মেঘের আড়ালে সূর্য খুঁজি
শেষ পর্ব
৬
ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছি আমরা। নাস্তা খেয়েই বাসা খুঁজতে শুরু করবো। আজকে দুজনের ছুটি আছে।একটা বাসা যেকোনো ভাবে খুঁজে বের করতেই হবে।
বিয়ের সিদ্ধান্ত নেবার পর থেকেই, কিছু টুলেট লাগানো বাসা দেখে রেখেছিলাম। যদি কোনো ভাবে রাশেদ বাসা নিতে রাজি হয়ে যায়, সেই ভেবে। সেটা এখন কাজে লাগবে মনে হচ্ছে।
অবশ্য বিষয়টা একটু অন্যরকম হয়ে গেল।যা নিয়ে মনে ভয় ছিল, তাই করতে হবে।বাসা নিয়ে আমাকে একাই থাকতে হবে।রাশেদ ওর সময় সুযোগ বুঝে চলে আসবে। যতদিন অফিসে জানানো না হচ্ছে, ততদিন পুরোদমে সংসার শুরু করতে পারবো না।
সকাল এগারোটার মধ্যে, অনেকগুলো বাসা দেখে ফেলেছি। তিন রুমের বাসাই বেশি। দুই রুমেরও বাসা পেয়েছি, কিন্তু প্রচুর ভাড়া। এক রুমের বাসা পেলে আমাদের জন্য ভালো হয়।না পেলে, দুই রুমেরই নিতে হবে আপাতত।
সারারাত না ঘুমিয়ে রাশেদের চোখ লাল হয়ে গেছে।
দু’জন মিলে আরেকবার চা খেয়ে নিলাম।
ধরেই নিয়েছিলাম,নিজেদের মন মতো বাসা মাত্র একদিনে পাওয়া যাবে না।
ঠিক তখনই, বাসাটা পেলাম। তিন রুমের একটা সুন্দর বাসা। দুইটা বেড রুম আর একটা ছোট্ট ডাইনিং স্পেস।
একটা ফ্যামিলি আছে সেখানে।তারাও আমাদের মতো নতুন বিয়ে করেছে। ওদেরও টাকাপয়সার ঝামেলা, তাই একটা বেডরুম সাবলেট দিতে চায়। ডাইনিং টা কমন থাকবে।
আমি তো মহাখুশি।একা থাকতে হবে না আমাকে।
রাশেদের মন এখনো খারাপ। রাতের অপমান, সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
তাছাড়া সারাদিন ডিউটি করে, সারারাত বারান্দায় বসে থেকেছে। এরপর, সকাল থেকে বাসা খোঁজা চলছে। টায়ার্ড লাগাটাও তো স্বাভাবিক।
আমার শরীর,মন সব ঠিক আছে। নতুন সংসারের আনন্দে, আমার মন ভরে আছে।সারারাত জেগেও ক্লান্ত লাগছে না। মন খারাপ তো মোটেই লাগছে না।
সত্যি এটাই যে, নিজের বিয়ে নিয়ে কখনো কোনো স্বপ্ন দেখিনি আমি। চেষ্টা করেও নিজের বিয়ের কোনো ছবি, কল্পনায় আঁকতে পারতাম না আমি। মনে মনে একাই ছটফট করতাম। ভাবতাম…না জানি কেমন হবে, আমার বিয়ের দিনটা।
সেরকম কোন স্বপ্ন সাজাইনি বলেই, আমার খুব একটা কষ্ট হয়নি। শুধু রাশেদের মুখের দিকে তাকিয়ে, একটু লজ্জা লাগছিল। নিজের বাবা তাঁর মেয়ের সাথে এরকম করতে পারে, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে।
বাইরে ডেকে এনে আমাকে বললো,
__ সব জেনেই তো তোমাকে বিয়ে করেছি। আমার কাছে কিচ্ছু গোপন করতে হবে না। সত্যি করে বলো,ইনি কি তোমার আপন বাবা?
আমি মনে মনে ভাবছিলাম, এইটুকু দেখেই এতো অবাক হয়ে গেলো রাশেদ। যদি সারাজীবনের ছবিগুলো দেখাতে পারতাম।
রাতে বারান্দায় বসে রাশেদ বললো,
__ সারাজীবন একসঙ্গে থাকবো তো… তাই, একটা কথা জানিয়ে রাখছি।এই ভদ্রলোককে, বাকি জীবনে কোনোরকম সাহায্য করতে পারবো না আমি।যত বড় বিপদই হোক না কেন।
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
রাশেদের মুখে সারাজীবন একসঙ্গে থাকার কথাটা শুনে, বুকটা আনন্দে ভরে গেলো। ওর কাঁধে মাথা রেখে, শক্ত করে হাতটা ধরলাম। সারাজীবন একসঙ্গে থাকবো আমরা… ভেবে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
অন্ধকারে, চোখের পানি দেখতে পাবে না রাশেদ।তাই, আটকানোর চেষ্টাও করছি না।এতো সুখের অশ্রু, আমার জীবনে আগে আসেনি।
রাশেদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিলো… আব্বার এখানে না এসে, বড় আপুর ওখানে চলে গেলেই ভালো হতো।আপু আর ভাইয়া চেয়েছিলেন, বিয়েটা ওদের ওখানে হোক। অথবা এখান থেকে বিয়ে সেরে, সোজা ওখানে চলে যাই।ওখানে সবাই মিলে, আনন্দ করা যাবে।নিমু তো আছেই,মেজো বোনও চলে যেতো ওখানে।
মেজো বোনটা প্রেগন্যান্ট।ডেট খুব কাছে।বড় আপুর বাড়িতে বিয়েটা হলে, এই শরীর নিয়েও নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারতো। বিয়ের পর থেকে একবারও দেখা হয়নি ওর সাথে। অনেক ভেবে, বড় আপুর ওখানে আর গেলাম না।
আমার আর রাশেদের কাছে যেটুকু টাকা আছে, বাসা নেয়া এবং তার পরবর্তী খরচের জন্য রেখেছি। এছাড়া দুজন মিলে একটু ঘুরতে যাবো ভেবেছি। বিয়েতে খরচের বাজেট নেই, আপাতত। সবাই মিলে আনন্দ করার লোভ, সামলে নিয়েছি তাই। তাছাড়া ছুটি নিলেই তো বেতন কাটা যাবে। সুপারশপে এমনি এমনি ছুটি পাওয়া যায় না।
সাক্ষী, উকিল এইসবের বন্দোবস্ত শাহাদাত ভাই করেছেন । উনি এসেছিলেন, উনার ছোটমামা আর দুইজন বন্ধু নিয়ে। বিয়ের পর একসাথে খাওয়া দাওয়া করে, উনারা চলে গেছেন। আমাদের ডিউটি ছিল বলে, বেশিক্ষণ থাকেননি।
অফিসে বিয়ের কথা গোপন রাখতে চাইছে রাশেদ।ছুটি না চাওয়ার এটাও একটা কারণ।
এমনিতেই ,রবিবার আমাদের দুজনের অফ ডে। রবিবারটা হাতে রেখে, বিয়ের ডেটটা শনিবারে করেছিল রাশেদ।
টাকাপয়সা বাঁচাতে গিয়ে , আপুদের ওখানে গেলাম না। এখন সারারাত বারান্দায় বসে, মশার কামড় খাওয়া ছাড়া উপায় কি।
আব্বার বিষয়টা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
তিনি সবসময় ভয়ে থাকেন।জমি বিক্রির টাকাটা ব্যাংকে আছে। চেকবই কোথায় রাখা, সেটাও আমি জানি।টাকাটা তো জালিয়াতি করে নেয়া।ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক।কখন তার গলায় ছুরি ধরে, মেয়েরা সেই টাকা নিয়ে যায়, এই চিন্তায় অস্থির আব্বা।তাই ঘরে জায়গা দেননি আমাদের। বারান্দায় রেখে, ভিতর থেকে ছিটকিনি টেনে দিয়েছিলেন।
রাতটা সত্যি খুব কষ্ট হয়েছে রাশেদের।
এখন বাসা পেয়ে, ছেলেটা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
চাইলে আজকেই নতুন বাসায় উঠতে পারবো জেনে, ছুটলাম মার্কেটে। বিছানা,বালিশ,তোশক তো আজকেই লাগবে।বাকি যতটা পারি, কিনে এনে একেবারে রেস্ট নিবো।
রাতের মধ্যে, মোটামুটি বাসা গুছিয়ে এনেছিলাম আমি।
তখনই রাশেদ বাইরে থেকে, খাবার কিনে নিয়ে ঢুকলো। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
__আজকে যদিও পোলাও বিরিয়ানি খাবার দিন, কিন্তু আমি ভারী খাবার আনি নি। সারারাত ঘুম নেই আর সারাদিনে এতো কিছু করলাম। মাথা ঝিমঝিম করছিল।ভারী খাবার মুখে রুচবে না, আজকে ।কি বলো?তাই আমার প্রিয় হোটেল থেকে, ভাত নিয়ে এলাম। সাথে ঝোল ঝোল মুরগির মাংস আর লাউ দিয়ে ডাল।এই দোকানের লাউ ডালটা একবার খেলে, ভুলতে পারবে না।কম তেল দিয়ে রান্না, আবার আচারের মতো টক স্বাদ।
আমি কাজ বন্ধ করে, রাশেদের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।চোখ ছলছল করছে আমার। শরীরটাও কেঁপে উঠেছে।
রাশেদ ভাবলো, পোলাও রোস্ট আনেনি বলে ,আমার মন খারাপ হয়ে গেছে।
আমার জীবনে ঝোল ঝোল মুরগির মাংস আর লাউ ডালের ঘটনা, তার জানা নেই।
আম্মার প্রাণহীন শরীরটা, চোখের সামনে ভেসে উঠলো… অনেকদিন পর, সেই ছবি ভেসে উঠলো।
ইশ!কি কষ্ট…! সেই ছবিতে কি যে কষ্ট…!
৭
আমাদের বিয়ের আট মাস পেরিয়ে গেছে।
এই আট মাসে, আমার সারাজীবনের সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে রাশেদ। স্বপ্নের মতো দিন কাটছিল আমাদের।
বিয়ের কথা এখনও অফিসের কেউ জানে না।
শুধু একটা কানাঘুষা চলছে, আমাদের নিয়ে। সবাই বুঝতে পারছে, আমাদের মধ্যে কিছু একটা চলছে।
আমি চিরকাল চুপচাপ স্বভাবের। দরকারের বেশি একটা কথাও বলি না।তাই আমার মুখ থেকে, কিছুই বের করতে পারেনি কেউ।
অবশ্য আমি বিয়ের কথা গোপন রাখতে চাই না। সমস্যাটা রাশেদের, বিয়ের বিষয়টা জানালে ওর নাকি ঝামেলা হবে। সে সুযোগ বুঝে জানাবে,সেই অপেক্ষায় ছিলাম আমি।
এরমধ্যে একদিন, তামান্না আপু আমাকে ডেকে পাঠালেন। উনি এখানকার সবচেয়ে সিনিয়র স্টাফ। ভীষণ পরিশ্রমী এবং সৎ । সবাই তামান্না আপুকে সম্মান করে।
আপু বললেন,
__তোকে একটা কথা বলি, কিছু মনে করিস না।
বুঝতে পারছি,রাশেদের সাথে তোর কিছু একটা চলছে। তুই তো নতুন, অনেক কিছুই জানিস না।তাই বলছি, যতটুকু সম্পর্ক গড়িয়েছে ততটুকুতে থেমে যা।এই ছেলে একদমই সুবিধার নয়। বড় ভাইয়ের জোরে চাকরিটা পেয়েছে ঠিক ই। কিন্তু ওর চাকরি আর বেশি দিন থাকবে না।অসৎ লোক সবাইকেই ধোঁকা দেয়।সে বন্ধু হোক বা প্রেমিকা।
সুপারশপের ঠান্ডা রুমে বসেও, আমার শরীরটা ঘেমে
উঠলো।
__ রাশেদের বড় ভাই কে? চাকরি থাকবে না কেন?
___তুই জানিস না?রফিক স্যার, মানে আমাদের ম্যানেজার রফিকুল আলম স্যার তো রাশেদের বড় ভাই। তোদের এতো ভালো সম্পর্ক, এই কথাটাও বলেনি?এই কথা গোপন রেখেছে কেন? রফিক স্যারের জন্যই চাকরিটা পেয়েছে রাশেদ।তা না হলে, ওর তো অনার্সও কমপ্লিট হয়নি। গ্রামের বাড়িতে ওর নামে কি একটা পুলিশ কেইস আছে।ওখান থেকে পালিয়ে, এখানে এসেছে। রফিক স্যারের কতো পাওয়ার এখানে,জানিস তো। রাশেদ ছেলেটা একেবারেই ভালো নয়। লাস্ট কয়েকমাসে,একাউন্টসে প্রচুর গরমিল পাওয়া গেছে। ওর উপর নজর রাখা হচ্ছিলো, এতো দিন। এখন প্রমান হাতে আছে।ওর চাকরি কোনভাবেই থাকবে না।
রফিকুল আলম সাহেব আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন।উনিই আমাকে সিলেক্ট করেছেন। রাশেদের কাছে কতবার সেই গল্প বলেছি। একবারও বলেনি তো, উনি তার আপন বড়ভাই। রফিক স্যার অবশ্য এখানে আসেন না খুব একটা। হেডঅফিসে বসেন উনি। কিন্তু আপন ভাইয়ের কথা গোপন করলো কেন? আমাদের বিয়ের কথা বড় ভাইকেও বললো না? রাশেদ বলেছিল, ওর পরিবারে সেরকম কেউ নেই। বাবা মা বেঁচে নেই। ভাই-বোন কেউ নেই।সব মিথ্যে কথা?
আর একাউন্টসে গড়মিল! কেইস! অনার্স কমপ্লিট করে নি! বলছে কি, তামান্না আপু এইগুলো?
দুইদিন যাবৎ, শরীরটা ভালো নেই আমার। দুই সপ্তাহ আগেই পিরিয়ডের ডেট পার হয়ে গেছে। যাবার সময়, প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট কিনে নিয়ে যাবো ভেবেছিলাম। তামান্না আপুর কথা শুনতে শুনতে, চোখে অন্ধকার দেখছিলাম আমি।
বলতে পারলাম না আপুকে, সম্পর্ক থেকে ফিরে আসার মতো জায়গায় আমি নেই।
৮
আমাদের বিয়ের কথা জানাজানি হয়েছে অফিসে। আমার চাকরি থাকলেও, রাশেদেরটা চলে গেছে।
ওর বড় ভাই বলেছেন, রাশেদকে চোখের সামনে দেখলেই পুলিশে ধরিয়ে দিবেন।
রাশেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। শুধু যে একাউন্টসে গড়মিল, তা নয়। ওখানকার বেশ কিছু মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এখানেই শেষ নয়, রাশেদ আগে বিয়ে করেছিল। দুই সন্তানও আছে। প্রথম স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দিয়েছে, এবং বেশ কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে কেইস করেছে। পুলিশকে টাকা পয়সা দিয়ে, এখানে পালিয়ে আছে সে।
আমি কি করবো, বুঝতে পারছিলাম না। প্রেগন্যান্সি টেস্টের রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে, তাই আত্মহত্যা করাটাও সহজ নয়।
কি করবো আমি?কি করতে পারি আমি? কতটুকু ক্ষমতা আছে আমার?
বড় মুখ করে, পরিবারের সবাইকে রাশেদের কথা বলেছিলাম। এখন কিভাবে জানাবো,এতো ভন্ডামির গল্প ?
রাশেদের এইরকম জঘন্য একটা চেহারা সামনে আসার পর, এইভাবে ঠকে যাবার পর,আমার অনুভূতি ঠিক কি ছিল… সেটা প্রকাশ করার মতো, কোনো শব্দ বা বাক্য আমার জানা নেই।
তাই, চেষ্টাও করবো না।
রাশেদ তার বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ, আমার সামনে স্বীকার করে নিলো।বললো,যা কিছু হয়েছে, সব আমার সাথে সম্পর্ক তৈরি হবার আগে। আমাকে ভালোবেসে, নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলেছে সে। প্রথম বিয়েটা, পরিবারের ইচ্ছায় হয়েছিল। সেখানে প্রথম থেকেই অসুখী ছিল সে। প্রথম স্ত্রী তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। সেইসব যন্ত্রণা ভুলতেই, অনেক অন্যায় করেছে সে। কিন্তু তার বর্তমান জীবনে ‘রাহমা’ ছাড়া আর কোন মেয়ের অস্তিত্ব নেই। আমাকে হারানোর ভয় থেকেই ,সবকিছু গোপন রেখেছে।
রাশেদ আমার সামনে, শিশুর মতো চিৎকার করে কেঁদেছে।আর একটা সুযোগ চেয়ে। ক্ষমা চেয়ে…
আমি মা হতে যাচ্ছিলাম। তাছাড়া, আমি তো কোনো ছলচাতুরি করিনি। আমার ভালোবাসার মধ্যে এতটুকুও ফাঁক নেই।মন থেকে রাশেদকে ভালোবেসেছিলাম।
নিজের ভালোবাসা থেকে নাকি অন্য কোনো পথ খুঁজে পাইনি দেখে… ঠিক, জানি না। রাশেদকে বিশ্বাস করলাম আমি। সুযোগ দিলাম আরেকটা… তার ভালোবাসা প্রমাণ করার। সুযোগ দিলাম, আরো একবার একসাথে সংসার করার।
নিজের মধ্যে আরেকটা ছোট্ট প্রান নিয়ে, একাই সংসারের হাল ধরেছিলাম।
রাশেদ চাকরি খুঁজে যাচ্ছিলো ,সেই সাথে ছোটখাট ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিল। এইচএসসি পাশের সার্টিফিকেট নিয়ে, চাকরি পাওয়া সহজ নয়।
আমি চাকরি আর সংসার সামাল দেয়ার পাশাপাশি, লেখাপড়াও করছিলাম।
মনে ভয় ছিল, কখন কি হয়!
বিশ্বাস ভেঙে গেলে, ক্ষনে ক্ষনে যন্ত্রণা হয়।
নিজের ভালোবাসার মানুষকে বিশ্বাস করতে না পারার যন্ত্রণা… সে বড় ভয়ংকর। বড় বেশি ভয়ংকর।
এইসবের মধ্যে আমার ছেলের জন্ম হলো।
ছোট্ট একটা শরীর। ছোট্ট মুখ… তারমধ্যে, মায়ার স্রোত বয়ে যাওয়া চোখ। বুকের ভিতরে উথাল পাতাল করে দেয়া হাসি। ছোট্ট হাত, ছোট্ট দুটো পা।
রাশেদের চাকরি হয়নি, তখনো।
মাত্র দশদিন মেটানিটি লিভ নিলাম আমি।কারন সেই সুপারশপে তখনো পেইড মেটানিটি লিভ চালু হয়নি। অবশ্য এর ঠিক কিছুদিন পরই চালু হয়েছিল।
বাবুকে রাশেদের কাছে রেখে, আমি দিনরাত কাজ করি। খাওয়া, ঘুম কোনো কিছু ঠিক নেই তখন। ওজন একটু বেড়ে গিয়েছিল। এতো চাপের মধ্যে ছিলাম, নিজের দিকে তাকানোর সময় কই?
সারাদিন অফিস আর সারারাত বাচ্চার দেখাশোনা। তারমধ্যে, অর্থনৈতিক সমস্যা তো আছেই।
কি যে কঠিন একটা সময় পার করেছি।
এরমধ্যে আরো একবার ধোঁকা খেলাম আমি। রাশেদের কাছ থেকেই খেলাম, সেই ধোঁকা।
পাশের ঘরে থাকা পরিবারটির সাথে, ভীষণ সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সেই মেয়েটির কাছে জানলাম,
রাশেদ একটা মেয়েকে বাসায় নিয়ে আসছে ,প্রায়ই।
মেয়েটি আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। মডেলিং করে।
প্রথমে বিশ্বাস করিনি। রাশেদের মতো বেকার ছেলের কাছে,মডেলিং করা মেয়ের কি চাওয়া থাকতে পারে?
রাশেদকে জিজ্ঞেস করলাম।
সে বললো,
ওই মেয়ের সাথে , বিজনেস শুরু করছে সে। টাকা পয়সা তো এমনি এমনি আসবে না। এইভাবে কতদিন চলবে? আমার একার উপর অনেক চাপ হয়ে যাচ্ছে… আমার কষ্ট আর সহ্য করতে পারছেনা,তাই…ইত্যাদি, ইত্যাদি।
জানেন তো…বিবাহিত পুরুষেরা, মেয়েদের ভোলানোর ব্যাপারে অবিবাহিত ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি পটু থাকে।কিসে একটা মেয়ে খুশি হয়, কিসে তাদের অভিমান ভাঙে ,কি তাদেরকে টানে… বিবাহিত পুরুষের সেইসব ভালোভাবে জানা।
রাশেদও মেয়ে ভোলানোর কাজে দক্ষ এবং পারদর্শী
তার নতুন প্রেম আমার সামনে আসতে, খুব বেশি সময় নিলো না।
যদিও এইবার আর স্বীকারোক্তি পেলাম না।
পেলাম পুরুষের চেহারায় থাকা, একটা কাপুরুষের ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন। পাশবিক অত্যাচার।
আমার মতো মেয়ে…,যার শরীরে মেদ ঝুলে থাকে…যে ঘুমের জন্য, রাতে চোখ খুলে তাকাতেই পারেনা…
এমন মেয়েকে ,কোনো পুরুষেরই নাকি ভালো লাগবে না।
বুঝলাম, রাশেদের কাছে আমাকে দেবার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই।
টাকাপয়সা তো কখনোই ওর কাছে চাই নি। টাকাপয়সা দেবার সামর্থ্যও ওর নেই । শুধু পাশে চেয়েছিলাম, ভালোবাসা চেয়েছিলাম, একটুখানি সম্মান চেয়েছিলাম। সেইসব দেবার মতো অবস্থায়ও, রাশেদ নেই।
আমার কেমন লেগেছে, জানতে চান?
আমি জানি, কেউ সেটা জানতে চাইবেন না। সেটা জানবার মতো, মানসিক শক্তিও হয়তো আপনাদের নেই।
এই পৃথিবীর হাজারটা নারী, যে দুঃখের কথা শুনতেও ভয় পায়,সেই দুঃখ আমি সহ্য করেছি। একা…
জানি, আপনারা আমার কষ্টে কষ্ট পাচ্ছেন। সেজন্য ধন্যবাদ। তবে, কারো সমবেদনা দরকার নেই আমার।
এই পৃথিবীর কাছে, কিচ্ছু চাই না আর আমি।
সুখ, শান্তি, ভালোবাসা, স্নেহ,মায়া, মমতা, সহানুভূতি, সমবেদনা… কিচ্ছু চাই না আর ।
আমি একা পথ চলবো। কিভাবে একা চলতে হয়, জানি আমি।একা ঘর,একা রাস্তা, একা জীবন… ভয় পাইনা তো আর।
আমার ছোট্ট সোনামনিকে সাথে নিয়ে ,সামনে এগিয়ে যাবো আমি।
চিন্তা করবেন না, ভালো থাকবো আমি।ভালো থাকবো আমরা। খুব ভালো থাকবো।
সমাপ্ত।