মেঘের খামে…
পর্ব ৬১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
রেড লাইটে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। রাজ ড্রাইভিং সিটে বসা। তার পাশেই বসে আছে রশ্মি। সে এখনো কাঁদছে। রাজ খানিকটা বিরক্তির স্বরে বলে, “এখানে কান্না করে কী লাভ? ওখানে তো তোর মুখ খুলে নি।”
“ভাইয়া তুমি এমনটা কীভাবে করতে পারো? জাহানকে তুমি মহুয়ার জানের হুমকি দিয়েছ? হাউ কুড ইউ?”
“শাট আপ। আমি সব তোর জন্যই করেছি। তুমি এভাবে প্রতিরাতে যেন জাহানের জন্য না কান্না করিস এজন্য।”
“তাই বলে তুমি কারো ক্ষতি করার কথা ভাববে? মানুষের জীবন কী এত সস্তা না’কি যে ইচ্ছা হলেই নিয়ে নিবে।”
রাজ ভীষণ বিরক্ত হচ্ছিল তার বোনের কথা শুনে। এমনিতেই তার মেজাজ আজ শীর্ষে উঠে আছে। কী অসম্মানই হলো তার। সবটা ওই মেয়ের জন্য। ওই মেয়েটা না আসলে সব তার পরিকল্পনা অনুযায়ী হতো। রাগে তার মাথার রগও ফরফর করছিল। লাল হয়ে ছিলো তার ফর্সা মুখশ্রী। এর উপর সে ‘আরও বিরক্ত হচ্ছিল তার বোনের কথা শুনে। তার বোনকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তার প্রথম সন্তান ভাবে নিজের বোনকে। কিন্তু মাঝেমধ্যে তার এমন কথাবার্তা শুনে ভীষণ রাগ উঠে তার।
সে রশ্মির থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল সামনে। তখনই সামনে দেখতে পেল তাদেরকে যাদের জন্য তার র’ক্ত টগবগ করে ফুটছে। এইমাত্র তার বোনের স্বপ্ন চুরমার করে, তার অপমান করে কী সুন্দর করে হেসে যাচ্ছে জাহান ও মহুয়া!
একটুখানি আফসোসও নেই তাদের মুখে।
বের হবার পর এমন হঠাৎ করে তার গাড়ির সামনে আসা। নিশ্চয়ই এটা নিয়তি!
হয়তো খোদাও তাদের পরিণতি লিখে রেখেছে রাজের হাতেই।
হঠাৎ সে গাড়ি স্টার্ট দিলে রশ্মি তাকায় ট্রাফিক লাইটের দিকে। এত জলদি সিগনাল পেয়ে গেছে? তখন দেখল ফুটপাতে থেকে রাস্তা পাড় হচ্ছে জাহান ও মহুয়া। সে আবার তাকাল তার ভাইয়ের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য তার মস্তিষ্ক কাজ করার বন্ধ করে দিলো। পরক্ষণেই তার ভাইয়ের মতলব বুঝলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে সে। রশ্মি তাৎক্ষণিক বলল, “ভাইয়া ডোন্ট। ভুলেও এমন টা করবে না। স্টপ ইট।”
রাজ উলটো গাড়ির স্পিড বাড়াল, বিশ, ত্রিশ থেকে আশি। রশ্মি হাত এগিয়ে ধরতে নিলো তাকে। যেন এতে কিছু হবে। কোনোভাবে আটকানো যাবে তার ভাইকে এত বড় পাপ করা থেকে। কিন্তু সে সময়টাও পায় না। সে দেখে গাড়িটা কাছে চলে গেছে তাদের। সে নিজের চোখের সামনে এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে দুইকানে হাত রেখে চিৎকার করে উঠে। চোখ খুলতেই দেখে তারা দুইটি নিস্তেজ শরীর পিছনে ফেলে রেখে গাড়ি এগিয়ে গেছে। সে পিছনে ফিরে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু সাহসে জোগাল না। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় রাজের দিকে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি। পৈশাচিক শান্তির হাসি।
রশ্মির মনে হলো তার নিশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে আজ পর্যন্ত সব সুখ, দুঃখ, কষ্ট সব জানাতো তার ভাইকে। অথচ আজ তার ভেতরে এমন জঘন্য অনুভূতি হচ্ছে অথচ তার ভয় লাগছে তার ভাই থেকে। ভয় লাগছে তার ভাইয়ের সামনে মুখও খুলতো। তার ইচ্ছা করছে গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে দেখে আসুক তার পিছনে ফেলে আসা দুইজনকে। তারা কী ঠিক আছে? অথচ একথা বলার সাহসও তার এলো না।
.
.
ফুটপাতের কাছে যেয়ে ছিটকে পড়ে জাহান। ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে নেয় সে হাতের বড় এক অংশ ছিঁলে র’ক্ত পরছে। পা’য়েও ব্যাথা পেয়েছে সামনে। তবে সে ব্যাথা অনুভবের পূর্বেই তার মহুয়ার কথা মনে পড়ে। চোখ খুলতে পেয়ে সবার আগেই দেখে সে রাস্তার পাশটা। স্থির হয়ে রইল সে। চোখ সরাতেও ভয় লাগছিল তার। সে কেবল মহুয়ার কন্ঠ শুনতে চাইল। আসলো না। তবে তিসানসহ তাদের বাকি ছোট ভাইদের কন্ঠ এলো। আতঙ্কিত কন্ঠ। কাঁধে এক হাতের ছোঁয়া পেয়ে সে তাকিয়ে দেখল জয়কে। তার পাশেই তার অন্যান্য সাথী।
“ভাই..ভাই আপনি ঠিক আছেন?”
জাহান উওর দিলো না। ভয়ে ভয়ে তাকাল সামনের দিকে। রাস্তার মাঝে লাল রঙা জামা পরনে মেয়েটি আশেপাশেও লাল রঙ ছড়িয়ে আছে। তার মাথা দিয়ে র’ক্ত পরছে। হাতের কতগুলো অংশ ছিঁলে গেছে। তার চোখ বন্ধ। তিসানরা এসে মহুয়ার পাশে বসে ডাকাডাকি করছে। জাহানের নিশ্বাস আটকে এলো। সে মুখ খুলে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল অপ্রাণ। তাও কষ্ট হলো।
জয় তাকে ধরে উঠানোর চেষ্টা করলেও সে হাত সরিয়ে নেয়। উঠে দাঁড়ায়। এক দৃষ্টিতে তাকায় থাকে মহুয়ার দিকে। খুঁড়িয়ে হেঁটে এগোয় সামনে। আশেপাশের গাড়ি থেকেও মানুষ নেমে ভীড় করে।
মহুয়ার সামনে যেতেই সে থপ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তিসানও সিক্ত দৃষ্টিতে তাকায় জাহানের দিকে। তার কোলে মহুয়ার মাথাটা দিয়ে বলে, “ভাই রাফিজ গাড়ি নিয়ে আনছে। ওর কিছু হবে না।”
জাহানের দৃষ্টি আটকে ছিলো মহুয়ার দিকে৷ তার ঠোঁট কাঁপলো। বলল, “আজ রাতের মধ্যে রাজকে ধরে নিয়ে আয়। ওকে আমার চাই।”
ব্যাস এতটুকুই বলল সে। তিসান বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “তাহলে কী এই এক্সিডেন্ট রাজ করিয়েছে?”
জাহান উওর দিলো না। সে মহুয়ার গালে হাত রেখে বলল, “জান দেখি উঠো। দেখো চোখ খুলো, নাহয় ভালো হবে না কিন্তু। জান উঠো না। আমি তোমাকে ধমক দিচ্ছি, তুমি রেগে যাবে না? বকা দিবে না আমাকে?”
জাহান তাকে শক্ত বুকে ভরে নেয়। তার চোখের পানি এসে পরছিল মহুয়ার কপালে। সে চাপা স্বরে বলে, “বকা দেও, ঝগড়া করো, তাও উঠো। প্লিজ উঠো।”
এতক্ষণে রাফিজ গাড়ি নিয়ে এসেছে। তিসান তাড়া দেয় জাহানকে, “দোস্ত জলদি কর। কাছের হাস্পাতালে নিয়ে যাই ওকে।”
জাহান সাথে সাথে তাকাল তার দিয়ে তাড়াহুড়ো করে তাকে কোলে তুলে গাড়িতে উঠালো। নিজের বুকেই ভরে রাখলো তাকে। জয় একটা রুমাল দিয়ে বলল, “ভাবির কপালে চেপে রাখেন যেন রক্ত না বের হয়।”
তিসান ফোন বের করে, “মহুয়ার পরিবারকেও জানানো দরকার।”
জাহানের আর কোনদিকে মন নেই। সে তাকিয়ে আছে মহুয়ার দিকে। সে ধীর কন্ঠে বলে, “আমি একারণে তোমাকে কিছু জানাই নি জান। তোমার থেকে দূরে তাও জীবন্ত লাশের মতো থাকতে পারবো, তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমাকে তুমি শাস্তি দিবে না বলো? আমাকে শাস্তি না দিয়ে তুমি এমন নিস্তেজভাবে শুয়ে থাকতে পারো না। উঠো প্লিজ।”
জয় ও তিসান একে অপরের দিকে তাকায় চিন্তিত দৃষ্টিতে। তিসান পরে ফোন দেয় মুরাদকে।
.
.
মুরাদদের হাস্পাতাল এসে পৌঁছাতে লাগে চল্লিশ মিনিট। তারা তিসানের কল পেয়েই দৌড়ে এসেছিল। মুরাদ, মৃণা মহুয়ার মা বাবা সবাই এসেছে। এক্সিডেন্টের কথা শুনে মৃণা ও মহুয়ার মা তো বাসা থেকেই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। এসেই মুরাদ তিসানকে জিজ্ঞেস করে, “মিষ্টি…মহুয়া কেমন আছে? কোথাও ও?”
“ভাইয়া ডাক্তার এখনো দেখছে। কতগুলো পরীক্ষা করেছে এতক্ষণ ধরে।”
মুরাদের নজর যায় সেখানে বসা জাহানের দিকে। হাঁটুতে কোণী রেখে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলো সে। সে রেগে ক্ষোভে যেয়ে তার কলার ধরে টেনে তুলে। চিৎকার করে উঠে, “তোমার জন্য। তোমার জন্য এসব হয়েছে তাই না? আমি বলেছিলাম ওর আশেপাশেও না আসতে। দুইজনের সাথে সম্পর্ক রাখতে লজ্জা করে না তোমার? তোমার জন্য আমার বোনের এই অবস্থা আজ।”
তিসান, মৃণা, জিনি সবাই এসে ধরে তাকে। কিন্তু জাহান কিছু বলে না। মুরাদকে ছাড়ালে আবার ধপ করে বসে পড়ে সে বেঞ্চে। জিনি মুরাদকে বলে, “ভাইয়া কোনো দুই সম্পর্কে ছিলো না। আমার ভাইয়া কেবল মহুয়া ভাবিকে ভালোবাসে। একমাত্র তাকেই ভালোবেসেছে। এই বিয়েতেও সে ভাবির জন্য রাজি হয়েছে।”
“সাট আপ। নিজের ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলা বন্ধ করো।”
“ও ঠিক বলছে।” মৃণা জানাল, “আপনি শান্ত হন। আমার সাথে আসুন। আমি আপনাকে সব বলছি।”
মৃণা একপাশে নিয়ে গেল তাকে। মহুয়ার মা বাবার কাছে। সবটা জানাল তাকে। রশ্মির কথা, রাজের হুমকির কথা। সে-ও সবটা জেনেছে সেদিন হাস্পাতালে। এসব শুনে মুরাদ তাকাল জাহানের দিকে। মৃণাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই সত্যি বলছিস?”
“একদম।”
সে দেখল তিসান জাহানের পাশে বসেছে। বলছে, “ভাই তোরও ড্রেসিং করিয়ে আসি চল।”
জাহান তার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিবে। তিসান ভড়কালো কিন্তু তবুও আবার বলল, “ইনফেকশন হয়ে যাবে পরে। ”
জাহান তবুও নড়লো না। জাহানের বাবা এলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। ডাক্তারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল সে। তাকে দেখতেই উঠে দাঁড়ায় জাহান। আতঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “ডাক্তার কী বলল? মহুয়া ঠিক আছে তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছে। ব্লাড লস হয় নি বেশি। কিন্তু ধারণা করছে পা’য়ে জোরে আঘাত লাঘায় ফ্রাকচার হতে পারে। এক্স-রে করতে নিবে। প্রথমে প্লাস্টার করে দেখবে, একমাস পর যদি লাগে তাহলে অপরেশন করতে হবে।”
মুরাদ দ্রুত আসে তার কাছে, “কোনো ঝুঁকি নেই তো?”
“আপনি?”
“মহুয়ার ভাই।”
“না, কোনো ঝুঁকি নেই। হঠাৎ মাথায় আঘাত লাগায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। অন্যসব ঠিক।”
মুরাদ শান্তির নিশ্বাস ফেলে। তারপর তাকায় জাহানের দিকে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “সরি আমি তখন না বুঝে তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছি। মৃণা সব বলল আমাকে। আমি এসবের ব্যাপারে জানতাম না। তাই তোমাকে দায়ী করছিলাম এক্সিডেন্টের জন্য।”
“আমি দায়ী ভাইয়া। আমার কারণেই এই এক্সিডেন্টটা হয়েছে। না আমি মহুয়াকে ভালোবাসতাম আর না আজ ওর এই অবস্থা হতো।”
“মহুয়া এইকথা শুনে অজ্ঞান অবস্থাতেও উঠে তোমাকে পেটাবে। তুমি যেয়ে ড্রেসিং করিয়ে আসো।”
“মহুয়ার সব রিপোর্ট আসুক। তারপর আমিও যাবো।”
সে সামনে থেকে মুরাদের কোনো কথা না শুনে বসে পরল চেয়ারে। মুরাদ তাকাল তিসানের দিকে, “একটা নার্স ডেকে ড্রেসিং করিয়ে নেও। বুঝলাম আমার বোন যেমন জেদি, ওর পছন্দ তো জেদি হবেই।”
মুরাদ একপলক জাহানের দিকে তাকিয়ে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, “আপনাকে চিনলাম না আংকেল।”
তারা পরিচিত হলো।
রাতেই মহুয়ার জ্ঞান ফিরেছিল। সবাই তাকে দেখে শান্তির নিশ্বাস ফেলে। ভোরের সময় ডাক্তার ডাকল মহুয়ার গার্জিয়ানকে। রিপোর্ট এসেছে তা জানানোর জন্য। মুরাদ গেল। আর সবাই বাহিরেই ছিলো। রুমে একজনের থাকার অনুমতি, মৃণা রইল।
মুরাদ ফিরে এলো প্রায় আধাঘন্টা পর। তার মুখটা থমথমে। এতক্ষণে থাকা স্বস্তিটা আর নেই। সে আসতেই তার বাবা প্রশ্ন করে, “কী বলেছে ডাক্তার? মহুয়া ঠিক হয়ে যাবে তো?”
মুরাদ চোখ নামিয়ে নেয়। তার বাবা আবারও জিজ্ঞেস করে, “কিছু বলছিস না কেন? সব ঠিক আছে তো?”
“ওর ফ্যাক…ফ্যাকচার হয়েছে ডান পা’য়ে। একমাস দেখবে প্লাস্টারে তারপর অপরেশন করবে।”
“একথা তো শুনিছি। তোকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?”
“হাতেও লেগে কিন্তু বেশি না ঠিক হয়ে যাবে।”
“এতটুকু তো?”
মুরাদ এক ঢোক গিলল, “বাবা পেটেও আঘাত লেগেছে। জরায়ুতে সমস্যা হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে ওর মা হতে সমস্যা হতে পারে। না হবার সম্ভাবনা বেশি।”
তার মা একথা শুনে ভড়কে গেল। সে মুরাদের সামনে এসে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল, “এ’কি বলছিস তুই? তুই মজা করছিস? এটা মজা করার জিনিস?”
“মা এমনি মহুয়া ঠিক আছে কিন্তু এই…”
“কত বড় ক্ষতি হয়েছে আমার মেয়ের তুই বুঝতে পারছিস না? সব ঠিক আছে কীভাবে? আমার মেয়ে মা হবে না? আল্লাহ কী হলো এটা? এখন আমার মেয়ের বিয়ে হবে কীভাবে? ওর ভবিষ্যত শেষ হয়ে গেছে আর তুই বলছিস ও ঠিক আছে?”
জাহান দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। এই কথা শুনে সে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। বলল, “আন্টি আমি এখানেই আছি।”
মহুয়ার মা তার দিকে তাকাল। জাহান পরিষ্কার গলায় বলল, “আপনার মেয়ের বিয়ে হবে কীভাবে মানে কী? যেখানে আপনি আমাকে নিজের চোখের সামনে দেখতে পারছেন। আমি নিশ্চয়ই অদৃশ্য নই।” জাহান স্বাভাবিক গলায় বলল কথাটি।
তখন তিসান তার পাশ থেকে বলে, “দোস্ত একটু বুঝেশুনে কথা বল। তোর একমাত্র স্বপ্নই ছিলো একটা সুখী পরিবারের।”
একথা শুনে মুরাদের চোয়াল শক্ত হয়। সে তাকায় জাহানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, “কারো দয়ার প্রয়োজন নেই। আমি আমার বোনকে সারাজীবনের জন্য দেখতে পারবো। এখানে এখন না থাকতে চাইলে যেতে পারো।”
জাহান সত্যিই এবার দ্বিধায় পড়ে যায়। বুঝতে পারে না একথার অর্থ। সে মুরাদের সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, “দয়া? আপনার বোনকে বিয়ে করে আমি ওর উপর দয়া করবো? উল্টো আপনি মহুয়ার সাথে আমাকে বিয়ে দিলে আমার উপর দয়া করবেন। কারণ ওকে না পেলে আমি কীভাবে বাঁচবো জানি না। এই কল্পনাও আসে নি আপনার বোনকে ভালোবাসার পর। আর ও তো সুস্থ আছে। যদি অসুস্থও থাকতো তারপরও আমি কেবল আপনার বোনকেই বিয়ে করলাম।” তারপর জাহান তাকায় মহুয়ার মা’য়ের দিকে। তার হাত ধরে বলে, “আন্টি আপনার মেয়ে একদম সুস্থ আছে। কেবল এই নিয়ে খুশি হন। অন্য সব ফালতু চিন্তা বাদ দিন।”
মহুয়ার মা আরও শক্ত করে ধরলো জাহানের হাত, “সত্যি তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে তো?”
“না করার কী আছে আন্টি? মহুয়া তো আর পরিবর্তন হয় নি। আমি যাকে ভালোবাসি সে-ই আছে। আর মেয়েদের বিয়ে কেবল বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য হয় না। আমার সারাজীবন কাটানোর জন্য কেবল আপনার মেয়েকে লাগবে। ও যদি বাচ্চা চায় তাহলে এই পৃথিবীতে অনেক এমন বাচ্চা আছে যাদের মা বাবা নেই। আমরাও তাদের মা বাবা হওয়ার সুযোগ পাবো। তাই না?” বলে মৃদু হাসে জাহান। সে তাকায় তার বাবার দিকে। তার বাবাও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন।
তার কথা শুনে মহুয়ার মা’ও শান্তির নিশ্বাস ফেলে।
মুরাদ জাহানকে দেখে মৃদু হাসে। মৃদুস্বরে বলে, “আমার বোনের পছন্দের উপর সন্দেহ করা উচিত হয় নি। সবচেয়ে মূল্যবান হীরা বাছাই করেছে।”
.
.
রশ্মি সারারাত ঘুমাতে পারে নি। গতকাল রাতের দৃশ্যটা সারাটারাত তার মাথায় ঘুরেছে আর সে আতঙ্কে কেঁপে উঠছে বারবার। তার ভাই বলেছে একদিনেই তারা এদেশ থেকে চলে যাবে। সব গুছাতে বলেছে জলদি করে। অথচ রশ্মি তার শাড়িটাও পালটায় নি। ভয়ে, আতঙ্কে তার কলিজা শুকিয়ে আসছে। তাই সে কল দিলো শায়ানকে। প্রথমে কল না ধরলেও, ধরার পর ঘুম ঘুম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “রশ্মি তুই এত সকাল সকাল কল দিলি যে?”
“তুই…তুই প্লিজ আসতে পারবি?” কথা বলতে যেয়েও নিশ্বাস আটকে এলো শায়ানের।
“তুই কাঁদছিস? আচ্ছা আমি আসছি।”
শায়ান এক ঘন্টায় এসে পৌঁছাল রশ্মির বাসায়৷ তার রুমে যেয়ে দেখে মেয়েটা এখনো কাঁদছে। তার খানিকটা অপরাধী অনুভব হলো। গতকালের পর নিশ্চয়ই মেয়েটা ভেঙে পরেছে। তার সাথে থাকা উচিত ছিলো। সে এসে বসলো রশ্মির পাশে। সাথে সাথে রশ্মি ঝাপটে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। শায়ানও তার মাথায় হাত বুলায়, “সরি রে আমার গতকাল তোর সাথে থাকা উচিত ছিলো আমার। আই এম সরি। আমি জানি গতকাল তোর অনেক খারাপ ভাবে মন ভেঙেছে কিন্তু কোনো মিথ্যা দিয়ে সম্পর্ক শুরু করা থেকে তো ভালো তাই না?”
রশ্মি তাকে ছেড়ে তাকায় তার দিকে, “জাহান…জাহানের জন্য কান্না করছি না। মানে ওর জন্য করছি কিন্তু…কিন্তু আমার অনেক ভয় লাগছে। ”
“ভয়? ভয় কীসের?”
রশ্মি ঢোক গিলল। তার চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট।
শায়ান আবারও প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে রশ্মি? আমাকে বল।”
“গতকাল… গতকাল ভাইয়া আমাকে নিয়ে বাসায় আসছিল। রাস্তায় জাহান আর মহুয়াকে দেখে সে জোরে গাড়ি চালিয়ে দেয়। এক্সিডেন্ট হয় তাদের। আমি অনেক আটকানোর চেষ্টা করেছিলাম পারিনি। আমি পিছনে ফিরে দেখেছি জাহানের তেমন ক্ষতি না হলেও মহুয়ার কথা জানি না। তুই একটু খোঁজ নিবি প্লিজ। মহুয়া ঠিক আছে কি-না!”
শায়ানের এক মুহূর্তের জন্য তার পৃথিবী থমকে গেছে। নিশ্বাস আটকে গেছে। সে অবাক হয়ে তাকাল রশ্মির দিকে, “কী…কী বললে তুমি? মহুয়ার কী হয়েছে?” সে দাঁড়িয়ে পরল হঠাৎ, “মহুয়ার একটা কিছু হলে তোর ভাইয়ের জীবন আমি হেল করে দিব।”
বলে সে বেরিয়ে পরল সাথে সাথে। রশ্মি সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে রইল। ঠিক কি হচ্ছে সে বুঝতে পাড়ল না। ঠিক কিছু মিনিটের মধ্যেই আবার এলো শায়ান। ক্ষোভের সুরেই জিজ্ঞেস করে, “তোর ভাই কই?”
রশ্মি শায়ানের ব্যবহারে এতটাই চমকে গেছে যে উওর দিতে পাড়ছে না। এর পূর্বে কখনো শায়ান তার সাথে এভাবে কথা বলে নি।
শায়ান এসে তার বাহু ধরে। শক্ত করে। রাগে তার নীলাভ চোখের আশপাশ লালচে হয়ে গেছে, “আমি জিজ্ঞেস করেছি তোর ভাই কই? সে ঘরে নেই।”
“ভা…ভাইয়া… রুমে…”
“রুমে নেই। কোথায়?”
“আমি… তো জানি না। তুই এভাবে ব্যবহার করছিস কেন আমার সাথে?”
“তোর ভাইয়ের কলিজা কত বড় আমিও দেখতে চাই। ওর সাহস হলো কী করে হলো মহুয়ার ক্ষতি করার? মহুয়ার কিছু হলে ওকে জিন্দা করব দিবো আমি।”
“শা…শায়ান তুই এমন করছিস কেন… আমার সাথে?”
শায়ান উওর দিলো না। সে রশ্মিকে ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
.
.
জাহান বসেছিল মহুয়ার পাশে। তার হাত ধরে নিজের গালে রেখে। গতরাত থেকে চিন্তায়, কান্নায় তার চোখ সম্পূর্ণ লালচে হয়ে আছে।
মহুয়া তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। প্রথমে শান্ত ভাবেই। ভোর থেকে সবাই এসে তার সাথে কথা বলেছে। জাহান এসেছে বহুবার কিন্তু কথা বলে নি একবারও।
“এই জানুমান, তোমার মুখে কি কেউ আঠা লাগিয়ে দিয়েছে?”
জাহান তার হাত শক্ত করে ধরে বাচ্চাদের মতো কান্না করে দিলো আসলেই। তার হাতে চুমু খেল গভীরভাবে। ভাঙা গলায় বলল, “আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তোমার কিছু হয়ে গেলে কীভাবে বাঁচতাম আমি?”
“তো তোমাকে বাঁচতে দিতাম না’কি? ভূত হয়েও তোমার ঘাড়ে চড়ে থাকতাম।”
“ভীষণ ব্যাথা করছে তাই না?”
“আরে না। ব্যাথাও মহুয়াকে ভয় পায়।”
“তোমার চিৎকার শুনেছি। যখন ডাক্তার তোমার পা নাড়ানোর চেষ্টা করছিল। তোমার চিৎকার শুনে আমার বুকে অনেক ব্যাথা করছে জান।”
“ঠিক হয়ে যাবো। আমার স্বপ্ন এখনো পূরণ করা বাকি আছে রিমেম্বার? আকাশে উড়ার।”
জাহান হেসে দেয়। মাথা নাড়ায়।
মহুয়া তার গালে রাখা হাত দিয়েই কাছে টানলো তাকে,
“সম্মতি দেওয়ার আগে বুঝে নিও। আমার স্বপ্ন তোমারই পূরণ করতে হবে।”
“শতবার করবো।”
“আকাশে উড়ার। পাখির মতোন।”
“হবে।”
“কীভাবে?”
“সে নাহলে আমার উপর ছেড়ে দেও। আমি বুঝে নিব।”
“এত ভালোবাসো আমাকে?”
“সন্দেহ আছে?”
“সন্দেহ তো আছে। আমার এমন অসম্ভব স্বপ্ন কীভাবে পূরণ করবে তুমি?”
জাহান হাসলো। তার কপালে আলতো করে চুমু খেল। আবার তাকাল তার দিকে। সিক্ত চোখে। বলল, “সএ দায়িত্ব আমার, মাই লাভ।”
সাথে সাথে দরজা খুলে ঢুকলো মোহ ও মৃণা। তাদের কাছাকাছি দেখে মোহ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। আর মৃণা পিছনে ফিরে গেল।
জাহান সাথে সাথে সরে গেল। লজ্জায় নিজের গাবলি চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “ঔষধ আনার কথা ছিল। তোমরা বসো আমি নিয়ে আসছি।”
জাহান যাওয়ার পর মোহ দৌড়ে এসে প্রথমে জড়িয়ে ধরল মহুয়াকে। মহুয়া তাকে ফেরত ধরার আগেই সে সরে গেল। ঠাস ঠাস করে কতগুলো চাটি মারল মহুয়ার কাঁধে। মহুয়া হা করে রইল। হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করে, “অসুস্থ ব্যক্তিকে থাপ্পড় মারতে তোর লজ্জা করে না?”
“মোটেও না। এই অবস্থায় না থাকলে লাথি দিয়ে তোকে বেড থেকে ফেলে দিতাম। তোরা দুইটা বেয়াদব, ফাজিল, শয়তানের চামচা, তোর এই অবস্থা অথচ কেউ আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করল না? মৃণা রাতে নাহলে ভুলে গেছে চিন্তায়, সকালে তুই না’কি মানা করেছিলি?”
“তুই তো দুইদিন আগে হাস্পাতালে ছিলি। দোস্ত একটা আইডিয়া আছে আমার কাছে।”
“প্লিজ আম্মা উল্টাপাল্টা বকিস না।”
“আরে শুন না। আমরা তো দেখি আজকাল দুইদিন পর পরই হাস্পাতালে আসছি। একটা হাস্পাতাল কিনে নেই চল।”
“তোর ব্যাংকে আছে কত?”
“সাতশো।”
“আমার কাছে চারহাজার আছে।”
দুইজনে তাকাল মৃণার দিকে। মৃণা সাথে সাথে উওর দিলো, “আমার কাছে দুইহাজার আছে। হবে?”
সাথে সাথে হেসে দিলো দুইজন। মোহ বলল, “আর ডাক্তার কী আমরা হবো। দুইদিনে পেসেন্টরা দৌঁড়ানি দিবে।”
তারা আবার হেসে দিলে মহুয়া হঠাৎ হাস্তে হাসতে কান্না শুরু করে দেয়। মোহ জিজ্ঞেস করে, “কাঁদছিস কেন?”
” ব্যাথা লাগে।”
তার কান্না দেখে মৃণাও কেঁদে দেয়। মোহ আবার তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কাঁদছিস কেন?”
“মহু কাঁদছে।”
“হলো। দুই পাগলের মধ্যে ফাঁসলাম।” তারপর মহুয়াকে জিজ্ঞেস করে, “বেশি ব্যাথা লাগছে পা’য়ে? ডাক্তার ডাকবো?”
“পা’য়ে না ব্যাথা লাগছে বুকে।”
“বুকে?”
“বলিস না। ওখানে দুইপাশেই খাবের দোকান। চারদিকে খাবারের ঘ্রাণ ম ম করছিল। অথচ খেতেপারি নি। কষ্ট লাগছে।”
“এসব ফালতু কথা বলার সময় পাচ্ছিস না তুই? পা’য়ে ব্যাথা করছে কি-না বল।”
মহুয়া আহ্লাদী চোখে তাকাল তার দিকে, “করছে।”
মৃণা বলে, “আমি ডাক্তার ডেকে আনছি। তুই ওর সাথে থাক।”
মোহ মহুয়াকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় হাত বুলায়। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠে। মা’য়ের কল। সে কেটে দেয়। আবারও দেয় সে৷ মোহ ভাবে মহুয়ার জন্য চিন্তা করছে তাই কল ধরল। প্রথমে জিজ্ঞেস করে, “মহুয়ার কী খবর এখন।”
“ব্যাথা আছে। তবে অন্য সমস্যা নেই। আলহামদুলিল্লাহ।”
“শুন, জামাই… সমুদ্র এসেছে। তোর কথা জিজ্ঞেস করায় মহুয়ার কথা বলে দিয়েছি। ও দেখতে আসতে চাচ্ছে।”
মোহ এই কথায় চুপ থাকে কিছুক্ষণ। তাকায় মহুয়ার দিকে। মহুয়া সবটাই শুনল। দুইজনে বসা পাশাপাশিই। বলল, “বলে দিস তাকে। বোন বলেছিল মুখে। এই অবস্থায় না আসলে আমি উল্টো রাগ করব। আর আসলেও আমার দুলুভাই মানছি না কিন্তু।”
মোহ হাসে। ফোনে ঠিকানা জানায়।
সমুদ্র এসে পৌঁছায় কিছুক্ষণের মধ্যেই। মোহ জানায়, “মহুয়ার ব্যাথা হচ্ছিল অনেক। ঔষধ দেওয়া হয়েছিল এখন ঘুমুচ্ছে।”
মোহ খেয়াল করে সমুদ্রকে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। ফরমাল পোশাক পরা ভীষণ এলোমেলো। চোখের নিচে কালি পরেছে গাঢ়। ঘুমে তার চোখ ছোট হয়ে গেছে। সে হাস্পাতাল থেকে বাসায় যাবার পরদিনও এসেছিল তার বাসায়। বাসার বাহিরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতো। সমুদ্রের মা বলেছিল সমুদ্র রাত জেগে কাজ করে অফিসে। মানে নিজের খেয়াল রাখে না। মোহের ভীষণ রাগ হয় তার এই অবস্থায়। সে ক্ষেপে যায়, “আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? নিজের খেয়াল রাখেন না? আপনি না’কি রাত জেগে অফিসে কাজ করেন। মানে ঘুমটুম নেই। আপনাকে আমি অফিসে কাজ করতে বলেছিলাম নিজের ঘুম হারাম করতে না। আপনি অফিস থেকে বাসায় যেয়ে না ঘুমিয়ে আমাদের বাসায় গিয়েছেন কেন?”
“যেয়ে জানতে পারবে।”
মোহ বিরক্ত হয় এই কথায়। জিজ্ঞেস করে, “কিছু খেয়েছেন?”
সমুদ্রের চুপিতেই উওর পেয়ে যায় সে। মোহ রাগে গভীর নিশ্বাস ফেলে। বলে, “বাহিরে কোনো ভালো খাবারের দোকান থাকলে বসবেন। আসুন।”
মোহ এগোতে নিলেই সমুদ্র তার হাত ধরে নেয়। মোহ জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
সমুদ্র তার হাতে একটি খাম দিয়ে বলে, “তোমার।”
“আমার? কী আমার?”
“অফিসে জয়েনের পর অবশেষে আমার ফার্স্ট প্রজেক্ট সেল করেছি। বড় প্রজেক্টটা না কিন্তু এটা আমার আবার স্বপ্ন দেখার প্রথম ধাপ।”
“আমাকে দিচ্ছেন কেন তাহলে?”
“তুমি আমার বউ।”
‘বউ’ শব্দটা শুনতেই বুকের ভেতরটা উষ্ণ হয়ে গেল আবার। সে তাকিয়ে ছিলো সমুদ্রের দিকে। চোখ নামাল। শাঁসালো নিজেকে। খামটা ফেরত দিতে চাইল, “এইটা আপনি রাখুন। আমার লাগবে না।”
“তোমাকে দিয়েছি কিন্তু এটা তোমার জন্য না।”
এবার মোহ অবাক হয়ে চাইলো সমুদ্রের দিকে। তার কথার অর্থ বুঝলো না, “মানে?”
“এই টাকা দিয়ে আমাদের দুই পরিবারের সবাইকে, তোমার ও আমার বন্ধুদের জন্য গিফট কিনে দিবে।”
“ওহ। আচ্ছা।”
“নিজের জন্য কিনবে না।”
এবার বিরক্ত হলো মোহ। সে না বললেও কিনতো না। এভাবে বলে কী সমুদ্র তার অপমান করতে চাইছে?
সে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় সমুদ্রের দিকে।
তবে সমুদ্র সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে তার হাত টেনে তাকে বসায় এক বেঞ্চে। জোর করে।
“কী করছেন আপনি?” মোহ জিজ্ঞেস করে, বিরক্ত গলায়।
সমুদ্র উওর দেয় না। তার সামনে বসে হাঁটু গেড়ে। নিজের পকেট থেকে বের করে একজোড়া রূপার নুপুর। তার এক’পা হাত দিয়ে তুলে রাখে নিজের হাঁটুর উপর।
মোহ ডোক গিলে। তার বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠে হঠাৎ। সে নরম চোখে তাকায় সমুদ্রের দিকে, “সবার আগে আমার জন্য এটা কিনেছেন?”
“উঁহু, তোমার জন্য এটা না।”
অবাক হয় মোহ, “তাহলে?”
“আমার জন্য। “আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় গান কী জানো মধু? তোমার নুপুরের শব্দ। তোমার নুপুর যখন ছনছন শব্দ করে তখন আমার পৃথিবীটা রঙিন হয়ে যায়। তোমার উপহারগুলো তোমার বাসায়।”
সমুদ্র নুপুর পরিয়ে আহত চোখে তাকায় মোহের দিকে, “তুমি কী আগের মতো নুপুর পরে আমার ঘরের প্রাণ হয়ে ফিরে আসবে মধু? এই শেষবারের মতো কী মাফ করা যায় না? আমার কাছে আবার ফিরে আসা যায় না?”
চলবে…
মেঘের খামে…
পর্ব ৬২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আশেপাশে কোনো শব্দ নেই। নীরবতা ছড়িয়ে আছে। রাজ নিজের মাথায় প্রচন্ড রকমের ব্যাথা অনুভব করে। সে নিজের মাথায় হাত রাখতে যেয়ে উপলব্ধি করে তার হাত পা বাঁধা। সে চিৎকার করলে একটা ছেলে এসে তার সামনে থাকা বিশাল দরজাটা খুলে দেয়। এসে লাইট জ্বালালে রাজ চোখ বন্ধ করে নেয়। হঠাৎ চোখে আলো পরায় সে সহ্য করতে পারে না। চোখ খুলে দেখতে পায় জাহানের সাথীকে, জয়কে।
তার সামনেই বিশাল এক প্রবেশপথ । এর থেকে উঁচু রুম। যেন দোতলা নিয়ে এই একটু রুম করা। কিছুটা দূরেই একটা স্টেজ। আশেপাশে প্লাস্টিকের চেয়ার একটার উপর একটা রাখা, খোলা টেবিল রাখা একপাশে। সামনেই কতগুলো বাঁশ। সে জয়কে দেখে হুমকির সুরে বলে, “দেখ আমাকে খুলে দে, নাহলে তোর জন্য ভালো হবে না।”
জয় তার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে চলে যেতে নেয়। ফোন বের করে কল দেয়। রাজ তখনও বলে, “বলতেছি ছেড়ে দেয় আমাকে। তোরা জানিস না আমি কে! আমার একটু আঁচও আসলে তোদের জীবন শেষ করে দিব।”
জয় তাকে পাত্তাই দেয় না। সে আর আবিদ দরজা বন্ধ করে দেয়। ওপাশ থেকে জাহানও কল ধরে, “ওই কুত্তা চিল্লাচ্ছে? মানে জ্ঞান ফিরেছে।”
“হ্যাঁ ভাই।”
“আমি আসছি।”
রাজ ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি করলে তারা স্পিকার এসে গান ছেড়ে উনো খেলতে বসে সবাই। জাহান ও তিসানের আসতে লাগে দেড়ঘন্টা। জাহান আসতেই জয় দরজা খুলে দেয়। রাজও এতক্ষণে হয়রান হয়ে চুপ করে গিয়েছে। তবে দরজা দিয়ে জাহানকে ঢুকতে দেখে আবারও তার ক্ষোভ উঠে যায়। আবারো হুমকি দিয়ে বসে, “জাহান তুই ভালো করছিস না। আমি কি করতে পারি তুই জানিস না। আমার সাথে শত্রুতা আমি করা তোর জন্য সুবিধার হবে না। ”
জাহান তাচ্ছিল্য হাসে। সে নিজের শার্টের হাতা বটিয়ে তার দিকে এগোতে এগোতে বলে, “বন্দী থেকেও বড় গলায় কথা? তোর কী মনে হয় আমি তোকে ভয় পাই? যে একটা ভয় ছিলো তা তো তুই নিজেই মিটিয়ে দিয়েছিস।”
জয় তাকে একটা ব্যাট এনে দিলো। জাহান সে ব্যাট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল, “যার জন্য আমি নিজের জীবন নষ্ট করতে রাজি হয়েছিলাম তার গা’য়ে চোট পৌঁছানোর আগেও তো তোর আত্না কাঁপা উচিত ছিলো। ওকে এত কষ্ট দিয়ে তুই কিভাবে ভাবলি আমি তোকে ছেড়ে দিবো।”
রাজের গলা শুকিয়ে এলো, “দেখ…জাহান আমরা কথা বলে এটা মিটমাট করে নিচ্ছি। আমার কিন্তু হলে আমার ফ্যামিলি, বিজনে পার্টনার, শায়ান কেউ তোকে ছাড়বে না।”
“মনে হয় আমি ভয় পেয়ে যাব? আমার একমাত্র দুর্বলতার উপরও আঘাত করলি? আমার বুকের সব ভয় ডর সে মুহূর্তেই শেষ।”
বলে ব্যাট জোরে মারে তার মাথায়। সাথে সাথে রাজের চেয়ার উল্টে পড়ে মেঝেতে। মাথা দিয়ে পিনপিনিয়ে রক্ত পড়ে। জয় এসে তার চেয়ার আবার উঠে বসায়। রাজ চিৎকার করে উঠে ব্যাথায়।
“এভাবে আমার মহুয়াও ব্যাথা পেয়েছিল। তোর থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছে।”
সে আবার ডাক সে, “তিসান।”
তিসান এগোয়, “বল।”
“রেকর্ড কর। এই চিৎকার শুনে যদিও মহুয়ার ব্যাথা কমবে না কিন্তু ওর অন্তর তো শান্তি পাবে।”
সে একের পর এক মারতে থাকে রাজকে আর সে চিৎকার করে উঠে।
হঠাৎ বাহিরে আরও শব্দ শোনা যায়। জাহানরা অবাক হয়। এ সময় তাদের ভার্সিটিতে কেউ আসে না। বিশেষ করে হল রুমের বাহিরে তো কেউই না। তারা দেখে শায়ান নিজের দলবল নিয়ে এসেছে। তাকে দেখেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল জাহানের। পার্টির পর মনে হয় তাকে জানিয়েছিল শায়ান তাকে পার্টিতে ঢুকাতে সাহায্য করেছে। সে ভেবেছিল, ছেলেটা ভালো হয়ে গেছে। অথচ আবারও তার কাজে বেগড়া দিতে এলো। ভারী বিরক্ত গলায় সে বলল, “দেখ শায়ান, তোর সাথে আমার কোন শত্রুতামি নেই। কিন্তু এই লোককে আমি ছাড়বো না। সো প্লিজ চলে যা, নাহলে তোরও এই অবস্থা করতে আমি দ্বিতীয়বার ভাববো না।”
শায়ান বাঁকা হাসে। ভেতরে ঢুকে বলে, “অবশ্যই শত্রুতা আছে। ছোট থেকে আছে। আমি আমার জীবনে যা চাই, তা আমি না পেলেও তুই পেয়ে যাস।”
“হোয়াট ননসেন্স। গেট আউট।”
“যেন তুই বললেই আমি চলে যাব।”
তিসানও এসে তার কাঁধে হাত রেখে আটকায় তাকে, “প্লিজ চলে যা। ওর জন্য আজ মহুয়ার অবস্থা অনেক খারাপ।”
শায়ান তাকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আবারও রাজের দিকে এগোয়। জাহানের দলের লোকেরা তাকে থামাতে এলে শায়ানের বন্ধুরা উল্টো তাদের আটকায়। এতে তাদের মধ্যে মারামারিও শুরু হয়ে যায় টুকটাক।
রাজ প্রায় জ্ঞান হারানোর অবস্থায়। সে শায়ানকে দেখে যেন আশার আলো পায়। নিভু নিভু চোখেও সে বহু কষ্টে বলো, “ব্রো তুমি এসেছ? আমি জানতাম রশ্মি তোমাকে পাঠাবে। আমাকে নিয়ে চলো এখান থেকে। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।”
“অফকোর্স ব্রো। এজন্যই তো আমি এসেছি।”
সে এসে দাঁড়ায় রাজের চেয়ারের সামনে। তার সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে বেশি কষ্ট দেয় নি এই জাহান?”
জাহানের মাথায় এমনেই রক্ত বুদবুদ করে উতড়াচ্ছে রাগে। এর মধ্যে এসব ফাজলামো তার মেজাজ আরও খারাপ করে দেয়। সে দ্রুত এসে শায়ানের কলার ধরে বলে, “গেট আউট রাইট নাউ। এই মুহূর্তে তুই ওকে বাঁচাতে আসলে তোকেও…”
সম্পূর্ণ কথা বলার আগে রুম কাঁপানো শব্দ শুনে জাহান স্তব্ধ হয়ে যায়। রাজের দিকে তাকিয়ে দেখে শায়ান তার বাঁধা হাতে একটা ছু’রি ঢুকিয়ে দিয়েছে। যা দেখে চমকে উঠে, কেবল জাহান না। সেখানে উপস্থিত সবাই। এমনকি শায়ানের দলের লোকেরাও।
চিৎকারে রাজের মুখে হা হয়ে গেছে বড় করে। তার চোখ দুটো বড়বড় করে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শায়ানের দিকে। শায়ান হেসে সে ছু’রিটি তুলে ছু’রিতে লাগা র’ক্ত রাজের সাদা শার্টেই পরিষ্কার করে। আর জাহানকে বলে, “কাওকে শাস্তি দিতে আজও ভালো করে পারিস না। ওকে হাজারোবার মা’রলেও এত কষ্ট পাবে না। এর উপর ওর থেকে বেশি তুই হয়রান হয়ে পরবি। যদিও তোর হয়রান হওয়াতে আমার কিছু আসে যায় না। আর যার ক্ষতি করে তার মতো তো শাস্তি দিবি। মহুয়ার মতো করে ওকে শাস্তি দেওয়া লাগবে তাই না?”
বলে সে রাজের হাঁটুতে ছু’রিটা ঢুকিয়ে মুচড়াতে। যতবার মুচড়ায় ততবার রাজের প্রাণ বের হয়ে যায় যেন। এত জোরে চিৎকার করে যেন কণ্ঠনালী ছিঁড়ে যাবে।
সে জাহানকে জিজ্ঞেস করে, “মহুয়ার পা ঠিক হয়ে কয়মাস লাগবে?”
জাহান উওর দেয় না। সে শায়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। সে তাকায় তিসানের দিকে, “কয়মাস লাগবে?”
“তুই…”
“যা জিজ্ঞেস করছি তা বল।”
“অপরেশন না করতে হলে একমাস। আর অপরেশন হলে ছয়মাস বা বেশি।”
শায়ান তাকায় রাজের দিকে। ভারী ইনোসেন্ট মুখ করে বলে, “এখন বেশি বলতে কত বেশি। বুঝতে পাড়ছি না। রাজ ভাই আপনি কী বারোবার আঘাতের আগে ম’রবেন না’কি? না, ম’রেন না। ম’রলে কষ্ট কমে যাবে।”
শায়ান একে একে তার পা’য়ে আটবার আঘাত করে। ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায় রাজ। শায়ান দাঁড়িয়ে ছু’রিটা দূরে ছেলে রুমাল দিয়ে নিজের হাতের র’ক্ত মুছে বলে, “শালাটার চিৎকারও মন মতো শুনতে পারলাম না।”
সে জাহানের সামনে যেয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “তোর কাজ সহজ করে দিলাম না? এর পরিবর্তে মহুয়ার সাথে দেখা করিয়ে দে।”
জাহান কপাল কুঁচকায় সে নিজের কাঁধের শায়ানের হাতের দিকে তাকায়। তারপর ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তার দৃষ্টি দেখেই অর্থ বুঝে নেয় শায়ান। সে হেসে বলে, “যা ভাবছিস তাই। আই লাভ হার।”
কথাটা কানে পৌঁছাতেই জাহান তার কলার শক্ত করে ধরে। এত জোর লাগিয়ে ধরে যে শায়ান দুই পা পিছিয়ে যায়। শায়ান হাসে তবুও, “এমন বিহেভ করছিস যেন আমি ওকে ছিনিয়ে নিয়েছি তোর থেকে। যদিও আমি আনন্দের সাথে এটা করতে রাজি। কিন্তু কী করার? ওর তোকে পছন্দ। চয়েজ খারাপ থাকলে যা হয় আরকি।”
জাহানের রাগ কমে। ঠিকই তো, যতজনই পছন্দ করুক মহুয়াকে। মহুয়া তো তার। একমাত্র তার। সে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় শায়ানকে। বলে, “আমার জীবনের সবই তোর পছন্দ হয়।”
“এমন কিছু না।”
“এমনটাই।”
“ওয়াটএভার, শেষদিন ও আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করেছে। সো আমি ওঁকে দেখতে পারি।” শায়ান বলল।
জাহান বিরক্ত হয় প্রচুর, “মহুয়াকে জিজ্ঞেস করবো। ও হ্যাঁ বললে, বাসায় গেলে দেখা করতে পারিস।”
“অফকোর্স তখনই যাবো। এই র’ক্তে মাখামাখি হয়ে তো যাব না। হ্যান্ডসাম তো লাগতে হবে না’কি?”
জাহান তার দিকে তাকায় দাঁত কামড়ে।
শায়ান দেখে সকলে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেদের মতভেদ, রাগ, ক্ষোভ সব ভুলে তার দিকে তাকিয়ে আছে বিস্মিত দৃষ্টিতে।
শায়ানের হঠাৎ কিছু মনে পড়ে। সে তাকায় জাহানের দিকে। বলে, “ভালো কথা, রশ্মি এসবের মধ্যে নেই। ওই আমাকে সব বলেছে। ওদিন আটকাতে চেয়েছিল এক্সিডেন্ট থেকে।”
জাহান গম্ভীরমুখে বলে, “জানি। ওর এমন কিছু করার সাহস নেই।”
জাহান তাকায় একপলক শায়ানের দিকে। সে দৃষ্টিতে আগের মতো বিতৃষ্ণা না থাকলেও খানিকটা বিরক্তি আছে। তবে শান্তিও হাসে একটা। সে বলে, “যদিও তুই ভালো হয়েছিস বলে আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু আজকের জন্য থ্যাংকস। ওর শাস্তি কঠিন হয় তা নিশ্চিত করতে আমার তোর সাহায্য লাগবে।”
“আমি নিজেই ওকে শাস্তি দিব। আর নিজের এই ভুল ধারণা পাশে রাখ যে আমি তোর হেল্প করছি। যা করছি মহুয়ার জন্য করছি। আমরা এখন অফিসিয়াল শত্রু। যুদ্ধের ময়দানে দুই বিরোধী দল কখনো বন্ধু হয় না। আমি এখনো মহুয়াকে পাওয়ার আশা ছাড়ি নি। এখনো পাঁচ বছর বাকি রাইট?”
শায়ান নিজের পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে পড়েই রওনা দেয় সেখান থেকে। জাহান তার যাওয়া দেখে কতক্ষণ বিরক্তি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও পরে হেসে দেয়।
জয় জিজ্ঞেস করে, “ভাই এর কী করব?”
জাহান তাকায় রাজের দিকে, “ডাক্টার এনে ক্ষত ট্রিট করাবি। জ্ঞান ফিরলে এই আঘাতের মধ্যে দ্বিগুণ আঘাত করবি। আমি আপাতত হাস্পাতালে যাচ্ছি। তোদের ভাবির কাছে যেতে হবে।”
“আমরা কবে দেখতে যাব? আমাদেরও অনেক চিন্তা হচ্ছে।”
“বাসায় গেলে মুরাদ ভাইয়াকে বলে ডাকবো তোদের। ও ঠিক সম্পূর্ণ হয়ে যাবে, চিন্তা করিস না।”
“চিন্তা করি না ভাই। আগেও করিনি। সবার এত ভালোবাসা রেখে ভাবি আমাদের ছেড়ে যাবে কই? আপনাকে ছেড়ে যাবে কই?”
.
.
হাস্পাতালে রাতে দুইজনের বেশি থাকা মানা। অথচ সেখানে থেকে যাওয়ার জন্য আলাদা ঝগড়া হয়েছে। সবার আগে হেরে গেছে মোহ। সে অসুস্থ বলে তাকে ধরে বেঁধে সবাই পাঠিয়ে দিয়েছে সবার আগে। মুরাদ বাসার সামনে দিয়ে গেছে।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পরেছিল৷ তার মা উঠে কেবল দরজা খুলে আবারও যেয়ে ঘুমিয়ে যায়। মোহ রুমে এসে দেখে বিছানায় কতগুলো বাক্স রাখা।
সে এসে প্রথম বক্স খুলে দেখল একটি কালো রঙের শাড়ি রাখা। এর পরের বক্সে আসমানী, পরেরটায় লাল। এমনভাবে সব রঙের শাড়ি রাখা। অন্য বড় বাক্সে কাজল, চুড়ি ও টিপ বিভিন্ন রঙের। হঠাৎ মোহের মনে পড়ে সমুদ্রের বলা কথা,
“তোমার জন্য শাড়ি কিনে আনবো অনেকগুলো। এখন থেকে আমি যেদিন ঘরে থাকবো আমার সামনে শাড়ি পরে ঘুরবে। কাজল দিবে, একটা ছোট টিপ দিবে, হাতে চুড়ি পরবে আর পা’য়ে নুপুরের শব্দে চারদিকে সুর তুলবে।”
কথাটা মনে পরতেই এক দীর্ঘ ভাবনা তাকে কাবু করে। সে হাত বুলিয়ে দেয় উপরে রাখা কালো শাড়িটায় আলতো করে।
.
.
পরেরদিনই মহুয়াকে বাসায় পাঠানো হয়। সাথে সবাই আসে তাদের বাসায়। মৃণা, মোহ, জাহান মহুয়ার সাথে গল্প করে কতক্ষণ। কিছুক্ষণের সন্ধ্যায় মৃণা নিচে আসে চা বানানোর জন্য। সাথে মোহও যায় তার সাহায্য করতে।
জাহান তার জন্য কমলা ছিঁলে খাইয়ে দিচ্ছিল। তখন দরজায় আসে শায়ান। তাকে দেখে জাহান বিরক্ত হয়।
অথচ শায়ান তো তার দিকে ধ্যানই দেয় না। একগুচ্ছ রেডরোজ এনে মহুয়াকে দিতে চাইলে জাহান কাঠ কাঠ গলায় বলে, “ওর ফুল পছন্দ না।”
মহুয়া আড়চোখে তাকায় জাহানের দিকে। শায়ানকে সে পছন্দ করে না ঠিক, কিন্তু ওদিন পার্টিতে হেল্প করেছে তা জানার পর তো খুশিই হয়েছিল শায়ানের উপর। তাহলে হঠাৎ কি হলো? বুঝতে চাইল মহুয়া।
শায়ানও বিরক্তি প্রকাশ করে, “ওকে ওকে আমি ফুল পড়া দেখেছি।”
“সেগুলো হয়তো আমি পরিয়ে দিয়েছি নাহলে আমার জন্য পরেছে।”
জাহানকে এমন অধিকার স্পষ্ট করতে দেখে মহুয়া বুঝল, জাহান জেনে গিয়েছে শায়ান তাকে পছন্দ করে।
মহুয়া অস্বস্তি পরিবেশটা দূর করতে বলল, “আরে তুমি এসেছ। এসেছ তাহলে আমার ক্রিমপাফকে নিয়ে আসতে।”
“পরেরবার নিয়ে আসবো।”
জাহান তো পরেরবার শুনে রেগে যায়, “পরেরবার মানে? আবার আসবে না’কি?”
“অফকোর্স। ওকে দেখতে আসবো না?”
“কোনো প্রয়োজন নেই। তোর বাসা থেকে ওর বিড়ালটা নিয়ে আসবো আমি।”
“এহ, বললেই আমি দিয়ে দিব আরকি।” সে আবার মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “প্রতিদিন ক্রিমপাফকে নিয়ে আসবো তোমার সাথে দেখা করানোর জন্য।”
জাহান সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যায়, “প্রতিদিন মানে? প্রতিদিন মানে কী?”
“সারাজীবন টপ করে প্রতিদিন মানে জানিস না? “শায়ান বিছানার পাশের টেবিলে ফুলের বুক-এ রেখে জাহানের টুল নিয়ে বসে পাশে। জাহান বিরক্ত হয়ে বলে, ” আমি বসেছিলাম এখানে?”
“তো? সারাজীবন আমার সব পছন্দের জিনিস তো নিলি। এখন একটা টুলও তোর লাগবে?”
জাহান দাঁতে দাঁত চেপে তার রাগ কমাল। বলল, “রাখ এই টুল। দয়া করে এই কথাটা বলা বন্ধ কর। কথাটা শুনেই আমার মাথা ব্যাথা করে।”
“তাহলে তো আরও দশগুণ বেশি বলবো।”
মহুয়ার দুজনে ঝগড়া তে মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। দুজনের উপর আরো চেতে বলে,”এই দুইজন বের হও তো। আমার ঝগড়া করতে অনেক ভালো লাগে, অন্যের ঝগড়া শুনতে ভালো লাগে না।”
শায়ান মহুয়ার দিকে তাকায় হাসিমুখে। গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “তুমি বলেছিলে না আমরা এখন থেকে ফ্রেন্ডস? তোমার সব বন্ধুরা এখানে। আমি আসতে পারি না?”
জাহান বসে মহুয়ার পাশে। উওর দেয় সে, “একদম না।”
শায়ান আহত চোখে তাকায় মহুয়ার দিকে। জাহান উল্টো বাচ্চাদের মতো তার চোখের উপর হাত রাখে যেন শায়ানকে সে দেখতেও না পায়।
মহুয়ার শরীর খারাপ থেকে বেশি এদের উপর বিরক্ত লাগলো।
.
.
বড় একটা প্রজেক্টে কাজ চলছে। আমেরিকার একটা কোম্পানি তাদের নতুন গেইম কিনার ইচ্ছা প্রকাশ করছে। দাম আর তাদের চাহিদা অনুযায়ী মিললেই তারা কিনে নিবে। এই নিয়ে মিটিং করেই রাত দুইটাইয় বাসায় ফিরলো সমুদ্র। এতদিন তো সে বাসায় আসেও নি। গতকাল মোহ তাকে বলেছিল প্রতিদিন বাসায় যেতে হবে। নিজের খেয়াল রাখতে হবে। তাই এসেছে সে, নাহলে এই কক্ষে আসতেই তার বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে উঠে।
নিজের রুমের দরজা খোলার আগেই বুকের ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আছে তার। হৃদপিণ্ডটা মুচড়িয়ে উঠে। রুমে ঢোকার পূর্বেই ভেতরটা শূন্য শূন্য লাগে। তবে দরজা খুলে রুমে ঢুকার পর আজ কিছুটা ভিন্ন মনে হয়। পরিচিত গ্রাম সারা রুমে ছড়িয়ে আছে। সমুদ্রের মনে হলো হ্যালেসিনেট করছ। না ঘুমাতে ঘুমাতে পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। মাঝেমধ্যে অফিসেও কাজ করতে যেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। হঠাৎ নুপুরের কন্ঠ ঘুমের মাঝেই তার কানে বেঁচে উঠত। সে আফসোসের নিশ্বাস ফেলে টাই খুলে বিছানায় রেখে শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে। হঠাৎ নুপুরের শব্দ বাড়ে। সমুদ্র থেমে যায়। সে তাকায় বারান্দার দিকে। বারান্দার বাতি জ্বালানো। সে থমকে যায়। দৌড়ে যেয়ে বারান্দার দরজা ঠেলে ঢুকতে দেখে মোহ কালো শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। আইস্ক্রিম খাচ্ছে।
সমুদ্র তাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ তাকেই রইল। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না তাই। হৃদপিণ্ডটা হঠাৎ কেমন লাফিয়ে উঠলো।
মোহ তাকে দেখে নিজের আইস্ক্রিমটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “আইস্ক্রিম?”
সমুদ্র তার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থেকে দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। শক্ত করে বুকের মাঝে ভরে নিলো। তার ভার হয়ে থাকা বুকটা হাল্কা লাগছে।
“ছাড়ুন নিশ্বাস আটকে আসছে আমার।” মোহ বলল।
তার কথা সমুদ্র তাকে ছাড়ল ঠিকই কিন্তু তার কপালে গভীর এক চুমু দিয়ে আবারও জড়িয়ে ধরল। অনেকক্ষণ ভরে।
“আইস্ক্রিমটা গলে যাচ্ছে৷ আপনার অপেক্ষায় পাঁচটা আইস্ক্রিম খাওয়া শেষ।”
সমুদ্র হাসে। তাকে ছেড়ে তার হাত ধরে আইস্ক্রিমে এক বাইট নিয়ে তাকায় তার দিকে। তার চোখে এক সাগর জল ঠেলে আসতে চাইল। সে আটকাল। তাকাল মোহের দিকে৷ ভেজা কন্ঠে প্রশ্ন করল, “তুমি আমার কাছে এসেছ মধু?”
মোহ মৃদু হাসে তার দিকে তাকিয়ে, “আপনার ঠোঁটে আইস্ক্রিম লেগে আছে।”
“বলো না, জ্বালিও না প্লিজ।”
মোহ কিছু বলল না। হাঁটু উঁচু করে টুপ করে মৃদু চুমু খেয়ে নিলো তার ঠোঁটে, “আইস্ক্রিম লেগে ছিলো।” বলে লজ্জামাখা মুখখানা নিয়ে তার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো। তবে সমুদ্র পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে। তাকে পিছন থেকে শক্ত করে ধরে তার কাঁধে নাক ডুবিয়ে বলে, “প্লিজ মধু আমাকে ছেড়ে যেও না।”
মোহ সরাসরি প্রশ্ন করে, “কেন ভালোবাসেন?”
সমুদ্র তাকে ছেড়ে ঘুরিয়ে মুখোমুখি হয়। বলে, “এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি তোমাকে ভালোবাসি। আর কখনো কোনো ভুল হবে না মধু। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না।”
“আজ আপনি আমায় এতকিছু দিলেন একটা জিনিস দিতে ভুলে গিয়েছেন।”
“কী?”
“আপনার উপর রাগ করে আমার মোহের সমুদ্রের ডায়েরিটা ফেলে দিয়েছিলাম। নতুন ডায়েরি লাগবে। আপনার আমার গল্প লিখবো। আবার নতুন করে।”
“মানে তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না?”
“ছেড়ে যেতে হলে তো আর আসতাম না।”
বলে জড়িয়ে ধরে সমুদ্রকে। তার বুকে মাথা রেখে শান্তিতে চোখ বুঝে নেয়। বলে, “আজ আপনার বুকে মাথা রেখে বহুদিন পর শান্তিতে ঘুমাব।”
সমুদ্র তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, “ঘুমানোর আগে আরেকটা কাজ আছে।”
“কী?” অবাক হয় মোহ।
“তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে।”
মোহ সাথে সাথে ছেড়ে দিলো সমুদ্রকে। অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে, “আপনি?”
“তোমাকে পাওয়ার সব রাস্তা যখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আল্লাহর কাছেই হাত পেতে চেয়েছিলাম তোমাকে। তার শুকরিয়া আদায় করা তো মাস্ট।”
কথাটা শুনে চোখে পানি এসে পরলো মোহের। সে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।
সমুদ্র তার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি স্মোকিং ছেড়ে দিয়েছি, আড্ডা বাদ দিয়েছি, অফিসে মন দিচ্ছি, নামাজ পড়ছি। এখন কী তোমার পার্ফেক্ট স্বামী হতে পারবো?”
মোহ সিক্ত চোখে মিষ্টি হাসে, “আরেকটা জিনিস ভুলে যাচ্ছেন।”
“কী?”
“আমাকে ভালোবাসা। এখন আমাকে ভালোবাসেন। জানেন আপনার প্রেমে কবে পড়েছি তা জানি না, কিন্তু বিয়ের প্রথমদিন থেকে আমার একটাই আকাঙ্খা, আপনি আমায় ভালোবাসবেন। আমার ভালোবাসায় ডুববেন।”
সমুদ্র একখানা চুমু খেল মোহের কপালে,
“সমুদ্র মোহেই ডুববে এটাই তো স্বাভাবিক তাই না?”
চলবে…