মেঘের আড়ালে সূর্য খুঁজি পর্ব-০১

0
12

মেঘের আড়ালে সূর্য খুঁজি
প্রথম পর্ব
রুচিরা সুলতানা

আমার বিয়ের প্রথম রাত কেটেছিল ,একটা ভাড়া বাসার বারান্দায়। চাঁদ দেখবো বলে নয় মোটেই। কোথাও থাকার জায়গা পাইনি বলে।

ওই বয়সেই বেশ দুঃখকষ্ট চিনে গেছিলাম।
তাই ,এই দুঃখটাও মেনে নিয়েছিলাম

পাশে ভালোবাসার মানুষ থাকলে, খুব আয়েশ করে দুঃখ উদযাপন করা যায়।

দুঃখকে কেন্দ্র করে ভালোবাসার মানুষের সাথে মনের অনেক কথা বলা হয়ে যায়, যেটা হয়তো সুখে থাকলে বলা হতো কিনা, সন্দেহ।

এমনিতে আমার আশেপাশে আপনজন খুব বেশি নেই।

চেনাজানা যে দুচারজন রয়েছে, তারা সবাই আমার গল্প শুনলে হা হয়ে যায়। বিশ্বাস করতে চায় না।

সবাই দু চারদিন বেশ আগ্রহ নিয়ে, আমার দুঃখের গল্প শোনে। তারপর আমাকে এড়িয়ে যেতে শুরু করে।

খুব তাড়াতাড়ি মানুষ বুঝতে পেরে যায়, আমার সাথে সম্পর্ক গভীর হলে, যেকোনো সময় সাহায্য চেয়ে বসতে পারি।

বহুদিন তাই, আমার গল্প কাউকে বলা হয়নি।

পাঠকের জীবন থেকে নেয়া গল্প লিখেন রুচিরা। জানি না কেন,আমারো খুব ইচ্ছা হলো তাকে নিজের গল্পটা বলার।

বাসর রাতের গল্পতে যাবার আগে, পিছনের গল্পটা বলে নেই। তা না হলে, অনেক কিছু বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে।

আমার আম্মা জন্মসূত্রে পাকিস্তানি। যুদ্ধের পরেও কিছু পাকিস্তানি পরিবার এদেশে রয়ে গিয়েছিল। আমার আম্মার পরিবার‌ও সেরকমই ।

এইধরনের পরিবারের মেয়েদের সাধারণত নিজেদের মধ্যেই বিয়ে হয়। বাইরের কারো সাথে ভাষা, পোশাক,রান্নাবান্না, নিয়মনীতি মিলে না,তাই।

আম্মা তখন মাত্র কৈশোর পার করেছে। হঠাৎ নানীর মৃত্যুতে আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সবে স্ত্রীর মৃত্যু হলো, এরমধ্যে মেয়েটা এতো অসুস্থ। নানাভাই দিশাহারা হয়ে পড়েন।ডাক্তারের পরামর্শে, আদরের মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে বের হন নানাভাই।

অচেনা পরিবেশে আম্মার শরীর,মন দ্রুত ভালো হবে…এই ভেবে, একজন বাংলাদেশী বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে আসেন নানাভাই।

আম্মা তখন অল্পবয়সী ।পাকিস্তানি মেয়ে,দেখতে বেশ সুন্দরী ।

আম্মাকে দেখামাত্র আব্বার বন্ধু এবং তার পরিবারের সবাই মিলে, বন্ধুর ছেলের সাথে আম্মার বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠে।

আব্বার পরিবার বাংলাদেশী। নানাভাইদের সাথে চালচলন, রীতিরেওয়াজ কিছুই মিলে না। বিয়েতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না নানাভাই। অনেকটা জোর করেই আম্মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি।

কিন্তু আমার আব্বা একেবারে নাছোড়বান্দা।অল্প কয়দিনের মধ্যে লম্বা দাড়ি রেখে, পাকিস্তানি কুর্তা গায়ে দিয়ে, নানাভাইয়ের বাড়ি গিয়ে হাজির। বিয়ে যদি করতেই হয়,এই মেয়েকেই করবো। না হলে সারাজীবন অবিবাহিত থেকে যাবো।

অবশেষে নানাভাইয়ের মন নরম হলো।মা মরা মেয়েটিকে তুলে দিলেন, বাংলাদেশী ছেলের কাছে।

বিয়ের পর পর, আব্বার চাকরী ছিল না। টুকটাক ব্যবসা করতেন।প্রতিমাসে কিছুদিন নানাবাড়িতে এসে থাকতেন আব্বা। তারপর চলে যেতেন।আমি এবং আমার বড় দুইবোনের জন্ম নানাবাড়িতেই
হয়। জীবনের সেই সময়টাই কেবল আমার আনন্দে কেটেছিল।
এরপর যা হয়, তা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য লাগে।

আব্বার একটা চাকরি হয় চিটাগাংয়ে। তিন মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে চিটাগাং শহরে আসেন, আমার আব্বা।
আম্মার প্রথম সংসার শুরু হয়।
প্রথম কিছুদিন ভালোই ছিল।
আস্তে আস্তে আব্বার মনে হতে থাকে,বাড়ি ভর্তি এতো মেয়ে তার ভালো লাগছে না।আম্মাকে তার ভালো লাগছে না।আম্মার রান্না তার ভালো লাগছে না। পাকিস্তানি ডাল রুটি, পাকিস্তানি সবজি বা মুরগি,গোশতের স্বাদ আব্বার বহু বছরের চেনা রান্নার সাথে মিলছে না।

তখন ইন্টারনেট বা ইউটিউবের চল ছিল না।

নানারকম শুঁটকি, ছোট মাছ, ভর্তা ,পাতলা মসুরের ডাল এগুলো আম্মা কোনদিন খাননি। আমরাও নানাবাড়ির রান্না খেয়েই অভ্যস্ত।

এছাড়াও আরো যেসব রান্নার কথা আব্বা বলতেন, সেগুলোর স্বাদ ঠিক কেমন আম্মা বা আমাদের তিন বোনের জানা নেই।তাই আব্বার মনমতো রান্না কিছুতেই করতে পারছিলাম না আমরা।

সমস্যা আরো ভয়াবহ হয়, যখন আমার চতুর্থ বোনের জন্ম হয়। আব্বা হঠাৎ ছেলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন।

আমার ছোটবোন জন্মের পর আম্মা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু আব্বার মাথায় কি চলছিল, জানিনা। আম্মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন না তিনি।

শুধু তাই নয়, বাসায় আমাদের তিন বোনের উপর শুরু হয় ভয়াবহ অত্যাচার। কথায় কথায় আমাদের প্রচন্ড মারধর শুরু করেন আব্বা।

বাড়িতে এমন একটা পরিবেশ ছিল, যেন আব্বা হলেন রাজা আর আমরা সবাই তার গোলাম।

ঠিক রূপকথার গল্পের মতো অত্যাচার হতো আমাদের
উপর। আব্বার লম্বা দাড়ি ছিল, পায়জামা পাঞ্জাবী পরতেন। কিন্তু ঠিকঠাক নামাজ পড়তেন না।

শীতের সকালে আব্বা ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমাদের রুটিন ছিল ,আব্বার হাতমুখ ধোঁয়ার জন্য গরম পানি করে রাখা। আব্বা হাতমুখ ধুয়ে বের হতে না হতেই, টেবিলে গরম গরম নাস্তা দেয়া।

আব্বা যখন নাস্তা খেতেন, আমরা তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আব্বার এরকমই আদেশ ছিল।

তার প্লেটে কিছু দিতে হবে কিনা, পানি ঢেলে দিতে হবে কিনা, এগুলো দেখার জন্য আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম। ওইটুকু বয়স আমাদের, সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশ।কি ভয় যে পেতাম আব্বাকে।

নাস্তা শেষ হবার আগেই, একজন চা ঢেলে আনতাম। আরেকজন, আব্বার গোসলের জন্য বালতিতে গরম পানি মিশিয়ে দিতো।সেই সাথে আব্বার জামাকাপড়‌ও রেডি করে দিতাম আমরা।

যে বয়সে বাবা মা মুখে তুলে খাইয়ে দেয়,সেই বয়সে আমরা তিন বোন সংসারের সব কাজ করেছি।আর প্রতিদিন দেখেছি, অসুস্থ আম্মার সাথে আব্বার ঝগড়া, মারামারি।

আমার দাদা তখন প্যারালাইজড ছিলেন।দাদী কখনো দাদাকে ফেলে কোথাও যেতেন না। অন্যান্য আত্মীয় স্বজন‌ও খুব একটা আমাদের বাড়িতে আসতো না। সবাই বলাবলি করতো, আম্মা রাঁধতে জানে না।

আমরা এভাবেই অযত্নে, অবহেলায় বড় হয়েছি।কত যে জ্বরের ঘোরে বিছানায় পড়ে থেকেছি আমরা। আব্বা কোনদিন ফিরেও তাকান নি।

আব্বা প্রতিদিন বাজার থেকে ফল কিনে আনতেন। সেগুলো আলমারিতে তালা দেয়া থাকতো। চাবি থাকতো আব্বার কাছে।
আমার সবচেয়ে ছোট বোনটা তখন একটু একটু বড় হচ্ছে।

কাঁচের আলমারিতে সাজানো ফল দেখে, সে ভীষণ কাঁদতো। ওগুলো আব্বাকে খেতে দেখতো,তাই সেও খেতে চাইতো।

আব্বাকে ফল কেটে দেয়ার সময়, ছোটবোনের জন্য ফল চুরি করতাম আমি। আব্বা অফিসে চলে গেলে, ওকে বের করে দিতাম।

বাড়িতে আব্বা থাকুক বা না থাকুক, আমরা স্বাভাবিক হতে পারতাম না ভয়ে।সপ্তাহের পাঁচদিন স্কুল থাকতো, আমাদের খুব ভালো লাগতো।আব্বার ভয়ংকর চোখ থেকে দূরে আছি…এই ভেবে,স্কুলে থাকতে কি যে ভালো লাগতো আমাদের।

আম্মা তখন ভীষণ অসুস্থ।শোয়া থেকে উঠতেই পারেন না। এদিকে নানাভাইয়ের‌ও বয়স হয়েছে অনেক।আজ যায় কাল যায় অবস্থা।

এরমধ্যে একদিন বুঝলাম, আম্মা আবার মা হবেন।

আমরা চারবোন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি, আম্মার অবস্থা দেখে। ছোট বোনটা জন্ম নেবার সময়েই ডাক্তার বলে দিয়েছিল, আম্মা যেন খুব সতর্ক থাকে।এই শরীর নিয়ে কোনোভাবেই বাচ্চা নেয়ার কথা চিন্তা করা যাবে না।

কিন্তু আমার আব্বার ছেলে চাই ,যে কোনো মূল্যে।

চলবে…