাকে দেখেই সবাই হঠাৎ চুপ হয়ে যায়।
নাদিয়া তড়িঘড়ি উঠে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে নিজের হাতে বানানো গরম গরম পাকোড়া নিয়ে এলো, সাথে সসও। প্লেটে সাজিয়ে তা নাবিহার সামনে রাখতেই সে একটানা তাকিয়ে রইল। এরপর একটা পাকোড়া তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে খেতে লাগল।

“তোমরা সবাই খেয়েছো?” মুখে খাবার নিয়েই জিজ্ঞেস করল নাবিহা।

মিজান সাহেব হাসিমুখে জবাব দিলেন, “খেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ।” তারপর একটু থেমে নরম স্বরে বললেন, “শোন নাবি, আগামীকাল পাত্রপক্ষ আসবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে হয়তো বিয়েটাও হয়ে যাবে। তুই প্রস্তুত থাকিস, মা।”

বিয়ের কথা শুনেই নাবিহার হাত থমকে গেল। পাকোড়াটা আর মুখে তুলতে পারল না। ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল—নীরব, স্থির… যেন কথাগুলো মন থেকে গেঁথে যাচ্ছিল তার হৃদয়ে।

নাবিহা মাথা নিচু করে বসে রইল। তার মনে একের পর এক প্রশ্ন জাগছে—সে কি সত্যিই বিয়ের জন্য প্রস্তুত?

নাদিয়া নাবিহার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, তার মন ভালো নেই। সে ধীরে ধীরে কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
“নাবি, তুই ঠিক আছিস?”

নাবিহা চমকে তাকাল নাদিয়ার দিকে। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। এরপর এক নিঃশ্বাসে বলল, “আমি জানি না, ভাবি… আমার কেমন একটা অদ্ভুত লাগছে। এত তাড়াতাড়ি সবকিছু ঠিক হয়ে যাচ্ছে! আমি কি সত্যিই প্রস্তুত?”

নাদিয়া নাবিহার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“সব মেয়েই বিয়ের আগে এমন অনুভব করে, নাবি। কিন্তু বাবা-মা তোকে কখনো খারাপের দিকে ঠেলে দেবে না, তাই না?”

নাবিহা ম্লান হাসল, কিন্তু তার চোখের ভাষা বলছিল, মনের ভেতর এখনো দোটানা কাজ করছে।

ঠিক তখনই মিজান সাহেব বলে উঠলেন,
“কাল দুপুরে তারা আসবে। তুই চাইলে ছেলেটার সাথে কথা বলতে পারবি, মা।”

নাবিহা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল, কিন্তু তার বুকের ভেতর দুরুদুরু কাঁপন শুরু হয়ে গেল। এই একটা সিদ্ধান্ত কি সত্যিই তার পুরো জীবন বদলে দেবে?
.
.
সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকলে নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু নাবিহা বিছানায়, ছোট্ট মোহাম্মদকে নিয়ে শুয়ে আছে। মোহাম্মদ শুয়ে শুয়ে পা নাড়িয়ে খেলছে, মুখে অস্পষ্ট শব্দ ফোটাচ্ছে। নাবিহা মাঝেমধ্যে তার মতো করেই সুর মিলিয়ে কথা বললে, মোহাম্মদ খিলখিল করে হেসে ওঠে, আরও কিছু বলতে চায় নিজের মতো করে।

কিন্তু নাবিহার মনে আজকের দিনের গুরুত্ব কোনোভাবেই প্রভাব ফেলছে না। বিয়ের মতো এত বড় একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, অথচ তার অনুভূতিতে কোনো ঢেউ নেই। যেন এ দিনটি একেবারেই সাধারণ, একেবারেই স্বাভাবিক।
.
নাবিহা মোহাম্মদকে কোলে নিয়ে বসে পড়ল। ছোট্ট হাত দুটো ধরে নাড়াতে নাড়াতে বলল,
“আমার মোহাম্মদ কী বলছে, হুম? আমাকেও বলো তো!”

মোহাম্মদ খিলখিল করে হেসে আবারো অস্পষ্ট কিছু বলল। তার উজ্জ্বল ছোট্ট চোখজোড়া আনন্দে চকচক করছে। নাবিহার মন এক মুহূর্তের জন্য হলেও হালকা লাগল।

হঠাৎ দরজার বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। পর্দা সরিয়ে নাবিহার মা উঁকি দিল বলল,
“নাবিহা, তুই এখনো গোসলে যাস নাই?”

নাবিহা চমকে উঠল। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই আয়নার সামনে চোখ পড়ল। নিজের ক্লান্ত চেহারা দেখে কেমন যেন অবিশ্বাস লাগল—আজ সত্যিই তার বিয়ে!

কিন্তু কেন জানি মন থেকে কোনো অনুভূতি আসছে না। উচ্ছ্বাস নেই, শিহরণ নেই। যেন সবকিছু একটা নির্লিপ্ততার চাদরে ঢাকা।

বাইরে কিছু আত্মীয়রা এসে পড়েছে। অথচ নাবিহার মনে হচ্ছে, এই কোলাহলের কোনো কিছুই যেন তাকে ছুঁতে পারছে না…
.
নাবিহা ধীরে ধীরে মোহাম্মদকে বিছানায় শুইয়ে দিল। ছোট্ট ছেলেটা ততক্ষণে হাত-পা ছুঁড়ে খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে এসেছে, তার চোখে ঘুমের ছায়া নেমে এসেছে।

বাইরে থেকে কেউ একজন আবার ডাকল,
“নাবিহা! দেরি হয়ে যাচ্ছে, পাত্রপক্ষ এক্ষুনি চলে আসলো বলে!”

নাবিহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আয়নার সামনে এসে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল। আজ তার বিয়ে! অথচ তার মনে কোনো আলোড়ন নেই। কেমন যেন শূন্যতা ঘিরে আছে তাকে।

আস্তে আস্তে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। উঠোনজুড়ে সাজসজ্জা, মানুষের ব্যস্ততা—সবকিছুই স্বাভাবিক লাগছে, শুধু তার মনটাই যেন অস্বাভাবিক হয়ে আছে। একটা চাপা শ্বাস ফেলে সে চোখ বন্ধ করল। কেন জানি মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে! কিন্তু কি?…
.
.
যোহরের নামাজ শেষে আত্মীয়স্বজন সবাই একসঙ্গে খাবার খেতে বসেছে। পাত্রপক্ষকেও আপ্যায়ন করা হয়েছে। তারা এসেছেন মাত্র সাতজন। এর বেশি নিয়ে আসার পক্ষপাতী ছিলো না পাত্র। তার বিশ্বাস, বিয়েতে একগাদা লোক নিয়ে আসা পাত্রীর পরিবারের ওপর একপ্রকার অন্যায়। তাই প্রথমে আরও কম লোক নিয়ে আসার ইচ্ছা ছিল তার। তবে অনেক অনুরোধের পর মিজান সাহেব এই সাতজনকে রাজি করাতে পেরেছেন।

অন্যদিকে, নাবিহা ঘরের এক কোণে নীরবে বসে আছে। খাবার নিয়ে এগিয়ে আসে নাদিয়া। হাতে ধরা প্লেটটা নাবিহার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে স্নেহভরে বলে,
“খেয়ে নে বোন, এখন না খেলে পরে আর খাওয়ার সুযোগ পাবি না।”

নাবিহার খেতে ইচ্ছে করছে না একদম। মুখে ক্ষুধার অনুভূতিও নেই। তবু নাদিয়ার আদুরে কণ্ঠে বলা কথা ফেলতে পারে না সে। অল্প করে কয়েক গ্রাস মুখে তোলে। কিন্তু প্রতিটা লোকমা যেন গলায় দলা পাকিয়ে আটকে যাচ্ছে। ভেতরে এক অজানা ঝড় বইছে, যা কেবল সে নিজেই টের পাচ্ছে। কাউকে বলার মতো ভাষা নেই, বোঝানোরও উপায় নেই।

নাবিহা চুপচাপ খেতে থাকে, অথচ তার অন্তরে এক নীরব ঝড় তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে…
.
.
অতঃপর…

নাবিহাকে লাল টুকটুকে বউ সাজানো হয়। গাঢ় রঙের শাড়িতে সজ্জিত হয়ে, হাতভর্তি মেহেদির রঙ আর গয়নার আভায় যেন অপরূপ লাগছে তাকে। চারপাশে আত্মীয়স্বজনের ব্যস্ততা, আনন্দ-উচ্ছ্বাস। কিন্তু নাবিহার মনে অদ্ভুত এক শূন্যতা, এক চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।

বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। মৌলভী সাহেব এগিয়ে এসে নিয়ম মেনে কাবিননামা পাঠ করেন। আশপাশে সবাই নীরব, এক অদ্ভুত প্রশান্তি ঘিরে রেখেছে পরিবেশ। কিন্তু পরক্ষণেই পরিচিত একটি নাম উচ্চারিত হতেই নাবিহার বুক ধক করে ওঠে।

সে যেন এক মুহূর্তের জন্য ঘোরের মধ্যে চলে যায়। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। এ কী শুনল সে!

ধীরে ধীরে পাশ ফিরে তাকায়, ভাই ও ভাবির দিকেই দৃষ্টি যায় তার। ফারিস চোখে চোখ রেখে ইশারায় আশ্বস্ত করে। যেন বলতে চাইছে, “কোনো ভয় নেই, ঠিক আছিস তুই।”

নাবিহা গভীর শ্বাস নেয়। বুকের ভেতর অনবরত ঢেউ খেলতে থাকা অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারপর কাঞ্চনখচিত ঘোমটার আড়ালে থমথমে কণ্ঠে বলে দেয়—
“কবুল!

নতুন পথচলা

বিয়ে সম্পন্ন হলে নবদম্পতিকে পাশাপাশি বসানো হয়। স্বজনরা হাসিমুখে মিষ্টি মুখ করায়, আনন্দে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। সবাই হাসছে, কথা বলছে, নবদম্পতির নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানাচ্ছে।

কামিনী বেগম নিজের পার্স খুলে ওয়েডিং রিং বের করেন। ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন,

— “এবার বউকে পরিয়ে দে।”

সায়ান মৃদু হাসে। তারপর ধীরে ধীরে নাবিহার হাত ধরে, কোমল টান দিয়ে তার অনামিকা আঙুলে আংটিটি পরিয়ে দেয়। মুহূর্তটি যেন থমকে যায়। আশপাশের কোলাহল হারিয়ে যায় নাবিহার কানে।

সে ধীরে ধীরে মাথা তোলে, সায়ানের দিকে তাকায়। চোখে হাজারো অনুভূতি খেলা করছে। অতীত, বর্তমান—সব একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে তার মনের ভেতর। পরক্ষণেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।

সায়ান মৃদু হেসে নাবিহার চোখের পানি মুছে দেয়। আর বলে,
” এখনো সেই পিচ্চি ই রয়ে গেছো, কিছু হলেই চোখের পানি নাকের পানি দিয়ে একাকার করো।”

নাবিহা নাক টেনে বলে,
“আমাকে পিচ্চি বলবেন না বলে দিচ্ছি।”

#চলবে… ইনশা আল্লাহ