#মেঘের_খামে
পর্ব ২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“মেয়েটা ইন্টারেস্টিং। আমার ইন্টারেস্টিং জিনিস পছন্দ। কিন্তু এই মেয়েটাকে আমার চরম অপছন্দ হয়েছে।”
জাহান তার গালের র*ক্ত বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে বলে।
“বোইন কি জোস একটা রিপ্লাই দিসো। পুরাই ফাটায়া দিলি। সো প্রাউড অফ ইউ।” মোহ মহুয়ার পিঠ থাপড়ে বলে। মৃণা চিন্তিত সুরে বলে, “কিন্তু কোনো সমস্যা হবে না তো? ছেলেটার কথা শুনে পাওয়ারফুল মনে হচ্ছিল।”
“আমাদের মুরাদ ভাই আছে না? মুরাদ ভাই থাকতে মহুয়াকে কেউ হাত লাগানোর সাহস করতে পাড়ে?”
“তা ঠিক। একমাত্র বোন বলে কথা।” সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলে, “এমন ভাগ্য তো সবার হয় না। বাট দোস্ত তুই টাকাটা না নিয়ে একদম ঠিক করেছিস। উনি এমনে দিচ্ছিল যেন খয়রাত দিচ্ছে।”
“ভাই চুপ করবি। কি করলাম ভাই!” মহুয়া হঠাৎ কাঁদোকাঁদো স্বরে বলে।
মোহ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর আবার কী হলো?”
“ভাই কচকচে একহাজারের কতগুলো নোট ছিলো। রাগ দেখাইয়া এমনে ফেলে দিলাম। আমার তো বুকে ব্যাথা করতাসে।” বলেই সে বুকে হাত দেয়। তারপর তাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি বলোস আবার যেয়ে নিয়ে আসুম?”
মোহ বিরক্ত হয়ে তাকায় তার দিকে। বাহু ধরে তাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “চুপচাপ চল বোইন। ইজ্জত মারিস না। তোর ভাইয়ের টাকার কমতি নাই।”
“স্কুটির খবর শুনলে তো নিশ্চিত বকুনি দিব। যদিও বকেটকে আবার কিনেও দিব। তাও দোস্ত এতগুলো কচকচে নোট তো আগে ধরি নাই। ভাব কতকিছু খাইতে পাড়তাম।”
“এত টাকা দেইখাও তোর খাওনের কথা মনে পড়তেছে?”
“আচ্ছা চল ফুসকাই খাই। ফুসকা বিলাস করে দু:খ মিটাই।” সে মৃণার কাঁধে হাত রেখে তার উপর হেলান দিয়ে বলে, “দোস্ত এখন আমি তোর দু:খ বুঝতাসি। তুই পোলার ছ্যাঁকা খাইসোস আর আমি টাকার ছ্যাঁকা। যদিও তোর থেকে আমারটা বেশি দু:খজনক।”
.
.
মৃণা বাসায় আসতেই তার সৎমা এসে দাঁড়ায় তার সামনে। চেঁচিয়ে বলে, “এতক্ষণে মহারাণীর আসার সময় হলো? সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কীসের এত ঘোরা তোর?বাইরে ড্যাংড্যাং করে ঘুরে বেড়াতে লজ্জা করে না? তুই যে ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়াস আমি কি তা বুঝি না? তোর কাজগুলোও কি এই বয়সে আমি করব? তুইও যে রান্না না করেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলি তা মহারাণী আমরা রাতে খাব কি?”
“আন্টি আমি তো সকালে বেশি করে রান্না করে রেখেছিলাম।”
“এখন তোকে খাওন নিয়েও হিসাব দিতে হবে আমার? ঘরে দুইটা যে তোর ভাই আছে ওদের তো বাড়তি বয়স। ওরা তো খাবে তাই না?”
মৃণা তর্ক করল না। মৃদুস্বরে বলল,”খাবার বসাচ্ছি আমি।”
বলে সে রুমে যেয়ে ব্যাগ রেখে এলো। তার হাঁটু অব্দি আসা চুলগুলো বাঁধতে বাঁধতে রান্না ঘরে যাচ্ছিল। তখন সে দেখল তার দুইভাই নিজের মা বাবার সাথে সোফায় বসে টিভি দেখছে আর গল্প করছে। গভীর নিশ্বাস ফেলে সে রান্নাঘরে যায়। রান্না বসিয়ে দেয়। রান্না বসিয়ে টুকটাক কাজ সেরে আগামীকালকের কাজ এগিয়ে রাখে। আগামীকাল একটু তাড়াতাড়ি বের হবে সে। তন্ময়ের সাথে দেখা করতে হবে। তার কি হয়েছে জানতে হবে। তার সাথে আবার সব ঠিক করতে হবে।
সবার খাওয়া শেষে নিজেও খেলো। থালাবাসন ধুঁয়ে রেখে রুমে এলো এগারোটায়। এসেই পড়তে বসলো। এই পড়া রাত তিনটা পর্যন্ত চলবে তার। আবার সকাল সাতটায় উঠে ঘরের কাজ সেরে ভার্সিটিতে যায় সে। ঘুম হয় না তার। একারণে তার চোখের নিচে কালি পড়েছে। তবে তার শ্যামবর্ণের কারণে হয়তো কেউ তা বুঝতে পারে না অথবা কারো তার প্রতি এতটা যত্ন নেই যে বিষয়টা খেয়াল করবে।
.
.
“কী তোর স্কুটি ভেঙেছিস? আমি বলেছিলাম ওকে এত দামী জিনিস কিনে দিও না। এই মেয়ে কিছু সামলাতে পারে না।” মহুয়ার মা থমথমে কন্ঠে বলে তার বাবাকে।
মহুয়া কাঁদোকাঁদো স্বরে বলে, “আমার কি দোষ? আমি কি ওই ব্যাটাকে বলেছিলাম। আয় আয় চ্যাঁকাম্যাঁকা হনুমানের বাচ্চা, আমার স্কুটিটা উড়িয়ে দিয়ে যা।”
কথাটা শুনে শব্দ করে হেসে উঠে মহুয়ার বাবা। আবার তার মা’য়ের কঠিন দৃষ্টি দেখে থেমেও যায়।
মহুয়া বুঝে নেয় এদিকে তার কাজ হবে না। সে উঠে যেয়ে তার সামনের সোফায় বসে। কাঁদোকাঁদো স্বরে তার হাত ধরে বলে, “ভাইয়া প্লিজ আমার ভার্সিটি লাইফ শুরু হচ্ছে। আমার কত ইচ্ছা ছিলো আমার স্কুটি নিয়ে ঘুরবো। তুমি তোমার এত কিউট বোনের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখবে?”
মুরাদ তার ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে আড়চোখে তাকায় তার দিকে। তার চশমাটা ঠিক করে আবার ফাইলে নজর দেয়, “কোন দিক থেকে কিউট? কোনো এংগেল থেকেই তোকে কিউট লাগে না। বান্দরনীর মতো দেখা যায়।”
“ভাইয়া!” মুখ ফুলিয়ে নেয় মহুয়া।
“চিল্লিয়ে কান থেকে রক্ত বের করিস না-তো। যা আগামী সাপ্তাহে কিনে দিব।”
“সত্যি ভাইয়া? ইয়েএএ…” সে মুরাদকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরতেই তার ভাই তাকে সরিয়ে দেয়, “ছি:! যা তো ঠিক ভাবে গোসল টোসল করোস না তুই। খবরদার ধরবি না।।তারপর আমার থেকেও দুর্গন্ধ আসবে।”
“ভাইয়া ফাজলামো করো না তো। তুমি এত সিরিয়াসভাবে বলো যে বাহিরের মানুষ শুনলে সত্যিই ভাববে।”
“হইছে চোখের সামনে থেকে বিদায় হ। কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবি না। কালকে ভার্সিটিতে ভর্তি হতে যাবি না? যেয়ে ঘুমা।”
তার কথা শুনে মহুয়া গুণগুণ করতে করতে বেরিয়ে যায়। মুরাদ আবার তাকে ডাক দেয়। বলে, “এটা ফার্স্ট এন্ড লাস্ট। আমার দ্বিতীয়বার ভুল করা মানুষ অপছন্দ। মানুষের ভুল থেকে শেখা দরকার। এইবার তোর স্কুটির কিছু হলে আর পাবি না। পড়াশোনা শেষ হওয়া পর্যন্ত তোর এটা দিয়েই কাজ চালাতে হবে। তারপর নিজে কামাই করে যা ইচ্ছা কিনিস।”
“আজব আমি কেমনে ভুল করলাম আমি তো তাই বুঝতেছি না। সবাই আমাকে বলতেছ কেন?” বলে সে হনহনিয়ে রুমে যায়। আজ তার দিনটাই খারাপ। একতো তার পিংকির পার্টগুলো উড়েমুড়ে ছন্নছাড়া হয়ে গেল, এর উপর সে এতগুলো কচকচে টাকার নোট এভাবে উড়িয়ে গাঁধামি করলো, এখন আবার সবার কথা শুনা লাগছে তার। সে কচকচে নোটগুলোর কথা মনে করেই বুকে ব্যাথা উঠলো তার। লাইট বন্ধ করে শোয়ার পরও ঘুম এলো না। সেরাতে তার একঘন্টা কম ঘুম হলো।
.
.
সকালে মৃণা উঠে তার কাজ সেরেই যায় তন্ময়ের অফিসের সামনে। সে পেশাগত গায়ক। অল্প জনপ্রিয়তাও আছে তার। কিন্তু সেখানে যেয়ে পায় না সে তন্ময়কে। সে না’কি আসে নি। তাকে কল করে, পায় না। বাসায় যেয়ে কারিম চাচা থেকে জানতে পারে সে আজ সকাল সাতটায় বেরিয়ে গেছে। সে কিছু জানে না। কোথায় গেছে, কেন গেছে, কিছু বুঝতে পারে না। তাকে না পেয়ে ভার্সিটিতে আসে সে। ভার্সিটির সামনে দাঁড়ায় তার বান্ধবীদের জন্য।
মহুয়া দুই মিনিটে আসলেও মোহের আসতে লাগে বিশ মিনিট। একারণে মহুয়া থেকে সে সকাল সকাল আবার বকা খায়, “তুই কি একটু সময়ে আসতে পাড়িস না মা? তোর আজও লেইট করতে হলো? ভেবেছিলাম একটু ভার্সিটি ঘুরে দেখে ভর্তি হবো।”
“সমস্যা কী? ভর্তির পড়ে দেখব। সবকিছু গুছিয়ে এনেছিস না?”
“কি জানি মা গুছিয়ে রেখেছিল।” সে উওর দিয়ে মৃণার দিকে তাকায়, “ভালো কথা তোর আন্টি কোনো কাহিনী করে নাই তো আসার আগে?”
“কী কাহিনী?”
“আংকেল একটা জামা কিনে দিলেও এ নিয়ে চিল্লাচিল্লি করে এত বড় ভার্সিটিতে ভর্তি হইতাসোস। কিছু কয় নাই?”
“উনি তো জানি আমি ফুল স্কোলারশিপ পেয়েছি। কোনো টাকা লাগবে না। দাদী যে মৃত্যুর পূর্বে আমাকে ভর্তি আর সেমিস্টারের জন্য টাকা দিয়ে গিয়েছিল তা জানে না।”
“ভাই জোস বুদ্ধি তো তোর। আর মিথ্যাও না ভর্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে তো পঁচাত্তর শতাংশ ছাড় পেয়েছিস। কম কোথায়?”
“তাই তো দুই সেমিস্টারের টাকা চালাতে পাড়ব। জব একটা নিতে হবে জলদি।”
“তুই ভার্সিটি করে আবার জব করবি? বাসায় যেয়ে আবার সব কাজও তোর করতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে যাবি।” মোহ চিন্তিত সুরে বলে। সে আবার তাকে নিখুঁতভাবে দেখে বলে, “দেখ তোর চোখের নিচেও কালি পড়ে গেছে।”
মৃণা অবাক হয়। সে খেয়াল করেছে? মৃদু হাসে সে। একটু শান্তি লাগে তার। এই দুইটা বান্ধবীই তো আছে যে তার চিন্তা করে, খেয়াল রাখে, ভালোবাসে। আর তন্ময়? হয়তো তন্ময়ও।
সে মৃদু হেসে বলে, “এমনি ঘুম কম হয় বলে। আমি ঠিক আছি।”
“মৃণা তুই শুকিয়ে যাচ্ছিস। বেশি স্ট্রেস নিস না প্লিজ।”
মহুয়া বলে, “তুই তো পারমিশন দেস না, নাহলে আমি তোকে স্ট্রেস দেওয়া পার্সনদেরই রকেটে বেঁধে ব্লাক হোলে দিতাম।”
মৃণা মুখ বানিয়ে তার দিকে তাকাতেই মোহ আর মহুয়া হেসে উঠে।
ভর্তির কাজ শেষ হতে হতে দুইটা বাজে। তাদের খিদে লেগেছে। ক্যান্টিন খুঁজতে থাকে তারা। তখন একস্থান থেকে ভীষণ চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পায় তারা।
“ওখানে কী হচ্ছে রে?” মোহ জিজ্ঞেস করে। বলে সে নিজেই সেদিকে গেলো কৌতুহলবশত। মহুয়া গেল তার পিছনে, “ভাই প্লিজ , ক্যান্টিনে চল। খিদায় আমার পেটে হাতিরা কাবাডি কাবাডি করতেছে।”
কিন্তু মোহ এগিয়ে যায়। না চাওয়া সত্ত্বেও তাদেরও যেতে হয়।
মোহ সেদিকে যেয়ে দেখে বাস্কেটবল খেলা হচ্ছে। কোর্টের আশেপাশে ছেলেমেয়েরা ঘেরা করে রেখেছে। মোহ ক’জনকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে ব্যাপারটা দেখে। দুইদল খেলছে একদল সাদা জার্সি পরা অন্যদল নীল। সে সেদিকে তাকিয়েই চোখদুটো বড়সড় করে মহুয়াকে খুঁজতে লাগলো। দুইজনের পিছনে তাকে দেখে টেনে আনল। অবাক কন্ঠে বলল, “মহুয়া দেখ এইটা গতকালের ছেলেটা না?”
মহুয়া দেখল সেদিকে। কোঁকড়াচুলো সাদা জার্সি পরা এক ছেলে। প্রায় ছয় ফিটের বা এর থেকেও একটু লম্বা। গায়ের রঙ ফর্সাও নয় আমার শ্যামবর্ণও নয়। ঘেমে তার নাজেহাল অবস্থা তার। চুল বেয়েও টুপটুপ করে ঘাম পড়ছে। অথচ তার লক্ষ্য বাস্কেটের দিকে। তার চোখে একরকম জেদ। তার সামনে কতগুলো বিপরীত দলে লোকরা এসে দাঁড়ায় বাঁধা হয়ে। তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে দিবে না তাই বলে। অথচ সে কারও দিকে তাকায়ও না। তার দৃষ্টি লক্ষ্যের দিকে। সময় শেষ হতে আসছে। তিন, দুই, এক!
সময় শেষ। এক মুহূর্ত পূর্বেই সে বাস্কেটে বলটা ফেলে গোল করেছে। সাথে সাথে তার দল লাফিয়ে উঠে উল্লাসে। সাথে আশেপাশের সবাইও। চারপাশে কেবল একটিই নামের গুঞ্জন ছড়ায়, জাহান…জাহান…
মোহ তার পাশের একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, “সবাই একটিই নাম নিচ্ছে কেন? উনি কী অনেক ফেমাস?”
“তুমি ইয়াজভান জাহানকে চিনো না?” মেয়েটার কন্ঠে বিস্ময়।
“আমরা আজই ভর্তি হলাম।”
“ওহ তাইতো। ইয়াজভান জাহানকে আমাদের ভার্সিটির কেউ চিনবে না তা হতেই পারে না। জাহান এখন সেভেনথ সেমিস্টারে পড়ছে। ভার্সিটির সবাই তাকে চিনে। সব মেয়েরা পাগল তার জন্য। আই মিন যাস্ট লুক এট হিম। সো ড্যাম হট। আর বাস্কেটবল খেলার সময় তো আরো হট লাগে। পড়াশোনার পাশে টুকটাক ফ্যামিলি বিজনেসও দেখে। দেশের সবচেয়ে বড় এয়ারলাইনস ‘ইভান এয়ারলাইন’ এর নাম শুনেছ না? ওটা জাহানদেরই। আর আই থিংক কিছু হোটেলও আছে দেশে বিদেশে।”
মোহ সবকিছু শুনে মহুয়ার দিকে ঝুঁকে বলে, “এজন্যই গতকাল এত টাকার গরম দেখাতে পাড়ছে।”
“ওই টাকার কথা কইস না। এখনো বুক জ্বলতেছে। তোর এসব নাটক দেখা হইলে চল তো। খিদায় আমার জান শেষ। এখনই মাথা ঘুরাইয়া পইরা যামু।”
খেলা শেষ হতেই জয় দৌড়ে এসে জাহানের হাতে একটি পানির বোতল দেয়। সে পানি একটুও পান করে। সম্পূর্ণ বোতল ঢেলে দেয় নিজের মাথায়। মাথা ঝাকিয়ে পানি ঝেড়ে ফেলে।
“ভাই…” জয়ের ডাকে সে তাকায় তার দিকে। জয় বলে, “ভাই ওই’যে গতকালের পাগলা মেয়েটা দেখেন।”
জাহান তাকায় সেদিকে কিন্তু চুলগুলো সামনে এসে পড়ায় ভালো করে দেখতে পারে না। হাত দিয়ে চুল আঁচড়ে পিছনে নেয়। তারপর আসলে দেখে সত্যিই গতকালের মেয়েটা। যে তাকে নিদ্বিধায় অপমান করে চলে গিয়েছিল। এ মেয়েটা তাদের ভার্সিটিতে কি করে?
সে দেখে মেয়েটা তাকে দেখে বিচিত্র মুখ বানিয়ে চলে যেতে নেয়। জাহান বাঁকা হাসে। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ে তার সাথে দ্বন্দ্বে জড়িত হয়েছে। তাকে আঘাত করেছে। অপমান করেছে। এমনকি এই প্রথম কোনো দ্বন্দ্বের সমাপ্তিতে সে বিজয়ী হয় নি। তাও আবার এতটুকু মেয়ের থেকে পরাজিত হলো সে? কী লজ্জার! তাইতো ভাগ্য এই মেয়েটাকে আবার তার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। যে দ্বন্দ্বে সে বিজয়ী হয় নি সে দ্বন্দ্ব শেষ হয়নি।
মেয়েটাকে যেতে দেখে সে নিচ থেকে তার বল তুলে জোরে মেয়েটার দিকে ছুঁড়ে মারলো।
আচমকায় ধাক্কা লেগে পড়ে যায় মহুয়া। নিচে পড়তে যেয়ে হাতে ভার দিয়ে বসায় তার ডান হাত ছিঁলে যায় দুই তিন জায়গায়। হাঁটুতেও ব্যাথা লাগে তার। সে অগ্নিদৃষ্টিতে ফিরে তাকায় জাহানের দিকে। জাহান এগিয়ে এসে তার সামনে বসে। সে খানিকটা হেসে তার গালের আঘাতের অংশ দেখায়, “ইয়াজভান জাহান কোনো ঋণ রাখে না। এভরি একশন হেভ আ ইক্যুয়াল রিয়াকশন।”
মহুয়ার অগ্নিদৃষ্টি তার দিকে অটুট থাকে। আর তার হাত যায় নিজের ব্যাগের ভেতর।
জাহান মেয়েটার স্পর্ধা দেখে অবাক না হয়ে পারে না, “এতটুকুনি মেয়ে আর তোমার ভেতর এত তেজ! চোখদুটোয় কত ইনোসেন্স ভরা অথচ এভাবে তাকিয়ে আছো যেন এখনই অগ্নিশিখা দিয়ে ভস্ম করে দিবে।”
“দিতেও পারি।” কঠিন গলায় বলে মহুয়া।
মোহ মহুয়ার পাশে বসে জাহানকে বলে, “ভাইয়া প্লিজ আমরা এখানে নতুন। আপনার থেকে বয়সে ছোটও। গতকালের ঘটনাটা বাদ দিন। আমরা ভার্সিটিতে কোনো ঝামেলা চাই না। মহুয়া প্লিজ চল।”
জাহান মহুয়ার দিকে তাকিয়েই বলে, “এইত্তো মেয়েদের এমন হওয়া উচিত। শিখো কিছু নিজের বান্ধবী থেকে। যাই হোক, ছেড়ে দিলাম। এরপর চেষ্টা করো ইয়াজভান জাহানের সামনে না পড়ার।”
জাহান মহুয়ার সামনে পড়া বলটা তুলতে গেলেই মহুয়া ধারালো কিছু বলটার ভেতর আঘাত করে। বলের হাওয়া সব বের হয়ে চুপসে যায় বলটি। সে জাহানের দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বলে, “আমার সামনে পড়ার চেষ্টা করবে না। তুমি যদি ইয়াজভান জাহান হোন আমিও জেরিন মহুয়া। আর জেরিন মহুয়া কাওকে ভয় পাওয়ার পাত্রী না। জীবন শেষ করে দিব।”
মোহ হাত ধরে দাঁড় করায়, “প্লিজ মা চুপ থাক। আরেক ঝামেলা বাঁধাইস না।”
“চল তো।”
জাহানের তো মাথায় রক্ত চড়ে উঠে যায় তার স্পর্ধা দেখে। রাগে তার হাতের রগগুলো কাঁপতে থাকে। সে দাঁড়িয়েই মহুয়ার আঘাত পাওয়া হাত শক্ত করে ধরে, “হাউ ডেয়ার ইউ!” মহুয়া সাথে সাথে ঘুরে তার হাতের ছোট আকৃতির ধারালো ছু’রিটি তার দিকে দ্রুত গতিতে এগোয়। ঠিক যেয়ে ধামায় তার চোখের সামনে। সবাই হতভম্ব হয়ে পড়ে এই দৃশ্যতে। কিন্তু জাহান চোখের পলকও ফালায় না।
মহুয়া আদেশের সুরে বলে, “হাত ছাড়ো।”
জাহান ছাড়ে না।
মহুয়া আবারও বলে, “ছাড়বেন, নাহলে এই মুহূর্তে এটা চোখে ঢুকিয়ে দিব। বিলিভ মি, রাগে ও ক্ষিধায় আমার মাথা কাজ করে না।”
জাহান তার হাত ছেড়ে দেয়।
মহুয়া তার দিকে তাকিয়েই বলে, “মোহ, মৃণা চল।”
সে যাবার পথে তাকিয়ে ছিলো জাহান। শরীরের শিরায় শিরায় যেন ক্রোধ অতিবাহিত হচ্ছে। আজ মেয়েটার কাছে দ্বিতীয়বার সে পরাজিত হলো। তাও তারই ভার্সিটিতে। এতগুলো মানুষের সামনে। রাগে তার কপালের রগটা ছটফট করছে। তার হাত মুঠোবন্ধ।
জয় দৌড়ে আসে তার কাছে, “ভাই আপনি….”
“সাট আপ।” জোর কন্ঠে বলে জাহান। তারপর বলে, “জয় ওর ফ্যামিলি হিস্ট্রি চেক কর। ওর পুড়ো লাইফ হিস্ট্রি চেক কর। ও ভার্সিটিতে কোন ডিপার্টমেন্ট, কত রোল, ওর সব খবর আমি চাই।”
“কিন্তু ভাই ওর নাম তো জানি না।”
“বললই তো জেরিন মহুয়া। ওর সব তথ্য আমার চাই।”
“আচ্ছা ভাই আমি দেখছি।”
জাহানের চোখের সামনে ভেসে উঠে মহুয়ার চোখদুটো। সে চোখদুটো মনে করতেই তার কেবল মনে পড়ে নিজের পরাজয়। ক্ষোভে তার বুকের ভেতর যেন অগ্নি উপচে পড়ে।
চলবে…
#মেঘের_খামে
পর্ব ৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
জাহানের চোখের সামনে ভেসে উঠে মহুয়ার চোখদুটো। সে চোখদুটো মনে করতেই তার কেবল মনে পড়ে নিজের পরাজয়। ক্ষোভে তার বুকের ভেতর যেন অগ্নি উপচে পড়ে।
তারা আর ভার্সিটির ক্যান্টিনে যায় না সেদিন। ভার্সিটির থেকে কিছুটা সামনের একটা ক্যাফেতে বসে।
“বেশি লেগেছে তোর?” মৃণা চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে।
“একদম না। এ’যে চামড়া যে উঠে যাচ্ছে এটার কারণে তো আমার অনেক মজার লাগতেছে। এটা তো মজার জিনিস।” মহুয়া ক্ষেপে উলটো উওর দেয়।
মোহ হেসে তার ব্যাগ থেকে হ্যালো কিটির ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ বের করে লাগিয়ে দেয় মহুয়ার ক্ষততে।
মৃণা তার ক্ষত দেখে কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,
“কতটা লেগেছে রে! উনার মনে কি একটু মায়াদয়া নেই? মেয়েদের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে?”
মোহ বলে, “এই ম্যাডাম কম কীসের? একবারে ছু’রি তার চোখের সামনে ধরসে। বলিকি যদি আসলে লেগে যেত তাহলে কী করতি?”
“তুই কি আমার সাইডে নাই ওই চেঁকামেঁকার চেহেরার হুনুমানের? শালা ভন্ড!”
মোহ হাসে, “মা তুই আমার জেন্ডার চেঞ্জ করিস না। আমি খাবার অর্ডার দিয়ে আসি। খাবার খেলেই তোর মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
মৃণাও যায় তার পিছনে।
মহুয়া মেজাজ খারাপ করেই ঢুকে ফেসবুকে। মোহ ও মৃণা আসা পর্যন্ত সময় কাটাবে। কিন্তু ফেসবুকে ঢুকেই সে যা দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। মুহূর্তে তার চেহেরার রঙ উড়ে গেল।
মোহ ও মৃণা আসার পর ডাকল তাকে, “তোর মুখখানা রক্তশূণ্য লাগছে কেন রে? ভূত দেখার মতো চমকে আছিস যেন!” মোহ জিজ্ঞেস করে।
মহুয়া চোখ তুলে চাইল তাদের দিকে। তারপর এক ঢোক গিলল। ফোনটা এগিয়ে দিল মৃণার সামনে।
“হঠাৎ কী হলো?” মৃণা জিজ্ঞেস করে ফোনটা নিতেই তার শ্বাস আটকে গেল। সে দেখল এয়ারপোর্টে তন্ময় বুশরার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে একটা ফুলের বুকে দিচ্ছে। তাদেরকে একসাথে দেখে বুকের ভেতর অঢেল যন্ত্রণা কাবু করল। তার চোখে জল ভেসে উঠে।
নিউজ চ্যানেলের ক্যাপশনে লেখা~ গায়ক তন্ময় তার এতবছর পর তার ভালোবাসার মানুষটাকে আবারও দেখতে পেল।
মৃণা চোখজোড়া বন্ধ করতেই তার চোখ গড়িয়ে পড়ল একবিন্দু নোনাজল।
“এতগুলো বছর…এতগুলো বছর আমি ওর সাথে ছিলাম। ওর সুখ, দু:খ, হাসি, কান্না, সাফল্যতা, বিফলতা সবটা সময় আমি ওর সাথে ছিলাম। বুশরা আপু তো ওকে সবার সামনে অপমান করে চলে গিয়েছিল। তবুও সেই ওর ভালোবাসার মানুষ হয়ে রইল?” বলে বসে পড়ে মৃণা। টেবিলে মুখ গুঁজে কান্না করা শুরু করল। মোহ এসে জড়িয়ে ধরে তাকে। আজ মহুয়া তাকে আর বকে না। কারণ সে জানে এবার যা হয়েছে তা আসলেই গম্ভীর ব্যাপার।
মহুয়া মৃণা ও মোহকে বাসায় আছে। মৃণাকে রাতে আর তাকে বাসায় যেতে দিবেই না সে। এই ঝামেলার পর বাসায় যেয়ে আবার সে তার সৎ মা’য়ের খোঁটা শুনবে? তাই সে নিজেই কল করে কথা বলে। মহুয়াকে মানা করতে পাড়ে না তার সৎমা। বড়লোক ঘরের মেয়ে। মৃণাদের বাসায় আসার সময় তাদের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে। এমনকি তিনবছর আগে যখন তার স্বামীর চাকরিটা গেল মহুয়াই তার ভাইকে বলে একজায়গায় চাকরি দিয়েছিল তার স্বামীকে।
কাঁদতে কাঁদতে মৃণার চোখ, গাল, নাক লাল হয়ে গেছে। তার ঠোঁটজোড়া ফুলে গেছে। মহুয়া ও মোহ তাকে গত তিনঘন্টা যাবত বুঝিয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছে। পাঁচমিনিট পর পর দেখছে মৃণাকে। তার চোখের টাঙ্কির পানি শেষই হয় না। এমন সময় দরজায় নক পড়ে। ভারী কন্ঠ শোনা যায়, “আসবো?”
মোহ তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসে।
মহুয়া উওর দেয়, “ভাইয়া আসো।”
“বাহ আজ দেখি তিন বান্দর একসাথে জোট হয়েছিস।” মুরাদ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল। মোহ মিষ্টি সুরে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছো ভাইয়া?”
মুরাদ পড়ার টেবিলের কাছ থেকে চেয়ার টেনে বসল, “আমি তো ভালো আছি। তোর বান্ধবীর কী হলো? এই সন্ধ্যারাতে চোখের পানি নাকের পানি এক করছে কোন দু:খে?”
মহুয়া ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, “উনার প্রিয় প্রেমিকের জন্য।”
“যে প্রেমিকের জন্য প্রেমিকার চোখের জল ফেলতে হয় সে তো প্রেমিক নয় নর্দমার কীটা!”
তার কথা শুনে মৃণা তার দিকে তাকায়। মুখ ফুলিয়ে। ভ্রু কুঁচকে।
মহুয়া এবার উৎসুক হয়ে তার ফোনটা পাশে ফেলে উঠে বসে, “তোমারও এটা মনে হয় তাই না ভাইয়া? এই তন্ময়কে তো আমার কোনো কালেই সুবিধার লাগে নাই। কত বড় ছ্যাঁচ্চর চিন্তা করো। যে মেয়ে তাকে সম্পূর্ণ ক্লাসের সামনে অপমান করে গেছে সে মেয়েকে ফুল দিয়ে রিসিভ করছে। তাও হাঁটু গেড়ে।”
মুরাদ কথাটা শুনে তাকায় মৃণার দিকে, “এই কীটার জন্য তুই এভাবে কাঁদছিস! মিষ্টি, মোহ আগামীকাল তৈরি থাকিস। তোদের বান্ধবীকে পাগলের ডাক্তার দেখাতে হবে। মেয়েটার পড়তে পড়তে মাথার সব স্ক্রু পড়ে গেছে।”
কথাটায় হাসিতে গড়াগড়ি খায় মহুয়া ও মোহ।
মুরাদ শুধায়, “হাসিস পড়ে। মা তোকে খাবার আনতে ডাক দিয়েছে। দেরি হলে তোর এই দাঁত আর থাকবে না। জলদি ভাগ।”
“আগে বলবা না তুমি?” মহুয়া উঠলে মোহও বলে, “দাঁড়া আমিও হেল্প করতে আসি।”
তারা যাবার পর মুরাদ মৃণার সামনে চেয়ার নিয়ে এসে বসে, “আজ ভর্তি হইছিস ঠিকভাবে?”
মাথা নাড়ায় মৃণা। উওর হ্যাঁ। কিন্তু তার চোখ নিচে।
মুরাদ আবার জিজ্ঞেস করে, “তুই না’কি ফাস্ট হয়েছিস ভার্সিটির পরীক্ষায়। সাথে ছাড় পেয়েছিস।”
আবারও মৃণা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।
“তাহলে এমন মরার কান্না কাঁদছিস কেন? সেলিব্রেট করবি।”
এবার মুখ তুলে তাকায় মৃণা, “আমি তো ওকে অনেক ভালোবেসেছি ভাইয়া। ও আমাকে কষ্ট দিচ্ছে কেন?”
“তো ছেড়ে দে। কষ্ট সহ্য করতে কে বলছে? নিজে গর্ত নিজে করলে তো সেখানে পড়বিই। বাঁশও খাবিই। ওই ছেলের জন্য নিজের এই অবস্থা করছিস? শুকিয়ে তো কাঠ হয়ে গেছিস। খেতে পারিস না ঠিকভাবে? ছোটবেলায় কি গুলুমুলু কিউট ছিলি আর এখন শুটকি হয়ে গেছিস।”
“এজন্যই কী তন্ময়ও আমাকে ছেড়ে বুশরা আপুর কাছে যেতে চাচ্ছে?” বলে আরো শব্দ করে কেঁদে উঠে মৃণা।
“এই কান্না বন্ধ কর তো। তুই যখন কান্নার সময় শব্দ করিস তা ভীষণ বিরক্তিকর শুনায় জানিস। আমার মাথায় টোং করে উঠে। পড়ে মাথা ব্যাথা করে।”
এই কথায় আর কান্না কমে না মৃণার। উলটো বাড়ে।
মুরাদ রাগান্বিত স্বরে বলে, “চুপ করতে বলেছি না তোকে? কাঁদবি না। তুই জানিস আমার কথা না শুনলে আমার মেজাজ খারাপ লাগে।”
সে তো থামেই না। এবার মুরাদের রাগ উঠে যায়। সে উঠে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলে, “চুপ করতে বলছি না? বেয়াদব হয়ে গেছিস দেখছি। বড়দের কথা শুনিস না। এখন চুপ না করলে এক থাপ্পড়ে চারটা দাঁত ফালায় দিব।”
মৃণার ভয়ে কাঁপুনি দিয়ে উঠে। সে সাথে সাথেই কান্না থামিয়ে দেয়। সাথে মুরাদের কন্ঠস্বরও শান্ত হয়, “গুড গার্ল। আমি একটুপর আবার আসবো। যদি তোকে কানতে দেখি তাহলে শুধু চারটা দাঁত থাকবে তোর মুখে। মনে থাকবে?”
মৃণা দ্রুত উপর নিচে মাথা নাড়ায়।
মুরাদ যেতে নিলেই দরজায় দেখে মহুয়া ও মোহ তিনপ্লেট খাবার নিয়ে আসছে। তিনজনের জন্য। মোহ জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া চলে যাচ্ছো?”
“না গিয়ে উপায় আছে? তোর বান্ধবী কানের কাছে যেমনে ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ শুরু করছে তার জন্য মাথা ব্যাথা উঠে গেছে। তোরা ওকে বলিস নাই কান্নার সময় কথা বলল ওর কন্ঠ কাকের মতো শুনায়?”
কথাটা বলে তাকায় মৃণার দিকে। সে চোখমুখ কুঁচকে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। সেদিকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে মুরাদ চলে যায়।
মহুয়া রুমে ঢুকে বিস্ময়ের স্বরে বলে, “তোর কান্না থেমে গেছে? কেমনে সম্ভব? চোখের টাঙ্কি খালি হয়ে গেছে না’কি?”
“তোর ভাইয়ের জন্য। ভাইয়া বলেছে আমার কান্নার শব্দে নাকি উনার মাথা ব্যাথা ধরেছে। কান্না করলে থাপড়ে দাঁত ফেলে দিবে। একবার বলল চারটা দাঁত ফালাবে। আবার বলল চারটা দাঁত রাখবে।”
মহুয়া শব্দ করে হেসে উঠে।
মৃণা ভীত কন্ঠে বলে, “তুই হাসছিস? আমি সত্যি ভয় পেয়ে গেছি। ভাইয়া সবসময় আমার সাথে এমন করে কেন?”
মোহ প্লেট দুইটা বিছানার উপর রাখে, “ওসব বাদ দিয়ে বিরিয়ানিতে মনোযোগ দে। আন্টির হাতের বিরিয়ানি বেস্ট। তোর মন খারাপ বলে আন্টি তোর ফেভারিট বিরিয়ানি রান্না করল।”
“তাই? আন্টিকে কালকে থ্যাঙ্কিউ বলে যাব। কিন্তু দোস্ত আমার খেতে ভালো লাগতেছে না। আন্টিকে বলিস না।”
“আন্টিকে না। সোজা ভাইয়াকে বলব।”
“এত খারাপ কেন তুই?” বলে সে প্লেটটা হাতে তুললো।
.
.
পরদিন মহুয়ার বাড়ি থেকে মৃণা বাসায় গেল না। সোজা গেল অফিসে। আজ তন্ময় এসেছে। তাকে দেখে কেমন ঘাবড়ে যায় তন্ময়। সে রেকর্ডিং রুম থেকে তার হাত ধরে বের হয়, “তোমাকে ওদিন না মানা করলাম তুমি আর এখানে আসবে না? আমাদের ব্রেকাপ তারপরও এখানে কেন এসে তুমি?”
“তুমি কী বুশরা আপুর জন্য আমার সাথে ব্রেকাপ করেছ?”
তন্ময় তার সাথে চোখ মেলাতে পারে না। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা চুলকে উওর দেয়, “আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলাম মৃণা বিশ্বাস করো। কিন্তু বুশরা আসবে শুনার পর ওর ভাবনা আমার মাথা থেকে যাচ্ছেই না।”
“আর আমার কী? আমি যে এতগুলো বছর তোমার পাশে ছিলাম, তোমার সাথে ছিলাম তার কোনো মূল্য নেই?”
“তোমার দায় আমি কখনো দিতে পাড়ব না মৃণা। আমার যখন কাওকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলে তখন কেবল তুমি ছিলে আমার পাশে। তুমি এখনো আমার কাছে অনেক কিছু। তোমার জন্য এখনো আমার চিন্তা হয়। কিন্তু আমি সারাজীবন তোমার সাথে থাকার কথা চিন্তা করতে পাড়ছি না। বুশরার ভাবনা মাথা থেকে সরাতে পাড়ছি না। ইউ নো রাইট আমি তোমার সাথে থেকে ওর কথা চিন্তা করলেও এটা ইমোশনাল চিটিং হবে।”
“আই ডোন্ট কেয়ার তন্ময়।” সে তন্ময়ের হাত ধরে নেয়। তার চোখ আবারও অশ্রুসিক্ত হয়ে গেছে। সে বলে, “তুমি কেবল আমার সাথে থাকলেই হবে। আমার হলেই হবে। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিও না।”
তন্ময় রাগ হতে চাইলেও তার চোখের পানি দেখে রাগও হতে পারে না। সে হাত তুলে তার গাল মুছে দিতে চাইলেও হাতটা তার গালে ছোঁয়ায় না।
সে মলিন কন্ঠে বলে, “প্লিজ মৃণা এখন না। এখন কান্না করো না। বুশরা এখানে আসবে। তোমাকে দেখলে ভুল ভাবতে পারে। তুমি এখন যাও। আমি তোমাকে পড়ে কল দিব।”
মৃণা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় তন্ময়ের দিকে, “বুশরা আপু আসবে বলে তুমি আমাকে চলে যেতে বলছো?”
তন্ময় নিজে তার হাত ধরে অফিসের বাহিরে নিয়ে একটা রিকশা ঠিক করে উঠিয়ে দিলো। বলল, “তুমি প্লিজ কান্না করো না। আমি তোমার সাথে পড়ে কথা বলব। আমি যা করছি তা আমাদের দুইজনের জন্যই উচিত।”
রিক্সা চালু হয়। সে রিক্সা থেকেও পিছনে ফিরে তাকিয়ে থাকে তন্ময়ের দিকে। সে দেখতে পায় একটি গাড়ি এসে।থেমেছে তন্ময়ের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে আসে একটি সুন্দরী মেয়ে। সে বুশরা আপু। বিদেশে যেয়ে সে আরও সুন্দর হয়ে গেছে। ড্রেস আরও মর্ডান হয়েছে। সে নিজেকে একবার দেখে নিলো। অবশ্যই তন্ময়ের বুশরা আপুর মতো মেয়েকেই পছন্দ হবে। তার এমন কী আছে যে কেউ তাকে পছন্দ করবে? তার তো কিছুই নেই। সে নিঃস্ব।
.
.
একসাপ্তাহের মধ্যে তাদের তিনজনের ভার্সিটি চালু হয়। এই একসাপ্তাহে মহুয়ার অজান্তেই সে অনেক ফেমাস হয়ে যায়। সবার মুখে মুখে তারই নাম। তবে বেশি ভালো দিকে নয়। ভার্সিটির হিরো ইয়াজভান জাহানকে চ্যালেঞ্জ করেছে। বিষয়টা সবার তো পছন্দ হয় নি। ভার্সিটিতে আসার পনেরো মিনিটের মধ্যেই সবাই তার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছে যেন সে কোনো এলিয়েন। সবুজ চামড়ার এলিয়েন। ভিনগ্রহ থেকে অস্বাভাবিক পোশাক পরে নাচছে।
মহুয়া নিজের ক্লাসে বসা। তার পাশে বসা মৃণাকে বলে, “তোরও মনে হচ্ছে না সবাই আমাদের আজব নজরে দেখছে?”
“আমাদের না তোকে।”
মহুয়া তার পিছনে ফিরে একজনকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা সবাই আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?”
সে উওর দেয় না। মুখ বানিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকায়। মহুয়া এবার বিরক্ত হয়, “বাদ দে তো, মোহরাণীকে কল দে একটা। ও কখন আসবে। ক্লাস শুরু হতে পাঁচ মিনিট বাকি।”
“মেসেজ দিয়েছিল। প্রায় এসে পড়েছে।”
হঠাৎ পুরুষালী কন্ঠে সারা ক্লাসে ধ্যান সেদিকে যায়, ‘এই ক্লাসে কি জেরিন মহুয়া পড়ে?”
এর মধ্যে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে মহুয়ার দিকে ইশারা করে।
মহুয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমাকে খুঁজছে কেন?”
“ওইদিন বাস্কেটবল কোর্টে যা হয়েছে হয়তো তার জন্য।”
“ওই জাহানের বাচ্চা আমাকে ক্লাসে এসে বিরক্ত করবে? এত সাহস হবে তার?”
“তার ফ্যামিলির ইনফ্লুয়েন্স অনেক। তাকে কে কি করবে?”
” সে তো আর আমাকে চিনে না। আমাকে বিরক্ত করলে তার রক্ষে নেই।”
কথা বলার সময় সে দেখে ছেলেটা বের হয়ে একটি ছেলের সাথে আসে। ছেলেটাকে দেখে সকলে একটু এগিয়ে আসে তাকে ভালো করে দেখার জন্য। ছেলেটি জাহান না। অন্য সুদর্শন ছেলে একনাগারে এগিয়ে আসে মহুয়ার দিকে। এসে তার সামনে দাঁড়ায়, “মহুয়া রাইট?”
মহুয়া মাথা নাড়ায়। ছেলেটি বাঁকা হেসে তার হাত এগিয়ে দিয়ে বলে, “নাইস নেম। আমি তিসান। তিসান আহমেদ ইহসান। তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।”
মহুয়া হাত মেলায় না। সে বুঝতে পাড়ে না ছেলেটা তার সাথে দেখা করতে এসেছে কেন? সে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।
তিসানের হাতের ইশারায় তার সামনের বেঞ্চের মেয়েরা সরে পড়ে। সে হাইবেঞ্চে বসে বলে, “তোমার হয়তো পেঁচানো কথা পছন্দ না। তাই সরাসরি বলি। গতসাপ্তাহে আমি ভার্সিটি ছিলাম না তাই দৃশ্যটা মিস করেছিলাম কিন্তু তোমার সেদিনের ভিডিও পড়ে দেখলাম। সবাই রেকর্ড করে রেখেছিল। তুমি তো জোস। আমি আগে এই ভার্সিটিতে এত সাহসী মেয়ে দেখিনি।”
“প্রশংসা করতে খুঁজছিলেন?”
“ঠিক তা না। জাহান ওদিন অকারণে তোমায় আঘাত করল। ও এটায় ভালো পাড়ে। মানুষকে আঘাত করতে।”
কথাটা বলার সময় তার হাসি হাসি কথাটা গম্ভীর হয়ে গেল। তবে আবার সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল, “তুমি ওদিন জাহানকে যেভাবে শিক্ষা দিয়েছ তা প্রশংসনীয়। তবে ও নিশ্চয়ই আরও ক্ষেপে গেছে। ও এবার তোমার পিছনে পড়বে। আর এই ভার্সিটিতে ওর বিপক্ষে দাঁড়ানোর ক্ষমতা কেবল আমাদের দলের আছে। শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়। তুমি আমার দলের অংশ হয়ে যাও। তোমায় রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।”
মহুয়া হেসে দেয়,”আপনি সেদিন ভিডিও দেখেছেন তাই না?”
“হ্যাঁ। কিন্তু তুমি হাসছো কেন?”
“আপনার মনে হয় আমাকে রক্ষা করার জন্য কাওকে লাগবে? আমি নিজেই নিজেকে প্রটেক্ট করতে পারি। আর আমার কারো সাথে শত্রুতামি নেই। যে আমার সাথে যেমন ব্যবহার করে আমি তার সাথে তেমনই ব্যবহার করি।”
তিসান হেসে উঠে দাঁড়ায়, “এজ ইউর উইশ। বাট তারপরও যদি তোমার কখনো প্রয়োজন পড়ে তাহলে আমি আছি হেল্প করার জন্য। ওকে?” বলে তিসান যেতেই কয়েকজন তার পিছনে বেরিয়ে যায় ক্লাস থেকে।
” এ আবার কে?” মহুয়ার প্রশ্নে তার পিছনের বেঞ্চের একটি মেয়ে উওর দেয়, “তুমি তিসান আহমেদ ইহসানকে চিনো না? তিসান আহমেদ ইহসান ‘ইহসান বিল্ডারস’ এর মালিকের ছেলে। বাংলাদেশের স্বনামধন্য বিল্ডারস। আর সাথে তিসান মাঝেমধ্যে শখের বসে মডেলিংও করে। তুমি আগে তাকে দেখো নি? তার ছবি বিলবোর্ডেও এসেছিল?”
মৃণা বলে, “আমি দেখেছিলাম।”
“দেখেছ? তোমার বান্ধবীও দেখেছে। কোন জগতে থাকো তুমি?”
.
.
“ভাই মেয়েটা আপনার মুখের উপর মানা করে দিলো। আপনি কিছু বললেন না?” তিসানের পিছন থেকে একটি ছেলে বলে।
“অসুবিধা নেই। জাহান যখন বিরক্ত করবে উপায় না পেয়ে নিজেই আসবে আমার কাছে। ও যেভাবে অপমান করেছে জাহান ওকে ছেড়ে দিবে না’কি!”
তারা লিফটে ঢুকে। ছেলেটি আবার জিজ্ঞেস করে, “ভাই তাহলে আমরা কি করব এখন?”
“কিছু করা লাগবে না। যা হবার হতে দে।”
লিফট নিচে আসে। দরজা খুলে। তিসান বের হতেই তার সামনে একটি মেয়ে চলে আসে। সে দৌড়ে আসছিল। হঠাৎ তাকে দেখে থেমে যায়। তিসান তাকে দেখে চোখ সরাতে পাড়ল না। আকাশী রঙের পোশাক পরিহিতা মেয়েটি যেন সদ্য আসমান থেকে নেমে এসেছে। পুতুলের মতো বড় বড় চোখ দুটোয় কাজলমাখা, গায়ের রঙ কিছুটা ফর্সা, নিখুঁত ঠোঁটজোড়া। সে কোনোমতে চোখ সরাতে পাড়ল না। মেয়েটা তার পাশ কাটিয়ে লিফটে উঠার সময়ও সে চোখ সরায় না। পলকও ফেলতে ভুলে যায়। ধীরে ধীরে লিফটের দরজা বন্ধ হতে থাকে।
“ভাই আপনার কি মেয়েটাকে মনে ধরেছে? ধামাব?” তার পাশ থেকে একটি ছেলে বলে।
তিসান হাতের ইশারায় তাদের থামায়। দরজাটা বন্ধ হওয়ার পর অবশেষে তার চোখ সরে।
চলবে….