মেঘের খামে পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
5

মেঘের খামে…
পর্ব ৪৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ব্যাকইয়ার্ডের বাস্কেটবল কোর্টে জাহান খেলছিল। ঘামে তার গেঞ্জি ভিজে গেছে সম্পূর্ণ। কিন্তু আজ একবারও বল বাস্কেটে ঢুকছে না। এই কারণে তার খিটখিটে হওয়া মেজাজ আরও বিগড়ে যায়। বিরক্তি নিয়ে সে বলটা ছুঁড়ে মারে পাশের সুইমিংপুলে।

গভীর নিশ্বাস ফেলে সেদিকে এগোয়। একদৃষ্টিতে সুইমিংপুলে বল ভাসতে দেখে নিজেও ঝাপ দেয়। পানির গভীর থেকে উঠে আকাশের দিকে তাকায়। এমন এক সূর্য ডোবা সন্ধ্যাতেই সে মহুয়াকে ওয়াদা করেছিল সে দ্রুত ফিরবে। তার আমানত ফিরিয়ে নিতে। অথচ… হঠাৎ একমাসের মাথায় কত পরিস্থিতি বদলে গেল। মিথ্যা রটে গেল তার সকল কথা। তার সকল ওয়াদা মূল্যহীন হয়ে গেল।

সে নিজের আঙুলে পরা আংটি খুলে আকাশের দিকে ধরলো। দেখলো র’ক্তিমা লালিমা মাখানো আসমানের সৌন্দর্য। বিষাদের দৃষ্টি নিয়ে। বুক চিরে বেরিয়ে আসে একরাশ কাঁপানো নিশ্বাস। সে আংটিটা ফেরত পরতে নিবে এই উদ্দেশ্যে নামাল। চমকে গেল। তার সামনে মহুয়া দাঁড়ানো। সে এক মুহূর্তের জন্য ভাবলো কল্পনা করছে সে। তাই সে আংটি সরিয়ে আবারও দেখলো।
মহুয়া তাকে দেখে হাত নেড়ে উপরে ডাকছে। তার উপর ঠোঁটের কোণে কী মধুর হাসি মাখানো। নিশ্চিত এটা তার কল্পনা, নাহলে মহুয়া তার দিকে তাকিয়ে হাসতো না তাকে সোজা পানিতে ডুবিয়ে মা’রতো। অতি সুন্দর কল্পনা।

মহুয়া তাকে উপরে আসার ইশারা করতেই সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পানিতে থেকে উঠে আসে। মাথা নাড়াতেই কতগুলো বিন্দু বিন্দু জল যেয়ে জমে মহুয়ার মুখমণ্ডলে। তবুও মহুয়ার মুখে একগাল হাসি। তা দেখে জাহান হাসে, এর জায়গায় আসল মহুয়া হলে তাকে অন্যগ্রহেই পাঠিয়ে দিতো। তার মহুয়ার মতো কেউ হতেই পাড়ে না। তার কল্পনার মহুয়াও না। সে মুগ্ধ চাহনিতে তাকায় তার দিকে। হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁতে যাবার পূর্বেই গালে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করে। তার কল্পনাতেও কী মহুয়া তাকে মে’রেছে? কল্পনাতে মানুষ একে অপরকে মা’রতেও পাড়ে?

মহুয়া তার গেঞ্জি ধরে বলে, “এই হনুমানের জাত বংশের নাম খারাপ করা লোক। আমার মুখ কী তোমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি? ঠুস করে মুখ ভিজিয়ে দিলে। ফালতু কোথাকার!”
মহুয়া নিজের ওড়না দিয়ে মুখ মুছে।
জাহান তো ভূত দেখার মতো চমকে যায়।

“তুমি…তুমি সত্যি এখানে?” জাহান অবিশ্বাস্য স্বরে বলল।
“না আমার ভূত দাঁড়ানো। সাধে সাধে তোমাকে গর্দভ বলি?”
“তুমি এখানে কীভাবে?”
“তোমার এসব ঢঙের পিছনের কারণ বের করতে এসেছি। এখন তুমি বলবে না আমার কষ্ট করে বের করতে হবে?”
জাহান সে মুহূর্তে চোখ সরিয়ে নেয় মহুয়ার থেকে তার পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে বলে, “কোনো কারণ নেই। তুমি সকালে যা শুনেছ সব সত্যি। তোমাকে আমি প্রাপোজ করেছিলাম তুমি রাজি হও নি, তাহলে কী আমি সারাজীবন তোমার অপেক্ষা করব না’কি?”
মহুয়া তার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়, তার পথ আটকায়, “কেন তুমি তো বলছিলে তুমি আমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করবে।”
জাহান চোখ নামিয়ে নেয়। তবুও কঠোর গলায় বলে, “আবেগে বলে ফেলেছিলাম।”
“আবেগে? আজ সকালে না বললে সব নাটক ছিলো? তাহলে আবেগ এলো কোথা থেকে?”
“তুমি কী গোয়ান্দাগিরি করতে এসেছ এখানে? এই উদ্দেশ্যে আসলে চলে যাও। তোমার জানার মতো কিছু নেই। দুই সাপ্তাহে আমার এনগেজমেন্ট।”
“এই,” মহুয়া তার গেঞ্জি ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে আনলো। তার চোখে চোখ রেখে নরমসুরে বলল, “তুমি না বলেছিলে দশবছর পরও আমার জন্যই অপেক্ষা করবে?”
জাহান তার চোখে চোখ মেলাতেও পাড়ে না। সে অন্যদিকে তাকায়। মহুয়া আবারও বলে, “দশ বছর পড়ে না। আমি এখনই বলছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি ইয়াজভান জাহান। আজ আমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দিলে এই জীবনে তোমাকে মাফ করব না আমি। তোমার জীবন জাহান্নাম করে দিবো।”

জাহান তাকাল তার দিকে। তার চোখজোড়া কেমন সিক্ত। কাঁপা কাঁপা হাতে সে মহুয়ার গালে হাত রেখে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে,
“তুমি এই পৃথিবীতে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো জান?”
প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে মহুয়া, “এ কেমন প্রশ্ন?”
“বলো না… ”
“আমার পরিবার, মৃণা, মোহ আর তুমি।”
“আর আমি কেবল আমার মা’কে, তোমাকে,বাবাকে আর জিনিকেই ভালোবেসেছি। তুমি ঠিক বলেছ সবকিছুর পিছনে কারণ আছে। যা তোমার জানার প্রয়োজন নেই।” বলে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
মহুয়া তো তার কথার অর্থ কিছুই বুঝে না। মানেটা কী?
সে জাহানের পিছনে গেল। কিন্তু জাহান এর পূর্বেই বাসার ভেতরে ঢুকে গেছে। মহুয়া তার পিছনে বাসার ভেতর ঢুকলেও তার পিছনে গেল না। সে গেল জিনির কাছে। জিনির বাহানাতেই সে বাসায় এসেছে। কলেজ থেকে এসে জিনি কল ব্যাক করার পর মহুয়া তাকে সব ঘটনা জিজ্ঞেস করে। জিনিও এই বিষয়ে কিছু জানে না। তখনই সে নিশ্চিত হয়। ঘরে বিয়ের কথা চলছে অথচ বোন কিছু জানে না আদৌও সম্ভব?

জাহান রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। মাথায় হাত রেখে পায়চারি করতে শুরু করে রুমে। আর গভীর নিশ্বাস ফেলে। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠে। সে কল ধরে না। যেয়ে শাওয়ার নেয়। তখনও ফোন বেজেই যাচ্ছিল। কল আসছেই। জাহান তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়ে দেখে ফোন তখনও বাজছে। আননোওন নাম্বার। সে বিরক্তি নিয়েই কলটা ধরল, “হ্যালো কে?’
” তুই এতক্ষণ কল ধরছিলি না কেন? আমি তো চিন্তায় পড়ে তৈরি হচ্ছিলাম বাড়িতে আসার জন্য। এই’যে বের হচ্ছি।”
কন্ঠ শুনেই মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায় জাহানের, “রশ্মি তোকে আমি বলেছি আমাকে কল দিবি না। আমি সাধে সাধে তোর নাম্বার ব্লক করিনি। তোর কন্ঠ শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই।”
“কিন্তু জাহান আমাদের তো এনগেজমেন্ট… ”
“এনগেজমেন্ট হোক, কিংবা বিয়ে আই ডোন্ট কেয়ার। ব্লাকমেইল করে বিয়ে দিয়ে আমার বাবা আর তোর ফ্যামিলি ভাবছে আমি তোকে আপন করে নিবো? স্বপ্নেও এই কল্পনা বাদ দেও। বিয়ে হলেও তোকে কখনো আমি আপন করবো না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কেবল একজনকেই ভালোবাসবো। তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তাকে পাই আর না পাই তাকেই ভালোবাসবো।”
“তুই কী সত্যি… সত্যি ওই সকালের মেয়েটাকে ভালোবাসিস? আজ সকালে যা কথা হয়েছিলো সব সত্য?”
“সব সত্য। আমি মহুয়াকেই ভালোবাসি। মহুয়াও আমাকে ভালোবাসা শুরু করেছিলো। তুই মাঝখানে না এলে সব সুন্দর মতোন হতো। তুই এসে সব বিগড়ে দিলি। ইউ নো হোয়াট রশ্মি, আমি তোর ওই কান্ডের পর তোকে সহ্য করতে পাড়তাম না। এখন ঘৃণা করি।”
“জাহান!” ফোনের ওপাশ থেকে রশ্মি কাঁদোকাঁদো গলা শোনা গেল, “তুই এটা কীভাবে বলতে পাড়িস? তুই জানিস আমার থেকে বেশি তোকে কেউ ভালোবাসতে পাড়বে না।”
“তুই আমাকে ভালোবাসিস না রে, তোর আমার প্রতি অবসেশন আছে। ভালোবাসা হলে আমার খুশি ছিনিয়ে আমাকে পাওয়ার চেষ্টা করতি না। কয়েকবছর আগে নিজেকে আমার সামনে বিলিয়ে দিতে চেয়ে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করলি। সেদিনের পর থেকে তোর দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা লাগে। সে মেয়ে নিজের সম্মান করতে জানে না তাকে অন্যেরা সম্মান করবে কীভাবে? আর এখন এসব ছলনা করে আমাকে বিয়ের বাঁধনে বাঁধতে চাইছিস? এসব করে ভাবছিস আমি তোকে কখনো ভালোবাসবো? তুই যে মুহূর্তে আমার চোখে তোর জন্য ভালোবাসা দেখতে চাইবি, শুধু ঘৃণা পাবি।”
“আমি কিছু করি নি। আমি তো কেবল তোকে ভালোবেসেছি বিশ্বাস কর। আমি এসব কিছু জানি না। আমি কিছু…”
তার কথা শেষ হবার আগেই কল কেটে দেয় জাহান। রশ্মি আবারও ফোন দিলে দেখে জাহান তাকে আবারও ব্লক করে দিয়েছে। ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। সাথে সাথে কল লাগায় শায়ানকে।
.
.
মৃণা মুরাদের কেবিনে বসে কাজ করছিল। অথচ তার মনোযোগ নেই কাজে। আজকের মহুয়া ও জাহানের কথাই সে ভাবছে। আচমকা কী তুফান এলো তাদের মাঝে।!

হঠাৎ-ই কানে কারো শব্দ পেলো সে, “ম্যাডাম এত ধ্যান সহকারে কী আমায় নিয়ে ভাবছেন?”
সে হতচকিত হয়ে ফিরল সামনে। মুরাদকে দেখে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। আচমকা ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। সে উওর না দেওয়ায় মুরাদ তার চেয়ার ঘুরিয়ে, দুই চেয়ারের হাতলে হাত রেখে ঝুঁকে এলো তার দিকে।
মৃণা হতভম্ব হয়ে পিছিয়ে গেল। পিঠ ঠেকে গেল তার চেয়ারের সামনে।
মুরাদ হাল্কা স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,”কী হলো? আমার কথা না ভাবলে আর কার কথা ভাবা হচ্ছে শুনি?”
এত কাছে আসায় মৃণার নিশ্বাস আটকে গেল। সে মুখ খুলেও কিছু বলতে পাড়লো না।
বহু কষ্টে তবুও কন্ঠ দিয়ে কিছু শব্দ বের করল, “মু…মুরাদ ভাই আপনি…” তবে মুরাদ কথা শেষ হতে দিলো কই? সে মৃণার ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে মৃদুস্বরে বলে, “জামাইকে ভাই বলতে নেই ময়না, পাপ হয়। তোর বাচ্চারা তাদের বাবাকে মামা বলে ডাকলে কেমন শুনাবে বল?”
কথাটা শুনে মৃণা লজ্জায় মিইয়ে যায়। সে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মুরাদের দিকে তারপর ফট করে উঠে পালাতে নিলে মুরাদ তার বাহু ধরে নেয়। বলে, “আচ্ছা এত লজ্জাবোধ করতে হবে না। শুন, তোর জন্য একটা নিউজ আছে।”
“আমার জন্য?”
“হ্যাঁ। তোকে গোল্ডেন স্টুডিও থেকে সিলেক্ট করা হয়েছে। মেইল এসেছিল। তাদের সাথেই কথা বলতে গিয়েছিলাম। তারা বলেছে আপাতত ভোকাল ট্রেনিং করতে হবে কয়েকমাস তারপর তারা তোর এলবাম বের করবে। তোর এলবাম। ভাবতে পাড়ছিস?”

না, মৃণা ভাবতেও পাড়ে না। এতবড় সুযোগ তার হাতে আপনা-আপনি এসে রাখা হবে এই কল্পনাও সে করে নি। যেখানে দু’মুঠো ভাতের জন্য তার কত কাজ করতে হতো সেখানে এত বড় সুযোগের কল্পনাও সে কখনো করে নি। কিন্তু তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটা তার জীবন কল্পনা থেকে বেশি সুন্দর করতে চাইছে। সে কী এটার যোগ্য?

মৃণার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে মুরাদ প্রশ্ন করে, “তুই কী খুশি না?”
মৃণা তার দিকে তাকিয়ে থাকে নরম দৃষ্টিতে, “আপনি এত খুশি কেন মুরাদ ভাই? আমার যত খুশি হবার কথা তার থেকেও বেশি।”
মুরাদ তার গালে হাত রাখে আলতো করে, “কারণ তুই আমার জন্য আমার লক্ষ্য পূরণ করেছিস। তোর স্বপ্ন না পূরণ করা পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না।”
“আমি কীভাবে আপনার লক্ষ্যপূরণ করলাম?”

মুরাদ হেসে তাকে ছেড়ে টেবিলে বসে, “তোর মনে আছে তোর যখন ষোল বছর ছিলো। জন্মদিনে আমাদের বাসায় এসেছিলি। তখন নতুন অনেক কাজ করার চেষ্টা করি। দুইটা ব্যবসা শুরু করেও ব্যর্থ হই। সেদিন আমি অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। কি করবো বুঝছিলাম না। বাবার থেকে টাকা নিয়েছিলাম, ধার নিয়েছি কত জায়গা থেকে। এদিকে বাবার চাকরিও ছিলো না। বাবা মা’কে সারাদিন চিন্তায় দেখে আমার মাথায় সারাদিন চিন্তা ঘুরপাক করতো। তুই মোহ আর মহুয়ার সাথে জন্মদিন পালন করে যাচ্ছিলি তন্ময়ের সাথে সময় কাটাতে। আমি তখন দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভেতরেও ঢুকতে পাড়ছিলাম না। আবারও একটা ব্যবসার ক্ষতি হলো। এতগুলো টাকা নষ্ট। তাহলে কীভাবে তাদের মুখ দেখাবো? তখন তুই এসে আমাকে সালাম দিলি, খোঁজ নিলি, কথাবার্তা বলে যাওয়ার সময় তুই আবার ফিরে এলি। আমি তোকে কিছুই বলিনি কিন্তু তুই যেন কীভাবে আমার মনের হাল বুঝে গেলি। হঠাৎ বললি, ‘জানেন মুরাদ ভাই আমার না স্বপ্ন ছিলো গায়িকা হবো। আমার বলতে আমার মা’য়ের স্বপ্ন ছিলো। সে তো স্বপ্নটা পূরণ করতে পাড়ে নি। আমার একটা স্বপ্ন জীবনের তার স্বপ্ন পূরণ করবো।’ তারপর তোর ওই কাজলকালো চোখ দুটো আমার চোখে রেখে একগালে মনভুলানো হাসি দিয়ে বলেছিলি, ‘আমাদের এই স্বপ্ন পূরণেই আমরা সবচেয়ে বেশি ধ্যান দেই। কিন্তু বাস্তবতার দিক থেকে সবার স্বপ্ন পূরণ হয় না। আমি জানি না আপনার কী স্বপ্ন! কিন্তু আপনার চোখের নিচের কালি, আপনার মুখে চিন্তার রেখা স্পষ্ট আপনার পরিস্থিতি জানান দিচ্ছে। সে স্বপ্নকে পাশে রেখে আপনি যেটাতে সবচেয়ে বেশি ভালো যেদিকে ধ্যান দিন। যে জিনিসে ভালো, তাতে বেস্ট হয়ে যান। হতে পাড়ে, আপনার স্বপ্নটা অপূর্ণ থেকে গেল কিন্তু আপনার চিন্তাটা দূর হয়ে যাবে। লক্ষ্যের পিছনে না দৌড়ে নিজের যোগ্যতা বাড়ান, সফলতা নিজে আপনার কাছে আসবে।’ সেদিনের তোর এক কথা আমি সব ছেড়ে যেটাতে ভালো ওটাতে ধ্যান দিলাম। কম্পিউটারে। সেখান থেকে আমি, সাহিদ, রিয়াজ কম্পিউটারে ক্যাম্পেইন শুরু করি মার্কেটিং এর। তারপর যখন টুকটাক টাকা আসে তখন আমরা তার স্কেল বড় করি। মার্কেটে তখনও যেহেতু আগের ধরন চলছিল ডিজিটাল মার্কেটিং এ ধ্যান দেই। বিদেশি পদ্ধতি ব্যবহার করি। ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করতে শুরু করি। সেখান থেকে আজ এই পর্যন্ত এসেছি।”
মুরাদ নিজের কেবিনে চোখ বুলিয়ে গভীর নিশ্বাস ফেলে। শান্তির এক হাসি তার ঠোঁটে এঁকে বিরাজ করে। সে আবারও মৃণার কাছে যায়। তার চোখে চোখ রেখে বলে, “সেদিনের এই চোখজোড়া, সে মন ভোলানো হাসি কেবল আমার চোখ বন্ধ করলে আজও আসে, তোর শব্দগুলো আমার কানে ভাসে। সে চোখদুটো আমার হৃদয়কে শেষ করে দিলো রে ময়না। তোকে মনে করতে করতে কবে তোর প্রেমে পড়ে গেলাম নিজেও জানলাম না। অথচ ভাগ্য দেখ সেদিন তুইও প্রেমে পড়লি তন্ময়ের। যেদিন মহুয়ার মুখ থেকে এই কথাটা শুনেছিলাম সেদিন আমার বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল যেন। মনে হলো, আমার পৃথিবীটা কেমন উজাড় হয়ে যাচ্ছে।” মুরাদের চোখটা ভিজে এলো এক মুহূর্তের জন্য। তারপর নিশ্বাস ফেলে বলল, “তারপর মনে হলো, ভালোবাসলে যে পাওয়া লাগবে এই নিয়ম তো কোথাও নেই। তোকে নাই পেলাম কিন্তু তোকে খুশি রাখবো। দেখ তাও পাড়লাম না।”

মুরাদ তার দিকে এগোল আরেক পা। তার গালে হাত রাখলো আলতো করে। বুড়ো আঙুল দিয়ে তার গালে আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “তুই এই অর্থ আর রঙয়ের জন্য আমার কাছে আসতে চাচ্ছিস না? বল তো ফর্সা হলেই সুন্দর, কালো হলেই অসুন্দর এই নিয়ম কী সে বলেছিল যে আমাদের তৈরি করেছে? মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছি, মাটিতে মিশে যাবো তখন কী সে মাটি সাদা কালো হয়ে যাবে? একসময় আমি শূন্য ছিলাম, আজ সম্পত্তির মালিক। কিন্তু পরকালে কী এই সম্পদ আমার কোনো কাজে আসবে? ওই পৃথিবীতে যদি ভালো কর্ম করে যেতে পাড়ি আল্লাহ তো সব দিয়েই দিবে। এই পৃথিবীর যদি কিছু নিতে পাড়ি তাহলে আমি ওই পৃথিবীতেও তোকেই চাইবো। আমার ময়নাকে। আমার এই পৃথিবীর আর ওই পৃথিবীর সাথী হবি ময়না?”

মৃণা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সে অনুভব করে তার গাল ভিজে গেছে। কখন ভিজলো সে টেরও পেল না। মুরাদ তার গালের নরম দুঃখটুকু মুছে দিলো আদর করে। মৃদু হেসে বলে, “এত আবেগী হতে হবে না। তোর চোখের পানি আমার কাছে রত্নের থেকে বেশি মূল্যবান। এত সহজে বয়ে যেতে দিবি না। থাক তোর এখনই উওর দিতে হবে না। এই পৃথিবী কেন, ওই পৃথিবীতেও তোর অপেক্ষা করতে আমি রাজি।”
.
.
জাহান বের হয় রুম থেকে। তার চোখজোড়া খুঁজে বেড়াচ্ছে মহুয়াকে। সে বুঝতে পাড়ে জিনির সাথেই মহুয়া এসেছে। কারণ তিসানের সাথে তার কথা হয়েছিল, সে এখনো কাজে। আর জয় তার অনুমতি ছাড়া কখনো মহুয়াকে আনবে না এখানে। তাহলে জিনিই বাকি রইলো। কিন্তু জিনির সাথে এত খাতির হলো কীভাবে তার?”

সে ড্রইংরুমে এসেও মহুয়াকে না পেয়ে আশেপাশে তাকায় ইতস্ততবোধ করে।
“জাহান আব্বা কাওকে খুঁজছো?”
জাব্বির চাচা জিজ্ঞেস করলেন। স্বভাবতই নরম কন্ঠেই।
জাহান গলা পরিষ্কার করে জিজ্ঞাসা করলো, “চাচা জিনিকে দেখছি না।”
“জিনি মামণি? মামণির এক বান্ধবী আইসে। খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়৷ নিজের কফি বানাইতেছে। চিন্তা করেন আব্বা জিনি মামণি নিজের জন্য পানি নিয়ে কখনো খায় নি আর সে কফি বানায়। ভাবা যায়?”
আসলেই ভাবা যায় না। যে জিনি মহুয়াকে সহ্য করতে পাড়তো না, সে মহুয়ার জন্য কফি বানাচ্ছে?

জাহান ভাব নিয়েই যায় রান্নাঘরে। যেয়ে দেখে মহুয়া সহ কতগুলো হেল্পার খুবই ধ্যান সহকারে ঝুঁকে চুলার কাছে কিছু দেখছে। এই দৃশ্য দেখে এগোল জাহানও। দেখার জন্য, আসলে কি হচ্ছে। সে এগিয়ে দেখে জিনি চামচে চিনি নিচ্ছে। একদম পরিমাণ সহকারে। এমনই পরিমাণ করছে যে দুইটা চিনির দানা বেশি লাগায় চামচে থেকে সরাচ্ছে আবার কম লাগায় উঠাচ্ছে। এমন সার্কাস দেখে জাহান আফসোসে চোখ বন্ধ করে নিলো। সে এগিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর কফি বানানো দেখি যুদ্ধের রণনীতি ভাবার থেকেও বেশি কঠিন।”
তাকে দেখে সবাই তাকাল তার দিকে। সে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে এগিয়ে বলল, “তোর করতে হবে না। আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”
একজন হেল্পার বলল, “স্যার আপনি…আপনি কেন করবেন? আমরা আছি তো।”
জাহান তার দিকে তাকাল সরু দৃষ্টিতে। মুখে বলাও লাগলো না, তারা বুঝে গেল এখন কথা বলা তাদের জন্য উপকারী নয়।

তারা সরে গেল। মহুয়া জিনিকে ইশারা দিতেই সে জোরেই বলে উথলো, “আচ্ছা ভাইয়া তুমিই তাহলে কফি বানাও। জানো মহুয়া ভা…আই মিন আপু ভাইয়া অনেক মজার কফি বানায়। ভাইয়া একটা কফিশপে কাজ করেছিল দেড় বছর। ওহ আমি তো ভুলেই গেছি, আমার একটা ড্রেস পাচ্ছি না। গতকাল থেকে। সবাই একটু এসে আমাকে খুঁজে দিতে হেল্প করবে প্লিজ?” সে সব হেল্পারদের বলল। সেখানে ছিলো তিনজন। দুইজন তার সাথে যেতে চাইল। আরেকজন থাকতে চাইলো জাহানকে সাহায্যের জন্য। জিনি আবারও বলল, “ভাইয়া তো সব পাড়েই আমি এখনও ছোট না? আমার খেয়াল রাখবে না তোমরা?”
তার এমন ওভার এক্টিং দেখে মহুয়ার হাসি পেল খুব। সে বহু কষ্টে হাসি আটকাল।
জিনি অবশেষে সবাইকে নিয়েই গেল। ড্রইংরুম থেকে জাব্বির চাচাকেও নিয়ে গেল।

সবাই যাওয়ার পর মহুয়া গেল জাহানের কাছে। সে যে কাউন্টারে কাজ করছিল তার মুখোমুখি হয়ে বসল কাউন্টারের উপর। পা দুলিয়ে দুলিয়ে দেখলো জাহানকে। পেস্তা রঙের শার্ট আর ক্রিম রঙের প্যান্ট পরেছে সে। শার্টের হাতা বটানো। চুল ভেজা, পানি পড়ে তার শার্ট ভিজে গেছে পিছনে কিছুটা। এক ঢোক গিলে মহুয়া। আজ কী একটু বেশিই সুদর্শন লাগছে না’কি? মনে মনে শাঁসালো নিজেকে। কীসব ভাবছে সে! মহুয়া তাকে ধরল না, কিছু বললও না। তার দিকে তাকিয়ে রইলো। কখনো ডান পাশে ঝুঁকে তাকাল, তো কখনো গালে হাত রেখে তাকাল।

এতটুকুতেই বুকের ভেতরটা এলোমেলো হয়ে গেল জাহানের। সে জানে মেয়েটা ইচ্ছা করে এমন করছে। তাকে জ্বালানোর জন্য। সে চাইল না তাকাতে। কিন্তু ত্রই বেহায়া চোখজোড়া লুকিয়ে দেখছিলো তার সামনে বসা পুতুলটাকে। সকালের কমলা রঙের জামাটাই পরা। চোখে নীল কাজল দিয়েছে সকাল থেকেও গাঢ় করে। একটি ছোট টিপও পরেছে যা সকালে ছিলো না। সকালে সোনালী ছোট দুল পরেছিল ফুলের মতো, এখন আরেকটু বড় কানেরদুল পড়েছে। তবে হাতটা খালি। তার দেওয়া রিংটা পরে থাকলে পরিপূর্ণ লাগতো। তার ভাবনার মাঝেই মহুয়া বলে, “আমাকে রিংটা ফেরত দেও তো। সকালে আবেগের ঠেলায় দিয়ে দিয়েছিলাম।”
কথাটাই জাহান তার বিটিং মেশিন বন্ধ করে। মনে খুশিতে সে আধখানা হলেও মুখ একবিন্দুও খুশি দেখাল না। রোবটের মতো তার মানিব্যাগ থেকে রিংটা বের করে। মহুয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।

মহুয়া রিংটা আবারও তার আঙুলে পরে দেখায় জাহানকে। জিজ্ঞেস করে, “দেখো মনে হয় না এই রিং আমার হাতের জন্যই তৈরি হয়েছে। আন্টির চয়েজ ভালো মানতে হবে।”
জাহান কথাটা মানে, এই রিং যেন তার মা মহুয়ার জন্যই বানিয়েছিল। সে লুকিয়ে মুচকি হাসে কথাটা ভেবে।
মহুয়া বলে আফসোসের সুরে, “কিন্তু আমি তো আর এটা রাখতে পাড়ব না। ফেরত দিতে হবে তাই না?”
জাহান ভারী স্বরে উওর দেয় সাথে সাথে, “না।”
“কিন্তু এটা তো আন্টি তোমার জীবনসঙ্গীর জন্য রেখে গেছে তাই না? তুমি তো অন্যকাওকে বিয়ে করে ফেলবে।”
খুবই আফসোসের সুরে বলল মহুয়া। পরক্ষণেই আবার লাফিয়ে জোর গলায় বলল, “থাক তাতে কী আমিও তো আরেকজনকে বিয়ে করবো।”বলে তাকাল জাহানের দিকে। তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। অথচ জনাবের কোনো রিয়েকশন নেই। সে কপাল কুঁচকায়, ” কী হলো? কিছু বলছো না কেন? আমি বলেছি আমি অন্যকাওকে বিয়ে করবো।”
“অবশ্যই করবে। সারাজীবন তো আর সিঙ্গেল থাকবে না। এটাই স্বাভাবিক।”
“স্বাভাবিক? আমি অন্যকাওকে বিয়ে করাটা এখন তোমার কাছে স্বাভাবিক? সেদিন তো রাগে তোমার মাথায় র’ক্ত উঠে হিয়েছিল।”
“তখন তো আমার মনে হয়েছিল তুমি কেবল আমার, কিন্তু…. ” জাহান এক ঢোক গিলল। হতাশার নিশ্বাস ফেলল। কথাটা আর সম্পূর্ণ করল না। কফি বানানো শেষ। সে মগটা মহুয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নেও। হয়ে গেছে।”

মহুয়া রাগে দাঁত পিষলো। রাগে, ক্ষোভে জাহানের শার্টের কলার ধরে টেনে নিজের কাছে আনলো। রাগে উঁচু স্বরে বলল, “এই হনুমানের বাচ্চা তোর হয়েছেটা কী? তোর এতশত ভাব কোথায় উড়ে গেল। আমাদের যখন প্রথম দেখা হয়েছে তখন এত তেজ ছিলো তোর চোখে সে তেজ কোথায় গেল? আজ আমার সাথে মিনমিনে সুরে কথা বলছিস? অন্যের ভয়ে নিজের ভালোবাসা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছিস? মানুষ শুনে হাসবে যে মহুয়া এমন এক ভিতুর ডিমের সাথে প্রেম করেছে।”
জাহান তবুও শীতল ভাব বজায় রেখে বলল, “তুমি কফি নেও, আমার একটু কাজ আছে।”
মহুয়া ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। আবার তার হাতে কফির দিকে। সে রাগে জাহানের হাতের মগটা এত দ্রুত ধরে কাউন্টারে রাখে যে দুইজনের হাতে গরম কফি পড়ে যায়। আবারো তাকায় সে জাহানের দিকে, “আমাদের কথা শেষ হয় নি। তুমি আমার কথা এড়াতে পাড়বে না।”

কিন্তু জাহানের ধ্যান সম্পূর্ণ তার হাতের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকে সে। মহুয়ার ফর্সা হাতটা লালচে হয়ে গেছে গরম কফির ছোঁয়া লাগতেই। মুহূর্ত গড়াতেই তার মেজাজ বিগড়ে যায়৷ সে মহুয়ার হাত খপ করে ধরে তাকায় তার দিকে। অগ্নিদৃষ্টিতে, “আর ইউ ম্যাড? নিজের হাতের কী অবস্থা করেছ তুমি?” জাহান রাগে গর্জে উঠে।
“তোমাকে কেউ চিন্তা করতে বলে নি। যাও যেয়ে নিজের হবু বাগদত্তার চিন্তা করো। এসব ঢঙ করতে হবে না আমার সামনে।”
সে জাহানকে ধাক্কা দিলে জাহান উলটো তার হাত ধরে নেয় শক্ত করে, “চলো, হাত পানির নিচে রাখতে হবে।”
“যাব না আমি।”
“জেদ করো না।”
“আমার জেদ কেমন তা জেনেই প্রেমে পড়েছিলে।”
“পড়ে জায়গাটা জ্বলবে।”
“জ্বলুক। জ্বলে, পুড়ে শেষ হয়ে যাক। তোমার কী?”
জাহান কিছুক্ষণ রাগাবুন্ড হয়ে তাকিয়ে রইলো মহুয়ার দিকে। তারপর একহাত দিয়ে তার কোমর ধরে উঠিয়ে নিয়ে গেল সিঙ্কের কাছে। সেখানে তাকে আবারও কাউন্টারে বসিয়ে পানি ছেড়ে তার হাত পানির নিচে রাখতে নিলেও মেয়েটা শান্ত থাকে না ধাক্কাধাক্কি শুরু করে। কিছুতেই হাতে পানি দিবে না। ধাক্কা দিয়েও যখন জাহানকে সরাতে পাড়ে না তখন তার বুকে খামচি বসায় নিজের সব শক্তি দিয়ে, “ছাড়ো। আমার চিন্তা তোমার করা লাগবে না।” রাগে তার সম্পূর্ণ মুখ লাল হয়ে যায়।
তবুও জাহান তাকে ছাড়ে না। সে তাকায় না মহুয়ার দিকে। কিন্তু তার চোয়াল শক্ত। রাগে তার মাথার রগ ফরফর করছে।
মহুয়া যখন দেখলো খামচি দিয়েও কাজ হয় না তখন তাকে হাত সরিয়ে নেয়। তার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার ব্যাথাতে কষ্ট পাও তাই না? ঠিকাছে। এখন ঠান্ডা পানি দিয়ে শান্ত হও। এই হাত আবার তোমার সামনে পোড়াব।”

কথাটা শুনেই জাহান তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সে মহুয়ার কোমর থেকে হাত সরিয়ে তার ঘাড়ে রাগে। তার মুখ নিজের কাছে নিয়ে আসে একদম। রাগে তার চক্ষুজোড়া রক্তবর্ণ হয়ে গেছে। সে কাঁপানো নিশ্বাস ফেলে জোর গলায় বলে, “তোমার সাহস কত হলে আমার জানে আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করছো।”
মহুয়ার চোখেও একই তেজ। সে চোখের পলকও ফেলে না, “অনেক সাহস আছে। চাইলে পরীক্ষা করে দেখতে পাড়ো। দেখবে?”
জাহান রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

মহুয়া তার দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। তেজি, রাগান্বিত দৃষ্টি। সে ক্রুদ্ধ স্বরে নিজের কথা রাখে, “প্রথমে নিজের ভালোবাসায় বাঁধার জন্য পাগল ছিলে, এখন যখন তোমার ভালোবাসায় ডুবেছি তখন দূরে সরানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছ? দূরে সরানোর চেষ্টা করলে নিজের সাথে তোমাকেও নিঃস্ব করে দিব। যে মুহূর্তে তোমার ভালোবাসাকে আপন করেছি সে মুহূর্ত থেকেই তুমি আমার। আর আমারই থাকবে বুঝেছ?”

জাহান তাকিয়ে থাকে তার দিকে৷ মহুয়ার চোখে পানি টলমল করছে কিছু কিছুতেই মেয়েটা সে একবিন্দু জলও পড়তে দেয় না। তার সারা মুখ লালচে হয়ে গেছে কান্না আটকে রাখতে গিয়ে। এই চোখের পানি যেদিন সে প্রথম দেখেছিল সেদিন তার বুক কেঁপেছিল। আর আজ তার জন্য আবারও এচোখে পানি ভরেছে এই ব্যাপার তার সহ্য হলো না। সে দাঁতে দাঁত চেপে ঘন কাঁপা নিশ্বাস ফেলে। সে মহুয়ার চুলে হাত রেখে তাকে কাছে টানে। তার কপালে কপাল ঠেকায়। তার নিশ্বাস মিশে যায় মহুয়ার উষ্ণ নিশ্বাসে। মৃদুস্বরে বলে, “প্লিজ জান এমন করো না। আমি নিজেকে সামলাতে পাড়বো না। আমি সব সামলান দিয়ে উঠতে পাড়লে তোমার কাছেই আসবো। তোমাকে ছাড়া আমি শূন্য। তোমার সাথে থাকা প্রতি মুহূর্ত আমাকে শান্তি দেয়। কিন্তু প্লিজ আমার অপেক্ষায় থেকো না। আমি কীভাবে কী করবো নিজেও জানি না এখন পর্যন্ত।”
“কী সমস্যা আমাকে বলো, আমি সব সমাধান করবো।”

জাহান তার চুলের ভেতর থেকে হাত সরিয়ে পিঠে রাখে। আর মাথা রাখে তার কাঁধে। চোখ বন্ধ করে তাকে আরেকটু গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে, “এটাই তো সমস্যা। তুমি সব নিজে করতে চাও। এই’যে তুমি এখানে এলে না ভেবেই। হতে পাড়ে এভাবে আমি তোমাকে শেষ ধরতে পাড়বো। তাই আরেকটু অনুভব করে নেই তোমায়।”

চলবে…

মেঘের খামে…
পর্ব ৪৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

জাহান তার চুলের ভেতর থেকে হাত সরিয়ে পিঠে রাখে। আর মাথা রাখে তার কাঁধে। চোখ বন্ধ করে তাকে আরেকটু গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে, “এটাই তো সমস্যা। তুমি সব নিজে করতে চাও। এই’যে তুমি এখানে এলে না ভেবেই। হতে পাড়ে এভাবে আমি তোমাকে শেষ ধরতে পাড়বো। তাই আরেকটু অনুভব করে নেই তোমায়।”

“জাহান আব্বা তুমি কী করতেছ এসব?” জাহান জাব্বির চাচার কন্ঠ শুনে গভীর নিশ্বাস ফেলে। মহুয়ার কাঁধ থেকে মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। তার গালে হাত রেখে বলে, “পাড়লে আমাকে ভুলে যাও। তোমার জন্যই ভালো হবে। ভেবে নেও আমি তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি। ঘৃণা করো আমাকে। তবুও ভুলে যাও।”
মহুয়ার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে এক ঢোক গিলল জাহান।

সে জাব্বির চাচাকে বলল, “চাচা একটা গাড়ি ঠিক করুন। ওর বাসায় দিয়ে আসতে। আর ও বাসায় এসেছে এটা যেন বাবা না জানে।”
“জাহান আব্বা তুমি…”
“যা বলেছি, তা করুন।” জাহান আদেশের সুরে বলল।
জাহান মহুয়ার দিকে তাকাল। সে এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কাজলমাখা চোখজোড়া ছোট হয়ে আছে, কপালে ভাঁজ পড়েছে হাল্কা। যেন তাকে পড়ার চেষ্টা করছে। বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু জাহান তাকে কিছুই বোঝার সুযোগ দিলো না। তাকে কোলে করে নামিয়ে সবার সামনে দিয়ে নিয়ে গেল বাহিরে।

বাড়ির সব হেল্পাররা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকল তাদের দিকে। জাহান কারো দিকে তাকাল না, মহুয়ার দিকেও না। তাকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। তার ওড়নাটা যত্ন সহকারে তার কোলে রেখে তাকাল তার দিকে, “সাবধানে যেও।” বলে সরে যেতে নিলে মহুয়া তার হাত ধরে নেয়। তার মুখের দিকে তাকাতেই বুকে ব্যাথা উঠে যায় জাহানের। মহুয়াকে দেখে মনে হচ্ছে তার কান্না পাচ্ছে খুব করে। বহু কষ্টে এই কান্না আটকে রেখেছে সে। আশাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

তবে জাহান খুব নির্দয়ভাবে তার আশা ভেঙে হাতটা সরিয়ে সে হাতে চুমু খেয়ে তাকাল তার দিকে। দু’জনের চক্ষু মেলল। বুকে কষ্টের জোয়ার বইল। তবুও সহ্য করল। জাহান গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিলো। তাকিয়ে রইলো গাড়িটি প্রবেশপথ দিয়ে না বের হওয়া পর্যন্ত।
.
.
দরজা দিয়ে শায়ান ঢুকতেই রশ্মি কান্নামাখা অবস্থায় দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে।

শায়ান এক মুহূর্তের জন্য অবাক হলেও রশ্মির কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “তুই কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে?”
“তুই…তুই মিথ্যা বলেছিস কেন আমার সাথে?” কান্নায় তার নিশ্বাস আটকে আসে যেন।
“আমি কী মিথ্যা বললাম?”
“তুই বলেছিলি জাহান কাওকে ভালোবাসে না। কিন্তু জাহান নিজে আমাকে ফোনে বলল ও একটা মেয়েকে ভালোবাসে। আমাকে বলল আমি যা-ই করি না কেন ও কখনো আমাকে আপন করবে না।”

রশ্মি শায়ানকে ছেড়ে তার দিকে তাকাল, “জাহান জানে, আমার থেকে বেশি কোনো মেয়ে ওকে ভালোবাসতে পাড়বে না। তাহলে কেন আমাকে এত কষ্ট দেয়। ও কেন অন্য মেয়েকে ভালবাসলো? তুই কেন আটকালি না? তুই বলেছিলি জাহান অন্যকাওকে ভালোবাসতে পাড়বে না। ওর একমাত্র ভালোবাসা আমিই হবো। তাহলে এখন কেন এমন হলো?” বলে হঠাৎ থামে সে। হঠাৎ তার মাথায় কিছু আসে। এই উপলব্ধি করে চমকে তার কান্নাও বন্ধ হয়ে যায়। সে শায়ানের দিকে তাকায় চিন্তিত দৃষ্টিতে, “জাহান অন্যকাওকে ভালোবাসে, সে এই বিয়েতে নিজ ইচ্ছায় রাজি হয় নি। তাই না?”

শায়ান রশ্মিকে বসিয়ে শান্ত করে। তার জন্য একগ্লাস পানি এনে বলে, “তোর এত চিন্তার দরকার নেই।”
“আছে। অবশ্যই আছে। তুই আর ভাই আমাকে বলেছিলি তোরা জাহানের সাথে কথা বলেছিস। তাকে ভিডিও দেখিয়েছিস, যেখানে আন্টি চাইছিল আমার আর জাহানের বিয়ে হোক। আর জাহান রাজি হয়েছে।”
“এটা সত্যি…”
“না, এটা মিথ্যা। যদি জাহান কাওকে ভালো না বাসতো তাহলে এই কথা আমি নিমিষেই মেনে নিতাম। কিন্তু ও যদি কাওকে ভালোবাসে তাহলে এই কথায় ও কখনো রাজি হবে না।”
“এসব নিয়ে তোর ভাবার প্রয়োজন নেই।”
“যদি ও আমাকে ছেড়ে মেয়েটার কাছে চলে যায়?”
“যাবে না।”
“তুই কীভাবে এত শিউর?”
এর উওরে শায়ান কিছু বলে না। রশ্মি এবার গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে তাকায় শায়ানের দিকে, “জাহান কী অনেক কষ্ট পাবে?”
“ভুলে যাবে কয়দিনে। এসব খানিকের আবেগ মাত্র।”
“আর ওই মেয়েটা?”

এই প্রশ্নে শায়ান তাকায় তার দিকে। তার চোখে এইবার চিন্তা ফুটে উঠেছে। সেদিনের মহুয়ার সিক্ত চোখজোড়া তার চোখের সামনে ভাসে। বুক কেঁপে উঠে তার অজান্তেই। বারবার তার কানে শব্দ আসে, “তুমি বসে বসে নিজের ভালোবাসাকে অন্যকারো হতে দেখো। আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে ফেরত পাবার উপায় ঠিক বের করে নিবো।”
শায়ান কিছু একটা চিন্তা করে দীর্ঘ সময় পর উওর দেয়, “ওর ব্যাপারটা আমি দেখে নিব।”
.
.
দরজায় নক পড়ে। মিতা খানিকটা দরজা খুলে দেখে মোহকে। বাতি বন্ধ। সে শুয়ে আছে বিছানায়৷ চুল এলোমেলো, চোখের নিচে কালি পড়েছে সদ্য, ঠোঁটগুলো ফেঁটে গেছে৷ মিতা এসে তার রুমের বাতি জ্বালায়। তার পাশে বসে বিছানায়৷

মোহ উঠে না। তার ইচ্ছা করছে না মোটেও। মিতা তার পাশে বসে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে, “আমাকে মাফ করতে পাড়বি মোহ?”
মোহ এবার তাকায় তার দিকে। এতক্ষণে।
মিতা আবারও বলে, “সত্যিই আমি জানতাম না এতকিছু হয়ে যাবে আমার এক ভুলে। বাবা তোকে আমার জায়গায় বিয়ে দিবে কখনো কল্পনাও করিনি। বাবা তো আমাদের পড়া শেষ হওয়ার আগে বিয়ে দেওয়ার বিরোধে ছিলো সবসময়। এরপর যখন তোর সমুদ্রের সাথে বিয়ে হলো আমি ভেবেছিলাম ভালোই হয়েছে৷ সমুদ্র অনেক ভালো ছেলে। ভেবেছিলাম আস্তে-ধীরে যা সমস্যা আছে সব সমাধান হয়ে যাবে। তোরা যখন আসতি তখন তোর চোখে ওর জন্য ভালোবাসা দেখতাম। একসময় ওর চোখেও তোর জন্য সে ভালোবাসা…”
এখানেই মোহ তাকে থামিয়ে দেয়, “তোমার কথা শোনার ইচ্ছা হচ্ছে না। বের হও।”
“আমাকে কী মাফ করে দিবি মোহ? তুই আমাকে ক্ষমা না করলে এই অপরাধবোধ আমাকে শান্তি দিবে না।”
“আমি কাওকে ক্ষমা করতে জানি না আপু। কেবল একজনকে ক্ষমা করে শিখেছিলাম, সে এর ভয়ানক পরিণতি দেখিয়েছে।”
মিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “সে বাহিরে দাঁড়ানো। তোর ফোন বন্ধ। অবশেষে না পেড়ে আমাকে কল দিয়েছে।”
এতটুকু বলে মিতা চলে যায়।

মোহ উঠে যায় বারান্দায়। দেখে সামনের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। বিহ্বল অবস্থা। গতকালের শার্টও পালটে নি। হাতে এখনো একই রুমাল বাঁধা। তাকে দেখেই বুকের ভেতরটা কামড়ে ধরল তার। আবারও কান্না পেল। কিন্তু গতকালের কথা মনে করতেই বুকের ভেতর ব্যাথার পরিবর্তে উপচে পড়লো একরাশ ক্ষোভ। সে বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে তেড়ে বের হয় বাহিরে। দরজা খুলে বের হতেই সমুদ্র দৌড়ে আসে তার কাছে। দৌড়ে এসে তার হাত ধরতে নিলেই মোহ পিছিয়ে যায়। হাত উঁচু করে থামায় তাকে, “আমাকে ছুঁবেন না বলে দিচ্ছি। আর আপনি এখানে কী নাটক করছেন? সকাল থেকে এই অবস্থায় আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে কী প্রমাণ করতে চাইছেন?”
“মধু আমি তো…”
“প্লিজ এই নামে ডাকবেন না। আপনার মুখে এই নাম শুনতে আসলে আমার মধুর মতো লাগতো, এখন বিষের মতো আমার বুকে গাঁথে। আপনি যান এখান থেকে। আমি আপনার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে ইচ্ছুক না।”

কথাটা কানে যেতেই সমুদ্র দৌড়ে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাইল। কিন্তু তাকে ছুঁয়ে দেখার শান্তিও দিলো না। দূরে সরে গেল। সমুদ্র তবুও তার হাতটা ধরে নিলো। তার হাত ধরে নিচে বসে আকুতি করে বলল, “মধু প্লিজ মাফ করে দেও। তুমি আমাকে একশোবার থাপ্পড় মারো। যা ইচ্ছা তা করো আমি উফফ পর্যন্ত করবো না কিন্তু এভাবে দূরে থেকো না আমার কাছ থেকে। আমি ম’রে যাব। তোমাকে ছাড়া এই জীবন আমি পরিকল্পনাও করতে পাড়ি না।”

মোহ তাচ্ছিল্য হাসল, “আপনার ভালোবাসার মানুষ ছেড়ে যাওয়ায় ম’রেন নি। আমি তো তুচ্ছ একটা মানুষ। যার আপনার জীবনে কেবল এতটুকু জুড়ে আছে যাকে বিশ্বাসও করা যায় না।”
“না মধু। প্লিজ এভাবে বলো না। সে মুহূর্তে আমার কি হয়ে গিয়েছিল আমি নিজেও জানি না। এক মুহূর্তের ভুলের জন্য আমাকে এত বড় শাস্তি দিও না। তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।” সমুদ্র উম্মাদের মতো কতগুলো চুমু খেলো মোহের হাতে। মোহ সাথে সাথে হাতটা সরিয়ে নেয়।
“এখানে এসব নাটক করবেন না। ওখানে এত লোকের সামনে আমার অসম্মান করে আপনার শান্তি হয় নি? এখন এলাকায় এসব নাটক করে আমাকে কলঙ্কিত করতে চান? হাসির পাত্র করতে চান?”

সমুদ্র সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যায়। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “আমি…. আমি তোমআকে কলঙ্কিত করতে চাই? তোমার সম্মান আমার জীবন থেকেও বেশি মূল্যবান।”
“এসব কথা শুনে, বিশ্বাস করে, এর পরিণামও দেখেছি। আপনি এখানে এভাবে দিনরাত দাঁড়িয়ে থেকে মানুষের সামনে আমাকে হাসির পাত্র বানাবেন না। ক’দিন বাদে মানুষের মুখে এমনিতেই আমার নামের চর্চা হবে। দোষ যারই হোক, ডিভোর্স হলে দোষী তো মেয়েই হয় তাই না?”

সমুদ্র তার দিকে তাকায় শূন্য দৃষ্টিতে, “যেদিন আমি ম’রে যাব সেদিন নিজেকে মুক্ত ভেবো। আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুমি আমারই থাকবে। আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব না।”

মোহ বিরক্তি নিয়ে চোখ সরিয়ে নেয় তার থেকে, “আপনি বলেছিলেন আমি যা বলব তাই করবেন?”
“কেবল তোমার থেকে দূর হবার কথা বাদে।”
“তাহলে এখান থেকে যান। কোনো তামাশা করবেন না। বাসায় যেয়ে ফ্রেশ হবেন। তারপর হাস্পাতালে যেয়ে নিজ…নিজের হাত ব্যান্ডেজ করাবেন।”
“তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পাড়বে মধু?”
এই প্রশ্নে মোহ তাকায় তার দিকে। খানিকটা হাসে, “আমার মন একবার কারো উপর উঠে গেলে কতটা শক্ত হতে পাড়ে তা আপনার জানা নেই।”
“আমি যে তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পাড়বো না।” সমুদ্র বলে। কেমন কাঁপানো তার স্বর।
“অবশ্যই পাড়বেন। আমি ভালোবাসা হারিয়ে বাঁচতে পাড়লে আপনার জন্য তো ব্যাপারটা খুব সহজ। আমি তো কেবল আপনার অভ্যাস। মানুষ অভ্যাসের দাস। আমি হারিয়ে গেলে অভ্যাসও ছুটে যাবে।”
সমুদ্র কাঁপানো নিশ্বাস ফেলে বড় করে। সিক্ত চোখে তাকায় মোহের দিকে। কিছু বলতে চায় কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বের হয় না।

কিন্তু মোহ স্পষ্ট বলে, “প্লিজ চলে যান। আপনার চেহেরা দেখতেও আমার কষ্ট লাগে।”
“তুমি যা বলবে।” থেমে আবার বলে, “যাওয়ার আগে একবার কী তোমায় জড়িয়ে ধরতে পাড়ি?” সিক্ত গলায় তার আবদার।
“না।”
সমুদ্র মাথা নাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। থেমে আবারও পিছনে তাকায়। মোহ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার গালে নোনা দুঃখ। সে জানে, মোহের বুকেও তার মতো কষ্টের জোয়ার বইছে৷ হয়তো আরও বেশি। সে এটাও জানে, মোহ কেবল তাকে না, নিজেকেও শাস্তি দিচ্ছে। তার ছোঁয়া না পাওয়া পর্যন্ত তার শান্তির ঘুম হবে না। সব জেনেও নিজেকে শাস্তি দিচ্ছে। তাকে ভালোবাসার শাস্তি?

সে গভীর নিশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাল। তার বুকে প্রচন্ড ব্যাথা করছে। এখনই এই হৃদপিণ্ডটা কাজ করা বন্ধ করে দিবে। কান্না পাচ্ছে খুব। নিজেকে অসহায় লাগছে। ইচ্ছে করছে সময়ের কাঁটা ঘুরিয়ে আবারও দু’দিন আগে ফিরে যেতে যখন সে রাতে তার মধুতে বুকে আঁকড়ে ধরে তাকে অনুভব করতে পাড়তো। এমন নিশ্বাস আটকে ফেলার অনুভূতি হচ্ছে কেন তার? তার হৃদয় কী কোনো একভাবে জানে সে তার মধুকে হারিয়ে ফেলছে?
.
.
মহুয়া বসে আছে বিছানার এককোণে। চিন্তা করছে কিছু গভীরভাবে। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠে। সে তাকায়। শায়ান মেসেঞ্জারে কল দিচ্ছে। সে দেখেও উঠায় না। বারবার কল দিলে বিরক্ত হয়ে কেটে দেয়। অবশেষে তারই একটা মেসেজ দেখতে পায়, “জাহানের ব্যাপারে কথা বলবো।”

সাথে সাথে মহুয়া কল দেয় তাকে।
“হ্যালো…”
“কল ধরছিলে না কেন?”
একথায় বিরক্ত হয় মহুয়া, “তোমাকে এড করার সময়ই বলেছিলাম বিড়ালছানাগুলোর ভিডিও দেওয়া বাদে আজাইরা কোনো কথা বলবা না।”
“আচ্ছা? ঠিকাছে রাখছি তাহলে।”
“এত ঢঙ না করে বলো কী বলবে জাহানের ব্যাপারে।”
“কালকে সকালে দেখা করো। তখন বলবো।”
“তোমার সাথে দেখা করার শখ আমার নেই। ফোনে বলো।”
“লাগবে না তোমার কিছু জানা।”
“ওয়েট…আচ্ছা ঠিকাছে দেখা করবো। কখন আর কোথায় আসবো?”
“সকাল সাতটায় ভার্সিটির ছাদে আসবে।”
“এত সকালে তোমার চাচা ভার্সিটি খুলবে?”
“আমি বললে রাত তিনটায়ও খুলবে।”
.
.
অফিসের কাজ সেরে মৃণাকে মুরাদ নিয়ে এসেছে গোল্ডেন স্টুডিওতে। তারা প্রধানত এসেছে মৃণার পরিচয় করাতে গোল্ডেন স্টুডিও এর সি.ই.ও আশরাফের সাথে।
গাড়ি থেকে নেমে মৃণা দাঁড়িয়ে ছিলো। মুরাদ পার্ক করেই এসে পড়বে। এমন সময় তন্ময়ও আসে সেখানে। তার কলিগদের সাথে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছিল। মৃণাকে দেখে একবার তার কাছে ছুটে আসতে নিয়েও থেমে গেল নিজের কলিগদের দেখে। নিজেকে স্থির রেখে গেল মৃণার কাছে।

মৃণা তাকে দেখে অন্যদিকে ফিরে গেল। দেখল তন্ময়ের কলিগরা তাকে দেখেই কানাঘুঁষা করছে। ভীষণ অস্বস্তি লাগলো তার। লজ্জা পেয়ে মৃণা সে চুপচাপ আবারও ফেরত যেতে নিলে তন্ময় ডাক দিলো তাকে, “মৃণা…দাঁড়াও। তুমি আমার সাথে দেখা করতে এসে চলে যাচ্ছো কেন? আমি তোমাকে সেদিনের জন্য মাফ করতে রাজি।”
মৃণা তাকায় তার দিকে। তন্ময় তার কলিগদের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে, “কোনো রেস্টুরেন্টে যেয়ে বসবে? ওখানে কথা বলি?”

“প্রয়োজন নেই।” মুরাদ পিছন থেকে এসে মৃণার কাঁধ ধরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।

মুরাদের ছোঁয়া লাগতেই কেঁপে উঠে মৃণার সর্বাঙ্গ। তাকায় তার দিকে। মুরাদ বলে, “ও আমার সাথে এখানে কাজে এসেছে।”
তন্ময় তাকে দেখে স্পষ্ট অখুশি। ভার কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে, “কী কাজে?”
“তোমার ফিউচারের সবচেয়ে বড় কম্পিটিশন হবার কাজে। আই মিন তোমাদের অডিশনে টিকেছে মৃণা। সো ভবিষ্যতে এখানেই কাজ করবে গায়িকা হিসেবে?”
“হোয়াট? বছরের পর বছরও চর্চা করে এখানে টিকতে পাড়ে না। সেখানে মৃণা তো গানই পাড়ে না।”

এই কথায় মৃণা কপাল কুঁচকে তাকায় মৃণা, “আমাদের প্রথম দেখাই হয়েছিল স্কুলের গানের ক্লাসে। এতবছর একসাথে থেকে এতটুকু জানো না আমি গান কত ভালোবাসি? এটা আমার, আমার মা’য়ের স্বপ্ন ছিলো। ওহ আমিও কার থেকে আশা করেছি যে কখনো কোনো সম্পর্কের মূল্য দিতেই শিখে নি।”
মুরাদ তাকে দেখে হাসে। আর তন্ময়কেও জানায়, “মৃণা কেবল ছয়মাস গান শিখে তোমাদের স্টুডিওর অডিশনে প্রথম হয়েছে। তোমাদের মতো হাই ক্লাস ট্রেনিং পেলে কি হবে যাস্ট ইমেজিন করো।”
মৃণা কথা আর বাড়াতে চায় না। সে মুরাদের হাত ধরে বলে, “মুরাদ ভাই চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
মৃণা তন্ময়ের দিকে বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
.
.
শায়ান দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কোণে। সাতটার জায়গায় আটটা বেজে গেছে মহুয়ার খবর নেই। সে বারবার ঘড়ি দেখে আবার তাকায় গেইটের দিকে। এইবার সে দেখতে পায় স্কুটি নিয়ে প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকছে এক মেয়ে। সাদা রঙের কুর্তির উপর নীল রঙের স্কার্ফ পরা।

তার ছাদে আসতে লাগলো কিছু সময়। আসতেই প্রশ্ন করল শায়ান, “এতক্ষণ লাগে আসতে? সাতটায় বলেছিলাম, বাজে আটটা।”
“তো আমার দোষ? সাতটায় কোন গাঁধায় ভার্সিটি আসে? আমার স্বাদের ঘুমের বারোটা বেজে গেছে।”
শায়ান হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে “তুমি না বললে জাহানকে ভালোবাসো? সে অন্যকাওকে বিয়ে করে নিচ্ছে জেনে ঘুম আসে কীভাবে তোমার?”
“দেখো আমার ঘুমকে মাঝে আনবে না। পৃথিবীর সব একদিকে ঘুম আর খাওয়া একদিকে। ঘুম আর খাওয়া ছাড়া আমার ব্রেন কাজ করে না। আর ব্রেন কাজ না করলে জাহানের সমস্যা সমাধান করে তার জীবনে স্বয়ং সমস্যা হওয়ার রাস্তা ভাববো কীভাবে?”
তার কথা শুনে শায়ান চোখ ঘুরায়, “ইউ নো স্বয়ং তোমাকে একটা মিউজিয়ামে রাখা যাবে।”

“অফকোর্স আই নো।” সে ব্যাগ থেকে একটা বাটারবন নিয়ে বসে পড়লো ছাদের বর্ডারে। সাথে সাথে ঘাবড়ে যায় শায়ান। সে খপ করে মহুয়ার হাত ধরে নেয়, “তুমি কী পাগল? এখান থেকে পড়লে কী অবস্থা হবে বুঝতে পাড়ছো?”
সে শায়ানের হাত সরিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আবার আমার চিন্তা শুরু করলে কবে থেকে? এসব বাদ দিয়ে কাজের কথায় আসো। জাহানের ব্যাপারে কী বলবে? তুমি কী জানো জাহান এসব কেন করছে?”
শায়ান খানিকক্ষণ চিন্তা করে উওর দেয়, “না।”

মহুয়া চোখ মুখ কুঁচকে নেয় বিরক্তিতে, “তাহলে আমাকে এখানে ডাকলে কোন দুঃখে? আমার ঘুম ভাঙার জন্য তোমাকে তো আমার অভিশাপ দিতে মন চাচ্ছে। শয়তান শায়ান।”
“পুরো কথা শুনবে?” শায়ান নিজেও উঠে বসলো ছাদের বর্ডারে। মহুয়াকে স্পর্শ করলো না, তবে তার পিছনে হাত রাখল। বলল, “তুমি ঠিক বলেছিলে।”
“আমি তো সবসময়ই ঠিক কথাই বলি। তুমি কোনো বিষয়ের কথা বলছ?”
“তুমি বলেছিলে না নিজের ভালোবাসার মানুষকে পাবার চেষ্টা না করেই কাওকে দিতে দেওয়াটা বোকামি? তাহলে আমাকে আমার ভালোবাসা পেতে সাহায্য করো।”
মহুয়া তার কথার অর্থ বুঝলো না। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল শায়ানের দিকে।

শায়ান উওরে বলে, “জাহান রশ্মিকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তাহলে তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হও।”

চলবে…

মেঘের খামে…
পর্ব ৪৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

শায়ান উওরে বলে, “জাহান রশ্মিকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তাহলে তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হও।”

মহুয়া ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় শায়ানের এমন প্রস্তাবে। সে হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করে, “ভাই তুমি কী গা’ঞ্জা সেবন করে এসেছ সকাল সকাল?”
“হোয়াট ননসেন্স!”
“ননসেন্স কথাবার্তা তো তুমি বলতেছো? বুঝতেছো কী বলছো তুমি? বিয়েতে রাজি হবো মানে? না আমি তোমাকে সহ্য করতে পাড়ি আর না তুমি আমাকে দেখতে পাড়ো। সাপ নেউলের মধ্যে বিয়ে হয় কোন জনম থেকে? যত্তসব ফালতু কথাবার্তা!”

মহুয়া নেমে সেখান থেকে যেতে নিলেই শায়ান তার হাত ধরে নেয়। মহুয়া তার দিকে ফিরে তাকায় সরু চোখে। শায়ান উওর দেয় ফটাফট, “সম্পূর্ণ কথা আগে শুনো। আমি নাটক করতে বলছি।”
“নাটক?”
“নাহলে তোমার সাথে আমি আসলে বিয়ে করতে যাব না’কি? আমার মাথায় কী ছাগল লেখা? আমরা বিয়েতে রাজি হয়েছি তাদের সামনে। ওরা যদি আসলেই ভালোবাসে, তাহলে জ্বলেপুড়ে নিজেরাই এনগেজমেন্ট ভেঙে দিবে।”
মহুয়া মুখ ঝামটাল, “এই নাটক করতে হলে অন্য এক সভ্য ছেলের সাথে করবো। তোমার সাথে করবো কেন?”
“তিসানের সাথে যখন নাটক করেছিলে জাহান কী তা দেখে আঁচ করতে পেড়েছিল?”
মহুয়া তাকায় তার দিকে সরু দৃষ্টিতে। শায়ান এক পা তার দিকে এগিয়ে আসে, “জাহান জানে, ওর ভালোবাসা ছিনিয়ে নেওয়ার সাহস কেবল আমার আছে। ও অন্যকারো কথা বিশ্বাস করবে না। আর বিশ্বাস করলেও তোমার খুশির জন্য মেনে নিতে পাড়ে কিন্তু আমার সাথে কখনো মেনে নিবে না।”
মহুয়াকে ভাবাল তার কথাগুলো। যুক্তি তো আছে। তবুও সে নিজের হাত ছাড়িয়ে বলল, “ফালতু আইডিয়া।”

সে যেতে নিলে শায়ান এবার তাকে থামায় না। আরামসে হেলান দেয় বর্ডারে। বলে, “আর এগারোদিন বাদেই ওদের এনগেজমেন্ট। যদি অন্য আইডিয়া থাকে দেন এজ ইউর উইশ।”
একথায় থেমে যায় মহুয়া। সত্যিই তো, তার ভাবতেই কতদিন লাগবে। এর উপর সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত। সে পিছনে ফিরে তাকায় শায়ানের দিকে, “ঠিকাছে তোমার উপর উপকার করছি। এখন আমি তো জাহানকে ফিরে পাওয়ার উপায় খুঁজেও নিতাম কিন্তু রশ্মিকে তুমি আর কীভাবে পাবা? আমার মন আবার অনেক বড় তো। মানুষের কষ্ট সহ্য হয় না।”
শায়ান বুকের উপর হাত ভাঁজ করে মাথা নাড়ায়। বিরক্তির সুরে বলে, “ড্রামাবাজ।”

মহুয়া তার সামনে এসে দাঁড়ায় আর বলে, “আর কিছু শর্ত আছে। বেশি কাছে ঘেঁষবে না, আমাকে রাগাবে না আর ঝগড়া করবে না।”
“আমি ঝগড়া শুরু করি?” হতবাক সুরে প্রশ্ন করে শায়ান। আরও বলে, “ঝগড়ার গোডাউন তো তুমি।”
মহুয়ার কপালে ভাঁজ করে, “এখন কে ঝগড়া করছে?”
“হোয়াট এভার! হঠাৎ যদি বলে দেই যে আমরা বিয়ের জন্য রাজি তাহলে কী সবাই বিশ্বাস করবে?”
“এত বিল্ড আপ করতে গেলে ওদের বিয়ে হয়ে যাবে ব্রো। এত ভেবে লাভ নেই। আজই সব ব্যবস্থা করতে হবে। ভার্সিটিতে না, এক কাজ করো বিকেলে রশ্মিকে ক্লাউড ক্যাফেতে আসতে বলো। আমি তিসানকে বলবো জাহানকে নিয়ে আসতে।”
“তাহলে পার্টনার্স?” শায়ান হাত বাড়ায় হ্যান্ডশেকের জন্য।
“ওকে পার্টনার।” মহুয়াও হেসে হাত মেলায়। আচমকা শায়ান তার সে হাত ধরে টান দেয়। মহুয়াকে কাছে টেনে আনে।

মহুয়া হতবাক হয়ে যায় তার এমন কান্ডে। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
শায়ান দুষ্টু হেসে মৃদুস্বরে তাকে জিজ্ঞেস করে, “এর মধ্যে আমার প্রেমে পড়ে যেও না আবার।”
অবাক হয়ে থেকে যায় মহুয়া তার কথা শুনে। তারপর হেসে দেয়, “আমি তোমার প্রেমে পড়বো? হোয়াট আ জোক। আর রশ্মি এসে পড়েছে এখন তো এসব বন্ধ করো। ওকে যে ভালোবাসো সে ভালোবাসা প্রমাণ করো। দশটা মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়ালে কোন মেয়ে বুঝবে যে তুমি তার প্রতি সিরিয়াস?”
“মানে আমি তার জন্য নিজেকে চেঞ্জ করলে সে আমাকে ভালোবাসবে?”
“বাসতেও পাড়ে। ভালোবাসা তো এমনিতেই হয়, কেউ নিজ থেকে ভালোবাসতে চায় না। কাওকে না চেয়েই ভালোবেসে ফেলে। আবার কাওকে চেয়েও ভালোবাসা যায় না।” সে আবারও তাকাল আকাশের দিকে, “আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে। বৃষ্টি পড়বে মনে হয়। নিচে চলো।”
“তুমি যাও। আমার বৃষ্টি পছন্দ।”
“তোমার?” মহুয়া অবাক হয়।
“হ্যাঁ, আগে ছিলো না। হঠাৎ এক রাতে এক বৃষ্টিবিলাসিনীকে দেখেছিলাম। সেদিন থেকে এই বৃষ্টিতে ভালো লাগতে শুরু হয়েছে।”
“রশ্মিকে?”
এই প্রশ্নের উওর দেয় না শায়ান। উওর না পেয়ে মহুয়া বলে, “আচ্ছা তাহলে তুমিই বৃষ্টিবিলাস করো। আমি গেলাম।”
“কোথায় যাবে?”
“মৃণাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছি। ক্লাসে যেয়ে অপেক্ষা করি।”
মহুয়া চলে যাবার পরও শায়ান সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে৷ মেঘের খামে করে মৃদু বৃষ্টি আসে তার নামের চিঠি নিয়ে। আধভেজা করে যায় শহর। সাথে তাকেও।
.
.
মৃণা আজ ভার্সিটি থেকে অফিসে না যেয়ে গোল্ডেন স্টুডিওতে গেল। তাদের কথানুযায়ী মৃণার কন্ঠ তাদের অনেক ভালো লেগেছে। কিন্তু সুরের হেরফের আছে। ছয়মাস প্রফেশনাল ট্রেনিং করতে হবে। তাই আজ এসে সময় নির্ধারণ করবে সে৷ ভার্সিটি ও অফিসের পাশাপাশি ট্রেনিংটা তার জন্য বেশ কঠিন হলেও সে করতে রাজি। মুরাদ ভাই তার উপর ভরসা দেখিয়েছে। এই ভরসা এত সহজে ভাঙতে দিবে না।

সে আশরাফের দরজাতে নক দেয়। অনুমতি পেয়ে ভেতরে ঢুকে দেখে সেখানে আশরাফের সাথে তন্ময়ও বসা। তাকে দেখে সে বাহিরে যেতে নিলো। বলল, “সরি স্যার পড়ে আসছি।”
“না না তুমি আসো। তোমাকে নিয়েই কথা বলছিলাম।”
মৃণা অবাক হয়। তাকে নিয়ে কী কথা বলছিল?

মৃণা ভেতরে ঢুকে। আশরাফ বলে, “তন্ময়কে বলছিলাম একটা মেয়ের কন্ঠ শুনে অডিশনে সব ভুলে গিয়েছিলাম। এত মধুর সে কন্ঠটা। তারপর জানতে পাড়লাম তোমরা তো একে অপরকে চিনো। এজন্যই তো বলি তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি। তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।”
মৃণা যেয়ে বসে। তাকায় তন্ময়ের দিকে। সে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে কী বলেছে? কে হই আমি উনার?”
“হ্যাঁ তাইতো। তন্ময় তুমি তো বললে না ওকে কীভাবে চিনো?”
তন্ময় তাকায় মৃণার দিকে। তাকে খানিকটা অস্বস্তি রূপে দেখা যায়। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, “ও স্কুল লাইফ থেকেই আমার চেনা। ফ্রেন্ড হয়।”
“তুমি তাহলে আগে বলবে না এত মধুর কন্ঠের কাওকে চিনো? আমি ওর কন্ঠ শুনে যাস্ট হারিয়ে গিয়েছিলাম। তোমার সাথে মৃণাও আমাদের স্টুডিওতে থাকলে আমরা এতদিকে একনাম্বার হয়ে যেতাম। অসুবিধা নেই ক’দিন পর হবো। কী বলো মৃণা?”

মৃণা মৃদু হাসি দেয়।
তন্ময় মাঝখানে বলে,”স্যার আমি ওর ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছিলাম।”
‘বলো।”
“ও পাবলিকে নার্ভাস হয়ে যায় অনেক। ওকে ছদ্মনামে সবার সামনে আনা যায় না? যেন মানুষের বা ক্যামেরার সামনে না যেতে হয়।”
আশরাফ তাকায় মৃণার দিকে, “একচুয়ালি উনার অডিশনের ভিডিও দেখে আমিও এটাই ভেবেছিলাম। অনেক বেশি নার্ভাস ছিলো। বোধহয় এজন্যই উনার আওয়াজ ক্রাক করছিল বারবার। কিন্তু জনাব মুরাদ যে ক্ষেপে গিয়েছিলেন, একথা বলেছি কোন সাহসে?”
মৃণা তন্ময়ের কথাটা ভাবছিলো। সে নিজেও চিন্তায় ছিলো কীভাবে মানুষের সামনে যাবে সে? তন্ময়ের উপদেশটা ভাবতে লাগলো কিন্তু আশরাফের মুখে মুরাদের নাম শুনেই তার দিকে তাকায়।

আশরাফ আরও বলে,”জনাব মুরাদ বলেছেন আমরা কেবল ওকে ট্রেনিং দিতে। বাকি সব উনি নিজে দেখবে। কিন্তু মৃণার গুণের প্রশংসা কেবল ওই পাবে। ওর স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব ওর নিজের। নিজেকে শক্ত করার দায়িত্বও ওর নিজের। এরপর আমার আর কী বলার থাকে বলো?” আশরাফ কথা শেষ করে আবার তাকায় মৃণার দিকে, “মিস মৃণা…”
“জ্বি?”
“আপনি অনেক লাকি। এমন মানুষ পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। আপনাকে অনেক ভালোবাসে। জানেন, উনি আপনাকে ময়না ময়না ডাকছিল তাই আমি ভেবেছি আপনার নামই ময়না। একবার আপনাকে ভুলে ময়না ডাকায় এমন ক্ষেপা ক্ষেপলো। আমিই ভয় পেয়ে গেছি।”

মৃণা মাথা নামিয়ে মুচকি হাসলো। তন্ময় তার দিকে তাকিয়ে এই লজ্জা পাবার ভঙ্গিতে বিরক্ত হয় প্রচুর। সে তাকায় আশরাফের দিকে। রাগ রাগ গলায় বলে, “তাহলে আমি আসি। আপনারা আপনাদের কথা বলে নিন।”
“আচ্ছা। তোমার এলবাম নিয়েও পড়ে কথা বলবো।”

মৃণা আজ কেবল তার সিডিউল নিয়ে বেরিয়ে এলো। সকালে জলদি এখানে আসবে সে। ভার্সিটির আগে। তারপর আবার রাতে আসবে। মোট চার থেকে পাঁচ ঘন্টা থাকতে হবে।

সে খুশিমনেই সিডিউল নিয়ে বের হয়। অফিসে যেয়েই মুরাদকে দেখাবে। কিন্তু মাঝখানে তার আবারও দেখা হয় তন্ময়ের সাথে। তন্ময় সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো দেয়ালে হেলান দিয়ে। তাকে দেখতেই সামনে এসে দাঁড়ালো।

মৃণা এবার তাকে এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু তন্ময়ও নাছোড়বান্দা। সে ঠিক এসে দাঁড়ায় মৃণার সামনে।
“তুমি কী আমাকে ইগনোর করছো?”
মৃণা অবাক হয়। এই মুহূর্তে তার বুকে কোনো ব্যাথা উঠছে না। যে তন্ময়কে দেখে বা না দেখে তার বুকের ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যেত তার সে বুকে অনুভূতির মান শূন্য প্রায়। যার সাথে হাজার অপরাধের সত্ত্বেও একটা কঠোর গলায় কথা বলতে পাড়তো না আজ তাকে দেখেই বিরক্তি লাগছে। সে বিষাদী কণ্ঠে বললো, “বুঝতেই যখন পাড়ছো তখন প্রশ্ন করার মতলবটা বুঝতে পাড়ছিনা।”
এই উওরে তন্ময়ের চোয়াল শক্ত হয়। তবুও সে শীতল ভাব নিয়ে বলে, “নাটক করো না মৃণা। আমি জানি তুমি আমার জন্য এসেছ এখানে।”
“তোমার জন্য আমি এখানে এসেছি?”
“নয়তো কী? এত স্টুডিও থাকতে তাহলে তুমি এখানে কেন আসবে?” তন্ময় খপ করে মৃণার হাত ধরে নেয়, “মৃণা দেখো আমি জানি আমার ভুল হয়ে গেছে। ভুল তো সেদিন তোমারও হয়েছে তাই না? আমি সব ভুলে যাব। তুমিও আমার কথা সব ভুল মাফ করে দেও। আই নো তুমি এখনো আমাকেই ভালোবাসো কেবল। চলো আমরা আবার প্রথম থেকে সব শুরু করি।”

তাচ্ছিল্য হাসে মৃণা, “আচ্ছা আমরা কত বছর ধরে একে অপরকে চিনি মনে আছে? প্রায় পাঁচবছর হবে। সম্পর্কে ছিলাম তিন বছরের বেশি। অথচ তুমি এই মাত্র আশরাফ স্যারকে উওরটা দিতে পাড়লে না। কেন? কারণ তুমি আমার থেকে লজ্জিত।”
“না মৃণা তুমি… ”
“আমাকে শেষ করতে দেও।” মৃণা তাকে থামিয়ে বলে, “আমি তো আগে বোকা ছিলাম। তাই এতবছর এতটুকু বুঝি নি যে তুমি কখনো অন্যের কাছে আমাকে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে পরিচয় করাও নি। বুশরা আপুর মতো সবাইকে এটাই বলে বেড়িয়েছো তাই না যে আমি তোমার পিছনে পাগল হয়ে আছি? তুমি মানা করা সত্ত্বেও আমি বেহায়ার মতো তোমার পিছনে পড়ে আছি! একারণেই তো সবাই আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতো। হাস্যকর ব্যাপার! আমি এত বছরেও বুঝি নি যে তুমি কখনো আমাকে ভালোই বাসো নি। আমি কেবল তোমার প্রয়োজন ছিলাম। কারণ তোমার কাছে কেউ ছিলো না, একমাত্র আমি ছাড়া। তুমি শুধু আমাকে ব্যবহার করেছ, কখনো ভালোবাসোনি। ”

“আমি তোমাকে ভালোবাসি নি? তাহলে এতবছর আমি তোমার সাথে ছিলাম কেন?” তন্ময় দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞাসা করে।
মৃণা উওর দেয় না। উওর দিলেও যদি সে না বুঝে তাহলে অকারণে বাক্য ব্যয় করে লাভ কী?

তন্ময় উওর না পেয়ে এবার ক্ষেপে যায়। অজান্তেই জোরে চিৎকার করে উঠে, “তাহলে আমি তোমাকে ভালো না বাসলে কে বাসে? ওই মুরাদ? ও তোমার…”
“চুপ। একদম চুপ।” মৃণা এবার নিজেও রেগে যায়। মুখের সামনে আঙুল তুলে বলে, “এই উঁচু গলায় আমার সাথে কথা বলতে আসবে না। তোমাকে আমি অধিকার দেই নি আমার সাথে এভাবে কথা বলার।”

তন্ময় হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মৃণা আজ পর্যন্ত তার সাথে এভাবে কথা বলে নি। যেন এই মৃণাকে সে চিনতেই পাড়ছে না।

মৃণা আবারও হুমকির সুর বলে, “আর মুরাদ ভাইকে অসম্মান করে কোন কথা বললে তোমার জন্য ভালো হবে না। এই প্রথম আর শেষবারের মতো বলছি।”
মৃণা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল তারদিকে, একপলক। তারপর সেখান থেকে চলে যেতে নিলো। মাঝখানে তন্ময়ের প্রশ্নে আবারও থামল মৃণা। কাঁপানো ভীত সুরে তন্ময় প্রশ্ন করল, “তুমি কী ওই লোকটার প্রেমে পড়ে গেছো মৃণা?”
মৃণা উওর ফিলো না। পিছনে ফিরলোও না। চলে গেল।
.
.
ক্লাউড ক্যাফেতে আড্ডা চলছিল জমজমাট। তিসান জাহানের দলের সবাইকেই ডেকেছে মহুয়ার কথায়। সবাই গল্প গুজব করছিল। জাহান বাদে। সে ফোনে ব্যস্ত। তিসান বিরক্ত হয়ে তার ফোন হাত থেকে নিয়ে নেয়, “ভাই তুই আজকাল সারাদিন ফোনে লেগে থাকিস। এখন আড্ডার সময়ও? এমন কি দেখিস তুই?”
যে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় মহুয়ার ছবি। সাথে সাথে সে ফোন রেখে দেয় টেবিলে শব্দ করে। তাকায় জাহানের দিকে গম্ভীর মনোভাব নিয়ে। সে শব্দে সবাই থেমে যায়। সবার ধ্যান আকর্ষণ হয় তাদের দিকে।

তিসান বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মহুয়ার জন্য দেবদাস হয়ে থাকলে এই এনগেজমেন্টের নাটক করার কী দরকার? তোর সাথে কী চলতেছে বল তো।”
আবিদও তার কথায় যোগ দেয়, “জাহান ভাই, আমরা জানি আপনি ভাবিকে কত ভালোবাসেন। আমরা তো মহুয়াকে মন প্রাণ দিয়ে ভাবি মেনে নিয়েছি। এখন অন্যকাওকে ভাবতে পাড়বো না।”
“আপনার কোনো সমস্যা থাকলে আমাদের বলেন ভাই। আমরা সাহায্য করবো। আপনার মন খারাপ সহ্য হয় না আমার।” জয়ও বলে।

জাহান বিরক্তি নিয়ে টেবিল থেকে ফোন তুলে, “চুপ করবি তোরা? তোদের বলেছি আমার মন খারাপ?”
সবাই একে অপরের দিকে তাকায়। তিসান তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “ভাই তোর মুখ এটা মহুয়ার ভাষায় হনুমান চেঁকামেঁকার মতো করে রেখেছিস আসলে। যেকেউ একদেখায় বলতে পাড়বে।”
“সাট আপ ম্যান।”

জাহান বিরক্ত হয় তাদের কাজে। সে তার ফোন হাতে নিতেই পরিচিত কন্ঠ শুনে আবারও। সামনে তাকিয়ে দেখে রশ্মি এসেছে। তাকে দেখেই মেজাজ আরও বিগড়ে যায় জাহানের।

রশ্মি উৎসুকভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলে, “তোরা এখানে আছিস? ওয়াও। কতবছর পর আমরা সবাই আবার এখানে আসলাম। পুরনো স্মৃতিগুলো তাজা হয়ে গেছে।”
জাহান টেবিলে জোরে বাড়ি মেরে উঠে দাঁড়ায়। তিসানের দিকে তাকিয়ে রাগে কটমট করে বলে, “তুই না বলেছিলি কেবল আমরাই থাকবো অন্যকেউ না। তাহলে ও এখানে কী করে?”
“আরে ভাই আমি ডাকিনি।” তিসান নিজের সাফাই গাইলো। সে আবার তাকাল রশ্মির দিকে, “তুই হঠাৎ এখানে যে?”
“শায়ান ডেকেছিল। বলল গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবে।” রশ্মি জানায়।
জাহানের রাগের মাত্রা শীর্ষে উঠে যায়, “ওহ গ্রেট! তাহলে আরেকজনও আসছে। আমার নিজের ব্লাড প্রেশার বাড়ানোর এত শখ নেই। আমি গেলাম।”
জাহান সেখান থেকে বের হতে নিলে রশ্মি তার পিছনে যায়, “জাহান একটু আমার কথা শুন। আমরা একটু শান্তিমতো বসে কথা তো বলি।”

জাহান থামেই না। উলটো রশ্মি তার বাহু ধরলে ঝটকায় সরিয়ে দেয়, “ডোন্ট ইউ ডেয়ার।”

জাহান বের হতে নিলে দেখে সামনে দিয়েই শায়ান আসছে। তাকে দেখে আরও বিরক্ত হয় সে। কিন্তু পরক্ষণেই থেমে যায়। থমকে যায়। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় সামনের দিকে।
মহুয়া!
মহুয়া শায়ানের সাথে কেন?
মহুয়া পাশ থেকে আসলে শায়ান তার বাহু ধরে তাকে নিজের পাশে এনে দাঁড় করায়। তার কাঁধে হাত রাখে।

এই দৃশ্যতে কেবল জাহান না, রশ্মিও চমকে যায়। আর ভেতরে ঢোকার সাথেই বাকি সবাইও। সবাই ভূত দেখেছে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে।

“তোরা একসাথে কী করছিস?” সবার আগেই তিসান প্রশ্ন করল।
“আমরা ভাবছি বিয়ে করে ফেলবো?”
“হেঁ?” তিসান যেন আকাশ থেকে পড়ল এই কথা শুনে। কোথা থেকে কী?
সে শক খেয়ে চেয়ারে বসতে যেয়ে নিচে পড়ে যায়। জয় তাকে উঠাতে নিলেও সে থামায়। তারপর তালি দিয়ে সবার আকর্ষণ নিজের দিকে করে জিজ্ঞাসা করে, “তোরা কে কে বিয়ে এনগেজমেন্ট সারবি আগে দিয়ে বলে দিবি ভাই। লিস্ট দিয়ে যা। নাহলে একদিন আমি শক খেয়ে সোজা উপরে চলে যাব।”
শায়ান বলে, “আমাদের বিয়ের কথা আগেই চলছিল। মহুয়া তখন মানা করে দিয়েছিল, এখন হঠাৎ করে রাজি হয়েছে। এই শুক্রবার আমাদের বাসায়ও আসবে এনগেজমেন্ট এর ডেইট ফিক্স করতে।”

সবাই সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় তাদের দিকে। যেন কারোই কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না। বিশেষ করে এই সাপ নেওলের মিষ্টি ব্যাবহার তো মোটেও না।

এমন দৃষ্টি দেখে শায়ান তাড়া দেয় মহুয়াকে,”বেবি চলো আমরা ওখানে যেয়ে বসি।”
মহুয়া জোর করে হেসে মাথা নাড়ায়। ফিরে একটু এগোতেই মহুয়া বিড়বিড় করে বলে, “এই বেবি বাবু করলে তোমার উপরেই বমি কইরা দিবো দেইখো।”
“গাঁধা না’কি? নাহলে সবাই বিশ্বাস করবে কীভাবে আমরা আসলে এনগেজমেন্ট করতে যাচ্ছি।”
“জীবনেও বিশ্বাস করবে না। কিন্তু দুইজন জ্বলবে ঠিকই। এখন হাত সরাও। আমার কাঁধকে কি বাপ দাদার সম্পত্তি মনে করে রাখছো? সে কখন থেকে ধরেই রেখেছ।”
“আরো কেউ বিশ্বাসই করবে না আমরা যে একসাথে আছি। তুমি তো ভারী আনরোমেন্টিক।”
মহুয়া আড়চোখে তাকায় তার দিকে, “হবোই তো। তোমার মতো একশোটা প্রেম যে করি নি।”
শায়ান সরু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “আমিও প্রেম করিনি।”
মহুয়া মুখ বানিয়ে তাকায় তার দিকে।
শায়ান গলা পরিষ্কার করে উওর দেয়,”সবগুলো ওয়ান নাইট স্টান্ড ছিলো।”
“এত গর্বের সঙ্গে কী বলছো? এটা আরও খারাপ।”

শায়ানদের জায়গায় যেয়ে দুইজন সামনা-সামনি বিনব্যাগে। রশ্মি দৌড়ে আসে। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে একবার তাকায় মহুয়ার দিকে। তারপর শায়ানকে প্রশ্ন করে, “এসব কী শায়ান? তুই তো আমাকে তোর কোনো বিয়ের কথা বলিস নি।”
“তোমাকে বলা লাগবে কেন? কে তুমি?” মহুয়া প্রশ্ন করে। কাঠ কাঠ গলায়।
এমন কঠিনভাবে কথা বলাটা রশ্মির ভালো লাগে না। কারণ আজ পর্যন্ত জাহান ছাড়া কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলেনি। সবার আদরের সে। তবুও সে মহুয়াকে কিছুই বলে না। শায়ানকেই জিজ্ঞেস করে, “তুই তো আমার কাছে সব শেয়ার করিস। তাহলে এটা বললি না কেন যে তোর এনগেজমেন্ট হবে?”
মহুয়া আবারও মাঝখানে বলে, “তোমার কী ভাই? দেখছো না আমরা পার্সোনাল টাইম স্পেন্ড করছি। তুমি যেয়ে তোমার ফিয়োন্সের সাথে বসো তো।”
রশ্মিকে দেখে মনে হয় সে এবার কেঁদেই দিবে। সে কাঁদোকাঁদো মুখে তাকায় শায়ানের দিকে। শায়ান তার মন খারাপ সহ্য করতে পাড়ে না। কিন্তু সে কিছুই বলে না। এই দেখে তার মন মেজাজ আরও বিগড়ে যায়। সে চোখে পানি নিয়েই সেখান থেকে যেয়ে অন্য চেয়ারে বসে।

শায়ান জিজ্ঞেস করে, “এসবের বেশি প্রয়োজন ছিলো? ও কান্না করে দিচ্ছিল।”
“অবশ্যই ছিলো। যতক্ষণ ওকে গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ না করবে ততক্ষণে তোমার গুরুত্ব কীভাবে বুঝবে? এভাবেই তো জ্বলবে বুঝেছ?”
শায়ান তার দিকে ঝুঁকে এসে তার হাত ধরল। বলল, “আচ্ছা তাহলে যে তুমি একটু পর পর খোঁটা মারো অন্য মেয়েদের নিয়ে। তুমিও কী জ্বলো না’কি?”

মহুয়া তার দিকে তাকায় মুখ বানিয়ে, “মাথায় কী মস্তিষ্কের জায়গায় গোবর জমিয়েছ না’কি? তোমাকে নিয়ে আমি জ্বলবো কোন দুঃখে? খোঁটা মারি কারণ এসব ধরনের মানুষ আমার চরম অপছন্দের। তুমি শুধরে গেছ বলেই রশ্মির সাথে সেটিং করাতে রাজি হয়েছি, নাহলে আমার শত্রুর সাথেও এমন মানুষকে থাকতে না দেই।”
একথা শুনে শায়ানের মুখের হাসির সাথে সাথে সব রঙ উড়ে গেল। তার দম আটকে আসছে কেন যেন! বুকের ভেতরটা ভার হয়ে গেছে। সে মহুয়ার ধরা হাতটা শক্ত করে ধরে নেয়। সাথে সাথে হাতটি ছাড়ানোর চেষ্টা করে, “এত শক্ত করে ধরেছ কেন? ব্যাথা পাচ্ছি। লোক দেখানোর জন্য হাত ধরতে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছি, ভাংতে নয়। হাত ছাড়ো।”
শায়ান তার হাতের মুঠো ঢিলা করলেও ছাড়লো না। মহুয়া আবারও বলল চোখরাঙিয়ে, “হাত ছাড়তে বলেছি।”
শায়ান তার হাত ছেড়ে দিলো।

জাহান এতক্ষণ দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে তাদের দেখছিল। তার মস্তিষ্ক ব্যাপারটাকে নিতেই পাড়ছিল না। কিছুক্ষণ চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখার পর তার আর সহ্য হলো না। সে দ্রুত যেয়ে তাদের সামনে দাঁড়াল, “মহুয়া আমার সাথে চলো। তোমার সাথে কথা আছে।”
মহুয়া ঢঙ করে বলল, “উফফ এখন না। দেখছো তো আমার হবু স্বামীর সাথে প্রথম ডেইটে এসেছি। ডিস্টার্ব করো না তো।”
জাহান তার খারাপ মেজাজ চাপিয়ে বলে, “মহুয়া আমার সাথে আসো।”
মহুয়া যেন তার কথাই শুনে না। সে এক গাল হেসে তাকায় শায়ানের দিকে।

জাহান চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস ফেলে। সে প্রথমেই বুঝে মহুয়া কীসে মানবে৷ তবুও প্রথমে বলতে চায় না। অবশেষে হার মেনে আকুতির সুরে বল তাকে, “জান…প্লিজ।”
একথা শুনে মহুয়া মুচকি হাসে লুকিয়ে। তারপর ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
“চলো তাহলে এত যেহেতুবলছো।”
সে যেতে নিলে শায়ান আবারও তার হাত ধরে নেয়। থামায় তাকে। উঠে দাঁড়িয়ে জাহানের সামনে যেয়ে বলে, “ও কোথাও যাবে না।”
জাহান কপাল কুঁচকায়। তাকায় তাদের হাতের দিকে। আবার তাকায় শায়ানের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে।
“হাত ছাড়।”
শায়ান তার সামনে দাঁড়িয়ে একই সুরে জেদি গলায় বলল, “ছাড়বো না কী করবি?”
জাহান সাথে সাথে তার কলার ধরে নেয়। রাগাবুন্ড হয়ে তাকায় তার দিকে। ক্ষুব্ধ স্বরে বলে, “তোকে বলেছিলাম ওর আশেপাশে আসলেও এতবছরের যেটুকু বন্ধুত্বের অনুভূতি ছিলো সব ভুলে যাবো। তোর জান বের করে নিতেও এক মুহূর্তও ভাববো না।”
“আর আমি চেয়ে দেখবো না’কি? তোর জীবন সালামতে রাখবো!”

এতক্ষণে আদনান আংকেল আসে শব্দ শুনে। তিসানরা দাঁড়িয়ে দেখছিল কেবল দৃশ্যটা। আদনান আংকেল তাকে এসে জিজ্ঞেস করে, “তিসান বাবা ওরা আবার কী নিয়ে ঝগড়া শুরু করলো?”
তিসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকায় তার দিকে, “আংকেল আপনার ক্যাফেতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় হলো পপকর্ণ। সেটাই নেই। পপকর্ণ রাখবেন বুঝলেন? আর বাহিরে একটা বড় সাইনবোর্ড লাগাবেন, যে এখানে নিত্যদিন নতুন নাটক হয়।”

রশ্মি দৌড়ে আসে দুইজনে মাঝে। তাদের জিজ্ঞেস করে, “এসব কী করছিস তোরা? এমন ব্যবহার করছিস কেন? জাহান প্লিজ ছাড় ওকে।”
জাহান তার কথা কানেই লাগায় না।
তারপর রশ্মি আকুতির সুরে শায়ানকে বলে একই কথা। শায়ান তার দিকে তাকায়। না চাইতেই ছেড়ে দেয় জাহানের শার্ট। বিরক্তি নিয়ে হাল্কা ধাক্কা দিলে জাহান এক ঘুষি মা’রে।
শায়ান বিনব্যাগের উপর পড়ে যায়। সবাই চমকে উঠে। মহুয়া অবাক হয়ে যায়। জাহান এমনটা করবে সে ভাবতে পাড়ে নি।
সে হতবাক হয়ে তাকায় জাহানের দিকে, “পাগল হয়ে গেলে না’কি কী করছ তুমি?” একপ্রকার উঁচু স্বরেই বলে মহুয়া।
রশ্মি শায়ানকে দেখতে হাঁটু গেড়ে বসেছিল। মহুয়ার কথা শুনে তার দিকে তাকাল অবাক দৃষ্টিতে। জাহানের একটুও পছন্দ না তার সাথে কেউ উঁচু স্বরে কথা বলুক। তবুও মেয়েটি জাহানের সাথে উঁচু স্বরে কথা বলার সাহস করলো। সে জাহানের প্রতিক্রিয়া দেখে আরও হতবাক হয়। এতক্ষণে তার যে দৃষ্টিতে আগুন জ্বলছিল, মেয়েটির দিকে তাকাতেই সে দৃষ্টি নম্র হয়ে গেল। তার মন বিষাদে ভরে যায়। জাহান কখনো তার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় না কেন! এই চাহনির জন্য তার বুকে যে কত তৃষ্ণা!

জাহান মহুয়ার হাত ধরে তাকে নিয়ে যায় বাহিরে। মহুয়াও কিছু বলে না। সে এটাই চাইতো কিন্তু শায়ানের জন্য একটু খারাপ লাগছে তার। বেচারা তার জন্য ব্যাথা পেল।

জাহান মহুয়াকে নিয়ে বাহিরে আসে। পার্কিং স্পটে। নিজের গাড়ির কাছে এনে তাকে বসে, “উঠো।”
“আমার কাছে আমার স্কুটি আছে। তোমার রাইড লাগবে না। আর আমি তোমার সাথে কেন যাব? তোমার ফিয়োন্সে তো ভেতরেই আছে। ওহ… আমারও।”
রাগে জাহান তার মুঠো বন্ধ করে নিলো। দাঁতে দাঁত পিষলো। গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “মহুয়া প্লিজ এসব কথা বলো না।”
“কেন? কেন বলবো না? তুমিও তো এটাই চাইতে তাই না? গতকাল না বলেছিলে আমি যে অন্যকাওকে বিয়ে করে নেই।”
“তুমি কোনো বিয়ে টিয়ে করছো না আমি জানি। আমাকে রাগাতে এসব কাহিনী ঘটাচ্ছো। তোমার ভাই তোমাকে এখন বিয়ে দিবে না।”
“আমি জেদ ধরলে দিতে হবে।”
জাহান নিজের রাগ ঠান্ডা করল। চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস ফেলে এসে দাঁড়ায় মহুয়ার সামনে। বলে, “তুমি আমাকে জ্বলাতে চাইছ? ওকে। অন্য ছেলেকে দিয়ে জ্বলাও বাট শায়ানের সাথে থাকবে না।”
“এখন তো একশো পার্সেন্ট ওর সাথেই থাকবো। দেখি তুমি কী করো?”
মহুয়া যেতে নিলে জাহান তার হাত ধরে তাকে নিজের গাড়ির সাথে চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে ভারী স্বরে বলে, “তোমার এই জেদ পাশে রেখে একবার আমার কথা শোনা যায় না? আমার কথা বুঝতে পাড়ছো না কেন তুমি? আমি তোমার জন্যই বলছি। শায়ানের ফ্যামিলি রাজনীতির সাথে জড়িত। তুমি শায়ানকে এখানে আনিয়েছ আর শায়ান রশ্মিকে ডেকেছে। আমি সব বুঝি মহুয়া। কিন্তু তুমি বুঝতে পাড়ছো না ওদের সাথে খেলা খেলে তুমি কত বড় বিপদ ডেকে আনছো।”

চলবে…