মেঘের খামে…
পর্ব ২৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
সে মুহূর্তে শায়ানের চোখের সামনে ভেসে উঠে এক অন্ধকার রুম। চারদিকে ঘুটঘুটে আঁধার। বিছানার একপাশে হাত ভাঁজ করে বসে আছে ছোট একটি ছায়া। কাঁপছে। চোখে পানি ভাসছে। বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু কেউ আসে না। কারও দেখা পায় না।
মহুয়া জিজ্ঞেস করে, “কার কথা বলছ?”
“কেউ না।”
শায়ানের উওরে বিরক্ত হয় মহুয়া। খানিকক্ষণ পূর্বে পূর্ণিও একই কাজ করল। কৌতুহল জাগিয়ে কথা লুকানোর মানে কী?
“উওর না দিলে এই কথা তুললে কেন?” মহুয়া বিরক্তির নিশ্বাস ছাড়ে ফোঁস করে। তারপর তার মাথায় আসে অন্য কথা, ” তুমি বলতে চাচ্ছো মেয়েরা স্বার্থপর হয়? বিশ্বাসঘাতক হয়?”
“তা হয় না?”
“অবশ্যই না। তুমি তো দেখলাম তোমার দাদীর সাথে, পূর্ণির সাথে অনেক ক্লোজ। তারাও কী এমন?”
“তাদের কথা আলাদা।”
“মোটেও আলাদা না। তারাও নারী। যাদের মনে মমতা ভরা। মা জাতি। আল্লাহ তো একারণেই মা’দের পা’য়ের নিচে জান্নাত দিয়েছেন। তারা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে জানে।”
শায়ান মেকি হাসে। সে বলতে চায়, “না। সব মা’য়েরা নিঃস্বার্থ ভালোবাসতে জানে না। আমার মা জানতো না।” তবে কিছু বলে না। তার ইচ্ছে হয় না এই মুহূর্তে মহুয়ার সাথে ঝগড়ায় বাঁধতে। সে মেঘহীন আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
মহুয়া আবারও বলে, “আর রইলো বিশ্বাসঘাতকতার কথা। তুমি মেয়েদের কথা বলছো অথচ তুমি নিজেই বিশ্বাসঘাতকতা করছো। এত মেয়েদের সাথে সম্পর্ক যে করছ, ভবিষ্যতে তোমার ভালোবাসার মানুষকে কী উওর দিবে?”
“আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে আমি ভবিষ্যত ভাবি না। ও অন্যকাওকে ভালোবাসে। আমার দায়িত্ব তাকে সে ভালোবাসা দেওয়া।”
মহুয়া তার দিকে তাকায়। তার মানেটা ঠিকই বুঝে। সে জাহানের কথা বলছে। তার কৌতূহল জাগল। সেদিন ক্যাফের কথা মনে করে তুক্কা মারল, “রশ্মির কথা বলছ?”
শায়ান ভূত দেখার মতো আশ্চর্যজনক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। সে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়, “তুমি রশ্মির কথা কীভাবে জানো? এটা বলো না জাহান বলেছে। জাহান কখনো রশ্মির নাম মুখেও আনবে না।”
“ওহ, এত ভালো করে চিনো জাহানকে? অফকোর্স শুনেছি তোমরা বন্ধু ছিলে। তো ওই মেয়ের কারণেই ফ্রেন্ডশিপ শেষ করে দিলে? ইউ নো রাইট আমরা জোর করে কাওকে ভালোবাসতে বা ভালোবাসাতে পাড়ি না।”
“তুমি কী তিসান ও জাহানের মধ্যে যেমন সব ঠিক করেছ তেমন আমাদের মধ্যে করতে চাও? তোমার ফ্রী গাইডেন্স আমি চাইনি। আর আমি তিসানের মতো নরম না যে কয়েকটা কথায় গলে যাব।” শায়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আই হেইট হিম। ওকে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি।”
“তো নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের সবচেয়ে ঘৃণা করা মানুষের কাছে দিতে চাও? নাউ দ্যাটস নিউ।” মহুয়া তার সামনে এসে দাঁড়ায়, “আই মিন তোমার ভালোবাসার মানুষের খুশির জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া এসব কেবল সিনেমা আর উপন্যাসেই ভালো শোনায়। যদি তুমি তাকে ভালোবাসো তাহলে অন্যকেউ তার সাথে জীবন কাটাবে এই চিন্তাও কীভাবে আসে? ভালোবাসায় পরাজিত হওয়া তো সবচেয়ে বেশি অপমানজনক। এর থেকে বেশি অপমানজনক না চেষ্টা করে তাকে অন্যকারো জন্য ত্যাগ করা।”
শায়ান তার হাত বুকের উপর ভাঁজ করে, “আর তুমি ভালোবাসা সম্পর্কে এতকিছু কীভাবে জানো? আমি যতটুকু জানি তুমি তো প্রেম করো না।”
“তো কি? প্রেমকাহিনী তো দেখি। জানো আমি কয়টা কে-ড্রামা, সি-ড্রামা দেখেছি? বলিউড লাভ স্টোরির তো অভাব নেই।”
“প্রেমের যত শত গল্প দেখো কিন্তু মনে রেখো জাহান কিন্তু কেবল রশ্মিরই হবে। রশ্মির খুশির জন্য আমি যা পাড়ি সব করব। ওর চোখের পানি আমি দেখতে পাড়ি না। ভুলেও জাহানের প্রেমে পড়বে না, নাহলে তোমার শত কান্নার কারণ হতে পাড়ি আমি। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে এতদিনে তোমার আইডিয়া হওয়া উচিত ছিলো।”
মহুয়া তার কথায় হাসে, “তোমার মনে হয় আমি তোমাকে ভয় পাই?”
মহুয়া তার সামনে ঝুঁকে বলে, “শিকদার সাহেব একটা কথা মনে রেখো, মহুয়া কারো নিয়ন্ত্রণের জিনিস নয়। আমি যার ইচ্ছা তার প্রেমে পড়বো, আমি যাকে চাই তাকেই বিয়ে করব, আমাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পাড়বে না। আর আমি যদি কারো প্রেমে পড়বো তাকে অন্যকারো জন্য বিসর্জন করব না। তাকে নিজের নামে লিখেই ছাড়ব।”
মহুয়ার শায়ানের চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলল। মেঘলা আকাশ ঝরে পড়ল দু’ফোঁটা জল শায়ানের গালে গাল ছুঁয়ে গেলে সে মহুয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। তীব্র বাতাসের বেগে মহুয়া বিড়ালকে নিজের কোলে লুকিয়ে শায়ানকে বলে,
“বৃষ্টি পড়ছে, আমি দ্রুত যাই। আমি বিল্লুভাই আজ আমার সাথে থাকুক আগামীকাল দিয়ে যাব।”
মহুয়া পিছনে ফিরে যাবার পূর্বেই তার একপাশে থাকা ওড়নাটা উড়ে যায়। প্রবল বাতাসের বেগে শায়ানের পাশ দিয়ে উড়ে যেতে নিলেই শায়ান তা ধরে নেয়। সামনে যেয়ে মহুয়াকে পরাতে নিলেই মহুয়া ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ওড়না নিয়ে দৌড়ে নিচে নামে। বৃষ্টিতে ভেজার ভয়ে।
আর শায়ান, সে তো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। বিন্দু বিন্দু জল থেকে তীব্র ঝড় শুরু হয়। এই ঝড় তার বুকের ভেতর উথাল-পাথাল করে যায়। এই বৃষ্টি তার আঁধার দিনের চিহ্ন। সে সবসময়ই বৃষ্টিতে ভিজতো কিন্তু তার বৃষ্টি কখনো পছন্দ ছিলো না। কিন্তু আজ কেন যেন এত খারাপ লাগছে না।
.
.
সকাল থেকে মোহ সমুদ্রকে এড়িয়ে চলছে। সমুদ্র দুপুরে কথা বলতে যায়, তার পিছনে ঘুরে কতক্ষণ। মোহ কথা তো বলেই না। পাত্তাও দেয় না। এমনকি বিকেলে মোহের পছন্দের আইস্ক্রিমও নিয়ে আসে তাও নেয় না। সমুদ্র বুঝে, মোহ আইস্ক্রিম নেয় নি, এর মানে সে অনেক অভিমান করেছে।
রাতে খাবারের পর মোহ তার শাশুড়ীর সাথে খাবার ফ্রিজে রাখছিল। মোহের শাশুড়ি ফ্রিজ থেকে দুইটা আইস্ক্রিম বের করে বলল, “ছেলের কান্ড দেখো আইস্ক্রিম নরমালে রেখে গেছে। ছেলেটার কী করবো?”
তারপর তা ফ্রিজারে রেখে তাকাল মোহের দিকে, “ওর সাথে রাগ করে থেকো না মোহ। আমার ছেলেটা একটু এমনই। রাগ বেশি। কিন্তু মন একদম পানির মতো স্বচ্ছ। আমি এটা বলছি না তোমার উপর উঁচু স্বরে কথা বলা বা হাত শক্ত করে ধরাটা ওর উচিত হয়েছে। একদম হয় নি। কিন্তু… কী বলব?”
“একটা প্রশ্ন করি আন্টি?” মোহ কৌতুহলী সুরে জিজ্ঞেস করল।
“বলো।”
“আপনি ও আংকেল আমার সাথে এত হাসিখুশিভাবে কথা বলেন। তাহলে সমুদ্র এলে আপনাদের মুখে আর হাসি থাকে না কেন?”
তার শাশুড়ী ঘন নিশ্বাস ফেলে একপাশে দাঁড়িয়ে। নিরাশাজনক দৃষ্টিতে তাকায় মোহের দিকে, “আমার সমস্যা ছিলো। বিয়ের অনেক বছর পর সমুদ্র আমাদের জীবনে আসে। ও হবার পর আমাদের খুশির ঠিকানা ছিলো না। আমাদের দুনিয়াই তো ও ছিলো। সমুদ্র ছোট থেকেই চঞ্চল আর রাগী ছিলো। কিন্তু এতও না যে কাওকে কষ্ট দিবে। অনেক মিশুক ছিলো, যেকারো মন জয় করতে পাড়তো অতি জলদি। নামাজ পড়তো। কোনো খারাপ অভ্যাস ছিলো না। বন্ধুবান্ধবদেরও অভাব ছিলো না। আমার সাথে সব শেয়ার করতো। মা কমে বন্ধু ছিলাম। তারপর জবার কথাও বলল। প্রথমে বন্ধু হিসেবে বললেও হঠাৎ ওর নামের কথা বেড়ে যায়। একসময় সব কথা ওকে ঘিরেই হয়। আমি তো বুঝেছি কি চলছে। সাপোর্টও করেছি। এর মধ্যে ও বিদেশ গেল। ট্রেনিং নেওয়ার জন্য। অথচ এর মধ্যে শুনি জবা অন্যাকাওকে বিয়ে করে নিয়েছে। ওদেরই ক্লাসমেট। এরপর সমুদ্র দেশে চলে আসে। আসার পর আগের মতো থাকলেও কেমন যেন হারিয়ে গিয়েছিল। ওর ভেতরের সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। না কোনো স্বপ্ন, না কোনো আকাঙ্ক্ষা। কেবল শূন্য হৃদয়। তখন থেকে ওর রাগ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়। ওর অফিস বা বিয়ের কথা উঠলে ঘরে ভাঙচুর, রাগারাগি শুরু করতো। কেমন যেন হয়ে গেছে। দায়িত্বহীন, আকাঙ্খাহীন, ছন্নছাড়া। ওর ব্যবহারে আমার আর তোমার শশুড় আব্বুর বুকে কত কষ্ট জমে আছে তা কাওকে বলতে পাড়ি না। এত দোয়ার পর আমার ছেলেটাকে পেয়েছিলাম, রাজকুমার করে রেখেছি কলিজার সাথে লাগিয়ে কিন্তু এক মেয়ের জন্য নিজের মা বাবার সাথে সাজানো সব স্বপ্নও ভুলে গেল। তোমার মতো আমাদের সাথেও এমন রাগ করতো। আরো বেশি করতো। কীভাবে সহ্য করি ছেলের এত খারাপ ব্যবহার আমরা জানি।” বলতে বলতে তিনি কান্না করে দেন। মোহ দৌড়ে এসে তাকে ধরে। সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে। তিনি মোহের হাত ধরে বলেন, “মোহ আমি জানি আমি তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করেছি। এর শাস্তি আল্লাহ যা দিবে আমি সব সহ্য করবো। কিন্তু একজন মা নিজের ছেলেকে প্রতি মুহূর্তে কীভাবে শেষ হতে দেখতে পাড়ে বলো? তাই আমি ওকে বিয়ের জন্য জোর করেছি। ভেবেছি বউ আসলে সব ভুলে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই নিজের জীবন নিয়ে ব্লাকমেইল করে ওকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছিলাম। কিন্তু আমি আসলেই মনে করেছি সমুদ্র সব ভুলে নতুন জীবন শুরু করবে। কিন্তু গতকাল যখন ও বলল নামমাত্র বিয়ে তখন… আমাকে মাফ করে দিও। নিজের ছেলের খুশির সামনে এতই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে অন্যের মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছি।”
মোহ প্রথমে বুঝল না কী বলবে। প্রথমদিন কঠিন ভাবে কথা কথা বললেও ধীরে ধীরে বুঝে সমুদ্রের মা আসলে এত খারাপ নয়।কিন্তু তিনি যে তার সাথে সত্যিই অন্যায় করেছেন তা অস্বীকার করার মতো নয়। সে কিছু না বলে জড়িয়ে ধরে সমুদ্রের মা’কে।
সমুদ্রের মা এই উষ্ণতা পেয়ে হাউমাউ করে কান্না করে উঠে, “তুমি আমাকে মাফ করে দিও মোহ। মা’য়ের নিঃস্বার্থ
ভালোবাসতে জানে কিন্তু নিজের সন্তানের জন্য স্বার্থপর হয়ে যায়। আর পাড়লে আমার ছেলেটাকে একটু ভালোবেসো। নিজের ভালোবাসা দিয়ে ওর মন জয় করে দেখো, ও সারা বিশ্বের সুখ তোমার পা’য়ের কাছে এনে দিবে।”
সমুদ্র রুমে এসে দেখে মোহ বিছানায় শুয়ে আছে। মুখের উপর ওড়না দিয়ে। ফ্যানের বাতাসে একপাশে তার কেশগুলো ময়ূরের মতন নাচছে। সে নিজের হাতের বাক্স টেবিলের উপর রেখে মোহের কাছে যায়।
“মধু…এই মধু…” ডাক পড়লেও মোহ উঠে না। কোনোভাবেই পাত্তা দিবে না সমুদ্রকে।
সমুদ্র সাড়া না পেয়ে তার ওড়না আলতো করে মুখ থেকে সরায়। ফ্যানের বাতাসে তার চুলোগুলো আরও এলোমেলো হয়ে যায়। মুখে এসে যন্ত্রণা দেয়। মোহ উঠে সমুদ্রকে দেখে ভারী বিরক্ত হয়। সমুদ্রের হাতে ওড়নার একপাশ দেখে টান দেয়। ওড়না ঠিক করে নিজের চুলগুলো খোঁপা করে নেয়। নিচে নেমে যেতে নিলেই সমুদ্র হাত হাত ধরে নেয়।
“কী সমস্যা?” মোহ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে।
“সরি মধু। ভুল হয়ে গেছে তো। আর করব না প্রমিজ।”
“হাত ছাড়ুন।”
“দেখো তোমার জন্য এক বাক্স আইস্ক্রিম এনেছি।”
“আইস্ক্রিমে নিজের অপমান ভুলে যাব। আমার বাবা আমার উপর আজ পর্যন্ত উঁচু স্বরে কথা বলে নি। আর আপনার এত সাহস আমার অপমান করেছেন।”
“আই প্রমিজ। এই ফাস্ট, এই লাস্ট। আর হবে না। আরেকবার এই ভুল হলে তুমি যে শাস্তি দিবে তা আমি মাথা পেতে মেনে নিব।”
মোহ ভেংচি কেটে বিছানায় বসে। রাগে ফেঁপে ফুলে উঠে।
সমুদ্র বাক্স থেকে দুইটা চকোলেট এনে তার পাশে বসে, “তো বাট্টি?”
“কী?” মোহ তার কথা বুঝে না।
“ছোটবেলায় ঝগড়া হলে কাট্টি করতাম। আর ঝগড়া ঠিক হলে বাট্টি করে নিতাম।”
“নো বাট্টি।” মোহ তার হাত থেকে আইস্ক্রিম নিয়ে খুলে খাওয়া শুরু করে।
“তুমি কালকে রাতে আমাকে যেভাবে খামচে ধরে ঘুমিয়েছ, ওই হিসেবে আমার শাস্তি মওকুফ করা উচিত ছিলো। তারপরও আমি এত ঘুরঘুর করছি, তবুও তোমার মন গলছে না। নির্দয়া মহিলা।”
মোহ বড় বড় চোখে তাকায় তার দিকে, “আআ… আমি?”
“নয়তো কি আমার দশটা বউ আছে যে অন্যকেউ পাশে ঘুমাবে?”
“আমি তো নিচে ঘুমাচ্ছিলাম আপনি আমাকে বিছানায় নিলেন কীভাবে?”
“কোলে তুলে।”
“কো…আপনি কোলে তুলতে গেলেন কেন?”
“কারণ তোমার নিচে ঘুমাতে কষ্ট হবে। আমি কী জানতাম তোমাকে পাশে শোয়ালে তুমি আমার ইজ্জতে নজর দিবে।”
মোহ বাকরুদ্ধ হয়ে যায় তার কথা শুনে। তার গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হয় না আর। সে হা করে তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে। লজ্জায় তার গাল, কান সব নরম হয়ে যায়। সে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আইস্ক্রিম খেতে থাকে। যেন সে কিছুই শুনে নি।
সমুদ্র তার কানের কাছে এসে বলে, “এমনি তোমাকে ধরে ঘুমিয়ে অনেক আরাম লেগেছে। অনেক বছর পর এত ভালো ঘুম হলো। মনে হচ্ছিল কোলবালিশ ধরে ঘুমাচ্ছি।”
মোহ তার দিকে তাকায় রাগান্বিত দৃষ্টিতে। একটি বালিশ দিয়ে তাকে কতগুলো মেরে বলে, “আপনি নিচেই ঘুমাবেন আজ থেকে।” বলে বালিশ নিচে ফেলে সমুদ্রের হাত থেকে আইস্ক্রিম নিয়ে যায়, “আপনার জন্য কোনো আইস্ক্রিম নেই।”
“এত্তগুলা আইস্ক্রিম এনেছি। তুমি আমাকে একটা দিতে পাড়বে না?”
“না।”
“নির্দয়া নারী।”
“যান এখান থেকে। আমি এখনো আপনাকে মাফ করিনি। ভাবছে একটু আইস্ক্রিম আনলে আমি গলে যাবে। দফা হোন আমার চোখের সামনে থেকে।”
সে সমুদ্রের আইস্ক্রিম খুলে দুইটা একসাথে খেতে থাকে। সমুদ্র হাসে তাকে দেখে। রাগ তো ভেঙেছে সে নিশ্চিত, এখন কেবল অভিমান ভাঙানো বাকি।
.
.
শায়ান বৃষ্টিতে ভিজে এসে শাওয়ার নিলো। ভিজে চুবচুবে হয়ে গিয়েছিল। শায়ান নিয়ে এসে চুল মুছছিল টাওয়াল দিয়ে। হঠাৎ রুমে নক পড়ে। সে টাওয়াল রেখে আলমিরা থেকে গেঞ্জি বের করে। পরতে পরতে যেয়ে দরজা খুলে। সিনথিয়াকে দেখে কপাল কুঁচকায়, “এত রাতে তুমি আমার রুমে কী করো?”
“আমি তো কতবার এসে ঘুরে গেলাম। আপনি তো দরজাই খুলছেন না। আপনি তো বলেছিলেন আপনি আমার সাথে ঘুরতে যাবেন। কবে যাবেন? আগামীকাল যাই? কোথায় যাবেন?”
শায়ান তার কথায় প্রচন্ড বিরক্তবোধ করে সে টেবিলের কাছে যেয়ে ড্রয়ের খুলে সিগারেট বের করে, “পড়ে দেখা যাবে।”
আচমকা সিনথিয়া এসে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, “শায়ান আপনি এত নিষ্ঠুর কেন? আমি আপনার জন্য মহুয়ার সাথে ঝামেলায় জড়ালাম। আর আপনি আমার দিকে ঠিক ভাবে তাকাচ্ছেনও না। আপনি জানেন আপনাকে প্রথম দেখায় আমি প্রেমে পড়ে গেছি।”
শায়ান পিছনে ঘুরলে সিনথিয়া তার গলা জড়িয়ে বলে, “আপনার মতো সুদর্শন ছেলে আমি এর আগে দেখিনি।”
শায়ান তার কথার উওর দেয় না। তার প্রতি ইন্টারেস্ট আসছে না শায়ানের। সে সিগারেটের একটান দিয়ে তা সিনথিয়ার মুখের উপর ছাড়ে। সিনথিয়ার তা বিচ্ছিরি লাগলেও সে সহ্য করে নেয়। এক হাত দিয়ে শায়ানের কপাল, গাল, ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে, “এই মুখ এটা আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলে আমার জীবন স্বার্থক।”
“আমি সারাজীবনের কমিটমেন্ট করতে পাড়ব না। তবে আজ রাত ফ্রী আছি।”
কথাটায় সিনথিয়া অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
শায়ান তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “হোয়াট? থাকো, নাহলে যাও। ডোন্ট ওয়েস্ট মাই টাইম।”
সিনথিয়া কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর নিজেই শায়ানের কাছে যেয়ে পা’য়ের পাতা উঁচু করে তার মুখোমুখি হলো। মৃদুস্বরে বলল, “তোমার জন্য আমি সব পাড়ব।”
তার ঠোঁটের দিকে এগোতে গেলে শায়ান তার ঘাড়ে হাত রাখে। চোখ বন্ধ করে তাকে কাছে টানতে নিলে হঠাৎ তার কিছু একটা হয়। আচমকা চোখ খুলে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তাল সামলাতে না পেড়ে সে নিলে পড়ে যেতে নিয়েও সামলে নেয়। তার চোখেমুখে স্পষ্ট রাগ কিন্তু শায়ানকে কিছু বলতে পাড়ে না। শায়ানের পরিবারের সামনে তারা কিছু না। এমনকি ঘরে তার বোনের শশুড় থেকেও শায়ানেরই বেশি চলে।
তাই ক্ষেপে যাওয়াটা বোকামি ছাড়া কিছুই না।
সে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করে, “হঠাৎ কী হলো? তুমিই তো বলেছিলে…”
সে আবার কাছে এসে শায়ানকে ধরতে চাইলে সে মুখ চেপে ধরে সিনথিয়ার, “তোদের মতো মেয়েকে আমি চিনি না? তোদের আমি না, আমার টাকা আর ক্ষমতা পছন্দ। তোর কি মনে হয় আমি তোকে মহুয়ার ভাইয়ের উপর ঠেলে পড়তে দেখিনি অনুষ্ঠানে? তোদের মতো মেয়েদের দুই পয়সার মূল্য নেই আমার কাছে। এরপর আমার সামনে আসলে জান নিয়ে নিব। গেইট আউট।”
সে সিনথিয়াকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। সিনথিয়া বলে, “কিন্তু… ” অথচ শায়ানের রক্তিম চক্ষুবর্ণ দেখে থেমে যায়। ভয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে। এক দৌড়ে পালায়।
শায়ান থপ করে বিছানায় বসে নিজের চুল টেনে ধরে,চোখ খিঁচে বন্ধ করে রাখে। বোধহয় সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। সিনথিয়াকে কিস করার সময় তার মহুয়ার সে কথাটা কীভাবে মনে পড়ল, “এত মেয়েদের সাথে সম্পর্ক যে করছ, ভবিষ্যতে তোমার ভালোবাসার মানুষকে কী উওর দিবে?”
সে তো একজনকেই ভালোবেসেছে একজীবন, রশ্মিকে। তাকে জাহানের সাথে বিয়ে দেবার প্রতিজ্ঞা করেছে সে। তাহলে তার এই কথা ভাবার কী আছে? সে তো আর বিয়ে করবে না। অন্য কাওকে ভালোবাসবে না। তাহলে তার এমন অপরাধী অনুভব হবারও কিছু নেই।
.
.
শায়ানের ঘুম ভাঙে দেরিতে। রাতে ভালো ঘুম হয় নি৷ উঠে ফ্রেশ হয়ে সে দেখে মুহিবরা এসেছে। হাসি-ঠাট্টা করছে তারা। শায়ান জিজ্ঞেস করে, “সকাল সকাল এত দাঁত কেলাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে?”
“ভাইয়া তুমি তো ঘুমে চক্করে সকাল ড্রামা মিস করে দিলা।”
“কিসের ড্রামা? ”
“সকালে উঠে দেখি বাহিরে সেই ভিড়। চেঁচামেচি হচ্ছে । দেখি সিনথিয়া, মানে বড়ভাবির বোনের চুলে চুইঙ্গাম লাগানো। আরও একদম উপরে। চুলে ভরা। মহুয়ার থেকেও বেশি। ওরা চুইঙ্গাম লাগানোর কম্পিটিশন শুরু করেছে। কী রকটা হাসির ড্রামা হয়েছে। ”
শায়ানের মোটেও ইন্টারেস্ট আরে না। সে একবারেই বুঝে যায় এসব মহুয়ার কান্ড। প্রতিশোধ নিচ্ছে। নিক, তার কী? তার এসবে ইন্টারেস্ট নেই।
“ভাইয়া জলদি তৈরি হও। চাচ্চু বলেছে সেন্টারে যেয়ে সব দেখে আসতে। কোনো কমতি থাকা যাবে না।” মুহিব বলল।
শায়ান তৈরিই ছিলো। টাউজার আর কালো গেঞ্জি পরা। স্যুটকেস থেকে অলিভ কালারের একটি জ্যাকেট বের করে পরে নিলো। নিচে যেতে যেতে হঠাৎ তার হাত আর ঘাড় চুলকাতে শুরু করল। যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ভীষণ অস্বস্তিকর লাগছে।
নিচে যেতে যেতে এই চুলকানো আরও বাড়ে। একবার সে হাতে চুলকায় আবার ঘাড়ে। আঙ্গনে বসে ছিলো সকলে। মহুয়া, আঁখি, পূর্ণি, দাদীসহ তার চাচীরাও। চা খাচ্ছিল সবাই। শায়ানকে এমন অস্বাভাবিক ব্যবহার করতে দেখে পূর্ণি জিজ্ঞাসা করে, “ভাইয়া কী হয়েছে তোমার?”
“বান্দরের রাজা বান্দরনাচ দেখাচ্ছে।” মহুয়া বলে মিটিমিটি হাসে।
শায়ান তাকে চোখ রাঙায়। যা মহুয়া মুখ ঝামটে উড়িয়ে দেয়।
ছোট চাচী বললেন, “বোধহয় এলার্জি হয়েছে।”
মুহিব অবাক হয়,”ভাইয়ের তো এত এলার্জি নাই কিছু থেকে।”
দাদী পরামর্শ দেয়, “তুই এর থেকে ভালো গোসল করে আয়। অনেক দৌড়াদৌড়ি পড়ছে তো। জায়গাটাও আসার আগে ভালো করে মনে হয় পরিষ্কার করে নাই। চাকরগো কাম আরকি। যা গোসল করে আয়।”
শায়ান দাদীর কথামতো যেতে নেয়। এর পূর্বে তার চোখ পড়ে মহুয়ার দিকে। তার মিটিমিটি হাসিতে সন্দেহ হয় তার। তারপর মনে পড়ে গতকাল সে মহুয়াকে তার রুমের কাছে দেখেছিল। হঠাৎ তার মাথায় ব্যাপারটা ক্লিক করে। আর সে রেগেমেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “এই পাগল মেয়ে এই কান্ড তুমি ঘটিয়েছ তাই না?”
মহুয়া থতমত খেয়ে যায়। শায়ান তাকে দেখেই প্রশ্ন করছে। সে মাসুম সাজার ব্যর্থ চেষ্টা করল, “আমি কেন করব?”
“গতকাল গুনগুনিয়ে তুমি আমার রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলে। মিথ্যে বলবা না। মিথ্যে বললে তোমার টেস্টবাড নষ্ট হয়ে যাবে দেখো।”
“এই খারাপ লোক, আমাকে যা বলার বলা আমার জিহ্বাকে কিছু বলবা না। মানুষ অক্সিজেনে বাঁচে আর আমি অক্সিজেন সহ মজার মজার খাবারে।”
“এর মানে তুমিই কিছু করেছ।”
“করেছি তো? নিজে যে পরিকল্পনা করে আমার চুলে চুইঙ্গাম লাগিয়েছ ওটার কী? আমার সিল্কি সিল্কি মিল্কি মিল্কি চুল তো গেছে।”
“তো ক্ষোভ বের করতে গিয়ে কাঁটতে কে বলেছিল? শাঁকচুন্নি ভর করেছিল তোমাকে? ওহ সরি, তুমি নিজেই তো শাঁকচুন্নি।”
মহুয়া দাঁতে দাঁত পিষে বলে, “একদম ভালো হয়েছে। ভালো করেছি। তোর মতো খারাপ লোকের সাথে এইটাই করা উচিত। আমি তোর স্যুটকেসের প্রতিটা জামায় বিছুটি পাতা লাগিয়ে দিয়েছি। অনুষ্ঠানেও এবার সবার সামনে বান্দরনাচ করবি।”
শায়ান রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মহুয়ার দিকে। এভাবে যেন চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিবে। পূর্ণি ডোক গিলে
মহুয়াকে বলে, “আপু ভাইয়া চরম রেগে আছে। ফায়ার হয়ে আছে।”
“তো আমি ভয় পাই না’কি?”
“ভাইয়াকে চিনো না। হাতে পেলে তোমাকে বিছুটি পাতা দিয়ে গোসল করাবে।”
মহুয়া তার দিকে তাকিয়ে ড্যাবড্যাব করে চায়। শায়ান রেগে চেঁচিয়ে উঠে, “মহুয়ার বাচ্চা তোমার একদিন কি আজ আমার একদিন।”
সে মহুয়ার কাছে আসতে নিলে মহুয়া দেয় এক দৌড়।
মহুয়া দাদীর পিছনে যেয়ে লুকায়, “এই ব্যাটা ক্যাটক্যাটা নিজেই তো শুরু করসো। আমি তো আমার মতলব রাখতেছিলাম। কে বলছিল আমার সাথে পাঙ্গা নিতে।”
“তোমার মতলব আমি দেখাচ্ছি। বিছুটি পাতার কারখানায় তোমাকে ফেলে আসবো।”
“দাদী কিছু তো করো।”
“আজ তো দাদী তোমাকে বাঁচাতে পাড়বে না।”
শায়ান মহুয়ার হাত ধরার আগ মুহূর্তে সে ছোঁ করে পালায়।
মুহিবও তার শায়ান ভাইকে সাহায্য করার জন্য যেতে নিলে দাদী থামায় তাকে। তারপর বাহিরে শায়ান ও মহুয়াকে দেখে মুচকি হাসলেন। পূর্ণির হাত ধরে বললেন, “বুঝলা বোন, তোর মেঝো ভাইকে এই এতবছর পর এমন বাচ্চামো করতে দেখেছি। আগে তো ওর দুষ্টুমিতেই ঘর মেতে থাকতো। এত বছর পর আজ আবারও তার বাচ্চামো দেখছি।”
“সব মহুয়া আপুর জন্য।”
দাদী পূর্ণির কানে কানে বলে, “এই মেয়ে তোর ভাবি হলে ভালো হবে না?”
পূর্ণি তো সব বড় বড় করে নেয় কথাটা শুনে। উৎসুকতায় লাফাতে নিলে দাদী তাকে ধরে নেয়। চোখ দিয়ে ইশারা দিয়ে তাকে থামায়।
মহুয়া দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হলে শায়ানও তার পিছু ছাড়ে না। তারা প্রথমে উঠানে যায়, তারপর বাগানে দৌড়ায়, অবশেষে পুকুর পাড়ে এসে থামে তারা। দুজনে হাঁপাচ্ছে। মহুয় কোমরে হাত রেখে বলে, “টাইম আপ। টাইম আপ। আর পাড়ব না।”
শায়ান তার দিকে এগিয়ে আসে, “তোমার খুব রিভেঞ্জের শখ উঠেছিল তাই না? শখ বের করছি তোমার।”
মহুয়া পিছায় তার কাছে আসা দেখে। আঙুল তুলে বলে, “খবরদার কাছে আসবে না, নাহলে তোমার মাথা টাক্কুবেল করে দিব।”
শায়ান আরও দ্রুত কাছে আসে। মহুয়া তত দ্রুতই সরে যেতে নিলে একদম পুকুরের কোণে এসে পড়ে। পড়ে যেতে নিলে শায়ান তার হাত ধরে নেয়। মহুয়া তো পড়ে যেতে নিলে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। সে তো সাঁতার পাড়ে না। তবে পানিতে না পড়ায় সে চোখ খুলে আস্তে ধীরে। শায়ান তার হাত ধরেছে সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। বলে, “যাক যত ভেবেছিলাম তুমি এতও বাজে না।”
তখন শায়ান একটা বড় হাসি দেয় আর ছেড়ে দেয় মহুয়ার হাত।
শব্দ হয় পানিতে পড়ার। মহুয়াকে পানিতে ছেড়ে শায়ান সন্তুষ্টি নিয়ে বলে, “তোমার ভাবনা থেকে বেশি বাজে।”
তবে শায়ান দেখে মহুয়া পানিতে ঝাঁপাচ্ছে। অস্পষ্টভাবে কিছু বলছে। এই মেয়ে কী সাঁতার জানে না না’কি?
জ্যাকেট খুলে শায়ানও ঝাঁপ দেয় পানিতে। সাঁতার কেটে মহুয়ার কাছে যেয়ে তার কোমর ধরে পানিতে তুলে।
মহুয়া কেশে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে। অনেকক্ষণ পর সে চোখ খুলে ভালো করে তাকিয়ে শায়ানকে দেখে রাগে ফুঁসে উঠে। তাকে ধাক্কা দেবার চেষ্টা করে, “শয়তান শায়ান তোর এত বড় সাহস আমাকে ছোঁয়ার।”
মহুয়া তাকে ধাক্কা দিলে শায়ান আরও শক্ত করে তার কোমর জড়িয়ে ধরে। এত কাছে আসায় মহুয়া স্তব্ধ হয়ে। তার চোখ দুটো বড় হয়ে আসে।
পানিতে এতক্ষণে মহুয়ার মুখ লালচে হয়ে গিয়েছিল। দম আটকে থাকার কারণে। তার চুলগুলো মুখের সাথে লেপ্টে আছে। মুখে বিন্দু বিন্দু জল মুক্তার ন্যায় গড়িয়ে পড়ছে। শায়ান সে মুহূর্তে চরম আকর্ষণ অনুভব করল। কিছু একটা টানল তাকে মহুয়ার দিকে। সে ঢোক গিলে
আনমনে মহুয়ার মুখ থেকে আলতো হাতে চুল সরিয়ে দিলো।
শায়ানের মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে মহুয়ার দৃষ্টি সরু হয়ে যায়। সে আবার ধাক্কা দিয়ে সরাতে গেলে শায়ানের হুঁশ ফিরে। সে করছিলটা কী? সাথে সাথে সে মহুয়াকে ছেড়ে দিলে সে আবারও ডুবে যেতে নেয়। শায়ান তাকে ধরে উঠায়। সাথে করে পুকুরের পাকা সিঁড়ির কাছে এনে বসায়। মহুয়া সিঁড়িতে বসে মুখ তুলে শায়ানের দিকে ক্ষোভের দৃষ্টিতে তাকায়।
শায়ান তার সাথে চোখ মেলায় না। সে একটু আগে মহুয়ার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছে এই ব্যাপারটা সে মানতেই পাড়ছে না। তা হোক এক মুহূর্তের জন্য। তবে এই ব্যাপারটা সে কিছুতেই স্বীকার করবে না। তাই সে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “তোমার কী মাথা খারাপ? পানিতে যেভাবে ধস্তাধস্তি করছিলে। নিজে ম’রতে আমাকেও মারতে।”
“তুমি তাহলে আমাকে এভাবে ধরেছিলে কেন?”
“সাধে তোমাকে আমি ছোঁব? স্বপ্নেও ভাববে না। না ধরলে ডুবে ম’রতে। তারপর সবাই আমাকে এসে ধরতো। জোর করে বাঁচাতে হয়েছে তোমাকে। তোমাকে ধরে আমার হাতটাও ময়লা হয়ে গেল।” সে হাত দু’টো গেঞ্জিতে মুছে। সে দেখে মহুয়া রেগেমেগে আগুন হয়ে গেছে। অন্তত তার কাজ তো হলো। মহুয়া ভুলেও ভাববে না শায়ান তার প্রতি আকর্ষিত হয়েছিল।
মহুয়া উঠে দাঁড়িয়ে শায়ানকে বকতে যাবে আর শায়ান দ্রুত ডানে বামে মাথা ঝাঁকায়। শায়ানের চুলের পানি এসে পড়ে মহুয়ার মুখেতে। মহুয়া চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখে।
শায়ান আঙুল দিয়ে আঁচড়ে চুল পিছনে সরায়। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে। নিচে তাকিয়ে দেখে মহুয়া ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে নীল রঙের জামাটা লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। শীতে কাঁপছে সে। সে মাটি থেকে নিজের জ্যাকেটটা নিয়ে মহুয়ার সামনে যেয়ে তার দিকে এগিয়ে দিলো, “এটা পরে নেও।”
মহুয়ার তার দিকে তাকায়। এই প্রথম তার ভালোদিক দেখে অবাকও হয় বটে। সে জ্যাকেটটা নিয়ে ছোট করে বলে, “থ্যাঙ্কিউ।”
শায়ানকে আবারও সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে যেতে দেখে মহুয়া। তারপর জ্যাকেটটা দেখে বলে, “শয়তানটার মাঝে অন্তত একটু তো ভালোদিক আছে।”
সে জ্যাকেটটা পরে নেয়। পরক্ষণেই তার হাতে চুলকানি শুরু হয়। যা বাড়তেই থাকে। তারপর তার মনে পড়ে এই জ্যাকেটে সে বিছুটি পাতার ছোঁয়া লেগেছিল। রাগে, ক্ষোভে সে তাকায় শায়ানের যাওয়ার দিকে। একে ভালো ভেবেও অপরাধ করেছে সে। সে চেঁচিয়ে উঠে, “শয়তান শায়ান তোকে আমি আমি ছাড়ব না।”
শায়ান উল্টোদিকে ফিরে বলল, “এতটুকু হাইট নিয়ে ধরতেও পাড়বে না। বিছুটি পাতার ছোঁয়া আমাকে লাগাতে এসেছিলে। এখন নিজে ইনজয় করো সুইটহার্ট।”
মহুয়া রাগে জ্যাকেটটা খুলে সিঁড়িতেই ছুঁড়ে মারে।
চলবে…
মেঘের খামে…
পর্ব ২৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
মুরাদ অফিসের জন্য তৈরি হয়ে কোর্ট হাতে নিলো। নিচে নেমে দেখল সবাই ব্রেকফাস্ট করছে। তার মা, বাবা ও মৃণা। সে ডাইনিং টেবিলের কাছে যেয়ে চেয়ার টেনে বসল। তারা গতকাল রাতেই এসেছিল শ্রাবণীর বিয়ে থেকে। আসার পড়েই ঘরে তুমুল এক ঝড় যায়। মৃণা মহুয়াকে জানায় বাসা পাল্টানোর কথা। অবশ্য জানায় না। মৃণার কোনো জিনিস বাসায় না পেয়ে মহুয়া জানতে পাড়ে আর ধরে বসায় তাকে সভা গড়ে। এতে কেবল মহুয়া না তাদের বাবাও ক্ষেপে যায়। সন্ধ্যায় আসার পর সবাই খাওয়াদাওয়া বাদে বিচার বসায়। মৃণা তিনঘণ্টা বুঝিয়ে সবাইকে শান্ত করে। তবে একটা শর্তে শুত্রুবার ও শনিবার মৃণার তাদের সাথে থাকতে হবে।
সকালে মৃণাকে বাসায় দেখে মুরাদ জিজ্ঞেস করে,
“ভার্সিটিতে যাস নি?”
” দুইটা ক্লাস ক্যান্সেল করে দিয়েছে। যে ক্লাসদুটো হবে সেগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ না। আর নতুন বাসার একটু জিনিস কিনতাম।”
“তাহলে তোর বান্ধবী কোথায়?”
এপ্রশ্নে মৃণা চুপ হয়ে যায়। মুরাদ তাকায় তার মা’য়ের দিকে। সে যেন কথাটা কানেই নেয় নি। তার তো খাবারে সম্পূর্ণ ধ্যান। মুরাদ উঠে সিঁড়ির দিকে তাকালে মৃণা বলে, “থাক না মুরাদ ভাই। প্রতিদিন গতকাল জার্নি করে এসেছে আজ একটু ঘুমাক নাহয়।”
“তুই তো ভার্সিটিতে যেয়ে আবার অফিসের কাজ করিস প্রতিদিন। তুই কয়টায় ঘুম থেকে উঠে যাস?”
মৃণা কথাটার উওর না দিলে মুরাদ তেড়ে যায় মহুয়ার রুমের দিকে। তার শার্টের হাত বটাতে বটাতে।
মৃণাও যায় তার পিছনে।
মুরাদ রুমে যেয়ে দেখে মহুয়া হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমুচ্ছে এখনো। অপেক্ষা না করে সে সুন্দর মতো তার পাশের সাইড টেবিল থেকে পানির জগ নিয়ে তার উপর ঢেলে দেয়।
হড়বড়িয়ে উঠে বসে মহুয়া। চুল এলোমেলো, আধোভেজা, চোখের ঘুম এখনো যায় নি। সে আশেপাশে তাকাতেই মুরাদকে দেখে মুখ ফুলায়, “ভাইয়া সকালসকাল তোমার আমাকে গোসল করানোর ক্রিমি উঠেছে কেন?”
“সকাল সকাল? সাড়ে নয়টা বাজে।”
“এটা তো আরও ভোর সকাল।”
“এই পেঁচার বংশধর এই দেরিতে উঠার কারণেই তো পড়াশোনার এই অবস্থা। তোর টিচার কালকে কল দিয়েছিল, ক্লাস টেস্টে সবগুলোতে দুইটা করে লাড্ডু এনেছিস। লজ্জা শব্দটা কি তোর ডিকশিনারিতে নেই?”
“এটা আবার কী?”
মুরাদ তার মাথায় একটি চাপড় মারে, “শুধু হাতে পা’য়ে বড় হয়েছিস। জ্ঞান বুদ্ধি তো হবে না। শুনে রাখ যদি রেজাল্ট খারাপ হয় তাহলে তোর হাতখরচ দেওয়া বন্ধ করে দিব। বাবাকেও দিতে দিব না।”
“এহ তাহলে আমি বাহিরে খাব কী করে? আমার চকোলেট, আমার ফুচকা, আমার ইয়ামি ইয়ামি বিরিয়ানি। না ভাইয়া তুমি এমন নির্দয়ের মতো কাজ করতে পাড়ো না।” বিছানার উপর দাঁড়িয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল মহুয়া।
মৃণা সাথে সাথে এলো মহুয়ার রক্ষার্থে, “ভাইয়া আপনি চিন্তা করেন না। আমি ওকে পড়া বুঝিয়ে দিব। রেজাল্ট ভালো হবে ওর।”
মুরাদের কিছুক্ষণ ভাবল কথাটা। বাঁকা হাসল। মহুয়াকে জব্দ করার পদ্ধতি পেয়ে গেছে। সে মহুয়ার দিকে তাকাল, “দেখ তোর বান্ধবী ভার্সিটি করবে, তারপর অফিসে করবে, তারপর তোকেও পড়াবে। আবার নতুন বাসায় কতশত কাজ। তোর জন্য নিজের পড়া আর স্বাস্থ্য ত্যাগ করবে।” মুরাদ গভীর নিশ্বাস ফেলে আবার বলে, “এমনিতেই ওর যে অবস্থা মনে হয় ধরলেই ভেঙে যাবে। এর মধ্যে এত পরিশ্রম করলে তো সিরিয়াসভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে। আমি তো শুনেছি এবছর অতিরিক্ত প্রেশারের কারণে কতজন হসপিটালাইজড হয়ে গেছে।”
মৃণা বলে, “না মুরাদ ভাই এগুলো তো আমার জন্য…. ” মুরাদ তার দিকে চোখ রাঙালেই চুপ হয়ে যায় মৃণা।
মহুয়া কিছু সময় গভীর ভাবনায় থাকে। তারপর হঠাৎ উচ্চস্বরে বলে উঠে, “না, আমি তোকে হসপিটালাইজড হতে দিব না রে মৃণা। তুই অফিসের কাজে ধ্যান দে তোর জন্য আমি সব পড়ার নোট করে রাখব।”
মুরাদ নিজের পরিকল্পনার সফলতায় চশমা ঠিক করে হাসে, “তাহলে শুরু হয়ে যা। মৃণার পড়াশোনার দায়িত্ব তো এখন তোর তাই না? এত কাজের মাঝে যদি ও আবার পড়াশোনার চাপ নেয় তাহলে ওর কত কষ্ট হবে। তুই ওর জন্য এসব করছিস। তাই ভালো মতো করবি। ওকে?”
“ডোন্ট ওয়ারি মৃণা। আমার নোটস পড়ে তুই ফার্স্ট হয়ে যাবি। ওহ তুই তো এমনিতেও ফার্স্ট হয়ে আসছিস সবসময়। এবারও হবি।” বলে সে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমের দিকে যায়।
মৃণা মুখ ফুলিয়ে তাকায় মুরাদের দিকে, “ভাইয়া আপনি ওর সাথে এমন কেন করলেন?”
“কারণ এছাড়া ওকে পড়াশোনা করানোর উপায় ছিলো না। নিজের জন্য না করলেও তোর জন্য করবে।”
মৃণার তার কথায় লজিক খুঁজে পায়। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “আপনি তো অনেক বুদ্ধিমান ভাইয়া।”
“বুদ্ধিমানের কিছু না। আমার বোনের রগে রগে চিনি আমি। এখন বল তুই বাসার জন্য কি কিনবি। আমি তোর সাথে যাবে।”
“না, না ভাইয়া আপনি কেন যাবেন?”
“কারণ আমি তোর বাসাও দেখে আসবো। আর তোর জন্য ওটা নিরাপদ কি-না তাও দেখতে হবে।”
“কিন্তু ভাইয়া…”
“আবার রিপিট করতে যেন না হয় মৃণা। তুই আমার দায়িত্ব। আমি আমার দায়িত্বের অবহেলা করি না৷ চল বের হই।”
“আপনার অফিস?”
“সে চিন্তা তোর করা লাগবে না। সাহিদ সামলে নিবে।”
.
.
সকাল বেলা মোহ খুব উৎসুকভাব নিয়ে বের হয় ভার্সিটির জন্য। প্রায় দশদিন পর তার মহুয়া ও মৃণার সাথে দেখা হচ্ছে। সে তৈরি হয়ে বের হয় নিজের শাশুড়ীর মা’কে বলে। রিকশায় উঠে। স্বাভাবিকভাবেই যাচ্ছিল ভার্সিটিতে। মাঝরাস্তায় আচমকা সে ডাক শুনতে পায়, “মধু….”
আশেপাশে তাকায় সে। কাওকে না দেখে পিছনে তাকায়। তাকিয়ে পায় সমুদ্র বাইক নিয়ে তার দিকে আসছে। তবে সে রিকশা থামায় না। তার অভিমান যে এখনো ভাঙে নি। তাই কথা বলে না সে সমুদ্রের সাথে এই দুইদিন ধরে।
সে ভেংচি কেটে সামনে ফিরে বসে। সমুদ্র কিছুক্ষণের মধ্যেই তার রিকশার পাশে এসে পড়ে। জোরগলায় বলে, “মধু রিকশা থামাও।”
“থামাব না।”
“জেদ করছ কেন মধু? থামাও না? আমি সকাল সকাল তোমার জন্য ফুল নিতে গিয়েছিলাম, এসে দেখি তুমি বের হয়ে গেছ। না ঘুমিয়ে তোমার জন্য ফুল এনেছি। নিবে না?”
মোহ তার হাতের হলুদ গোলাপের বুক-এ দেখে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে উঠে। তার যে ফুল ভীষণ পছন্দের। তা দেখে সমুদ্র হাত বাড়িয়ে ফুলটা এগিয়ে দেয় আর মোহও তা নিয়ে নেয়। সে বলে, “আচ্ছা যান মাফ করলাম। যেয়ে ঘুমান। আর আমি বাসায় আসার আগে আইস্ক্রিম নিয়ে আসবেন আবারও।”
“তোমার হাতের চা খাওয়ালে আনবো।”
“আচ্ছা।”
সমুদ্র তার বাইকের স্পিড কমিয়ে দেয়। মোহ দেখে সে বাইক ঘুরিয়ে নিয়েছে। মোহ হেসে সে ফুলগুলোর দিকে তাকায়। ফুলগুলো বুকে জড়িয়ে নিয়ে গাঢ় নিশ্বাস নেয়। তার ঘ্রাণ ভালো লাগে না তেমন। কিন্তু ফুলগুলো ভীষণ পছন্দ হলো। সে ফুলের মাঝে মাঝে কতগুলো চকোলেট রাখা। আর একটা ছোট কার্ডও, “এই মধু…সরি তো।”
মোহ হাসল। একটি চুমু খেয়ে কার্ডে লিপ্সটিকের ছাপ বসিয়ে দিলো। তারপর বুকের কাছে চেপে ধরল। তার স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া প্রথম উপহার এই কার্ড, সব ফুল, এমনকি চকোলেট এর র্যাপারও যত্ন করে রেখে দিবে সে।
ভার্সিটির সামনে নেমে ভাড়া মিটিয়ে যাবে সময় সে দেখতে পায় তিসান সেখানে কতজনের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভদ্রতার খাতিরে সে হাসি দিলো কিন্তু তিসান উলটো ঘুরিয়ে নিলো। সে-ও ঘাটলো না নিজের ক্লাসে দিকে রওনা দিলো।
শায়ান ঠোঁট গোল করে বলল, “আমাদের ভার্সিটিতে কি এখন অপ্সরীরা পড়ে না’কি?”
তিসান তার দিকে তাকায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। শায়ান অবাক হয়, “তোকে কিছু বলেছি না’কি?”
মুহিব হেসে বলে, “ভাই তিসান ভাইয়া তো মেয়ের পিছনে লাড্ডু ছিলো কয় সাপ্তাহ। কিন্তু জাহান ভাইয়াকে জ্বালানোর জন্য মহুয়াকে প্রাপোজ করে ফেঁসে যায়। মেয়েটা মহুয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড। মহুয়াকে বলতে বলতে মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায়। তখন থেকে তিসান ভাই দেবদাস হয়ে আছে।”
শায়ান হেসে তার সানগ্লাস খুলে শার্টের মাঝখানে ঝুলায়। তিসানের কাঁধে হাত রেখে বলে, “বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? এখনো ট্রাই করতেই পাড়িস।”
তিসান বিরক্তি নিয়ে তার হাত সরিয়ে বলে, “তোদের এই ফালতু কথা আমার সামনে বলবি না৷ আর ওর দিকে তাকানোরও প্রয়োজন নেই। বিয়ে হয়ে গেছে, রেসপেক্ট ইট।” বলে সে রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে চলে যায়।
শায়ান জিজ্ঞেস করে, “ওর আবার কী হলো?”
“কী জানি ভাই? ওটা বাদ দেন। মহুয়াকে শিক্ষা দেওয়ার কোনো পদ্ধতি ভেবেছেন।”
শায়ান কপাল কুঁচকে তাকায় তার দিকে মুহূর্তখানিকের জন্য। তারপর স্বাভাবিক করে নেয় আবার, “আমি আমার প্রতিশোধ নিয়েছি আর নিব। তোদের মাঝখানে নাক গলাতে হবে না। এমনিতেও ওকে দাদী আদর করে। ওর কিছু হলে কষ্ট পাবে। সো আমার অনুমতি ছাড়া কিছু করবি না।”
.
.
মহুয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। চুল এলোমেলো, কানে গুঁজে আছে কলম, হাতে হাইলাইটার । আর কান্না কান্না মুখ। আর ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। সামনে তিন চারটা বই এলোমেলো হয়ে আছে।
জাহান প্রতিদিনের মতো আজও মহুয়ার ক্লাসে আসে তাকে দেখতে। আজ মহুয়ার স্কুটিও পার্ক করা ছিলো। মানে সে ভার্সিটিতে এসেছে। তাকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে যায়। জাহান তাদের হাতের ইশারা দিয়ে বসতে বলে।
জাহান মহুয়ার সামনের বেঞ্চে বসে খানিকটা অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে, “তোমার কী হয়েছে?”
মহুয়া কন্ঠ শুনে ঠোঁট উল্টে উপরে তাকায়, “কী বলব আর দুঃখের কথা, যে জিনিস এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বেশি অপছন্দ সে জিনিস নিয়েই দিনরাত থাকতে হবে। এই শোক আমি কই রাখি?”
জাহান প্রথমে তার কথার মানে না বুঝলেও বেঞ্চে ছড়িয়ে থাকা বই আর তার অবস্থা দেখে ঠিকই বুঝতে পাড়ে। ঠোঁট টিপে হেসে জিজ্ঞেস করে, “এই শোকে কী চুলও কেটে নিলে না’কি?”
“এমনি নিউ হেয়ারস্টাইল ট্রাই করতে ইচ্ছা হলো।”
“কিন্তু তোমাকে আগের চুলে বেশি সুন্দর লাগতো। যখন তুমি দুষ্টুমি করতে তখন তোমার চুলগুলোও দুষ্টুমি করতো। উড়তো। তোমার মুখের সামনে খেলতো। আর…”
“হয়েছে?”
“আচ্ছা এটা বাদ দিয়ে বলো হঠাৎ পড়ার প্রতি এত ইন্টারেস্ট এলো কীভাবে? তোমার তো আগে এক্সামে লাড্ডু পেলেও দুঃখ লাগতো না।”
“মৃণার জন্য।”
“মৃণার জন্য?”
“হ্যাঁ, মুরাদ ভাইয়া বলল মৃণার অফিস আর ভার্সিটি সামলাতে সামলাতে অসুস্থ হয়ে যাবে। ও আবার নতুন বাসায় শিফট করছে। কত কাজ! এর মধ্যে আবার এত পড়া পড়লে যদি হাস্পাতালে ভর্তি হয়ে যায়। তাই আমি দায়িত্ব নিয়েছি ওকে পড়ানোর। কিন্তু আমিই তো কিছু পড়তে পাড়ছি না।”
বলে আবারও আফসোসের ভঙ্গিতে মাথায় হাত রাখল।
জাহান তার কথা শুনে ভ্রু কপালে তুলে নেয়। তারপর মনে মনে বলে, “আমার সম্বন্ধী সাহেবের তো দেখি শেয়ালের মতো বুদ্ধি। এই পড়াচোরকে বই খাতায় ডুবিয়ে দেওয়ার প্লান করেছে। আমারও দেখছি ভবিষ্যতে সাবধানে থাকা লাগবে।”
জাহান মহুয়াকে বলে, “এইটুকু ব্যাপার? আমি আছি তো।”
“তুমি কী করবে?”
“স্কুল থেকে ভার্সিটি পর্যায়ে আমি কখনো সেকেন্ড হই নি। ইনফ্যাক্ট ভার্সিটিতেও পার্ফেক্ট সিজিপিএ এসেছে। এই ভার্সিটির হিস্ট্রিতে কেবল আমারই পার্ফেক্ট সিজিপিএ এসেছে।”
“এখন নিজের প্রশংসা বাদ দিয়ে কাজের কথা বলো।”
“মানে আমি তোমাকে পড়াতে পাড়ি। তুমি বুঝে মৃণাজে বুঝাবে।”
“তাহলে তো আমি টিচারদের থেকেই বুঝতে পাড়ি।”
“কিন্তু তুমি তা তো বুঝবে না।”
“পয়েন্ট আছে।”
“আর আমি আমার নোটসগুলোও দিতে পাড়ি। যা জয়রা সবাই এক্সামের একদিন আগে পড়েও ফার্স্টক্লাস পায়। তবে একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”
“আমার সব কথা শুনতে হবে এক্সাম পর্যন্ত। সব।”
“এহ নিজের চেহেরা দেখছ?”
জাহান হঠাৎ তার একদম সামনে যেয়ে বেঞ্চে কণুই রেখে গালে হাত রাখে, “হ্যান্ডসাম আছে তাই না?”
মহুয়া হঠাৎ তার সামনে আসায় ভড়কে যায়। তার গালদুটো গরম হয়ে আসে।
সে খানিকটা কেশে গলা পরিষ্কার করল। তার অস্বাভাবিকভাবে মিষ্টি করে হাসিমুখে তাকাল জাহানের দিকে, “আমি তোমার সাথে ডেইটে যাব নে, নোটসগুলো দিয়ে দেও।”
“ওটা তো ভালো খাবারের লোভ দেখালে তুমি এমনিতেও যাবে।”
মহুয়ার মুখের পরিবর্তন ঘটে সাথে সাথে। মুখ ভোঁতা করে বলে, “উল্টাপাল্টা কিছু বলতে পাড়বে না।”
“ওটা এমনিতে ও বলবো না। প্রতিদিন ক্লাস শেষে একঘন্টা লাইব্রেরিতে পড়বে আমার সাথে। প্রতিদিনের নোটস প্রতিদিন পাবে। আর আমার সব কথা শুনবে মিষ্টিপাখির মতো। যেদিন কথা শুনবে না ওদিন নোটস দিব না।”
মহুয়া মুখ বানায়, “জাহান হনুমান।”
“উফফ এটা না। ওটা বলো। জানুমান।”
“আমি তখন বুঝিনি যে কী বলছি কিন্তু এখন বুঝতে পেড়েছি।”
“তাইতো বলছি। বলো।”
“না।”
“না? তাহলে নোটসের কথা ভুলে যাও।”
জাহান উঠে যেতে নিলেই মহুয়া তার হাত ধরে নেয় দুইহাত দিয়ে, “আচ্ছা আচ্ছা বলছি…” জাহান তার দিকে তাকালে সে আমতা-আমতা করে, “জা..জা..জানুমান।”
“হায়!” জাহান তার বুকের বাঁ পাশে হাত রাখে। মহুয়ার তার হাত ছেড়ে বসে যায় আবার বেঞ্চে। মুখ ঢেকে নেয়। নিশ্চয়ই আশেপাশের সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় সে জাহানকে মনে মনে কতগুলো গালি দেয় আর মারেও।
জাহান তাকে বলে যায়, “ভার্সিটি শেষে আমার বাস্কেটবল ম্যাচ আছে। তুমি আমাকে চিয়ার-আপ করতে আসবে।ওকে জান?”
মহুয়াকে কিছু না বলতে দেখে জাহান আবারও জিজ্ঞেস করে, “ওকে?”
“ওকে।” মহুয়া মুখ ঝামটে অন্যদিকে তাকায়।
জাহানের যাবার কিছুক্ষণ পর মোহ আসে। এসেই ঝাপ্টে ধরে মহুয়াকে একপাশ থেকে। মহুয়ার মুখ গোমড়া দেখে সে জিজ্ঞেস করে, “তোর আবার কী হলো আর তোর চুলের কী হলো?”
মহুয়া তার দুঃখের কাহিনী শোনাতে যাবে এর আগেই দেখে মোহের হাতে ফুলের গুচ্ছ।
“এত ফুল? দুলুভাই দিয়েছে না’কি?” মহুয়া উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে। সে দেখে মোহের গাল লাল হয়ে গেছে। তা দেখে মহুয়া তো আরও উৎসুক হয়ে উঠে, “ওহ হো আমার দুলুভাই তো দেখি সেই রোমেন্টিক। কক্সবাজার যেয়ে ভালোই উন্নতি হয়েছে।”
“কক্সবাজার না কক্সবাজারের পরে। আরে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমি রাগ করেছিলাম দুইদিন ধরে পিছনে ঘুরছিল। ওদিন রাতে এত্তগুলা আইস্ক্রিম আনলো আর আজ ফুল আর চকোলেট। তুইও কয়টা চকোলেট নে। শুধু পড়ে প্যাকেট দিয়ে দিস।”
“প্যাকেট দিয়ে কি করবি?”
“উনি প্রথম উপহার দিয়েছে তো তাই রেখে দিব।”
“ওহ হো। তোর এই মুহূর্তে আয়নায় নিজেকে দেখা উচিত ছিলো তোর গাল দুটো লাল টমেটো হয়ে গেছে। আগে বল কক্সবাজারে কি কি হয়েছে। তারপর আমার কাহিনি বলছি।”
ক্লাস শেষে মহুয়া আর মোহ গতদশদিনের সব গল্প করে।
তারপর মহুয়া মোহকে নিয়ে যায় বাস্কেটবল কোর্টের দিকে। যেয়ে দেখে চারপাশে মানুষ ভরা। যেন এখনো কেউ বাসাতেই যায় নি। সম্ভবত সম্পূর্ণ ভার্সিটির শিক্ষার্থীরাই এখানে। সবাই হৈ-হুল্লোড়ে ব্যস্ত। অবশ্য হবেই বা না কেন? প্রতি মাসের শুরুতে ভার্সিটিতে বাস্কেটবল ম্যাচ হয়। যার জন্য সবাই উৎসুক থাকে। এমনকি কতগুলো টিচাররাও আসে এই ম্যাচ দেখতে।
ভার্সিটি শেষে সবাই উপস্থিত হয় বাস্কেটবল কোর্টে। দুই দল সামনা-সামনি দাঁড়ানো। সাদা জার্সি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে জাহানরা এবং নীল জার্সিতে শায়ানদের দল। খেলা শুরু হয়ে গেছে। অর্থাৎ মহুয়ারা আসতে দেরি করে ফেলেছে। মহুয়া লাফিয়ে কয়বার দেখতে চাইলো খেলার দৃশ্য কিন্তু এত ভীড়ে পাড়ল না। তারা ভাবে চলে যাবে। তখন জাহানের দলের কয়জন তাকে থামায়। দ্রুত তার কাছে যেয়ে রাস্তা ফাঁকা করিয়ে তাকে নিয়ে আসে কোর্টের ভেতরে। কোর্টের দুইপাশে চারটা করে বেঞ্চ যেখানে খেলোয়াড়রা ব্রেক টাইমে আরাম করে। সেখানে তারা বসতে বলল মহুয়া আর মোহকে।
মোহ তো তাদের খেলা দেখে মজাই লাগে। আর আবার খেলা দেখা পছন্দ। সে উচ্চস্বরে বলে,”জিজু জিতে আসবেন কিন্তু।”
শব্দ শুনে জাহান তাকায় তাদের দিকে। মহুয়াকে দেখে তার মুখে হাসি ফুঁটে উঠে। শায়ানও সেদিকে তাকায়। মহুয়াকে জাহানদের দলের দিকে বসে থাকতে দেখে। সে বিরক্তি নিয়ে চোখ ঘুরায়। তারপর ইশারায় তাদের দলের একজনকে বলে তাকে বল দিতে। এমনই হয় সে দ্রুত বাস্কেটের কাছে এগোয়। বাস্কেটের সামনে জাহান ছিলো। সে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো তখন। মহুয়া প্রথমে তাদের খেলায় ইন্টারেস্ট না পেলেও যখন দেখল শায়ান জাহানের দিকেই আসছে, তাদের বাস্কেটের দিকে তখন সে দাঁড়িয়ে উঁচু স্বরে বলে, “আরে আমাকে পড়ে দেখো। সামনে তাকাও। গর্দভ কোথাকার।”
সে সামনে তাকানোর আগেই শায়ান তাকে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দেয়। নিচে পড়ে যায় জাহান আর শায়ান বাস্কেটের মাঝে বল ফেলে দেয়। এর সাথেই শায়ানদের দল দুই হয়ে যায় আর জাহানদের এক থেকে যায়।
জাহান কোর্টে ঘুষি মেরে বলে, “শীট!”
আবিদ এসে উঠায় তাকে। শায়ানদের দল তো আরেকটা গোল করে খুশিতে চেঁচামেচি করে। শায়ান জাহানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসি দেয়। যেন তাকে নিয়ে উপহাস করছে।
জাহানের হাতের মুঠো শক্ত হয়। সে-ও রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় শায়ানের দিকে। তাদের পাশের বেঞ্চে বসা জয় বলে, “উফফ এখন জোস একটা ম্যাচ হবে।”
মহুয়া তার দিকে তাকায়, “কীভাবে বুঝলে ব্রাদার?”
“জাহান ভাই আর শায়ানভাইয়ের দৃষ্টি দেখছ না ভাবি? আগুন জ্বলছে তাদের দৃষ্টিতে। তারা ছোট থেকে বাক্সেটবল খেলে। আর বেস্ট প্লেয়াল ভার্সিটির মধ্যে। দেখে মনে হচ্ছে বাঘ আর সিংহ দাঁড়িয়ে আছে যুদ্ধের জন্য। সেই হবে ম্যাচটা।”
“কে বেশি ভালো খেলে?”
“অফকোর্স জাহান ভাই। যদিও উনিশ-বিশ। কিন্তু শায়ানভাইদের দলে তিসান ভাইও আছে তাই পরিণাম কী হবে জানি না। শায়ান ভাইকে আজ খেলার প্রতি বেশিই উৎসাহী লাগছে। কী জানি দেখি কি হয়!”
আবারও খেলা শুরু হয়। পঁচিশ মিনিটের মধ্যে দুইদল দুই পয়েন্টে এগোয়। এরপর শুরু হয় ব্রেক। ব্রেক টাইমে জাহান তার দলের কাছে আসে। মোহ দাঁড়িয়ে উৎসুকতার সাথে বলে, “জিজু জোস একটা গেইম ছিলো। জিতে আসবেন।”
“তোমার বান্ধবী যদি চায় তাহলে অবশ্যই জিতবো।”
কিন্তু মহুয়ার তো তার দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। যেখানে সবাই কাজ কাম ছেড়ে ম্যাচ দেখতে এখানে হাজির হয়েছে। আর মহুয়া ম্যাচের মাঝে হেডফোন লাগিয়ে কে-ড্রামা দেখছে।
জাহান তার দিকে তাকিয়ে নিরাশ হয়। সে জয় থেকে পানির বোতল নিয়ে পাশে বসে। তবুও তার ধ্যান আকর্ষণ করতে পাড়ে না। সে উঁকি মারে মোবাইলের দিকে। কে-ড্রামা দেখছে সে। জাহান তার কান থেকে হেডফোন খুলে বলে, “জান এখানে কী দেখছো? আমার দিকে তাকাও।”
মহুয়া তো বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকায়। সে বলে, “আর সময় পেলে না? কী ইনটেন্স সময়ে ড্রামা এসেছিল জানো। তাও আমার ফেভারিট, মোস্ট হ্যান্ডসাম আর কিউট cha eun woo এর একশন। এটার জন্যই তো ফুল ড্রামা দেখছিলাম।”
জাহানের মুখের ভাব বিগড়ে যায় কথাটা শুনে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “আমার থেকেও হ্যান্ডসাম?”
“এহ আসছে আমার ক্রাশের সাথে মিলাতে। কোথায় রাজকুমার আর কোথায় হনুমান।” বলে মুখ ঝামটাল।
জাহান আচমকা তার কাছে এসে পড়ে। এসে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, “ভালো করে দেখো তো।”
হঠাৎ তার কাছে আসায় মহুয়া চমকে যায়। ঘামে ভিজে গেছে জাহানের চুল। টপকে পানি পড়ছে। চুলগুলো আঁচড়ে পিছনে করা। তার মুখও ভেজা। তার সাদা জার্সি দিয়ে শরীরের সুঠাম ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। মহুয়া কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার বেহায়াপনায় নিজেই লজ্জা পেল। সরে বসলো একটু। ঢোক গিলল। কিন্তু তার গালদুটো গরম হয়ে যাচ্ছে মনে হলো। হৃদপিণ্ডটা অস্বাভাবিক ভাবে দৌড়াচ্ছে। তবুও জাহানের বেহায়ামি কমলো না সে তাকিয়ে রইলো সে তীক্ষ্ণ সরু চোখ দিয়ে৷
মহুয়ার কেন যেন মনে হলো তাকে দেখার সময় জাহানের চোখে কোনো নেশা মিশে যায়। কিন্তু সে দৃষ্টি অপবিত্র না। কিন্তু সম্পূর্ণ নিজের মাঝে বন্দী করে নিতে চায় মহুয়াকে।
“তোমার গাল কী লাল হচ্ছে? তুমি লজ্জা পাচ্ছো জান?” জাহান অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। মহুয়া লজ্জা লুকাতে বিরক্তি নিয়ে তাকায় তার দিকে, “আর মানুষ পাও নি। আমি লজ্জা পাব, তাও তোমার জন্য। জোক অফ দ্যা ইয়ার।”
“আচ্ছা তাহলে তোমার চা চা’কে সাইডে রেখে নিজের স্কার্ফ দিয়ে আমার মুখটা যত্ন করে মুছে দেও।”
“এই আমার ক্রাশকে চাচা বলার মতো সাহস হয়েছে কীভাবে তোমার? আর আমার স্কার্ফ দিয়ে তোমার ঘাম মুছবো? ছিঃ!”
“নোটস তো বোধহয় তোমার লাগবেই না।”
মহুয়া বিরক্ত নিয়ে তাকায় তার দিকে। রেগে ফুলে ফুঁপে না পেয়ে স্কার্ফটার এককোণ দিয়ে উপরে উপরে মুছে দিতে নেয় জাহানের মুখখানা। এই দেখে আশেপাশের সবাই জোরে চিৎকার করে উঠে। মহুয়া তো সবার সামনে লজ্জা পেয়ে যায়। সে চোখ বন্ধ করে জাহানকে কতগুলো বকা দেয়। আর হঠাৎ তার হাতের উপর জাহানের হাতের স্পর্শের অনুভূতি পায়৷ সে চোখ খুলে তাকাতেই সে নেশায় জড়ানো চোখে চোখ পড়ে তার। হঠাৎ কিছু একটা হলো তার হৃদয়ের সাথে৷ কেমন ব্যাথা করে উঠলো। সূক্ষ্ম ব্যাথা। এক মুহূর্তের কিন্তু এতে তার নিশ্বাস বেড়ে গেল। জাহান তার হাতটা চেপে ধরল নিজের গালে। আবারও একই অনুভূতি হলো তার হৃদয়ের ঘরে। কী হচ্ছে তার সাথে? সে কী পাগলই হচ্ছে যাচ্ছে?
কোর্টের অপরপাশের বসা দল এই দৃশ্য দেখে বিরক্ত হচ্ছিল। মুহিব বলল, “এখানে এরা কী নাটক করতে এসেছে?”
“মনে তো তাই হচ্ছে। সিনেমার নায়ক নায়িকা ভাবছে নিজেকে।” আরেকজন সাঁয় দিলো।
তিসান পানি পান করার সময় তাদের কমেন্ট শুনে বিরক্ত হয়, “চুপ করবি তোরা? এত ধ্যান ম্যাচে দিলে জিতে যেতাম।”
মুহিব বলে, “তিসান ভাই এখন জাহান ভাইয়ের সাথে খাতির হওয়ার পর আমাদের তো আপনার অসহ্য লাগেই। সত্যি বলেছি না শায়ান ভাই?”
শায়ান কিছু বলে না। তার দৃষ্টি এখনো অপরপাশেই আটকে আছে তার হাতের বোতলটা হাতের মুঠোয় পিষে দেয় সে। তার চোয়াল শক্ত হওয়া। তার নীলাভ রঙের চোখজোড়ার আশপাশটা লালচে হয়ে যাচ্ছে।
মুহিব আবারও প্রশ্ন করে, “ভাই সত্যি বলছি না?”
শায়ান তার দিকে তাকায় একই দৃষ্টিতে। তার রাগান্বিত দৃষ্টি দেখে তো মুহিবের জান প্রায় যায় যায় অবস্থা। সে সাথে সাথে তার সামনে থেকে চলে যায়। শায়ান বোতলটা নিচে ছুঁড়ে মেরে নিজের জ্যাকেট নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। তার দলের সবাই বারবার ডাকে তাকে। সে পিছনেই ফিরে না। একবার পিছনে ফিরেও তাদের দিকে তাকায় না। তার দৃষ্টি যেয়ে আটকায় জাহান ও মহুয়ার দিকে। অবশেষে শায়ান না থাকায় জাহানের দল সহজেই জিতে যায় খেলাটা। সাদা দল এর পয়েন্ট হয় পনেরো। এবং নীল এর ছয়।
.
.
মুরাদ ও মৃণা মার্কেটে এসেছিল। মৃণা বাসার জন্য বালিশ ও চাদর কিনতে এসেছে। সাথে জগ, গ্লাস টুকিটাকি জিনিস লাগবে। এর মাঝেই সাহিদ কল দেয় তাকে। একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। যা রজন্য তাদের অফিসে যেতে হবে। রাত আটটার মিটিং শিফট হয়েছে বিকেল চারটায়। এখন বাজে সাড়ে বারোটা। যদিও সময় ছিলো কিন্তু মৃণা বলল, “স্যার আমরা এখন বাসায় যাই? এসব গাড়িতে থাক। রাতে যাবার বাসায় নিয়ে যাব।”
মুরাদের কথাটা মন্দ লাগে না। তারা আগে দিয়ে বের হয়ে যাবে অফিস থেকে। আর মিটিং এর আগেও কিছু কাজ আছে তাই তারা গেল অফিসে। অফিসে যেয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তারা ক্লায়েন্টের সাথে সাক্ষাৎ এর জন্য। কাজ শুরু করল। ক্লায়েন্ট হচ্ছে ডিজাইনার ড্রেসের ব্রান্ড। এমন এড স্যুট করা তাদের জন্য স্বাভাবিক হলেও তাদের অনুরোধ হচ্ছে এডটা মিউজিকাল হতে হবে। আর এডে কাজ করা মেইন দুইজন তাদের পরিচিত হবে। এখন মুরাদদের কাজ হলো তাদের ডিমান্ড অনুযায়ী স্ক্রিপ্ট লিখে তা শ্যুটিং এর ব্যবস্থা করা। শুটিংয়ের পর তা এডিট করে যথাসম্ভব তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই তাদের কোম্পানির কাজ। অর্থাৎ মার্কেটিং করা।
সবসময় অফিসে শান্তশিষ্ট মহল থাকলেও কোনো ক্লায়েন্ট আসার আগে হয় সব ঝামেলা। এই’যে এখনো দৌড়াদৌড়ি চলছে। আজই বেশি ঝামেলা হয়েছে মুরাদ কিছু সময় অফিসে না থাকায়। এর উপর ক্লায়েন্টদের আসার কথা ছিলো রাতে। তারা হঠাৎ বিকেলে সময় দিলো। মিটিংরুমে সবকিছু তৈরি করছিল সাহিদ ও রিয়াজ স্টাফদের সাথে মিলে প্রজেক্ট সেট করছিল। মৃণাকে পাঠালো মুরাদের কেবিনে। মৃণা দ্রুত তার হাতের ফাইল নিয়ে মিটিংরুম থেকে বের হয়। এগুলো রেখে নতুন ফাইল আনতে হবে। ফাইলে চোখ গেঁথে রাখায় সামনে তাকিয়ে হাঁটছিল না সে। তাই হঠাৎ ধাক্কা লাগায় সে পিছিয়ে যায়। তার সব ফাইল নিচে পড়ে যায়। সে ঘাবড়ে তাড়াহুড়ো করে নিচে বসে ফাইলগুলো তুলতে শুরু করে। হঠাৎ এক মেয়েলী কন্ঠ শোনা যায়, “মৃণা তুমি না?”
নিজের নাম শুনে চোখ তুলে তাকায় মৃণা। সামনে দেখতে পায় তাদের ক্লায়েন্টের সাথে দাঁড়িয়ে আছে বুশরা ও তন্ময়।
চলবে…
মেঘের খামে…
পর্ব ৩০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
নিজের নাম শুনে চোখ তুলে তাকায় মৃণা। সামনে দেখতে পায় তাদের ক্লায়েন্টের সাথে দাঁড়িয়ে আছে বুশরা ও তন্ময়।
“হ্যাঁ মৃণাই তো দেখছি। তোমাকে এখানে এক্সপেক্ট করিনি।” বুশরা বলে।
মৃণা তার ফাইলগুলো নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তন্ময় ও বুশরাকে হঠাৎ দেখে তার খানিকটা অস্বস্তিকর বোধ হয়। তবুও সে জোরপূর্বক হেসে বলে, “ভালো আছেন আপু?”
“ভালো থাকার কী কথা নয়? কিন্তু তোমাকে দেখে তো এত ভালো মনে হচ্ছে না।”
বুশরা তাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ভালো করে দেখে বলে। এতে খানিকটা অস্বস্তিকরবোধ করে মৃণা। তার কামিজটা টেনেটুনে ঠিক করে নেয়। অস্বস্তি নিয়ে উওর দেয়, “আমিও ভালো আছি আপু।”
এরই মাঝে তাদের ক্লায়েন্ট ইশরাত বলে, “বুশরা তুই ওকে চিনিস?”
“আমাদের স্কুলে পড়তো। মিউজিক ক্লাসে দেখা হয়েছিল ক’দিন। আর… ” সে তন্ময়ের দিকে তাকায়, “তন্ময়ের এক সময়ের ভালো ফ্রেন্ড ছিলো। বললে না মৃণা তুমি এখানে কি করো?”
“ইন্টার্ন হিসেবে জয়েন করেছি।”
বুশরা তন্ময়ের বাহু ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করে, “তন্ময় তুমি তো কথাটা আমাকে বলো নি।”
মৃণার মনে হলো তার হৃদপিণ্ডটায় কেউ সূঁচ গেঁথে দিয়েছে। কেমন ব্যাথা হলো। সে চোখ সরিয়ে নিলো তাদের থেকে।
এতক্ষণে তন্ময়ের ধ্যান ভাঙে মৃণার দিক থেকে। সে ছোট করে বলে, “আমিও জানতাম না।”
বুশরা মৃণার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “ইন্টার্নি করছ ঠিক আছে কিন্তু অফিসে কাজ করো সেভাবে তো আসবে। আমাদের বাসায় যে হেল্পার আসে তারাও এর থেকে বেশি ভালো করে আসে।”
তার কথায় মৃণা প্রথমে স্তব্ধ হয়ে যার, তারপর আরও অস্বস্তিতে পড়ে যায়। অপমানে তার চোখ নিচু হয়ে যায়। এভাবে এত মানুষের সামনে আজ পর্যন্ত সে অপমানিত হয় নি। অথবা অপমানিত করবার কেউ সাহস পায় নি। মোহ এবং মৃণা সবসময়ই তার সাথে ছিলো। আজও তাদের খুব মনে পড়ছে। তারা থাকলে কেউ তাকে অপমান করার সাহস পেত না। তার কিছু বলতে ইচ্ছে হলো, উওর দিতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু তার গলা ধরে এলো। তার চোখদুটো সিক্ত হয়ে গেছে।
ইশরাত তাকে চোখ রাঙায়, “বুশরা, মুখ সামলে।”
“হোয়াট আপু? আমি তো যাস্ট এডভাইজ দিচ্ছিলাম। আমি কী ভুল কিছু বলেছি তন্ময়?”
তন্ময় অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তারপর আবার মৃণার দিকে। মৃণার চোখের পানি দেখে তার বুক কেঁপে উঠে। সে কিছু বলতে যাবে এর পূর্বেই পিছন থেকে শব্দ আসে, “আই থিংক কেউ আপনার এডভাইজ চায় নি।”
কন্ঠ শুনে তারা পিছনে ফিরে তাকায়। মুরাদকে দেখে ইশরাত এগিয়ে এসে হাত মেলায়, “হ্যালো মুরাদ, কেমন আছেন?”
মুরাদ মৃণার দিকে তাকিয়ে দেখে সে এখনো মাথা নামিয়ে আছে। যতটুকু মুখ দেখতে পাড়ছে ততটুকু দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার মন ভীষণ খারাপ। আবার সে তাকায় তন্ময় ও বুশরার দিকে। তার কপাল কুঁচকে যায়, “আমি তো ভালো আছি মিসেস ইশরাত। বাট এখানে কী এডভাইজ দেওয়া হচ্ছিল? আমি শুনতে পাই নি ঠিকভাবে। কিন্তু আপনাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে না এডভাইজটা কোনো যোগ্য ব্যক্তি থেকে এসেছে।”
সে বুশরার দিকে তাকিয়ে বলে। বুশরা উওর দেবার পূর্বেই ইশরাত আবারও তার দিকে চোখ রাঙায়।
ইশরাত মুরাদকে বলে, “আই এমন সো সরি মিস্টার মুরাদ। আমার বোন না বুঝেই কথা বলে ফেলে। ছোট তো। কিছু মনে করবেন না।” আবার সে মৃণাকেও বলে, “প্লিজ তুমিও ওর কথায় কিছু মনে করো না। ও বলার আগে ঠিক বেঠিকও ভাবে না। আমি ওর পক্ষ থেকে ক্ষমা চাচ্ছি।”
মৃণা তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে। কেউ তার সাথে এই প্রথম অন্যায় করার পর ক্ষমা চাইল। সে এতটুকুতেই খুশি।
মুরাদ তার হাসি দেখে একটু ঠান্ডা হয়। তারপর ইশরাতকে বলে, “আপনারা সময়ের আগে এসেছেন। মিটিং রুমে সব আইডিয়ার প্রেজেন্টেশন সেট করা হচ্ছে। চাইলে চা খেতে সিটিং এড়িয়াতে যেতে পাড়ি।” “অফকোর্স।”
“মৃণা তুইও আয়।”
ইশরাত বুশরাকে নিয়ে মুরাদের পিছনে যায়। মৃণা প্রথমে যেতে নেয় মুরাদের কেবিনে। তার সাহিদকে ফাইল দিতে হবে। সে তন্ময়ের পাশ দিয়ে যেতে নিলে সে মৃণার হাত ধরে নেয়। মৃণা তার দিকে ফিরে তাকায়। তন্ময় কেমন অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যা দেখে মৃণার বিরক্ত লাগল। একটু আগে যখন সে মৃণার জন্য স্টান্ড নিতে পাড়তো তখন চুপ ছিলো এখন এমন অনুভূতি দেখানো মানে কী?
মৃণা কিছু না বলে তার হাত ছাড়িয়ে নিজের কাজে চলে যায়। ফাইলগুলো সাহিদদের কাছে পৌঁছে দিয়ে সিটিং এড়িয়ার দিকে যায়। মাঝখানে পিওনের সাথে দেখা হয় তার। একসাথে দুইটা ট্রে নিয়ে যেতে সমস্যা হচ্ছিল তার। তাই মৃণা তার সাহায্য করার জন্য একটি ট্রে নিলো। কেবিনের ভেতরে এসে টেবিলে ট্রে রাখে। তা দেখে বুশরা হেসে দেয়। বলে, “দেখলে কীজন্য তখন কথাটা বলেছিলাম? বি প্রফেশনাল মৃণা। অফিসে ইন্টার্নের কাজে আছো বুয়ার না।”
তার কথায় মহলটা সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যায়। সবাই আবারও অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। মুরাদ একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার মৃণার দিকে তাকায়। অর্থাৎ তখনও বুশরা মৃণাকে অপমান করছিল?
মুরাদ উঠে পিওনকে না করে, নিজে সবাইকে চা এগিয়ে দেয়। ইশরাত বলে, “থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”
“আপনি তো আসলেই জ্যান্টেলম্যান। সো সুইট অফ ইউ।”
বুশরার কথায় মুরাদ কৌতুক হাসে, “রিয়ালি? আমি ভেবেছি আপনি একাজের জন্য আমাকে পিওন বলবেন। অবশ্য এটা সম্মানের ব্যাপারও হতো। কাদের চাচা এই বয়সে আমাদের থেকে বেশি পরিশ্রম করে। এটলিস্ট কারো সুপারিশ নিয়ে কাজে আসে না।”
বুশরার কপাল কুঁচকায়, “আপনি কী আমাকে অপমান করছেন?”
“না, কেবল আপনার কথার উওরে কথা বলছি।”
“আপনি…” বুশরা কিছু বলার আগে ইশরাত তার ধমক দেয়, “সাট আপ বুশরা। সে কখন থেকে তোর বেয়াদবি দেখছি। আরেকটা কথা বললে তোর খবর আছে। তুই সাধারণত এমন করিস না। আজ কী হলো তোর?”
মুরাদ মৃণার দিকে তাকায়, “তোকে কী বসার জন্য আমন্ত্রণ দেওয়া লাগবে? বসছিস না কেন?”
“থাক স্যার। আমি ঠিক আছি।”
মুরাদ তার হাত ধরে তাকে বসায়। তার হাতে নিজের চা’য়ের কাপ দিয়ে মিষ্টি সুরে বলে, “চা’টা খেয়ে নে। ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।”
এতক্ষণ শীতল কন্ঠে কথা বলা লোকের মুখে এমন মিষ্টিভাষী কথা শুনে সামনে বসা তিনজন হা হয়ে যাবার মতো অবস্থা। তন্ময় তো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর দিলো তাদের হাতের দিকে। মৃণার হাত এখনো মুরাদ ধরে আছে।
ইশরাত কৌতুহল সামলাতে না পেড়ে জিজ্ঞাসা করেই নিলো, “আপনারা কী অফিসের বাহিরেও পরিচিত? না মানে আপনাদের ঘনিষ্ঠ লাগছে।”
“হ্যাঁ, ওহ আমার ফ্যামিলি।”
কথাটা শোনা মাত্রই তন্ময়ের হাত থেকে কাপ পড়ে যায়। সবার দৃষ্টি তার দিকে আটকালেও সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় মৃণার দিকে।
মুরাদ মেকি হাসে, “মিস্টার তন্ময় আপনি কি ঠিক আছেন?”
তন্ময় তার উওর দেয় না। সে এখনো মুরাদের কথার মানেটা বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু মুরাদ তার সময় দেয় না। সে ঘড়ি দেখে বলে, “ওহ ওয়েল চারটা বেজে গেছে। মিটিংরুমে যাওয়া যাক?”
.
.
রাতে মুরাদ মৃণাকে তার নতুন বাসার গলির সামনে দিয়ে যায়। সে জিনিসপত্র নামিয়ে নিয়ে যেতে নিলে মৃণা থামায়, “ভাইয়া আমি এখান থেকে নিয়ে যাব। থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া… মানে স্যার এত কষ্ট করার জন্য।”
“আমি নিয়ে যাই।”
“যদি কেউ দেখে খারাপ ভাবে নিবে। এখন আপনার আমার সম্পর্ক তো আমি আপনি জানি, মানুষ তো জানে না।”
“আচ্ছা? তো কী আমাদের সম্পর্ক?”
মৃণা অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। কথার মানেটা ধরতে পাড়ে না। সে সরলভাবেই উওর দেয়, “আপনি মহুয়ার ভাইয়া তাহলে আমারও… ”
মুরাদ তাকে সেখানেই থামিয়ে দেয়, “থাক তুই যা। জলদি যা।”
মৃণা মাথা নাড়াল। সে যেতে নিলেই মুরাদ আবারও থামায় তাকে, “এই শুন কোনো খাবার তো নিস নি।”
“সামনের দোকান থেকে সব নিয়ে নিব।”
“আচ্ছা।”
মৃণা যেতে নিলে আবারও মুরাদ তাকে ডাকে, “আচ্ছা শুন, তুই ঠিক আছিস তো? আমি আসলে জানতাম না ইশরাত ওদের এডের জন্য যাদের নিতে চায় তারা বুশরা ও তন্ময়। তুই চাইলে আমি প্রজেক্ট ক্যান্সেল…”
“না না ভাইয়া। এমন করেন না। আমি ঠিক আছিস। সবসময় এভাবে লুকিয়ে থাকলে নতুন জীবনের সূচনা করবো কীভাবে?”
মুরাদ হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আদর করে, “গুড গার্ল। বাট এর পরেরবার থেকে কেউ কিছু বললে নিজে ফাইট করবি। যত চুপ থাকবি মানুষ তত তোকে অপমান করার সাহস পাবে বুঝেছিস? ”
মৃণা মাথা নাড়ায়। তারপর এগিয়ে যায় তার নতুন বাসার দিকে। নতুন জীবনের দিকে।
মুরাদ তাকে যেতে দেখে। তার যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। সে পকেটে হাত রেখে দেখে মৃণাকে যেতে। গভীর নিশ্বাস ফেলে। বলে, “তোকে নিজের করে পাওয়ার লোভ আমার আছে ঠিক। কিন্তু তোর খুশি আমার নিজের সুখ থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি এই নতুন জীবন তোর সুখ নিয়ে আসবে।”
.
.
মুরাদ রাতে বাসায় আসার পর দেখে মহুয়া বসে টিভি দেখছে। সে তখনই কিছু বলে না। আগে নিজের রুমে যেয়ে গোসল করে আসে। তারপর আরামে মহুয়ার পাশে বসে তার মাথায় চাটি মারে আর রিমোট নিয়ে বলে, “তোর না পড়ার কথা ছিলো?”
“একটা টিচার খুঁজে বের করেছি। পড়ায় অনেক ভালো। ও কাল থেকে পড়াবে। তারপর আমি ওগুলো ক্লাসে মৃণাকে বুঝিয়ে দিব। প্লান ভালো না? এই ভাইয়া আমার কার্টুন পাল্টাবা না।”
“তুই তো নিজেই এক কার্টুন। তুই কার্টুন দেখে কী করবি?”
“ভাইয়া!”
এতক্ষণে তাদের মা আসে চা নাস্তা নিয়ে। তাদের ঝগড়া দেখে বলে, “তোরা কী এখনো বাচ্চা? এমন ঝগড়া করছিস কেন? আর মহু তোর ভাই সারাদিন পর বাসায় এসেছে একটু ওকে দেখতে দিলে কী হয়?”
“ভাইয়ার রুমে টিভি আছে না? এটা আমার টিভি।”
“আচ্ছা তোদের খুনসুটি তো শেষ হবে না। আমাকে আমার কথা বলতে দে, তারপর আমি যাই। এই শুক্রবার শ্রাবণীদের শশুড়বাড়িতে দাওয়াত আছে আমাদের।”
“তোমরা যাও। আমি যাব না।” মহুয়া বলল।
“শ্রাবণীর দাদী শাশুড়ি তোকে বিশেষভাবে দাওয়াত দিয়েছে। তোকে তো যেতেই হবে।”
মহুয়া ন্যাঁকা কান্না করে বলে, “ভাইয়া…”
মুরাদ তো এই কথোপকথনে নেই। সে তার মা’কে বলে, “মা আমাদের এখন একসাথে চারটা বড় প্রজেক্ট জমা হয়েছে। এর উপর ছোট কতগুলো তো আছেই। আগামী মাসের মধ্যে সব কমপ্লিট করতে হবে৷ আমার বাসায় বসে ওগুলো শেষ করতে হবে।”
“আচ্ছা বাবা তোর জন্য রান্না করে রাখবো।”
মহুয়া তো আরও চেতে যায়, “মা তুমি এখন ভেদাভেদ করছ কিন্তু।”
“আরেকটা কথা বললে তোর খাবারের পর মিষ্টি বন্ধ।”
মহুয়া মুখ ফুলায়, “মা’য়ের এত জালিম হয়? আর আমি সেদিন মোহ, সমুদ্র দুলুভাই আর মৃণাকে নিয়ে ঘুরতে যাব।”
“তুই আমাকে বলেছিস শনিবার যাবি। খবরদার কাহিনি করবি না। বলেছি তুই শুক্রবার আমাদের সাথে যাবি মানে যাবি। বয়স্ক মানুষ একজন এত আদর করে তোকে ডেকেছে তুই যাবি না?”
“না।”
“তোকে তো…” মা উঠে মহুয়ার পিঠে কয়টা চাটি বসিয়ে বলল, “তুই যাবি তোর বাপও যাবে।”
“বাপ তো যাবেই।”
“আরেকটা কথা মুখ দিয়ে বের করবি না। আল্লাহ জানে তোকে বিয়ে দিব কীভাবে? ”
“এহ, আমি কী পাগল হইসি যে বিয়ে করব?”
“তোর সাথে এমনিতেও কোনো সুস্থ মানুষ বিয়ে করবে না। তুই যত না করিস তোকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাব।”
“ভাইয়া তুমি কিছু তো বলো।”
মুরাদ হাই তুলে উঠে যায়, “আমার ঘুম পেয়ে গেছে তোর বকরবকর শুনে।”
“আমাকে বাঘের মুখে ছেড়ে এখন তোমার ঘুম ধরে গেছে?”
মুরাদ তার কথার উওর না দিয়ে চলে যায়। মা’ও তার কথা না শুনে চলে যায় রান্নাঘরে। মহুয়া বিরক্ত হয়ে আবারও তার কার্টুনে মনোযোগ দেয়। তখন তার ফোনেও মেসেজ আসে। সে ফোন উঠিয়ে দেখে পূর্ণির মেসেজ, “আপু তুমি কী শুক্রবারের দাওয়াতের কথা শুনেছ? তুমি তাড়াতাড়ি করে আসবে কিন্তু। তোমার সাথে আমি এত্তগুলা গল্প করব। দাদীও তোমার কথা অনেক মনে করছে।”
মহুয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে, তার যাবার মোটেও ইচ্ছা ছিলো না। বিশেষ করে ওই শায়ানকে দেখার তো তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই কিন্তু কি করার? বোধহয় যেতেই হবে।
.
.
পরেরদিন জাহান মহুয়াকে নিয়ে ভার্সিটি থেকে যায় সোজা ক্লাউড ক্যাফেতে। সেখানে তেমন কেউ ছিলো না। দুইটা কাপল ছিলো কেবল। জাহান তাদের টেবিলে যেয়ে বসে আদনান আংকেলকে তার জন্য কফি ও মহুয়ার জন্য কিছু খাবারের অর্ডার দেয়। আর নিজের নোট খুলে বসে মহুয়ার সামনে, “আমরা আজ এগুলো দিয়ে শুরু করবো।”
“আসতে না আসতেই কে পড়তে বসে ভাই? এমনিতো না খেলে আমার মাথা কাজ করে না।”
জাহান নোটগুলো পাশে রাখে, “আচ্ছা ঠিকাছে। তাহলে বলো।”
“কী বলব?” মহুয়া তার গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে।
“তোমার যা ইচ্ছা। তোমাকে কথা বলতে দেখলেও আমার ভালো লাগে।”
মহুয়ার গাল খানিকটা ভারী হয়ে আসে। সে নিজের ঠোঁট কামড়ে রাখে কতক্ষণ তারপর বলে, “এভাবে কথা বলো না তো।”
“কীভাবে?”
“যেমন আমরা প্রেম করছি।”
“আমি তো করছি। তুমিও জলদি করবে।”
মহুয়া ভেংচি কাটে, “এত প্রেমিক হওয়ার শখ কেন তোমার? প্রেম তো কেবল একটু অনুভূতি। অনুভূতিটা কিছু সময়ের জন্য ভালো লাগে। আমি এটাও জানি এই ভালোবাসা সারাজীবন থাকে না। দায়িত্ব আসলে ভালোবাসা হেরে যায়। আমার মা বাবাকেই দেখেছি। তাদের লাভ ম্যারেজ ছিলো। প্রথম প্রথম সব ভালো ছিলো কিন্তু যখন বাবার চাকরিটা চলে যায় ঘরে পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যায়। বাবা মা চিন্তা সহ্য করতে না পেড়ে একে অপরের উপর চিল্লাতো। প্রতিদিন অশান্তি হতো ঘরে। অভাব আসলে প্রেম থাকে না। আর অনুভূতি একসময় শেষ হয়েই যায়, সারাজীবন থাকে না। হতে পাড়ে তোমার অনুভূতিও বদলে যাবে একসময়।”
জাহান তার কথা শুনে ধ্যান সহকারে। তারপর আদনান আংকেলের দিকে ইশারা করে বলে, “তুমি জানো এই ক্যাফেটা আদনান আংকেলের না। তার মৃ’ত স্ত্রীর। তার স্ত্রীর অনেক শখ ছিলো একটা ক্যাফের। যখন নতুন ক্যাফে খুলে তখন আমরা প্রথম স্কুল থেকে আসি এখানে। তখন আমরা সবাই ক্লাস ফোরে পড়তাম। আমার এখনো মনে আছে আন্টি আমাদের এত যত্ন নিয়েছিল। আন্টির হাতের ব্লুবেরি কেক বেস্ট ছিলো। আমাদের চারজনের পছন্দের ছিলো। প্রতিবার আসলে ওটাই নিতাম। মাঝেমধ্যে আংকেলও থাকতো ক্যাফেতে। তার একবছর পর এসে দেখি ক্যাফেটা বন্ধ। একদিন কাটে, একসাপ্তাহ, তারপর দুইমাস। আমরা চারজন ড্রাইভারের সাথে প্রতিদিন আসতাম। তারপর আসাটা কমে যায়। দুইমাস পর এসে দেখি ক্যাফে খোলা। ওদিন আন্টি আর ছিলো না। আদনান আংকেল ছিলেন। দুইমাসে তার বয়স দশবছর বেড়ে গেছে হঠাৎ। আমরা জানতে পাড়ি আন্টি ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন।” কথাটা বলে জাহান গভীর নিশ্বাস ফেলে, “আদনান আংকেল এসপি ছিলেন৷ তিনি এত বড় পোস্ট ছেড়ে এই ছোট ক্যাফে সামলাচ্ছেন। কেবল নিজের স্ত্রীর জন্য। তার কোনো বাচ্চা নেয়, আর বিয়েও করে নি। এখন বলো, তোমার মনে হয় সময়ের সাথে এত সহজে প্রেম শেষ হয়ে যায়?”
মহুয়া তার কথা শুনে উওর দিতে পাড়ে না। সে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।
জাহান আবারও বলে, “হয়তো অভাবের সময় তোমার বাবা মা’য়ের মাঝে হাজারো ঝগড়া হয়েছে কিন্তু তারা কী একে অপরকে ছেড়ে গেছে? অভাব আসলে প্রেম চলে যায় না। প্রেম চলে গেলে তোমার মা’ও তোমাদের ছেড়ে চলে যেত। কিন্তু উনি তোমার বাবার পাশে ছিলেন। তোমার বাবা নিজের দায়িত্ব থেকে পালাতে পাড়তো। তোমার বাবা তোমাদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এটাই ভালোবাসা। শত বাঁধা পেরিয়ে একসাথে থাকা। শুনো মহুয়া,” জাহান মহুয়ার হাতের উপর হাত রাখে। বলে, “ভালোবাসার অনুভূতিটা সহজে যায় না। আমি আমার চোখের সামনে আমার মা’কে আমার বাবার জন্য জীবন দিতে দেখেছি আর আমার বাবাকে তার স্মৃতির কষ্ট নিয়ে জীবন কাটাতে। আমার কাছে ভালোবাসার মতো পবিত্র অনুভূতি এই পৃথিবীতে দুটো নেই।”
জাহান মহুয়ার হাত নিয়ে তার গালে রেখে নীরসস্বরে বলে, “আর তুমি তারপরও আমার ভালোবাসা পরীক্ষা করতে চাইলে একবার বলে দেখো আমি আমার সব সম্পত্তি ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসতে পাড়বো। অভাব থেকেই তোমার সাথে আমাদের রাজমহল গড়ে দেখাব। দেখাব যে দায়িত্ব আসলেই ভালোবাসা শেষ হয় না।”
মহুয়া তার হাতে জাহানের গালের উষ্ণতা টের পায়। সাথে সাথে হাত সরিয়ে নেয়। অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকায়। একবার বই খুলে তো আবার ফোন। জাহান হাসে তার কান্ডে।
“ভাইয়া তুমি এখানে কী করো?” জাহান পরিচিত কন্ঠ শুনে পিছনে ফিরে তাকায়। দেখে জিনি এসেছে। তার বান্ধবীদের সাথে। তাদের দেখে জাহান বিরক্ত হয়। জিনির বান্ধবীরা সব বাচ্চা কিন্তু তার সাথে এভাবে ফ্লাটিং করে যেভাবে ভার্সিটির মেয়েরাও করে না। আজকালকার বাচ্চারা এত চতুর কীভাবে বুঝে কুলায় না।
জাহান বিরক্তির ভঙ্গিতেই তাকায় তার দিকে, “কাবাডি খেলছি দেখিস না?”
মহুয়া সাথে সাথে কল্পনা করে জাহানকে কাবাডি খেলার সময় কেবল লাগবে। আর ফিক করে হেসে দেয়। তারপর জোরেই হেসে উঠে।
জাহান চোখ ঘুরিয়ে তাকায় তার দিকে। জিনিও তাকায়। মহুয়াকে দেখে তার মুখ কালো হয়ে যায়৷ সে গোমড়া মুখে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আবার এর সাথে এখানে কী করছ?”
জাহান কপাল কুঁচকায়, “এটা কেমন ভাষা জিনি? তুই কী দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস? সরি বল, রাইট নাউ।”
“তুমি আগে বলো তুমি কোনো মেয়ের সাথে থাকো না তাহলে ওর সাথে এখানে কী করছ?”
“এখানে আমরা যখন ইচ্ছা তখন আসবো৷ যার সাথে ইচ্ছা তার সাথে আসবো। কিন্তু তুই নিজের বড়দের সাথে এভাবে কথা বলতে পাড়বি না। সরি বল ওকে।”
মহুয়া বলে, “থাক না। বাচ্চা মানুষ।”
জাহান তবুও জিনিকে ছাড় দেয় না, “সরি বল, রাইট নাউ।”
“বলব না।”
“আই থিংক আমার আব্বুর বিরুদ্ধে যেয়ে তোকে এলায়েন্স দেওয়াটা ভুল হয়ে গেছে। তোর শিক্ষা প্রয়োজন। আজ থেকে তোর সব টাকা দেওয়া বন্ধ।”
“ভাইয়া তুমি এমন একটা মেয়ের জন্য আমাকে বকছো? তুমি জানো ও তিসান ভাইয়ার সাথেও… ”
জাহানের দৃষ্টি রাগান্বিত হয়ে যায়। সে আবারও আদেশের সুরে বলে, “আমি ওর বিরুদ্ধে একটা অসম্মানজনক শব্দও শুনবো না।”
জিনি ভাইয়ের রাগ দেখে অবাক হয়ে যায়। ভয়ও পায়। সে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছুকভাবে মাফ চায়।
জাহান বলে, “এখন নিজের দল নিয়ে অন্যকোথাও যা। তোর সাথে আমি বাসায় যেয়ে বাকি কথা বলবো।”
জিনি কাঁদোকাঁদো চোখে তাকায় তার ভাইয়ের দিকে। তারপর মহুয়ার দিকে। তার ভাই তাকে সহজে বকে না। আজ একটা মেয়ের জন্য বকলো। তাও যে মেয়ে তার ও তিসান ভাইয়ার সাথে টু টাইমিং করছে! মুহূর্তে কান্না করে দিয়ে রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল।
মহুয়া এতক্ষণ নীরব দর্শক হয়ে সব দেখছিল। সে জাহানকে বলল, “বেচারি বাচ্চা মানুষ, হুদাই এত বকার কী দরকার ছিলো? আর কি কিউটও।”
“দেখতে তো আমার মতোই হয়েছে মানে আমাকেও তোমার কিউট লাগে?”
মহুয়া কাশে একটুখানি। তার কথার উওর দেয় না যদিও। সে বলে, “শনিবারে তো ক্যাফেটা খোলা থাকবে তাই না?”
“থাকার তো কথা। আসবে না’কি?”
“মৃণা, মোহ আর আমার ওয়ান এন্ড অনলি গ্রেট সমুদ্র দুলুভাইকে নিয়ে আসবো। জায়গাটা ওদের অনেক পছন্দ হবে।”
“আমাকে ডাকবে না?”
“আসলে এসো।” মহুয়া মৃদু হেসে চোখ নামিয়ে তার বই সামনে টেনে নেয়। হাসি লুকিয়ে বলে, “খাবার আসতে হয়তো দেরি হতে পাড়ে। পড়া শুরু করে দেই আসো।”
জাহান তার লুকানো হাসিটা ঠিকই দেখতে পায় কিন্তু কিছু বলে না।
মহুয়া লুকিয়ে তাকায় তার দিকে। চিন্তা করে শায়ানের কথা কী তাকে জানাবে? শায়ানের ভাইয়ের সাথেই যে ওর ফুফাতো বোনের বিয়ে হয়েছে তা কী জানানো উচিত? আবার এই শুক্রবার দাওয়াতে যাবে। কিন্তু তার কী জাহানকে জানানোর প্রয়োজন আছে? জাহান কী হয় তার? তবে তার এমন কেন মনে হচ্ছে জাহানের কাছে ব্যাপারটা লুকিয়ে সে ঠিক করছে না।
.
.
সমুদ্র আড্ডা দিয়ে এসে দেখে মোহ ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ আরও তাড়াতাড়ি আসলো সে মোহের সাথে গল্প করতে। এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাবে ভাবে নি। অবশ্য ভালোই হলো, অন্তত তাকে মেঝেতে ঘুমাতে বলতে পাড়বে না।
সমুদ্র রান্নাঘরে যেয়ে ফ্রিজ থেকে খাবার নিয়ে খেল। তারপর হাতমুখ ধুঁয়ে এসে শুঁয়ে পড়লো তার আরামদায়ক বিছানায়। অনেকক্ষণ যাবত এদিক ওদিক ফিরল। তার ঘুম এলো না। অবশেষে না পেরে উঠে বসে। আজকের রাতটাও বোধহয় তার ভালো ঘুম হবে না।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে ঘুরে দেখে। ডিম লাইটের মৃদু নীলচে আলোয় তাকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মধুকে তবুও মিষ্টি দেখাচ্ছে। সে হেসে এক কোণি বিছানায় রেখে তার দিকে একপাশ হয়ে ঝুঁকে শোয়। তার মুখে এসে বিরক্ত করা চুলগুলো আলতো করে পিছনে নিয়ে কানের পিছে গুঁজে দেয়। বলে, “ঘুমানোর সময় কী শান্ত দেখায় তোমাকে। ঘুম থেকে উঠলেই আমাকে বকা শুরু যায় তোমার। অন্য সবার সাথে কী মিষ্টিভাষী তুমি মধু! আমার সাথে কথা বলতে আসলেই কী তোমার রাগ লাগে বুঝি?” ভেবে হাসে সমুদ্র। তারপর গাল আলতো করে ছুঁয়ে বলে, “আমাদের এই সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক আমি চাই তুমি সবসময় বন্ধুর মতো আমার পাশে থাকো। তোমার নাম সত্যিই যথার্থ, তোমার সাথে থাকলে মানুষ মোহে পড়তে বাধ্য। মা, বাবা, ঈশা, সাথে আমিও কীভাবে তোমার মোহে পড়ে যাচ্ছি দেখো। তোমাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। এজন্যই তো আমি তোমাকে সুখে দেখতে চাই। তুমি সত্যিই এমন কাওকে ডিসার্ভ করো যে তোমাকে নিজের জীবন থেকেও বেশি ভালোবাসবে। চিন্তা করো না মধু তোমার স্বপ্নটা আমি পূরণ করবোই।”
সমুদ্র কথাগুলো ধীর কন্ঠে বলে আবারও শুয়ে পড়ল ঘুমানোর জন্য। আবার তাকাল মোহের দিকে। তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি এঁকে উঠল। হঠাৎ সে মোহের কাছে যেয়ে তাকে বুকে টেনে নিলো। তার প্রশস্ত বুকের মাঝে মোহকে ভরে নিলো। দু’হাত দিয়ে তার জড়িয়ে নিলো। মোহও নড়ে-চড়ে দখল করে নিলো সমুদ্রের বুকখানা। যে এই বুকে কেবল তারই অধিকার আছে।
চলবে…