মেঘের আড়ালে সূর্য খুঁজি
তৃতীয় পর্ব
৩
আমরা চার বোনই আম্মার গায়ের ফর্সা রঙ নিয়ে জন্মেছি। যখন প্রথম চিটাগাংয়ে এসেছি, আশেপাশের সবাই আমাদের বিষয়ে বেশ কৌতূহলী ছিল। আমরা উর্দুতে কথা বলি, আমরা এত ফর্সা… প্রতিবেশীরা আগ্রহ নিয়ে গল্প করতে চাইতো।
কিন্তু আব্বা অপ্রয়োজনীয় গল্প একেবারেই পছন্দ করেন না। বিশেষত, মহিলাদের গল্পগুজব করাটা তো তার দুই চোখের বিষ। আম্মা অসুস্থ, মনমরা, ভয় পাওয়া এক মানুষ, আব্বার চড়া মেজাজ।ধীরে ধীরে পাড়া প্রতিবেশীদের আসা-যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
আম্মার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে, প্রতিবেশীরা অনেকেই ছুটে এলো। সবাই তো আমাদের বহু বছরের চেনা। শুধু যোগাযোগটাই ছিল না।
এদের মধ্যে একজন প্রতিবেশী, দুপুরবেলা সবার জন্য খাবার নিয়ে এলো।
খুব সাধারণ খাবার… আলু দিয়ে মুরগির মাংসের ঝোল আর লাউ দিয়ে ডাল। সাথে হাড়ি ভর্তি গরম ভাত।ডালের মধ্যে সম্ভবত আচার বা টক জাতীয় কিছু একটা মেশানো ছিল।
সেদিনের ভাত খাওয়ার কথা মনে হলে, আজও আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে প্লেট ভর্তি গরম ভাত আর মুরগির মাংস দেখলে, আমি কাঁদিও জানেন? সেদিনের ভয়ানক খিদার কথা মনে করে কাঁদি।
আম্মার লাশ ঘরে রেখে ,আমরা চার বোন পাগলের মত ভাত খেয়েছি। ভাত খাওয়ার মাঝখানে, মাঝে মাঝে কেঁদে উঠি, আবার ভাত খাই। চোখের পানি ভাতের সাথে, আমাদের মুখে ঢুকে যাচ্ছে।
আমার দলে দু একজন তো নিশ্চিত পাবো, যারা নিজের জীবনে উপলব্ধি করেছেন…শোক,তাপ, যন্ত্রণা, অপমান সবকিছু ,খিদার কাছে নেহাতই তুচ্ছ।
আজ গল্পটা বলতে গিয়ে মনে হলো, সেদিন ভাত খাওয়ার সময়ও আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। বারবার মনে হয়েছে…আব্বা যদি হঠাৎ এসে দেখেন, আমরা এভাবে ভাত খাচ্ছি… ভীষণ রেগে যাবেন।এই ভেবে, আরো তাড়াতাড়ি ভাত খাচ্ছিলাম আমি।
অবশ্য আব্বা দেখতে পান নি, বাড়িতে এত মানুষ, আম্মার দাফন কোথায় হবে,জানাযা কখন হবে… সেইসব নিয়ে আব্বা ব্যস্ত।
বাড়ি ভর্তি লোকজন দেখে, আম্মার মৃত্যুশোক ছাপিয়ে আমাদের ভিতরে একটা অস্বাভাবিক আনন্দ কাজ করছিল। লোকজনের ভীড়ে, আমরা কেমন একটা নিরাপদ বোধ করছিলাম। মনে হচ্ছিল,এই ভীড় যদি চিরস্থায়ী হতো… ভীড়ের মধ্যে, আমাদের চারবোনকে যদি কখনো আর খুঁজে না পেতো আব্বা, কতো ভালো হতো।
আম্মা অনেকদিন থেকেই তো অসুস্থ ছিলেন। আমরা জানতাম আম্মা সবসময় চেয়েছেন, তার কবর যেন নানীর কবরের পাশে হয়।
নানাভাইকেও নানীর পাশে দাফন করা হয়েছে। আম্মাকেও সেখানেই দাফন করার কথা। কিন্তু আব্বা হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলালেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, নানাভাইয়ের বাড়ি যেতে।ভয় অসৎ মানুষের পিছু ছাড়ে না।
মোবাইলের তখন অল্প অল্প ব্যবহার শুরু হয়েছে।
এতো অল্পবয়সে আম্মার মৃত্যুটা , আমাদের পাকিস্তানী আত্মীয়-স্বজন, পাড়ার লোকজন ঠিক মেনে নিতে পারছিল না। সবাই বুঝতে পেরেছিল ,এই মৃত্যুর জন্য আব্বার অবহেলা অনেকটাই দায়ী।
আব্বাও বুঝে গেলেন…আম্মাকে দাফন করার জন্য নানাবাড়িতে নিয়ে গেলে, সেখানকার লোকজন তার উপর চড়াও হবে ।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, দাদার বাড়িতেই নেয়া হবে আম্মাকে।
সন্ধ্যার আগেই আমরা রওনা হলাম।
তখন পর্যন্ত দাদার বাড়ি আমাদের কাছে বেশ অচেনা।
সেখানে আমাদের আসা যাওয়া ছিলো না ,কোনো কালেই।
আম্মার বিয়ের পরপরই, নানাভাই এবং দাদার বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়।
অল্পদিনের মধ্যেই নানাভাই বুঝতে পেরেছিল, তার একমাত্র আদরের মেয়েকে বিয়ে করতে চাওয়ার পিছনে, বন্ধুর পরিবারের উদ্দেশ্য অতোটা সরল নয়।
কাছে না এলে, মানুষ চেনাটা সহজ নয় তো।
বিয়ের আগে মেহমান হয়ে এসে যে আতিথেয়তা আম্মা পেয়েছিলেন,বউ হয়ে এসে ঠিক তার উল্টোটা পেলেন।
তখন আব্বার চাকরী ছিল না। দাদা দাদী ধরেই নিয়েছিলেন, আম্মা যেহেতু নানাভাইয়ের একমাত্র মেয়ে তাই তার খরচ বাবদ প্রতি মাসে কিছু টাকা পয়সা দাদার হাতে আসবে। মেয়েজামাই চাকরি না করলে, শ্বশুর দেখবে এটাই তো স্বাভাবিক।
নানাভাই অবশ্য তাতে আপত্তি করেননি প্রথমে।
কিন্তু দাদার বাড়িতে আম্মার কষ্ট হতো খুব। খাওয়ার কষ্ট, ঘুমের কষ্ট। খুব অল্প বয়স তখন , এরমধ্যে বড়আপু আম্মার পেটে।
দাদার বাড়িতে নিয়ম ছিল, সবার খাওয়া শেষ হলে তারপর বাড়ির বউ খাবে। বেশিরভাগ দিনই তরকারি শেষ হয়ে যায়। আম্মার খাওয়া দাওয়া কেউ খেয়াল করে না। তাছাড়া তরকারিতে এতো ঝাল দেয়া, আম্মা কিছুতেই পেট ভরে খেতে পারেননা।
‘মেয়েদের যত্ন লাগে ‘ বিষয়টা, দাদার বাড়িতে একেবারে অকল্পনীয়।
নানাভাই বুঝতে পেরে, মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যান। এতো আদরের মেয়ে, বয়সও কম। এরমধ্যে পরপর তিন বাচ্চা জন্ম নিলো।নানাভাইয়ের মনের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করতো, তিনিই তো দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছেন মেয়েকে।
তার সুখের কথা ভেবেই, তিন নাতনিসহ মেয়েকে আর শ্বশুর বাড়িতে পাঠাননি।
সেই নিয়েই দাদার রাগ! মেয়ে নিয়ে নানা ভাইয়ের এতো আদিখ্যেতা কেন? সে শ্বশুর বাড়িতে থাকবে, দিনরাত খাটাখাটনি করবে, সবার সেবা যত্ন করবে, তা না হলে কিসের মেয়েমানুষ?
দুই দেশের দুই বন্ধুর চিন্তায় এতো ফারাক, বন্ধুত্বের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট রইল না।
তখন পর্যন্ত আম্মাকে ভালোবাসতেন আব্বা।
পরবর্তীতে যখন আমরা চিটাগাংয়ে আসি,দাদা দাদী চাইলেন না আম্মা ওখানে যাক। বললেন,
“এতো বছর শ্বশুর বাড়িতে আসে নাই যখন, এখন আর আসার দরকার নাই। বছর বছর একটা করে মেয়ে জন্ম দিয়েই এতো দেমাগ… দরকার নাই এমন বউ”।
আমরা ছেলে হলে হয়তো ,তাদের এতো রাগ থাকতো না।
এরমধ্যে দাদাও প্যারালাইজড হয়ে যান।
ঈদে,বা ছুটিছাটায় আব্বা একাই দাদার বাড়িতে যেতেন। আম্মা নিজেও চাইতেন না শ্বশুর বাড়িতে যেতে। ওদের সবাইকে আম্মা ভীষণ ভয় পেতেন।
আম্মার শরীরে আজ প্রাণ নেই।সব ভয়-ভীতির উর্ধ্বে আম্মা।আজ আর দাদার বাড়ি যেতে কোনো বাঁধা নেই।
একটা ট্রাকে করে আম্মাকে নিয়ে আমরা দাদার বাড়ি এলাম। তখন রাত প্রায় বারোটা।
বাড়ির সামনে অল্প কিছু লোকজন অপেক্ষা করছিল।
আমরা বাড়িতে ঢোকার কিছু সময়ের মধ্যে, পাড়ার অনেক লোক এসে বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল।
এতো অচেনা লোকজন , কারো চেহারায় আম্মার জন্য কোনো দুঃখ নেই। কারো চোখে একফোঁটা পানি নেই।
সবার চোখে শুধুই কৌতূহল, আমাদের চার বোনকে ঘিরে।
ফজরের পর আম্মার সবকাজ শেষ হলো।
শুনলাম…কেউ যেন চাপা গলায় বলছে, মেয়েগুলো এখন থেকে এখানেই থাকবে।
চলবে…