মেঘের আড়ালে সূর্য খুঁজি পর্ব-০৪

0
11

মেঘের আড়ালে সূর্য খুঁজি
চতুর্থ পর্ব

রাতভর সবাই মোটামুটি জেগে ছিল। সকালের দিকে কিছুক্ষণের জন্য বিছানায় গিয়েছে। আমরাও একটা ঘরে শোবার জায়গা পেয়েছি।

ছোটবোনটা শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকি, আমাদের তিন বোনের কারো চোখেই ঘুম নেই।

দাদার বাড়িতে,একটা উঠানের তিন পাশে তিনটা বাড়ি। একটা বাড়ি অনেক পুরোনো আর বাকি দুইটা বাড়ি পরে বানানো হয়েছে। পুরোনো বাড়িটা দাদার বানানো।ওটার কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে একেবারেই ছোট হয়ে গেছে।এই ছোট্ট বাড়িতেই ,দাদা দাদী থাকেন।

বাকি দুইটা বাড়ি আমার দুই চাচার। দু’জন ই আব্বার বড় ভাই।আব্বা এখনো কোনো বাড়ি বানাননি। যখন বানাবেন, তখন পুরোনো বাড়িটা পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হবে।চাচাদের বাড়িগুলোও সেরকম বড় নয়, তবে খোলামেলা। চারপাশে অনেক গাছ।

জানালার বাইরে তাকিয়ে মনে হলো, দাদার বাড়ি আমার কাছে খারাপ লাগছে না। এখানে থাকলে ভালোই হয়।

দাদী আমাদের চার বোনের সাথে খুব সহজ গলায় কথা বলেছেন। তাকে বলতে হয়নি, কার নাম কি। উনি ঠিক ঠিক চিনতে পেরেছেন, যেন আগে বহুবার দেখেছেন।

দাদার প্যারালাইজড শরীরটা পুরোপুরি অচল নয়। আগের চেয়ে ভালো আছেন এখন।কারো সাহায্য পেলে, তিনি নড়াচড়া করতে পারেন। উঠে বসতে পারেন।লাঠি দিয়ে অল্প হাঁটতেও পারেন। কষ্ট হয়, তবে পারেন।

দুই চাচার স্বভাব এবং চেহারা আব্বার মতোই ।চাচীদের সাথে সেরকম কোন কথা হয়নি। আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে অনেকেই এসেছিল রাতে। তাঁরাও সম্পর্কে আমাদের আত্মীয়।

এতো মানুষ অথচ আম্মার জন্য কারো চোখে পানি দেখিনি আমি। আমাদের জন্য‌ও কৌতুহল দেখেছি, ভালোবাসা কিংবা স্নেহ নয়।

দুই চাচার‌ই তিনজন করে ছেলে আছে। বড়চাচার একটা মেয়েও রয়েছে, আমার কাছাকাছি বয়সী। ওর ঘরেই শোবার জায়গা পেয়েছি আমরা।

এখানে একটা ঘর থেকে জানালা দিয়ে সবগুলো ঘর দেখা যায়।কে কোন ঘরে হেঁটে যাচ্ছে,কে বাইরে কাজ করছে সব।

উঠানের একপাশে একটা রান্নাঘর। সবার জন্য একটাই রান্নাঘর কিনা জানিনা, তবে দুই চাচী একসাথে কিছু একটা করছে। এই বাড়িতে মেয়ে ব‌উদের বিশ্রামের নিয়ম বেশ কড়া।তাই সারারাত জেগেও, চাচীরা এখন রান্নাঘরে। ওরা কি করছে, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।

যতটুকু শুনতে পেয়েছি, সকালে বাড়িতে রান্নার প্রয়োজন হবে না।পাশের কোনো ঘর থেকে, সকালের নাস্তার জন্য খিচুড়ি পাঠানো হবে।

অবশ্য দুপুরের কথা জানিনা।

রান্নাঘরে ওদের আসা যাওয়া দেখতে দেখতে, আমার চোখ লেগে এসেছিল ।বড় আপুরা ঘুমিয়েছে নাকি জেগেই ছিলো, ঠিক মনে করতে পারছি না আর আজ।


দাদার বাড়িতে আমাদের রেখে, আব্বা চিটাগাং ফিরে গেছেন। তার অফিস রয়েছে।

আমরা কোথায় থাকবো, এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।তবে, আপাতত এখানেই থাকবো কিছুদিন। আব্বা অফিসে চলে যাবেন,খালি ঘরে মেয়েদের থাকা নিরাপদ নয়, তাই।

ঠিক হলো,আমি আর আমার ছোটবোন দাদা দাদীর ঘরে থাকবো এবং খাবো।বাকি দুই বোন, দুই চাচার বাড়িতে ঘুমাবে ও খাবে।এই কঠিন ভাগ বাটোয়ারা করতে গিয়ে, কয়েকদফা ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে।

বয়সের পার্থক্য খুব কম হবার কারণে, ছোটবেলা থেকেই আমার বড় দুই বোন একই ক্লাসে পড়েছে। ওরা দুজন ক্লাস টেনে পড়ে আর আমি ক্লাস এইটে উঠেছি।বড় দুই বোনের সবসময় একসাথে লেপ্টে থাকার অভ্যাস। এখন দুইজন আলাদা বাড়িতে থাকবে শুনে কান্নাকাটি করছে ।
কিন্তু চারবোনকে একসাথে রাখা, কারো পক্ষেই তো সম্ভব নয়। এতো জায়গাও নেই কারো ঘরে।

আমাদের ছোটবোনটা মাত্র ক্লাস ওয়ানে পড়ে। জন্মের পর থেকে, আমার সাথেই বেশি ঘেঁষে থাকে ও। আমরা দুজন একঘরেই থাকবো দাদা দাদীর সঙ্গে,শুনে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম।

তবে, এই ব্যবস্থা একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। কেউ আমাদের দায়িত্ব নিয়ে খুশি নন। আব্বা বলে গেছেন, বিয়ের জন্য খোঁজ খবর করতে।

আম্মার মৃত্যুর গন্ধ বাড়িতে থাকতেই,বিয়ের আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।এক, আব্বার বিয়ে। দুই ,বড় আপুদের বিয়ে। যদি সম্ভব হয়, আমাকেও বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে।

শুনেছি, এরমধ্যেই বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হয়েছে। আমাদের গায়ের রং ফর্সা তো,তাই অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছিলো।

অল্প সময়ের মধ্যে এতো কিছু ঘটে যাচ্ছে…আমরা কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।বুঝতে পারছি না, ঠিক কোথায় থাকলে আমরা নিরাপদ থাকবো।ভালো থাকার চিন্তা আপাতত বাদ দিয়েছি। নিরাপদে থাকতে পারাটাই এখন একমাত্র চাওয়া।

এতবছর নানাভাইয়ের কাছে থেকেছি,আব্বা আম্মার কাছে থেকেছি। আব্বার অনেক রকম যন্ত্রণা সহ্য করেছি, কিন্তু সেগুলোর মধ্যেও এতোটা অনিরাপদ কখনো লাগেনি।যতটা এই ক’দিনে লাগছে।

আম্মার মৃত্যুর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই, আমাদের তিন বোনের ভয়াবহ কিছু অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। এমন কিছু যে হতে পারে জানাও ছিল না ।আমাদের জানা ছিল না , মেয়েদের জীবনে যন্ত্রণা ঠিক কতভাবে আসতে পারে।

আমরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছিলাম।

না, বাড়িতে বাইরের কোনো লোক আসে নি। সবাই নিজেদের লোক। খুব তাড়াতাড়ি বুঝে গেছিলাম, মানুষের চেহারায় থাকা কিছু পশুদের হাতে এসে পড়েছি আমরা। যদি বাঁচতে চাই,খুব সাবধানে থাকতে হবে । একটু অসতর্ক হলেই, মারা যাবো।

বুঝে গেছিলাম…আমাদের চারপাশের চেনাজানা আট দশটা পরিবারের সাথে, এই পরিবারের মিল নেই।এই পরিবারে অন্ধকার জমাট বাঁধা।

জন্মের পর থেকে, নানাভাইয়ের ভালোবাসা পেয়েছি। যতদিন তার কাছে ছিলাম,বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন ,আমাদের তিন বোনকে। শুধু তাই নয়, ছোট থেকে শিখিয়েছেন সত্যি কথা বলতে হবে, ধৈর্য্য ধরতে হবে,গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, সৎ থাকতে হবে, অন্যের জিনিসে লোভ করা যাবে না …

দাদার কাছে কখনো আসিনি যদিও, তবু কল্পনায় তাকে নানাভাইয়ের মতোই ভেবে রেখেছি। কিন্তু সেটা যে কত বড় ভুল,তা বুঝতে সময় লাগে নি।

দাদা দাদীর ঘরটা যে খুব বড় নয়, সেটা তো আগেই বলেছি। ঘরটাতে মাত্র দুটা রুম। একটা রুমের প্রায় পুরোটা জুড়ে, বড় একটা বিছানা পাতা। দাদা দাদী সেই বিছানায় ঘুমান।অন্য রুমে একটা বড় পুরনো টেবিল, কিছু চেয়ার, কাঠের আলমারি, চালের ড্রাম এগুলো রাখা।

আব্বা চলে যাবার পর…প্রথম দাদা দাদীর ঘুমাতে এসেছিলাম ,ছোট বোনকে নিয়ে। আমরা দু’জন বড় বিছানাটায়, দাদা দাদীর সঙ্গেই শুয়েছি। একটাই তো বিছানা তাদের।

প্রথমে দাদা, তারপর দাদী, তারপর আমার ছোট বোনটা আর সবার শেষে আমি শুয়েছি।

দাদী খুব ভোরবেলাতেই উঠে গিয়েছিলেন। এতো ভোরে কোথায় গিয়েছিলেন, কে জানে?আমার ছোটবোনটা, ঘুমের মধ্যে বালিশ থেকে সরে গিয়েছিল। হঠাৎ মনে হলো ,কেউ একজন আমাকে পেছন থেকে চেপে ধরে আছে।

জীবনে প্রথমবার, পুরুষাঙ্গের স্পর্শের সঙ্গে পরিচিত হলাম আমি। দাদা তার আধমরা, প্রায় অচল শরীরটা নিয়ে আমাকে পিছন থেকে চেপে ধরেছে।

চিৎকার দিয়ে এক ধাক্কায় নিজেকে ছাড়িয়ে, বিছানা থেকে নেমে গেলাম আমি।

একদৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মনে হলো, নিমু ওখানেই তো রয়ে গেছে। আমার ছোট বোনের নাম, নিয়ামাহ। আদর করে নিমু ডাকি।
দৌড়ে এসে নিমুকে টেনে তুলেছি।

ছোট্ট নিমু, গভীর ঘুম থেকে এইভাবে জেগে…সে কি কান্না!

আমি নিজেও ভয়ে কাঁপছিলাম। বোনকে জড়িয়ে একটা চেয়ারে বসে কাঁপছি আর বোনের কান্না
থামাচ্ছি।

দাদীর কোনো সাড়াশব্দ নেই।

কিছুটা সময় এইভাবেই কাঁপছিলাম … তারপর,চেয়ারে বসেই বমি করে দিলাম আমি।

একটু পরে, দাদী ঘরে এলেন। কি হয়েছে, কিছুই বলতে পারছিলাম না। ঘোরের মধ্যে ছিলাম কেমন… মনে হচ্ছিলো, দাদার সঙ্গে রাগারাগী করছেন দাদী।

বড় আপুদের সাথে কথা বলে জানলাম, ওদের অভিজ্ঞতা আরো ভয়াবহ। তিনটা বাড়িতে, মোট নয়জন পুরুষ আছে, তারা সবাই একেকটা রাক্ষস।

এতো বছরে… আব্বার কাছে, পুরুষের প্রভুত্ব দেখেছি। এখানে এসে পশুত্ব চিনলাম ।

দুই চাচা অবশ্য আপত্তিকর কিছু করেননি। চাচাতো ভাইদের সবাই যে আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছে, তাও নয়। তবে কারো চোখেই ,আমাদের জন্য সম্মান দেখিনি।কারো চোখে মনুষ্যত্ব দেখিনি। ওরা সবাই যে এক, সেটা বুঝে গেছিলাম।

শুধু বুঝতে পারছিলাম না, কার কাছে বলবো? পুরুষ তো সবাই এক। মহিলারা কি আমাদের কথা বিশ্বাস করবে? নাকি উল্টো আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপাবে? আব্বা শুনলে কি বলবেন?এইধরনের কথা কিভাবে বলতে হয়, তা-ও তো জানিনা আমরা।

দুই সপ্তাহ পর, আব্বা এলেন।
আমরা আব্বার পা জড়িয়ে কান্না শুরু করে দিলাম।
বললাম, চিটাগাং ফিরে যেতে চাই।

আব্বার মন নরম হলো না, এবারেও।উল্টো আমাদের উপরেই রেগে গেলেন।

দাদী আমাদের বুঝিয়ে শান্ত করলেন। বললেন, আব্বার বিয়ের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। বিয়েটা হয়ে গেলেই, আব্বার কাছে চলে যেতে পারবো আমরা। তখন আর একা ঘরে থাকতে হবে বলে, চিন্তা করতে হবে না আব্বাকে।

দাদী জানতেন, এই এতো লোকের মাঝখানে থেকেও আমরা নিরাপদে নেই।

আব্বা বললেন,ভদ্র মেয়ের মতো সবার কথা শুনে চলতে।বাড়িতে থেকে, দাদী আর চাচীদের কাছে বাংলাদেশী রান্নাবান্না আর কাজকর্ম শিখে নিতে। যেন বিয়ের পর কোনো অসুবিধা না হয়।

কাজ তো আমরা করছিলামই। দুই চাচীই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমাদের থাকা খাওয়া বাবদ আব্বা কোনো টাকা পয়সা দিচ্ছেনা।তাই, মেহমান সেজে থাকার চিন্তা যেন না করি।

দাদী আমাদের সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেননি।
এতোগুলো মানুষের মধ্যে… একমাত্র দাদীর কাছ থেকেই, একটুখানি ভালোবাসা পেয়েছিলাম।তাই হয়তো, মরে যাইনি আমরা।

নাকি, মরেই গিয়েছিলাম?

সারাদিনে বহুবার… আমরা চার বোন, দূর থেকে আম্মার কবরের দিকে তাকিয়ে থাকি। কান্না সামলানো শিখছিলাম, একটু একটু করে। আরো শিখছিলাম, নিজেদেরকে বাঁচাতে… লালসার চোখ থেকে।

চলবে…