মেঘের খামে…
পর্ব ৫৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
একটু আগে জমজমে পরিবেশটাও এখন নীরব হয়ে গেছে। সবাই সোফায় বসা। একটু আগে তারা এসেছে পুলিশ স্টেশন থেকে। এদিকে মৃণা মহুয়াকে ধরে কাঁদছে। তার কান্না শান্তির৷ মুরাদ তার মা’কে কল দিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা বলেছিল। কিন্তু মৃণা কিছুতেই যাবে না। ওদিনের কথা মনে পড়তেই তার বুক ভয়ে কেঁপে উঠে। হাত পা কাঁপতে শুরু করে রীতিমতো।
মোহ দাঁড়িয়ে ছিলো পিছনেই। সে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র আজ হুট করেই তার সামনে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। যদি বাহুতে না লেগে ছুরিটা অন্য কোথাও লাগতো তাহলে! যদি তার গম্ভীর কিছু হয়ে যেত? ভাবতেই সমুদ্রের উপর রাগ উঠে মোহের। সাথে কান্নাও পায়। তার কারণে এত বড় আঘাত পেল সে। তিন সেলাই দিতে হয়েছে। ক্ষত গভীর ছিলো। তার কত ব্যাথা লেগেছে তা চিন্তা করেই নিশ্বাস আটকে গেল মোহের।
মহুয়া প্রথমে মৃণাকে সান্ত্বনা দিলেও পরবর্তীতে সে ক্ষেপে যায়, “ভাই তুই কাঁদতে কাঁদতে গঙ্গা যমুনা বানায়া দিচ্ছিস। ওই পোলার হাতে যে আমি ছ’রি ঢুকায় দিলাম তাও বেচারা এত কান্দে নাই। তুই এমন কানতাসোস। আমার কপালে এমন ছিচকাঁদুনি ভাবি জুটবো কল্পনাও করিনি আমি।”
এই কথায় মৃণা তার দিকে তাকাল মুখ তুলে। ঠোঁট উলটে আরও বেশি কাঁদতে শুরু করল।
মহুয়া সাথে সাথে তাকে ধরে মাথায় হাত বুলাতে থাকে, “সরি আম্মা, কাঁদা বন্ধ কর প্লিজ। তুই খুশি না?”
“অনেক।” কান্নার মাঝখানেই বলে মৃণা।
“তাহলে কাঁদছিস কেন?”
“খুশিতে।”
“হায় খোদা! খুশিতে মানুষ এমন মরার কান্না কাঁদে?”
মুরাদ মনে করায়, “তুই-ই অভিশাপ দিয়েছিলি।”
এ বাক্য শুনে মহুয়া তাকায় তার দিকে। হঠাৎ তার মনে পরে সে অভিশাপের কথা। সে তো একগাল হেসে উল্টো উওর দেয়, “তাহলে তো সে অভিশাপের আমার আরও উপহার পাওনা আছে।”
এই কথা শুনেই মুরাদ মুখ ফিরিয়ে তাকায় শায়ানের দিকে, “থ্যাঙ্কিউ। তুমি তখন এসে হেল্প করলে এজন্য।”
“অফকোর্স ভাইয়া। আংকেল বাবাকে কল দিয়েছিলাম। বাবা ব্যস্ত ছিলো বলে আমাকে জানাল। আমার তো আসতেই হতো।”
সে হেসে তাকায় মহুয়ার দিকে। আবার জাহানের দিকে। তাকে এখানে দেখেই মেজাজ বিগড়ে যায় শায়ানের।
মুরাদ তাকে বলে, “আগামীকাল আমার বিয়ে। তুমি আসলে খুশি হবো।”
“অবশ্যই ভাইয়া। অবশ্যই আসবো। তাহলে আজকের মতো আসি?” সে উঠে দাঁড়ায়। তাকায় জাহানের দিকে, “তুই যাবি না? চল একসাথেই যাই।”
মহুয়া ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বাহ সাপ নেওলের মধ্যে কবে থেকে এত সুন্দর বন্ধুত্ব হলো? আর এমনিতেও আজ ওর এখানেই থাকার কথা। আগামীকাল মৃণার বিয়ে তো। মৃণার ভাই হিসেবে ও বিয়েতে অংশগ্রহণ করছে। তো সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ওর।”
শায়ান তার কথার পরিবর্তে কিছু বলতে পারলো না।
মোহ সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী রুমে যেয়ে রেস্ট করবেন?”
মুরাদ বলে, “প্রশ্ন করার কী আছে? জলদি নিয়ে যা। ভাইয়াকে উঠতে দিবি না সহজে। আর ভাইয়া প্লিজ, আপনি দুইদিন ধরে অনেক কিছু করেছেন। আপনার এখন কিছু করা মানা। রেস্ট নিবেন কেবল।”
“তোমার বিয়ের কাজ তুমিই করবে?”
“আমরাও তো আছি ভাইয়া। ভুলে গেলেন? আমরা আরো কনেপক্ষ। আমাদের বোনের বিয়েতে কোনো কমতি রাখবো না।” জাহানের কথা শুনে মুরাদকে খুশিই দেখা গেল। সে মহুয়ার দিকে তাকাল। তারপর ফোন বের করে মেসেজ দিলো একটা।
শব্দ পেয়ে মহুয়া মোবাইল দেখে। মুরাদের মেসেজ। তার সামনে বসে থেকে তাই ভাই মেসেজ দিচ্ছে কোন দুঃখে? সে মেসেজ খুলে দেখে, লেখা,
“তুই উপহার চেয়েছিলি না? যাহ, তোর পছন্দ মেনে নিলাম। ছেলেটা ভালো। এই দুইদিন ধরে ওকেই অবসার্ভ করে আসছি৷ বেশ দায়িত্ববান। আজ মামুন চাচাকে যখন বললাম তাকে আমি চাকরি দিব এত বড় উপকারের জন্য। তখন শুনি জাহান আগেই এই কাজ করে ফেলেছে। মনেরও ভালো তাহলে। ছেলেদের শুধু ভালোবাসা থাকলেই হয় না, দায়িত্ববান ও মনের দিক থেকে ভালো হতে হয়। মনের দিক থেকে ভালো না হলে ভবিষ্যতের ন্যায় অন্যায় করার সময় ভাববে না। এই ছেলে তোর যোগ্য। তাই তোর উপহার হিসেবে রেখে দিস।”
মেসেজ পড়ে মহুয়া কতক্ষণ মোবাইলের দিকে আবার কতক্ষণ মুরাদের দিকে তাকিয়ে থাকে ড্যাবড্যাব করে। মুহূর্ত বাদেই উঠে একদৌঁড়ে তার ভাইকে ঝাপিয়ে জড়িয়ে ধরে, “থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া। আই লাভ ইউ এত্তগুলা।”
“কী হলো হঠাৎ করে?” তার বাবা জিজ্ঞেস করে।
মুরাদ হেসে বলে, “আমাদের ভাই বোনের সিক্রেট। ভবিষ্যতে জানতে পাড়বে।”
.
.
“তুমি আমাকে বলো নি কেন জাহান তোমাদের বাসায় থাকছে?”
মহুয়া শায়ানকে এগিয়ে দিতে আসে বাহিরে। তখনই শায়ান এই প্রশ্ন করে বসে।
“কেন সব আপডেট তোমাকে দিতে হবে না’কি?”
মহুয়ার এমন কড়া উওরে শায়ান কিছুটা নরম গলায় বলে, “তা বলিনি। তুমি রাজি হয়েছিলে আমার সাথে নাটক করার জন্য। তাই না?”
“রশ্মি তো এখানে নেই। তাহলে এখন নাটক করে কী লাভ? সময় হলে আবার করবো। কিন্তু থ্যাঙ্কিউ সো মাচ আজকের সাহায্যের জন্য।”
“অফকোর্স। এটা তো আমার দায়িত্ব। তোমার কোনো ক্ষতি কীভাবে হতে দিব আমি?”
মহুয়া হাসে, “তুমি আমায় নিয়ে এত চিন্তা করতে শুরু করলে কীভাবে?”
“আমরা বন্ধু এখন তাই না? অফকোর্স আমি সবসময়ই তোমার সাহায্য করবো।”
“তাই না’কি? তাহলে আমার আরেকটা সাহায্য করবে? কেবল তুমিই করতে পারবে।”
“বলেই দেখো।”
“জাহানের বিয়ের পিছনে রাজি হবার কারণ বের করো।”
আবদারটা শুনতেই মুখে কালো ছায়া নেমে এলো শায়ানের। রাগ উঠে যায় তার। হাত মুঠোবন্দি করে নেয়। রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। কিন্তু মুখে তার অনুভূতি স্পষ্ট।
হঠাৎ জাহান সেখানে উপস্থিত হয়। সে তাকায় মহুয়ার দিকে, “ভেতরে যাও।”
“এহ আসছে আদেশ দিতে। কী এক লাড সাব!”
“মৃণা ডাকছে।”
“তাহলে যাচ্ছি।”
মহুয়া যাবার পর জাহান তাকায় শায়ানের দিকে, “ওর আশেপাশেও আসবি না খবরদার।”
শায়ান হাসে তার কথায়। তার বাইকের চাবিটা আঙুলে ঘুরিয়ে বসে তার বাইকে। হেসে বলে, “তুই তো আমাকে হুমকি দেবার পরিস্থিতিতে নেই। অনুরোধ করে দেখ, মানতেও পারি।”
জাহান দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকায়, “ওর মধ্যে আমার জীবন বাস করে। ওর কিছু হলে আমি ম’রে যাব। ডোন্ট হার্ট হার। প্লিজ।”
তার প্রথম বাক্যটায় শায়ানের নিজের বুকেও ব্যাথা হয়। সে কী নিজের জীবন থেকে বেশি মহুয়াকে ভালোবাসতে পেরেছে? না, এই দিকে অন্তত সে জাহানকে বিজয়ী হতে দিবে না। ছোট থেকে যা তার ছিলো না সব জাহান পেয়েছে। মা’য়ের ভালোবাসা, বাবার সময়, সবার কাছে গুরুত্ব, রশ্মির যত্ন, তিসানের বন্ধুত্ব সব। অন্তত মহুয়াকে তো সে করতেই পারে। ভালোবাসার দাবি সে ছাড়বে না।
তার বুকের বিষাদ সে মুখে স্পষ্ট করে না। জাহানকে শীতল গলায় প্রশ্ন করে, “এতই যেহেতু ভালোবাসা তাহলে রাজ ভাইয়ার শর্ত পূরণ করছিস না কেন? ওর থেকে দূরে থাকতে বলেছিল।”
জাহান নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। গভীর নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে৷ আজ পর্যন্ত কারো সাহস হয় নি তার জিজ্ঞাসাবাদ করার। অথচ এরা দুইজন তাকে হুমকি উপর হুমকি দিচ্ছে? একবার ক্ষমতা তার হাতে আসুক, এদের দুইজনকে শিক্ষা দিবে সে মন মর্জিতে।
সে শান্ত গলায় উওর দিলো, “মৃণার জন্য। ওকে বোন মেনেছি। ও আমাদের মতো মা হারা। আমরা তো কেবল মা হারা, ও তো পরিবার হারা। সে সম্পর্কে আমার বোন হয়।”
শায়ান তাকায় তার দিকে। তার বুকে ছেঁত করে উঠে পুরনো আঘাত তাজা হওয়ার। কিন্তু সে মুখে রাগী ভাব নিয়ে উঠে বসে।
“আমি রাজ ভাইয়াকে আপাতত কিছু জানাব না। কিন্তু আগামীকালের পর যদি ওর আশেপাশে থাকিস তাহলে কী হবে তুইও জানিস। আর রইলো আমার সাথে থাকার কথা,” শায়ান তাকায় তার দিকে, “ও যতক্ষণ আমার সাথে থাকবে ততক্ষণ সুরক্ষিত থাকবে।”
শায়ান চলে যায়। সে শায়ানের যারা দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষ কথার মানেটা কী? সে বেশি ঘাটে না বিষয়টা। শায়ানের মাথায় আজগুবি কি চলে সে বুঝে না।
সে পাশে তাকিয়ে দেখে সমুদ্রের বাইকের উপর মহুয়ার ফোন রাখা। এই মেয়ে যখন এত সহজে তার কথা মেনে চলে গিয়েছিল তখনই তার সন্দেহ হয়।
সে ফোনটা তুলে এতক্ষণের তার করা রেকর্ডিং ডিলিট করে দেয়। আর নিজে এক রেকর্ডিং করে তার ভারী ভয়েসে, “এই জানপাখি, গোয়েন্দাগিরি করা বন্ধ করে যেয়ে ঘুমাও। তোমার এতটুকু মাথায় এত চাও দেবার কিছু নেই। এসব মাথা খাটানো এক্সামের সময় কাজে লাগাও না কেন? এক্সামে তো পাও আন্ডা।”
তারপর হেসে ফোনটা আগের স্থানে রেখে চলে যায় সেখান থেকে।
.
.
মোহ সমুদ্রের সাথে রুমে এলো। সমুদ্রের ব্যাগ থেকে একটি শার্ট ও টাউজার বের করে দিয়ে বলল, “ফ্রেশ হয়ে আসুন। শার্টে র’ক্ত লেগে আছে চেঞ্জ করে নিন।”
মোহ তাকিয়ে ছিলো মেঝের দিকে৷ তার মুখ লালচে হয়ে আছে। দেখেই বুঝা যায় কান্না করে দিবে। কিন্তু বহু জোর দিয়ে আটকে রাখছে। সমুদ্র তার গালে হাত দিয়ে মুখ তুললো তার। তার চোখে ভাসা টলটলে জল দেখে বুকখানা কেঁপে উঠে।
সে প্রশ্ন করে, “তোমার কান্না আসছে কেন? সব ঠিক আছে? তুমি কোথাও ব্যাথা পেয়েছ?”
মোহ যেন একটা প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিলো। অথচ তিনটা প্রশ্ন করে ফেললে সমুদ্র।
“ফাজলামো করছেন আপনি আমার সাথে? আপনাকে কে বলেছিল আমার সামনে আসতে? যদি অন্যকোথাও লেগে যেত।” মোহ তার কাঁধে এক ঘুষি মারে। এবার কান্নাই করে দেয়।
সমুদ্র তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে, “কেন তোমার কষ্ট হচ্ছে?”
মোহ তার হাত মুচড়ায়, “হাত ছাড়ুন। আপনার জন্য আমার কেন কষ্ট হবে?”
“তাহলে কান্না করছ কেন?”
“আমার ইচ্ছা। কান্না করার আগে কী আপনার পারমিশন লাগবে?”
সমুদ্র তার হাত ছেড়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। মোহ তার কাছ থেকে সরতে নিলে সমুদ্র আরও শক্ত করে ধরে নেয়।
“ছাড়ুন বলছি। আপনার এক আঘাত নেওয়াতে আমি আপনাকে ক্ষমা করে দেই নি।”
“তোমার ক্ষমার জন্য আমি আঘাত নেই-ও নি। তোমার কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যেতাম। যা করেছি নিজের জন্য করেছি।” কথাটা বলে সমুদ্র কিছুক্ষণ চুপ থাকে। আবার বলে, “সরি মধু। আমি তোমাকে রক্ষা করার ওয়াদা করেছিলাম। অথচ দুইবার তোমার সাথে এমন ঘটনা ঘটলো অথচ আমি উপস্থিত ছিলাম না। এরপর থেকে তোমার সাথে এমন কিছু আমি হতে দিব না।”
“সমুদ্র…” মোহ মৃদুস্বরে ডাকে তাকে। তার এমন ডাকে সমুদ্রের বক্ষপিঞ্জর কেঁপে উঠে হঠাৎ।
মোহ আবার বলে, “আগামীকালই আমাদের শেষ দেখা।”
সমুদ্র চোখ বন্ধ করে নেয় কথাটি শুনে। সে মোহকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। যেন এক মুহূর্তের জন্য ছাড় দিতে চায় না। যদি ছেড়ে দিলে দূরে চলে যায়?
.
.
জুম্মার নামাজের পরই সব পুরুষরা আসে সেন্টারে। বিয়ের অনুষ্ঠান হবে সেন্টারেই। জাহান সবার আগে এসেই সবকিছু সামলাচ্ছে। তার বন্ধুদের সব কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে। মহুয়ার বাবাও আছে তার সাথে৷ সে আত্নীয়দের দেখছে আর জাহানকে সাহায্য করছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মুরাদের সাথে সাহিদ ও রিয়াদ এসেও তাদের সাহায্যে জুটে যায়।
সমুদ্রকে মানা করা সত্ত্বেও সকাল থেকে ছিলো সেন্টারে। খাবার ও ডেকোরেশনের সবকিছু দেখার পর জাহান আসলে সে তৈরি হতে আসে মহুয়ার বাড়িতে। সাদা একটা শেরোয়ানি পরছিল সে। মুরাদ নিজে এনে দিয়েছে এটা। তার সাথে জাহান ও নিজের বন্ধুদেরও একইরকম শেরোয়ানি উপহার দিয়েছে।
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে সে তাকায় মোহের দিকে। সাদা জামদানীতে সোনালী কাজের শাড়ি পরেছে সে৷ তাকে দেখে কিছু মুহূর্তের জন্য তার বেহায়া চোখজোড়া অন্যদিকে তাকাতেও ভুলে যায়। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে যায়। অথচ মোহ তার চোখ নামিয়ে নেয় তাকে দেখার সাথে সাথে।
মোহ তাকে এড়িয়ে যায় আলমিরার কাছে।
“তুমি এখানে?” সমুদ্রের প্রশ্ন শুনে মোহ মৃদুস্বরে বলে, “মৃণা মাথার ওড়না আমার কাছে রেখেছিল। নিতে ভুলে গেছি।”
সে ওড়না বের করে পিছনে ফিরতেই দেখতে পায় সমুদ্রকে। তার একদম কাছে। হঠাৎ তাকে এত কাছে দেখে ভয় পেয়ে পিছনে সরতে নিলে সমুদ্র তার মাথার পিছনে হাত রাখে৷ একটু জন্য মাথায় বারি খাওয়া থেকে বেঁচে যায় সে।
“আপ…আপনি কী করছেন? দেখুন আমি আপনাকে এখনো মানছি না।” মোহ ভারী নিশ্বাস ফেলে বলে।
সমুদ্র খানিকটা হাসে। তার শেওরোয়ানিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “পরতে পাড়ছি না। একটু সাহায্য করবে প্লিজ।”
মোহ এদিক-ওদিক তাকায়। তবুও সরাসরি তাকায় না তার দিকে, “না।” বলে তার পাশ কাটিয়ে যেতে নেয়।
সমুদ্র আফসোসের সুরে বলে, “থাক কী করার? সেলাইয়ে টান লেগে ব্যাথা লাগবে একটু। সেলাইটাও খুলে যেতে পারে। কিন্তু কারো মনে তো আমার জন্য একবিন্দু সহানুভূতিও নেই।”
মোহ থেমে যায়। চোখ বন্ধ করে বুঝ দেয়, তার চলে যাওয়া উচিত। যা ইচ্ছা সমুদ্র তা করুক। কিন্তু সে পারে না। অবশেষে বড় এক নিশ্বাস ফেলে। তার মনের কাছে মস্তিষ্ক হেরে গেছে। সে ফিরে তাকায় সমুদ্রের দিকে। তার দিকে এগিয়ে গম্ভীরমুখে তার শেরোয়ানিটা হাতে নেয়। পিছনে থেকে তাকে পরিয়ে সামনে এসে শেরোয়ানির বোতাম লাগাতে শুরু করে। তার নিশ্বাস আটকে আসছে। মন ভারী হয়ে আসছে। সে অনুভব করতে পাড়ছে সমুদ্রের গভীর দৃষ্টি তার সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে দিচ্ছে। কিন্তু সে উপরে তাকানোর সাহস করছে না। সে জানে, সে চোখে তাকালে সে মোহের সমুদ্রে ডুব দিবে আবারও। যা তার সম্মানে আটকায়। সে নিজের পিঠে অনুভব করে সমুদ্রের হাত। সাথে সাথে কেঁপে উঠে। কিন্তু তারপরও তাকায় না তার দিকে।
অনুভব করতে পারে সমুদ্র তার চুল নিয়ে খেলছে। তার আরও কাছে আসছে। যত কাছে আসছে সে ততই পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার দিকে তাকাচ্ছে না। হঠাৎ সমুদ্র শক্ত করে তার পিছনে হাত দিয়ে থামিয়ে নেয় তাকে। এক টানে তাকে কাছে টেনে নেয়। মুখ ঝুঁকিয়ে তার কাঁধে নাক ঘষে। সাথে সাথে মোহ তার শাড়ির আঁচল মুঠোবন্দি করে নেয়।
এই মানুষটার ছোঁয়া আজও তাকে কাঁপিয়ে তুলে। সে নিজেই নিজের মাঝে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
তার মৃদু কন্ঠ আসে তার কানের কাছে, “মধু তোমায় সাদা রঙে দেখে আমি এই রঙের প্রেমে পড়ে গেছি আজ।”
আর ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় তার কানের লতিতে। আবারও বলে, “তুমি কখনো আমার ছোঁয়াকে উপেক্ষা করতে পারো নি মধু, কখনো পারবেও না। এই পৃথিবীতে কেবল আমার ছোঁয়াই তোমাকে স্বস্তি দেয়। অন্যকোনো পুরুষের ছোঁয়া তোমার সহ্য হবে না।”
মোহ তাকায় তার দিকে। কথাটা সত্য। শুধু পার্থক্য হলো সে অন্যকোনো পুরুষকে তাকে কখনো ছুঁতে দেয় নি। জীবনে দিবেও না। সমুদ্র তার জীবনের প্রথম পুরুষ। আর শেষও। এই সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক। এই সত্যটা অটল থাকবে।
সমুদ্র তার গালে হাত রেখে বুড়ো আঙুল বুলায়, “মধু কী করলে তুমি আমাকে ক্ষমা করবে বলো। আমি যে তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকার কথা কল্পনা করতে পারি না। একবার ক্ষমা করে দেখো। এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো হাসবেন্ড হয়ে দেখাবো। আমি আজকাল কেবল কল্পনা করি, আমাদের ভবিষ্যত। আমার আর তোমার সংসার। আমাদের সন্তান। আমাদের এক ছোট সংসার হবে। আমি আমাদের বাচ্চার সবচেয়ে ভালো বাবা আর তোমার বেস্ট হাসবেন্ড হয়ে দেখাব। একবার সুযোগ দিবে আমায়?”
মোহ তাকিয়ে ছিলো সে চোখের দিকে। এক ঢোক গিলে সে সমুদ্রের কথায়। ডুবে যেতে নেয় আবারও সে প্রেমের সমুদ্রে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কি যেন হয়! ক্ষত তাজা হয় সেদিনের। সেদিন এই চোখে দেখতে পেয়েছিল অবিশ্বাস। সাথে সাথে তার ঠোঁট দিয়ে উওর বের হয়, “না।”
আর সে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে সমুদ্রের বাহুডোর থেকে। পিছিয়ে আসে দুই’পা। বিছানা থেকে মৃণার ওড়না দিয়েই দৌড় দেয় সেখান থেকে। বেরিয়ে যায়।
.
.
সবার আগে আসে মেয়েদের মধ্যে মহুয়া তার মা সহ। সে আজ কমলা রঙের জামদানী পরেছে৷ খোলা চুল। মুখে মাখা প্রসাধনী। নীল রঙের গয়না পরা। সাথে তার চোখে গাঢ় নীল কাজল মাখা। তার ছোট চুলে সাদা রঙের বেলিফুল দেওয়া।
জাহান তার কাজেই ব্যস্ত ছিলো। ডেকোরেশন করা লোকের সাথে আলাপ করছিলো কিছু নিয়ে। তখনই তার চোখ আটকে যায় প্রবেশপথ দিয়ে আসা মহুয়ার দিকে। তাকে দেখে থমকে যায় জাহান। বাকরুদ্ধ হয়ে যায়৷ তার নিশ্বাস আটকে যায়। হৃদপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দেয় কিছু মুহূর্তের জন্য। আপনা-আপনি হা করে তাকিয়ে থাকে সে।
মহুয়া তার সামনে এসে আঙুল দিয়ে তার মুখ বন্ধ করিয়ে দেয়। তাকে দেখে ডেকোরেশনের লোক সরে গেল।
“কী বেয়াইসাহেব যেভাবে মুখ খুলে রেখেছেন, মশা মাছির দল ঢুকে যাবে।”
“এখন আমার বেয়াইন সাহেবাকে আজ দেখতে এত অসাধারণ লাগছে। কী করার? তবে লেহেঙ্গার কী হলো যে কিনেছ?”
“মোহের বাসায় গিয়েছিলাম ওর শাড়ি আনার জন্য। সেখানে আলমিরাতে শাড়িটা দেখে পছন্দ হলো, তাই এটা পড়ে নিলাম।”
“বলো দেখে মনে হলো, আজ জাহান আমাকে এই শাড়িতে দেখে হার্ট অ্যাটাক করবে। তো ওকে মা’রার প্লানটা সেরে ফেলি।”
মহুয়া ঠোঁট টিপে হাসে, “এটাই।”
জাহান এক ঢোক গিলে তাকে দেখে। এগিয়ে এসে তার হাত ধরে। আঙুলের ফাঁকে আঙুল ডুবিয়ে দেয় নিমিষে। মহুয়া সাথে সাথে তার হাত ছাড়িয়ে নেয়।
“পাগল হয়ে গেলে না’কি! এতগুলো মানুষের সামনে কীসব করছ?”
“তোমাকে আজ দেখে অন্যকিছুর হুঁশ খুঁজে পাচ্ছি না।”
“পাগল একটা। দেখি সরো।”
মহুয়া যেতে নিলে জাহান তার হাত ধরে নেয়, “শুনো।”
“কী?” মহুয়া পিছনে ফিরে তাকায়।
“তোমাকে সূর্যোস্ত থেকেও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।”
“তাই না’কি? তো জনাব প্রশংসা ছাড়া আজ কিছু বলার আছে। আমার কাজ পরে আছে এখনো।”
“ওহ হ্যাঁ।” জাহান তার পকেট থেকে একটি লাল রঙের বক্স বের করল। তা দিলো মহুয়ার হাতে, “এটা কী?”
মহুয়া খুলে দেখলো স্বর্ণের চুড়ি। তা দেখে সাথে সাথে বক্সটা ফেরত দিলো জাহান, “এটা আমাকে দিচ্ছো কেন?”
“এটা মৃণার জন্য। আমার মা, নানী জিনি আর আমার বৌ এর জন্য কতগুলো স্বর্ণের সেট রেখে গিয়েছিল। এর মধ্যে থেকে একটি। মৃণার জন্য এনেছি। এখন বোন বলেছি, বিশেষ কিছু উপহার তো আনতেই হতো। এটা তোমার ও আমার পক্ষ থেকে।”
“তোমার পক্ষ থেকে বুঝলাম। আমার পক্ষ থেকে কীভাবে?”
জাহান মনে মনে বলে, “তুমি আর আমি কী আলাদা না-কি? কাপলরা তো একসাথেই উপহার দেয় তাই না? যা আমার সব তো তোমারই। উলটো এই গয়নাতে আমার চেয়ে তোমার অধিকার বেশি। আমার ভবিষ্যতের ঝগড়াটু বউ তুমি।
“কিছু বলছো না কেন?”
“কিছু না তুমি দেও।”
“আমি দিলে জিন্দিগিতেও নিবে না। তুমি দেও। উল্টো খুশি হবে। মৃণা এসে পরবে পনেরো মিনিটেই। মা ওকে গয়না পরাবে তখন তুমিও দিও।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই পার্লার থেকে মোহ মৃণাকে নিয়ে আসে সেন্টারে। সকলে এসে পরেছে। সে এসেছে জেনে মুরাদ তাৎক্ষণিক তাকে দেখতে চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, মহুয়া কিছুতেই বিয়ে পড়ানোর আগ পর্যন্ত তাকে দেখতেই দিবে না।
মুরাদের মা মৃণাকে গয়না পরাচ্ছিলেন। তার পরপরই তার সামনে এসে বসে জাহান।
তার পকেট থেকে চুড়ি বের করে হাত পেতে মৃণার হাত চাইল। মৃণা পরিষ্কার মানা করে দিলো, “না ভাইয়া, আমি এগুলো নিতে পাড়বো না।”
“কেন?”
“এত দামী জিনিস আমি নিতে পারবো না।”
“দেখো মৃণা, তোমাকে আমি সেদিন বোন মেনেছিলাম মনে আছে? আমি মুখে কিছু বলি না। যা মিন করি তাই বলি।”
জিনিও পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো মহুয়ার। তার হাত ধরে। তখন সে-ও বলে উঠে, “হ্যাঁ হ্যাঁ আমিও পারমিশন দিয়ে দিয়েছি।”
জাহান তার দিকে তাকায় কপাল কুঁচকে, “আর তোর থেকে পারমিশন চেয়েছে কে? জিনি মিনির বাচ্চা।”
জিনি তখনই বিচার দেয় মহুয়াকে, “দেখো ভা…আপু, আমার সাথে কেমন করে। বিচার করো।”
সে আদুরে ভঙ্গিতে ঢলে পড়ে যেন মহুয়ার উপর। মহুয়াও তার ঢঙে সাঁয় দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ রাঙায় জাহানকে, “এই চেঁকামেঁকা আমার জিনুকে বিরক্ত করবা না।”
জাহান জানে এখানে ঝগড়া করতে গেলে তার লস তাই সে ফেরত তাকায় মৃণার দিকে। তার চোখে পানি দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। অস্থির ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, “কাঁদছো কেন তুমি?”
“আমি ভেবেছিলাম মহুয়া আপনাকে বিয়েতে আমার পক্ষ হতে আসতে বলেছে। আপনি ইচ্ছা করে আসেন নি।”
“তোমাদের বাসার বিয়েতে তো আর দাওয়াত ছাড়া আসতে পারি না। ও বললেও আমি আমার মন থেকে এসেছি। এবার হাসো।”
মৃণা উলটো আরও কেঁদে উঠে, “এখন কাঁদছো কেন?”
“সারাজীবন সম্পর্কের জন্য প্রার্থনা কতেছি। আজ এতগুলো সম্পর্ক একসাথে পাচ্ছি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।”
জাহান হাসে। মৃণার হাতটা ধরে যত্নে তাকে চুড়ি পরিয়ে বলে, “একটুখানি পর জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পর্ক পাবে তুমি। যে সম্পর্ক তোমার সারাজীবন থাকবে। তোমার এই সম্পর্কটা ভালোবাসায় ভরে উঠুক। মুরাদ ভাই আসছে। তোমাকে নিজের করতে। তৈরি তো?”
মৃণার বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো। অস্থিরতা বাড়লো। সে কী পারবে এই সম্পর্কে ভালোবাসা ভরে দিতে। একপক্ষিক ভালোবাসায় কী সারাজীবন কাটানো যায়? মুরাদ ভাই কী সারাজীবন কাটাবে তার সাথে? না, সমাজ যখন হাসবে তাদের জুটি দেখে তখন বাস্তব উপলব্ধি করে ছেড়ে দিবে তার সাথে পথচলা?
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ে সম্পন্ন হলো। চারদিকে খুশির আমেজ। সবাই খুশিতে আত্নহারা। মহুয়া ও মোহ তাদের দুইজনের মাঝে ধরেছিলো এক লাল ওড়না। তা সরিয়ে এক ফুল দিয়ে সাজানো আয়না রাখল মোহ। দুইজনে আয়নাতে তাকালে মোহ প্রথমে মৃণাকে জিজ্ঞেস করে, “কী দেখতে পারছিস আয়নাতে?”
“মুরাদ ভাইকে।”
ভাই শব্দ শুনে সবাই তার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে মানুষ না, এলিয়েন। মোহ তার মাথায় চাটি মেরে বলল, “জামাইকে ভাই বলতে লজ্জা করে না?”
মুরাদ বলে, “আমার পক্ষ থেকেও দুইটা দিয়ে দে।”
মহুয়া আফসোসের সুরে বলে, “তোদের বাচ্চারা যদি বাপকে মামা ডাকে তাহলে আমার ভাই সমাজে কেমনে মুখ দেখাবে?”
তার এমন কথা শুনে এবার সবাই আজব দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
মোহের তো তার দুই বান্ধবীর এমন আজব কথা শুনে মাথায় হাত। সে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “ভাই তোরা বাদ দে। তোরা মুখই খুলিস না। মুরাদ ভাই, আপনি বলেন। আপনি কী দেখতে পাড়ছেন?”
“আমার ময়নাপাখি। আমার কৃষ্ণকলি। আমার চাঁদ। যে আমার জীবনের আঁধারে ভরা আকাশের মেঘ সরিয়ে চন্দ্র হয়ে আমার জীবন উজ্জ্বল করেছে।”
মৃণা আয়না থেকে মুখ তুলে তাকায় সরাসরি মুরাদের দিকে। মুরাদও তাকায় তার দিকে। দৃষ্টিমিলন হয়। মৃণার আত্না কেঁপে উঠে। তার হৃদস্পন্দন আচমকা বেড়ে যায়।
হঠাৎ এমন অনুভূতি কেন হচ্ছে তার সাথে?
জাহান মহুয়ার পাশে এসে বাহু দিয়েই ধাক্কা দেয়। মহুয়া তাকায় তার দিকে। ভ্রুঁ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী?”
“আমি আয়নায় তোমাকে দেখলে কী বলতাম জানো? আমি আমার জানকে দেখতে পাড়ছি।”
মহুয়া মুখ বানিয়ে তাকায় তার দিকে, “এটাই তো বলতে পারবে। আমার ভাইকে দেখছো কত কাব্যিক ভাষায় উওর দিয়েছে৷ শিখো কিছু।”
“এহ এক্সামে দুইটা আন্ডা পেয়ে এই কথা তোমার মুখে মানায়? কাব্যিক মানে কি তা জানো?”
মহুয়া তার মান সম্মানের এমন বারোটা বাজতে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে তাকায় তার দিকে, “আর আমি আয়নাতে দেখলে বলবো আমি হনুমান দেখছি। আস্তো এক ছ’ফুটের হনুমান।”
মুরাদের পিছনে দাঁড়িয়েই তারা দুইজন মন মতো গল্পগুজব করছিল। সে তো সবটাই শুনলো। তার হাসি আসছিলো ভীষণ। সে পিছনে তাকাল। দুইজন তাকে দেখে সোজা সামনে তাকাল। যেন কিছুই বলে নি।
মুরাদ হেসে দেয় তাদের দেখে।
জাহান অবাক হয়ে। পাশে ঝুঁকে মহিয়াকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার ভাই আমার দিকে তাকিয়ে এত সুন্দর হাসছে কেন? কাহিনী কী?”
“আছে এক কাহিনী। বলা যাবে না।”
এমন সময় শায়ান আসে সেখানে। এসেই দেখে সবাই একজোট হয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করে,
“বিয়ে পড়ানো শেষ না’কি? আসতে দেরি করে ফেললাম।”
মুরাদ উঠে দাঁড়ায়। শায়ানের সাথে রাদিনও এসেছে। তাদের সাথে হাত মেলায়। শায়ান বলে, “অভিনন্দন ভাইয়া। নতুন জীবনের শুভকামনা।”
“থ্যাঙ্কিউ।”
তারপর সে তাকায় জাহানের দিকে, “কেমন আছিস? জিনিকেও দেখি আনলি, রশ্মিকেও নিয়ে আসতে পারতি।”
হঠাৎ রশ্মির কথা উঠায় অপ্রস্তুত হয়ে যায় মহুয়া ও জাহান দুইজনই।
মুরাদ জিজ্ঞেস করে, “রশ্মি ওর আরেক বোন?”
মহুয়া তখনই থামাতে চায় শায়ানকে।
কিন্তু সে কিছু বলার আগেই শায়ান বলে উঠে, “বোন হতে যাবে কেন? ওর ফিয়োন্সে হয়। বাগদত্তা।”
এই কথা শুনে মুরাদের সাথে মহুয়ার পরিবারও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে জাহানের দিকে।
মুরাদ তো সরাসরি তাকায় জাহানের দিকে। তার মুখে লেখা স্পষ্ট রাগ, চোখে ক্ষোভ, সে দাঁতে দাঁত চেপে শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “এটা কী সত্যি?”
জাহান কোনো উওর দেয় না। চোখ নামিয়ে নেয়। তার মুঠোবন্দি করে নেয়। এই মুহূর্তে তার শায়ানের উপর ভীষণ রাগ উঠছে। রাগে কাঁপছে সে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।
মুরাদ জাহানের থেকে উত্তর না পেয়ে মহুয়ার দিকে তাকায়, “তুই কী এসব জানতি?”
মহুয়া উওর দেয় না। সে সরাসরি তাকায় শায়ানের দিকে, “একটু আমার সাথে আসো।” তার চোখে ক্ষুব্ধ ভাব। সে রাগে হনহনিয়ে সেখান থেকে নিচে নেমে এক কোণে যায়। শায়ানও যায় তার পিছনে। কিছুক্ষণ আগের আমেজে ভরা সভাটা থমথমে হয়ে যায় মুহূর্তে।
মহুয়া রাগে ক্ষোভে যেয়ে দাঁড়ায় সেন্টারের একপাশে। এইপাশটা আপাতত নীরব। শায়ান তার সামনে এসে দাঁড়ালে সে চোখ গরম করে প্রশ্ন করে তাকে, “কী ছিলো এটা?”
শায়ান হাসে। তার নাকে আলতো করে টোকা দেয় আঙুল দিয়ে, “বাবাহ এত রাগ! রাগে তোমার বোচা নাকটা লাল হয়ে গেছে৷ তবে সুন্দর লাগছে। আজ নীল কাজল দিয়েছ? তোমার চোখে নীল কাজল কত সুন্দর লাগে তুমি জানো?”
শায়ান কথা বলতে বলতে তার হাত ধরে নেয়। যা মহুয়া এক ঝটকায় সরায়, “তোমার কী মাথা নষ্ট হয়ে গেছে?”
“মাথা নষ্ট হবে কেন? সবাই আমার চোখের নীল মণির প্রশংসা করে সবসময়। কিন্তু আমার এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর কী লাগে জানো? তোমার বাদামী বর্ণের চোখজোড়ায় নীল কাজল মাখা।”
“তুমি কী এখনো নাটকের ক্যারেক্টরে ঢুকে আছো না’কি? তোমার কী মনে হয় আমি বুঝি না তোমার এসব নাটকের প্রস্তাব দেওয়ার কারণ। কারণ তুমি আমার আশেপাশে থেকে জাহানকে নজরদারির উপর রাখতে চাইছো। কিন্তু তোমার কী আমাকে এতই বোকা মনে হয়? যে আমি এমনিতেই রাজি হয়ে যাব? আমি তোমার সাথে থাকতে চেয়েছি যেন তোমার থেকে সত্যিটা বের করতে পারি। জাহান এসব কোনো এক কারণে করছে ওটা আমি জানি। আর এর পিছনে যে তুমিও আছো এটাও বুঝতে পেরেছি। তুমি এত নিচে নামবে কখনো আমি ভাবতেও পারি নি। কেবল রশ্মির খুশির জন্য তুমি তিনটে ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিতে চাইছো? তুমিও তো ওকে ভালোবাসো। নিজের ভালোবাসা দিয়ে ওর মন থেকে জাহানের দুঃখ মুছে দিতে পাড়তে। কিন্তু তুমি কী করলে? নিজের ভালোবাসার সাথে, আমাদের ভালোবাসারও বিসর্জন দিলে।”
শায়ান নীলাভ নয়নে তাকায় মহুয়ার নীল কাজলা চোখে,
“আমি রশ্মিকে না, তোমাকে ভালোবাসি মহুয়া।”
চলবে….
মেঘের খামে…
পর্ব ৫৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
শায়ান নীলাভ নয়নে তাকায় মহুয়ার নীল কাজলা চোখে,
“আমি রশ্মিকে না, তোমাকে ভালোবাসি মহুয়া।”
মহুয়া ভাবল, সে কথাটা ঠিক মতো শুনে নি। তার কান বাজছে বোধহয়।
“কী? কী বললে তুমি? পাগল হয়ে গেছো না নতুন নাটক শুরু করেছ?”
“রিয়াদ ভাইয়ার হলুদের পরদিন যখন তুমি বৃষ্টিতে ভিজে তোমার ক্রিমপাফকে খাবার দিতে এসেছিলে সেদিন তোমার হাসি দেখে আমার ঠোঁটের কোণে হাসি একে পরেছিল। এর আগে বৃষ্টি আমার অসহ্য লাগতো। সেদিনের পর থেকে বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয় হয়ে গেছে। তখনও আমার অনুভূতিগুলো বুঝতে পারি নি। কিন্তু ধীরে ধীরে মনে হয়েছে তুমি আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।”
মহুয়া তাচ্ছিল্য হাসে। বুকের উপর হাত ভাঁজ করে বলে, “ক’দিন আগে তুমি রশ্মিকে ভালোবাসতে। ক’দিনে রশ্মি থেকে আমাকে ভালোবেসে ফেললে? কী অদ্ভুত তোমার মন!”
“রশ্মি এখনো আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ও প্রথম কেউ যে আমার কাছে এসে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল। আমি ওর জন্য একাকিত্ব থেকে বেরিয়ে এসেছি। ওর কষ্ট, খারাপ লাগা আমার সহ্য হয় না৷ কিন্তু কখনো ওকে আমি অযথা কল্পনা করিনি, ওকে দেখে আনমনে হাসি নি, ওর জন্য মনে ডঙ্কা বাজে নি কখনো, ওকে আমার পেতে হবে এই চিন্তা কখনো করিনি। ওর প্রতি আমার দায় আছে কিন্তু ওকে পাওয়ার দাবি কখনো করিনি৷ তোমাকে পাওয়ার করেছি৷ তোমাকে আমার চাই মহুয়া৷ তোমার জন্য আমি বিগত সব খারাপ কাজ ছেড়ে দিয়েছি। তোমার যোগ্য হওয়ার জন্য কাজে যোগ দিয়েছি।” সে আবারও মহুয়ার হাত ধরে শক্ত করে, “বিলিভ মি মহুয়া, তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসবো। তোমার খুশির জন্য যা করা লাগে সব করবো।”
মহুয়া তার হাত সরিয়ে নেয়। শায়ানের দিক থেকে তার চোখ সরে নি। কিন্তু তার চোখে এখন ক্ষুব্ধতা নেই, আছে বিরক্ত।
সে বলে, “জানো তোমার সমস্যা কী? তুমি আমাকে বা রশ্মিকে কাওকে চাও না। তুমি কেবল জাহানকে হারাতে চাও। ওর প্রতি তোমার হিংসা এত গভীর হয়ে গিয়েছে যে সবার জীবন নষ্ট করার আগেও ভাবছো না। কাওকে কষ্ট দেওয়ার আগেও চিন্তা করছো না। কিন্তু আমি বলে দেই, আমি জাহানকে ভালোবাসি আর ওকে নিজের করেই ছাড়বো।”
মহুয়া সেখান থেকে চলে যেতে নিলে শায়ান বলে, “দেখা যাবে।”
মহুয়া পিছনে ফিরে তাকায় না। তবে শায়ান নিজে তার সামনে এসে দাঁড়ায়, “তুমি জাহানকে ভালবাসো, জাহানও তোমাকে ভালোবাসে। তবে ভালোবাসলেই কী ভালোবাসা পাওয়া যায়?”
“মহুয়া কখনো পরাজিত হয় না। না জীবনে আর না ভালোবাসায়।”
শায়ান বাঁকা হাসে, “দেখো, কি করতে পারো। কারণ আমিও পিছাবো না। তুমিই বলেছিলে ভালোবাসলে চেষ্টা না করে পিছিয়ে যাওয়া বোকামি। আমার কাছে তো এখনো পাঁচ বছর আছে রাইট? তোমার কাছে এক সাপ্তাহ আছে। তোমাকে একটা মজার কথা বলি? যা জাহানও এখনো জানে না।”
মহুয়া জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
শায়ান খানিকটা ঝুঁকে আসে। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “আগামী শুক্রবার ওদের এনগেজমেন্ট না, কাবিন।”
মহুয়া তাকায় তার দিকে। চরম অবিশ্বাস তার দৃষ্টিতে। তার নিশ্বাস আটকে আসে মুহূর্তের জন্য। তার এতবছরের শক্ত হৃদয়টাও কেঁপে উঠে।
শায়ান আরও বলে, “এরপর তুমি কোনোমতে জাহানের সাথে দেখা করতে পারবে না। মৃণার বিয়ে পর্যন্তই ওর এখানে থাকার কথা ছিলো। আমি আংকেলকে কথাটা জানাতে বাধ্য হয়েছি। এই একসাপ্তাহ ওকে খোঁজার চিন্তাও করো না। পাবে না।”
মহুয়া তাকায় স্টেজের দিকে। সে সত্যিই জাহানকে দেখতে পারে না।
“সরি মহুয়া, তোমার একটু কষ্ট হবে কিন্তু একবার কাবিনটা সেরে যাক তারপর আমি সব ঠিক করে দিবো। সময়ের সাথে সাথে তোমরা একে অপরকে ভুলে যাবে। তারপর পাঁচ বছরে আমি নিজেকে তোমার ভাইয়ের কাছে যোগ্য প্রমাণ করে তোমাকে নিয়ে যাব।”
মহুয়া চোখের সাদা অংশও লালবর্ণ হয়ে গেছে রাগে। তার ঠোঁটও কাঁপছে রাগে। সে দাঁতে দাঁত পিষলো, “আর তোমার মনে হয় তোমার এমন নিচু কাজ করার পর আমি তোমার সাথে বিয়ে করবো? না’কি আমাকে জাহানের মতো ব্লাকমেইল করার ইচ্ছা আছে? শায়ান শিকদার, তুমি আমাকে পাঁচবছর পর কেন, সারাজীবনেও পাবে না। তুমি মোটেও পাল্টাও নি। আগের মতোই আছো। কেবল আগে বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করতে এখন ভালো সাজার নাটক করছো। তোমার মতো মানুষদের আমি চরম রকমের ঘৃণা করি।”
মহুয়া তার দিকে তাকায় ঘৃণার দৃষ্টিতে। ফিরে চলে আসে সেখান থেকে। আর ফিরেও তাকায় না।
সত্যিই জাহানকে আর খুঁজে পায় না মহুয়া। সারা সেন্টারে, সেন্টারের বাহিরেও খুঁজে তাকে অথচ তার কোনো অনুসন্ধান পায় না। তাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না।
.
.
তিসান সকলের সামনেই বেহায়ার মতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো মোহের দিকে। তার সাথে কথা বলতেও গিয়েছিল দুইবার। সুযোগ পায় নি। তবে তার এই দৃষ্টি কম বেশি চোখে পড়েছে তার আশেপাশে মানুষদের। জয় তো তাকে ডাকও দেয়। তবে তিসান বিশেষ পাত্তা দেয় না।
হঠাৎ জিনি এসে তাকে ডাকে। সে প্রথমে বিরক্ত হয় তার উপর। মোহকে দেখে মন ভরছিল, এমন সময় তাকে বিরক্ত করার কী বিশেষ দরকার ছিলো? তবুও উঠে যায় সে জিনির সাথে।
জিনি বুকের উপর হাত ভাঁজ করে। বড়দের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে, “এসব কী হচ্ছে ভাইয়া?”
তার এমন ভঙ্গিমা দেখে হেসে দেয় তিসান, “কী হবে?”
“মোহ আপু বিবাহিত আপনি জানেন না?”
“জানি তো?”
জিনি হতভম্ব হয়ে যায় নিমিষেই এমন স্বীকৃতি শুনে।
“তো আপনি এক বিবাহিত মেয়ের দিকে নিলজ্জের মতো তাকিয়ে আছেন। বিষয়টা কতটা কটু দেখায় আপনি জানেন?”
“মোহের বিয়েটা সাধারণ ছিলো না। ওর বোন পালিয়ে গিয়েছিল দেখে বিয়ে করতে হয়েছে ওর বাধ্য হয়ে। ওর হাসবেন্ড অন্যকাওকে ভালোবাসতো। ওদের ডিভোর্স হয়ে যাবে জলদি।”
জিনি আশ্চর্য হয়ে যায় এই কথা শুনে। এই দুইদিন তো মোহ আর সমুদ্রকে স্বাভাবিকই দেখলো সে।
“আমি এতকিছু জানতাম না। তবুও আপনার এভাবে তাকিয়ে থাকা বা তার পিছু নেওয়াটা ভালো দখায় না। সে বিবাহিত। মানুষ কী ভাববে আপনাকে নিয়ে?”
তিসান কপাল কুঁচকায়, “তোকে কে বলেছে আমাকে নিয়ে ভাবতে?”
“এভাবে বলছো কেন ভাইয়া? আমি তোমার ভালোর জন্য বলছি।”
“ভালোর জন্য না। তুই নিজের জন্য বলছিস? আমি কিছু বুঝি না? সে ছোট থেকে আমার পিছনে পড়ে আছিস। সে কবে থেকে বিরক্ত করিস। এসব ন্যাকামি আর ভালো লাগে না। কোনো মেয়ের সাথে দেখে একশোটা প্রশ্ন করতে হবে তোর। তার সাথে হিংসা করতে হবে। ভেবেছিলাম বড় হলে বুদ্ধি এসে পরবে। উল্টো অবনতি হচ্ছে৷ দেখ জিনি তোর উপর আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই, না কখনো হবে৷ তাই ভুলেও আমার আর মোহের মাঝে আসবি না। অনেক আশা হারানোর পর ওকে ফিরে পাচ্ছি। জাহানের জন্য তোকে সহ্য করেছি, নাহলে… ”
“হয়েছে ভাইয়া। অনেক বলেছেন।” জিনি তার দিকে তাকায় ছলছলে দৃষ্টিতে, “আমি জানতাম না আপনি আমার উপর এতটা বিরক্ত, নাহলে সে কবেই আপনার সামনে আসা বন্ধ করে দিতাম। হ্যাঁ, আমি আপনার পিছনে ছোট থেকে পড়ে আছি কারণ আপনাকে ভালোবাসি৷ কিন্তু আপনি আমার উপর এতটা বিরক্ত আমি জানতাম না। জানলে হয়তো আপনাকে আর বিরক্ত করতাম না। জানেন তিসান ভাইয়া, আমার বাবা মা একে অপরের প্রথম ভালোবাসা ছিলো। একটু বড় হতেই ভাইয়াকেও প্রতিজ্ঞা নিতে দেখলাম সে জীবনে একবারই ভালোবাসবে। আমিও তখন মনে মনে শপথ নিলাম, জীবনে একজনকেই ভালোবাসবো। সে-ই ছোট থেকে আপনি আমার মনে ধরে আছেন। আমার প্রথম ভালোবাস হয়ে। তবে যদি আপনার মনে হয় এসব ন্যাকামো। তাহলে ন্যাকামোই থাক। আমার আর প্রথম ভালোবাসা পাওয়া লাগবে না। সবার প্রথম ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য যে হয় না। আমার শপথতা অপূর্ণই থাক নাহয়। আপনাকে আমি আর কখনো বিরক্ত করবো না। আজ নাহয় আমাদের শেষ কথোপকথন এতটুকুই থাক।”
“ওভার রিয়াক্ট করার এখানে কিছু নেই জিনি।”
জিনি কোনো উওর দেয় না। সেখান থেকে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।
.
.
সেন্টার থেকে বাড়িতে যেতে তাদের বিকেল হয়। সবাই হাসিখুশি থাকলেও সকলকে মজায় মাতিয়ে রাখা মহুয়া চুপচাপ বসে আছে রুমে। কল দিয়ে যাচ্ছে জাহানকে। ফোন বন্ধ। তার মাথা কাজ করছে না এই মুহূর্তে।
মোহ তার রুমে আসে। বসে তার পাশে, “কী হয়েছে তোর? ঠিক আছিস?”
“তুই একটু জাহানকে কল দিয়ে দেখবি?”
“কী হয়েছে?”
“যা বলছি তা কর।”
মোহ কল দেয় জাহানকে। ফোন বন্ধ।
মহুয়া চিন্তায় মাথা ধরে নেয়।
মোহ জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে বলবি?”
মহুয়া কিছু বলতে যাছে এর আগেই রুমে মুরাদ আসে। তাকে ভীষণ রাগে দেখাচ্ছিল।
সে কাঠকাঠ গলায় জিজ্ঞেস করে, “সবাই বাহিরে, এখানে বসে আছিস কেন তুই? বাহিরে যা। আমি কোনো গসিপিং চাই না তোর নামে। যদিও এমন এক কাজ তুই করেছিস। বিয়ে বাড়িতে তামাশা চাচ্ছি না তাই কিছু বলছি না।”
মহুয়া উঠে গেল তার কাছে, “ভাইয়া আমি তো…”
“চুপ। তোকে আমি অনেক স্বাধীনতা দিয়েছি। স্বাধীনভাবে বাঁচতে শিখিয়েছি। এর মধ্যে অন্যের বাগদত্তার সাথে প্রেম করা শেখাই নি। এর উপর তুই ওকে বাসায় নিয়ে এসেছিস, এত্তো সাহস তোর?”
“ভাইয়া তুমি ভুল বুঝছো।”
“আর কিছুই আমি বুঝতে চাই না। তোর থেকে আমি এটা মোটেও এক্সপেক্ট করিনি। আজকের পর থেকে তুই ওই ছেলের থেকে দূরে থাকবি। ক’দিন তোর বাহিরে যাওয়া বন্ধ। নাহলে…. ” বলতে গিয়ে একটু থামলো মুরাদ। চোখ ফিরিয়ে নিলো তার থেকে। অবশেষে বলেই দিলো, “নাহলে যদি আকাশে উড়ার জন্য তোর পাখনা আমি গজিয়ে উঠাতে পারি সে পাখনা আমি কাটতেও পারি।”
মহুয়ার চোখে পানি এসে পড়ে। সে গাল ফুলিয়ে ঠোঁট উল্টে তাকায় তার ভাইয়ের যাওয়ার দিকে।
তবে মুরাদ একবার ফিরেও তাকায় না পিছনে।
মহুয়া শব্দ করে কেঁদে উঠে।
মোহ তাকে এসে জড়িয়ে ধরে সাথে সাথেই। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “ভাইয়া আপাতত একটু রেগে আছে। পরে বুঝিয়ে বলিস। ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমার ভালো লাগছে না’রে। সবকিছু এমন হয়ে গেছে কেন হঠাৎ করে। আমার এত সুন্দর গুছানো জীবন কেমন ওলট-পালট হয়ে গেল দেখ।”
“সব ঠিক হয়ে যাবে দোস্ত৷ তুই কান্না করিস না প্লিজ। প্রেমে পড়াই ভুল বুঝলি? প্রেমের সাথে কান্না এক চুক্তি আছে। প্রেমে পড়লে কান্না করাটা বাধ্যতামূলক।”
মহুয়া মোহকে ছেড়ে তাকায় তার দিকে। জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে।
“মানে কী? তোর আর সমুদ্র ভাইয়ার মধ্যে সব ঠিক আছে তো?”
মোহ কথা বলে নিজেই ফেঁসে গেল। মনে মনে নিজেকে বকতে লাগলো। তারপর ভুল শুধরানোর চেষ্টায় বলল, “প্রথমদিকে তো একটু করতে হয়েছে। এখন সব ঠিক আছে।”
চিন্তায় মহুয়ার কান্নাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিশ্বাস আটকে এসেছিল। তবে মোহের কথায় সে চিন্তামুক্ত হয়। তার নিশ্বাস ফিরে। সে গভীর নিশ্বাস ফেলে মোহের কাঁধে হাত রেখে বলে, “তুই চিন্তা করিস না। একটা বাচ্চা করে নে, আমার আন্ডারে এমন ট্রেনিং দিবো যে তোর প্রতিটা কান্নার প্রতিশোধ নিবে ভাইয়া থেকে।”
মোহ তার কথায় ভ্রু নাচায়, “সে না তোর দুলুভাই? তুই যেমনে তার খেয়াল রাখিস যেন আমি তোর ছোটবেলার বান্ধবী না, সে তোর ভাই।”
“এজন্যই তো আমি ডিরেক্ট কিছু করতে পাড়ব না। তোর বাচ্চাকে শিখিয়ে দিব। আমি কী আমার দুলুভাইকে শিক্ষা দিতে পারি বল?”
“কান্না শেষ তাহলে?”
মহুয়ার হঠাৎ মনে পড়ে তার দুঃখের কথা। সে মোহের কথা শুনে কান্নাই ভুলে গিয়েছিল। মনে পড়ায় সে কান্না করতে চাইলো। কান্নামাখা মুখ বানালেই মোহ বলে, “অবশ্য আমাদের মহুয়া কান্না করার মেয়ে না’কি? সে তো কান্না করায়। তাই না?” মোহ মহুয়ার দিকে চোখ মারল।
মহুয়া ভাবল। তার মনে হলো, সে কান্না করলে তো আর সব ঠিক হয়ে যাবে না। তার কিছু একটা করতে হবে। আগের মতো ঢিলামি দিলে চলবে না। জোরেশোরে মাঠে নামতে হবে।
মোহও শান্তির নিশ্বাস ফেলে। মুরাদ যেহেতু ক’দিন মহুয়াকে বাহিরে যেতে মানা করেছে সেহেতু সে সুরক্ষিত আছে এই কয়দিন। কিন্তু জাহানের ফোন বন্ধ কেন? সে কোনো সমস্যায় পড়ে নি তো?
চিন্তায় পরে মোহ। কিন্তু এই কয়দিন সে কোনো অবহেলা করবে না। মহুয়ার সাথেই থাকবে।
সে বলে, “আচ্ছা শুন, এই সাপ্তাহ আমি এখানেই থাকি? মৃণার নতুন বিয়ে হয়েছে। এর উপর তোদের অনেক মিস করি আজকাল। তোদের সাথে আগের মতো সময় কাটানোই হয় না।”
“এটা জিজ্ঞেস করার কী আছে? তোরই বাসা। কিন্তু দুলুভাই?”
“তাকে বলে দিব। সমস্যা হবে না।”
“সমস্যা তো হবে না। কিন্তু সে তো তোমাকে মনে করে উন্মাদ হয়ে যাবে জান। যদিও ফায়েদা আমারই। গতবারের মতো এত্তো চকোলেট, চিপ্স আর আইস্ক্রিম পাব। ”
মোহের মনটা বিষাদে ভরে গেল আবারও। তবুও ঠোঁটের হাসি একটুও নড়াল না। সে বুঝতে পাড়ছে না, কি করবে? তার বুকের মাঝে চলছে এক সাগর সংশয়। এই যুদ্ধ তার মন ও মস্তিষ্কের। কিন্তু এই সংশয় দূর করতে কারো উপদেশও নিতে পারছে না সে।
“কী এমন ভাবছিস তুই?”
মোহের ধ্যান ভাঙে, “না। কিছু না।”
“চল। বাসর রাতের দরজা ধরবো।”
“তুই? তুই ঠিক আছিস তো?” আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে মোহ।
“তো ভাইয়া আমাকে এত বড় হুমকি দিয়ে গেল এখন তো ডাবল টাকা নিব। টাকা না নিয়ে আজ ছাড় নেই। মৃণাকে লাগলে নিয়ে আসবো আমার রুমে। কত্তো বড় সাহস জেরিন মহুয়াকে হুমকি দেয়। আমার ভাই তো কি হয়েছে। শিক্ষা তারও পাওয়া লাগবে।”
মোহ মহুয়ার বাহু ধরে বলে, “এই নাহয় আমার মহু।”
দুইজনে হেসে গল্প করতে করতে বের হয়। বাহিরে সবাইকে ডাকে গেইট ধরার জন্য। তার কাজিনদের ডেকে সমুদ্রকে খুঁজে। পায় না। অবশেষে মহুয়ার মা জানায় সমুদ্র চলে গেছে। তার ভাষ্যমতে,
“ওর একটা ফোন এসেছিল। তারপর বলল অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আছে। আর চলে গেল তাড়াহুড়ো করে। ”
কথাটা শুনেই মোহের মুখটা মলিন হয়ে এলো। মহুয়া তার এমন মুখের ভঙ্গিমা দেখে সান্ত্বনার সুরে বলল, “আরে আপসেট হচ্ছিস কেন? দুলুভাইয়ের কোনো জরুরি কাজও তো এসে পড়তে পারে। এত মন খারাপ করিস না।”
মোহ জোরপূর্বক হাসে। কিন্তু তার বুকের ভেতর তুফান উঠে। সমুদ্র যেকারো কলে এভাবে বের হয় না। তাহলে কী জবা কল করেছিল? তার সাথে দেখা করতে বের হয়েছে। বুকের ভেতরটা মুচড়িয়ে উঠলো তার। ভেতরটা বিষাদে ভরে গেল।
.
.
“স্যার দুইজন লোক আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।”
কারিম বিছানায় শুয়ে ছিলো। পাশেই বসে তার জন্য ফল কাটছিল জবা। হঠাৎ এই কথা শুনে দুজনে একত্রে তাকায় সামনের লোকটির দিকে। কারিমের হাতে ও মাথায় এখনো ব্যান্ডেজ করা। সে ভাবে তার কোনো বন্ধু এসেছে।
“কে এসেছে?”
“বলল আপনারা একসময় বন্ধু ছিলো।”
“নাম বলে নি?”
“জিজ্ঞেস করিনি স্যার। করে আসবো?”
“না, প্রয়োজন নেই। বসতে বলো। আসছি।”
সে বিরক্তি নিয়ে তাকায় জবার দিকে, “তোকে কি এখন আমন্ত্রণ দিতে হবে? আলমিরা থেকে ভালো একটা শার্ট বের করে দে।”
“দি…দিচ্ছি।”
কারিম তৈরি হয়ে আসে ড্রইংরুমে। সেখানে সমুদ্র ও লামিনকে দেখেই তার মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। সে চেঁচিয়ে উঠে, “তোদের সাহস কি করে হলো এখানে আসার? আমার এই অবস্থা করার পর তোদের রুহ কাঁপলো না এখানে আসার আগে? ”
সমুদ্র বসেছিল। তার কথা শুনে তাচ্ছিল্য হাসল, “রুহ তো তোর কাঁপা উচিত। এই অবস্থা কার জন্য হয়েছে ভুলে গেছিস?”
“তোকে তো…”
“গলার স্বর নিচে নামিয়ে কথা বল। তোকে দেখেই আমার মাথায় র’ক্ত উঠে গেছে। বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করেছি। চুপচাপ বোস৷ কথা আছে।”
কারিমের মেজাজ খারাপ হলো খুব। তার বাসায় এসে তাকে আদেশ দিচ্ছে? কিন্তু তবুও সে দেখতে চাইল এরা কী করে! তাই বসলো।
তখনই কথা শুরু করল না সমুদ্র। পাঁচটা মিনিট কাটলো নীরবতার। তারপর সেখানে প্রবেশ করল ঈশা। হাতে কতগুলো ফাইল। তা নিয়ে বসলো সমুদ্রের পাশে। সে কিছু বলতে চাইলো ঈশাকে কিন্তু ঈশা তার দিকে তাকালও না ঠিকভাবে।
সমুদ্র সবার আগে প্রশ্ন করল, “আমার থেকে প্রতিশোধের জন্য তুই জবাকে বিয়ে করেছিস? কথাটা ঠিক?”
কারিম হাসল। আনন্দিত সে হাসি। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে জবা। তার মুখ মেঝের দিকে ঝুঁকানো। চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না সে।
কারিম সন্তুষ্টির সাথে উত্তর দেয়, “একদম। আর মজার কথা কি জানিস? ওর পিছে আমার তেমন ঘুরতেও হয় নি। আমি কেবল দুইদিন কথা বলেছি আর তোর সাথে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও…. ”
কারিমের কথা কোন দিকে যাচ্ছে তা বুঝে জবা চমকে তার দিকে তাকায়। আর কথা আটকায় সাথে সাথে।
“কারিম তুমি এসব কেন বলছো?”
কারিম তার কাঁধে জবার হাত দেখে। তার হাত ধরে শক্ত করে ধরে সরিয়ে দেয়।
“তোর সাহস তো কম না। আমার কথা থামাতে যাচ্ছিস? জিহ্বা কেটে ফেলবো।”
ভারী অপমানবোধ করে জবা। ঘরে কারিম যাই করুক, বাহিরের মানুষদের সামনে এমন করবে?
সে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় সমুদ্রের দিকে।
কিন্তু সমুদ্র চক্ষু তুলেও তাকায় নি তার দিকে। আর ঈশা ও লামিন তার দিকে তাকালেও তাদের চোখেমুখে বিরক্তি।
সমুদ্র গম্ভীর সুরে বলে, “কন্টিনিউ।”
কারিম প্রথম অবাকই হয় তার কোনো রিয়েকশন না দেখে। তারপর বলে, “তোর সাথে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ও আমার কাছে এসেছে। বিলিভ মি, ওর প্রতি আমার দুই পয়সার ইন্টারেস্ট নেই, কখনো ছিলোও না। কিন্তু ওকে বিয়ের পর তোর ভেঙে পড়াটা, তোর গুছানো জীবন তছনছ হয়ে যাওয়া, তোর ক্যারিয়ার, তোর স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে যেতে দেখে যে আমার কত ভালো লেগেছে বলার বাহিরে। ইট ওয়াস ওয়ার্থ ইট।”
” যতটুকু জানি আমি কখনো তোর কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে আমার কষ্টে তোর এত খুশি খোঁজার কারণ পাচ্ছি না।”
“কিছু করিস নি? তুই আমার সব ছিনিয়ে নিয়েছিস।”
“হোয়াট ননসেন্স!”
“এটা কোনো ননসেন্স হওয়া কথাবার্তা না।” এবার কারিমের কন্ঠ উঁচু হয়, “ঈশা আমার বোন ছিলো। আমার কোনো ভাইবোন ছিলো না। ছোট থেকে ঈশাকে নিজের বোন ভেবে এসেছি। লামিন প্রথমে আমার বন্ধু ছিলো। স্কুলে সবসময় ওরা আমার সাথে থাকতো। স্কুলে সবজায়গায় শুধু আমার প্রশংসা হতো। বাবার কাজের জন্য কেবল তিন বছর… তিন বছরের জন্য বিদেশ গেলাম। এসে দেখি আমার জায়গা কত সহজে তুই দখল করে নিলি। আমি প্রথমদিকে সব মানিয়ে আবারও সবার কাছে আগের মতো হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঈশা তোর বেশি আপন হয়ে গিয়েছিল, লামিন তোর বেস্টফ্রেন্ড হয়ে গেছে, টিচাররা আমার জায়গায় তোর প্রশংসা হতো। সম্পূর্ণ স্কুলে তুই পপুলার ছিলি। আর আমি ছিলাম? কেউ না। যেখানে এসব প্রথমে আমার ছিলো।”
ঈশা বলে, “তুই সবসময় আমার ভাই ছিলি।”
“মিথ্যা কথা। তুই কী ভেবেছিস আমি দেখিনি? আমার সাথে কয়টা কথা বলে সমুদ্র আসতেই তুই হাসিমুখে ওর কাছে দৌড়ে যেয়ে কথা বলতি। আমার সব মনে আছে। কিন্তু তোর মনে নেই তুই কাকে সবার আগে ভাই বানিয়েছিলি। কে তোকে ক্রিকেট শিখিয়েছে, তোকে চকোলেট এনে দিতো, তোকে ফুপি থেকে বকা খাওয়া থেকে বাঁচাতো।”
সমুদ্র তার কথা শুনে আরও বিরক্ত হয়, “এইসব কারণে তুই আমাকে নিজের শত্রু ধরে নিয়েছিস? আমি তো কখনো নিজ ইচ্ছায় তোর কোনো ক্ষতির চেষ্টা করিনি।”
“তোর কাছে এসব সামান্য হতে পাড়ে। আমার কাছে আমার সম্পূর্ণ জীবন। কিন্তু মজার কথা কি জানিস? জবাকে তোর থেকে ছিনিয়েও আমার এতটা আনন্দ হয় নি যতটা তোর বউকে তোর থেকে দূরে করে হয়েছে।”
মোহের কথা উঠতেই সমুদ্রের হাত মুঠোবন্দি হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
তবে কারিম নিজের মতোই বলে যাচ্ছে, “কেন জানিস? জবা তো এক ডাকেই আমার কাছে এসে পড়েছিল। কিন্তু মোহের পিছনে আমি দুইদিন ঘুরেছি। ওকে এটাও বলেছি যে ওর জন্য আমি এই জবাকে ছেড়ে দিবো। এমনিতেও একে আমি রাখতাম না। তোর চোখে ওর প্রতি আর কোনো অনুভূতি আমি পাই না। তাই রেখে লাভ কী বল? কিন্তু তুই এত ভালো মেয়েকে এর জন্য হারালি? যে আমার এত সম্পদের কথা শুনেও বিরক্তি নিয়ে তাকিয়েছিল। তোর জন্য আসলেই এবার আমার আফসোস হলো। এমন মেয়েকে তো পেলে নিজেই ছাড়তাম না। আর কী আগুন রূপ উফফ! তোর এমন পরীর মতো বউ থাকতে তুই এই মেয়ের জন্য তাকে হারালি। ওকে যদি আগে দেখতাম তোর উপর সব প্রতিশোধ ভুলে ওরে রেখে দিতাম। এই আগুন রূপ দেখেই তো ওদিন সহ্য করতে না পেরে ধরেছিলাম। ওরে পাওয়ার পর হাত পা ভাঙলেও আফসোস হতো না…”
তার সম্পূর্ণ কথা শেষ না হতেই সমুদ্র উঠে আসে তুফানের বেগেতে। তার পেটের উপর পা রেখে গলা চেপে ধরে। অন্য হাত দিয়ে ডান হাত মচকে বলে, “হারামির বাচ্চা তোকে আধম’রা করে দিয়েছিলাম তাও তোর শিক্ষা হয় নাই? আমার বউকে নিয়া বাজে চিন্তা তোর মাথায় আসে কীভাবে?”
জবা তাকে থামানোর চেষ্টা করে, “সমুদ্র তুমি কী করছ? ছাড়ো ও…”
কিন্তু সমুদ্রের রাগান্বিত দৃষ্টি দেখে সে চুপ হয়ে যায়। ঘরের হাউজহেল্পার আসে কারিমকে বাঁচাতে। লামিন ও ঈশাও ছাড়ায় সমুদ্রকে।
অথচ কারিম নিশ্বাস নিতে কষ্ট হলেও হাসল। বলল, “যাই করিস কী লাভ? মেয়ে তো চলে গেছে? গেছে না? এমন সম্মান থাকা মেয়ে আর থাকবে না। ওকে দেখেই বুঝছি। আর এই দেখ তোর প্রথম প্রেম, এত লাথি গুঁতা দেই যাই ই না। চলে গেলে এই বিলাসিতা যে পাইবো না। কী লোভী ভাবা যায়! এমন মেয়ের প্রেমে পড়েছিস এই শিক্ষা তো পেতেই হতো।”
“আমার মধুর চিন্তাও তোর মাথায় এলে তোর মাথা ফাঁটায় দিবো। লামিন ছাড়, আমি কিছু করছি না।”
“রাগে নিয়ন্ত্রণ হারাবি না তো?”
“না।”
সমুদ্রকে ছাড়লে ও সোফায় রাখা ফাইলগুলো নিয়ে রাখে কারিমের সামনে।
“এগুলো কী?”
“তোর ধ্বং’স।”
“কী?” কারিম অবাক হয়।
“তোর সবচেয়ে বড় অহংকার তোর এই টাকা পয়সা, সম্পত্তি তাই না? জে’লে তো এসব সম্পত্তি উপভোগ করতে পারবি না। আফসোস।”
কারিম আতঙ্কে উঠে দাঁড়ায়।
“আমি কিন্তু মোহের সাথে কোনো কিছু করার সুযোগ পাই নি…”
“তোর মনে হয় আমি আমার বউয়ের নাম এসবের মাঝখানে আসতে দিবো?” সমুদ্র ব্যঙ্গ করে হাসে। আবার বলে, “এগুলো তোর ব্যবসায়ের ফাইল। তুই যে ট্যাক্সে গত চারবছর ধরে ঘাপলা করেছিস তার ফাইল। যা ট্যাক্স অফিসে পৌঁছে গেছে। সাথে তুই যে পণ্যে কত ক্ষতিকারক পদার্থ মিক্স করিস তার প্রমাণ আছে। এখানে সব কপি। আসলগুলো জায়গা মতো পৌঁছে গেছে। রেডি থাক এবার তোর ধ্বং’সের জন্য।”
“না, তুই এমনটা করতে পাড়িস না।”
“এটা তোর আমার বউকে ছোঁয়ার আগে ভাবা উচিত ছিলো। তাকে বুকে ভরলে আমার পৃথিবী শান্ত হয়ে যায় তুই তার সম্মানে হাত দিয়েছিস। তোর সম্মান আর জীবন দু’টো শেষ করেই ছাড়বো।”
“ঈশা…ঈশা তুই ওকে বুঝা।”
ঈশা কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে যায়। লামিনও সমুদ্রকে ধরে নিয়ে যায়। আরও কোনো ঝামেলা না বাঁধে এজন্য। কিন্তু জবা মাঝখানে এসে পথ আটকায়। সমুদ্রকে বলে, “সমুদ্র প্লিজ এসব করো না। অন্তত আমার জন্য। ”
“তোমার জন্য?” সমুদ্র অশ্রদ্ধ নিয়ে তাকায় তার দিকে, “তোমাকে দেখলেও আমার রাগ উঠে। আমার বউয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলার সাহস কীভাবে হলো তোমার? তোমার জন্য আমি ওকে ছাড়বো? তোমারও ব্যবস্থা করে এসেছি আমি। ওর জে’ল হওয়ার পর তুমি কোথায় থাকবে? বাবাবাড়ি বা শশুড়বাড়ি? সবাইকে তোমার আসল রূপ আর বিয়ের কারণ সব জানিয়ে এসেছি। তাদের প্রশ্নের উওর তৈরি করো এখানে বসে অথবা এরপর কোথায় যাবে তা চিন্তা করো। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তোমার প্রেমে পড়া। তোমার জন্য আমি নিজেকে শেষ করে দিয়েছি তার জন্য আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পাড়লেও আমার মধুকে যা কষ্ট দিয়েছি তা ভেবে নিজেকে শেষ করে দিতে মন চাচ্ছে আমার। অথচ ওকে আরেকবার দেখার, কাছে পাওয়ার লোভ সামলাতে পাড়ছি না। তুমি আমার জীবনে না এলে হয়তো ও আমার প্রথম আর শেষ ভালোবাসা হতো। ওর স্বপ্নটা পূরণ করার সাধ্য থাকতো আমার। অথচ ওর সব স্বপ্ন, সব আকাঙ্খা চুরমার করে ওর কষ্টের কারণ হয়েছি আমি। আমি যদি সময়ে ফিরে যেতে পারতাম কেবল আর কেবল আমার মধুকে ভালোবাসতাম। ও কেবল আমার শেষ ভালোবাসাই না, প্রথম ভালোবাসাও হতো।”
চলবে…