মেঘের খামে পর্ব-৪+৫

0
3

#মেঘের_খামে
পর্ব ৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“ভাই আপনার কি মেয়েটাকে মনে ধরেছে? থামাব?” তার পাশ থেকে একটি ছেলে বলে।
তিসান হাতের ইশারায় তাদের থামায়। দরজাটা বন্ধ হওয়ার পর অবশেষে তার চোখ সরে।
“শী ইজ সো ড্যাম প্রিটি।”
পাশের ছেলেটি আবার বলে, “আপনি বললে থামাতাম।”
“সুন্দর ছিলো সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছি। এতটুকুই।”
.
.
ক্লাস চলছিল। তখন একজন পিওন আসে প্রফেসরকে বলে, “স্যার একজনকে অফিসে ডাকা হয়েছে।”
“কেন?”
“ভর্তিতে না’কি কোনো সমস্যা হয়েছে।”
“আচ্ছা সাথে নিয়ে যাও।”
“জেরিন মহুয়া কে?”
মহুয়া দাঁড়ায়। মোহও তার সাথে যাবার জন্য দাঁড়ায় কিন্তু পিওন বলে, “শুধু উনাকে আসতে বলছে।”
মহুয়া একাই তার সাথে যায়। সে পিওনের পিছনেই যাচ্ছিল। পিওন যেয়ে থাকে একটি রুমের সামনে। ঠিক রুম না হল বলা যায়। বিশাল একটি খালি রুমে মাঝখানে চেয়ার নিয়ে বসে আছে জাহান। সে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশে সিগারেট খাচ্ছে। পাশে কতগুলো ছেলেও চেয়ারে বসেছিল। তাদের চেহেরায় উৎসুকভাব। যেন তারা কোনো সিনেমা দেখতে এসেছে। কয়েকজন চিপ্স খাচ্ছিল। একজন তো ফোনে ভিডিও করছিল। এর মধ্যে পিছন থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনল।

মহুয়া ঘাবড়াল না। শান্ত রইল। স্থির দৃষ্টিতে তাকাল জাহানের দিকে। তার দৃষ্টিটা পছন্দ হলো না জাহানের। যে দৃষ্টিতে সে অগ্নির ন্যায় তেজ দেখতে পায় সে দৃষ্টিতে সে ভয়, দু:খ আর পরাজয় দেখতে চায়।
“জেরিন মহুয়া মুসতাহিদ হোসেন মুরাদের একমাত্র ছোট বোন। বাবা ব্যাংকের কর্মচারী ছিলো। কিন্তু হঠাৎ চলে গেল। মিডেলক্লাস ফ্যামিলি ছিলো যা চেঞ্জ হলো ইদানীং। পাঁচবছর হলো মুরাদ একটি এডভাটাইসিং কোম্পানি খুলেছে। আর পাঁচবছরে অনেক বেশি সাফল্যতাও পেয়েছে। ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এখন আমাদের ভার্সিটিতে এসেছ। অনেক বন্ধুবান্ধব থাকলেও দুইটা ক্লোজ ফ্রেন্ড আছে। মৃণা ও মোহ।”

মহুয়া তাচ্ছিল্য হাসে, “এসব বলার জন্য ডাকসো ভাই? এসব তো আমি জানিই।”
“তোমার কি ভয় লাগে না?” কাঠকাঠ কন্ঠে প্রশ্ন করে জাহান।
“বাঘ, ভাল্লুক কিছুই তো দেখতে পাড়ছি না। ভয় পাবার কী আছে?”

জাহান চেয়ার থেকে উঠে মহুয়ার সামনে যেয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলে, “তুমি এখানে একা মেয়ে এতগুলো ছেলের মাঝে। ভয় লাগা উচিত। আজ তো কোনো হাতিয়ারও নেই তোমার সাথে।”

“ওহ,” সে তার পকেট থেকে একটা ছোট চিকন ছু’রি বের করে তার খুলে আঙুলের মাঝে ঘুরাতে থাকে, “এটার কথা বলছো? এটা তো আমার ফেভারিট। একে ছাড়া আমি কোথাও যাই না। তোমার এটার কথা এখনো মনে আছে? চোখের সামনে ভাসে না’কি?”
জাহান বিরক্ত হয়ে চোখ ঘুরিয়ে নেয়।

মহুয়া তার পাশ কাটিয়ে বলতে থাকে, “আমার এত তথ্য বের করে করছটা কী? কী উল্টায় ফেলছ শুনি?”
মহুয়া যেয়ে জাহানের চেয়ারে যেয়ে বসে ঠিক তার মতো। তারপর হাত দিয়ে ইশারা করে জয়কে ডাকে।

জয় একটু হতভম্ব হয়ে যায়। জাহানের দিকে তাকিয়ে আসে তার সামনে।
“ডাকছ কেন?” মহুয়া তার প্রশ্নের উওর দেয় তার হাতের চিপ্সের প্যাকেটটা নিয়ে, “ব্রাদার ক্যান্টিন থেকে একটা সাব-স্যান্ডউইচ আর একটা কফি আনাও তো। আমার তো স্যার ক্লাসে ঢুকতেই খিদে লেগে গেছে।”
“আমি ক্যান্টিন থেকে তোমার জন্য খাবার আনব?”
“তো কি? আচ্ছা টাকার ব্যাপার। ক্লাসে যেয়ে টাকা দিয়ে দিব নে। আমিও আবার কারও ঋণ রাখি না।”
বলে সে তাকায় জাহানের দিকে। জাহান রেগে তার সিগারেট ফেলে তা জুতো দিয়ে নিভিয়ে দেয়। সে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে একজন মহুয়ার ঠিক সামনে আরেকটা চেয়ার রাখে। জাহান এসে বসে সেখানে।
“তোমাকে আমি ক্লাস থেকে এখানে এনেছি। একা রুমে এতগুলো ছেলেদের সাথে বন্ধ তোমার চোখেমুখে একটুও পেনিক নেই। তুমি উল্ট স্যান্ডউইচ চাচ্ছো?”
“সাব স্যান্ডউইচ। অর্ডার ভুল করবে না।”
“আমাকে কি তোমার ওয়েটার মনে হয়? অর্ডার কাকে দিচ্ছো?” সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে বলে, “শুনো পাগল মেয়ে, তুমি বুঝতে পাড়ছ না কার সাথে পাঙ্গা নিচ্ছো?”
“বুঝাও তাহলে। আমার অনেক সময় আছে। এটেন্ডেন্স যেহেতু নেওয়া হয়ে গেছে স্যারের বোরিং লেকচার শুনতে কে বসবে? আরও ভালো করেছ ডেকেছ। আমার পড়াশোনা ছাড়া সবই বুঝতে ভালো লাগে। বুঝাও।”

জাহান নিজেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে উঠে মহুয়ার সামনে যেয়ে তার দিকে ঝুঁকে তার কাছাকাছি যায়। তার চোখে চোখ রেখে বলে, “তুমি জানো আমি কে? কি করতে পারি?”
মহুয়া এক মুহূর্তের জন্যও পলক নামায় না। সে উলটো জাহানের জ্যাকেটের কলার ধরে তাকে আরও কাছে টেনে নেয়। চোখে চোখ রেখে একইভাবে উওর দেয়, “না, জানাও।”
সব ছেলেরা হা করে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। এখানে কি ঝগড়া চলছে না অন্যকিছু তারা বুঝতে পাড়ে না।

জাহান এবার চমকে উঠে। এই মেয়ে কী জিনিস? না ভয় পায়, না লজ্জা পায় আর না ঘাবড়ায়। সে নিজেই উল্টো তাকে এত কাছে দেখে অস্বস্তিবোধ করে। সে মহুয়ার হাত থেকে তার জ্যাকেট ছাড়িয়ে বলে, “তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাইবে কি না?”

“না।” তার সরাসরি উওরে আরও ক্ষেপে যায় জোহান।
“আমি তোমাকে ভার্সিটি থেকে বের করে দিতে পাড়ি।”
“তাহলে আমি অন্য ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাব।”
“তোমার ভাইয়ের কোম্পানিতে ঝামেলা বাঁধাতে পারি।”
“আমার ভাই বুদ্ধিমান আছে। নিজেই সামলে নিতে পাড়বে।”
“তোমাকে…তোমাকে….” সে রাগে তার চেয়ারটা জোরে লাথি মেরে ফেলে দেয়। আর মহুয়া শান্ত গলায় বলে, “রাগ শরীরের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের নিজের মাথা সবসময় ঠান্ডা রাখা উচিত। শীতল মস্তিষ্ক দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।”
জাহান আবারও তার দিকে তাকায় মুখ বানিয়ে । এই মেয়ে আসলে একটা মানসিক রোগী। নিজে গতসাপ্তাহে দুইদিন ক্ষোভে এত কান্ড ঘটিয়ে এখন তাকে জ্ঞান দিচ্ছে?

জয় বিস্ময়ে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে, “আপু আপনার মুখে তো এই কথা মানায় না।”
“কেন? আমি চরম শান্ত, শিষ্ট, মিষ্টি ও ভদ্র একটি মেয়ে। শুধু খাবার না খেলে আমার মাথা ঘুরে যায় একটু। তাছাড়া আমি খুব শান্ত।”
কথাটা শুনে এবার জাহানের ধৈর্য্যর বাঁধ ভাঙে। সে জয়কে বলে, “এই মানসিক রোগীকে আমার চোখের সামনে থেকে সরা। ক্লাসরুমে দিয়ে আয়।”
“একদম না। আমি ওই ক্লাসে যাব না। দ্বিতীয় ক্লাসে শেষের দিকে যেয়ে এটেনডেন্স দিয়ে আসবো।” সে আবার জয়কে বলে, “ব্রাদার আমার সাব-স্যান্ডউইজ?”

জয় তাকায় জাহানের দিকে। জাহান বিরক্ত হয়ে নিজেই বের হয়ে যায় রুম থেকে। এক মেয়ের কাছে এই তৃতীয়বার সে হারলো। কতবড় লজ্জার ব্যাপার! এই মেয়েকে এবার শিক্ষা না দিলে তার হৃদয় ঠান্ডা হবে না।

মোহ ও মৃণা ফোন করে জানতে পায় মহুয়া হলে আছে। পিওন তাকে কোনো কাজে আনে নি বরং জাহান তাকে আনিয়েছে। কথাটা শুনা মাত্র তারা দৌড়ে আসে হলে। ঘাবড়ে যায় তারা। আল্লাহ জানে জাহান কি করছে মহুয়ার সাথে। কিন্তু এসে তারা দেখে অন্য ঘটনা। ফ্লোরে বসে মহুয়া কতগুলো ছেলের সাথে চোর পুলিশ খেলছে। এর মধ্যে জাহানের সাথে থাকা জয়ও আছে। তাদের দেখে মোহ বলে, “ভাই আমাদের জান উড়ে গেছে আর তুই এখানে বসে খেলছিস?”
“আরে আয়। বয় বয়। এরা আমার নিউ ভাই ব্রাদার। এদের সাথে আমার ভালো জমেছে। এরা ওই হনুনাম চ্যাঁকামেঁকার মতো নয়। ভালো আছে।”
মোহ ও মৃণা এসে বসে তার পাশে। মোহ বলে, “তুই পারিসও ভাই। দুইঘন্টায় জাহানের বন্ধুদের সাথে ভাবও জমিয়ে নিলি? জাহান কোথায়?”
“ভাগিয়ে দিয়েছি।”
মোহ হাসে, “শুধু তোর দ্বারাই সম্ভব।”

প্রায় সব ছেলেরাই হা করে তাকিয়ে থাকে মোহের দিকে। তাদের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মহুয়া মোহকে তার পিছনে লুকিয়ে বলে, “আমার বান্ধবীর দিকে কু নজর দিলে চোখ তুলে নিব। আমার ভাই ব্রাদার মানে ওরেও বোনের নজরে দেখতে হবে।”
“এভাবে বলো না।” জয় বলে। সাথে যোগ করে, ” দুইদিন ঝগড়ার চক্করে ভালোমতো খেয়ালই করিনি তোমার বান্ধবীকে। পরিচয় করিয়ে দেও না।”
“মোহ পরিচয় হ। আজ থেকে এরা তোর নতুন ভাই।”
মোহ হেসে উঠে। আর সকলের মুখ কালো হয়ে যায়।

“ব্রাদার বলে তুমি এভাবে করতে পাড়লা?” জয় জিজ্ঞেস করে।
“দেখো ব্রাদার। আমি না করলেও লাভ হতো না। এই মেয়ে কারো প্রাপোজাল এক্সেপ্ট করে না। তাইতো এখনো সিঙ্গেল।”
“সিঙ্গেল?” জয়ের চোখজোড়া চকচক করে উঠে।
“সিঙ্গেল বাট নট রেডি টু বি মিঙ্গেল। ওর সাথে মিঙ্গেল হতে গেলে ইউর জীবন উইল বি জাঙ্গাল।”
“হেঁ?”
“আই মিন ম্যাডাম কেবল এরেঞ্জ ম্যারেজ করবে। এখন ভেবে দেখো তার পিছনে কতজন ঘুরে। আমার একটা কাজিনও পাগল হয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামকরা স্টুডেন্ট। এখন আমেরিকাতে অনেক বড় একটা ভার্সিটিতে পিএচডি করতে গেছে যেন ওর বাবা বিয়ের প্রস্তাবে কোনো দিক থেকে মানা না করতে পারে। তাইলে ডেডিকেশন দেখো। এটা তো একটা উদাহরণ দিলাম। আরও আছে। তুমি এমন করতে পাড়বে?”
জয় খানিকটা কেশে বলে, “থাক আপু, আপনার এমন এরেঞ্জ ম্যারেজ আপনাকেই মোবারক।”

সবাই হাসাহাসি করতে থাকে। এর মধ্যে মৃণার ফোনে কল আসে। তন্ময়ের বাসার ল্যান্ডলাইন থেকে। মৃণা বুঝে উঠে না সে কি কলটা তুলবে না’কি? তন্ময় তাকে মানা করেছিল তার সাথে যোগাযোগ করতে না। বুশরা আপু না’কি তাকে দেখলে ভুল বুঝবে। গভীর নিশ্বাস ফেলে মৃণা। যে মানুষটা তাকে কান্নার মাঝে ফেলে রেখে গিয়েছিল তারজন্য কতটা চিন্তা তন্ময়ের মনে , অথচ যে সবসময় তার পাশে ছিলো তাকে তীব্র যন্ত্রণা দিতেও তার মনে বাঁধে না?

সে গভীর নিশ্বাস ফেলে কলটা ধরে, “হ্যালো।”
“মৃণা আম্মা বলতেছো? আমি কারিম চাচা তোমার। ছোট সাহেব অনেক অসুস্থ। আমি কিছু বুঝতেছি না কোন ঔষধ দিব।”
মুহূর্তে তার অভিমান মিশে যায় বাতাসে। সে অস্থির স্বরে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে ওর?”
“ছটফট করতেছে অনেক। হাত পা লাল হয়ে গেছে।”
“আচ্ছা আমি আসছি।”
মৃণা ফোন রেখে তাকায় মহুয়া ও মোহের দিকে। তারা জানলে কিছুতেই যেতে দিবে না। তাই সে তাদের কাছে যেয়ে মিথ্যা কথা বলে, “আন্টি এখনই বাসায় যেতে বলেছে। কি কাজ আছে।”
“অন্য ক্লাস করবি না? আধা ঘন্টা পরেই।” মোহ জিজ্ঞেস করে।
“আজ হয়তো আর পাড়ব না। আমি যাই।”
মৃণা তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়ে।

রিক্সা নিয়ে তন্ময়দের বাড়ির সামনে নামে মৃণা। রাস্তা থেকে আসার সময় সে ঔষধ নিয়ে এসেছে। এসেই তন্ময়ের রুমে যেয়ে তার অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে যায়। সে দ্রুত যেয়ে তাকে একটি পাউরুটি খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয়। তন্ময় তাকে দেখেছে কি-না সে তা ঠিক জানতে পারে না। তন্ময় তার দিকে ভালো মতো তাকাতে পাড়ে না। ঔষধ খাওয়ার পর কিছুক্ষণ ছটফট করে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু সে তার পাশেই বসে থাকে হাত ধরে। মাঝেমধ্যে কাপড় ভিজিয়ে মুখ মুছে নেয়। তার অবস্থা দেখে। তার হাতে আর র‍্যাশ দেখা যায় না। সে শান্তির নিশ্বাস ফেলে। অর্থাৎ হাস্পাতালে নেওয়ার মতো অবস্থা হয় নি। সে যখন সে শান্তির নিশ্বাস ফেলে তখন তার কানে তন্ময়ের কন্ঠ শুনতে পায়। সে মৃণা তার আরেকটু কাছে যায়, শুনতে সে কি বলছে। তন্ময় কেবল বুশরার নাম নিচ্ছিল। কাঁপানো নিশ্বাস বের হয় মৃণার বুক চিরে। সে উঠে দাঁড়ায়। বারান্দায় যেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। তারপর রুমে এসে দেখালে লাগানো তন্ময়ের প্রথম গিটারটা দেখে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে। সে ডুবে যায় অতীতের স্মৃতিতে….

সে ছোটবেলায় গান শিখতো। তার মা’য়ের কাছে। অসম্ভব সুন্দর তার কন্ঠ। কিন্তু মা মারা যাবার পর সে গান ছেড়ে দেয়। তখন তার বয়স আট। একবছর পর আবার স্কুলে যাবার সময় ভীষণ চিন্তিত ছিলো। আগে তাকে মা দিয়ে যেত আর সে নেই। তাই সে দাদীর দায়িত্ব। সে সময় প্রথম তার দেখা হয় মোহ ও মহুয়ার সাথে। অক্ষর অনুসারে সবাইকে বসানো হয়েছিল। সে বসেছিল মোহ ও মহুয়ার সাথে। মোহের সাথে তার প্রথমদিনই বন্ধুত্ব হয়ে যায় কিন্তু মহুয়ার রাগী, জেদি, ও বসি স্বভাবের কারণে তাদের বন্ধুত্ব হতে সময় লাগে কিন্তু একসময় হয়েই যায়। তারা দুইজন তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে যায়।

যখন মৃণার বয়স পনেরোতে পড়বে সে পড়তো অষ্টম শ্রেণীতে। সে জানতে পারে তারাও অষ্টম শ্রেণি থেকে তাদের সিনিয়রদের সাথে গানের ক্লাসে যুক্ত হতে পাড়বে। স্কুল ছুটির পর গান শিখতে পাড়বে। মৃণা এ সুযোগ হাতছাড়া করে না। গানের ক্লাসে নিজের নাম লেখায়। সেখানেই প্রথম তার দেখা হয় বুশরার সাথে। সে অসম্ভব সুন্দর ছিলো। ফিমেইল এলেগেন্স ছিলো তার মাঝে। লম্বা চুল, সুন্দর চেহেরা, মিষ্টি কন্ঠ। সব ছিলো তার মাঝে। সে যখন বুশরার কন্ঠে প্রথমবার গান শুনে মুগ্ধ না হয়ে পারে না সে। এমনকি সে এতটুকু বয়সে প্রফেশনালভাবে গান গাইতো। ক্লাসের সবার মতো সে-ও বুশরার উপর মুগ্ধ ছিলো। সব মেয়েরা তার মতো হতে চাইতো। মৃণাও তার বিপরীত ছিলো না। সে একই ক্লাসে ছিলো তন্ময়ও। বুশরার ক্লাসমেট। তবে তাকে বেশি একটা খেয়াল করে নি মৃণা। যদিও তন্ময় বেশ মিশুক ছেলে ছিলো তবুও তার সাথে কথা হয় নি মৃণার।

একদিন হঠাৎ সে কনাঘষা শুনতে পায়। তন্ময় বুশরাকে প্রাপোজ করবে। সবাই ভীষণ উৎসুক ছিলো। সাথে মৃণাও। দুইজনকে সবদিক থেকে একে অপরের সাথে মানাতো। তা সৌন্দর্য হোক বা গান। একে অপরকে কমপ্লিমেন্ট করতো।

গানের ক্লাস শেষে তন্ময় তার কলেজের পোশাকের উপর কোর্ট পরে, একগুচ্ছ ফুল হাতে নিয়ে বুশরার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। তারপর হাঁটু গেড়ে ফুল এগিয়ে তাকে প্রাপোজ করে। সাথে সাথে সবাই খুশিতে চিৎকার করে উঠে। সবাই যেন কোনো সিনেমা দেখছে। একটি সিনেমার দৃশ্য তাদের চোখের সামনে দেখায় তাদের কিশোরী চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। কিন্তু এই সিনেমার সমাপ্তিটা সুন্দর ছিলো না। বুশরা বিরক্ত হয়ে তার হাত থেকে ফুল নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে মারে। আর বলে, “তোমার মনে হয় তুমি আমার যোগ্য? কী করেছ তুমি আমার যোগ্য হওয়ার মতো? এই বয়সে আমার কন্ঠের কারণে আমাকে কতজন চিনে, আমি নিজের যোগ্যতায় বিদেশে মিউজিক ইন্সটাটিউটে পড়তে যাচ্ছি। হোয়াট এবাউট ইউ? যেদিন আমার যোগ্য হবে ওদিন কথা বলতে এসো।” বলে সে ফুলগুলো লাথি মেরে সরিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।

তন্ময় বিস্মিত হয়ে বসে থাকে কতক্ষণ। সবাই তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। লজ্জায়, অপমানে, কষ্টে সে দৌড়ে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। সে মুহূর্তে মৃণার তার জন্য খারাপ লাগে। কেননা তার বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর তারও এমন অপমান সহ্য করতে হয়। তাও প্রতি মুহূর্তে। তারও তখন এভাবে দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে হয়। যা সে করতে পারে না। কিন্তু আজ সে দৌড়ে গেল তন্ময়ের পিছনে। সে কলেজ থেকে বেরিয়ে দেখে তন্ময় রাস্তার একপাশে বসে কাঁদছে। তন্ময় তার তিন/চার বছরের বড় হবে।নিজের থেকে এত বড় ছেলেকে সান্ত্বনা দিতে গেলেও কি বলবে সে? কিন্তু সে যেতে নিলেও তন্ময়ের জন্যও খারাপ লাগে তার।

মৃণা দুইটা আইস্ক্রিম নিয়ে তন্ময়ের পাশে যেয়ে বসে। একটি তন্ময়ের দিকে এগিয়ে দেয়। তন্ময় বিরক্তি নিয়ে চোখের পানি মুছে তার দিকে তাকায়, “তুমি আবার কে?”
“আমি আপনাদের জুনিয়র। গানের ক্লাসে ছিলাম।”
“তো মজা উড়াতে এসেছ এখানে?”
মৃণা দ্রুত তার মাথা নাড়ায়। সে আইস্ক্রিমটা তার দিকে এগিয়ে বলে, “কষ্টে আপনার মন তেঁতো লাগতে পারে তাই মিষ্টি কিছু নিয়ে এসেছি।”
“কী?”
“আমার একটা বান্ধবী বলে কষ্ট লাগলে না’কি মিষ্টি খেতে হয় তাহলে মন ভালো হয়ে যায়।”
তন্ময় তার বোকামি কথা শুনে হাসে কিছুটা। তার হাত থেকে আইস্কিম নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “থ্যাঙ্কিউ।” তারপর সে আশেপাশে তাকায়, “তুমি ছাড়া কেউ আসে নি?”
মৃণা আবার মাথা নাড়ায়। তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ আকাশে তুলে তাকায়, “এতগুলো বন্ধু অথচ কেউ আমার পিছনে এলো না আমাকে দেখতে?”
“বন্ধু সংখ্যা বেশি না হয়ে আপন বেশি হতে হয়।”
“আচ্ছা তোমার আছে?”
“আমার দুইটা বান্ধবী আছে। অনেক ভালো। আমাকে অনেক ভালোবাসে।”
“কীভাবে বুঝলে? দেখবে আমার মতো যখন তোমার কাওকে লাগবে তখন ওরা থাকবে না। সবগুলো স্বার্থপর। বাহিরে আড্ডা দেওয়ার সময়, ঘুরতে যাওয়ার সময় শুধু আমাকে মনে পড়ে।”
“আমার বান্ধবীরা এমন না। ওরা সুখে, দু:খে সবসময় আমার সাথে থাকে।” মৃণা প্রতিরক্ষামূলক ভাবে উওর দেয়।
“তোমার এতটুকু জীবনে আবার কী কষ্ট?”
“আমার মা নেই। বাবা অন্য বিয়ের পর আর আমাকে ভালোবাসে না। তো বলতে গেলে বাবাও নেই।” তন্ময় চকিতে তাকায় এবার মৃণার দিকে। মৃণা আরও বলে, “আগে যখন সবার বাবা মা তাদের স্কুলে আসতো, আমার জন্য কেউ আসতো না। তখন আমার ক্লাসমেটরা জ্বালাতন করতো। কিন্তু ওরা থাকতে আমাকে আর কেউ কিছু বলতে পারে না। মহুয়া তো এক ছেলের নাক ভেঙ্গে ফেলেছিল।” মৃণা হাসে কথাটা বলে।
তন্ময়ও হাসে তার হাসিটা দেখে। সে মৃণার আইস্কিমের সাথে তার আইস্কিমটা একটু লাগিয়ে বলে, “চেয়ার্স। আমার মা বাবা থেকেও নেই। মাসে একদুইবার দেখা হয়। নাহলে কাজে সারাবছর এদেশ ওদেশে ঘুরে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে মনে পড়লে কল দেয়। তুমি আমি তাহলে দুইজনই একইরকম। পরিবার থাকতেও নেই।”
“আইস্ক্রিম গলে যাচ্ছে তো। খাবেন না?”
তন্ময় তার দিকে তাকায় একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে, “তোমার কাছে তাহলে আমি আইস্ক্রিমের জন্য ঋণী। কাল ক্লাস শেষে একটা রেস্টুরেন্টে আসবে। আমার ট্রিট।”
“সরি কিন্তু… ”
“প্লিজ মানা করো না। তুমি না থাকলে আজ আমি এখানে কতক্ষণ উদাসীন মনে বসে কাটাতাম কে জানে।”
“আচ্ছা।” উওরটার তন্ময় খুশি হয়।
“বাই দ্যা ওয়ে, সত্যি বলতে ক্লাসে তোমাকে আগে খেয়াল করিনি। আজই প্রথম দেখলাম তোমায়। এই দিনে আজ প্রথম ভালো একটা কিছু হলো।”

সেদিনের পর তাদের প্রায় দেখ হয়, কথা হয়। অনেক ভালো বন্ধু হয়ে যায় তারা। মৃণার পনেরোতম জন্মদিনও সে মোহ, মহুয়া ও তার সাথে পালন করে। তারপর কেটে যায় আরেক বছর।

সেদিন ষোলোতম জন্মদিন ছিলো মৃণার। সেদিন মহুয়া তাকে নিয়ে আসে তার বাসায়। মোহ ও মহুয়া তার জন্য ছোটখাটো আয়োজন করেছিল। সেদিন তার অনেক ভালো যায়। তার মা যাবার পর এই প্রথম তার জন্মদিন এত ভালো কাটে কিন্তু সেদিনটা তার জন্য আরও খুশির হয়ে উঠবে কে জানতো। মহুয়ার বাসা থেকে বের হবার পর তাকে তন্ময় নিতে আসে গাড়ি নিয়ে। তাকে নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে যায়। সেখানে অনেককিছু অর্ডার দেয়। কেকও আনায়। কিন্তু মৃণা কফি ছাড়া কিছুই খায় না। সে সবসময়ই তন্ময়ের সাথে বের হলে পানি অথবা চা কফি খায়। এর থেকে বেশি সে কিছুই নেয় না। কারণ তন্ময় তাকে সবসময় অনেক দামী রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসে যা তার সামর্থ্যের বাহিরে। আর সে নিজের খাবারের টাকা নিজেই দিতে চায়। তন্ময় তার জন্য কিছু দামী উপহারও আনে। তা জোর করলেও সে নেয় না সে। যা ফেরত দিতে পাড়বে না তা গ্রহণ করবে কেন?

সন্ধ্যায় বাসায় যাওয়ার পূর্বে তন্ময় তাকে নিয়ে রমনা পার্কে আসে। তার জন্য একটা উপহার তৈরি করেছে যা মৃণা ফিরিয়ে দিতে পাড়বে না।
তারা বসে পুকুরের সামনের বেঞ্চে। তন্ময় তার গিটারটা কোলে নিয়ে বাজাতে শুরু করে। বলে, “এই গানটা আমি কেবল তোমার জন্য শিখেছি…”

চোরাবালি মন তোমার কেন শুধু লুকিয়ে থাকো?
একটু আড়াল হয়ে আমায় দেখো
চোরাবালি মন তোমার কেন শুধু লুকিয়ে থাকো?
একটু আড়াল হয়ে আমায় দেখো
যদি কোনো চিত্র আঁকি
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী
সে চিত্রতে তুমি perfectly বসো
কেন লাগে শূন্য শূন্য বলো
তোমায় ছাড়া এত? তুমি কি তা বলতে পারো?

পুকুর পাড়ের তীব্র বাতাসে তার কৃষ্ণাঙ্গ কেশ তার মুখে এসে বিরক্ত করতে লাগলো। সে তার চুল সরিয়ে তার সামনে বসা যুবকটির দিকে তাকায়। তার গাঢ় বাদামী রঙের চুলগুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। তবে সেদিকে তার ধ্যান নেই। সে মৃণার দিকে তাকিয়ে গানটি গেয়েই যাচ্ছিল। তার মুখটায় হাসি হাসি ভাব। সে হাসিতে, সে সুরে, সে বাতাসে মৃণার কিশোরী মনটা দোলে গেল। সে জীবনে প্রথম তার হৃদয়ে প্রেমের আগমন ঘটেছিলো।

বর্তমানে সে গিটারের দিকে তাকিয়ে কেমন দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃণা। তার মনে হয় সেদিন তন্ময়ের সাথে তার দেখা করাটাই অনুচিত ছিলো।

তন্ময়ের শব্দ সে শুনতে পায় পিছন থেকে, “মৃণা তুমি এখানে?”
মৃণা পিছনে তাকায়। তার ঘুম ঘুম চোখদুটো এখনো সে সম্পূর্ণ খুলতে পাড়ছে না। সে উঠে বসতে গেলে মৃণা দৌড়ে তার কাছে যায়, “বসা লাগবে না। শুইয়ে থাকো। কিছু খাবে?”
“তুমি এখানে কী করো?”
“কারিম চাচা বলল তুমি অসুস্থ তাই চলে এলাম।”
“তোমার এখানে আসা উচিত হয় নি। আমি বুশরাকে কল দিয়েছিলাম ও বলল আসবে। ও এসে তোমাকে যদি এখানে দেখে তাহলে কী ভাববে বলো?”
মৃণার মুখটা মলিন হয়ে গেল। তার মনে হলো বুকের ভেতরটা কেউ মুচড়ে দিয়েছে। এত ব্যাথা করছে কেন?
তবুও সে জিজ্ঞেস করে, “তোমার এলার্জি হলো কীভাবে?”
“বুশরার শী ফুড অনেক পছন্দ। তাই ওর সাথে গিয়েছিলাম। ও সাধলো তাই…”
“তাই বলে তুমি খেয়ে নিবে? তোমার কত বড় এলার্জি আছে তুমি জানো না? হাস্পাতালে নিতে হয় নি ভাগ্যিস।”
তন্ময় বলল, “তুমি যাও। আমি তোমাকে পড়ে কল দিব।”
মৃণা কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু আর বলল না।
তার যাবার পর তন্ময় দেখলো তার বেডের পাশের টেবিলে খাবার ও ঔষধ রাখা। নিশ্চয়ই মৃণা রেখেছে। মেয়েটা এখনো তার এত খেয়াল রাখে কেন? সে কী মৃণার এই যত্নের আদৌও যোগ্য?
সে তার ফোন বের করে দেখে। বুশরা এখনো আসে নি। সে কী ঘর চিনতে পারেনি? হারিয়ে গেল না’কি?
সে ফোন বের করে দেখে বুশরা তাকে মেসেজ দিয়েছে, “আমি আজ আসতে পাড়ব না। আমার কাজ এসে পড়েছে।”

মৃণা হাঁটছিল। পড়ন্ত শেষ বিকেলে আবারও তন্ময়ের সাথে তার প্রথম কথোপকথন মনে পড়ে। তার চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে অশ্রুসিক্ত। সে রাস্তার এককোণে যেয়ে বসে। কিছু সময় কাটে। কেউ আসে না। সে নিজের পাশে তাকায়, তার পাশে কেউই নেই। তার হৃদয়ের ভেতরের যন্ত্রণা কাবু করতে থাকে তাকে। সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মুখে হাত দিয়ে। সে সময় তার ঠোঁট দিয়ে কেবল একই বাক্য বারবার বেরিয়ে আসে, “তন্ময় তুমি অনেক স্বার্থপর। অনেক স্বার্থপর। সে সবে আসলো আর তুমি আমাকে এভাবে ছেড়ে দিলে?”

চলবে…

#মেঘের_খামে
পর্ব ৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মহুয়ার আজ ভার্সিটি ঢুকেই কেমন যেন লাগলো। সবাই গত তিনদিন ধরেই তার দিকে তাকিয়ে ছিলো কিন্তু আজকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। তার মনে হলো সকলে ইচ্ছা করেই তার থেকে চোখ সরাচ্ছে না। আজ ভার্সিটির মাঠেই জাহানকে তার পাতানো ভাই ব্রাদারদের সাথে দেখে তার সন্দেহ ঠিকই মনে হয়। তাদের মধ্যে একজন কিছু একটা ইশারা করে তখনই সে বুঝতে পারে এটা তার সন্দেহ না। জাহান নিশ্চয়ই কিছু ভেবে রেখেছে।
তার চিন্তায় পড়ার কথা ছিলো। কিন্তু সে খুশি হয়। বিষয়টাকে একটা খেলার মতো দেখে সে। তার কাছে ব্যাপারটা এডভেঞ্চারাস লাগে। সে লিফটের সামনে যেতেই তার মনে হয় এটাই তাকে টার্গেট করার প্রথম স্থান। যে লিফটের সামনে মানুষের গিজগিজ থাকে সে স্থান খালি যা হজম করার মতো না।

সে সন্দেহ করে। লিফটের বাটন চাপ দিয়েই দৌড়ে সিঁড়ির কাছে যায়। উঁকি দিয়ে দেখে তার সন্দেহ ঠিকই ছিলো। লিফটের দরজা খুলতেই দুইজন কতগুলো পানির বেলুন মারতে থাকে হাওয়ায়। সে দেখে পিছনে তাকায়। জাহানের দিকে। বিজয়ীর হাসি দিতেই সে দেখে জাহানও হাসছে অর্থাৎ এখনো কিছু একটা করে রেখেছে এই ছেলে। সে ভেংচি কেটে উপরে যায়। তার ক্লাসরুমের দরজা বন্ধ। সে জানে এই দরজা খুলতেই তার উপর এক বালতি পানি পড়বে। সে বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলে, “এই জাহানের বাচ্চা কি আমাকে ছাগল ভাবে?”

সে বিরক্ত হয়েই নিচে যায়। জাহানের সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে বলে, “ভাই সিরিয়াসলি এই বাচ্চাদের মতো ট্রিক আমার উপর ব্যবহার করতেছ? এই ট্রিক তো আমি দশ বছর আগে করতাম। ভাবছিলাম জীবনে প্রথম কোনো বুদ্ধিমান প্রতিদন্দ্বীর থেকে বিজয়ী হবো। কতটা আনন্দের ব্যাপার স্যাপার। আহ আমার আনন্দে আসলে পানি ঢেলে দিলা। যাই হোক, যত ছোট ট্রিকই হোক না কেন যেহেতু আমি আবারও বিজয়ী হয়েছি সো কনগ্রেটস জানাতে… ”
চুপ হয়ে গেল সে। হঠাৎ সে খেয়াল করলো তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘুরে তাকাতেই কেউ এক বালতি পানি তার উপর ঢেলে দিয়েছে। এই চমক থেকে বের হবার আগেই আরেক বালতি পানি ঢেলে দিলো।

সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই রইলো। হঠাৎ কি হলো সে বুঝতে পাড়ল না। এটা তার ক্যালকুলেশনে ছিলো না।
এমন সময় জাহান তার সামনে এসে দাঁড়ায়। উপরে তাকায় মহুয়া। তার মুখে রাগ রাগ ভাব। কিন্তু মনে তার রাগ না বিরক্ত লাগছে। এত সাধারণভাবে সে জাহানের কাছে হেরে গেল? যদি কোনো কঠিনভাবে জাহান তাকে পরাজিত করতো তাও মানা যেত কিন্তু এভাবে? এসব বাচ্চামো ট্রিকে সে হেরে গেল। সে কি আসলেই ছাগল?

ভাবতেই জাহানের ভারী স্বরে তার ধ্যান ভাঙে, “আই থিংক এবার তোমার আমাকে কনগ্রেটস বলা উচিত।” বলে বাঁকা হাসে সে। আবারও বলে, “যতই বড়বড় কথা বলো না কেন আসলে তুমি বাচ্চাই। তাই বাচ্চামো ট্রিকেই হেরে গেলে।”

মহুয়া মনে মনে কান্নাকাটি করে জাহানের চুলগুলো টেনেটুনে ছিঁড়ে ফেললেও বাহিরে শান্ত গলায় বলে, “ডোন্ট ওয়ারি মিঃ ইয়াজভান জাহান গেইম তো সবে শুরু। আমি আসলে এতটা গুরুত্ব দেই নি তোমাকে। এবার আমিও দেখবো কে জিতে।”

বাতাস এসে তাকে ছুঁলে ভেজা শরীরে কেঁপে উঠে মহুয়া। পানি দিয়ে ভেজালো তাও ঠিক আছে। একটু কুসুম গরম পানি আনবে না। এখন সে শীতে মরে গেলে কী হবে? এই লোক তাকে হারিয়েছে। সে পরাজিত খেলোয়াড় হয়ে মরেটরে গেলে তার মান সম্মানে কথাটা এসে পড়বে। তার চোখ পরে জাহানের কাঁধের উপর একটি জ্যাকেট ঝুঁলিয়ে রাখা। সে বিনাবাক্যে তার নীল জ্যাকেটটা নিয়ে নিজে পরে নেয়।
“হোয়াট দ্যা হেল!” জাহান কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠে।
মহুয়া তার দিকে তাকায়, “তো তোমার কি মনে হয় আমি এখন এইভাবে বাসায় যাব? ডোন্ট ওয়ারি ধুঁয়ে দিয়ে দিব। বাই দ্যা ওয়ে থ্যাংকস।”
“কী? থ্যাংকস?” বিস্মিত স্বরে জাহান জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ আজকে আমার ক্লাস মিস। স্যার জিজ্ঞেস করলে সবাই তো আজকের কাহিনী বলবেই মানে স্যার আমাকে কিছু বলতে পাড়বে না। ইয়াহুউউ আজকে ক্লাস নেই।” শেষ কথাটা মহুয়া এত জোরে বলল যে জাহান পিছনে সরে যায়। তার কান দিয়ে আরেকটুর জন্য রক্ত পড়ে নি।
সে দেখে মহুয়া নাচতে নাচতে ভার্সিটির গেইট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

জয় জাহানের পাশেএসে বলে, “ভাই অবশেষে আপনি একবার জিতছেন।”
জাহান সরু চক্ষুতে তাকায় তার দিকে। জয় আমতা-আমতা করে বলে, “মানে মহুয়া থেকে জিতছেন। তিনবার হারার পর।”
জাহানের আরও মেজাজ খারাপ হয়। তার তো মহুয়ার নাচা দেখে সন্দেহ হচ্ছে আসলে সে জিতেছে? সে জয়কে রাগী কন্ঠে বলে, “তোদের বলেছিলাম পানি না কোক বা অন্য কোনো বেভারেজ মেয়েটার উপর ঢালবি। না তোদের তো বাচ্চা মেয়ে বলে দরদ ভেসে যাচ্ছিল। ওর নাচা দেখেছিস। আমার লিটিলারি গা জ্বলছে। এই মেয়ে আসলে একটা মানসিক রোগী।”
“শান্ত হন ভাই। শান্ত হন।”
“কি বলেছিলি ও তিনবার জিতেছে?”
“হ্যাঁ ভাই। ওই গাড়ি ভেঙে একদিন, বাস্কেটবল ম্যাচের দিন আর হলে…”
“হয়েছে বুঝেছি। আর আমি একবার। মানে টানা তিনবার হারালে আমি এগিয়ে যাব। ওকে আমি আর অপেক্ষা করতে পাড়ব না। আগামী কালই তাহলে ওকে দুইবার হারিয়ে সমান হতে হবে।”
“কী করবেন ভাই?”
“সময় হলে দেখিস।”
.
.
তিসান লাইব্রেরিতে যায়। সাততলার শেষ দিকে লাইব্রেরী। সে সাধারণত এখানে আসে না। এত সকাল সকাল তো না-ই। কিন্তু তার একটা এসাইনমেন্ট আগামীকালই জমা দিতে হবে। তাই বই খুঁজতে আজ তাড়াতাড়ি ভার্সিটিতে এলো সে। সে বিশাল লাইব্রেরীর মধ্যে প্রায় পনেরোমিনিট ধরেও তার প্রয়োজনীয় বইটি পাচ্ছে না সে। সে কেবল একা না তার সাথে আরও দুইজন খুঁজছে তার জন্য।

বই খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ তার চোখ পড়ে শেষ টেবিলের দিকে। জানালার কাঁচ ভেদে মিষ্টি সোনালী রোদ্দুর একটি মেয়ের মুখে এসে পড়ছিল। কমলা রঙের পোশাক পরিহিতা মেয়েটার মুখটা সোনালী রঙের হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল সত্যিই তার রঙ সোনালী। তার ঢেউ খেলানো কোমড় অব্দি খোলা চুলগুলো লালচে হয়ে আছে। সাথে সোনালি কিছু চুল চিকচিক করছে। সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়। সে বুকসেল্ফ থেকে অচেনা এক বই নিয়েই টেবিলে যায়। জিজ্ঞেস করে, “আমি কি এখানে বসতে পারি?”

মেয়েটি তাকায় এবার চোখ তুলে তার হাল্কা বাদামী চোখগুলো দেখে তিসান এক ঢোক গিলে। তার হৃদয় স্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে গেল। মেয়েটি আসেপাশে তাকাল। হয়তো দেখে বুঝাতে চাইছে সব টেবিল খালি। তাই সে আবারও জিজ্ঞেস করে, “বসতে পারি?”
“খালিই তো আছে। যেখানে ইচ্ছা বসুন।”

সে তার সামনে সেখানেই বসলো। মেয়েটা আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো। তার মনে হলো সে মেয়েটাকে আগেও কোথাও দেখেছে। তার মনে পড়ে সে মেয়েটাকে দেখেছে একদিন আগেই। লিফটের সামনে। এই মেয়েটাকে দেখেই সে মুগ্ধ হয়েছিল সেদিন। আজ আবারও হলো। তিসান একটা মেয়েকে দেখে যেহেতু দুইবার মুগ্ধ হয়েছে তাহলে মেয়েটা আসলেই বিশেষ।

তিসান কেশে মেয়েটির আকর্ষণ তার দিকে করার চেষ্টা করে। লাভ হয় না। তাই সে নিজেই কথা শুরু করে, “কী বই পড়ছেন?”
তার কথায় মেয়েটা চোখ তুলে তাকায়। এই মেয়েটি যদি তার দিকে এই দৃষ্টিতে আর কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে তাহলে সে নিশ্চিত এখানেই হার্টঅ্যাটাক করবে। মেয়েটা ঠিক উওর দেয় না। সে গালে হাত রেখে তাকে দেখে হঠাৎ বলে, “আপনাকে আমি কোথাও দেখেছি।”
উফফ এত মিষ্টি সুর কারো কীভাবে হয়? তিসান খুবই কষ্টে তার হৃদয় সামলায়। কিন্তু তবুও কিছু বলতে পারে না।

বোধহয় তাকে উওর না দিতে দেখেই মেয়েটি অস্বস্তিবোধ করে বলে, “আসলেই আপনাকে দেখেছি মনে হয়েছে। অন্যভাবে বলছি না।”
তিসানের মেয়েটাকে আরও কিউট লাগে। সে হেসে তার চুলঠিক করে বলে, “মাঝেমধ্যে শখের বশে মডেলিং করি। হয়তো সেখান থেকেই… ”
“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। আমি ম্যাগাজিনে আপনার ছবি দেখেছি।”
“রিয়ালি? তো ভালো লেগেছে তোমার?”
“কী?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মেয়েটি।
“আই মিন প্রডাক্ট… পোজিং… প্লিজ বাদ দেও কি যা তা বলছি আমি।”
লজ্জায় শেষ তিসান। কি করছে সে? বলতে চাইছেটা কি? তার কি হয়েছে সে নিজেও বুঝতে পাড়ছে না।

তখনই সে হাসির শব্দ শুনে। সামনে তাকিয়ে দেখে তার সামনে বসা মেয়েটি মুখ চেপে হাসছে। তাকে ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে। একবার তাকিয়ে আর সে চোখ ফেরাতে পারে না। তাই সে প্রশ্ন করেই বসে, “আচ্ছা কিছু মনে না করলে তোমার নাম জানা যাবে?”
মেয়েটা কিছু বলতে নিবে এর পূর্বেই কেউ জোরে তার নাম ডাকে, “তিসান ভাই…তিসান ভাই দেখে যান কী পেয়েছি!”
তিসান বিরক্ত ও লজ্জিত দু’টোই হয়। সে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বকে তার সাথীদের তারপর বলে, “আমি একটু আসছি।”
মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, “তো আপনাকে লাইব্রেরিতে এভাবে চিৎকার করে ডাকছে?”
প্রশ্নটায় আরও লজ্জিত হয় তিসান। মেয়েটি বলে, “জলদি যান নাহয় লাইব্রেরীয়ান আপনাদের সবাইকে তার কান থেকে রক্ত বের করার দায়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। আমি নিশ্চিত।”
তিসান জোরপূর্বক হেসে আবদার করে বলে, “তুমি থাকো আমি এখনই আসছি।”
তিসান দ্রুত যায় তার সাথীদের কাছে। যেয়ে জানতে পারে তারা বইটি পেয়েছে। তিসানের এবার রাগ হয়। এমনভাবে তারা চিৎকার চেঁচামেচি করছিল যেন কোনো খাজানা পেয়েছে তারা। সে বিরক্তি নিয়েই আবারো টেবিলে ফেরত যায়। কিন্তু আর সে রূপবতী অপ্সরীর দর্শন পায় না। টেবিলে কেউ নেই। মেয়েটি এভাবে তার নাম না জানিয়ে চলে গেল?
.
.
মহুয়া মোহের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে দশ মিনিট ধরে। সে দেখল এখন সে দৌড়ে আসছে। এসে হাঁপাতে হাঁপাতে তাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে। তারপর জিজ্ঞেস করে, “কি’রে তোর এই শীতে মাঝরাস্তায় গোসল করতে মন চাইলো কেন?”
“তোর বিয়া যে তাই।”
“তুই আমার বিয়াতে এভাবে আসবি? হবু জামাইয়ের সামনে আমার আর মান সম্মান থাকব না।”
“মান সম্মান তো আমি ওই জাহানের মিটামু।”
“আবার কী হলো?”
“রিক্সায় উঠ। সব বলতেছি। আজকের প্লান শুন, ক্লাস ক্যান্সেল সো আগে একটা শপে যাব। একটা ড্রেস কিনে পালটে যাব একটা খাবারের দোকানে। সেখান থেকে কতকিছু কিনে যাব মৃণার বাসায়। ওকে নিয়ে যাব বাসায়। বাসায় যেয়ে সব খাবারের প্যাকেট খুলে খাব আর জাহানকে শায়েস্তা করার প্লান করব।”
“খাবারের দোকানটা সবসময়ই তোর কথায় হাইলাইটেড থাকে তাই না?”
“আবার জিগায়। আপাতত আমার একমাত্র প্রেমই তো এটা। এখন বিরক্ত না করে রিক্সায় উঠ।”
তারা রিক্সায় উঠে। মহুয়ার প্লানমতো সব কাজ শেষে মৃণার বাসার সামনে এসে তাকে কল দেয়।

“বল মহু….”
“তোর বাসার সামনে আছি। তাড়াতাড়ি আয়।” মহুয়া বলে।
“এখন? রান্না করছি তো।” উওরটা দেওয়ার সাথে সাথে কল কেটে যায়। মৃণা তার ফোনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার মনে পড়ে চুলায় তরকারি আছে। মনে করতেই সে দ্রুত যায়। কিছুক্ষণ পর রান্না করার সময় কলিংবেল বাজে। আর তার ছোট ভাইয়ের উৎসুক কন্ঠে শোনা যায়, “মা মা মোহ আপু এসেছে। মোহ আপু এসেছে।”
সে চুলা বন্ধ করে বাহিরে যায়। দরজার সামনে যেয়ে দেখে মহুয়া ও মোহ এসেছে। তার ভাই মোহের আগেপিছে ঘুরছে। তার ভাই তার থেকে সাত বছরের ছোট। এই বছর কেবল তেরো বছরে পড়ল। অথচ মোহকে দেখে সে নিজেকে কত বড় মনে করে। তাকে দেখে খানিকটা হাসে মৃণা।

তার সৎ মা নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এসেই মহুয়াকে দেখে তার চোখদুটো খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠে। ঠিক মহুয়াকে দেখেও না তার হাতের এতগুলো প্যাকেট দেখে। মৃণা এই জিনিসে বিরক্ত হয়। সে মহুয়াকে আগে অনেকবার মানা করেছে তাদের বাসায় কিছু না আনতে। তার কেমন যেন খারাপ লাগে। সে জানে মহুয়া চায় কিছু জিনিসের বিনিময়ে হলেও তাকে এই বিরক্তিকর খাঁচা থেকে কিছুসময়ের জন্য উড়িয়ে নিয়ে আসতে। কিন্তু তবুও তার খারাপ লাগে।

মহুয়া ব্যাগগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল, “আন্টি এগুলো আপনার জন্য।”
রুবিনা বেগম ব্যাগগুলো তাড়াতাড়ি নিয়ে বলে, “আরে এগুলোর কি দরকার ছিলো। তোমাদের কি এসব নিয়ে আসতে হয় না’কি? ভেতর আসো, বসো।”
“না না আন্টি। আসলে মৃণাকে নিয়ে বাহিরে যেতাম। ‘কিন্তু ও মানছেই না। ওর না-কি কাজ আছে। আমি বলি আন্টি থাকতে তোর আবার কী এমন কাজ? তাও মানছে না আপনাকে না’কি হেল্প করবে কাজে। আমিও বলি আন্টি এখনো যে প্রিটি আর স্ট্রং এরকম পাঁচটা ঘর সামলে নিবে তোর হেল্পের কি প্রয়োজন? ঠিক বলেছি না আন্টি?”
রুবিনা বেগম আমতা-আমতা করে বলে, “ঠি…ঠিক বলেছ।”
” তো আন্টি ওকে নিয়ে যাই? আজ আমার বাসায় থাকুক।”
“হ্যাঁ…. হ্যাঁ যাও।”
“আর আন্টি এই শুক্র, শনিবার আমরা বেড়াতে যাব। ওকে নিয়ে যাব কিন্তু। ও মানা করছে। আপনি ওকে জোর করে পাঠিয়ে দিবেন।”
জোর করে হাসল রুবিনা বেগম, “ঠিকাছে।”
“আন্টি আপনি এত্তো সুইট কেন বলেন তো।” সে আবার মৃণার দিকে তাকায়, “দেখেছিস আন্টি কত সুইট। এখন দৌড়ে যা ব্যাগ আর মোবাইল নিয়ে আয়।”
.
.
তিনজনে রিকশাতে উঠেছে। একটু আগের মৃণার সৎ মা এর কাহিনীতে এখনও হাসাহাসি করছে। মহুয়া উপরে বসেছে। মোহ মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাই তুই পারিসও কীভাবে চাসনিতে ডুবিয়ে আন্টিকে বাঁশ দিলি।”
“মৃণার ফ্যামিলি দেখে কিছু বলতে পাড়ি না, নাহলে ওনাকে দেখতে আমার গা জ্বলে যায়।”
” আচ্ছা মৃণা তুই দুইদিন ধরে আসছিস না কেন? ”
“এমনি ভালো লাগছিল না।”
“তোর শরীর খারাপ? জ্বর জ্বর লাগছে?” বলে মোহ চিন্তিত সুরে তার কপালে হাত রাখে।
“আরে না এমনিতেই ভালো লাগছিল না ক্লাসে যেতে।”
মহুয়া হেসে বলে, “ভাই তোরে আমার সঙ্গদোষ লাগছে।”
মোহ বলে, “কি যে কাহিনী মিস করলি আজ আমাদের মহুয়া জাহান ভাইয়ের কাছে হেরে গেল। এই মহু তুই না বলেছিলি তুই কেবল তাকে মন দিবি যে তোকে হারাতে পাড়ছে।”
“ছি: আমার টেস্ট এত খারাপ না’কি যে ওই জাহানকে মন দিব।”
“এভাবে বলিস না জাহান ভাই সেই হ্যান্ডসাম কিন্তু। আমাদের ক্লাসের তো সব মেয়ে পাগল। আমি তো শুনেছি আমাদের ভার্সিটিতে না’কি উনিই সবচেয়ে হ্যান্ডসাম। তার জন্য মেয়েরা ফ্যানক্লাব করে বসে আছে।”
“সবগুলো পাগল দেখেই ওই ছেলের জন্য পাগল। আমার তো তাকে দেখে গা জ্বলে।”
“কিন্তু সে তো তোকে হারিয়ে দিয়েছে।”
“যাস্ট একবার। আর আমি তিনবার। এখনো আমার টক্করে আসতে পারে নি। আমার টক্করে আসার আগে আমি ওনাকে আরেকটা বাঁশ দিব।”

তারা যখন কথায় ব্যস্ত মৃণা তাদের দিকে তাকাল একে একে। প্রথমে দেখে তার পাশে বসে মোহকে। অপরূপা সুন্দরী মেয়েটি। তার চোখ, ঠোঁট, চেহেরা, রঙ সব যেন নিখুঁতভাবে তৈরি। তাকে দেখে যেকেউ প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হতে বাধ্য। সে-ও যদি ছেলে হতো এক দেখাতে মোহের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতো। কেবল সৌন্দর্য নয় তার আচরণ, ব্যবহার, সৃজনশীলতা, বুদ্ধি সবকিছুই নিখুঁত। তার সবই নিখুঁত।
তারপর তাকাল উপরে চোখ তুলে মহুয়ার দিকে। বাবা-মা, ভাইয়ের জীবন সে। তারা তাকে কাঁচের আলগে রাখে যেন ছাড়লেই ভেঙে যাবে। তাকে একটুও কষ্ট পেতে দেয় না তারা। তাও মহুয়া প্রচুর সাহসী, শক্ত, আত্নবিশ্বাসী ও নিজের সকল লক্ষ্য অর্জন করার ক্ষমতা রাখে।

এমন কোনো গুণ নেই মৃণার মধ্যে। সে খুবই নরম স্বভাবের মানুষ। একটুতেই ভেঙে পড়ে। তার কাছে নেই আদর করার মতো মহুয়ার পরিবার। নেই তার মতো সাহস ও আত্নবিশ্বাস। নেই মোহের মতো বুদ্ধি, নেই তার মতো সৌন্দর্য।

সে নিজের হাতের দিকে তাকালো, সে শ্যামবর্ণের রোগা একটি মেয়ে। স্বাভাবিক তন্ময় কেন তার মতো একটি মেয়েকে বেছে নিবে? তার জন্য বুশরা আপুই সঠিক যে মোহ ও মহুয়ার মতো। একটুও তার মতো নয়।
সে গভীর নিশ্বাস ফেলে তার দুই বান্ধবীকে দেখে। তারা এখনো গল্প করছে। সে মৃদু হেসে তাদের কথোপকথনের মাঝে বলে, “কেবল তোরা দুইজনই আমার পরিবার।”
তার এমন কথা শুনে মহুয়া ও মোহ দুইজনে থেকে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।
“হঠাৎ এই কথা বলসি যে? কিছু হয়েছে?” মোহ জিজ্ঞেস করে।
মৃণা মৃদু হাসে। খানিকটা লজ্জা পেয়ে তার চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে বলে, “এমনিই বললাম।”
মহুয়া হেসে পিছন থেকে দুইজনকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে, “অফকোর্স আমরা ফ্যামিলি। নট বাই ব্লাড বাট বাই চয়েজ।”
.
.
রাতে তিনজন বসেছিল মহুয়ার রুমে বসেছিল। মহুয়া পপকর্ন খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে, “তোরা কেউ কোনো আইডিয়া দিচ্ছিস না কেন?”
মোহ তার ফোনের দিকে তাকিয়ে বলে, “ভাই তোর মাথায় বুদ্ধির অভাব আছে আমরা কি দিব? আর এসব শয়তানি বুদ্ধি কেবল তোর মাথায়ই আসে।”
“প্রশংসা করছিস না ইনসাল্ট?”
“যেটাই ভাব। কিন্তু আমার মনে হয় জাহান ভাইকে জব্দ করা এতও সহজ হবে না। তাকে দেখেই কেন যে একটা উইনার ভাইব আসে।”
মহুয়া বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকায়, “তুই তার সাইডে না আমার সাইডে বল তো?”
“সাইডের কথা না। এতটুকু বলছি তাকে হারানো তোর জন্য সহজ হবে না। সে তোকে এতটাই দুর্বল ভাবে চাইল্ডিস ট্রিক ব্যবহার করে তোকে হারিয়েছে।”
“আর আমি তো ওকে তিনবার হারিয়েছি।”
“আই মিন লাস্টের ব্যাপারটা ইম্প্রেসিভ কিন্তু প্রথম দুইবার সে অফফগার্ড ছিলো। তো এবার তোকে অনেক স্ট্রং প্লান করতে হবে। আর এটা মাথায় রাখবি যে সে ভার্সিটিতে সবাই জাহান ভাইকে ফেভার করে।”
“উঁহু, সবাই না।” হঠাৎ মহুয়ার তিসানের কথা মনে পড়ে।

মৃণার তাদের কথাবার্তা রাজনৈতিক কথার মতো ক্লান্তিকর লাগে। তাই সে উঠে বের হয় রুম থেকে। মহুয়াদের ডুপ্লেক্স এপার্টমেন্ট। নিচতলায় ড্রইং, ডাইনিং এবং মহুয়ার মা বাবার রুম। আর দোতলায় মহুয়া, মুরাদ ও একটি গেস্টরুম আছে। কিন্তু তার সবচেয়ে বেশি পছন্দ এক পাশে বড় ব্যলকনিটা। ব্যলকনিটা একটা ছোট রুমের সমানই। এখানে একটা সোফা ও ছোট টেবিল আছে। কয়টা ফুলের গাছও লাগানো একটা যার কারণে সারাক্ষণ একটা মিষ্টি সুবাস দোলতে থাকে হাওয়ায়।

মৃণা এই স্থানে আসলে সে কিছু মুহূর্তের জন্য সবকিছু ভুলে যায়। এক আঁধারভরা আকাশ জুড়ে তারার ছিটিমিটি। অন্যদিকে মিষ্টি বাতাসের সাথে মিশানো সুবাস। এখানে কিছু মুহূর্ত কাটানো তার জন্য স্বর্গ থেকে কম না।

সে যেয়ে বর্ডারে কোণি রেখে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার হাঁটু অব্দি চুলগুলো উড়তে থাকে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছিল। সে আলতো করে তার মুখে আসা চুল কানের পিছে গুঁজে নেয়। তারপর আকাশের দিকে তাকায়। হঠাৎ তার আভাস হয় এখানে সে ছাড়াও আরও কেউ আছে। তার বুকের ভেতরটা ভয়ে কেঁপে উঠে। সে আশেপাশে তাকায়। দেখতে পায় সোফায় বসা এক অগ্নিমূর্তি। তার বুকের ভেতরের ভয় আরও বাড়ে। সে ধীর পায়ে এগোয় সেদিকে।

সে কাঁপা -কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কে ওখানে?”
উওর আসে না। ভয় আরও বাড়ে তার। সে এক ঢোক গিলে এগোতে থাকে। যখন কাছে যায় তখন চন্দ্রিমার দেখতে পায় সে অগ্নিমূর্তিটা আর কেউ না মুরাদ ভাইয়া। সে হাত বুকের উপর ভাঁজ করে মাথা উপরে তুলে বসে আছে। তাকে দেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে মৃণা। সে সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছিল। মৃণা খেয়াল করে মুরাদের চশমা পড়ে যাচ্ছে। তার হয়তো ঘুমাতে অসুবিধাও হচ্ছে। তাই সে আলতো করে তার চশমাটা সরাতে চায়। আচমকায় মুরাদ তার হাত ধরে ফেলায় মৃণা নিজেও চমকে উঠে।
মুরাদ ঘুমঘুম চোখে তাকায় তার দিকে। বলে, “ওহ তুই! আমি ভেবেছি কোন ভূত পেত্নীর এত সাহস এসে আমার ঘুম নষ্ট করল।” তারপর তার ধরা মৃণার হাত একটু উঁচু করে ঘুরিয়ে দেখে।
“কী করছেন?” মৃণা অবাক হয় তার কান্ডে।
“ভাবছি তোরও ভূত পেত্নী হতে বেশিদিন লাগবে না। একটু জোরে নাড়লেই ভেঙে যাবে।”
মৃণা মুখ ফুলিয়ে নেয়, “মুরাদ ভাই মজা করেন না তো।”
“তোর মনে হয় আমি মজা করছি। এই দেখ আমার দুই আঙুলের মাঝেও ঢিলা হয়। তোকে না ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম ঠিক মতো খাওয়ার জন্য। তোর কি এখন আর আমাকে ভয় করে না?”

মৃণা যেন এবার কেঁদেই দিবে। মুরাদ তার হাত ধরে রেখেই তাকে পাশে বসায়। অন্য হাত দিয়ে তার চশমাটা নিয়ে পড়ে বলে, “এই কান্নাকাটি করবি না বলে দিলাম। কান্না করলে এখানেই একটা চড় মারবো।”
মৃণা সাথে সাথে চুপ হয়ে যায়। মুরাদ তার পাশের টেবিল থেকে তিনটা চকোলেট দিয়ে বলে, “নে তোদের তিন বান্দরনীর জন্য।”
মৃণা খুশিমনে চকোলেট নেয়, “মোহ দেখে তো অনেক খুশি হবে।”
“তুই খুশি হলি না?”
মৃণা একগাল হেসে তার দিকে তাকায়, “”আমি তো খুশিই। মোহের মিষ্টি খাবার বেশি পছন্দ এজন্য।”
মুরাদ তার দিকে তাকিয়ে হাসে, “কবে বড় হবি তুই?”
“হুঁ? কিছু বললেন মুরাদ ভাইয়া।”
“সেসব বাদ দে। তোর গায়ক বয়ফ্রেন্ড এর খবর কী? আবার সব মিটমাট?”
মৃণার মন খারাপ হয়ে যায়। সে মৃদুস্বরে বলে, “সে ব্যস্ত।”
“নতুন গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে?”
সে মুরাদের দিকে তাকায়। মুখ কালো করে বলে, “আপনি জানলে জিজ্ঞেস না করলেও পাড়তেন।”

মুরাদ সে কথায় হাসে। মৃণার তার হাসি দেখে আরও রাগ হয়। সে মুখটা কান্নামাখা করে নেয়। এই তার প্রধান সমস্যা। তার সহজে রাগ উঠে না, রাগ উঠলেও সে রাগ দেখাতে পারে না। তার কেবল কান্না আসে।
সে উঠে যেতে নিলে দেখে মুরাদ এখনো তার হাত ধরে রেখেছে। সে বলে, “ভাইয়া আমার হাত…”
তার কথা শেষ হবার আগেই মুরাদ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, “তোর কি নিজেকে আমার বোন মনে হয়? আমার একটাই বোন আছে। আর আমার বোনের মুখেই ভাইয়া শুনতে ভালো লাগে। আর এই আহ্লাদী ডাক ডাকবি না আমাকে। বুঝলি?”
মুরাদের দৃষ্টি দেখে মৃণা ভয়ে ঢোক গিলল। দ্রুত মাথা নাড়ায় সে। মুরাদ সেখান থেকে তেজ দেখিয়ে উঠে চলে যায়।

মৃণা আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই বলে, “মুরাদ ভাইয়ের রাগ এখনো কমলো না। আগের মতোই। হঠাৎ কি নিয়ে রেগে যায় আল্লাহ জানে। দুই ভাইবোনের রাগ একইরকম।” ভেবে আবারও মন খারাপ হয় মৃণার। সে আবারও বলে, “স্বাভাবিক তার কাছে মহুয়ার মতো সুন্দর ও সাহসী বোন আছে একারণে আমার মতো মেয়ে ভাইয়া বলে সম্বোধন করলেও তার রাগ উঠে। আমার নিজের ভাইদেরও ইগোতে লাগে তাহলে মুরাদ ভাইয়া তো পর। আমি হয়তো কারো সাথে যুক্ত হওয়ার যোগ্যই না।” তারপর আবার গালে হাত রেখ নিজেই চিন্তা করে, “আচ্ছা মুরাদ ভাইয়া তো বলে গেল না তাকে ভাইয়া না ডাকলে কি ডাকব?”

চলবে…