মেঘের খামে পর্ব-৫৯+৬০

0
4

মেঘের খামে…
পর্ব ৫৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শায়ান। বারবার ঘড়ি দেখছে। অপেক্ষা করছিল মহুয়ার বাড়ির সামনে। রীতিমতো দেরি হয়ে গেছে তাদের। কথা ছিলো সাতটায় আসার বাজে আটটা। খানিকটা বিরক্তও হয় সে। আবার ঘড়ি দেখে দরজার দিকে তাকায়। তখনই দেখা পায় মহুয়ার। তাকে দেখে হেলান দেওয়া থেকে সোজা দাঁড়িয়ে পরে শায়ান। ঢলে পড়ে গেল না এই তার সৌভাগ্য। লাফানো হৃদপিণ্ড খুব কষ্টে কাবু করল।

মহুয়া এসে দাঁড়াল তার সামনে। গাঢ় লালচে-কমলা রঙের গাউন পরেছে সে। কানে ছোটো দুইটা সোনালী রঙের কানেরদুল, বামহাতের আঙুলে একটি আংটি আর ডান হাতে ব্রেসলেট। আজ প্রসাধনীও মেখেছে ভালো। চোখের উপর তীক্ষ্ণ ধারালো আইলাইনার ও ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপ্সটিক। চুলের একপাশে গুঁজে আছে লাল রঙের জারবেরা ফুল। এমন বেশে আর কখনো দেখে নি সে মহুয়াকে।

“দাঁড়িয়ে থাকবে না চলবে। এমনিতেই লেইট হয়ে গেছে।” মহুয়া নিজেই যেয়ে গাড়ির দরজা খুলে বসলো প্যাসেঞ্জার সিটে। শায়ান কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে হজম করলো কথাটা। সে এখানে এসে দাঁড়ানো বিশ মিনিট ধরে। আর সে দেরি করেছে?

মহুয়ার আবার ডাকে সে যেয়ে বসলো ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি স্টার্ট দেয়।
মহুয়া জিজ্ঞেস করে, “আজকে তোমার জানের থেকেও প্রিয় বাইক কই গেল?”
“পার্টিতে তো তোমাকে পিক করে বাইকে নিতে পারবো না। তাই আব্বুর থেকে গাড়ি নিয়ে এলাম।”
“আংকেলের সাথে তোমার সম্পর্ক ভালো হচ্ছে?”
“মনে তো হচ্ছে। কাজের মাঝখানে সময় কাটছে। তোমার জন্য কাজ শুরু করলেও ভালোই ইনজয় করছি।”
“আমার জন্য সবার ভালোই হয়। আমি অনেক গ্রেট আমি জানি।” খানিকটা ভাব নিয়ে বলল মহুয়া। তারপর হাসল।
শায়ান আড়চোখে দেখল সে হাসি। সত্যিই আজ অনেকদিন পর এই প্রাণবন্ত হাসিটা আবার দেখছে সে। তার বুকের ভেতরটা এলোমেলো করে দেওয়া হাসি। তারও ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে ছোট করে। জিজ্ঞেস করে, “প্লান কী?”
“তোমাকে কেন বলবো? তুমি ওখানে আমাকে নিয়ে যাও বাকিটা আমি সামলে নিব। সেখানে যেতেই জিনি আমাকে সাহায্য করবে। ওকে বলেছি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকতে।”
“মানে সেখানে ঢোকানোর পর আর আমায় চিনবে না। তুমি তো স্বার্থপর আছো।”
“তাহলে অপ্রেমে পড়ে যাও।”
“অপ্রেমে পড়ে কীভাবে?”
“জানি না তো।”
“তাহলে তুমি জাহানের অপ্রেমে পড়ে যেতে পারো না?”
“মোটেও না।”
ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে শায়ান, “আচ্ছা আমি আজ তোমার কাজে বাঁধা হবো না কিন্তু তোমাকে সাহায্যও করবো না। তবে এক শর্ত আছে।”
“কী?”
“তুমি আজ জাহানকে পাও অথবা না পাও, আমাদের সম্পর্ক নতুনভাবে শুরু করবো। ফ্রেন্ডস?”
মহুয়া তাকাল তার দিকে। তারপর তার সামনে হ্যান্ডশেকের উদ্দেশ্যে হাতটা এগিয়ে দিলো সেদিকে। কিন্তু সে মুখ ফিরিয়ে নিলো, “পরে ভাববো।”
.
.
শ্বেতমহলটা আজ ফুল আর লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে ভীষণভাবে। চারদিকে মানুষের জমজমাট। মহুয়া কথামতো এসেই জিনির সাথে চলে গিয়েছিল। শায়ান কথা বলছিল রশ্মির ভাই রাজ, রশ্মির বাবা, জাহানের বাবা ও আরও কয়েকজনের সাথে।

তখনই সে দেখে জাহান আসছে। তার আশেপাশে ছয়টা বডিগার্ড। সবাই তৈরী কিন্তু যার জন্য অনুষ্ঠান সেই তৈরি না। জাহান আসতেই তার বাবা নিজের কাছে ডাকলেন। তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “মালদ্বীপের ট্রিপ কেমন লেগেছে?”
জাহান আর চোখে দেখল তার বাবাকে। বিতৃষ্ণা নিয়ে। নিজের কাঁধ থেকে তার বাবার হাত সরিয়ে দিলো সাথে সাথে।
রাজ বলল, “রশ্মিরও মেকাপ করা প্রায় শেষ। রেডি হয়ে যাবে কতক্ষণে। তোমার জন্যও হেয়ার ড্রেসার আনিয়েছি। জলদি করে তৈরি হয়ে যাবে।”
“নো নীড।”
জাহানের বাবা বলল, “ইট’স ইউর স্পেশাল ডে সান। আমার ছেলে এমনিতেই হ্যান্ডসাম জানি। কিন্তু স্পেশাল ডে-তে একটু ফিটফাট হয়ে তো আসাই যায়।”
“আপনাদের স্পেশার ডে। আমার না। আমি রুমে যেয়ে রেডি হয়ে আসছি।”
“জাহান এটা কেমন কথার ধরণ?”
রাজ মাঝখানে বলল, “আংকেল বাদ দিন। জার্নি করে এসেছে তো। টায়ার্ড মেবি। ওর স্যুট ওর রুমে পাঠিয়ে দিলে হবে।”
রাজ তারপর তাকাল জাহানের দিকে, “রশ্মি নিজে তোমার জন্য চুজ করেছে। আমরা তো শেরোয়ানি ঠিক করে রেখেছিলাম কিন্তু ওর এই স্যুট অনেক ভালো লেগেছে।”
জাহানের এতে কোনো মতলব নেই। সে উল্টো বিরক্ত হলো কথা শুনে। নিজের রুমের দিকে যেতে নিলে তার পিছনে এলো বডিগার্ডরাও। তাদের দেখে জাহান রাগান্বিত স্বরে বলল, “আমি শাওয়ার নিব। এখন বাথরুমেও সাথে আসবে না’কি? ফালতু।”

জাহান তার রুমে গেলে বডিগার্ডরা দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে। জাহান অতিরিক্ত মাত্রায় বিরক্ত, অতিষ্ঠ, হয়রান। এক সপ্তাহ হয়ে গেল তার সাথে অপরাধীর মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। মালদ্বীপের রিসোর্টেই ছিল সে গত এক সপ্তাহ ধরে। আশেপাশে কয়েকটি লোক থাকতোই। একসাপ্তাহ ধরে তাকে কারো সাথে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি তার বোনের সাথেও না। ব্যাপারটা আজব লাগলো সে ভাবে মহুয়ার ব্যাপারে কোনো যোগাযোগ না রাখার জন্যই জিনির সাথেও কথা বলতে বাঁধা দেওয়া হয় তাকে। মহুয়ার কথা আবার মনে পরতেই বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠলো। পীড়া হলো। মহুয়া কেমন আছে? খুব বেশি মন খারাপ কী আজ? তার এনগেজমেন্ট বলে কথা। তাকে মনে করছে? কাঁদছে না’কি?”

ভেবে তার নিজেরও মন খারাপ হয়ে গেল। সে ছোট এক নিঃশ্বাস ফেলে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। শার্ট খুলতে থাকলো শাওয়ার নেওয়ার উদ্দেশ্যে।

আচমকা রুমের শিষের আওয়াজ শুনে সে। অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকায়। সাথে সাথে তার ঠোঁটজোড়া খুলে হা হয়ে যায়। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে সে তার সামনে টেবিলের উপর বসে থাকা কন্যাটির দিকে। এক মুহূর্তের জন্য ভাবে সে কল্পনা করছে। নিশ্চিত কল্পনা করছে। মহুয়া এখানে কীভাবে আসবে। আর অবশ্যই মহুয়া কখনো এভাবে সাজগোজ করে না। তাই অবশ্যই কল্পনা করছে। তাকে এতদিনে এমন শত শতবার কল্পনা করেছিল সে। কিন্তু অন্যকোনো কল্পনাতেও তাকে এতটা সুন্দর লাগে নি।

জাহানের ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে আপনা-আপনি। সে এগিয়ে যায় সে টেবিলের দিকে। টেবিলের দুইপাশে হাত রেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় মহুয়ার দিকে, “কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে জানেমান! আমি জানি তুমি আমার কল্পনা, কিন্তু কল্পনা করেও আমার চোখের শান্তি পাচ্ছি।”
মহুয়া তার চুল ধরে টান দেয় জোরে। সাথে সাথে জাহান ব্যাথায় আঁতকে উঠে, “আরে পাগল না’কি…” বলতে বলতে থেমে যায়। মাথায় হাত ঢলতে যেয়ে আর মাথায় এই কথাটা আসে সামনে বসা কন্যাটি তা কল্পনা নয়, বাস্তব।

সে হতভম্ব হয়ে তাকায় সামনের দিকে, “মহুয়া তুমি আসলে আছো?”
“জ্বি।”
“কিন্তু কীভাবে?”
“শায়ানের পার্টনার হিসেবে এসেছি।”
এই কথা শুনেই জাহান মুখ গোঁজ করে নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আর কাওকে পাও নি? তোমাকে আমি বলেছিলাম জান তুমি ওর সাথে থাকবে না। আর তুমি এখানে কেন? কেউ দেখে নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।” আমি কোনভাবে তোমাকে বের করছি। তোমার কোনো ক্ষতি হলে আমি…”
তাকে নামানোর জন্য জাহান তার হাত ধরে। কিন্তু মহুয়া উল্টো তার শার্টের কলার ধরে তাকে কাছে টেনে আনে, “তো মিস্টার ইয়াজভান জাহান আপনি বলুন, আমার থেকে কথা লুকানোর শাস্তি কী হতে পাড়ে আপনার জন্য? ”
“মহুয়া এটা মজা করার সময় না। কেউ তোমাকে দেখে নিলে অনেক বড় একটা সমস্যা হয়ে যাবে।”
“কী সমস্যা হবে শুনি? আমার কোন ক্ষতি করবে?”
“ওয়েট তুমি কীভাবে…”
“মোহ বলেছে।”
“আমি জানতাম। আমি জানতাম তোমাকে এসব জানালে তুমি নিজেই মাতব্বরি করবে। তাই তোমাকে কিছু বলিনি। মোহকে বলেছিলাম যেন তোমার খেয়াল রাখতে পারে। কিন্তু উল্টো তোমায় বলে দিলো।”
“না বললে তোমার বিয়ে আটকাতে আসতাম কীভাবে?”
“বিয়ে না এনগেজমেন্ট।”
“জ্বি না বুদ্ধিহীন ইয়াজভান জাহান। আজ আপনার বিয়ে। যা আপনি নিজেই জানেন না। আপনার বাবা আপনাকে এনগেজমেন্টের কথা বলে বিয়ে করাতে চাচ্ছে।”
“হোয়াট!” বিস্মিত স্বরে বলে জাহান, “এটা কীভাবে সম্ভব?”
“তাই তো করছে।”
রাগ উঠে যায় জাহানের। মাথায় আগুন ধরে যায় যেন, “এত্তো বড় ধোঁকা। আমার বাবা আমার সাথে এত বড় ছলনা কল্পনাও করিনি। আমি এক্ষুনি তার সাথে কথা বলছি।”
জাহান যেতে নিলেই মহুয়া থামায় তাকে, “তুমি নিজের মতো করে যা করার করেছ। এবার আমার মাতব্বরি করার সময়। আমি যা করছি করতে দিবে। যা বলছি শুনো।”
“না মহুয়া আমি তোমাকে কোনো ক্ষতি…”
মহুয়া জাহানের ঠোঁটে আঙুল রাখে। মৃদুস্বরে বলে, “তুমি আমার সাথে থাকলে আমার কিছু হতে দেবে না। তুমি আমার সাথে না থাকলে আমি থাকতে পারব না জাহান। তুমি আমার নিজের প্রেমে ফেলেছ এখন সারাজীবন প্রেম দণ্ড পাবার জন্য তৈরি হও। তোমাকে আমি অন্যকারো হতে দিব না। আমার জন্যও না।”

জাহান তার চোখের দিকেই চেয়েছিল। অনুভব করছিল ঠোঁটে তার আলতো আঙুলের ছোঁয়া। তার চোখ গেল লাল রঙের ঠোঁটের দিকে। এক ঢোক গিলল সে। নিঁখুতভাবে যাচাই করল মহুয়ার আজকের নতুন আবরণ। তার চুলে থাকা ফুল, যা কখনো ওর পছন্দ ছিলো না। তার ধারাল আইলাইনার ও লাল রঙের লিপ্সটিক যা ও কখনো পরে না। লালচে-কমলা রঙের গাউন। তার চোখ, ঠোঁট, গলায় সবটা নজর বুলাচ্ছে সে। আর কেমন অস্বস্তিতে পরে যাচ্ছে।

তার এই অবস্থা চোখে এড়ালো না মহুয়া। সে দুষ্টু হাসল। জাহানের ঠোঁটে রাখা আঙুল নিচে নামাল আস্তে করে। তার ঠোঁট থেকেই এডামস-এপেলে বেয়ে তার বুকে নামায়। জাহান সাথে সাথে তার হাত ধরে নেয় বুকের সাথে শক্ত করে চেপে, “করছোটা কী?”
“কী করছি?” মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে মহুয়া।তার দুষ্টুমিভাব মুখে ছলকে উঠে। জাহান তার কোমর ধরে টান দেয় নিজের কাছে। আচমকা টানে মহুয়া তার একদম কাছে এসে পড়ে। তবে ঘাবড়ায় না। জাহানের গলা জড়িয়ে ধরে দুইহাত দিয়ে।
জাহান ঝুঁকে যায় তার ঠোঁটের কাছে। সে লাল রঙা ঠোঁটে গভীর চুমু খেতে ইচ্ছা হচ্ছে ভীষণভাবে। তবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নিজেকে। চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস ফেলে, “আমার জান কেড়ে নিচ্ছো। তোমার ভাই পাঁচ বছরের শর্ত না দিলে এই মুহূর্তেই তোমাকে বিয়ে করে নিতাম।”
মহুয়া এক হাত বুলায় জাহানের কোঁকড়াচুলে, “বাহিরে তোমার বিয়ের প্রিপারেশন চলছে জনাব। কিন্তু বউ তো আমি নই।”
“তুমি ছাড়া অন্যকেউ আমার বউ হবেও না।”
“আমি হতে দিলে তো।”
মহুয়া জাহানকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। নিজেও নামে টেবিল থেকে, “তৈরী হয়ে নেও। মেহমানদের এত অপেক্ষা করাতে নেই।”
“কী করতে চাইছ তুমি? তোমাকে কোনো রিক্সে আমি ফেলতে পাড়বো না।”
“তাহলে বিয়ে করে নিবে?”
“এর আগে তাদের না মে’রে ফেলি?”
মহুয়া হাসে ছোট করে, “তাহলে সব আমার উপর ছেড়ে দেও। চরম এক সিনেমা দেখাব আজ মেহমানদের।”
“কী সিনেমা দেখাবে?”

চলবে…

মেঘের খামে…
পর্ব ৬০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মহুয়া হাসে ছোট করে, “তাহলে সব আমার উপর ছেড়ে দেও। চরম এক সিনেমা দেখাব আজ মেহমানদের।”
“কী সিনেমা দেখাবে?”
“তোমাকে কেন বলবো? তুমিও দেখতে থাকো। এখন যেয়ে শাওয়ার নিয়ে রেডি হও।”

জাহান শাওয়ার নিয়ে শার্ট প্যান্ট পরে এসেছে। এসে দেখে মহুয়া তার রুম ঘুরে ঘুরে দেখছে।
“আপনার ফিউচার রুমটা কেমন লাগলো মেডাম?”
“তোমাকে বিয়ে করব বলেছি আমি? ”
জাহান তার সামনে এসে দাঁড়ায়। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে। এসে সামনে দাঁড়ায় মহুয়ার, “তো তুমি বিয়ে না করলে কী আমি বাহিরে যেয়ে বিয়েটা করে ফেলবো না’কি?”
কথাটা শুনে মহুয়া তাকাল তার দিকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে এমনভাবে।
জাহান আগেই নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য বলল, “মজা করছি।”
“একদিন এই মজাই তোমার ম’রার কারণ হবে। তো কি বলছিলাম?”
“যা বলার বলো। কেবল হুমকি দিও না।”
জাহান ড্রায়ার নিলো চুল শুকানোর জন্য। মহুয়া তার হাতের থেকে ড্রায়ারটা নিয়ে তাকে বিছানায় বসায়। আলতোহাতে বুলিয়ে ড্রায়ার দিয়ে তার চুল শুকাতে চায় জলদি আর বলে, “তুমি বাহিরে যেয়ে একদম নরমাল বিহেভ করবে। অতিরিক্ত খুশিও হবে না, অতিরিক্ত রাগও করবে না। যা করার আমি আর জিনি করবো।”
“জিনিও এসবে আছে না’কি?”
“ওই তো তোমার রুমে লুকিয়ে আনলো।”
“বাহ আমার ছোট বোনটা বুদ্ধিমান হয়ে গেছে দেখি।”
“হ্যাঁ তোমার ছোটবোনই বলেছে রশ্মিকে আজ সেজে অপ্সরীর মতো লাগছে। সো তাকাবে না। তাকালে চোখ তুলে ফেলবো।”
জাহান মহুয়ার হাত ধরে তাকে বসায় নিজের পাশে। মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “তোমাকে ছাড়া এই পৃথিবীর অন্যকোনো নারীকে দেখে আমি মুগ্ধ হই না জান। সাধারণভাবেই তোমাকে দেখে আমার হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠে। আজকে তুমি যে আগুন সুন্দরী হয়ে এসেছ এই হৃদপিণ্ডের শব্দ নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছো।”
“এতদিন পর ঠুস করে এসে একটু বেশিই রোমেন্টিক হচ্ছো না?”
“তোমার তো এটাই প্লান ছিলো। এভাবে সেজে এসে আমাকে পাগল করার। শাস্তি দিতে চাও তাই না?”
মহুয়া ছোট করে হাসল। ঠোঁটে কামড় দিয়ে ভাবলো।কিছু সেকেন্ড। তারপর আচমকা তার ঠোঁটের নিচে টুপ করে চুমু খেল।
“হোয়াট দ্যা হেল! এটা কী ছিলো?” জাহান প্রশ্ন করে। এখনো বুঝে উঠতে পারছে না সেকেন্ডখানিক আগে কি হয়েছে।
“বিশেষ কিছু না।” মহুয়া বলে খুবই সাধারণভাবে উওর দিলো। তারপর উঠে দাঁড়াল আবারও। কিন্তু জাহান তাকে যেতে দিলো না। উল্টো টেনে তাকে বসিয়ে নিলো নিজের কোলে। একহাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে অন্যহাত রাখলো তার থুতনিতে। বুড়ো আঙুল দিয়ে তার ঠোঁটে আলতো হাত বুলিয়ে বলল, “আমার হৃদপিণ্ডে আঘাত করে এভাবে পালাচ্ছো? বলেছিলাম না, ততক্ষণ পর্যন্তই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবো যতক্ষণ না তুমি প্রথম স্টেপ নিচ্ছো। এখন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো না।”
তাকে জড়িয়ে কাছে টেনে নেয় সে। চোখে চোখ রাখে। নেশাময় সে দৃষ্টি। হাত দিয়ে মহুয়ার চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে। তার হাত ঘাড়ের কাছে নিয়ে চুলে ডুবিয়ে দেয়। কাছে আনে নিজের। তার নিশ্বাস দ্রুত। মহুয়ার উষ্ণ নিশ্বাসের ছোঁয়া তার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে তুলছে শতগুণ বেশি।
মহুয়ার ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র তৃষ্ণা মেটানোর শেষ সময় মেয়েটা তার ঠোঁটের উপর হাত রেখে পিছিয়ে ঠেলল তাকে, “এত দ্রুত না জনাব। প্রথমে বিয়ে করুন তারপর।”
“তাহলে তুমি এমনটা করলে কেন?”
মহুয়া জাহানের ঠোঁটের নিচে লাগা লাল লিপ্সটিক মুছে দেয় নিজের বুড়ো আঙুল দিয়ে। নিজের চুল থেকে ফুল খুলে তার শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলে, “একটু মজা নিলাম।”
“মজা না? আমার ভেতরটা এলোমেলো করে দিয়ে তুমি মজা নিয়েছ?”
“দুইসাপ্তাহ আমাকে জ্বালিয়েছ। কারণ যাই হোক, শাস্তি তো তোমাকে পেতে হবে। বিয়ের পর চুমু খেতে পারবে না’কি তা নিয়ে চিন্তা করো।” বলে উঠে যায় মহুয়া তার কোলের থেকে।
জাহান যেন জীবনের সবচেয়ে বড় শক খেল। সে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে থাকে কথাটা শুনে। বলে, “এই কী বললে তুমি? আমি প্লান করেছি বিয়ের দশ বছরে পাঁচটা বাচ্চা নিবো।”
“কী!” এবার শক খেল নিজে মহুয়াও, “পাগল না’কি?”
“আমার তো একটাই স্বপ্ন, বড় আর হ্যাপি ফ্যামিলির।”
“তাহলে ভুলে যাও। আমি তোমাকে বিয়ে করছি না।”
জাহান হেসে তার হাত ধরে নেয়, “তোমাকে ছাড়া আমি কাওকে বিয়ে করছি না। আর তোমাকে অন্যকাওকে বিয়ে করতে দিবো না, লাভ।”
এমন সময় দরজায় টোকা পরল। বের হবার সময় হয়েছে। মহুয়া দ্রুত তাকে কোর্ট পরিয়ে বলল, “দ্রুত যাও। আমি আসছি। আর স্বাভাবিক ব্যবহার করবে বুঝলে?”
.
.
জাহান বের হয়ে মহলের সাজসজ্জা দেখে বুঝল সঠিক বলেছিল মহুয়া। ফুলের পর্দা, কাজি ও রশ্মির বেনারসি দেখে সে সবটা ধরতে পারলো কিন্তু না বুঝার মতো ব্যবহার করল। কারো সাথে ভালোমতো কথা বলে নি। স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। বিরক্ত, খানিকটা রাগান্বিত এবং অনুত্তেজিত।

সবার আগে ছবি তোলার পালা এলো। ছবি তুলল সকলে মিলে। তার জাহানের বাবা স্টেজে এলো। সাথে ডাকল তার ও রশ্মির পরিবারকে। এনাউন্সমেন্ট করল, “আমি আজ অনেক খুশি। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না সেদিন যাদের আমি কোলে তুলে ঘুম পাড়িয়েছিলাম আজ তারা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। রশ্মি ও জাহান ছোট থেকে একসাথে আর আজ তারা বিয়ের বাঁধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে৷ এটা আমার স্ত্রীর শেষ ইচ্ছা ছিলো। আপনারা নিজের দোয়া রাখবেন তাদের জন্য।”
মুখের সামনে থেকে মাইক সরাতেই জাহান তার বাবাকে বলল, “বাবা বিয়ে না এনগেজমেন্ট।”
“সরি সান কিন্তু আমি তোমাকে ভরসা করতে পাড়ছি না। ওই মেয়ের জন্য তোমাকে আমার একসাপ্তাহ আটকে রাখতে হয়েছে। এটা অনেক বড় জিনিস। তোমাকে আমি এতটুকু বিশ্বাস করতে পারছি না যে একসাপ্তাহ ছেড়ে রাখবো। আর পাঁচবছর তো দূরের কথা। তোমার আজ কাবিন হবে। তুমি চাইলে পাঁচ বছর পর উঠিয়ে আনবো রশ্মিকে।”
জাহানের চোয়াল শক্ত হলো কিন্তু মুখ খোলার আগে বাবা বললেন, “এতগুলো মেহমানের সামনে নিজের বাবার অসম্মানের কিছু করবে না। যদি বিয়ে করতেই হয়, তাহলে তখন করো আর এখন করো। পার্থক্য কই?”
জাহান হঠাৎ এসব জানলে হয়তো রাগে তামাশা করতো। কিন্তু মহুয়ার কথা অনুযায়ী সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।

জিনি হঠাৎ বলে, “বাবা আমি আমাদের ফ্যামিলি ভিডিও বানিয়েছি একটা। যেটা তোমাকে সকালে দেখিয়েছিলাম। ওটা তাহলে প্রেসেন্ট করি?”
গত চারদিনে জিনি মহুয়ার কথায় এই বিয়ের জন্য খুবই উৎসুক ব্যবহার করছে। তাই তাকে সন্দেহ করার কোন কারণ খুঁজে পেল না জাহানের বাবা। তবুও সকালে জিনি পারমিশন নিয়েছিল তার বাবার কাছে। ভিডিওটা দেখিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই চালু হলো ভিডিও। প্রথম জাহানের মা’য়ের ভিডিও এলো। বাগানে খেলছিল ছোট জাহান ও রশ্মি। জাহান দুষ্টুমি করে রশ্মির জুটি খুলে দিলো আর রশ্মি কেঁদেকেটে এলো জাহানের মা’য়ের কাছ। অনেক আহ্লাদ করল। তারপর জাহান এসে তাকে একটা চকোলেট দিয়ে মানালো আর তাকে নিয়ে খেলতে গেল। তখন জাহানের মা বলেছিলেন, “দুইজনকে একসাথে কত কিউট লাগে। বড় হয়ে এদের দুইজনের বিয়ে দিবো।”
জাহানের বাবা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন স্ক্রিনের দিকে। তার কথা শুনে একগাল হাসলেন। হাইটা তার চোখ পর্যন্ত যেয়ে আটকাল। তারপর তাদের ছবি আসলো স্লাইড করে। প্রথমে জাহান, শায়ান, রশ্মি, জিনি ও তিসানের। তারপর তাদের পরিবারেরও। অবশেষে জাহানের ফ্যামিলির। তাদের চারজনের। আর শেষেরটা জাহানের তার মা’য়ের সাথে। জাহানের মা তাকে কোলে তুলে গালে চুমু দিচ্ছিল। এরপর আরেকটা ভিডিও আসলো। যা দেখে অবাক হলেন জাহানের বাবা। সকালে জিনির দেখানো ভিডিওতে এটা ছিলো না।

ভিডিওটা জাহানের জন্মদিনের। জান্নাতের একপাশে বসে ছিলো দশ বছরের জাহান ও অন্যপাশে ছোট ছয় বছরের জিনি। জাহানের মা তাকে একটি প্লাটিলেটের রিং পুরিয়ে চুমু খেল। যা দেখে ছোট জিনি মুখ ফুলিয়ে বলে, “মা সবচেয়ে বেশি ভাইকে আদর করে। জিনিকে না।”
জান্নাত টুপ করে চুমু খেল জিনির গালেও, “মোটেও না। মা দুইজনকে সবচেয়ে বেশি আদর করে। মা’য়ের কাছে তোমাদের খুশি থেকে বেশি কিছু মেটার করে না এই পৃথিবীতে। মা’য়ের কলিজার দুই টুকরো হচ্ছো তোমরা দুইজন।”
জিনি আদুরে ভঙ্গিতে জাহানের হাতের রিং দেখিয়ে বলল, “এটা আমার।”
জাহান জিহবা বের করে ভেঙাল তাকে, “এটা তো আমার। মা আমাকে দিয়েছে তোকে না।”
একথা শুনে জিনি জোরে কেঁদে উঠে। মা তাকে কোলে তুলে বলে কতক্ষণ চুপ করানোর চেষ্টা করে। সে করে না। তারপর মা তার আঙুলের ডায়মন্ডের আংটি দেখিয়ে বলে, “এটা তোমার আব্বু আমাকে দিয়েছে। আমার প্রিয় যখন তুমি বড় হবে তখন এটা তোমার।”
জাহান তখন বলে, “মা এটা ঠিক না। আমার এখনের এটা লাগবে না। আমার প্রিয়টা লাগবে।”
এই কথা শুনে হাসে জান্নাত। সাথে ক্যামেরার পিছন থেকে হাসে জাহানের বাবাও।
জান্নাত তাকে আরেক হাত দিয়ে নিজের কাছে এনে আদুরে গলায় বলে, “ছেলেরা তো এগুলো পরে না। তোমার বউকে দিব আমার সবচেয়ে প্রিয় আংটি।”
তার হাতের আনামিকা আঙুলের স্বর্ণের রিং দেখিয়ে বলে, “এটা তোমার বাবা প্রথম উপহার আমাকে দেওয়া। এই পৃথিবীতে আমার এর থেকে বেশি কোনো জিনিস প্রিয় না। হাজারো স্বর্ণ গহনা, টাকা কিছু এর তুলনা করতে পারবে না। যখন তুমি এমন কাওকে পাবে যার কাছে এই পৃথিবীর সব মূল্যহীন তাকে তুমি এই রিংটা দিবে। আমি চাই এই রিং দিয়েই তুমি নিজের নতুন জীবন শুরু করবে।”
এভাবেই শেষ হয় ভিডিওটি।

জাহানের বাবা তবুইও স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবে কতক্ষণ। তারপর চোখ সরিয়ে তাকায় জাহানের দিকে, ” রিংটা কোথায়?”
“আমার কাছে নেই।” জাহানের পরিষ্কার উওর।
তবে উওরটা শুনে তো ক্ষেপে যায় জাহানের বাবা, “নেই মানে? সেটা তোমার মা’য়ের সবচেয়ে প্রিয় গয়না ছিলো। তুমি সেটা কীভাবে হারালে জাহান? সেটা তোমার মা তোমাকে দিয়েছিল নিজের নতুন জীবনের সূচনার জন্য।” শেষ কথায় তার আওয়াজ উঁচু হয়ে যায়।
তখন জাহান হাসে তাচ্ছিল্যভাবে, “বাবা আওয়াজ নিয়ন্ত্রণে রাখো। মানুষ দেখছে। তোমার অসম্মান হবে না?”
জাহানের বাবা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তার উপর হাত তুলতেও এগোয় কিন্তু শেষ মুহূর্তের জিনি বলে ওঠে, “আমি জানি আংটিটা কোথায়। নিয়ে আসছি।” বলে জিনি চলে যায়।

খানিকক্ষণ আগের গান বাজনা ভরা মহলটাও নীরবতায় ভরে যায়। জাহান তার বাবার দিকে ঝুঁকে হাসিমুখে বলে, “তুমি মা’য়ের গহনা হারানোর কথা শুনে এত আবেগী হয়ে যাচ্ছো আর তুমি তো আমার ভালোবাসার মানুষটাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছো। এটা শুনলে যে রিংটা দিয়ে মা আমার নতুন জীবন শুরু করতে বলেছিল কিন্তু এটা শুনলে না মা এমন কাওকে পরাতে বলেছিল যার সামনে আমার জীবনের সব মূল্যহীন। রশ্মি সে মেয়ে না আর কখনো হবেও না। সে রিংয়ের একমাত্র হকদার আমার জান, আমার মহুয়া। আর সে রিং নিজের মালিকের কাছেই আছে।”
এই কথা শুনে জাহানের বাবা অবাক হয়ে তাকালেন তার দিকে।

এরমধ্যে জিনিও এলো। সাথে নিয়ে এলো মহুয়াকে হাত ধরে। তাকে দেখে জাহানের বাবা সহ রশ্মি ও রশ্মির ভাইও চমকে যায়।
অথচ মহুয়া নির্বিকার গলায় জিজ্ঞেস করে জাহানের বাবাকে, “আপনি না’কি আমাকে খুঁজছিলেন?”
“হোয়াট ননসেন্স। সিকিউরিটি… ”
জাহান এসে তার বাবার মুখোমুখি দাঁড়ায়। মহুয়ার সামনে, “বাবা স্টপ ইট। এসব পাগলামো বন্ধ করো। আমি যদি জানতাম তোমরা আজ এনগেজমেন্ট না বিয়ের ষড়যন্ত্র করছো তাহলে আমি এয়ারপোর্ট থেকেই পালিয়ে যেতাম।”
রশ্মি দৌড়ে এলো জাহানের পাশে। তার বাহু ধরে বলল, “জাহান এসব কী বলছো তুমি? তুমি রাজি হয়েছিলে আমাদের বিয়ের জন্য।”
“আমি রাজি হই নি। আমাকে ব্লাকমেইল করা হয়েছে। এমন নাটক করো না যে তুমি জানো না।”
জাহানের বাবা রাগান্বিত স্বরে বলে, “তোমার মা’য়ের ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে না? ছেলে নামে কলঙ্ক তুমি!”

“এক মিনিট,” মহুয়া জাহানের পিছন থেকে মুখ বের করে তাকায় তার দিকে। চোখ মুখ কুঁচকে। যেন ক্ষেপে গেছে সে। সে হাত দিয়ে সরায় তার সামনে দাঁড়ানো জাহানকে। দুই কোমরে হাত রেখে তাকায় জাহানের বাবার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে, “আপনি জাহানকে বলছেন ও ছেলে নামে কলঙ্ক? আপনি স্বামী নামে কলঙ্ক।”
একথা শুনে রাগে গর্জে উঠে জাহানের বাবা, “এই মেয়ে তোমার এত বড় সাহস…”
মহুয়া তাকে কথা শেষও করতে দেয় না। দ্বিগুণ গলা উঁচিয়ে বলে, “আছে আমার সাহস তো? কী করবেন আপনি? প্রথম ভিডিওটা দেখে তো নেচে নেচে ছেলের বিয়ে করাতে গেলেন। শেষ ভিডিও দেখেন নি? আমার শাশুড়ী আম্মু কত কিউট। উনার কাছে তার ছেলে মেয়ের খুশি সবচেয়ে বড়। উনি যদি দেখে আপনি তার স্বামী হয়ে তার ইচ্ছার প্রতি এমন অনীহা দেখাচ্ছেন কত কষ্ট পাবে চিন্তা করেছেন। বেচারা আমার কিউট শাশুড়ী আম্মু, আপনার মতো খাটাশ লোকের সাথে বিয়ে হয়ে গেল।” আফসোসের নিশ্বাস ফেলল সে।

জাহান অন্যদিকে মুখ করে হাসল ঠোঁট টিপে। জিনি তো সামলাতে না পেরে তার ভাইয়ের পিঠে মুখ গুঁজে হাসতে শুরু করে। নিচের থেকেও হাসির শব্দ আসে। আর সবচেয়ে জোরে হাসির শব্দ আসে নাহিদ আংকেলের থেকে। কিন্তু জাহানের বাবা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতেই সে চুপ হয়ে যায়।

মহুয়া তার মুখের সামনে হাতে তালি মেরে নিজের দিকে ধ্যান আকর্ষণ করে, “আর দেখে লজিক্যালি বলি, প্রথম ভিডিওটা যেখানে আন্টি বিয়ের কথা বলেছে সেখানে ওরা কয় বছরের ছিলো বড়জোর চার পাঁচ? একদম মজা করেই বলেছে। বান্ধবীদের ছেলেমেয়ে নিয়ে মেয়েরা এসব মজা করে বলেই। এখন বলেন শেষ ভিডিও ক্লিপে দশ বছরের। তখন যদি আন্টি চাইতো যে রশ্মির সাথে জাহানের বিয়ে হোক তাহলে তো এই রিংটা রশ্মিকে দিয়ে যেত। জাহানকে ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে দিতে বলতো না। লজিক শশুড়আব্বা, লজিক। এজন্যই আপনার শশুড় নিজের মেয়েকে দিতে রাজি হয় নি। হুদাই আমার শশুড়িআম্মু আপনার জন্য তিনদিন না খেয়ে ছিলো।”
জাহানের বাবা এই কথা শুনে তাকাল তার বন্ধু নাহিদের দিকে। সে বুঝতে পাড়ে এই গল্প কে শুনাতে পাড়ে। নাহিদ আংকেলের দিকে তাকাতেই সে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। এক ঢোকে তার হাতের গ্লাসের সম্পূর্ণ কোক শেষ করে দেয়।

এর মাঝেই রাজ অগ্নিমূর্তি হয়ে যায়, “এখানে সবাই নাটক দেখছে কেন দাঁড়িয়ে। সিকিউরিটি এই মেয়েকে উঠিয়ে ফালাও বাহিরে।”
“খবরদার। ওকে ছোঁয়ার কথা ভাবলেও এখানেই হাত কেটে দিবো।” জাহান হুমকির সুরে বলে।
মহুয়া তার গুণগান করার পরিবর্তে উলটো ঝারি মারল, “তোমাকে মাঝখানে বলতে বলেছি? আমি কথা বলছি না? চুপ।”
তারপর রাজের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার কাছেও আসবো। প্রথমে আমার শশুড়আব্বার থেকে নিপ্টে নেই।”
“তোমার সাহস কম না আমার বোনের বিয়েতে এসে কাহিনী করছো আবার আমাকে হুমকি দিচ্ছো?”
“তুমি যে আমাকে মা’রার হুমকি দিয়ে জাহানকে বিয়ে করতে ব্লাকমেইল করেছিলে তার কথা উঠাই নি এখনো। তুমি চাও এখনই উঠাই?”

“হোয়াট!” জাহানের বাবা অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন রাজের দিকে, “তুমি সত্যি এমন করেছ?”
রশ্মির কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না, “অসম্ভব আমার ভাইয়া এমন করতেই পারে না। তুমি মিথ্যা বলছো।”
“জিজ্ঞেস করো তাহলে নিজের ভাইকে।” মহুয়া বলে।
রশ্মির মা এসে রাজের পাশে দাঁড়ায়, “এটা কী সত্যি রাজ? তুই এমনটা কীভাবে করতে পারিস? জাহান এই মেয়েটাকে ভালোবাসে, তারপরও তুই ওকে হুমকি দিয়ে এই বিয়ে করাতে চেয়েছিলি? তোর মনে হয় এমন বিয়েতে রশ্মি খুশি হতো?” সে তাকায় রশ্মির দিকে, “খুশি হতি তুই? যে ছেলে তার ভালোবাসার মানুষকে বাঁচানোর জন্য তোকে বিয়ে করবে সে কী বিয়ের পর তোকে ভালোবাসতে পারতো। জাহানকে পাওয়ার জেদের চক্করে তুই নিজের এতগুলো বছর নষ্ট করলি তুই কী সারাজীবন এই জেদে শেষ করতে চাচ্ছিলি? তোর ভাই তো কিছু করার আগে ভাবে না। ওর কাছে তো কোনো আশা আর আমার নেই। কিন্তু তুই? তুই সেদিনের ঘটনার পর আমাকে ওয়াদা করেছিলি এমন ভুল আর কখনো করবি না। কসম খেয়েছিলি আমার।”
“মা আমি এসব কিছু জানতাম না। ভাইয়া কেবল আন্টির ভিডিওর কথা জানিয়েছিল আমায়। বলেছিল ভিডিওর কথা শুনেই জাহান হ্যাঁ বলেছিল।”
“সেটাও তো ইমোশনাল ব্লাকমেইল তাই না?” সে জাহানের বাবার দিকে তাকায়, “আর ভাইয়া আপনার থেকে তো এটা আমি কখনো আশা করিনি। আমরা তো এইখানে মজা করে বলছিলাম। সবসময়ই মজা করে এসব বলতাম। কিন্তু আপনি এই কথাকে নিয়ে নিজের ছেলেকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলেন। জান্নাতের জান বাস করতো নিজের ছেলেমেয়ের মাঝে। আপনার মনে হয় ও থাকলে এসব দেখে খুশি হতো? ও আপনার উপর ভীষণ নিরাশ হতো আরিদ ভাই।”

মহুয়া পিছিয়ে যেয়ে জিনির পাশে দাঁড়ায়, “রশ্মির মা তো জোস। ছেলে মেয়ে এমন তারছেঁড়া হলো কীভাবে?”
“ভাবি, বি সিরিয়াস।”
“ও হ্যাঁ।” সে ফটাফট নিজের আগের জাতগায় এসে দাঁড়ায়। গলা পরিষ্কার করে বলে, “দেখেন শশুড়আব্বা, আমি কিন্তু আপনার ছেলেকে নিয়ে অনেক সিরিয়াস। আর আমি কখনো কোনো কিছু নিয়ে সিরিয়াস হই না। আপনার জন্য এই ওয়ার্ড আমার ডিকশনারিতে আনা লেগেছে। আপনি রাজি হন বা না হন। আমি তো আপনার ছেলেকে বিয়ে করবো। আপনি রাজি না হলে ওকে নিয়ে পালিয়ে যাব।”
জাহানের বাবা এবার আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনে। এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আর পালিয়ে নিয়ে কোথায় যাবে? তোমার পরিবার মানবে?”
“আপনাকে আর আমার শাশুড়ী আম্মুর পথ অনুসরণ করে যদি পালাই তাহলে একটু কষ্ট করে থাকতেও পাড়বো। ভাইয়া না মানলে নেই। বিয়ে করে এক রুম নিয়ে থাকবো আপনাদের মতো।”
“আচ্ছা আমার ছেলে ছোট থেকে সব সুবিধা ভোগ করে বড় হয়েছে। ও কী এত কষ্ট সহ্য করতে রাজি হবে?”
মহুয়া তাকায় জাহানের দিকে। সে-ও তাকিয়ে আছে মহুয়ার দিকে। এবার মহুয়া ক্ষেপে যায়, “উওর দিচ্ছো না কেন?”
“তুমিই তো বললে চুপ থাকতে।”
“যেন আমার বলা সব কাজ করো তুমি? দুইসাপ্তাহ ধরে ঘোরাচ্ছ। যত্তসব ঢঙ!”

জাহান এসে হাত ধরল মহুয়ার, “আমার আপনার কোনো কিছুই লাগবে না বাবা। না কোনো সম্পত্তি, না আপনার ব্যবসা। আমার কেবল মহুয়াকে লাগবে। ও পাশে থাকলে আমি এই পৃথিবীর সকল সুখ ওর পা’য়ের কাছে এনে রাখবো। ওকে রাণী করে রাখার যোগ্যতা অর্জন করবো।”
“আচ্ছা ঠিকাছে। তাহলে যাও।” খুবই গম্ভীরমুখে বললেন তিনি। তেমনই দ্বিধাহীনভাবে জাহানও মহুয়ার হাত ধরে রওনা দেয় সেখান থেকে। জিনি পিছন থেকে ডাক দেয়। জাহান থামে না। তখন জাহানের বাবা বলে, “যেয়ে ওর পরিবারকে নিয়ে আসো। বিয়ের কথাও তো বলতে হবে।”
একথায় থেমে যায়। জাহান অবাক হয়ে ফিরে তাকায় তার বাবার দিকে, “কী?”

“বলেছি তাহলে ওর পরিবারকে নিয়ে আসো। বিয়ের কথা বলে নিবো। আমি তো জানতাম না তুমি ওর জন্য এই বিয়েতে রাজি হয়েছ। আমি ভেবেছিলাম তোমার মা’য়ের ভিডিও দেখে আর রাজের সাথে জিনির বিয়ের কথা শুনে তুমি রাজি হয়েছ। কিন্তু আমার পিছনে এতকিছু চলেছে আমি তো জানতাম না।” সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রাজের দিকে। তারপর মহুয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। একপলক তার হাতের দিকে তাকিয়ে পরনের রিংটা দেখে৷ মৃদু হেসে মাথায় হাত রেখে বলল, “তোমার এই খাটাশ শশুড়আব্বা থাকতে কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। কেউ ক্ষতি করার চেষ্টা করলে তার আমার মুখোমুখি হতে হবে।”
সে এক গভীর নিশ্বাস ফেলে, “আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি জান্নাতের ইচ্ছা পূরণ করতে যেয়ে ভুলেই গেছে ওর সবচেয়ে বড় ইচ্ছা ছিলো তার ছেলে মেয়ের খুশি। আমি সত্যি ভাবিনি যে তোমরা নিজেরা এই সম্পর্ক নিয়ে এত গভীর। যখন জাহান একবার কথা বলাতে না বলে চলে গিয়েছিল তারপর একবার তোমাদের কথা চিন্তা করলেও যখন পরেরদিন এসে সে রাজি জানাল তখন ভেবেছিলাম যে সামান্য আবেগ মাত্র। ক’দিনে চল যাবে। কিন্তু আমার ছেলে যে তোমার জন্য নিজের সব খুশি , শান্তি বিসর্জন দিতে রাজি হয়ে যাবে নির্দ্বিধায় তা কখনো ভাবিনি। তোমাদের দুইজনকে দেখে নিজের অতীত মনে পড়ে গেল। তবে আমাদের গল্প তোমাকে শুনাল কে শুনি?”
মহুয়া তাকাল ডা. নাহিদের দিকে। জাহানের বাবা বলল, “ডাক্তার মানুষ কী আর গল্প বলতে জানে? বোরিং লেগেছে না?”
“অনেক বেশি।”
“তাহলে আমার ছেলেকে বিয়ে করে নেও আমি প্রতি রবিবার গল্প শুনাব।”
জাহান বিড়বিড় করে বলে, “ঠাডা মিথ্যা কথা। আমাদের জন্যই উনার সময় হয় না।”
মহুয়া কথাটা শুনে হাসে। তারপর বলে, “আসলে আমার ভাইয়া পাঁচ বছর আগে বিয়ে দিবে না। এর উপর আপনার ছেলের উপর ক্ষেপে আছে। ওর এনগেজমেন্ট এর কথা জানে। একারণে।”
“তুমি চাইলে আমি কথা বলে সব ভুল ধারণা দূর করতে পারি।”
“আপনি কেন বলবেন আংকেল? আমি আপনাকে মানিয়েছি তাহলে আপনার ছেলে আমার ভাইকে রাজি করাবে।”
মহুয়া তাকায় জাহানের দিকে। জাহান জোরপূর্বক হাসে। না চাইতেও বলে, “অফকোর্স।”
“তারপরও আমি ওকে বিয়ে করতে পাড়বো না।”
“কেন?” একসাথে প্রশ্ন করে বসে জাহান ও তার বাবা।
“ওয়েল আপনার ছেলে এখনো আমাকে প্রাপোজ করে নি।”
“একশোবার করেছি।” জাহান নিজের পক্ষ রেখে বলল।
“অফিসিয়ালি তো করো নি।” মহুয়া আফসোসের নিশ্বাস ফেলে জাহানের বাবার হাত ধরে বলে, “বুঝলেন শশুড়আব্বা আপনার ছেলে মোটেও আপনার মতো কিউট না।”
“আমি তো একটু আগে খাটাশ ছিলাম তাই না?”
“কি’যে বলেন শশুড়আব্বু আপনি কি কিউট। আপনার ছেলের থেকেও বেশি। তখন তো আবেগে মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে।”
জাহানের বাবা হাসলেন। তাকালেন জাহানের দিকে, “আমাদের ঘর তাহলে জলদি আগের মতো হয়ে যাবে না? যখন তোমার মা ছিলো তখনের মতো। সারাঘর হাসিতে মাতিয়ে থাকবে।”
জাহানের বুক চিরে বেরিয়ে এলো গভীর এক নিশ্বাস। এতদিন পর যেন সে এক শান্তির নিশ্বাস নিতে পেরেছে। সে অবশেষে একগাল হেসে সম্মতি দেয়।
“তো কীসের অপেক্ষা করছিস? কাম হেয়ার।”
“একটা মিনিট।”

জাহান মহুয়ার কাছে যাওয়ার আগে যায় রশ্মির সামনে। সে কাঁদছিল। জাহান তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকায় মহুয়ার দিকে। সে যা ভাবছিল মহুয়াও টের পেল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।
জাহান আবারও তাকাল রশ্মির দিকে। মৃদুস্বরে বলল, “রশ্মি…”
রশ্মি অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে তাকাল তার দিকে।
“রশ্মি তুই আমার সবচেয়ে প্রথম বন্ধু ছিলে। আমরা একই হাস্পাতালে জন্ম নেওয়া থেকে খেলার সাথী হয়েছিলাম। তোকে কখনো আমি বন্ধু থেকে বেশি কিছু ভেবে থাকলে বোন ভেবেছি। তোকে কখনো আমি সেভাবে দেখিই নি। তোর সাথে আমার বিয়েটা হলে আমার থেকে বেশি তুমি কষ্ট পেতি। তুই পেয়েও আমাকে কখনো পেতে পারবি না। আমার মনে তোর জন্য থাকতো কেবল ঘৃণা ও ক্ষোভ। তোকে কখনো ভালোবাসা তো দূরের কথা সম্মানও দিতে পারতাম না। আই এম সরি, এই ক’দিন তোর সাথে অনেক বাজে ব্যবহার করেছি। আমি ভেবেছিলাম তোর ভাইয়ের সাথে তুইও জড়িত আছো। মাফ করে দিস। আমরা কী এখন অপরিচিত হয়ে থাকতে পারি?”
রশ্মি তার দিকে তাকাল ছলছলে দৃষ্টিতে, “বন্ধু হয়েও না?”
জাহান মাথা নাড়ায়, “সেদিনের পর থেকে তোরর দিকে তাকাতেও আমার অস্বস্তি লাগে৷ তোর প্রতি আমার সে সম্মানটা আর আসে না। হয়তো অন্যকেও হলে মাফ করতে পারতাম। কিন্তু তুই সেদিন আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে আমার জন্য শেষ করে দিয়েছিলে। আমার প্রথম বন্ধু, প্রথম খেলার সাথী, আমার সিক্রেট কিপার, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, সব একসাথে শেষ হয়ে গেলি। এই কষ্ট, এই ক্ষোভ কখনো কাটিয়ে তুলতে পারবো না আমি। ছোট থেকে তোর ও জিনির সম্মান রক্ষা করা আমার দায়িত্ব ভেবেছিলাম। সে সম্মানটা আমিই তোকে আর কখনো দিতে পারবো না। তাহলে কীভাবে বন্ধুত্ব করবো বল?”
রশ্মি ঠোঁট উল্টে কাঁদোকাঁদো চোখে তাকাল তার দিকে। তারপর শাড়ি ধরে দৌড়ে স্টেজ থেকে নিচে নামলো। রাজ কতবার ডাকল তাকে। পিছনে তাকিয়ে জাহানকে দেখল অগ্নিদৃষ্টি। হুমকি দিয়ে বলল, “এর পরিণাম অনেক খারাপও হবে।”
বলে সে-ও গেল রশ্মির পিছনে।

জাহান মহুয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাত নেয় নিজের হাতে। হাঁটু গেড়ে বসে তার সামনে। মহুয়া মৃদুস্বরে বলে, “আরে কি করছ তখন মজা করছিলাম।”
জাহান তাকায় তার দিকে। তার চোখে।
“কিন্তু আমি এই মুহূর্তের অপেক্ষা করছি গত আটমাস ধরে৷ তোমার চোখে চাওয়া মানেই বিপদ, এই চোখে তাকিয়েই যে নিজের হৃদয়ে খোঁজ হারিয়েছিলাম। সে চোখে দেখলেই হারিয়ে ফেলি সব যুক্তিবুদ্ধি। সব অনুভূতিরা এলোমেলো হয়ে যায় আমার বুকের ভেতর। জানেমান তুমি কী জানো তোমার কাছে এই পৃথিবীর সবই মূল্যহীন। ইচ্ছা হয় তোমার প্রেমেই তো ডুবে থাকি সকাল-সন্ধান!”
বলে সে চুমু খায় মহুয়ার হাতের আনামিকা আঙুলে। মহুয়া দুষ্ট হাসে, “এই প্রেমে ডুবে থাকার জন্যও তোমার আমার ভাই থেকে পারমিশন নিতে হবে।”
“এভাবে কেবল রোমেন্টিক মুড নষ্ট করতে পারো।” জাহান আফসোসের নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। তার দুইগালে হাত রেখে তাকায় তার চোখের মাঝে, “আই লাভ ইউ।”
মহুয়ার হাসি তার চোখ পর্যন্ত পৌঁছায়। নিজ অজান্তেই চোখে ভরে যায় একটুখানি নোনাপানি। সে কাঁপানো সুরে বলে, “আই লাভ ইউ মোর, মাই লাভ।”
আরেকটু হাসতেই তার নরমগাল বেয়ে পড়ে জল। সাথে সাথে জাহান তাকে তার বুকে ভরে নেয়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে। মহুয়া কাঁপানো সুরে বলে, “আমি না দেখালেও ভেতরে অনেক ভয়ে ছিলাম। যদি সব ঠিক না হয়, তুমি আমার না হও?”
“চান্সই ছিলো না। ম’রে যেতাম, কিন্তু তোমাকে ছাড়া অন্যকাওকে বিয়ের কথা কল্পনাও করতাম না।”

জাহানের বাবা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তার এখন শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে সে সঠিক কিছু করেছে। সে জিনির কাঁধে হাত রাখল, “তোমার মা আজ থাকলে কত খুশি হতো তাই না? ওদের একদম মেড ফর ইচ আদার লাগছে।”
“না বাবা। মা মোটেও খুশি হতো না।”
জিনির কথায় তার বাবা জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায়।
জিনি তার হাত নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে বলে, “মা তো আমাদের তোমার দায়িত্বে দিয়ে গিয়েছিল। তুমি কী করলে? ঠিকাছে তুমি রাজের হুমকির কথা জানতে না। কিন্তু তুমিও ধোঁয়া তুলসি পাতা না। তুমি ভাইয়াকে মা’য়ের ভিডিও দেখিয়ে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করেছ, আমাকে রাজের সাথে বিয়ে দেওয়া নিয়ে ব্লাকমেইল করেছ? আমি তোমার মেয়ে বাবা। তুমি এমন মানুষের সাথে আমার বিয়ের কথা চিন্তাও কীভাবে করতে পারো?”
তার বাবা ঘাবড়ে যায়। একরাশ ভয় তাকে গ্রাস করে নেয়৷ সে বুঝতে পারে জিনি অনেক কষ্ট পেয়েছে তার এই কথায়। তাই সে জলদি করে নিজের পক্ষে কিছু বলতে চাইল, “আমি সে মুহূর্তে এমনেই…”
“কন্ঠ নিচে নামিয়ে কথা বলো। আমি চাই না এর জন্য ভাইয়া আর ভাবির মোমেন্ট নষ্ট হোক। তুমি যেভাবেই কথাটা বলেছ, বলেছ তো। আমি আর ভাইয়া কোনো পুতুল বা জিনিস না যেভাবে তুমি চাইবে সেভাবেই নাচবো। তোমাকে আমি আর ট্রাস্ট করতে পারবো না। আমি বিদেশে যেতে চাই। তোমরা যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছ তাদের থেকে বহুদূর। ভাইয়ার সামনে এই নিয়ে কোনো কথা বলবে না।” বলেই জিনি হঠাৎ তার মুখে হাসি এনে দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে জাহান ও মহুয়াকে।

শায়ান দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো স্টেজের দিকে। তার চোখজোড়া আবদ্ধ জাহান ও মহুয়ার উপর। তার হৃদয়টা মুচড়ে যাচ্ছে। কেমন ব্যাথা করছে। অদ্ভুত ধরনের কষ্ট লাগছে তার। কী বিষাদময় অনুভূতি!
হঠাৎ সে তার কাঁধে কারো স্পর্শ অনুভব করল। পাশে তাকিয়ে দেখল তার বাবাকে। তার বাবা এই প্রথম তার দিকে হেসে তাকালেন। বললেন, “তুমি ঠিক করেছ।”
শায়ান জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। কারণ সে অর্থ বুঝল না।
শায়ানের বাবা বললেন, “জোর করে তো আর ভালোবাসা হয় না। চাপিয়ে দিতে চাইলে দূরত্ব বাড়ে। আমার সাথে এমন হয়েছিল। তাই তুমি ঠিক করেছ। মাঝেমধ্যে না পাওয়াতেও শান্তি থাকে।”
মোটেও শায়ানের শান্তি লাগছিল না। এসব ত্যাগের কথা তার কাছে ফালতু মনে হয়। কিন্তু সে সময় বাবা তার চুলে হাত বুলায়। এখন শায়ানের বুকে শান্তি লাগছে, একটুখানি। তার বুকের কষ্ট কমলো কী? হয়তো, কমেছে।

জাহানের বাবার সাথে আরেকটু কথা বলে মহুয়া জাহানকে ধরল, “চলো, আমরা যাবো।”
“কোথায়?”
“এখানে সামনেই। অপেক্ষা করছে তিসান, জয়, আবিদ সবাই। আমাদের অপেক্ষা করছে। বেচারাগুলো গতকাল রাত থেকে এখানে। পৌঁছে যেয়ে মৃণা আর মোহকেও ডাকবো।”
“যো হুকুম মেডাম।”

জাহান তার বাইকের চাবি আনলো। তারা দুইজনে বাইকে করে রওনা দিলো। জাহানের বাসার একটু সামনেই এক রাস্তায় শুধু খাবার ও পোশাকের কতগুলো দোকান। বাইকে যেতে লাগলো পাঁচ মিনিট। সেখানে পৌঁছে মহুয়া ফোন দিলো তিসানকে। দেখলো রাস্তার অপরপাশেই আড্ডা জমিয়েছে তারা। মহুয়ার সাথে জাহানকে দেখে রাস্তার ওপাশ থেকেই হৈ হুল্লোড় শুরু করে দিলো।

সিগনালে রেড লাইট জ্বালানো অর্থাৎ গাড়ি চলাচল বন্ধ। সামনের গাড়িগুলোও দাঁড়িয়ে আছে সিগনাল পেয়ে। তাই সে এগোল। জাহানও বাইক পার্ক করে নামলো। তার একটু এক দুই হাত পিছেই ছিলো। মহুয়া মাঝ রাস্তায় এগোতেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা এগিয়ে এলো। স্পিড বাড়লো। হঠাৎ দ্রুত গতিতে ছুটে আসলো মহুয়ার দিকে।

মহুয়ার দৃষ্টি তিসানদের দিকে থাকলেও। জাহান আশেপাশে তাকাল। তখনই সামনের থেমে থাকা গাড়ি এগিয়ে আসতে দেখে তার মাইন্ড ব্লাঙ্ক হয়ে গেল এক মুহূর্তের জন্য। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে তার মা’য়ের মৃত্যুর দৃশ্যটি। সাথে সাথে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনে। মহুয়ার নাম চিৎকার বড় বড় পা ফেলে তার কাছে যায়। তাকায় গাড়ির দিকে। গাড়িটি একদম কাছে আসতেই চিনে নেয় ভেতরে বসা দু’টো মানুষকে। সে মহুয়ার বাহু ছুঁতেই নিয়েছিল। এর আগেই গাড়ির একটু ছোঁয়া লাগতেই সে ছিঁটকে পড়ে পাশের ফুটপাতে।

চলবে…