মেঘের খামে পর্ব-৪০

0
4

মেঘের খামে…
পর্ব ৪০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

জবা এসে দাঁড়ায় কারিমের পাশে। তার চোখ যায় তার ধরা মোহের হাতের দিকেও। কিন্তু সে এমনভাবে তাকায় যেন কিছু দেখে নি। সে উলটো ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি এঁকে মোহের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে সামনা-সামনি প্রথম দেখলাম। ছবি থেকেও বেশি সুন্দর দেখতে তুমি সামনা-সামনি।”

মোহ হতবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। আবার তাকায় নিজের হাতের দিকে। মোহ সরাসরি তাকায় কারিমের দিকে। কঠিন গলায় বলে, “এই মুহূর্তে আমার হাত না ছাড়লে চিৎকার করে ভিড় করব আমি। আমি হাওয়ায় কথা বলি না।”

মোহের এমন কঠিন কথার ধরন দেখে কারিম হাত ছাড়লেও তার মুখ দেখে মনে হলো না সে একটুখানিও ভয় পেয়েছে। উল্টো সে বাঁকা হেসে বলে, “যদিও আমার মেয়েদের উঁচু স্বরে কথা বলাটা পছন্দের না কিন্তু আগুন সুন্দরীদের কন্ঠে আগুন হলেও মানায়।”

মোহ ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। সে এত কম সময়ে কাওকে ঘৃণা করতে পাড়ে জানা ছিলো না। সে একপলক জবাকেও দেখলো। সে নিজের চোখের সামনে নিজের স্বামীকে এমন জঘন্য কাজ করতে দেখে কীভাবে চুপ থাকে?

মোহ কিছু না বলেই সেই মুহূর্তে সেখান থেকে চলে যায়। রুমে আসে সমুদ্রের খোঁজে। সে রুমে এসেও সমুদ্র পায় না। সে মুহূর্তে তার আরও মেজাজ খারাপ হয়। সে রাগে গজগজ করতে করতে যায় বাথরুমে গোসল করতে। লম্বা চল্লিশ মিনিটের একটা শাওয়ার নিয়ে তার মেজাজ ঠান্ডা হয়। তারপর যেয়ে সে তাদের রুম গুছাতে শুরু করে মোহ। তার ও সমুদ্রের আজকের হলুদের কাপড় বের করে লাগেজ দুটো খাটের নিচে রেখে দেয়। সমুদ্রের ব্যাগ সরাতে যেয়ে দেখতে পায় সমুদ্রের ব্যাগের নিচেই মানিব্যাগ রাখা। এই দেখে বিরক্ত হয় মোহ। নিজের মানিব্যাগ কেউ এভাবে ফেলে রাখে? সে মানিব্যাগটা সরিয়ে রাখতে নিলে তার চোখ পড়ে মানিব্যাগে রাখা ছবির দিকে। যেখানে আগে জবার ছবি লাগানো ছিলো এখন সেখানে মোহের ছবি লাগানো। ছবিটা দেখে সে কিছু সময় স্তব্ধ রইল। নিজের চোখকে এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস হলো না তার। সে বিছানায় বসে পড়লো। শুন্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অজান্তেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ডাক পড়ে নাস্তা করার জন্য। সে নিচে যেয়ে দেখে অনেকগুলো চেয়ার পাতানো। কেউ চেয়ারে বসে খাচ্ছে তো কেউ নিচে পাটি পেতে খেতে বসেছে। সে দেখল সমুদ্র তার বন্ধুদের সাথে নিচে বসে খাচ্ছে। ঈশাকেও সেখানে দেখে সে গেল সেদিকে। সে ঈশার কাছে গেল। ঈশা তাকে দেখে উঁচু স্বরে তার এক বোনকে বলল, “এই অনু একটা চেয়ার এদিকে আন তো। আর মোহকে নাস্তা দে জলদি।”
মোহ তার পাশেই বসলো। মিষ্টি হেসে বলল, “চেয়ার লাগবে না আপু। তোমাদের সাথেই বসি। এখানেই সম্ভবত বেশি মজা হচ্ছে।”
শ্যাওলা রঙের মাঝে গোলাপি পদ্ম আঁকা জামা পড়েছে সে। আপাতত মুখে কোনো প্রসাধনী মাখা নেই। মাথায় ওড়না থাকলেও কিছু ভেজা চুল মুখে এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
তাকে দেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সমুদ্র। এক ঢোক গিলল। তার বুকে কেমন তোলপাড় শুরু হলো। সে এমনিতেই নির্দ্বিধায় সুন্দরী। তার সৌন্দর্যের জন্য সবাই তার দিকে একবার না হলেও ফিরে তাকায়।

তবে সমুদ্রের কাছে সবসময়ই সবাইকে একইরকম লাগে। প্রথম জবাকেও তার সাধারণই লেগেছিল। যতদিন না পর্যন্ত সে ফাংশনে তার নাচ দেখেছিল। সে এক মুহূর্তে তার কাছে মনে হয়েছিল এর থেকে বেশি সৌন্দর্য পৃথিবীর অন্যকোথাও হতেই পাড়ে না। ইদানীং সে অনুভূতি তার মোহের জন্যও হচ্ছে। তাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। অদ্ভুত রকমের সুন্দর। সবাই কেবল তার রঙ এবং মুখের নিঁখুত গড়নই চোখে লাগে। কিন্তু তার মুখের মায়া আর পবিত্রতাও কী তাদের চোখে পড়ে?

এই মুহূর্তে তো তাকে সদ্য পদ্মফুলের মতো দেখাচ্ছে। মিষ্টি, কোমল আর পবিত্র। তার ভেজা চুলের থেকে পানি পড়ছে তার মুখে। তার গাল গড়িয়ে পড়া শীতল পানির বিন্দু দেখে সে এক ঢোক গিলে। তার হৃদপিণ্ডের রোগটা আজও বাড়লো।

লামিন খাচ্ছিল সমুদ্রের পাশে বসেই। রিফাতের সাথে গল্প করতে করতে একটা প্রশ্ন করে তাকাল সমুদ্রের দিকে। দেখে সমুদ্র খাবার খাওয়া ছেড়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কোথাও। প্রথমে তার মেজাজ খারাপ হলো এই ভেবে যে সমুদ্র এই দৃষ্টিতে কেবল তাকায় জবার দিকে। যা আগে তাদের দেখতে ভালো লাগলেও এখন ভাবতেও বিরক্ত লাগে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে জবা এখনো খেতে আসে নি। সে সমুদ্রের দৃষ্টি অনুযায়ী সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় সমুদ্র তাকিয়ে আছে মোহের দিকে। মোহ ঈশার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। মুহূর্তে তার মনে হলো তার বুকের ভেতরটা হাল্কা হয়ে গেছে। খুশিতে সে তার প্লেটটাও ধরে রাখতে পাড়ল না। পড়ে যেতে নিতেই যেমন তেমন করে ধরে নিলো। মুহূর্তে ফোন বের করে মেসেজ দিলো ঈশাকে। ঈশা মেসেজ পেয়ে তার দিকে তাকালে ইশারায় দেখাল সমুদ্র ও মোহকে। তাদের দেখতেই ঈশার চোখদুটোও জ্বলজ্বল করে উঠে।

অন্যকেউ না হলেও তারা জানে সমুদ্র জবার প্রতি কতটা দুর্বল ছিলো। কতটা ভালোবাসতো। তার জন্য পাড়ে না সারা পৃথিবীর সুখ এনে দেয় তার কোলে। তার ভালোবাসা, তার পাগলামো সব দেখেছে তারা। তখন তারাও খুব করে চাইতো এই দুইজনের মিলন। কিন্তু ভাগ্য অন্যকিছু লিখেছিল। জবা বিয়ে করে নেয় কারিমকে। যদিও সবাইকে জানায় ওর পরিবারের প্রেশারে। কিন্তু কারিম ঈশার মামাতো ভাই হয়। সত্যিটা তার সামনে আসতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু সমুদ্র কিছুতেই এসব মানতে নারাজ। তার কাছে জবা সবসময়ই মিষ্টিভাষী ও নরম প্রকৃতির মেয়ে। সে জবাকে ঘৃণা করে না উল্টো নিজেকে স্বার্থপর মনে করতে থাকে। যে সে তার স্বপ্নের জন্য জবাকে একা এত কষ্টের সম্মুখীন হতে ছেড়ে গেছে। তারা দেখেছে তাদের প্রাণপ্রিয় গুছানো, মজাদার, স্বপ্নবিলাশ বন্ধুকে ছন্নছাড়া হয়ে যেতে। প্রথমে যখন মোহের সাথে তাদের দেখা হয়েছিল তখনও সমুদ্রের প্রতি তার ছাড়া ভাব দেখে তারাও ভয়ে ছিলো কিন্তু আজ সমুদ্রের এই দৃষ্টি দেখে তাদের এত বছরের বুকে জমা ভয় আজ নিমিষেই মিশে গেছে। তাদের থেকে ভালো এই দৃষ্টির অর্থ কে বুঝে? এই দৃষ্টির অর্থ হলো মোহ এখন সমুদ্রের পৃথিবী হয়ে গেছে।

মোহ কিছু একটা বলে ঈশার দিক থেকে চোখ সরিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকাতে নিলেই সমুদ্র আগেই চোখ নামিয়ে নিলো। আবার তাকাল। মোহ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
সমুদ্র ইশারায় জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে?’
মোহও বাচ্চাদের মতো মুখ করে ইশারায় উওর দিলো, ‘আইস্ক্রিম খাবে।’
সমুদ্র হাসল। ইশারাতেই জানাল, ‘খাবারের পর আনব।’
মোহ তো খুশি হয়ে খাওয়া শুরু করে। এরই মাঝে আসে কারিম ও জবা। কারিম এসেই চেয়ার টেনে জবাকে আদেশের সুরে বলে খাবার নিয়ে আসতে।

কেউ সেদিকে তাকায়ও না। মোহ ও সমুদ্র ছাড়া। মোহ তার দিকে তাকায় বিরক্তির দৃষ্টিতে। আবার চোখ সরিয়ে নেয়। সমুদ্র খাবারের মাঝ থেকেই উঠে দাঁড়ায়। জবাকে বলে, “তুমি বসো, আমি তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”
মোহ তার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিলে নিলেও তার বন্ধুদের মুখে চরম বিরক্তি। এসব আদিখ্যেতা দেখে তারা বিরক্ত।

জবা কারিমের পাশে চেয়ার টেনে বসে। কিন্তু কারিম তার পাশ থেকে উঠে যায় মোহকে নিচে বসা দেখে। সে যেয়ে বসে সমুদ্রের আগের স্থানে। লামিন তো বিরক্তি নিয়ে সরে বসে। যেন তার ছোঁয়াও বি’ষের মতো লাগে।

সমুদ্র খাবার এনে একপ্লেট দেয় জবার হাতে। আরেক প্লেট কারিমকে দিতে যেয়ে দেখে কারিম তার স্থানে বসেছে। যদিও কারিমকে তার কোনোকালে সহ্য হয় নি। খুব বদ ও অহংকারী ছেলে। তবুও জবার বিয়ের পর সে চুপচাপ সব সহ্য করে, নাহলে পড়ে জবার উপর অত্যাচার করে সে। তাই সে শান্ত কন্ঠে বলল, “এইখানে আমি বসেছিলাম।”
কারিম তাচ্ছিল্য হাসে। সমুদ্রের থেকে প্লেট নিয়ে বলে, “তোর সব তো অবশেষে আমারই হয়। এটা তো যাস্ট একটা সিট।” বলে সে তাকায় জবার দিকে। জবা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেয়।

সমুদ্রের মুঠোবন্দি হয়ে আসে কিন্তু সে চুপ থাকে।
মোহ তখন একটুখানি সরে জায়গা করে বলে, “আপনি এখানে আসুন। বসার জায়গা হবে।”
সমুদ্র তখন শান্ত হয়। সবাই আরও চেপে বসে তার জন্য জায়গা করে দেয়। সে খুশিমনে যেয়ে বসে মোহের পাশে। রিফাত টিটকারি করে বলে, “ভাই পাশে অনেক জায়গা আছে। এত ঘেঁষে বসার দরকার নেই। তোর বউকে কেউ নিয়ে যাবে না।”
মোহ তো লজ্জা পেয়ে যায় এই কথায়। সমুদ্র উল্টো নিলজ্জের মতো বলে, “আমার বউয়ের সাথে ঘেঁষে বসি আর ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ি। তোর কী ভাই? শালা সিঙ্গেলের বাচ্চা।”
সবাই হেসে দিলেও কারিম স্তব্ধ হয়ে গেল। পরোটা ছিঁড়ে ভাজি দিয়ে এক লোকমা বানিয়েছিল মুখে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। সে অবাক হয়ে তাকায় সামনের দিকে। সমুদ্রকে মোহের সাথে এত খুশি দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “বউ?”
ঈশা মোহের দিকে ইশারা করে বলে, “সমুদ্রের বিয়ে হয়ে গেছে এটা তো সবাই জানে। আর ও হলো সমুদ্রের একমাত্র মধু বউ। মোহ।”
কারিম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় সেদিকে। রাগে তার মুখে আর খাবার উঠে না। সে দাঁতে দাঁত পিষে। আচমকা সে খাবারের প্লেট ঠেলে সরিয়ে উঠে যায়। কতক্ষণ জবার দিকে তাকিয়ে থেকে রাগে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। তার রাগ দেখে জবা ভয়ে ঢোক গিলে একটা। তারপর দ্রুত উঠে পিছনে যায়।

রুমে যেয়ে দেখে কারিম সিগারেট জ্বালাচ্ছে। জবা দৌড়ে তার সামনে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার হঠাৎ কী হলো? এত রাগে দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?”

কারিম র’ক্তবর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। গভীর নিশ্বাস ফেলে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। জবার চুলের মুঠো ধরে শক্ত করে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “কী হয়েছে আমার? তোকে আমি বিয়ে করেছি ওই সমুদ্রের অবনতি দেখার জন্য। ওকে বরবাদ করার জন্য, নাহলে তোর মতো কুৎসিত আর লোভী মেয়ের দিকে আমি ফিরেও না তাকাই। আর ওই সমুদ্র তোর থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এক অপ্সরীর মতো মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে!”
সে অন্যহাত দিয়ে নিজের সিগারেট হাতে নিয়ে সে হাত জবার বাহু চেপে ধরে। জবা ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে। কারিম সেদিকে পাত্তাও দেয় না। সে আরও বলে, “সমুদ্র এত সুন্দর মেয়ের সাথে খুশিতে জীবন কাটাবে আর আমি তোর সাথে কাটাব? অসম্ভব। এখন তোকে কাছে রেখে লাভ কী?”

কারিম ধাক্কা দিয়ে জবাকে সরিয়ে দিয়ে চলে যায়৷ জবা দেখে তার বাহুর দিকে জ্বলন্ত সিগারেটে তার কামিজের হাতাও পুড়ে ছিদ্র হয়ে গেছে। ব্যাথায় সে চোখ বন্ধ করে নিলো। তার হঠাৎ মনে পড়ে সমুদ্রের মোহের সাথে হেসে কথা বলার দৃশ্যটা। এতদিন তার মনে একটুখানি হিংসা আসে নি মোহের জন্য। তার ছবি দেখেছিল জবা। সত্যিই অপ্সরীর ন্যায় সুন্দর। কিন্তু সে জানতো সমুদ্রের কাছে বাহ্যিক এই সৌন্দর্য কিছুই না। সে কেবল জবাকে ভালোবাসে। সে জানতো সমুদ্র তাকেই সারাজীবন ভালোবেসে যাবে। কিন্তু সামনা-সামনি কল্পনা থেকে অন্য এক রকম দৃশ্য দেখে তার অসহ্য লাগছে। এর উপর কারিমও তাকে হুমকি দিয়ে গেল। সে কি করবে না করবে ভেবে কুল পাচ্ছে না সে। কিন্তু একটা জিনিস সে নিশ্চিত মোহকে তার মোটেও পছন্দ হয় নি। কেবল একবাক্যের কথোপকথন হয়েছে তাদের মধ্যে। অথচ তাকে অসহ্য মনে হলো জবার।

সারাদিন খুব ভালো কাটলো মোহের। সকালে নাস্তা শেষে মেহেদী দিতে বসেছে সবাই। সমুদ্রের বন্ধুরা অনেক মজার। গান ছেড়ে নাচছে , লাফালাফি করছে, গান গাইছে বেসুরো গলায়, হাসাহাসিতে মেতে আছে। কেউ তো একে অপরের উপর ঢলে পড়ছে হাসতে হাসতে। সবাই মোহকে অনেক আদর করছে। তাদের মধ্যে সবার ছোট মোহ। তাই তার কথা মজার না হলেও সবচেয়ে বেশি জোরে হাসছে।

এই নাচগান থামলো দুপুরবেলায়। তিনটার সময়। যখন খাবার আসলো। এখন সমস্যা হলো মোহ একটু আগেই মেহেদী দিয়েছে। খাবে কী করে? ভাবতে ভাবতে সমুদ্র এলো তার সামনে এক প্লেট নিয়ে। সে ভাবলো তাকে খাওয়াতে খাবার নিয়ে এসেছে। অথচ নিজে বড় এক লোকমা ভরলো নিজের মুখে। এই দেখেই তো মোহ রাগে ফুঁসে উঠে। মুখ ফুলিয়ে বলে, “নিলজ্জ লোক এদিকে আমি আপনার নামের মেহেদী পরছি বলে খেতে পাড়ছি না আপনি আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাচ্ছেন?”
“মিস করে ফেললে মধু। বিরিয়ানিটা এত মজা হয়েছে কী বলব? থাক রাতে খেয়ে নিও। এখন আমাকে খেতে দেখে পেট ভরে নেও।”
“আপনার নামের মেহেদী লাগাবোই না আমি।” সে ফিরে তাকাল বৃষ্টির দিকে। যে তাকে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছিল। বলল, “তুমি খেয়ে আমার মেহেদী থেকে নামটা কেটে দিও আপু।”
সমুদ্র সাথে সাথে বলল, “একদম না। উল্টো দুই হাতে পা’য়ে, পাড়লে মুখেও আমার নাম লিখে ভরে দিবি। যেন কেউ সমুদ্রের বউয়ের দিকে তাকানোর সাহস না করে।”
“ওহ-হো আমাদের সমুদ্র ভাই দেখি বউপাগল হয়ে যাচ্ছে।” বৃষ্টি টিপ্পনী কেটে বলল।
কিন্তু মোহ তা মানল না। সে ভেংচি কেটে বলল, “যত্তসব ঢঙ।”
সমুদ্র এবার মজা ছেড়ে তার মুখের সামনে খাবার এগিয়ে নিলো। মোহ খেলো ঠিকই। সাথে কামড়ও বসালো সমুদ্রের আঙুলে।
“এটা কী হলো?”
“উচিত কাজ হয়েছে। আরও দিব।”
“তাই না?” সমুদ্র তার সামনে ঝুঁকে তার এলোমেলো চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে দেয়। ঠোঁটটা তার কানের এতটা কাছে নিয়ে যায় যেন তার ঠোঁট আলতো ছুঁয়ে দেয় মোহের কানের লতিতে। সাথে সাথে কেঁপে উঠে মোহ।

সমুদ্র কেমন নেশালো সুরে শুধালো, “আরেকবার কামড় দিলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সবার সামনে তোমার ঠোঁটজোড়া খেয়ে নিব। আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই এই বিষয়ে। কিন্তু তুমি ঠিকই লজ্জায় আর রুম থেকে বের হতে পাড়বে না। তাই আয়ার ধৈর্য্যর পরীক্ষা না নিয়ে চুপচাপ খাও।”
মোহ একবার তার নিলজ্জের মতো কাহিনী দেখে অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। তারপর চুপচাপ খেতে শুরু করে।

“আমি বসতে পাড়ি এখানে?” মেয়েলী কন্ঠে দুইজনের ধ্যান যায়। প্রশ্ন করেও উওর না নিয়ে চেয়ার টেনে বসলো জবা সমুদ্রের পাশেই। ব্যাপারটা মোহের ভালো না লাগলেও সে চুপ থাকলো।

সমুদ্র তার মুখের হাসি বজায় রেখেই জিজ্ঞেস করে, “তুমি খেয়েছ?”
“মেহেদী দিয়েছি তো। হাত দিয়ে খেতে পাড়ছি না। পড়ে খেয়ে নিব।”
সমুদ্র তার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর বৃষ্টিকে ডেকে বলে, “বৃষ্টি শুন, তোর খাওয়া শেষ হলে জবাকেও একটু খাইয়ে দিস।”
উওরে জবাকে খুশি দেখা গেল না। তবুও সে কিছু বলতে পাড়ে না।

সমুদ্র মোহের সাথে পরিচয় করাল জবাকে, “মোহ ওর সাথে পরিচিত হও, ও জবা। আর জবা তুমি তো মধুকে দেখেছই।”
জবা তাকাল মোহের দিকে। তার মুখে স্পষ্ট অসন্তুষ্টি। সে বলল, “সকালে দেখা হয়েছিল আমাদের। আমি পরিচয় দিয়েছিলাম।”
“ওহ তোমরা পরিচিত হয়েছ?”
“মানে আমি কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। ও তখন বোধহয় আমাকে চিনতে পাড়ে নি। তাই চলে গিয়েছিল।”
সমুদ্রের হাসিটা উধাও হয়ে যায় কথাটা শুনে। সে গম্ভীরমুখে তাকায় মোহের দিকে, “তুমি ওর সাথে কথা বলো নি?”
মোহ জবার কথায় প্রচন্ড অবাক হয়। সে নিজের স্বামীকে অন্যমেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে দেখেও কিছু বলে নি। এখন এমনভাবে কথা ঘুরিয়ে বলছে!
সে নিজের পক্ষে কিছু বলতে যাবে এর আগেই সমুদ্র জবাকে উওর দেয়, “বোধহয় মধু তোমার কথা শুনে নি, নাহলে ভালোভাবে দেখে নি। এছাড়া কোনো কারণ হবে না।”
জবা প্রথমে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে। তার জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়ায়, “আমারও তাই মনে হচ্ছিল। এখন না চিনলেও তো মানুষ কথা বললে উওর দিতে হয়। বোধহয় ও কথাই শুনতে পায় নি।”
মোহ তার দিকে তাকিয়ে চোখ ঘুরায়। এই মুহূর্তে তার সত্যিই বিরক্ত লাগে জবাকে। সে ইচ্ছা করে তাদের মধ্যে ঝামেলা ধরানোর চেষ্টা করছে? সে একবার ভাবে সমুদ্রকে ব্যাপারটা বলবে, পরক্ষণেই আবার চিন্তা করে সমুদ্রের কাছে জবা এতটা গুরুত্বপূর্ণ। সে কী বিশ্বাস করবে তার কথা?

মোহ ভারী বিরক্ত হয়। খাওয়া-দাওয়া শেষেও জবা তাদের পাশ থেকে যাচ্ছে না। এমনকি সমুদ্র উঠে গেলেও তার পিছনে যায় সে। তার বন্ধুদের কাছেও যায়। যদিও সমুদ্র ছাড়া অন্য কেউ জবার সাথে কথা বলে না তবুও সে তাদের ছেড়ে যায় না।

বিকেলদিকে সবাই চা খেয়ে যাচ্ছিল নিজের রুমে। সন্ধ্যায় হলুদ বলে সে সকলে একটু আরাম করে তৈরি হবে এই উদ্দেশ্যে গেছে। মোহ যাই নি। সমুদ্র মোহকে একটু দাঁড়াতে বলছে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে সে গেল বাহিরে। সে অপেক্ষাই করছিল তখনই জবা এলো সেখানে। হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করল, “দাঁড়িয়ে আছো যে?”
জবাকে দেখে মোহ খুশি না হলেও বিরক্তি দেখাল না। জোরপূর্বক হেসে উওর দিলো, “সমুদ্র বলেছে।”
“এই সমুদ্রও না নিশ্চয়ই কিছু আনতে গেছে। সবার অনেক খেয়াল রাখে জানো তো?”
“হুম।” মোহ তার সাথে কথোপকথন বাড়াতে ইচ্ছুক নয়।
“আমরা যখন একসাথে ছিলাম তখন একবার কী করেছিলো জানো? ফোনে কথা বলার সময় এমনিতেই বলেছিলাম আমার ওভেন বেকড পাস্তা খেতে মন চাচ্ছে। ওর জ্বর ছিলো। সে জ্বর নিয়ে ও রেস্টুরেন্টে গিয়ে আমার ফেভারিট পাস্তা নিয়ে এসেছে ব্যালকনির সামনে। কত পাগল ছিলো ছেলেটা। এখন কী এমন আছে না’কি?”

মোহ স্পষ্ট বুঝলো জবা তাকে খুঁচিয়ে কথা বলছে। কিন্তু সে কী চুপচাপ শুনে যাবে না’কি?
সে মধুর হাসি নিয়ে তাকাল জবার দিকে, “উনার শরীর খারাপ থাকলে আমি কখনো এমন আবদার করিই না। আর আমার আবদার বলা লাগে না, বলার আগেই এনে হাজির করে উনি। আপনি হাসবেন্ডও এমন করে আপু?”
উওর শুনে জবার মুখের হাসি আর থাকলো না। তার মুখে কালো মেঘ নেমে এলো। তবুও মোহ তার ঠোঁটের হাসি সরাল না। বললে, “আপনাকে অনেকদিন ধরে একটা কথা বলতাম। দেখাই হয় নি। আজ সকাল থেকে সুযোগও পাই নি বলার।”
“কী?”
“থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”
“থ্যাঙ্কিউ?” জবা আসলে অবাক হয়।
“হ্যাঁ, থ্যাঙ্কিউ। আপনি সমুদ্রকে এভাবে না ছেড়ে গেলে আমি এত কেয়ারিং আর কিউট হাসবেন্ড পেতাম কীভাবে? যে আমার সামনে অন্তত অন্য মেয়ের হাত ধরে তার প্রশংসা করে না।”

ক্রোধে জবার গভীর নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে দেখল সমুদ্র আসছে দরজা দিয়ে। সে তখন এই প্রতিক্রিয়া দাবিয়ে রাখলো। আবারও মিষ্টি হেসে বলল, “অন্তত সে শুধু ফ্লার্টিং করে, নিজের প্রাক্তনের প্রেমে ডুবে থাকে না। তোমার কী মনে হয় খেয়াল রাখলেই সমুদ্রের মন তোমার হয়ে যাবে? কখনো না। ও তো সবারই খেয়াল রাখে। রাস্তায় কুকুর দেখলে তাকেও কিছু কিনে খাওয়াবে আর তুমি তো দুর্ভাগ্যবশত ওর বউ হয়ে গেছো। ও কেবল না পেড়ে নিজের দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু আজও ওর মনে কেবল আমি আছি, আর আমিই থাকব।”

মোহ রাগে দাঁতে দাঁত পিষলো। কিন্তু কোনো উওর দিলো না। সমুদ্র এসে পড়েছে। সে নিজেকে বুঝ দিলো এই দুইদিন কেবল। ঈশার বিয়েতে সে কোনো ঝামেলা করতে চায় না। কিন্তু এভাবে ছেড়েও দিবে না। যা করার পড়ে দেখবে। সমুদ্রকে দেখে সে গাঢ় হাসলো। সমুদ্র তাকে আইস্ক্রিম দিয়ে জবাকে বলল, “তুমি থাকবে জানতাম না। তাহলে তোমার জন্য চকোলেট নিয়ে আসতাম। তুমি তো আইস্ক্রিম খাও না।”
জবা মিষ্টি হেসে বলে, “তুমি এখনো মনে রেখেছ? অফকোর্স মনে রেখেছ। তুমি আমার ছোট বড় সবকিছুই মনে রাখতে সবসময়।”
সমুদ্র এবার নিজেই অস্বস্তিবোধ করে। আড়চোখে তাকায় মোহের দিকে। অবশ্যই মোহকে একথায় খুশি দেখা গেল না। সে আইস্ক্রিমে এমনভাবে কামড় দিলো যেন তাকে কামড়ে দিচ্ছে।
সমুদ্র তবুও হাসলো। জবাকে বলল, “যেয়ে রেস্ট নেও তাহলে। জার্নি করে টায়ার্ড হয়ে গেছ না?”
জবা মোহকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আজ সন্ধ্যায় কী পরবে?”
“ঈশা আপু শাড়ি দিয়েছিল ওটাই পরবো।”
জবা গভীর নিশ্বাস ফেলে হতাশার সুরে বলে, “তোমাকে তো ওটা পরলেও সুন্দর লাগবে। আমি একটা কাজ করা শাড়ি এনেছি বুঝলে? এখন কী করার? আমি কালো তো এমন সাদামাটা পড়লে সুন্দর লাগে না।” বলে আবারও গভীর নিশ্বাস ফেলে জবা।
“এসব কী বলছ জবা? তোমাকে যেকোনো কিছুতেই ভালো লাগে।” সমুদ্র উওর দিলো।
“তুমি ভালো দেখে কেবল কথাটা বলছ। সত্যিটা আমি জানি। আমি তো আর মোহের মতো সুন্দর নই।”

মোহ তার কথার ধরণ ধরে নেয়। সে কী চায় সমুদ্র বলুক, তার বউ থেকেও জবা সুন্দর! তাদের মাঝে ঝামেলা ধরানোর চিন্তা ভাবনা। তাই এবার সমুদ্র কিছু বলার আগে মোহ বলল, “আপু ফর্সা কালো তো কেবল রঙ মাত্র। একজন মানুষ ভেতর থেকে যেমন সবাইকে সে রূপেই দেখে। দেখুন না, আমার দুইটা বেস্টফ্রেন্ড আছে। একজন ধবধবে ফর্সা, অন্যজন কৃষ্ণকলি। সে দুইজনই খুবই সাদামাটা জামা পড়ে। আমাদের তিনজনের মধ্যে কেবল আমিই এত সাজগোজ করি। যার যার পছন্দ রাইট? কিন্তু আমার চোখে ওরা দুইজন সবচেয়ে বেশি সুন্দর। আপনি তো শ্যামলা, আমার সে বান্ধবীর রঙ কালো। অথচ ওর মুখে এই জগতের সব মায়া ভরা। এত সুন্দর। এই’যে আপনি ভাবছেন মানুষের কাছে আপনাকে সুন্দর লাগবে না। মানুষের কাছে কী আপনার সুন্দর লাগাটা খুব জরুরি? আমাদের দেশে মানুষ যেমন সাদাপ্রিয় অন্যান্য অনেক দেশ আছে যেখানে ফর্সা মানুষ কালো হবার চেষ্টা করে। এটা যার যার মানসিকতা, নাহলে আমাদের সবাইকে তো একজনই বানিয়ে। তাই সবাই সুন্দর। একজনের চোখে একেকজনকে সুন্দর লাগে। এই’যে আপনাকে যেদিন আমি প্রথম দেখেছিলাম আপনাকে খুবই মায়াবী লেগেছে আমার কাছে।” কথা শেষ করে সমুদ্রের দিকে তাকাল মোহ, “ঠিক বলেছি?”
সমুদ্রের ঠোঁটের কোণে হাসি। সাধারণ হাসি নয়, গর্বিত হাসির ঝলক। সে মোহের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “একদম। আমার মধুর মতো কথা বলেছ। আইস্ক্রিম?”
সমুদ্র নিজের আইস্ক্রিমটা এগিয়ে দিলো। মোহও স্বভাবতই কামড় দিলো সমুদ্রের আইস্ক্রিমে। এখন মোহের তার আইস্ক্রিমে কামড় না দিলে হয় না, আর সমুদ্রও মোহের আইস্ক্রিমে কামড় দেবার পরই নিজে খায়।

জবার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। সমুদ্র কখনো তাকে সাপোর্ট করা ছাড়ে নি। সঠিকে বেঠিকে নির্দ্বিধায় তার হয়ে কথা বলেছে। আজ কয়মাস আগে আসা মেয়ের জন্য তাকে এড়িয়ে গেল। আবার ‘আমার মধু’ ডাকছে!
সে রাগে ফুঁসে উঠে। আবার নিজের ঠান্ডা সরল আবরণ বরণ করে কিছু মুহূর্তেই। সে হাসিমুখে উওর দেয়, “আসলেই তোমার ভাবনা মিষ্টি।”
মোহের এতক্ষণের জবার ব্যবহারের পর এমন সোজা প্রশংসা হজম হলো না। সে অবাক হয়। তবে জবাও বেশিক্ষণ নেয় না তার পরের টিপ্পনী কাটতে, “কিন্তু তোমার আইস্ক্রিম তো আছে। অন্যের আইস্ক্রিমে এমন কামড় দিলে খারাপ দেখায় তো। বিষয়টা অনেক আনহাইজেনিকও বটে।”
মোহের এই মুহূর্তে খুবই বিরক্তিকর লাগে জবাকে। তবুও ভাবে তাকে কিছু বললে সমুদ্র রাগ করবে। তাই চুপ রইল। কিন্তু তাকে অবাক করে সমুদ্র বলে, “আমি ওর স্বামী জবা। অন্য যেকেউ না। ও আমার আইস্ক্রিমে কামড় দেবার পরই আমি খাই। আমাদের পার্সোনাল ব্যাপার।”
“আমি ওভাবে বলতে চাই নি।”
“আমি জানি তুমি খারাপভাবে বলো নি। তুমি যেয়ে রেস্ট করে রেডি হও। তোমার বোধহয় শরীর খারাপ, নাহলে তুমি কী আজব কথা বলছো নিজেও বুঝতে পাড়ছ না।”
কথাটায় বোধহয় লজ্জা পেল জবা। মুখ ভার করে উপরে চলে গেল।

মোহ তো হতবাক। তার হয়ে কথা বলেছে সমুদ্র, তাও জবার বিপরীতে!
সে ভয়ে ছিলো এখানে আসার আগে। ভেবেছিল সমুদ্র জবার সামনে তার সাথে কথাই বলবে না। জীবনে ভুল প্রমাণিত হয়ে এর থেকে বেশি খুশি সে আর কখনো হয় নি।

সমুদ্র তার দিকে একপাশ থেকে ঝুঁকে বলে, “তোমার ঠোঁটের ছোঁয়ায় যে আমার আইস্ক্রিমও আরও মিষ্টি হয়ে যায়। একথা বলি কীভাবে বলো?”
মোহ আড়চোখে তাকায় তার দিকে। মুচকি হাসে লুকিয়ে। তারপর বলে, “আমিও যাই। একটু আরাম করে রেডি হবো। আপনি আসবেন না?”
“কেন আমি না আসলে তোমার আরাম করা হবে না?”
“মানে সোজা উওর দিতে গেলে আপনার গলায় কাঁটা আটকে যায়?”
হাসে সমুদ্র, “এদিকে স্টেজ বানাবে। আমরা সবাই এখানে আছি। পড়ে এসে রেডি হবো। তুমি যাও।”
“আচ্ছা।”
সে যেতে নিলে সমুদ্র আবার ডাকে, “আচ্ছা শুনো…”
“হুঁ?”
“এখানে কি একটা চুমু খেতে পাড়ি?”
“নিলজ্জ লোক কোথাকার!” সে মুখ ঝামটাল। আর চলে গেল।
.
.
বাহিরের কাজ শেষ সব বন্ধুরা এলো নিজেরাও তৈরি হতে। দরজা খোলা পেয়ে সমুদ্র রুমে ঢুকে। হাঁপিয়ে গেছে সে। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে রুমে ঢুকে বলে, “এই মধু জলদি রেডি হয়ে নেও। ঈশার বাচ্চা নিজে আগে তৈরি হয়েছে দেখে এখন সবাইকে তাড়া…”
সে হঠাৎ থেমে যায়। মোহ বারান্দা থেকে দৌড়ে এসেছে তার কন্ঠ শুনে। তার নুপুরের ছনছন শব্দ সারা রুমে গুঁজে উঠে৷ সে অপলক তাকিয়ে থাকে তার সামনে দাঁড়ানো শাড়ি পরিহিতা কন্যাটির দিকে। নীল পাড় সাদা জমিনের শাড়ি পরেছে মোহ। সাথে রূপালী রঙের গহনা আর সাজে অসাধারণ লাগছে। এই প্রথম শাড়িতে দেখেছে সে মোহকে। বৌভাতে দেখলেও এত খেয়াল করে নি। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে শাড়িতে দেখে হৃদয়ের স্পন্দন যেন সেখানেই থেমে গেছে।

“ভালো হয়েছে আপনি এসে পড়েছেন। কয়টা ছবি তুলে দিবেন? মহুয়া আর মৃণাকে পাঠাব।” মোহ তার ফোন এগিয়ে দিলো।
সমুদ্র ধ্যানমগ্নের মতো এগোল তার দিকে। তার দৃষ্টি এই প্রথম যাচাই করছে সম্পূর্ণ মোহকে। সে হাত এগিয়ে ফোনটা নিয়ে বিছানার দিকে ছুঁড়ে মারে।
“আপনি ফোনটা এভাবে ফেলে দিলেন কেন? ছবি তুলে দিতে বলেছিলাম।”
মোহ তার পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই সমুদ্র তার হাত ধরে নেয়। তাকে বাহুডোরে ভরে আবদ্ধ করে নেয়। নিজের উন্মুক্ত বুকে তাকে ভরে তার লালিমামাখা মুখখানা উপভোগ করে।
মোহ নিশ্বাস আটকে যায়। লজ্জামাখা নয়নে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, “কী করছেন? ছাড়ুন।”
“তোমার চিত্র নিজের চোখ ও বুকে ছাপিয়ে রাখছি। তোমকে আজ কতটা সুন্দর লাগছে জানো তুমি? মনে হচ্ছে কোনো চিত্রকর এই পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য এক ক্যানভাসে এঁকে আমার জন্য গেছে।”
সে শাড়ির ভাঁজে হাত রাখে মোহের উন্মুক্ত পেটের ভাঁজে। সাথে সাথে মোহের ভেতরটা কেঁপে উঠে। তার সারা দেহ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। সে চোখ বন্ধ করে সমুদ্রের শার্ট ধরে মুঠোর ভেতর।
“প্লিজ এমন করে না। ম’রে যাব আমি।”
সমুদ্র উলটো তার কানের কাছে ঠোঁটজোড়া এনে মৃদুস্বরে বলে, “আমাকে হৃদয়কে যে ঝলসে দিচ্ছো তার কি?”
তার চুলে বাঁধা একটা গোলাপ খুলে নেয়। সে গোলাপের নরম পাঁপড়ি তার ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দিয়ে বলে, “আজ নাহয় একটু অনুষ্ঠান মিস করলাম।”
তার কথায় মোহের সম্পূর্ণ দেহ কেঁপে উঠে। সে কিছু বোঝার আগেই সমুদ্র তাকে কোলে তুলে নেয়। পা বাড়িয়ে এগোনোর আগে মোহ বলল, “ঈশা আপু অপেক্ষা করছে।”
এই কথায় বিরক্ত হয় সমুদ্র, “এই সময় তোমার ঈশার কথা মনে পড়েছে?”
মোহ উপর নিচে মাথা নাড়ায়।

সমুদ্র হতাশা নিয়ে তাকে আবার নামিয়ে দেয়। তবে তার মুখখানায় হাত রেখে বলতে ভুলে না, “তোমার জন্য শাড়ি কিনে আনবো অনেকগুলো। এখন থেকে আমি যেদিন ঘরে থাকবো আমার সামনে শাড়ি পরে ঘুরবে। কাজল দিবে, একটা ছোট টিপ দিবে, হাতে চুড়ি পরবে আর… ”
“আর?”
“আর পা’য়ে নুপুরের শব্দে চারদিকে সুর তুলবে।”
মোহ হেসে দুইহাত দিয়ে তার কাঁধ জড়িয়ে বলে, ” এমন প্রেমিক পুরুষদের মতো কথা বলছেন কেন? প্রেমে পড়েছেন না’কি?”
কথাটায় সমুদ্রের মুখে খানিকটা বিকৃতি ঘটল। তার হাসিমুখ এমন মলিন হবার ব্যাপারটা মোহের ভালো লাগলো না। তারও মন খারাপ হয়ে গেল। সে নিজের হাতজোড়া পিছিয়ে নিয়ে জানায়, “এমনিতেই বলছিলাম। আমি নিচে যাচ্ছি আপনি আসুন।”
সে পিছিয়ে যাবার পূর্বেই সমুদ্র তাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়, আবারও। তার কপালে আলতো করে এঁকে দেয় ভালবাসার পরশ।
স্মিত হেসে বলে, “প্রেমে পড়েছি কি-না জানি না কিন্তু এখন আমার জীবন জুড়ে তুমি আছো। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ তুমি। তোমাকে ছাড়া আমি এই জীবন কল্পনাও করতে পাড়ি না।”

চলবে…