মেঘের খামে পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
5

মেঘের খামে…
পর্ব ৪১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সে পিছিয়ে যাবার পূর্বেই সমুদ্র তাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়, আবারও।
স্মিত হেসে বলে, “প্রেমে পড়েছি কি-না জানি না কিন্তু এখন আমার জীবন জুড়ে তুমি আছো। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ তুমি। তোমাকে ছাড়া আমি এই জীবন কল্পনাও করতে পাড়ি না।”
মোহের চোখে খুশির জল এসে পড়ে কথাটা শুনে। বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক স্বস্তির নিশ্বাস। এই ব্যাপারটা সে বুঝতো। কিন্তু সমুদ্রের মুখে শুনে তার খুশির ঠিকানা থাকে না আর। মন মনের ভেতর হৈচৈ করতে থাকে প্রজাপতিরা। সে একগাল হেসে তাকায় সমুদ্রের দিকে।
তারপর মৃদুস্বরে বলে, “আমি নিচে আছি। আপনিও জলদি আসুন। আর হ্যাঁ, আপনি নতুন প্রজেক্টে কাজ করছেন না? সে গেইম সাকসেসফুলি সেইল হলেই তো আপনি নিজের অংশ নিতে পাড়বেন তাই না? তখনই আপনার থেকে আমি উপহার নিব। আমি কেবল আমার স্বামীর পরিশ্রমের অর্থ থেকে উপহার চাই।”
“তুমি যা বলবে তাই হবে।” সমুদ্র আলতো করে এক চুমু খায় তার কপালে, “নিচে যাও। আমি আসছি।”

সমুদ্র নিচে নামে কতক্ষণ পড়েই। সাদা পায়জামা ও নীল পাঞ্জাবি পরা। এসেই তার চোখ খুঁজতে লাগলো মোহকে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছিল না তাকে। চোখদুটো যখন তাকে খুঁজতে ব্যস্ত তখন এনাউন্সমেন্ট হয় জবার নাচের। যেকোনো অনুষ্ঠানে জবার নাচ হবে এটা সবাই জানে। তার নাচের প্রশংসা ছিলো স্কুল-কলেজ থেকেই এলাকা পর্যন্ত। যেকোনো অনুষ্ঠানে জবার নাচ থাকবেই। সবাই বলে গানের সুরের সাথে তার নাচের তাল অবিকল মিলে যায়। যেন পাখিরা পেখম মেলে দুলছে। তার এক নাচের পর কতশত প্রশংসা পায় সে। কেবল সমুদ্রই না কত ছেলে যে তার নাচে মুগ্ধ হয়েছে। এমনকি কারিমও একসময় তার নাচ দেখে মুগ্ধ হয়েছে।

জবা সম্পূর্ণ আত্নবিশ্বাসের সাথে আজও নাচ করছিল। সে নাচের মধ্যেই আশেপাশে তাকায় প্রতিবারের মতো। সবার দৃষ্টি তার দিকে। সে জানে তার উপর মানুষ যতই রাগ করে থাকুক, নাচের সময় তার থেকে চোখ ফেরাতে পাড়বে না। সে দেখে কারিমও তার দিক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণে বিকল সে হাসি।
তার চোখ এবার খুঁজে সমুদ্রকে। দেখাও পায়৷ কিন্তু সমুদ্রের ধ্যান তার দিকে ছিলো না। তার চোখজোড়া অন্যকাওকে খুঁজছিল।
তার চোখজোড়া বড় হয়ে গেল। তার বিশ্বাস হলো না এক মুহূর্তের জন্য। আগে তার নাচের সময় সমুদ্র চোখের পলকও পড়তো না। আর আজ তার দিকে তাকাচ্ছেও না?
এই উপলব্ধি করতেই সে মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেল। সাথে সাথে নাচ ছেড়ে আচমকা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে। তার বুকের ভেতর কেমন ভয় করতে শুরু করে।

সমুদ্র স্টেজে আসে ঈশার কাছে। তার পাশে বসে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “মধু কই রে?”
ঈশা হঠাৎ আওয়াজে ভয় পেয়ে যায় প্রথমে। তারপর পাশে সমুদ্রকে দেখে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে। বলে, “ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। এভাবে ভূতের মতো এসে কেউ পাশে বসে হঠাৎ?”
“ধ্যুর কাহিনি না করে বল মধু কই?”
“মধু? মৌমাছির কাছে যেয়ে জিগা মধু কই?”
“ফাজলামো করলে এই হলুদ তোর পুরা মুখে মেখে দিব। কাহিনী না করে জলদি বল।”
“জলদিই জানতে পাড়বি। অপেক্ষা করো সোনা। অপেক্ষায় মেওয়া…না না মেওয়া না মধু ফলে।”
“হেঁ?”
“হেঁ নয় হ্যাঁ।”
হঠাৎ আরেকবার এনাউন্সমেন্ট হয়। আর ঈশা বলে, “এবার সামনে ফিরে দেখ তোর মধুকে।”

সমুদ্র তাকায় সামনে। দেখে স্পটলাইটে এসেছে উঠানের ঠিক মাঝখানে। এক ললিতার উপর। যার রূপ থেকে চোখ সরানোটা কোনো পুরুষ কেন নারীর জন্যও দায়। অথচ এই রূপ দেখেও প্রথমে মন গলে নি সমুদ্রের। কতমাস তার দিকে তাকায়ও নি ভালোভাবে। তবে আজকাল কী হচ্ছে? তার বুকের ভেতরটা কাঁপে এই মেয়েটার এক ঝলকে। যেন তার সারা দেহ, মস্তিষ্ক বশ হয়ে যায়। আটকে যায় এই মেয়েটার উপর। চোখ ফেরানোও দায় হয়ে যায় তার জন্য। যেমনটা এখন হচ্ছে। চারদিকে হৈচৈ। মানুষে ভরা। অথচ সমুদ্রের মনে হচ্ছে এই সারা জগতে কেবল আছে সে আর তার মধু। গান বাজছে, তার কানেও আসছে কিন্তু তার নুপুরের ছনছন শব্দ তার মস্তিষ্কে ঘুরঘুর করছে।

যে পাখি ঘর বোঝেনা, যে পাখি ঘর বোঝেনা
উড়ে বেড়ায় বন বাদাড়ে
ভোলা মন মিছে কেন মনের খাঁচায় রাখিস তারে?

ও পাখি ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা
মানেনা প্রেমের শিকল
ও পাখি দশ দুয়ারে শত মন করে দখল…
যে পাখি ঘর বোঝেনা, যে পাখি ঘর বোঝেনা,

সমুদ্র মুগ্ধ দৃষ্টি এগিয়ে গেল তার দিকে। মোহমুগ্ধর ন্যায়। যেয়ে দাঁড়ায় ঠিক তার সামনে।
মোহ একটা নীল রঙের ওড়না দিয়ে তার নাচ প্রদর্শন করছিল। ঈশার জোরাজোরিতে সে নাচের জন্য রাজি হলো। ভেবেছিল স্যারপ্রাইজ দিবে সমুদ্রকে। সে যখন নাচের ভর্চা করছিল ভাবছিল সমুদ্র কী মুগ্ধ হবে তার নাচে? যেমনটা সে একবার হয়েছিল জবার সাথে। তাকে দেখেও কী হারাবে সমুদ্র?

মোহ দেখে সমুদ্র সোজা এসে তার সামনের একপাশে দাঁড়ায় বুকের উপর হাত ভাঁজ করে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মোহও দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় এসে ভার করল। নিজের নাচের চর্চা ভুলে সমুদ্রের চারদিকে ঘুরে নতুন ডান্সস্টেপ তৈরি করল।

চারদিকে হৈ-হুল্লোড় বাড়ল। সমুদ্র তো এসেছিল আরও কাছ থেকে তার মোহে ডুব দিতে। অথচ মোহ উল্টো নিজের মাঝে ভাসিয়ে নেবার পরিকল্পনা রচিত করছে? সে-ও কম কীসের? আচমকা হাত ধরে বসলো সে মোহের। মোহ তার দিকে তাকায় বিস্মিত দৃষ্টিতে। সকলের সামনে এমন কিছু করবে সমুদ্র, তা তো মোহ ভাবে নি। সে বিস্ময় থেকে উঠার পূর্বেই সমুদ্র একটানে তাকে কাছে টেনে নিলো। পিছনের স্পিকারের সাথে নিজেও গাইলো মোহের গালে হাত দিয়ে,

পাখিটার এমন স্বভাব
নিজের অভাব পূরণ করে, নিজের মতো।
পাখিটা হাসে খেলে অন্তরালে সুনিপূন করে কত
ও পাখি বাঁধনহারা ছন্নছাড়া মানেনা প্রেমের শিকল
ও পাখি দশ দুয়ারে শত মন করে দখল
যে পাখি ঘর বোঝেনা, যে পাখি ঘর বোঝেনা।

মোহ অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। লজ্জায় মেখে গেল সে যেন! চোখ সরিয়ে নিলো। সমুদ্র উল্টো তার থুতনিতে হাত রেখে মুখ তুলল। চোখে চোখ মিলতেই তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। সাথে নিলো এক গভীর নিশ্বাস। তার বুকের ভেতরটা কেমন হাল্কা লাগছে। একটু বেশিই হাল্কা। মোহ তার কাছে থাকলে শান্তির নিশ্বাস নিতে পাড়ে সে।

চারপাশে হাততালি, চিৎকার, শিস বাজানো হচ্ছে। সবাই রীতিমতো হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দিয়েছে তাদের দেখে। এমনকি ঈশাও স্টেজে বসে যেন ভুলে গেছে সে বউ, সে-ই শিস বাজাচ্ছে সবার জোরে।

মোহ তো সবাইকে এমন করতে দেখে লজ্জায় মিইয়ে গেল। আশেপাশে সবার দিকে একবার তাকিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকাল আবার নম্র দৃষ্টিতে। সবার সামনে এখন মুখ দেখাবে কীভাবে সে? এক দুই না ভেবে সে মুখ লুকালো সমুদ্রের বুকেতে। যেন এতেই কেউ তাকে দেখতে পাড়বে না।
সমুদ্র কিছু বলে না। হেসে তার পিচ্চি বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তার বুকে রেখে।
.
.
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়। মোহ হৈচৈ ছেড়ে শান্তির জন্য একটু আসে পুকুরপাড়ে। তবুও তার শান্তি মিললো আর কই? যাবার এক মিনিটের মাঝেই সেখানে এসে হাজির হলো জবা। গাঢ় নীল রঙের শাড়িতে তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছিল আজ। কিন্তু সাজের সাথে তার মুখের ক্রোধভঙ্গির কোনো মিল নেই। সে তার দিকে তাকিয়ে আছে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে। তার চোখে জল ছলছল করছে৷ আগপিছ কিছু নে৷ সে সরাসরি শুধাল, “তোমার কী মনে হয় রূপ দেখালে সমুদ্র তোমার হয়ে যাবে?”

হঠাৎ এমন কথায় তব্দা খেয়ে যায় মোহ। তবুও কঠোরকন্ঠে শুধাল, “আপনি হয়তো ভুল বুঝছেন আপু। যেদিন থেকে সমুদ্রের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। সেদিন থেকে উনি একান্তই আমার।”
“আচ্ছা তাহলে বৌভাতের রাতে তোমাকে ছেড়ে আমার সাথে ফোনে কথা বলছিল কেন? তুমি জানো কেন তখনই আমি সমুদ্রকে কল দিয়েছি? দেখাতে যে ওর জীবনে আমি কোন পর্যায়ে আছি। নিশ্চয়ই দেখেছ।”
“হুম দেখেছি৷ এখন সেটা অতীত।”
“শিউর তুমি?” জবা তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর আবার হেসে বলে, “তাহলে দেখি বর্তমানে কার মূল্য বেশি।”
জবা মোহের হাত ধরে নেয় আচমকা। কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে পাশের পুকুরে।
ভালো করে না জানলেও মোহ টুকটাক সাঁতার জানে। সে উঠতেও নেয়। কিন্তু জবা তার হাত শক্ত করে ধরেই রাখে।
সে চিৎকার করে ডাকে। মোহও চিৎকার করে। কিন্তু তার নাকে মুখে পানি ঢুকে যায়। নিশ্বাস আটকে আসে।

মুহূর্তে কতগুলো মানুষ এসে জমে। আসে সমুদ্রও। মোহ আর জবাকে একসাথে পানিতে দেখে অবাক হবারও সময় পায় না। সে এক লাফে ঝাঁপ দেয় পানিতে। দ্রুতই সামনে যেয়ে তাদের একসাথে দেখে। এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে মোহের হাত ধরে টান দেয়। তখনই আরেকবার পানিতে ঝাপানোর শব্দ শুনে। সে দ্রুত মোহকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে উপরে উঠে। দেখে লামিনও জবাকে টেনে তুলছে। জবা পানি থেকে উঠে এসে কাশছে। সমুদ্র একপলক তাকে দেখে নিচে তাকায়। মোহের মুখখানা দেখে। আচমকা ছোট হয়ে গেছে মেয়েটার মুখ। সম্পূর্ণ মুখ লাল হয়ে গেছে। তার এই অবস্থা দেখেই তো মাথায় রক্ত উঠে যায় সমুদ্রের। সে চেঁচিয়ে উঠে, “তোমরা কী পুকুরপাড়ে নাচতে এসেছিলে? এখানে কী তোমাদের? এই পাশটা গভীর তোমরা জানো না?”
সে রেগে একবার জবার দিকে তাকিয়ে আবার তাকায় মোহের দিকে। তাকে দেখেই ঠোঁটটা উলটে কাঁদোকাঁদো মুখের ভাব নিয়ে তাকায় মোহ। দুই হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরতেই সমুদ্রের রাগ পানির ভেসে যায়। সে হেসে তাকে কোলে তুলে ঈশাকে বলে, “আমি মোহকে নিয়ে যাচ্ছি। তুই জবাকে রুমে নিয়ে যা। ঠান্ডা লেগে যাবে।”
মোহ তাকায় জবার দিকে। সে তাদেরকেই দেখছিল। তাকে দেখে একটা বিজয়ের হাসি দেয় মোহ। এই খেলাটা শুরু করেছিল জবা। অথচ প্রতিযোগিতায় সে অংশগ্রহণই করে নি তাতে বিজয়ী হয়ে গেল। তার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার সমুদ্রের বুকে মুখ গুঁজে নেয়।

রুমে এসে বিছানায় নামায় তাকে সমুদ্র। দরজা বন্ধ করে ব্যাগ বের করল বিছানার নিচ থেকে। আর প্রশ্ন করল, “পানিতে কীভাবে পড়লে?”
“জবা আপু আমার হাত ধরে টান দিয়েছিল।”
উওর শুনে সমুদ্র তার দিকে তাকায় অবাক দৃষ্টিতে, “ও এমন কেন করবে?”
“হয়তো দেখতে চেয়েছে আপনি কাকে বাঁচান।”
সমুদ্র অনেকক্ষণ চুপ থাকলো এই কথায়। তারপর গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, “হয়তো তোমার ভুল হচ্ছে মধু। জবাকে আমি অনেক বছর ধরে চিনি। হয়তো পড়ে যাচ্ছিল বাঁচার জন্য তোমার হাত ধরেছে। তুমিও সাথে পড়ে গেছ।”
পরিবর্তে উওর দেয় না মোহ। সে বুঝে সমুদ্রকে এই নিয়ে প্রেশার দিয়ে কিছু বলা যাবে না। যেখানে সবাই তাকে বলে এসেছে জবা টাকার জন্য বিয়ে করেছে কারিমকে অথচ সে বিশ্বাস করতে নারাজ? তাহলে তার কথা বিশ্বাস করবে? করবে কী? সে এই ঝুঁকি নিলো না। তবে তাকে জানাল, “তার হাসবেন্ড আছে না?”
“কারিম?”
“হ্যাঁ, উনার কী সমস্যা?”
“কেন কী হয়েছে?”
“আমার সাথে বেয়াদবি করেছে। এখন না আজ সকালে।”
এই কথায় সমুদ্রের মেজাজ আরও বিগড়ে যায়। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মোহের দিকে, “আর তুমি এখন আমাকে জানাচ্ছো? তোমাকে বলেছি না আমাকে সাথে সাথে এসে এসব জানাবে? ওই শালার চরিত্রই খারাপ। ভার্সিটিতে থাকতে এই মেয়ে ছেড়ে ওই মেয়ের পিছনে পড়তো। জবার বাবা কী দেখে যে এমন ছেলে বাছাই করল ওর জন্য! বিয়ের পরও না’কি ওরে সামনে অন্য মেয়ের সাথে….” কথা বলতে বলতে চুপ হয়ে গেল সে। গভীর নিশ্বাস ফেলে, “এই নিয়ে কিছু বললে জবার উপর হাত তুলে।এখানে দেখো না কত বেয়াদবি করছে টাকার গরমে। যেভাবে অর্ডার দেয় যেন সবাই ওর চাকর। ওকে তো আমার জিন্দা কব’র দিতে মন চায়। কেবল ঈশা আর জবার জন্য চুপ থাকি। তোমাকে কী বলেছে তা বলো। তোমার সীমা অতিক্রম করলে ওকে ছাড়বো না আমি।”
মোহকে এই কথাটা ভাবায়। এখন কিছু হলে ঈশার বিয়েতে বড় এক ঝামেলা হবে। সমুদ্রের রাগ সম্পর্কে তো জানা আছে তার। একবার যদি বলে কারিম তার দিকে বদনজর দিয়েছে, তার হাত ধরেছে তাহলে একটা বিরাট বড় ঝামেলা হবে। আর আছে একদিনই তো। এরপর ওই লোকের সাথে তার দেখাও হবে না। তাই সে বলল, “বাদ দিন। ঝামেলা করার মতো তেমন কিছু বলে না৷ কিন্তু একটা কথা বলুন, ” মোহ বিছানায় পা তুলে হাঁটুতে মাথা রেখে প্রশ্ন করে, “জবা আপু আর আমার মাঝে আমাকে কেন বাঁচালেন?”

সমুদ্র তাকে দেখে একবার যাচাই করে। তারপর বলে, “এই ভেজা চুবচুবে অবস্থায় তোমার এই উওর শুনতে মন চাচ্ছে? যেয়ে জামা চেঞ্জ করে আসো।”
“বলুন না….প্লিজ।”
মোহের এমন নরম সুরের কথনে সমুদ্র সম্পূর্ণ গলে গেল। সে বসলো যেয়ে মোহের পাশে। তার পা’য়ে পরা নুপুর আলতো করে ছুঁয়ে বলল, “জানি না…তখন তোমাকে দেখে আমার মাথায় অন্যকিছুই আসছিল না। তোমার পাশে কে আমি তাও দেখতে পাড়ছিলাম না যেন। তোমাকে হারানোর একটুখানি খেয়ালেও আমার হৃদপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল।”
এতটুকু বলে সমুদ্র থামলো। আবার তাকাল মোহের দিকে। এবার তার হাতের চুড়িগুলো আলতো করে ছোঁয়াল, “এছাড়া জবা আমার জন্য যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, পরনারীকে আমি কখনো ছুঁই নি। আমাকে সম্পর্ক থাকাকালীনও ওর হাতটাই ধরেছিলাম কেবল। যদিও এখানে জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন ছিলো তাই ব্যাপারটা ভিন্ন। প্রয়োজন হলে তোমাকে বাঁচানোর পর আমি যেতাম। যেহেতু অন্যকেউ ছিলো সেহেতু আমার বাঁচানোর প্রশ্নই উঠে না। আর… ” সে খপ করে মোহের হাত ধরে তাকে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে।
আচমকা এমন কান্ডে মোহ চমকে উঠে। সে তাল সামলাতে না পেড়ে বিছানা থেকে পড়ে যেতে নিলে সমুদ্র তার ধরে নিজের কোলে বসিয়ে নেয়। তার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে, “আর তোমাকে আমি ছাড়া অন্যকেউ ছুঁবে এটা আমার সহ্য হবে না। তুমি একান্তই আমার। তোমার শরীর আর মন সবটা আমারই হতে পাড়বে।” সমুদ্র তার ভেজা পিঠে হাত রাখতেই কেঁপে উঠে মোহ। সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে বলে, “একতরফা চাইলেই কী হয় না’কি? দিতে হবে না?”
“কী লাগবে?”
“আপনার মন। সম্পূর্ণ আপনাকে লাগবে আমার।”
“লিখে নিতে চাও?”
মোহ তার কাঁধ থেকে মুখ তুলে বলে, “কাগজে আগের থেকেই আপনি আমার।”
সমুদ্রের দৃষ্টি আটকায় মোহের চোখে। চুলের থেকে পানি বয়ে তার চোখের পলকে আটকেছে। চোখের পলক বন্ধ করতেই সে বিন্দুটি গড়িয়ে পড়লো তার গালে, তার ঠোঁট ছুঁয়ে গেল আলতো করে। সমুদ্রের চোখ যেয়ে আটকাল তার ভেজা গলায়। বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে এখনো। তা দেখে এক ঢোক গিলল সমুদ্র। মোহের ঘাড়ে হাত রেখে ঠোঁটটা ছুঁয়ে দিলো তার ভেজা গলায়।
মোহের অন্তর কেঁপে উঠে তার এই কান্ডে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “কী…. কী করছেন?”
সমুদ্র উওর দেয় না। অন্যহাত দিয়ে জড়িয়ে তাকে আরও কাছে টেনে আনে। চুমুটা গভীর হয়ে উঠে।
আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয় মোহ। তার গলা জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।

এমন সময়ই দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। মোহ চকিতে চোখ খুলে বলে, “দরজায় কেউ এসেছে।”
“আসুক।”
“দরজা খুলতে হবে। সরুন।”
“বিরক্ত করো না মধু।”
আবারও নক পড়লো মোহ তাকে ঠেলে বলে, “দরজা খুলুন।”
সমুদ্র মুখ তুলে তাকায় বিরক্ত দৃষ্টিতে। তারপর খিটখিটে মেজাজে বলে, “এই শালার মানুষরাও আর আসার সময় পেলো না।”
“গালি দিবেন না আমার সামনে।”
“শালা গালি না। আর তোমার কোনো ভাই নাই তাই অফেন্ড হওয়ারও কিছু নাই।”
সমুদ্র মেজাজ খারাপ নিয়েই দরজা খুলল। দেখল ঈশা এসেছে। সে বিরক্তি নিয়ে বলল, “তোর হলুদ ছেড়ে এখানে কী?”
“মোহকে দেখতে এসেছি।”
“দেখা শেষ। তাহলে যা।”
সমুদ্র দরজা লাগাতে নিলে ঈশা তাকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে রুমের। মোহকে এখনো ভেজা শাড়িতে দেখে বল, “মোহ তুমি শাড়ি পাল্টাও নি এখনো? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”
“যাচ্ছিলাম আপু।”
“এতক্ষণ হয়ে গেছে তাও যাচ্ছিলে?”
সমুদ্র বলে, “ও পালটে নিবে তুই বের হো।”
“তুই এমন করছিস কেন আজব? আর তুই জামা পাল্টাচ্ছিস কেন?”
ঈশা আবার তাকায় মোহের দিকে। তার গলায় চোখ পড়ে তার। সে জিজ্ঞেস করে, “তোমার গলায় কী হয়েছে?”
মোহ সাথে সাথে হাত দিয়ে তার গলা ঢাকলো। তাকাল সমুদ্রের দিকে।
আমতা-আমতা করে বলল,”মশা কামড়ে দিয়েছিল।”
ঈশা প্রথমে কিছু না বুঝলেও মোহের রিয়েকশন দেখে সব বুঝে যায়। সে ঠোঁট টিপে হেসে জিজ্ঞেস করে, “মশাটা কী ছয়ফিটের ছিলো?” আর তাকায় সমুদ্রের দিকে।

সমুদ্র এবার নিজেও লজ্জিত অনুভব করল। তার মাথার চুল চুলকে বলল, “আমিও পোশাক পালটে আসি।” বলে ব্যাগ থেকে শার্ট প্যান্ট নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। বেরিয়ে এসে তাকাল মোহের দিকে। মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “তুমি চেঞ্জ করে নেও, আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসি।”
মোহ লজ্জামাখা মুখে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।
এই দেখে আরও মেজাজ খারাপ হলো সমুদ্রের। মেয়েটা তাকে বিরক্ত করতে চাইছে ইচ্ছা করে। সে নিশ্চিত। এমন লজ্জামাখা মুখ দেখে তার যেতে মন চায় বাহিরে?

দুইকাপ চা নিয়ে সমুদ্র উপরে যাচ্ছিল। সিঁড়িতেই তার সাথে দেখা হলো জবার। জবাকে দেখে সে জিজ্ঞেস করে নরম সুরে, “কী অবস্থা তোমার? ঠান্ডা লাগে নি তো? মধুকে এই চা দিয়ে তোমার খোঁজ নিতেই আসতাম।”
তবে জবাকে আজ খুশি দেখাল না। সবসময়ের তার ঠোঁটের হাসিটা আজ নেই। সে একপলক দেখল তার হাতের চা’য়ের কাপ।
সমুদ্র সাধলো, “তুমি এককাপ চা নেও। এই রাতে পানিতে পড়ে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
জবা চায়ের কাপ হাতে নিলো। সমুদ্রের দিকে চাইল হতাশাজনক দৃষ্টিতে। বলল, “একটু কথা বলতে পাড়বে? চলো ওদিকে দাঁড়াই।”
সমুদ্র রাজি হলো। জবার সাথে যেয়ে দাঁড়াল একটু সামনেই। জবা বলল, “তুমি এই চা’টা খাও। মনে আছে আমরা আগে প্রতিদিন একসাথে চা খেতাম।”
“এই চা মধুর জন্য। আবার বানাতে গেলে আধাঘন্টা লাগাবে লোকেরা। ওর ঠান্ডা লেগে যাবে।”
“অনেক খেয়াল রাখছো ওর।”
এই কথায় সমুদ্র খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেল, উওরে কী বলবে?
জবা আবার বলল, “মেয়েটা ভালোই মিষ্টি।”
“অনেক। একদম মধুর মতো। কেবল মাঝেমধ্যে বোম্বাই মরিচ হয়ে যায়৷” হাসে সমুদ্র কথাটা বলে।
জবা আড়চোখে তাকায় সমুদ্রের দিকে। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
সে তবুও নরমস্বরে বলল, “কিন্তু ওর বোধহয় আমাকে পছন্দ হয় নি।”
“এমন কেন মনে হলো তোমার?”
“সকালে আমি যেয়ে সেধে ওর সাথে কথা বলেছি। ও আমার দিকে তাকিয়েছেও কিন্তু উওর না দিয়ে চলে গেছে। আজ দুপুরে আমি যখন কথা বলছিলাম খুব রুষ্ট ব্যবহার করল। আর একটু আগে….”
সে তাকাল সমুদ্রের দিকে। ভাবলো সমুদ্র তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে কিন্তু সে করল না। সংকুচিত কপাল নিয়ে তাকিয়ে রইলো। তাই সে নিজেই বলল, “একটু আগে ও বোধহয় পড়ে যাচ্ছিল আমার হাত ধরে নিলো। আমরা পড়ে যাবার পর ও একবার এগিয়ে যেতে নিয়েও থেমে যায়। মনে হলো সাঁতার পাড়ে। তুমি তো জানো আমি সাঁতার পাড়ি না। পাড়লে ওকে নিয়ে আমিই উঠে আসতাম। হয়তো আমার ভুল হচ্ছে কিন্তু… ”
“তোমার ভুলই হচ্ছে।” সমুদ্র উওর দিলো কঠিন স্বরে।
জবা তার এমন কন্ঠ শুনে আকস্মিকতায় তাকায় তার দিকে। তারপর আবারও বলে, “তোমার ভুল হচ্ছে জবা। মধু অনেক ভালো মেয়ে। তোমাদের দুইজনের ভুল হচ্ছে।
একটু আগে মধুও বলল তুমি ওর হাত টান দিয়েছ। তোমাদের ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে আমি বুঝতে পেড়েছি। এসব কথা মাথা থেকে ঝেড়ে দেও। মধুর চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমি দিয়ে আসি।”

চলবে…

মেঘের খামে…
পর্ব ৪২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“বলছিস আমি প্রাপোজ করব সমুদ্রকে?” মোহ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মহুয়াকে।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মোহ তৈরি হয়েছিল। তারা কয়েকজন ঈশার সাথে পার্লারে যাবে। ঈশার বোন, দুইটা কাজিন ও সে। মোহ সাজগোজ সম্পর্কে ভালো জানে দেখে তাকে আগে থেকেই বলে রেখেছিল ঈশা। সে-ও সেখান থেকেই সেজেগুজে যাবে সেন্টারে। তাই শাড়িসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে উপরে যাচ্ছিল। এমন সময় মহুয়ার কল আসে। তার সাথে গল্প করতে করতে দোতলায় এসে লম্বা করিডরে দাঁড়ায়। বাহিরের ওয়েদার আজ ভালো। এখান থেকে দৃশ্য দেখে কথা বলাটা ভীষণ স্বস্থির মনে হলো তার। এমন সময়ই ক’দিনের সব ঘটনা শুনে মহুয়া বলল, “সব শুনে তো মনে হচ্ছে দুলুভাই তোর প্রেমে পড়ে গেছে। উনি বুঝতে পাড়ছে না তো কী হয়েছে? তুই তো বুঝতে পাড়ছিস। তার কেন আগে নিজের প্রেমের কথা স্বীকার করতে হবে? তুই স্বীকার কর। দুলুভাইকে কত ভালোবাসিস তা মন খুলে বলে দিবি। সে তোর জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ, তুই তার জন্য কী অনুভব করিস সব বলবি। যখন সে বুঝবে সে-ও তোর জন্য একইরকম অনুভব করে তখনই তার বুকের থাকা সব কুয়াশা সরে যাবে। এখানে তো হারানোর কিছু নেই। কেবল দুলুভাইয়ের ভালোবাসার স্বীকারোক্তি পাওয়ার আছে।”
“কিন্তু আমি আগে…”
“ব্রো এই যুগে ছেলে মেয়ে কী? মেয়েরা স্পেশে যাচ্ছে আর তুই তো প্রাপোজ করবি শুধু। আর এমনিই আজ দুলুভাইয়ের পছন্দের রঙের শাড়ি পরবি। বেচারা তো এমনিতেই ফিট হয়ে থাকবে। যখন দুর্বল থাকবে তখন সুযোগে ছক্কা মেরে দিস।”
মোহ হাসে তার কথায়। তাকিয়ে দেখে অপরপাশ থেকে কারিম আসছে। তাকে দেখেই মেজাজ চিটচিটে হয়ে গেল মোহের। সে মহুয়াকে বলল, “আচ্ছা জানু রাখি। তোকে পড়ে কল দিব।”
“শাড়ি পরে দুলুভাইয়ের সাথে ছবি তুলে তার শালীসাহেবাকে পাঠাবি।”
“আচ্ছা, পাঠাবো।”

কারিমকে আসতে দেখে চরম বিরক্তি নিয়ে মোহ চলে যেতে নিলেই কারিম দৌড়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে,
“আরে যাচ্ছেন কেন? একটু কথা বলতে এসেছি শুনুন তো।”
মোহ বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী সমস্যা?”
“আপনি।”
“ফালতু কথা বললে বয়সের চিন্তা বাদ দিয়ে একটা থাপ্পড় দিব গালে।”
“জানেন মেয়েদের উঁচু গলায় কথা বলাটা আমার কাছে চরম বিরক্তির কিন্তু আপনার এই রাগ আমার ভালো লেগেছে। আপনার নাচ আরও বেশি। এরথেকে বেশি সুন্দর লেগেছে আপনাকে ভেজা অবস্থায় দেখে। গতকাল মনে হচ্ছিল আসমান থেকে স্বয়ং অপ্সরা এসেছে স্বর্গ থেকে।”
মোহের ঘিন লেগে গেল তার কথা শুনে, “আপনার একথা মুখে আনতে জঘন্য লাগলো না?”
“মোটেও না। সকালে আপনাকে দেখে তাও সামলে নিয়েছিলাম নিজেকে কিন্তু রাতে ভেজা শরীরে আপনাকে দেখে আমার মাথা ঘুরে গেল। সারারাত ঘুম হয় নি আপনার জ্বালায়।”

মোহ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। পাড়লে এই মুহূর্তে লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে এখান থেকে ফেলে দেয়। সে রাগে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “সমুদ্র আপনাকে খু’ন করে ফেলবে একথা শুনলে।”
“আপনাকে একবার পেলে আমি খুন হতেও রাজি।”
মোহ কষিয়ে তার গালে এক থাপ্পড় মারল, “এরপর থেকে এই বিশ্রী মুখ দিয়ে আমার সাথে কথা বললে আমিই খু’ন করে ফেলবো তোকে।”
সে যেয়ে নিলে আবারও কারিম তার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের গালে হাত রেখে বলল, “আপনার নরম তুলতুলে হাত দিয়ে মারায় গালে না সোজা বুকে লেগেছে। ধন্যবাদ আপনার স্পর্শ দেওয়ার জন্য। এই স্পর্শ প্রতিদিন পাবার নেশা ধরে গেল। আপনি খারাপভাবে নেওয়ার আগে বলে দেই আপনার মতো সুন্দরীকে আমি হারামভাবে আপন করবোও না। আপনি একবার বলেন আমি জবাকে ছেড়ে আপনার কাছে এসে পড়বো।”

মোহ তো এবার হতভম্ব হয়ে পড়ে তার বেহায়ামি দেখে৷ সে কর্কশ গলায় জিজ্ঞাসা করে, “একদিনও হয় নি মেয়ে দেখে, এর জন্য আপনি আপনার স্ত্রীকে ছেড়ে দিবেন?”
“দিলাম। এমনিতেও ওকে আমার পছন্দ না।”
“তাহলে বিয়ে করেছেন কেন?”
“একটি বিশেষ কারণ আছে। তা আপনাকে পড়েও জানাতে পাড়ব। আপনি আগে আমার প্রস্তাবটি নিয়ে ভাবুন।”
মোহ ঘিনে তার থেকে চোখও সরিয়ে নিলো, “এমন ফালতু কথা আমার সামনে বললে ভালো হবে না। আমি বিবাহিত, মনে রাখুন।”
“তো আপনিও মনে রাখুন যে সমুদ্র থেকে আমি হাজারোগুণে ভালো। আপনাকে সুখে রাখার জন্য সক্ষম। সমুদ্র তো আমার সামনে কিছুই না। এই বাড়ি দেখছেন এটা আমার বাবার নামে হয়েছে ক’দিন আগেই। চট্টগ্রামে আমাদের অনেক বাড়ি আছে। ভাড়া দেওয়া। দোকান আছে অনেকগুলো। ঢাকায় চারটা বাড়ি আছে। ব্যবসা আছে নিজস্ব। আর সমুদ্রের কী আছে? একটা স্টার্টআপ যা ও একটা গেইম বানিয়েই সরে গেছে। আমার সম্পত্তির একবিন্দুও নেই ওর কাছে।”
“ভুল বললেন। আপনার না, আপনার বাবার। আর যা আপনার না তা নিজের দাবি করবেনও না। রইলো জায়গা সম্পত্তির কথা? আপনার থেকেও বড়লোক ঘরের বিয়ে এসেছে আমার জন্য। কিন্তু আমার এই দালানকোঠা থেকে মানুষটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই মানুষটা সমুদ্র। আমি বিয়ের আগে অর্থে গলিনি, বিয়ের পর এসব দেখে গলে যাব? এমন অর্থ আমার স্বামীর সাথে মিলে অনেক কামাতে পাড়বো। কিন্তু আপনার মতো পুরুষ স্বামী হিসেবে পেলে সে পোড়া কপাল ফেরাতে পাড়ব না। যে ব্যক্তি এখন স্ত্রীর সামনে অন্য মেয়ের হাত হাত ধরতে বাজে কথা বলতে পাড়ে, সে পড়ে আবারও পাড়বে। এই’যে আপনি একদিনে আমার রূপ দেখে গলে গেলেন দু’দিন পর আমার সৌন্দর্য আপনার কাছে ফিকে লাগবে। অন্যকারো সৌন্দর্য হবে চোখে ধাঁধানো। কিন্তু জানেন সমুদ্র এতমাসে আমার সৌন্দর্যে গলে নি। সে গলেছে তার মধুর জন্য। আমার রূপ না, সম্পূর্ণ আমাকে মনে এঁকেছে। এরপর উনার কাছে আমার রূপ ভালো লেগেছে। এমন পুরুষ ছেড়ে আমি আপনার মতো চরিত্রহীন লোকের কাছে যাব? আমি এখনো সুস্থ আছি মানসিক ভাবে। নিজের হতজ্ঞান হারাই নি।”
এবারও সে চলে যেতে নিলো। তখন কারিম জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু ও যে অন্যকারো প্রেমে পাগল তার কী করবেন? তার মন তো অন্যকারো দখলে। এমন পুরুষ দিয়ে কী করবেন যে অন্যকাওকে ভালোবাসে? আমি তো অন্তত আপনার রূপের সাধনা করলাম।”
তাচ্ছিল্য হাসে মোহ, “একথা বলে আমাদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝির বাঁধানোর চেষ্টা করেও লাভ নেই। আমি এতও বোকা নই। গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত উনাকে যত দেখেছেন, মনে হয়েছে আমি উনার মনে নেই? জানি না উনার মনে আমার জায়গা কতটুকু, কিন্তু সারাজীবন তো আছে। সে মন সম্পূর্ণ আমার দখলে হবে।”
মোহ এবার মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে শুরু করে। আর পিছু ফিরে তাকায় না।
.
.
মহুয়া ড্রইংরুমে বসে কার্টুন দেখছিল। এমন সময় কলিংবেল বাজে। বাসায় কেউ নেই সে আর মলিকা খালা ছাড়া। খালা দরজা খুলে মহুয়াকে বলে, “মামণি তোমার মেহমান আইসে।”
মহুয়া অবাক হয় কথাটা শুনে। তার মেহমান? সে সাথে সাথে তার কার্টুনের চ্যানেল পালটে তাদের ভেতরে আনতে বলে। মহুয়া দেখে পূর্ণি ও জিনি এসেছে। পূর্ণিকে দেখে সে স্বাভাবিক থাকলেও জিনিকে দেখে সে অবাক হয়। যে জিনি তাকে দেখেই রেগে আগুন হয়ে যেত সে এখানে কী করে?

দুইজনই এসে তার দুইপাশে বসে। সে তো এই কথোপকথনের জন্য তৈরিই ছিলো না। কিন্তু জিনি এসেই সরাসরি এই প্রশ্ন করে, “আপু তুমি সত্যি বলো, তুমি জাহান ভাইকে ভালোবাসো না?”
“হেঁ?” মহুয়া তাও আকাশ থেকে পড়ে সরাসরি এই প্রশ্ন শুনে। তখন পূর্ণিও বলে, “না মহুয়া আপু আমার শায়ান ভাইয়াকে ভালোবাসে। আপি কেবল আমারই ভাবি হবে।”
“দুইজন থামবে। কী হয়েছে তা বলো? আর…” সে তাকায় জিনির দিকে, “তোমার হঠাৎ আমার উপর এত প্রেম উথলে পড়ছে কেন?”

জিনি তার হাত ধরে ঘেঁষে বসে তার পাশে, “আপি আগের জন্য সরি। আমি না ভেবেছিলাম তুমি টু টাইমিং করছো। আমি শুনেছিলাম তুমি তিসান ভাইয়ার সাথে রিলেশনে আছো। এজন্যই তোমার সাথে সেদিন খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। তারপর তোমাকে ভাইয়ার সাথে দেখলাম। ভুল ভেবেছিলাম। সেদিন যখন শায়ান ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ের কথা শুনে ভাইয়াকে বললাম তারপর তিসান ভাইয়া সব ভুল বুঝাবুঝি ক্লিয়ার করল। আমার ভাই প্রথম কারো প্রেমে পড়েছে। আমি সাপোর্ট করব না? আমি তো জানপ্রাণ দিয়ে তোমাকে ভাবি মেনে নিয়েছি।”
“মগের মুলুক না’কি? আমি হাওয়া থেকে এসে জুড়ে বসেছি? আমি তো প্রথম দেখায় আপিকে ভাবি মেনে নিয়েছি। ভাবি এট ফার্স্ট সাইট। সো আপির উপর আগে অধিকার আমার।”
“শায়ান ভাই তো ক্যান্সেল। বিয়ে ক্যান্সেল তোর ভাবি হওয়ার লাইসেন্সও ক্যান্সেল। মহুয়া ভাবি তো কেবল আমার জাহান ভাইয়েরই বউ হবে।”
“জ্বি না। পাঁচ বছর পর ভাবি বাছাই করবে। শায়ান ভাইয়েরও চান্স আছে।”
“কচু আছে।” তারপর সে ধরল মহুয়াকে, “আপু তুমি বলো কাকে পছন্দ করো তুমি? জাহান ভাইকে না শায়ান ভাইকে?”
“হঠাৎ করে এই প্রশ্নের উওর আমি কীভাবে… ”
পূর্ণিও তাকে চেপে বসলো, “তোমার বলতেই হবে আপি। আজ কোচিং এ গেছি হঠাৎ করে এই জিনির বাচ্চা তোমাকে ভাবি ডেকে বসে। এর উপর কত বড় সাহস হলে বলে জাহান ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে। আর জাহান ভাই নিজের ভালোবাসা আদায় করেই ছাড়ে।”
“তো ভুল কী বলেছি?” জিনি বসে এবার পা’য়ের উপর পা তুলে। ভাব নিয়ে বলে, “আমার ভাই সেরা। জীবনে কেবল একজনকে ভালোবাসবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। যখন মহুয়া ভাবিকে ভালোবেসেছে তখন ভাবি তারই হবে। আমার মা বাবার ভালোবাসার গভীরত্ব দেখেছিস? আমার মা আমার বাবাকে তার ভালোবাসা স্বীকার করিয়েই ছেড়েছে। আমার আর আমার ভাইয়ের মধ্যে একই রক্ত আছে। আমরা এত সহজে পিছিয়ে যাব না’কি?”
পূর্ণি তার দিকে তাকায় সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে, “জাহান ভাইয়ার কথা তো বুঝলাম। তুই আবার কার থেকে ভালোবাসা স্বীকার করাবি?”
মহুয়া নির্বিকারে উওর দেয়, “কেন? আমার ব্রোফ্রেন্ড থেকে। মানে তিসান।”
“কী!” পূর্ণি চেঁচিয়ে উঠে, “তুই তিসান ভাইকে পছন্দ করিস?”
“তুই আজ জানলি?” জিনি সত্যিই অবাক হয়।
“তুমি জানতে না। আমিও একথা জানি।” মহুয়া বলে।
“আমি কোন দুনিয়ায় থাকি?” পূর্ণির সুরে হতাশা স্পষ্ট। পরক্ষণেই সে তার নিরাশা দূর করে বলল, “তুমি আগে বলো তুমি কাকে পছন্দ করো?”
মহুয়া উওর দিতে চায় না তখনই। সে এত জলদিই নিজের মনের কোণে লুকানো অনুভূতি কাওকে প্রকাশ করতে চায় না। অন্তত যার প্রতি তার এই অনুভূতি জেগে উঠছে তার আগে তো একটুও না।

এরই মাঝে পূর্ণি আবারও জিনিকে বলে, “তুই না রশ্মি আপুকে ভাবি বানানোর জন্য লাফাচ্ছিলি? তাহলে তাকে নিয়েই থাক না। আমার ভাবির দিকে নজর দিচ্ছিস কেন?”
“জাহান ভাইয়ের মন যেদিকে আমি সেদিকে।”
মহুয়া পা তুলে বসলো সোফায়। তাকাল জিনির দিকে, “আচ্ছা আমি না একটু একটু গল্প শুনেছি রশ্মীর। কিন্তু সে কেমন আজও জানলাম না।”
“রশ্মি আপু? আপু তো অনেক ভালো।”
“অনেক বেশি ভালো।” পূর্ণিও তাল মিলিয়ে বলে।
জিনি আবারও বলে, “দেখতেও বেশ সুন্দরী। কোনো রাস্তা দিয়ে গেলে সেখানে ছেলে হোক বা মেয়ে একবার ফিরে তাকাবেই এমন সুন্দর। আর ব্যবহারও ভালো। আমাদের বোনের মতো আদর করতো সবসময়।”
“ভাইয়ারা আমাদের বকলে আপু সবসময় আমাদের সাইড নিতো।” পূর্ণি আবারও বলল।
“কিন্তু সে এক ভুলে…” গভীর নিশ্বাস ফেলে জিনি। মগুয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “কাহিনীটা শুনেছিলে? যে কারণে ভাইয়াদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেছে?”
“শুনেছি।”
“আমি না আজ পর্যন্ত বুঝতে পাড়ি নি আপু কেন এমনটা করল! আপুকে সবাই ভালোবাসতো। সবার চোখের মধ্যমণি ছিলো। তার পরিবারের জান বাস করতো তার মধ্যে। তার রাগ, জেদ তেমন ছিলো না কখনো। এত সম্পত্তি থাকার পরও, এত আদরে বড় হবার পরও কখনো আংকেল আন্টির কাছে নিজের মুখ ফুটে কিছু চায় নি। কেবল একমাত্র জাহান ভাইকে ছাড়া। যদি আপুর কোনো জেদ থাকে তা হলো জাহান ভাই। তার জীবনের একমাত্র জেদ। একমাত্র চাওয়া।”
“এই চাওয়াটা যে হারিয়ে ফেলল, এখন?”
জিনি একটু সময় নেয় উওরের জন্য, “সত্যি বলতে জানি না। আপুর সাথে তেমন যোগাযোগ হয় না। একমাস আগে কথা হয়েছিল। বলেছিল আপু বাংলাদেশে আসবে। এতটুকুই জানি।”
.
.
সমুদ্রের দায়িত্বে পড়লো ঈশাদের পার্লার থেকে নিয়ে আসার। সকাল থেকে কাজ করে সে ভীষণ ক্লান্ত। এখনো খাওয়ারও সময় পায় নি। মাথা ব্যাথা সে কখন থেকে। ঈশাদের সেন্টারে পৌঁছে দিয়ে সে প্রথমে বাড়িতে যেয়ে জামা পালটে সেন্টারে এসে খাবে ইচ্ছামতো, নাহলে তার মাথা আর কাজ করবে না। সে দেখলো ঈশার বোন আর কাজিন এসেছে কিন্তু ঈশা ও মোহ আসে নি। সে বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে রিসাকে, “এতক্ষণ লাগে রমনী? আমিই তো দাঁড়িয়ে আছি এখানে আধা ঘন্টা ধরে। ওইদিকে তুষার ভাইয়ারা বের হয়ে গেছে। তোর শাঁকচুন্নিমার্কা বোন সিঙ্গেল ফটোস্যুট করবে কখন, আর কাপল করবে কখন? তারপর আমাদের মাথা খাবে।”
“আমার বোন আজ পরী সেজেছে ভাইয়া।”
“এহ! ওইটা শাঁকচুন্নি, শাঁকচুন্নিই থাকবে।”
“আমার বোন নাহয় শাঁকচুন্নিই থাকবে। তোমার বউকে যে সাজিয়েছে তাকে তো পরী লাগছে। হার্ট অ্যাটাক করবে না তো আবার?”
সে ইশারা দিকে বলে সামনে তাকাতে। সে দেখে মোহ ঈশার লেহেঙ্গা ঠিক করে দিচ্ছে ও তাকে নিয়ে আসছে। ঈশাকে যেন তার চোখেই পড়লো না। কেবল ঈশাকে কেন, আশেপাশের সব তার কাছে ধোঁয়াশা লাগছিল। তার চোখে ভাসছিল কেবল তার মধুকে।

কালো শাড়ীতে সাদা রঙের স্টোনের কাজ করা একটি শাড়ি পরেছে। সাথে কানে, গলায়,হাতে সাদা স্টোনের গয়না পরা। মুখে প্রসাধনী মাখা ও চুলগুলো কার্ল করা।
তাকে দেখে নিশ্বাস আটকে উপক্রম হলো সমুদ্রের। সে বুকের বাঁপাশে হাত রাখল নিজ অজান্তেই। পাশ থেকে রিসা ঠোঁট টিপে হাসল, “কী ভাইয়া আসলেই কী হার্ট অ্যাটাক এলো না’কি?”
“ঘনিয়ে আসছে মনে হচ্ছে। আরেকটু দেখলে ফুল এসে পড়বে।”
রিসা তার চোখের সামনে হাত রেখে তখন বলল, “থাক পুরো হার্ট অ্যাটাক করার দরকার নেই। দেখো না তাহলে।”
সমুদ্র তার হাত সরিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, “না দেখলে নিশ্বাস আটকে মরে যাবো।”
রিসা হাসে তার কথায়, “ভাইয়া তুমি তো ভাবির প্রেমে পুরো পাগল হয়ে গেছো।”
একথায় সমুদ্র অবাক দৃষ্টিতে তাকায় রিসার দিকে। সে মোহের প্রেমে পড়েছে?

ঈশা এসেই তাকে তাড়া দেয়, “এই জলদি চল। দেরি হয়ে গেছে। ফটোগ্রাফারটা আবার ক্যাচক্যাচ করবে।”
“নিজে এত দেরি করে এসে আমাকে বলিছিস? এত সময় লাগলো কেন তোর? লাগছে তো ওই শাঁকচুন্নিই।”
“লেহেঙ্গা ভারী বলে, নাহলে জুতা দিয়ে পিটাতাম তোকে। এই বৃষ্টি দরজা খুল।”
সমুদ্র তাকাল মোহের দিয়ে। মোহ ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে, তাকে কেমন লাগছে?
সমুদ্রের চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস ফেলে মোহের দিকে তাকিয়ে বলে, “এই ঈশা শুন…”
“বল।”
“তুই একটু গাড়িটা চালাতে পাড়বি?”
“আমি এই বিশ কেজির লেহেঙ্গা পরে গাড়ি চালাব? মাথা কী গেছে তোর?”
“কাওকে দেখে আমার হার্ট ফেল হয়ে যাচ্ছে ব্রেক ফেইল করলে তুই আর বিয়ের অবস্থায় থাকবি না।”
মোহ লজ্জায় মুখ নামিয়ে গাড়িতে যেয়ে বসে।

সমুদ্রও গাড়িতে উঠে। সারারাস্তা বারবার তার বেহায়া চোখ যায় কেবল তার মধুর দিকেই। মোহও একটু পর পর তাকাচ্ছিল তার দিকে।

সমুদ্র সেন্টারের সামনে এসে ঈশাদের বলল, “তোরা যা। আমি বাড়ি থেকে চেঞ্জ করে আসি। আন্টি বলেছিল আরও কিছু জিনিস আনতে হবে।”
মোহও নামতে নিলে সমুদ্র তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কোথায় যাচ্ছো? তুমি আমার সাথে বাড়িতে যাবে।”
“আমি তো সব এনেছি।”
“আমার স্যুট কোথায় রেখেছ তা আমি কীভাবে জানবো?”
“আপনার ব্যাগেই আছে। আপনিই রেখেছিলেন।”
ঈশা মিটিমিটি করে হাসে, “আরে মধু যাও না। এমন করছো কেন? তোমার স্বামী বউকে একটু মন ভরে দেখতে চায় একাকী।”
.
.
বাড়িতে এসেই রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে নেয় সমুদ্র। মোহকে দরজার সাথে চেপে ধরে তার একপাশে হাত রেখে বলে, “আজ কী আমায় খু’ন করার মতলব আছে তোমার?”
মোহ লজ্জামাখো দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “কেন আপনাকে তো সুস্থই দেখা যাচ্ছে।”
সে কাজলমাখা চোখে চোখ রেখে নিশ্বাস আটকে এলো সমুদ্রের। সে একহাত দিয়ে মোহের আঙুলের মাঝে আঙুল ডুবিয়ে তার কাঁধে নাক ঘেঁষে গভীর নিশ্বাস নেয়। সাথেই মোহের দেহে কম্পন সৃষ্টি হয়। সে চোখ বুঝে নেয় আবেশে।
“আমার মন যে অসুস্থ সে খবর রাখো?” সমুদ্র তার কাঁধে চুমু খেতে করে। এক পর্যায়ে মোহ থামায় তাকে, “শুনেন…”
সমুদ্র শুনলো না। সে উলটো তার শাড়ির পিছনে তার উন্মুক্ত পেটে হাত রেখে নিজের দিকে টেনে জড়িয়ে ধরে। তার কাঁধে নাক ঘেঁষে মাতালো স্বরে বলে, “মধু, তোমার সম্মতি হলে কী আমরা আমাদের সম্পর্কে এগোতে পাড়ি? আমি তোমার সাথে আমার পরিবার চাই। আমাদের সন্তান চাই। বাচ্চা তোমার গ্রাজুয়েশনের পর নিলেও তোমার ইচ্ছা। কিন্তু আমি সম্পূর্ণ তোমাকে নিজের করতে চাই। তোমাকে দেখতেই আজকাল।তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে হয়। এক মুহূর্তের জন্য তোমার আমার দূরত্ব থাকলে তোমায় দেখার অপেক্ষায় থাকি। তোমাকে কাছে পাওয়ার তোমাকে এই বুকের মাঝে নেওয়ার অপেক্ষায় থাকি। কী হচ্ছে আমার সাথে এসব মধু?”
মোহ মৃদু হাসে, “আপনি তা জানেন, কিন্তু মানতে চাচ্ছেন না।”
সমুদ্র তাকে ছেড়ে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। মোহ হেসে তার গালে হাত রেখে বলে, “দ্রুত তৈরি হয়ে নিন, ওদিকে বিয়ে শুরু হয়ে যায়। আমি রাব্বির কাকাকে বলে জিনিসপত্র গাড়িতে রাখিয়ে দিচ্ছি।
সে যেতে নিলে সমুদ্র তার হাত ধরে নেয়, ” উওর দিলে না।”
“কীসের উওর?”
সমুদ্র তার কাছে এসে তার গালে হাত রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো আলতোভাবে, “তোমাকে কাছে পাওয়ার, সম্পূর্ণভাবে।”
মোহ তার কথা বুঝল, কিন্তু ভান করল না বুঝার, “আমি তো আপনারই বউ। সম্পূর্ণভাবে।”
“তাই? বুঝো নি?”
“না-তো।”
সমুদ্র তার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলে, “আমি বলতে চাচ্ছি আর ঈশা ও তুষার ভাইয়ের বিয়ে হলেও আমরা আমাদের বাসর সেরে ফেলছে পাড়ি।”
মোহ তার ঠোঁটকাটা কথা শুনে সে কাজল মাখা চোখ নিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকায় তার দিকে। তার গালদুটো লাল হয়ে যায় সম্পূর্ণ। সে লজ্জায় চোখ নামিয়ে মিনমিনে সুরে বলে, “আপনি তৈরি হয়ে আসুন। আমি গাড়ির কাছে থাকবো।”
সে দরজা খুলে বেরোতে নিলে সমুদ্র জিজ্ঞাসা করল, “এই লজ্জাকে কি সম্মতি মানবো?”
“এমনিতেও আজ আপনাকে বিশেষ কথা জানানোর আছে।”
“আর তা কী?”
“তা নাহয় পরেই জানলেন। আর শুনুন, কালো স্যুটটা পড়বেন। আমার শ্যামসুন্দর স্বামীকে খুবই সুদর্শন লাগে কালো রঙে। ” বলে নিজেই লজ্জা পেয়ে বেরিয়ে গেল।
.
.
সেন্টারে কারিম ও জবা তাদের বন্ধু ও কাজিনদের সাথে কথা বলছিল। এর মধ্যেই একজন বলে, “ভাই ওটা সমুদ্র আর তার বউ না?”
এই কথা কানে যেতেই সকলে তাদের দিকে তাকায়। মোহকে দেখে তো কারিম হা করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এতদিন এমনিই বললেও আজ সত্যি মনে হচ্ছে কোনো অপ্সরা আসমান থেকে নেমে এসেছে। এই মেয়ে তা পাগল করেই ছাড়বে। এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্য দেখে কার মাথা ঠিক থাকে? এর উপর আজ মেয়েটা তাকে প্রত্যাখ্যান করল। তার এত সম্পত্তির কথা শুনেও। এরপর কেবল মেয়েটা তার চোখেই না মাথায়ও ধরে গেল। এখন তো মেয়েটাকে তার লাগবেই।
তাদের একটা বন্ধু বলল, “ভাই সমুদ্রের কী ভাগ্য রে! কী একটা বউ পাইসে!”
“একদম। এই সমুদ্র না বলতো তার রূপরঙে কিছু আসে যায় না তাই এই পরীকে বিয়ে করছে কেমনে?”
তার কথায় প্রথমজন তাকে খোঁচা মেরে দেখায় জবা আর কারিমকে।
কারিম তো রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় জবার দিকে তারপর সেখান থেকে চলে যায়। জবাও যায় তার পিছনে।

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। তুষাররা এসেছে। কাজিও এসে বসেছে তাদের বিয়ে পড়ানোর জন্য। সমুদ্রসহ তার বন্ধুরা তো অনেক মজা নেয় তাদের নিয়ে।
বিয়ে পড়ানো হতেই সবাই হৈ-হুল্লোড় শুরু করলো।
কবুল বলার পর সবাই একে অপরকে অভিনন্দন জানাল। ঈশার মা খেজুর খুঁজতে এলো সমুদ্রের কাছে। সমুদ্র ও লামিন দুই ছোট বাক্স খেজুর নিয়ে আসলো। তারপর তাদের মনে পড়ল তারা আয়না তো রেখেই এসেছে গাড়িতে। সমুদ্র মোহকে বলল, “মধু একটু গাড়ি থেকে আয়না নিয়ে আসবে? আয়নাতে দেখে জিজ্ঞেস করতে হবে না তারা কী দেখছে? মজা তো নিতে হবে একটু আয়না আনতে ভুলে গেছি।”
মোহ চাবি নিয়ে গেল সেদিকে।
তাকে যেতে দেখে কারিমও। সে তার পিছু নেয়।

গাড়ির পিছনের সিটে আয়না রাখা। মোহ তা নিয়ে পিছনে ফিরতেই দেখে কারিমকে। হঠাৎ এত কাছে দেখে ভয়ে শব্দ করে পিছিয়েই যায়। গভীর নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে প্রথমে তারপর রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় কারিমের দিকে, “আপনাকে না বলেছি আমার সামনে আসবেন না?”
তারপর আর কথা বাড়ানোর ইচ্ছা হয় না তার। সে চলে যেতে নিলে কারিম গাড়িতে হাত রেখে তার পথ আটকায়। মোহ কপাল সংকুচিত করে, “কী করছেন আপনি? সকালের থাপ্পড় ভুলে গেছেন?”
“উঁহু, ভুলিনি। সে থাপ্পড় আমাকে প্রতিমুহূর্ত আপনার কথা মনে করিয়েছে।”
মোহ তার কথা পাত্তা না দিয়ে অন্যদিক থেকে যেতে নিলে কারিম অন্যহাতও রাখে তার অপরপাশে।

এবার মোহ চরমভাবে ভয় পায়। সে ভীত দৃষ্টিতে তাকায় কারিমের দিকে। তার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। সে চিৎকার করলে কী ভেতরে শোনা যাবে? সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পায় জবা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখ মিলতেই জবা উল্টো পথে হাঁটা শুরু করে। মোহ উঁচু স্বরে তাকে ডাজে, “জবা তোমার হাজবেন্ডকে বলো আমার সাথে কোনোরকম বেয়াদবি না করতে। সমুদ্র তাকে ছাড়বে না।”
কিন্তু জবা দাঁড়ায় না। সে আরও তিন-চারবার ডাক দেয় তাকে। সে না থামায় এবার সে কারিমের দিকে তাকায়। সে ভয়ে কাঁপছিল। চোখ সিক্ত হয়ে গেছে তবুও জোর গলায় বলে, “সমুদ্র জানলে তোমায় জ্যান্ত ক’বর দিবে।”
কারিম তাচ্ছিল্য হাসল, “তাকে আমি দেখে নিবো। তুমি ভাবো অন্য পুরুষ ছোঁয়ার সে তোমায় চাইবে? দোষ তো তোমারই, এমন অপরূপ সুন্দরী হলে কোন পুরুষের নিয়ত ঠিক থাকে বলো?”
হঠাৎ মোহ অনুভব করল তার পেটে পুরুষালী হাত। যা তার পেট থেকে পিঠের দিকে উঠছিল।

মোহের সম্পূর্ণ শরীর ঘিনঘিন করে উঠে। তার নিশ্বাস আটকে যায়। সম্পূর্ণ দেহ স্তব্ধ হয়ে যায়। মঅনে হচ্ছে তার সারা দেহ ঝলসে যাচ্ছে। সে জোরে এক চিৎকার দিয়ে তার হাতের আয়নাটা মারলো কারিমের উপর। সাথে সাথে কারিম পিছিয়ে গেল। তার ঘাড়ে কাঁচ লেগে কেটে গেছে। র’ক্ত পড়লো বোধহয়। সেদিকে খেয়াল নেই মোহের। সে এক দৌড়ে দিলো সেন্টারের ভেতর।

চিৎকার শুনে বোধহয় জবা আবার ফিরছিলো। তাকে দেখে কিছু মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়াল। মোহ তার সামনে এসে তাকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার ভেতরের দিকে এগোল। তার চোখে সে ক্রোধ না অগ্নি ভাসছে। জবা তার দৃষ্টি দেখে একবার ভয় পেল। তারপর দ্রুত গেল তার পিছনে। তাকে ধরে বলল, “মোহ আমার কথা শুনো।”

মোহ ক্ষেপে যায় তার কন্ঠ শুনেও, “আমি তখন কত ডেকেছিলাম শুনেছিলে? এক নারী হয়ে অন্য নারীর সম্মানহানি কীভাবে দেখতে পাড়ো তুমি? তাও তোমার স্বামী! নিজের স্বামীকে অন্য নারীর কাছে দেখতে তোমার সহ্য হয় কী?”
মোহ তার হাত ঝেড়ে সামনে এগোয়। জবাও তার পিছনে আসতে আসতে বলে, “প্লিজ সমুদ্রকে কিছু বলো না। দেখো সবাই কত খুশি। ঝামেলা পাকিও না।”
মোহ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় জবার দিকে। কিন্তু ঘিন নিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। ভেতরে ঢুকেছে। সমুদ্রকে খুঁজছে সে। জবা তখন আবার বলে, “দেখো কারিম নেশায় ছিলো বোধহয়। পুরুষ মানুষ আধ একটু দোষ করেই।”
মোহ থেমে যায়। এবার সত্যিই জবার দিকে তাকায় বিস্ময়ের সব সীমানা ছাড়িয়ে।
জবা তার কথার সাথে যোগ করে, “এছাড়া তোমার প্রথম অভিজ্ঞতা এমনও না। ঠিক তারও দোষ নেই। এই সৌন্দর্য দিয়ে কত ছেলেকে ভুলিয়ে তাদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছো কে জানে? এমন বলো যে এই প্রথম কোনো পুরুষ তোমাকে…”
কথা শেষ হবার আগেই মোহ তার গালে কষিয়ে একটা চড় মারলো।

মুহূর্তে আশেপাশের সব স্থির হয়ে যায়। আশেপাশে লোকেরা তাদের দিকে তাকালো সব ভুলে। সমুদ্র ছিলো ঈশা ও তুষারের পাশে। হঠাৎ কি হলো দেখার জন্য সে নিচে নামলো। দেখলো মোহ ও জবা দাঁড়িয়ে আছে। জবার গালে হাত। সে দ্রুত গেল তার পাশে। তাদের পিছনে নামলো বর বধূ আর সবাইও। তারাও দেখতে নামলো হঠাৎ কী হলো যে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে।

সমুদ্র এসে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে এখানে?”
মোহ কিছু বলার আগেই জবা তাকে সুযোগ দেয় না। এই সুযোগ তার ব্যবহার করতেই হবে। সে দ্রুত যেয়ে সমুদ্রের হাত ধরে বলে, “সমুদ্র তোমাকে আমি বলেছিলাম না মোহ আমাকে পছন্দ করে না। এই দুইদিন আমাকে অপমান করেছে আমি মেনে নিয়েছি। কতকিছু তোমাকে বলিও নি। কিন্তু আজ আমায় থাপ্পড় পর্যন্ত দিলো।”
সমুদ্র অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় মোহের দিকে, “তুমি ওর উপর হাত তুলেছ মধু?”
পাশ থেকে এক মেয়ে বলল, “হ্যাঁ আমি দেখেছি। এই মেয়েটাই থাপ্পড় মেরেছে।”
সমুদ্র জবার হাত সরিয়ে মোহের সামনে এসে দাঁড়ায়, “তাহলে কী জবা গতকাল সত্যি বলেছিল?”
“উনি কি বলেছে আমি জানি না কিন্তু উনি এই থাপ্পড় ডিভার্ভ করতো। লআগলে আরও দশটা থাপ্পড় দিবো। উনার মতো জঘন্য মহিলা আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। উনি কী করেছে জানেন? উনি…”
“মোহ!” সমুদ্র উঁচু স্বরে তার সাথে কথা বলে তাকে থামায়। মোহ অবাক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। আজ পর্যন্ত সমুদ্র তাকে মধু ছাড়া ডাক দেয় নি। আজ এই প্রথম তাকে মোহ বলে ডাকল সে। এই ডাক শুনেই যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কেবল যেন একটা নাম এভাবে ডাকে নি সে, সাথে প্রমাণ দিয়েছে যে সমুদ্র তার আগে জবাকে বিশ্বাস করেছে।

সমুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “জবা আমাকে গতকাল থেকে বলছে তুমি ওকে ইগনোর করেছ। গতকাল না’কি তুমি ওর হাত ধরেছিল পড়ে যাবার সময়। আমি বিশ্বাস করিনি। আজ তুমি ওকে থাপ্পড় মারলে। এটা কীভাবে অবিশ্বাস করবো আমি?”
মোহ কাঁপানো সুরে কেবল একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে , “আমি মধু থেকে মোহ হয়ে গেলাম?”
“কারণ আমার মধু এত জঘন্য কাজ করতে পাড়ে না।”
“মানে আপনি ওর কথা বিশ্বাস করেছেন? আমি যখন বলেছিলাম উনি আমাকে টান দিয়েছে পানিতে তখন তো বলেছিলেন…”
“বলেছি, এক কথা ওকেও বলেছি। কিন্তু তুমি যে এখন এই কাজটা করলে সে আমি কীভাবে না দেখে থাকি? তুমি কী জ্বেলাসিতে ওর সাথে এমন করেছ? সরি বলো ওকে। রাইট নাউ।”
মোহের কন্ঠও এবার উঁচু হয়, “আপনি ওর জন্য আমাকে প্রশ্ন করছেন? আমার বিচার করার জন্য? আমাকে অবিশ্বাস করছেন এই মেয়ের জন্য যে আপনার বিশ্বাস ভেঙেছে? এটাই সেই মেয়ে যে আপনাকে টাকার জন্য ছেড়ে অন্য ছেলের কাছে গিয়েছিল। এমন নিচু মনের, জঘন্য, লোভী মেয়ের জন্য আপনি আমাকে….”
“মধু…!” সমুদ্র হঠাৎ হাত উঠিয়ে নেয় রাগে অন্ধ হয়ে। তারপর হঠাৎ-ই থেমে যায়। নিজের এই কান্ডে হতভম্ব হয়ে যায় নিজেও। সাথে তার সব বন্ধুরাও। তারা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সমুদ্রের।

মোহ সমুদ্রের হাতের দিকে তাকায়। তার চোখ ভরে আসে জলে। কিন্তু তবুও তাচ্ছিল্য হাসে সে। সে গভীর এক নিশ্বাস নেয় বহু কষ্টে। যেন এতক্ষণ সে নিশ্বাস আটকে ছিলো। তারপর হেসে সমুদ্রকে বলে, “আপনাকে বলেছিলাম না আজ এক বিশেষ কথা বলতাম আপনাকে? আপনার কাছে আমার ভালোবাসার স্বীকারোক্তি করতাম। না চেয়েও আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম বিন্দু বিন্দু করে অথচ এক মুহূর্তে আমার হৃদয়ের সব অনুভূতি মুছে গেল। যেখানে আমি নিজের সম্মানের বিচারের দাবিতে আপনার কাছে এসেছিলাম সেখানে ভরা মহলে আপনিই আমাকে অসম্মান করলেন আজ।”
“না মধু….” সমুদ্র এগিয়ে তার হাত ধরতে গেলে মোহ পিছিয়ে যায়। তার দিকে তাকিয়েই শক্ত গলায় বলে, “মোহ। মধুরা মোহ। একটু আগেই ডেকেছিলেন, এত জলদি ভোলার কথা নয়।”

মোহের চোখে জল দেখে বুক কেঁপে উঠে সমুদ্রের। যে চোখের জল তার সহ্য হয় না সে চোখের জলের কারণই আজ সে। হঠাৎ রাগে অন্ধ হয়ে সে কী করে ফেলল এটা? তার নিজের মস্তিষ্কেই বিষয়টা ঢুকছে না। সে কীভাবে করতে পাড়লো? হাত কীভাবে তুলতে পাড়লো সে তার মধুর উপর?

ঈশা এসে মোহের হাত ধরে বলল, “মোহ ওর রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না। ও কি করে কি বলে নিজেই জানে না। প্লিজ তুমি…. ”
মোহ তার কথা কেটে বলে, “রাগে স্ত্রীর উপর হাত তোলা পুরুষদের কাপুরুষ বলে। আপু আপনি আমার জায়গায় হলে এটা সহ্য করতে পাড়তেন? আপনার ভালোবাসার মানুষ, আপনার স্বামী আপনার উপর হাত তুলেছে। আজ কেবল উঠিয়েছে, কাল রাগে মারতে কতক্ষণ?”

সমুদ্র অস্থির হয়ে তার হাত ধরলো, “না মধু আর কখনো এমন হবে না। আমার সে মুহূর্তে কী হয়েছিল আমি নিজেও জানি না।” কথা বলতে বলতে তারও চোখে পানি এসে পড়ে।

মোহ তার তার ঝটকে সরিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে, “জানেন আমি কবে সম্পূর্ণভাবে আপনার প্রেমে পড়েছিলাম? যেদিন আপনি ফুপির বাসায় আমার সম্মান রক্ষা করেছিলেন। সেদিনের থেকে তো বড় অপমান আজ আপনি আমায় করলেন। আমার উপর হাত তুলে, অবিশ্বাস করে, আমাকে ছোট করে।”
জবা কথার মাঝে বলে, “হাতই তো তুলেছে। থাপ্পড়ও মারে নি। তোমার স্বামী হয়। এতটুকু করতেই পাড়ে।”
তার এমন কথায় মোহ তাকায় তার দিকে। কঠোর দৃষ্টিতে, “আমার বাবা মা আজ পর্যন্ত আমার গা’য়ে হাত তুলে নি। আমার জন্মের পর তাদের আমার উপর সবার আগে অধিকার আছে। সেখানে তো আমি উনাকে আমার উপর অধিকার দিয়েছি। কিন্তু আমাকে অপমান করার অধিকার কারো নেই। আমি অধিকার দিলে আমি ফিরিয়েও নিতে পাড়ি। আমার উপর হাত তোলা তো দূরের কথা এই কথা ভাবতেও পাড়বে না উনি।”

তারপর আবার তাকায় সমুদ্রের দিকে। কান্নামাখা চোখ নিয়েও হেসে বলে, ” আপনি বললেন না আমি উনার উপর জ্বেলাস? জানেন সত্যিই আমি উনার সাথে জ্বেলাস ছিলাম। ঈর্ষা করতাম। আমি ভাবতাম যাকে আমি এই জনমে দেখি নাই তাকে এত কীসের ঈর্ষা!” মোহ সমুদ্রের বুকে হাত রেখে বলে, “কারণ এই হৃদয়ে কেবল উনি ছিলো। কিন্তু সে ঈর্ষা সে কবেই মিটে গিয়েছিল। উনাকে দেখার পর এক মুহূর্তও আমার ঈর্ষা হয় নি। কারণ আমার ভুল ধারণা ছিলো যে এই হৃদয়ের কোথাও আমি আছি এখন। বড় অংশ জুড়ে। এত বড় ভুল ধারণা ছিলো আমার।”
“না তুমি… ”
“কথা বলবেন না। তখন আপনি বলেছেন আমি শুনেছি। এবার আপনি শুনুন। আপনি তো কেবল দেখলেন আমি উনার উপর হাত তুলেছি কেন তুলেছি জানেন?”

তখনই জবা বলল, “তুমি…. ”
মোহ আর্তনাদ করে উঠে। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “খবরদার। আরেক শব্দ করলে তোর নোংরা স্বামীর বাহিরে যা অবস্থা করেছি তার থেকে বেশি খারাপ অবস্থা হবে তোর।”
সে একই দৃষ্টিতে মোহ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তার কলার ধরে কাছে আনে, “আমাকে হ্যারেজ হয়েছি এটা আপনার জবাফুলের কাছে খুবই স্বাভাবিক লেগেছে। সে দেখেও না দেখার মতো চলে গেল। তার মতে পুরুষ মানুষ এসব একটু করেই। দোষ আমার। আমি এই সৌন্দর্য দিয়ে কত ছেলেকে ভুলিয়ে তাদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছি। এই কথাই বলেছিল আপনার প্রাক্তন প্রেমিকা।” সে জেবার দিকে তাকায় আবার, “ওয়ার্ড টু ওয়ার্ড। ভুল বলেছি?”
সমুদ্র বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। মোহ তখন তার পা’য়ের তালু উঁচু করে সমুদ্রের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলল, “আর এসব কথা কেন হয়েছে জানতে চান? সহ্য করতে পাড়বেন শুনে? উনার স্বামী অর্থাৎ কারিম আমার শরীরে হাত দিয়েছে।” কথাটা শুনে নিশ্বাস আটকে গেল সমুদ্রের। আত্না কেঁপে উঠে তার।
মোহ তাকে ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, “আজকের পর আমি আপনার চেহেরাও দেখতে চাই না।” বলে সে ফিরে যেতে নিলে ঈশা লামিনকে পাঠায় তার পিছনে। বলে দেয়, “ও যেন সহি সালামত বাড়িতে পৌঁছায়। ভুলেও রাতে বাড়ির বাহিরে বের হতে দিবি না।”
লামিন তার কথায় সায় দিয়ে দৌড়ে যায় মোহের পিছনে।

লামিন মোহকে বলে, “গাড়িতে উঠেন ভাবি।”
“লাগবে না। আমি যেতে পাড়বো।”
“ভাবি আপনি রাস্তা চিনেন না। এত রাতে একা আমি আপনাকে পাঠাতে পাড়ি না। আপনি আমার বোনের মতো। ভাই মেনেই উঠুন। প্লিজ।”
মোহ তার কথা মানলো। গাড়িতে উঠে যাবার সময় দেখলো কারিম উঠেছে এতক্ষণ পর। তাকে দেখে আরও র’ক্তাক্ত করে দিতে মন চাইল মোহের। লামিন তাকে বলল, “ভাবি এই কু’ত্তার দিকে তাকানোরও দরকার নেই।”
লামিনসহ মোহ গাড়িতে উঠলো। গাড়ি চলাকালীন লামির বারবার দেখছিল মোহকে। তার চোখে পানি জমা অথচ সে একবার পলকও ফালাচ্ছিল না।
লামিন গভীর নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকাল তার সমুদ্রের জন্য চিন্তা হলো প্রচুর। এতমাসে সে সমুদ্রকে পরিবর্তন হতে দেখেছিল মোহের কারণে। কিন্তু এত বড় ঘটনার পর কী হতে যাচ্ছে সে বুঝতে পাড়ছে না।

ঈশা এসেই সমুদ্রের পিঠে কতগুলো থাপ্পড় মাড়ে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তুই কী করেছিস বুঝতে পাড়ছিস তুই? যে মেয়ে তোর জীবনে তখন থেকেছে যখন তুই হাজারো বদঅভ্যাসে জড়িয়ে ছিলি। তোকে ঠিক করেছে। তোর সব বদ অভ্যাস ছাড়িয়েছে। তোকে ভালোবেসেছে। সে মেয়েকে এত আঘাত দিলি তুই এমন…” সে জবার দিকে তাকাল, “এমন মেয়ের জন্য যে তোকে টাকার জন্য ছেড়ে গিয়েছিল? আরে এই কথা এখানের সবাই জানে। তোর এখনো বিশ্বাস না হলে যেয়ে জিজ্ঞেস কর জবার মা বাবাকে তারা কি নিজে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল, না এই মেয়ে কারিমকে নিয়ে তার কাছে গিয়েছিল?”

সমুদ্র তাকায় জবার দিকে। তার তাকানো দেখেই জবা ঘাবড়ে যায়। সমুদ্র ধীর পা’য়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার চোখদুটো লালচে। চোখে এখনো পানি ভাসছে। সে কিছু প্রশ্ন করার পূর্বেই জবা নিজের সাফাই দিতে শুরু করে, “সমুদ্র বিশ্বাস করো বাবা মা নিজে….”
“কারিম কোথায়?”
“কী? সমুদ্র কারিমের সাথে আমার বিয়ের আগে কোনো রকমের সম্পর্ক ছিলো না। সত্যি কথা?” জবা ভীত স্বরে বলে।
সমুদ্র গর্জে উঠে তখন, “ড্যাম ইট আমি জিজ্ঞেস করছি কারিম কোথায়? ওর সাহস কী করে হলো আমার বউকে ছোঁয়ার?”
এতটুকু বলতেই তার চোখ দিয়ে যেন অগ্নিজোয়ার উঠলো।
“স…সমুদ্র… ”
“তোমারও হিসাব আমি পড়ে করবো। এত্তো বড় সাহস তোমার আমার বউয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলো! ও আমার কাছে এই দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি পবিত্র। ওর পবিত্রতার উপর তুমি প্রশ্ন তোলার কে? শেষবার জিজ্ঞেস করছি কারিম কোথায়? উওর না এলে আগে হিসাব তোমার হবে।”
জবা ভয়ে চুপসে গেল। তার বিশ্বাস হলো না সমুদ্র তার সাথে এত উঁচু গলায় কথা বলছে। যে সমুদ্রকে ছেড়ে যাওয়ার পরও সে তাকে রক্ষা করে এসেছে সে তার সাথে এভাবে কথা বলছে? তাহলে কী সমুদ্র সত্যিই মোহকে ভালোবাসে?
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি।” আবারও সমুদ্রের গর্জনে জবা ভয়ে কেঁপে উঠে। বলেই দেয়, “তো…তোমার গাড়ির কাছে।”

সমুদ্র সেদিকে এগোতে থাকে। তার পিছনে যায় ঈশা তুষার সহ কিছু মানুষও।
সমুদ্র তার কোর্ট খুলে টাই খুলে ফেলে। শার্টের প্রথম দুই বোতাম আলগা করে হাতা বটে নেয়। বাহিরে এসেই দেখতে পায় কারিমকে। তার ঘাড়ে একটু কেটে গেছে। র’ক্ত পড়ছে।

সমুদ্র সেই অবস্থায় তার কলার ধরে একের পর এক ঘুষি মারে কারিমকে।
সে এমনিতেও আহত অবস্থায় ছিলো। হঠাৎ এমন আক্রমণ সহ্য করতে না পাড়ায় বসে যায় মাটিতে। কিন্তু সমুদ্র মা’রতে থাকে। তাকে লাথি মা’রে একের পর এক। এতক্ষণ সবাই দাঁড়িয়ে দেখলেও দুই চারজন এগিয়ে আসে তাকে থামানোর জন্য। সমুদ্র তো থামেইই না তাদের উল্টো মেরে দেয় কতগুলো। কারিমকে কলার টেনে উঠিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আগুন্তক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোন হাত দিয়ে ছুঁয়েছিলি আমার মধুকে? শালা তোর ভয় নেই? তুই আমার বউকে হাত লাগিয়েছিস কীভাবে?”

সে কারিমের ঘাড় ধরে তার মাথা জোড়ে মা’রে গাড়ির কাঁচে। যদিও কাঁচ সম্পূর্ণ ভেঙে ঢুকে না তার মুখে কিন্তু র’ক্ত বয়ে পড়ে তার মাথা আর গাল দিয়ে।
চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয় মুহূর্তে। কারিমের মা বাবাও আসে এতক্ষণে। তার ছেলের অবস্থা দেখে হা হুতাশ করে।
কিন্তু সমুদ্রর রাগ তো কমছিলোই না। সে তার হাতে লাথি দিয়ে জুতা দিয়ে পিষে দেয়। ঈশা থামায় তাকে, “সমুদ্র হয়েছে। ম’রে যাবে তো।”
“ম’রে যাক। ওর সাহস কি করে হয় আমার মধু…আমার বউয়ের গা’য়ে….” এরই মাঝে হঠাৎ চোখে পানি এসে পড়ে সমুদ্রের। সে ঈশার দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় বলে, “আমি ওর রক্ষা করতে পাড়িনি ঈশা। উলটো…উলটো কিছু না শুনে আরোপ লাগিয়েছি। আমি…আমি ওর উপর হাত… ” এতটুকু বলেই সে হাত দিয়ে গাড়ির দরজায় জোরে আঘাত করল। সাথে সাথে হাত হাতে কাঁচ ঢুকে যায়। র’ক্ত পড়তে শুরু করে গড়িয়ে। ঈশা চমকে যায়, “তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস?”
তার হাত ধরতে নেবার আগেই সে মাটিতে বসে পড়ে। গাড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে। এক হাত মোড়ানো হাঁটুর উপর রেখে র’ক্ত টুপটুপ করে গড়িয়ে পরতে দেখে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আর কাঁপানো সুরে বলে, “ও বড্ড অভিমানী রে ঈশা। একবার উঁচু স্বরে কথা বলায় ও আমার সাথে কথা বলে নি কতদিন। এবার এত বড় ভুলের পর কী আমার সাথে কথা বলবে? ওকে ছাড়া আমার নিশ্বাসও আটকে যায়। ও আমার সাথে কথা না বললে আমি বাঁচবো কী করে?”
.
.
বাড়িতে এসে রুমে ঢুকে দরজা এড়িয়ে বাথরুম যায় মোহ। ঝর্ণা ছেড়ে চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে মুখ করে রাখে। আজকের সকল ঘটনা তার চোখের সামনে ভাসছে। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি মুহূর্ত। কতকিছু ভেবে রেখেছিল আজকের মুহূর্তের জন্য। নিজের ভালোবাসার স্বীকারোক্তি করবে, সে কী জানতো আজ তার ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটবে!

সমুদ্রের প্রতিটি শব্দ তার কানে ভাসে। তাকে থাপ্পড় মারার জন্য হাত উঠানো দৃশ্য বারে বারে তার চোখের সামনে ভাসে। মুহূর্তে মেঝেতে বসে পড়লো না। সে চিৎকার দিলো। তার ভেতরের সব কষ্ট যদি বেরিয়ে আসে এই গর্জনের সাথে? সে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। দেয়ালের চারদিকে গর্জন করে দুঃখের হাহাকার।

চলবে….

মেঘের খামে…
পর্ব ৪৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মহুয়া নিজেকে দেখলো। আজ প্রথম নিজ ইচ্ছায় সেজেছে সে। কমলা রঙের সেলোয়ার-কামিজ পরেছে। নীল রঙের কাজল মেখেছে চোখে। আর গহনা হিসেবে তার আনামিকা আঙুলে জাহানের দেওয়া আংটি। আজ এত সুন্দর করে সাজার কারণ হলো আজ তাদের ভার্সিটি খুলছে সেমিস্টার এক্সামের পর। আজ আসছে জাহানও। যদিও তার সাথে কথা হয় নি। তার ফ্লাইট ছিলো একদিন আগেই। আসার পর তাকে কল দেয় নি এই অভিমানে সে-ও কল দেয় নি। আজ দেখা হোক, ক্লাস নিবে তার।

সে দ্রুত বের হয় তার বাসা থেকে। তাকে এমন সেজেগুজে বের হতে দেখে তার মা বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারা তো কনফিউজড হয়ে যায় তারা কী তাদের মেয়েকেই দেখলো না’কি?

স্কুটি নিয়ে ভার্সিটির সামনে পৌঁছায়। সেখানে আড্ডা দিচ্ছিল জয়ের দল সহ তিসান। তাকে দেখে জোরে ডেকে বলল, “আমার বন্ধু তো পাগল হয়ে যাবে এমন সেজে এসেছ কেন?”
মহুয়া স্কুটি পার্ক করে এলো তার সামনে, “পাগল না বলো ছাগল। ওই ছাগলে এসেছে না’কি?”
“এসেছে তো ভাবি। আপনার সাথে কথা হয় নি?” জয় জিজ্ঞেস করে।
“সাধে সাধে কী ছাগল বলেছি? এসে একবার জানায়ও নি। ভার্সিটিতে এসে নিক, মাথা ফাঁ’টাবো তোমাদের ভাইয়ের।”
তিসান হাসে, “কেন সিসফ্রেন্ড আমার বন্ধুকে মিস করেছ না’কি?”
“ওই হনুমান চেঁকামেঁকাকে আমি মিস করব? হুহ্ আর মানুষ পাও নাই।”
“তা তো দেখতেই পাড়ছি।” তিসান দেখে মহুয়া বারবার নিজের মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে। সময় দেখে রেখে দিচ্ছে। সে হেসে বলে, “এই জয় জাহানকে একটা কল দে তো। কারো তর সইছে না।”
“এই টিকটিইক্কা তোমাদের বন্ধুত্ব আমি করালাম এখন আমার সাথে মজা নেও ওর হইয়া?”
তিসান হাসে তার কথায়। কিন্তু হঠাৎ তার চোখ থেমে যায় মহুয়ার কাঁধের পিছন দিকে। তার হাসি মলিন হয়ে যায় মুহূর্তে। ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে, “রশ্মি এখানে!”
মহুয়া কথাটি শুনে প্রথমে কপাল কুঁচকায়। তার পিছনে ফিরে তাকায়।

একটি সুন্দরী নেয়ে নীল রঙের লং স্কার্ট ও সাদা রঙের টপ্স পরে একটি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। গাড়িটি তার চেনা। গাড়িটি দেখেই তার বুকে একটা ধাক্কা খেলো। তবুও সে নিজেকে সামলায়। দেখে জাহান বের হয়েছে গাড়িটি থেকে। রশ্মি নামক মেয়েটা দৌড়ে এসে জাহানের বাহু ধরলো। এই দৃশ্য দেখে তার চোখ দুটো বড় হয়ে যায়। সে চকিতে তাকায় তিসানের দিকে, “এই মেয়েটাই কী সে রশ্মি?”
তিসান চেয়েও উওর দিতে পাড়ে না। তাকেও ভীষণ বিস্মিত দেখাচ্ছে। কেবল সে না জয়, আবিদ জাহানের দলের যারা এখানে উপস্থিত সবাইকে হতভম্ব দেখাচ্ছে।

রশ্মি তিসানকে দেখে দূর থেকে দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে, “কতবছর পর দেখলাম তোকে। তুই তো আজকাল আমায় মনেই করিস না।” তারপর ছেড়ে বলে, “এই তুই তো দেখি আরও লম্বা হয়ে গেছিস।”
তিসান জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে। জিজ্ঞেস করে, “তুই এখানে?”

মহুয়া তখনও জাহানের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু সে মহুয়াকে দেখার পর এক পা’ও নড়ে না। সেখানেই স্থির থাকে। রশ্মি যেয়ে দৌড়ে জাহানের বাহু ধরে তাকে টেনে আনে। তারপর একগাল হেসে বলে, “তোদের জন্য স্যারপ্রাইজ আছে। আমার ও জাহানের এনগেজমেন্ট ঠিক হয়েছে।”
কথাটা শুনে মহুয়ার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। সে তাকায় জাহানের দিকে।
তিসান বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “কী?”
আবার তাকায় সে মহুয়ার দিকে। কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পাড়ছে না যে।

জাহান হাসার চেষ্টা করে। বলে, “এটা সত্যি। আমাদের এনগেজমেন্ট ঠিক হয়েছে।”
“কী?” মহুয়ার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে কথাটা শুনে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় পৃথিবীটা থেমে গেছে। তার নিশ্বাস আটকে গেছে। সে ভুল শুনছে নিশ্চিত। কথাটা শুনে মহুয়ার হাত পা কাঁপতে শুরু করে। তবুও সে এই আবেগ দেখাবে না। সে এতটাও দুর্বল না। তার ফর্সা মুখখানা লালচে হয়ে যায় কান্না থামানোর কারণে। তবুও সে কঠিন গলায় প্রশ্ন করে, “তো মিস্টার ইয়াজভান জাহান, তুমি এখন এনগেজমেন্ট করলে আমার সাথে সেদিন এই রিং পরিয়ে আমায় কী বললে? আমি না’কি তোমার অফিসিয়াল ফিয়োন্সে?”

একথায় রশ্মি অবাক হয়ে তাকায় তার হাতের দিকে, “এটা তো আন্টির…”
“রাইট। কেউ একজন আমাকে খুব যত্নে পরিয়ে দিয়েছিল তাই না? তুমি না বলেছিলে আমাকে ভালোবাসো তাহলে এসব কী ইয়াজভান জাহান? অন্যকারো সাথে এনগেজমেন্ট করতে হলে এসব জান, লাভ বলে আমার সাথে এত ঢঙ করেছ কোন দুঃখে?” সে জাহানকে প্রশ্ন করে।
রশ্মি তার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকায় জাহানের দিকে,
“ও এসব কী বলছে জাহান?”
জাহান তার কথার উওর না দিলেও মহুয়ার কথার উওর দেয়, “তো? তুমি উওর দিয়েছ? দেও নি। আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিলো না তাই এমন বিহেভ করবে না যে তুমি আমাকে ভালোবাসো।”
“আচ্ছা,” মহুয়া তার সামনে এসে দাঁড়ায়। বুকের উপর হাত ভাঁজ করে বলে, “তুমি তো আমাকে ভালোবাসো।”
জাহান অন্যদিকে তাকায়, “না, ভালোবাসি না।”
রশ্মি মহুয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আপু আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে।”

মহুয়া এমনিতেই রেগে আছে জাহানের উপর। এর উপর মেয়েটার এত মিষ্টি ভাষায় কথা বলাটা ভীষণ বিরক্ত করছে তাকে। উল্টাপাল্টা কথা বললে তাও একটু কথা শুনিয়ে ক্ষোভ বের করতে পাড়তো। কিন্তু এমন মিষ্টি করে কথা বললে কী করবে সে? কিছু কটু বলতেও পাড়বে না।
সে শান্ত গলাতেই উওর দিলো, “সম্পূর্ণ ভার্সিটির সামনে ও আমাকে প্রাপোজ করেছে। তাও বারবার।”

জাহান এক’পা এগিয়ে আসে তার দিকে, “আর তুমি মানা করেছ রাইট? তোমার সাথে আমার কিছুই হয় নি। না প্রেম, না সম্পর্ক। আমাদের শর্তের কথা মনে আছে তোমার? আমি হেরে গেছি।” বলে এক ঢোক গিলল সে। সে রশ্মিকে আবার বলে, “চলো।”
জাহান পিছনে ঘুরতেই মহুয়া বলে, “যদি বলি আমিও ভালোবেসে ফেলেছি তাহলে?”
জাহান থেমে গেল। চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস ফেলে আবার তাকাল তার দিকে, “তাহলে আমি জিতে গেছি আর তুমি হেরে গেছো। আমাদের গেইমের কথা মনে আছে? আমরা একে অপরকে হারানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলাম? অবশেষে তুমি হেরে গেলে। তোমার কী মনে হয় আমি তোমার প্রেমে পড়ব? সব নাটক ছিলো তোমাকে হারানোর জন্য।”
সম্পূর্ণ কথা শেষ হতেই মহুয়া সজোরে এক থাপ্পড় মারলো তার গালে।
সকলে হতভম্ব হয়ে গেল এই দৃশ্য দেখে।
রশ্মি ছুটে এসে জাহানের গালে হাত দিয়ে দেখে। তারপর কাঁদোকাঁদো মুখে তাকায় মহুয়ার দিকে, “আপনি কী শুরু করেছেন এসব?”

মহুয়া তার কথা এড়িয়ে যায়। পাত্তাও দেয় না। সে জাহানের আরেকটু কাছে এসে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করে, “ঘুম ভেঙেছে?”
জাহান অন্যদিকে মুখ করলে মহুয়া তার গাল হাত দিয়ে চেপে ধরে তার দিকে ফেরায়, “আমাকে কী পাগল মনে হয় তোমার? তোমার চোখ দেখে আমি কেন যেকেউ বলে দিবে মনে কি চলছে। এসব নাটক হলে এই চোখ ভিজে আছে কেন তোমার?”
জাহান মহুয়ার হাত সরায় ঝেড়ে। বলে, “তোমাকে কৈফিয়ত দেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবুও এতক্ষণ তোমার বকবক সহ্য করেছি। নাউ সাট আপ। আমি আমার লাইফে কি করবো না করবো তা প্রশ্ন করার অধিকার তোমার নেই।”
মহুয়া রাগে কষ্টে তার দিকে তাকায়। সে দাঁতে দাঁত পিষে তার কথাগুলো সহ্য করলো। তার চোখ ভিজে আসতে থাকে। সে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ। তার নাক মুখ লাল হয়ে গেছে। তারপরও সে জাহানের চোখে চোখ রেখে বলল, “ওকে, গো টু হেল। আমার সামনে আর এই প্রেম পিরিত দেখাতে আসলে কলিজা থেকে জান বের করে নিবো।”
সে নিজের আঙুল থেকে রিংটা খুলে জাহানের হাতে দিয়ে বলে, “নেও তোমার একমাত্র আমানত ফিরিয়ে দিলাম।”
সে হাত সরাতে নিলেই জাহান তার হাত ধরে নেয়। মহুয়া একবার তাকায় তার হাতের দিকে, আবার জাহানের দিকে। তার চোখে ক্ষোভ, অথচ পানি টলমল করছে। মহুয়া হাত সরাতে চাইলে সে আরও শক্ত করে হাত চেপে ধরে। তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর এক ঢোক গিলে। হাত ছেড়ে সেখান থেকে চলে যায়।
.
.
রাতভরে অপেক্ষা করছিলো মোহ ভোরের আলো ফোঁটার। সকাল হলেও চলে যেত। রাতে কখন মোহের চোখ লেগে এলো সে জানে না। তবে সকালে ঘুমের নেশা কাটতেই এক পরিচিত ঘ্রাণ তার নাকে এসে লাগলো।

প্রতিসকালে এই ঘ্রাণ পেয়ে উঠলে তার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। কিন্তু আজ এই ঘ্রাণ তার কাছে বিষের মতো লাগছে। আজ আর সে মানুষটার মুখ মায়াভরা দৃষ্টিতে দেখলো না সে। সে মুহূর্ত না ভেবে শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে সমুদ্রকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গেল।

হঠাৎ এমন তীব্র ঠেলায় সমুদ্রের ঘুম ভেঙে যায়। সে অনেকটা সরে গেছে। বিছানার কোণায় এসে পড়েছিল। সে উঠে বসলো মোহকে দেখে। সে রুমে এসেছিল ভোরে। সারারাত রুমের বাহিরে অপেক্ষা করার পর। কীভাবে সে মোহের মুখোমুখি হবে জানতো না। রুমে এসে মোহকে নিদ্রায় ডুবে থাকতে দেখে সে তার কাছে আসে। তার ঘুমন্ত মুখখানা দেখে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ভেবেছিল তার ঘুম থেকে উঠার আগেই চলে যাবে। অথচ কখন তার চোখ লেগে এলো বুঝলো না। সে মোহের দিকে তাকিয়ে মুখ খুললো কিছু বলার জন্য। কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো কথা বের হলো না।

মোহ বিছানা থেকে নেমে তার ফোনে দেখলো সকাল দশটা বেজে গেছে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে বাস চলাচল শুরু হয়েছে। সে নিজের গুছানো ব্যাগটা হাতে নিয়ে একবার কঠোর ভঙ্গিতে তাকাল সমুদ্রের দিকে। শক্ত গলায় বলল, “আজকের পর থেকে আমাকে ছোঁয়ার তো দূরের কথা কাছে আসারও সাহস করবেন না।”
মোহ কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে সমুদ্র দৌড়ে এসে তার হাত ধরে নেয়, “মধু….”

মোহ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় তার হাতের দিকে। দেখেই চমকে যায়। তার হাতে সাদা রুমাল বাঁধা যা লাল হয়ে গেছে র’ক্তে। এই দৃশ্য দেখে তার বুক কাঁপলেও তা নিখুঁতভাবে গোপন করে সে। সমুদ্রের হাত ঝেড়ে সরিয়ে দেয় আর নিজে বেরিয়ে যায়। সমুদ্র তার পিছনে ডাকতে ডাকতে বের হয়, “মধু একবার তো আমার কথা শুনো….”
মোহ থামে না।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সমুদ্র বলে, “তুমি ঢাকা গেলে আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে….মধু একটু তো দাঁড়াও।”
নিচে মেহমানরাও ছিলো। নাস্তা করছিল। এই দৃশ্য দেখে সকলের দৃষ্টি তাদের দিকে আটকায়। লামিনও ছিলো সেখানে। সে দৌড়ে যেতে মোহকে বলে, “ভাবি আপনি একা যেয়েন না। আমি সাথে যাচ্ছি আপনার।”
তার কথায় মোহ থামে, “না ভাইয়া। আমি যেতে পাড়ব। গতকালকের জন্য ধন্যবাদ।” তারপর তাকায় সে ঈশার মা’য়ের দিকে, “আন্টি আপনাদের কষ্ট দিলাম। অনুষ্ঠানে আমার জন্য এত ঝামেলা বাঁধলো। অনুষ্ঠানটা নষ্ট হলো। পাড়লে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন।”
“না, তোমার দোষ নেই। তুমি পাড়লে আমাদের ক্ষমা করো। আমাদের ভাইয়ের ছেলে তোমার সাথে… সমুদ্র একদম উচিত শিক্ষা দিয়েছে ওকে।”

কথাটা শুনে মোহ একবার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। তাচ্ছিল্য হেসে বলে, “কী লাভ? দুইজনের মধ্যে বিশেষ একটা পার্থক্য নেই।”
কথাটা শুনে সমুদ্র বিস্ময় নিয়ে তাকায় তার দিকে।
মোহ বাড়ি থেকে বের হতেই সমুদ্র তার হাত ধরে নেয়, “মধু প্লিজ। আর ভুল হবে না।”
মোহ তাচ্ছিল্য হাসলো। তার দিকে তাকাল রাগান্বিত দৃষ্টিতে। শান্ত অথচ রুষ্ট স্বরে উওর দিলো, “একথা হাজারোবার শুনেছি। ভুল তো আপনার না, আমার। আপনাকে ভালোবাসা আমার সবচেয়ে বড় ভুল। এই ভুলের উসুল দিচ্ছি এই হৃদয় পুড়িয়ে।”
“তুমি… তুমি যেভাবে বলবে আমি সেভাবে চলবো। আই প্রমিজ। জবার সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিব। তুমি যা বলবে, সব করবো আমি।” সমুদ্র মোহের এক হাত নিজের দুইহাতের মাঝে রাখলো। অকুতির স্বরে বলল তাকে। তার কন্ঠ কাঁপানো। নিশ্বাস দ্রুত। চোখে কেমন অসহায়ত্ব।
মোহ তাকে দেখে মৃদু হাসে, “আমাদের সম্পর্কটা বেশ লম্বা হয়ে গেল তাই না? ছয়মাস পাড় হয়ে গেছে। চলুন ডিভোর্স নিয়ে নেই।”
কথাটায় বুকের ভেতর কামড়ে উঠে সমুদ্রের। ভয় এসে বিরাজ করে তার বুকের ভেতর। নিশ্বাস আটকে যায়। সে স্তব্ধ হয়ে যায়। লামিন ভেতর থেকে এসে তার পাশে দাঁড়াল। সে দেখল মোহ সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে সমুদ্রের কাঁধে হাত রেখে বলল, “কী হয়েছে?”
সমুদ্রের ধ্যান ভাঙে। সে লামিনকে বলল, “আমি মোহের সাথে যাচ্ছি।”
“জলদি যা।”
মোহ এক রিক্সা নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে যেয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ বাদেই দেখলো সমুদ্রও এসেছে সেখানে। তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো।

বাসের টিকিট নেওয়ার পর উঠলো। সমুদ্রও উঠলো তার পিছনে তবে তার পাশে বসলো না। তার পাশের রো এর এক সিট পর বসলো। মোহ তার দিকে তাকায়ও না কিন্তু অনুভব করতে পাড়ে সমুদ্র তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার হাতের রক্তাক্ত অবস্থা মনে করতেই বুকের ভেতরটা মুচড়িয়ে উঠলো তার। সে সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিলো। এই পৃথিবীতে কী আর মানুষ ছিলো না তার প্রেমে পড়বার মতোন? হাজারো কোটি মানুষের মাঝে সে এই মানুষটারই প্রেমে কেন পড়লো? যে মেয়ে সারাজীবনে কাঁদে নি এই এক মানুষের জন্য কত দুঃখ ঝরিয়েছে এই দুই নয়ন দিয়ে।
.
.
রশ্মি ও জাহান ক্যান্টিনে বসেছে। মহুয়া যেয়ে ঠিক তার সামনের টেবিলে বসলো। এদিকে বাকি সবাই নিজেরাই দ্বিধায় পড়ে যায় তারা কী করবে? কোথায় বসবে?
তিসান মহুয়াকে একা দেখে তার সাথে যেয়ে বসে। জয়ও আসে জাহানের কাছে। বাকি সবাই কোনো পক্ষে না জড়িয়ে অন্য টেবিল খুঁজে বসে পড়ে।

মহুয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জাহানের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে। রাগে তার সারা শরীর কাঁপছে।
জাহান ফোন চালাচ্ছিল। ফোন থেকে চোখ তুলে তাকায় একপলক তার দিকে। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। আবার ফোনে চোখ দিতে যেয়ে চোখ আটকায় মহুয়ার দিকে। আবারও সে চোখ লুকিয়ে নেয়।

তিসান অবাক সুরে জিজ্ঞেস করে, “বাহিরে এত কিছুর পর তুমি জাহানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছো কেন? সবাই দেখছে।”
“দেখুক। কিন্তু এই শালা চেঁকামেঁকাকে আমাকে দেখতে দিব না। আমাকে কী পুতুল ভেবেছে যেভাবে ইচ্ছা নাচাবে? ক’দিন আগেও তার ভালোবাসা উথলে পড়ছিলো। আর আজ অন্য কাওকে নিয়ে ঢ্যাঙঢ্যাঙ করে ঘুরে এনগেজমেন্টের কথা জানাচ্ছে। আবার তাকাতেও মন চাইবে তার। শালাকে তো আমার ব’ন্দুক দিয়ে উড়িয়ে দেবার জন্য হাত চুলকাচ্ছে।”
“তুমি তো ভারি ডেঞ্জারা’স। শান্ত হও, হয়তো কোনো ঝামেলা হয়েছে আমি নিশ্চিত। জাহান নাহলে এমন করতেই পাড়ে না।”
মহুয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “তোমার কী মনে হয় আমি এখনো ব্যাপারটা ধরতে পাড়ি নাই? কিন্তু কথা হলো ঝামেলা হলে তো বলবে এমন কাহিনি না করে।”
“নিশ্চিত কোনো জটিল ব্যাপার আছে।”
“কচু আছে।”
সে আবারও রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল জাহানের দিকে। জাহান তার দিকে ই তাকিয়ে ছিলো। সে তাকাতেই চোখ সরিয়ে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়।
দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। তার পিছনে উঠে যায় রশ্মিও।

তারা যেতেই মহুয়া রাগে তিনটা পেস্ট্রি আনায়। প্রথমে খাবে, তারপর মাথা দৌঁড়াবে। পেস্ট্রি আনা হয়। মহুয়া এমন চিটচিটে মেজাজ দেখে তিসান আর কিছু বলে না। এরই মধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হয় শায়ান শিকদার। সে চেয়ার ঘুরিয়ে বসে চেয়ারের উপর হাত রেখে বলে, “সো মিস পাগলের কারখানা এখন অনুভূতি কেমন আপনার?”
মহুয়া তার দিকে তাকায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, “মেজাজ খারাপ করলে লাথি মেরে উগান্ডা পঠায় দিব।”
শায়ান কথাটা মজায় উড়িয়ে দেয়, “শুরু থেকেই বলেছিলাম জাহান কেবল রশ্মির। তখন তো কথাটা শুনো নি। এখন এত ক্ষেপে লাভ নেই।”
হঠাৎ মহুয়া কিছু একটা ভেবে বলে, “এক মিনিট, তুমি জানো জাহান এমন কেন করছে? যেখানে ও রশ্মির নামও সহ্য করতে পাড়তো না সেখানে ও বিয়ে করতে যাবে ওর সাথে? কোনো এক কাহিনী তো আছে।”
এই কথা শুনে শায়ান এক মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তবুও নিজেকে সামলে বলে, “তিসান আর জয় জাহানের সবচেয়ে বেশি কাছের। ওরা না জানলে আমি কীভাবে জানবো?”
“তোমার চেহেরা দেখে এখন আমি নিশ্চিত তুমি জানো। পড়াশোনার বাহিরে সব কিছুতে আমার ব্রেন ফ্লাসের স্পিডে কাজ করে।”
শায়ান বাঁকা হাসে, “তো তুমি জানলেই কি আমি বলবো না’কি?”
মহুয়া তার বাকি কেক মুখে নিয়ে শব্দ করে চামচটা রাখে বাটিতে। অস্পষ্ট স্বরে বলে, “তো তুমি না বললে আমি জানবো না?”
এতটুকু বলে রেগে উঠে যায়। হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়ে ক্যান্টিন থেকে। শায়ান তিসানকে জিজ্ঞেস করে, “ওর কী প্রতি মিনিটে পাগলামির ঝটকা লাগে?”
“এমনিতেই বেচারি চিন্তায় আছে তুই ওকে আরও ক্ষেপিয়ে দিলি কেন?”
শায়ান তার কথা সম্পূর্ণ না শুনেই মহুয়ার পিছনে গেল।

মহুয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কল দিলো জিনিকে। ফোন বন্ধ সম্ভবত সে কলেজে। তার জানতেই হবে জাহানের সাথে কি হচ্ছে?
তার মাথা ধরে গেছে প্রচুর। অস্থির অস্থির লাগছে। কিছু ভালো লাগছে না। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। সে দ্রুত কল দেয় মৃণাকে,
“হ্যালো, কই তুই?”
“এই ভার্সিটি আসতে দশ মিনিট লাগবে।”
“রিক্সা দিয়ে এসে পড় দ্রুত।”
“সব ঠিক আছে তো মহু? তোর কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন?”
“প্লিজ জলদি আয়।”
“আচ্ছা আমি রিকশা নিয়ে আসছি।”
মহুয়া ফোন রেখে পিছনের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ চেপে ধরে একহাত দিয়ে মাথার চুল টেনে ধরে। ঠোঁট কামড়ে ধরে রাখে। তার চোখে পানি আসছে। কিন্তু সে কাঁদতে চায় না। কিছুতেই না।

হঠাৎ সে টান অনুভব করে হাতে। সাথে সাথে চোখ খুলে দেখে শায়ানকে। সে নিজের বাহুতে ধরা তার হাত দেখে বিরক্ত হয় প্রচুর। নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে।
শায়ান জিজ্ঞেস করে তাকে, “এমন বিহেভ করছো কেন?”
“কেমন?”
“যেন খুব দুঃখে আছো। তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম জাহান কেবল রশ্মির। আগেই ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম। এছাড়া তুমি এমন ব্যবহার করেছ যেন তোমরা সম্পর্কে ছিলে।”
“থাকলেই কি বা না থাকলেই কী? তোমার কী? কী সমস্যা তোমার?”
“আমার সমস্যা তুমি। তুমি আমাকে নিজে বলেছ তুমি ওকে ভালোবাসো না তাহলে এখন কেন তুমি… ”
সাথে সাথে মহুয়া তার কথার মাঝে বলে, “ভালোবাসি।”
শায়ান এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় কথাটা শুনে।
মহুয়া আবারও বলে, “আমি ভালোবাসি জাহানকে।”
তার চোখে হঠাৎ পানি ভেসে উঠে।

সে চোখের জল দেখে শায়ানের মাথায় আগুন উপচে পড়ে। তার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে। তার কপালে ভাঁজ পড়ে। ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। ক্রুদ্ধ স্বরে বলে, “তুমি ওই জাহানকে ভালোবাসো? মানা করেছিলাম তোমাকে আমি? এখন… এখন তাহলে কী করবে? এখন তো ওর বিয়ে অন্য কারো সাথে হচ্ছে।”
“আমি ব্যাথা পাচ্ছি। ছাড়ো।”
তাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই মহুয়া খামচি বসিয়ে দেয় তার হাতে। এত জোড়ে দেয় সে নখ বসে র’ক্ত বেরিয়ে আসে।
শায়ান সাথে সাথে তার হাত সরিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকায়। বিরক্তির স্বরে বলে, “তুমি আসলেই জংলী। জংলী বিড়াল।”
“আমাকে ব্যাথা দেওয়ার শাস্তি। আর ওই জাহানকেও আমি ছাড়ছি না। ওকে ভালোবেসেছি, ওকেই বিয়ে করে সারাজীবন শাস্তি দিব ওই শালার হনুমান চেঁকামেঁকাকে।”
“হোয়াট! এতকিছু হবার পরও তুমি ওকে বিয়ে করবে?”
“তো? এখন আরেকজনকে ধরে ভালোবাসবো না’কি? আর আমি তোমার মতো না, যে চেষ্টা না করেই নিজের ভালোবাসাকে অন্যকারো কাছে অর্পণ করে দিবে। আর বাহিরে একশোজনকে প্রেমি বিলিয়ে বেড়াবো। এখন আমার সামনে থেকে রফাদফা হও তো।”
“তুমি…”
“গেট লস্ট।”
“তুমি এই জেদ ধরে ভালো করছো না।”
“আমার ভালো খারাপ আমি নিজে দেখে নিবো। তোমার চিন্তা করার দরকার নেই। তুমি বসে বসে নিজের ভালোবাসাকে অন্যকারো হতে দেখো। আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে ফেরত পাবার উপায় ঠিক বের করে নিবো।”
শায়ান অগ্নি দৃষ্টিতে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে তার পাশের দেয়ালে এক ঘুষি মারে। আর সেখান থেকে চলে যায়। মহুয়া আরও বিরক্ত হয়, “শুধু শুধু দেয়ারলে কষ্ট দিলে কেন? আমাকে বলতে হাতটাই কে’টে দিতাম। যত্তসব ঢঙ!”

মৃণা মহুয়াকে কল দিয়ে জানলো সে দোতলায় বসে আছে। হঠাৎ মহুয়া তাকে এত তাড়া দিয়ে ডাকলো এই ব্যাপারটাই তার হজম হচ্ছে না। এর উপর তার কন্ঠও কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছিল।

দোতলা উঠতেই সে দেখা পায় মহুয়ার। সিঁড়িতে বসে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে। মৃণার বুকের ভেতর কামড় দিয়ে উঠলো। সে দৌড়ে যেয়ে মহুয়ার পাশে বসে, “মহু…এই মহু তোর কী হয়েছে?”
মৃণাকে দেখতেই মহুয়া তাকে জড়িয়ে ধরে। তাকে কাছে পেয়ে তার চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে পানি ঝরতে শুরু করে।
মৃণা অস্থির হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে, “কী হয়েছে মহু? তুই কাঁদছিস কেন?”
“তুই যখন আগে ওই ছ্যাঁচড়, খাচ্চড়, ফকিন্নি তন্ময়ের জন্য কাঁদতি তোকে কত বকা দিতাম আমি। বলতাম চোখের ট্যাঙ্কির পানি নষ্ট করছিস। তখন বুঝতাম না প্রেমে কত কষ্ট আছে।”
মৃণা মহুয়াকে তুলে তার মুখে হাত রেখে অস্থির ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করে, “কী হয়েছে তোর? কে তোকে কষ্ট দিয়েছে?”
“ওই শালা জাহানের বাচ্চা ঢ্যাঙঢ্যাঙ করে রশ্মিকে নিয়ে এসে আমাকে বলে ওদের না’কি এনগেজমেন্ট। তো আমি কী ছিলাম? আমাকে তাহলে এত ভালোবাসার রঙ দেখালো কেন? ওভাবে ছেড়ে দিতে?”
“জাহান ভাইয়া! কীভাবে সম্ভব? সারা ভার্সিটি জানে সে তোকে ভালোবাসে। আমি জানি। তার দৃষ্টি দেখেই বুঝা যায়। তুই সামনে থাকলে তার দৃষ্টি অন্যকোনদিকে যায় না। তাহলে কীভাবে?”
“ওই হনুমান চেঁকামেঁকার মাথায় কী চলে আমি কীভাবে বুঝবো? একবার পেয়ে নেই, ওর কাওয়ার বাসার মতো চুল টেনে টেনে ছিঁড়বো।” কথাটা বলে আবার ভাবলো সে, “না থাক ওই হনুমানের চুলগুলো আমার একটু বেশিই পছন্দ।”
“তুই কী বলছিস ভাইয়া কোনো প্রেশারে এসে এমনটা করছে?”
“যতই প্রেশার থাকুক আমার সাথে এসে তো কথা বলবে। নিজের এত মাতব্বরি করতে কে বলেছে? শুন আমি বাসায় যাব। আমাকে বাসায় নিয়ে চল। আমার কিছু ভালো লাগছে না। কিছু ভালো লাগে না আমার।”
.
.
কলিংবেল বাজায় মা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে যেয়ে দরজা খুললেন। মোহকে এত সকালে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে ঘাবড়ে গেলেন। পরক্ষণেই তার মনে পড়লো সমুদ্রসহ মোহ গিয়েছিল বেড়াতে। বেড়াতে বলতে বিয়েতে। হয়তো সেখান থেকে একবারেই এসেছে।
মা হেসে জিজ্ঞেস করে,
“কি’রে তুই একা? জামাইবাবু আসে নি?”

মোহ উওর দেয় না। যেতে নেয় নিজের রুমে। পথে দেখতে পায় মিতা সোফায় পা তুলে ফল খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। সে দুইমাসের প্রেগন্যান্ট। তাই আপাতত বাড়িতে এসে থাকছে। তাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও মিতা তাকে দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠে, “তুই এসেছিস? মানে সমুদ্রও এসেছে নিশ্চিত। বাডির সাথে কতদিন আড্ডা হয় না। ভালোই হলো। ও কোথায়?”

মোহ তার কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজের রুমে ঢুকে পড়ে। তবুও সে পিছিনে যায় মোহের, “আরে তোকে কিছু জিজ্ঞেস করছি। সমুদ্র কোথায়? আসে নি? আসে নি কেন? রাতে আসবে?”
মোহের মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিলো। সমুদ্রের নাম শুনতেই রাগে তার শরীর জ্বলে উঠে। সে চিৎকার করে বলে, “আসবে না আর সে এই ঘরে? হয়েছে? শুনেছ? বের হও এখন এই রুম থেকে।”
এমন চিৎকার শুনে মা’ও ডাইনিং রুম থেকে দৌড়ে আসেন। কথাটা শুনতেই তার মা’য়ের বুকে কু ডাকল। সে দরজাতেই দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,”আসবে না কেন জামাইবাবু? সব ঠিক আছে তো?”
“আসবে না কারণ উনার সাথে আর আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ডিভোর্স দিব আমি তাকে। আমার সাথে সম্পর্ক নেই মানে এই ঘরের কিছু হয় না সে।”
মোহ মিতাকে বের করে দরজা লাগিয়ে দেয় শব্দ করে।
মিতা তবুও বলে, “পাগল না’কি? এত ভালো ছেলে পেয়ে তো ভালো লাগছে না তাই ছাড়তে চাইছিস? স্বর্ণ পেয়ে কদর করছিস না? সমুদ্রের মতো আরেকটা ছেলে পাবি তুই খুঁজে?”
মোহের উওর দিতে ভালো লাগলো না। সে বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়লো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সিলিং এর দিকে। বাহির থেকে তখনও মিতার কন্ঠ শুনছিল সে। তার কিছু ভালো লাগছিলো না। সে নিজের মাথার নিচের বালিশ দিয়ে কানের উপর চেপে ধরলো।

চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠে সমুদ্রের চেহেরাটা তার চোখের সামনে। কী করবে সে। হঠাৎ কী হয়ে গেলো মুহূর্তের মাঝে। তার এত সুন্দর করে মাসের পর মাস গড়ে তোলা সংসার মুহূর্তে উজাড় হয়ে গেল!

ঘন্টাখানিক সময় বাদেই মোহ দরজার ওপাড় থেকে বাবার কন্ঠ শুনে অবশেষে দৌড়ে যেয়ে দরজা খুলে সে। বাবাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে। কিন্তু তার বাবা আজ প্রতিবারের মতো তার মাথায় হাত রাখে না। সে ছোট মুখখানা নিয়ে তার বাবার দিকে তাকায়। আবার তাকে ছেড়ে দেখে সেখানে সমুদ্রও দাঁড়ানো। তাকে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল মোহের, “আপনি এখানে কী করছেন? আপনাকে বলেছি না আপনার চেহেরাও আমাকে দেখাবে না।”
“এটা কেমন ধরনের কথা মোহ। ও তোর হাসবেন্ড হয়।” মিতা বলল।
“তুমি চুপ করো। আমি তোমার সাথে কথা বলেছি?”
তখন বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন, “ওকে আমি এনেছি। আসার সময় দেখি ও বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। হাত কেটে শার্টে র’ক্ত লাগা। কী হয়েছে এমন তোমাদের মাঝে?”
মোহ আবেগহীন চোখে তাকাল সমুদ্রের দিকে, “বাবা তুমি বলেছিলে ছয়মাস সময় দিতে এই সম্পর্কে। ছয়মাস পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন এই সম্পর্ক শেষ করার সময় এসে পড়েছে।”
“তুমি কী বলছ এসব আম্মু? এতমাস দেখেছি তো তোমাদের কী সুন্দর সম্পর্ক ছিলো। কত খুশি ছিলে তোমরা। তোমাদের কোনো ঝগড়া হয়েছে?” মোহের বাবা জিজ্ঞেস করেন। তার মা সাথে সাথে বলেন, “ঝগড়া হলেই কী সম্পর্ক ভাঙতে হবে? বিয়ে কী পুতুলখেলা যে যখন ইচ্ছা তখন বিয়ে ভেঙে দিবে?”
মোহ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, “যে সম্পর্কে বিশ্বাস নেই সে সম্পর্ক মূল্যহীনই।”
“মধু আমার একটু…”
“আপনি বের হন এখান থেকে। আমি আপনার চেহেরাও দেখতে চাই না। আপনি এখান থেকে না গেলে আমি কি করে ফেলবো নিজেই জানি না। গেস্ট লস্ট।” এইবার হুঙ্কার দিয়ে উঠে মোহ। তার এই কাজে সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে৷ তারা কখনো মোহকে এমনটা দেখে নি।

সমুদ্র তার দিকে কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল। তার যাবার পর মিতা বিরক্তি নিয়ে বলল, “তোমরা না বলতে তোমাদের ছোট মেয়ের জ্ঞান বুদ্ধি কত বেশি, ব্যবহার নিয়ে প্রশংসা করতে। এই দেখো ও হতজ্ঞান! নিজের স্বামীর সাথে কেউ এভাবে… ”
“চুপ! একদম চুপ।” মোহের ঝারি শুনে মিতা সাথে সাথে চুপ হয়ে যায়। হতভম্ব হয়ে যায় কিছু মুহূর্তের জন্য। সে আরও বলে, “তুমি আমাকে জ্ঞান দেবার কে? তোমার এক ভুলের কারণে আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। তুমি যে এত স্বাভাবিক ব্যবহার করছো তুমি ভুলে গেছো তুমি কী করেছ? নিজের বিয়ে ছেড়ে প্রেমিকের সাথে পালাতে হলে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে আমাকে ফাঁসাতে গেলে কেন?”
তার মা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল, “মোহ তুই শান্ত হো। দেখ ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নে। সমুদ্র বাবা আসলেই অনেক ভালো। মিতার বাবা তুমি কিছু বলো। মোহ তোমার সব কথা শুনে।”

“এটাই তো সমস্যা।” মোহ দাঁতে দাঁত চেপে তাকায় তাদের দিকে। তার সিক্ত চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে পড়ছে নোনাপানি। রাগে, ক্ষোভে, কষ্টে তার শরীর কাঁপছে। সে কাঁপানো সুরে বলে, “এটাই সমস্যা। ছোট থেকে তোমাদের সব কথা মেনে এসেছি। টু শব্দ করি নি। মোহ এটা করে দে, যা বলেছ তা করেছি। মোহ এভাবে চলবি, সেভাবেই চলেছি। মোহ বিয়ে কর, বিয়ে করেছি। মোহ তোর স্বামী তোকে ভালোবাসে না, তার প্রাক্তনকে ভালোবাসে, তাও ছয়মাস সংসার কর। তাও করলাম। সব করলাম। তোমাদের জন্য, তোমাদের কথায় সব করেছি। তোমাদের সুখের জন্য। এখন তোমরা চাও আমি সারাজীবনের জন্য তার সাথে সংসার করি? আমি কী পুতুল, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নাচাবে? আমার কোনো অনুভূতি নাই?”

সবাই স্তব্ধ হয়ে যায় কিছু মুহূর্তের জন্য। এই বারো বছর তারা কখনো মোহকে কাঁদতে দেখে নি। আর আজ কাঁদতে কাঁদতে সে নিশ্বাস আটকে যাচ্ছে।

মোহ এসে মিতার বাহু ধরে বলল, “আপু তুমি তো ভাইয়ার সাথে ব্রেকাপ করেছিলে তাহলে কেন আবার তার কাছে ফিরে গেলে? কেন বিয়ের জন্য হ্যাঁ বললে তুমি? আচ্ছা আপু তুমি তো ভাইয়ার আগেও কাওকে ভালোবেসেছিলে তাই না? তাকে এত নিখুঁতভাবে কী করে ভুলেছ? আমাকে একটু বলো না! আমি সমুদ্রকে ভুলতে চাই। আমার…আমার প্রতিটি নিশ্বাসের সাথে যে তার অস্তিত্বের আভাস পাচ্ছি সে অনুভূতি মিটিয়ে দিতে চাই। আপু প্লিজ আমাকে শেখাও, আই প্রমিজ তোমাকে মন থেকে মাফ করে দিব। কোনো দাবি রাখবো না। কেবল এতটুকু শিখিয়ে দেও।”
তার নিশ্বাস হঠাৎ ঘন হতে থাকে। সে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নিলে তার বাবা কাঁধ ধরে নেয়, “আম্মু…আম্মু তোমার কী হয়েছে? এমন করছো কেন মামণি?”

মোহ তবুও দাঁড়িয়ে থাকতে পাড়ে না। তার শরীরের সব ভার ছেড়ে নিচে বসে পড়ে মেঝেতে, “বাবা… ও বাবা তুমি কেন আমাকে ওর সাথে থাকতে বললে? আমি যে ওকে।বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসে না। আমার বুকে অনেক কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ আমার বুকের ভেতরের হৃদপিণ্ডটা খামচে ধরে রেখেছে। দেখো আমি নিশ্বাস নিতে পাড়ছি না। আমার প্রতিটি নিশ্বাসে আমি তার অনুভূতি পাই। এই নিশ্বাস নিতেও কষ্ট লাগে আমার। কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসে না কেন বাবা? কেন? আমি তো ভেবেছিলাম সে আমাকে ভালোবাসতে শুরু করছে। ভালোবাসলে তো সে আমাকে বিশ্বাস করতো। তাই না বাবা? তার কাছে না থাকলে আমার বুকে অগ্নিশিখা জ্বলবে প্রতি মুহূর্তে কিন্তু তার সাথে থাকলে আমিই হয়তো থাকবো না। বাবা কেন সমুদ্র এই মোহের ভালোবাসায় ডুবে যায় নি? কেন…?”

মোহের শরীর আরও দুর্বল হয়ে গেল। সে বসেও থাকতে পাড়ছিল না আর। তার মা স্তব্ধ হয়ে যায় মেয়ের এই অবস্থায়। ছোট থেকে মিতার পিছনে তাদের সময়ও চিন্তা ব্যয় করতে হলেও মোহকে নিয়ে কখনো ভাবতে হয় নি। মোহ সবসময় তাদের অনুগত্য মেয়ে। তাকে জেদ করা তো দূরের কথা কিছু চাইতেই দেখে নি। কাঁদেও নি কখনো। সে মেয়ের আজ এই অবস্থা দেখে সে সহ্য করতে পাড়লো না। তার বুকের ভেতর কাঁপতে শুরু করল। এমন কী হয়েছে সমুদ্র ও মোহের মাঝে? যে তার এত শক্ত মেয়েটাও এমন ভেঙে পড়লো? তিনিও
মেয়ের এই দুঃখ দেখে কাঁদতে শুরু করলেন, “আমার ফুলের মতো মেয়ের এই কী অবস্থা হয়েছে? এই শুনো, লাগবে না এই সম্পর্ক। আমার মেয়ের আজ পর্যন্ত আমি কাঁদতেও দেখিনি সেখানে ও এমন ভেঙে পড়েছে।”
সে মোহকে ধরে বলে, “তোর বাবা আজই উকিলের সাথে কথা বলবে না। তুই আর কাঁদিস না। তোকে অন্য ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দিব যে তোকে অনেক ভালোবাসবে দেখিস।”
“মা আমার কারো ভালোবাসা লাগবে না। সে কেন আমাকে ভালোবাসলো না? আমি যে আর কাওকে ভালোবাসতে পাড়বো না। এই জীবনে তো আমি কেবল আমার স্বামীর ভালোবাসা চেয়েছিলাম। এতটুকুও আমার ভাগ্যে নেই? উনাকে ভালোবেসে আমি যে কষ্ট সহ্য করেছি সে কষ্ট আমি অন্যকাওকে দিব না। আমি একা এই জীবন কাটিয়ে দিতে পাড়বো। তবুও উনার সাথে কাটাতে পাড়বো না, আর না উনাকে ছাড়া অন্যকারো সাথে কাটাতে পাড়বো।”

চলবে…