মেঘের অন্তরালে পর্ব-১৬

0
660

#মেঘের_অন্তরালে
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১৬

নিহান আশেপাশে তন্নতন্ন করে খুজেও যখন নিশিতাকে পেলো না, তখন ফুটপাতে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্না করতে লাগলো। বুক ফেটে যাচ্ছে নিহানের, কোথায় খুঁজবে মেয়েকে, কিছুই বুঝতে পারছে না।

পাপা,,,,

নিশিতার আওয়াজ পেয়ে নিহান মাথা তুলে তাকালো আর এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো। নিশিতা আইসক্রিম হাতে দৌড়ে এসে নিহানকে জড়িয়ে ধরলো। নিহানও মেয়েকে জড়িয়ে কান্না করতে লাগলো। নিশিতাকে বুক থেকে সরিয়ে সারা মুখে চুমু খেলো।

কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি ?

আমি তো ঐ আন্টিটার সাথে গিয়েছিলাম। আমাকে বলেছিলো মাম্মামের কাছে নিয়ে যাবে।

তোমাকে কতবার বলেছি তোমার কোনো মাম্মাম নেই, আমিই তোমার পাপা আর আমিই মাম্মাম।

নিহানের ধমকে চমকে উঠলো নিশিতা। হাত থেকে আইসক্রিমটাও পরে গেলো নিচে।

নিহান আবারও ধমক দিয়ে বলে, আর তোমাকে মানা করার পরও, তুমি অচেনা কারো সাথে কেনো গিয়েছিলে ?

ওকে আর বকো না প্লিজ, আমি নিয়ে গিয়েছিলাম।

চিরচেনা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলো নিহান। বিস্ফুরিত চোখে সামনে তাকিয়ে দেখতে পেলো মলিন হেঁসে তার দিকে তাকিয়ে থাকা নীলাকে। আজ দীর্ঘ পাঁচ বছর পর চিরচেনা মানুষটা দেখে একটু বেশি অবাক হলো নিহান। চেহারার সেই লাবণ্যতা অনেকটাই কমে গেছে, দেখে বুঝা যাচ্ছে হয়তো নিজের অবহেলার জন্যই এই অবস্থা।

নিশিতাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বললো, তুমি ?

নীলা নিশিতার গালে আলতো স্পর্শ করে বললো, হ্যাঁ আমি।

নিহান নিজেকে সামলে নিশিতাকে নীলার থেকে দূরে সরিয়ে নিলো আর কঠিন গলায় বললো, আমাকে না জানিয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে আসার সাহস হলো কী করে তোমার ?

নীলা অসহায় গলায় বললো, নিহান তুমি ভুলে যাচ্ছো তুমি যেমন নিশিতার বাবা, আমিও নিশিতার মা।

নীলার কথায় অট্টহাসিতে ফেটে পরলো নিহান। নিশিতা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে নিজের পাপার দিকে। এর আগে কখনো তাকে এভাবে হাসতে দেখেনি। নিশিতার ছোট মাথা নিহানের এই হাসির মানে বুঝতে পারলো না। শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিহানের দিকে।

নিহান নিচু হয়ে নিশিতার কপালে চুমু খেয়ে বললো, মামুনি তুমি গাড়িতে গিয়ে বসো, পাপা এখনই আসছে।

নিশিতাও বাবার বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসলো। নীলা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিজের মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে। নিশিতা চলে যেতেই নিহান রাগী দৃষ্টিতে তাকালো নীলার দিকে।

কী যেনো বলছিলে, তোমার মেয়ে ?

ভুল কিছু বলেনি তো, দশ মাস দশ দিন এই গর্ভে রেখেছি।

নিহান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, সেটা তো নিজের স্বার্থের জন্য বাধ্য হয়েছিলে। একটুও লজ্জা করলো না, যাকে জন্মের আগেই মেরে ফেলতে চেয়েছিলে তাকে নিজের মেয়ে বলতে ?

নীলা কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

ধরা গলায় নিহান বললো, ওর জন্মের পর কতবার বলেছিলাম আমার জন্য না হলেও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে যাও। কিন্তু মেয়েটা কালো বলে, তুমি তাকে নিজের মেয়ে মানতেই নারাজ।

নীলা এবার কেঁদেই দিলো, প্লিজ আর বলো না, এসব সহ্য করতে পারছি না আর।

নিহান ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বললো, এখন যেগুলো শুনতে পারছো না, একদিন সেগুলো করতে পেরেই খুশি হয়েছিলে।

আমি আমার কাজের জন্য অনুতপ্ত।

তোমার অনুতাপ আমার মেয়ের সেই কষ্টের কান্না গুলো মুছে দিতে পারবে ? যখন একটা দুধের বাচ্চা তার মায়ের জন্য কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলো। সেই সময়টা ফিরিয়ে আনতে পারবে যে সময়টায় মেয়েটার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো তোমাকে ?

নীলা কী উত্তর দিবে নিহানের প্রশ্নের ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তো নেই তার কাছে। আছে শুধু চোখের পানি আর বুক ফাটা কষ্ট।

নিহান কঠিন গলায় বললো, আমি আর আমার মেয়ে দুজনেই তোমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গিয়েছি। এখন আর আমাদের জীবনে কোনো প্রয়োজন নেই তোমাকে। তোমার ছায়াও যেনো আর কখনো আমার মেয়ের উপর না পড়ে।

নিহান কথাগুলো বলে উল্টো ফিরে গেলো। চোখের কোণের পানিটা মুছে সামনে আগাতে লাগলো। নীলা পেছন থেকে ডাকলো কিন্তু নিহান ফিরে তাকায়নি। গাড়ি চলতে শুরু করলে নীলা নিচে বসে কাঁদতে থাকে।

পাপা আন্টিটা কাঁদছিলো কেনো ?

নিহান মেয়ের দিকে তাকালো তবে কেনো উত্তর দিলো না। বাসায় পৌঁছে নিশিতাকে নামিয়ে দিয়ে আবার অফিসের দিকে চলে গেলো, লাঞ্চ না করেই। নিশিতা শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে।

২৭.
ইসরা অনেকক্ষণ ঘুরে ফিরে ক্লান্ত হয়ে গেছে। বেখেয়ালি হাঁটতে গিয়ে কিছুতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো আর পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলো। কোনো মতে উঠে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো রক্তে ভেসে যাচ্ছে, হাঁটুর খানিকটা নিচে পাজামা ছিঁড়ে গেছে, পাও অনেকটা কেটে গেছে । নিচে তাকিয়ে দেখলো একটা কাটা গাছের তীক্ষ্ণ অংশ। কাটা জায়গা চেপে ধরে একটা গাছের শেকড়ে বসে পড়লো। নিজের ওড়নার একটা অংশ ছিঁড়ে ভালো করে বেঁধে নিলো। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বুঝতে পারলো হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। এখন ভয় করতে শুরু করেছে ইসরার। রাস্তা খুঁজে না পেলে এখানেই রাত হয়ে যাবে আর রাত হলে জঙ্গলের হিংস্র পশু বেড়িয়ে আসবে। এসব চিন্তা ভাবনা মাথায় আসতেই ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো ইসরা। এদিকে ঠিক মতো হাঁটতেও পারছে না। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে এখন।

ইসরা আশেপাশে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললো, কেউ আসেন ?

চারপাশ এতোটাই নির্জন, গাছ থেকে পাতা পড়ার শব্দও যেনো কানে লাগছে। ইসরার কাছে অদ্ভুত লাগছে, কারণ একটা পাখির ডাকও নেই কোথাও।

কেউ আসনে, আমাকে একটু সাহায্য করতে পারবেন ? আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি।

কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ইসরার ভয় বাড়তে লাগলো। থেমে না গিয়ে একই কথা বারবার চিৎকার করে বলতে লাগলো ইসরা। আয়মানের পা থমকে গেলো ইসরার গলা শুনে। ইসরা গলা চিনতে আয়মানের ভুল হতে পারে না, সাহায্য চাইছে শুনে মনে হলো হয়তো বিপদে পড়েছে। যেদিন থেকে আওয়াজ আসছে সেটা অনুসরণ করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে যেতে লাগলো। রাস্তা থেকে একটু ভেতরে গিয়ে একটা গাছের শেকড়ে বসে থাকতে দেখলো পা চেপে ধরে।

আয়মান সামনে দাঁড়িয়ে বললো, তুমি এখানে কী করছো ?

নির্জন জায়গায় হঠাৎ কারো আওয়াজে চমকে উঠলো ইসরা। সামনে তাকিয়ে আয়মানকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ইসরার পায়ের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো আয়মান। পায়ের কাছে বসে পা ধরতে গেলে পিছিয়ে নিলো ইসরা।

আয়মানও জোড় করে ধরে সামনে এনে বললো, পা কাটলো কীভাবে ?

ইসরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, পরে গিয়েছিলাম।

আয়মান আশে পাশে তাকিয়ে বললো, তুমি এখানে কী করতে এসেছিলে ?

ইসরা আমতা আমতা করে বললো, ঘুরতে।

আয়মান ভ্রু কুঁচকে বললো, এতোদিনে একবারের জন্যও ক্যাম্পের বাইরে যাওনি আর আজ একা ঘুরতে চলে এলে ? নাকি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে এখানে এসেছিলে ?

ইসরা কিছু না বলে বিরক্তি নিয়ে তাকালো আয়মানের দিকে আর তা দেখে আয়মান মুচকি হাঁসলো।

চলো তোমাকে ক্যাম্পে পৌঁছে দিচ্ছি।

ইসরা গম্ভীর গলায় বললো, দরকার নেই, আমি একাই চলে যেতে পারবো।

ভেবে বলছো তো ? না মানে, একটু পরই এখানে হিংস্র সব পশুর আনাগোনা শুরু হবে আর রক্তের গন্ধ ওদের কাছে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছায়।

আয়মানের কথায় ভয়ে ঢোক গিললো ইসরা। আয়মান একটু বাড়িয়ে বললেও একেবারে মিথ্যা বলেনি, জায়গাটা যথেষ্ট নির্জন। যে কোনো সময় যে কোনো বিপদ হতে পারে।

ইসরা একটু ভেবে বললো, ওকে চলুন আপনার সাথেই যাচ্ছি।

আয়মান ইসরার আড়ালে মুচকি হাঁসলো। ইসরা গাছ ধরে উঠে দাঁড়ালো কিন্তু গাছে ছেড়ে দিতেই বেসামাল হয়ে পরে যেতে নেয়। আয়মানও সুযোগের সদ্ব্যবহার হিসাবে ইসরাকে ধরে ফেলে। দেখে অনেকটা জড়িয়ে ধরার মতো মনে হচ্ছে। ইসরা দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো আয়মানের থেকে। সজ্ঞানে ইসরা কখনো কোনো ছেলের এতো কাছে যায়নি কোনোদিন। সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠেছে ইসরার।

নিজেকে সামলে ইসরা বললো, আপনি শুধু আমার হাতটা ধরুন আমি যেতে পারবো।

আয়মানও বেশি বাড়াবাড়ি না করে ইসরার হাতটা শক্ত করে ধরে আগাতে লাগলো। ইসরা এক কদম আগাতেই ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আয়মান কিছু না ভেবেই কোলে তোলে নিলো ইসরাকে।

ইসরা চমকিত কণ্ঠে বললো, আরে আরে কী করছেন ? ফেলে দিবেন তো।

তোমার মতো দু’জন একসাথে তোলার শক্তি আমার গায়ে আছে মিস ইসা।

আমার মতো দশজন তোলার শক্তি আপনার থাকলেও, আপনার কোলে থাকার একবিন্দু ইচ্ছে আমার নেই, এখনই নামিয়ে দিন আমাকে।

ইসরা নড়াচড়া করতেই আয়মান কড়া চোখে তাকালো ইসরার দিকে, একদম নড়াচড়া করবে না। বেশী তিড়িং বিরিং করলে পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দিবো। এমনই আমার পায়ের ব্যাথা এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি, তার উপর কোলে চড়ে লাফাচ্ছে।

ইসরা চুুপ করে গেলো আয়মানের ধমকের স্বরে বলা কথাগুলো শুনে।

তোমার কোনো আইডিয়া আছে, তুমি কতদূর এসেছো ?

ইসরা কৌতূহল নিয়ে বললো, কতদূর এসেছি ?

ক্যাম্প যে গ্রামে আছে, এটা তার পাশের গ্রাম। আর একটু এগুলোতেই শহরে যাওয়ার জন্য গাড়ী পাওয়া যায়।

ইসরা চমকে উঠলো আয়মানের কথায়। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে এতদূর চলে এসেছে খেয়ালই করেনি।

আর তুমি যেভাবে হাঁটছিলে, তাতে ক্যাম্পে যেতে রাত হয়ে যেতো আর রাস্তায় পাহাড়ি হিংস্র পশু আমাদের ডিনার মনে করে খেয়ে নিতো।

আয়মানের কথায় ইসরা ভয়ে শার্টের কলার খামচে ধরলো আয়মানের। পাহাড়ি রাস্তায় একজনকে কোলে তুলে হাটা সত্যি অনেক কষ্টকর, তার উপর আয়মানের পা পুরোপুরি ঠিক হয়নি এখনো। ইসরা খেয়াল করলো আয়মান অনেকটা হাঁপিয়ে গেছে।

আপনার কষ্ট হচ্ছে, আমাকে নামিয়ে দিন আমি হেঁটে যেতে পারবো।

আয়মান ইসরার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টও সহ্য করতে জানি। তার সামনে এই কষ্ট তো সামান্য।

ইসরা মুখ ঘুরিয়ে নিলো আয়মানের দিকে থেকে। ইসরার ওজন একেবারে কম নয়, ৫০ কেজি ওজন। এতোটা পথ তাকে কোলে নিয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। আয়মান অনেকটা পথ হাঁটার পর ইসরাকে একটা গাছের কাছে নামিয়ে দিলো। কোমর ধরে নিচু হয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো।

আগেই বলেছিলাম নামিয়ে দিতে।

পায়ে ব্যাথাটা না থাকলে এতোটা কষ্ট হতো না। একটু বসে নেই তারপর আবার যাওয়া যাবে।

ইসরা গাছের শেকড়ে বসেছে, আয়মানও ইসরার পাশে বসে পড়লো। আয়মানের কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে টপটপ। শীতের মধ্যেও ঘেমে গেছে দেখে ইসরার খারাপ লাগলো আয়মানের জন্য। পশ্চিম আকাশে সূর্যটা লাল হয়ে গেছে আর সেই লাল আলো আয়মানের মুখে পড়ছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে সূর্যের আলোয়। চাপ দাঁড়ির মাঝে লাল ঠোঁট দুটো আরো লাল দেখাচ্ছে। নাকের উপর জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। ইসরা এতোটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আগে কখনো দেখেনি কোনো ছেলেকে আর আয়মানকেও নয়। এক কথায় আয়মানকে সুদর্শন পুরুষ বলা চলে। নিহানের সাথে গায়ের রঙের মতো চেহারায়ও মিল নেই আয়মানের। তবে আয়মানের চেহারা অনেকটা তার মায়ের সাথে মিলে। আয়মান ইসরার দিকে তাকাতেই ইসরা চোখ নামিয়ে নিলো।

আয়মান ইসরার দিকে ঝুঁকে ফিসফিসে আওয়াজে বললো, এভাবে তাকিয়ে থেকো না, প্রেমে পড়ে যাবে।

ইসরা কড়া চোখে তাকিয়ে বললো, আনজুম ইসরার মন এতো দূর্বল নয়। মানুষের আঘাতে আঘাতে আনজুম ইসরার মনটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে।

আয়মান সামনে তাকিয়ে বললো, নরম মনের মানুষেরা ডক্টর হতে পারে না। ডক্টরদের অনুভূতি একটু কমই থাকে আর তার জন্য লাশ, রক্ত, মানুষের কান্না তাদের মধ্যে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারে না। এসব বিষয় ডক্টরদের কাছে খুব সাধারণ।

দুজনেই আবার কিছুটা সময় চুপচাপ পার করে দিলো। আয়মান আবার তাকালো ইসরার দিকে। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় অসম্ভব সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।

পড়ন্ত বিকেলে ফুলে ফুলে ভড়ে উঠা সরিষা ক্ষেত দেখেছো কখনো ?

ইসরা ভ্রু কুঁচকে তাকালো আয়মানের দিকে।

এখানে সরিষা ক্ষেত এলো কোথা থেকে ?

ইন্ডিয়ায় গিয়েছিলাম দুই বছর আগে। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের লাল আলোয় মাইলের পর মাইল সরিষা ফুল দেখে কিছু মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। আজ আবার পুরনো সেই অনুভূতির ছোঁয়া পেলাম।

ইসরা বুঝতে পারলো না আয়মানের কথার মানে, তাই আশেপাশে তাকিয়ে সরিষা ক্ষেত খুঁজতে লাগলো। আয়মান মুচকি হাঁসলো ইসরা কাজে।

বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ইসরা অবাক হয়ে বললো, বাবাহ্ ইউএস থেকে এতো সুন্দর বাংলা কবিতা আবৃত্তি ?

আয়মান মুচকি হেঁসে বললো, নিজের দেশকে ভালোবাসি আর দেশের সংস্কৃতিকেও।

কিন্তু এই মুহূর্তে এই কবিতা আবৃত্তির কারণটা বুঝতে পারলাম না।

ডাক্তারির মোটা মোটা বই পরে আমার কবিতা আবৃত্তির কারণ বুঝতে পারবে না ইসাপাখি।

ইসরা ভ্রু কুঁচকে তাকালো আয়মানের দিকে আর আয়মান শব্দ করে হেঁসে উঠলো, আমাকে এতো বুঝতে যেও না, পাথরের মতো মনটাও, মোমের মতো গলে যাবে।

আয়মান উঠে দাঁড়িয়ে বললো, সন্ধ্যা নেমে গেছে চলো যাওয়া যাক।

আয়মান আবার ইসরাকে কোলে তুলে হাঁটতে লাগলো। এবার আর তাড়াহুড়ো করে হাঁটছে না বরং নিজের মতো ধীরে ধীরে হাঁটছে। ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে মুচকি হাসি। ইসরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়মানের দিকে আর আয়মান সেটা বুঝতে পেরেও কিছু বলছে না। ইসরার কাছে আয়মানকে একদম অন্যরকম মানুষ মনে হচ্ছে। নিহান অনেকটা খাঁচায় পোষা পাখি মতো, তাকে যেমনটা শেখানো হয়েছে সে তেমনটাই চলে আর আয়মান মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখির মতো। যে সম্পূর্ণ নিজের মর্জিতে চলে, যার রাজ্যের রাজা সে নিজেই। দুজন মানুষ যেনো দুই মেরুর মতো, একে অপরের বিপরীত। ইসরা নিজের চিন্তায় এতোটাই মগ্ন ছিলো কখন ক্যাম্পে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি। ততক্ষণে সূর্যটা সম্পূর্ণ লুকিয়ে পরেছে পশ্চিম আকাশে আর চাঁদের এখনো আগমন ঘটেনি। তাই অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে আশপাশটা। আয়মান ইসরাকে নিয়ে সোজা ইসরার তাবুতে চলে গেলো। এতোক্ষণ ইসরাকে না পেয়ে সবাই চিন্তিত ছিলো আর ইমন তো প্রায় কেঁদেই দেয়। ইসরাকে আয়মানের কোলে দেখে সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। সবাই এক প্রকার ঘিরে ধরেছে ইসরা আর আয়মানকে। ইসরা তখনও আয়মানের দিকে তাকিয়ে আর আয়মান সংক্ষেপে সবটা বুঝিয়ে বললো সবাইকে। মিষ্টি ইসরার কাটা জায়গার বাঁধন খুলে ড্রেসিং করে দিতে লাগলো। মেডিসিন লাগাতেই জ্বলে উঠলো আর ইসরা আহ্ করে পায়ের দিকে তাকালো। বাথ্যায় ইসরার ছোট আর্তনাদ যেনো আয়মানের বুকে বিঁধল। ব্যস্ত হয়ে ইসরার পাশে গিয়ে বসলো।

মিষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললো, একটু আস্তে করুন, ব্যাথা পাচ্ছে তো।

ইসরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো আয়মানের দিকে, আয়মান ইসরার হাত ধরে বললো, আর একটু সহ্য করো কষ্ট করে। ড্রেসিং না করলে ইনফেকশন হয়ে যাবে আর সেটা আমার থেকে তুমি ভালো জানো।

মিষ্টির চোখ এড়ালো না ইসরার প্রতি আয়মানের কেয়ার। ড্রেসিং করা হচ্ছে, ইসরার পায়ে কিন্তু আয়মানের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ব্যাথা সে পাচ্ছে। মিষ্টি ইসরা আর আয়মানের দিকে একবার তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। রক্ত পরিষ্কার করার পর দেখতে পেলো গাছের ভাঙা চিকন একটা অংশ এখনো গেঁথে আছে। মিষ্টি খুব সাবধানে সেটা টান দিয়ে তুলে ফেললো। ইসরা ব্যাথায় আয়মানের হাত এতোটাই শক্ত করে ধরেছে তাতে ইসরার নখ আয়মানের হাতে গেঁথে গেছে। আয়মানের সেদিকে খেয়াল নেই, সে ইসরার ব্যাথায় কাতর মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে। ইসরার প্রতিটা ছোট ছোট আর্তনাদ যেনো আয়মানের বুকে বিঁধছে তীরের মতো।

মিষ্টি আয়মানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, ইসরার জীবনে মেঘের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সূর্যটা কী তবে আপনিই ? এবার কী তবে মেয়েটা একটু সুখের দেখা পাবে ? কালো মেঘে ঢেকে গেছে ওর জীবনটা, সুখগুলো বারবার ঠকিয়ে গেছে মেয়েটাকে।

চলবে,,,,