#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১৯
অফিসার মাহির বলা শুরু করল
“আমি মেঘের লাশ ইনভেস্টিগেশনে গিয়ে প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম এখানের খু/নটা তাদের পরিবারের মধ্যেই কেউ করেছে। কারণ এরকম হাজারো খু/নী দেখে আমি অভ্যস্ত। প্রতিটা মানুষের মধ্যে একটা ইতস্ততা ছিল। প্রতিটা মানুষের অঙ্গভঙ্গি সন্দেহজনক ছিল। প্রথম ধাপেই আমি খু/নীকে বের করে ফেলেছিলাম। জমশেদ সাহেবের এলোমেলো স্ট্যাটমেন্টে সব প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল। সে নিজেই স্বীকার করতে বাধ্য হয়ে গিয়েছিল। আমি সেটারেই সুযোগ নেই। আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল টাকার। স্ত্রীর অসুস্থতা, বাবার মৃত্যু, ছেলেটার অসুস্থতা আমাকে ভীষণ কাবু করে ফেলেছিল একটা সময়। এত এত টাকার জোগান আমি দিতে পারছিলাম না। নিজের সম্পত্তি বিক্রি করেছি। নিজেকে অনেক সৎ রাখার চেষ্টা করেছি। তবে প্রতিদানে পেয়েছি শুধু অপমান। সরকারকেও বলেছিলাম আমার সন্তানের চিকিৎসার জন্য সাহায্য করার জন্য। আমি সাহায্য পাইনি। আমার সাথে সরকার পক্ষের কিছু মামলা নিয়ে বিরোধ ছিল। আমি তো অনেক সৎ ছিলাম তাই সরকারকেও ছাড় দেইনি। ফলস্বরূপ একের পর এক বদলি আর মিথ্যা অপবাদ।
আমি হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমি আর পারছি না। আমার শরীর মন ভেঙে গিয়েছিল। বিনা চিকিৎসায় একমাত্র সন্তানের মৃত্যু আমাকে ভীষণভাবে কাঁদিয়েছিল। আমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য আমার স্ত্রী আমাকে দায়ী করে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কারণ তার আমাকেই দায়ী মনে হয়েছিল। কারণ এত বড়ো চাকুরি করেও আমার সন্তানের চিকিৎসা আমি করতে পারিনি। সব মিলিয়ে সততার প্রতিদানে আমি কেবল যন্ত্রণায় পেয়েছি।
সব হারিয়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার টাকার দরকার। টাকা ছাড়া দুনিয়ায় চলা মুশকিল। সততা বলতে কোনো শব্দ নেই। সব টাকার খেলা। আপনার টাকা আছে মানে আপনি দুনিয়ায় রাজা। আর আপনার টাকা নাই মানে আপনি দুনিয়ায় নর্দমার কীট। এরপর থেকে আমার জীবনে যত মামলা এসেছে আমি মিথ্যাটাকে জিতিয়ে দিয়েছি সত্যটাকে হারিয়ে দিয়েছি। কারণ সত্য বলার অপরাধে আমি যে শাস্তি পেয়েছি। আমি চেয়েছি অন্যরাও পাক। একা যন্ত্রণা আমি কেন ভোগ করব? সবাই ভোগর করুক। সততা বলতে কোনো অধ্যায় নাই। যা আছে সব শুধু বাণী। সততার বাণী দিয়ে দুনিয়া চলে না। অসৎ এ শহরে সৎ হয়ে টিকা যায় না। তেমনি আমি টিকতে পারিনি।
দেখুন আমি যখন সৎ ছিলাম তখন সবাই আমাকে ছেড়ে গিয়েছে। আর আমি যখন অসৎ হলাম। টাকার পাহাড় গড়লাম। তখন আমার স্ত্রী সন্তান শোক ভুলে আমার কাছে ফিরে আসলো। লাখ লাখ টাকার গন্ধ তাকে সন্তানের শোক ভুলিয়ে দিয়েছে। টাকার পাওয়ার অনেক। এ টাকা সকল সম্পর্ক ভুলিয়ে দিতে পারে। এ দুনিয়ায় সব টাকার খেলা। আমার স্ত্রীকে দেখলে এখন মনে হয় আমি পেরেছি টাকা দিয়ে সম্পর্কও কিনতে।
এখন আসি মূল প্রসঙ্গে। মেঘ আর বৃষ্টির কেইসে যখন জমশেদ সাহেব সব স্বীকার করে ফেলে। তখন আমি ছক কষি। মেঘের বাবার সাথে বসে একটা ডিল করি। মেঘের বাবার থেকে ১ কোটি টাকা নেই প্রথম ধাপে। পরে আরও নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। টাকা নিয়ে এ কেইসের নতুন গল্প সাজাই। যে গল্পে অপরাধী হবে নির্দোষ আর নির্দোষ হবে অপরাধী। এ কাজে আমার অনুসূচণা আসে না। কারণ আমি এখানেই নিজেকে শক্তিশালী মনে করি। আমার মধ্যে আরও কনফিডেন্ট কাজ করে।
এ গল্পে প্রথমে আমিই ময়নাতদন্ত রিপোর্ট মিরাজকে টাকা দিয়ে এইচ আই ভি পজিটিভ বানাই। যাতে করে ঐ পরিবারের উপর কোনো প্রেসার না পরে। প্রথম যদি আমি খু/ন বলতাম তাহলে পরিবারের মানুষের প্রতি একটু হলেও সন্দেহ আসত। এরপর আমিই বুদ্ধি করে তুরাগকে দিয়ে মামলা করাই। আর বৈশাখী তো মেঘের জন্য পাগল ছিল। তাই বৈশাখীকে দিয়ে বৃষ্টিকে হুমকি দেওয়ায়। কারণ এ অধ্যায়ে বৈশাখীর অধ্যায় টা জরুরি ছিল। সে অবশ্য এখানে নির্দোষ। কারণ সে এ পরিকল্পনার আগে পরে কিছুই জানত না। এখনও জানে না। তাকে শুধু টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছি। এটা বুঝিয়েছি বৈশাখীকে বিয়ের জন্য মেঘ বৃষ্টিকে ছেড়েছিল।
এরপর আমি আবারও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পরিবর্তনের নাটক করি। প্রথমদিকে আমি বৃষ্টির প্রতি একটা সহানুভূতি দেখাই যাতে করে আমার প্রতি কারও সন্দেহ না আসে। সবাই যেন ভাবে এ কেইসে আমি নির্দোষ এবং অপরাধীকে খোঁজার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি। আর সে অপরাধীকে খুঁজতে গিয়ে সেখানে বৃষ্টিকে ফাঁসিয়ে দেই।
এরপর প্ল্যান বি তে চলে যাই। বৃষ্টিকে জেলে মেরে দিয়ে জুলফিকার সাহেবকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করি। আমি চেয়েছিলাম বৃষ্টিকে টর্চার করে এমন একটা জবানবন্দি নিতে যেখানে বৃষ্টি নিজের মুখে বলবে সে জুলফিকার সাহেবের সাথে হাত মিলিয়ে মেঘকে খুন করেছে। আর এমনিতেও বৃষ্টি মানসিক ডিসঅর্ডারে ভুগছিল যেটা আমি ডাক্তার আবিরের মাধ্যমে জানতে পারি। সুতরাং বৃষ্টিকে ডিমোটিভেট করা কঠিন কিছু ছিল না।
পরিকল্পনাণুযায়ী বৃষ্টিকে জেলে খুন করিয়ে দোষ চাপাতাম জুলফিকার সাহেবের উপর। তখন জুলফিকার সাহেব চায়লেও বিষয়টি আর প্রমাণ করতে পারত না সে নির্দোষ। কারণ ততক্ষণে বৃষ্টি মৃত থাকত। আর বৃষ্টির এমন জবান বন্দির আশঙ্কায় তারা খুন করিয়েছে বলে চালিয়ে দিতাম। এতে জুলফিকার সাহেবও ফেঁসে যেত। মেঘের বাবার দুটো লাভ হত পথের কাটা মেঘ তো চলেই গেছে। সে সাথে তার অপছন্দের বৃষ্টিও দুনিয়ায় নেই। আর সবচেয়ে বেশি লাভ সিমপ্যাথি অর্জন করে জনগণের মন জয় করে ক্ষমতায় আসা। ক্ষমতা ভীষণ কড়া জিনিস। যাকে একবার এ লোভ ধরেছে সে জাত,পাত, আপন, পর ভুলে ক্ষমতার পেছনে ছুটেছে। ক্ষমতা সব কিছুকে তুচ্ছ করে দিতে পারে৷
সেদিন বৃষ্টির বন্ধু তুরাগ বৃষ্টিকে বের হতে দেখেছিল ঠিক। তবে খু/ন করে না। কিন্তু তুরাগ থানায় এসে এটা এমনিই বলতে এসেছিল। সে নিশ্চিত ছিল না খুন করেছে কি’না। তবে আমি তাকে বুঝিয়েছি ইন্দন দিয়েছি তাই সে মেঘের খুনী যেন বিচার পায় সেজন্য এ কাজ করেছে৷ তার মনে সততায় ছিল। আমি কেবল তার সততাকে কাজে লাগিয়েছি অসৎ কাজে। কারণ সততাতে আমি বিশ্বাসী না।
কিন্তু ব্যাগড়া ঘটল যখন বৃষ্টি পালিয়ে গেল। আমার সকল পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম হয়তো বৃষ্টি নিজেকে প্রমাণের জন্য কিছু একটা করবে। তাই নিজে সতর্ক থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম। বৃষ্টি নিখোঁজের পর থেকে প্রায়ই ঐ বাসায় যেতাম। আর কোনো সন্দেহজনক কিছু পেলে সেটা নষ্ট করে দিয়ে আসতাম।
আমি যখন শুনেছি আপনি ঐ বাসায় এসেছেন আমি বুঝতে পেরেছি আপনি এমনি এমনি আসেননি। কোনো কারণ অবশ্যই আছে। তবে আকরাম সাহবের কথা শুনে মনে হয়েছিল আপনি আপনার স্ত্রী সন্তানদের জন্য গিয়েছেন। তাই আকরাম সাহেবকে নাটকটা সাজাতে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম আপনি জুলফিকার সাহেবের প্রতি রুষ্ঠ হয়ে প্রতিশোধ পরায়ণ হবেন। তবে আপনি ভীষণ তীক্ষ্ণ মানুষ। আপনি ঠিকই সত্যিটা খুটিয়ে বের করলেন।
আপনার উপর আমার নজরদারি ছিল। কারণ আমি তো মেঘের ঘর ঐভাবে তদারকিই করিনি। যেখানে জেনে গিয়েছি খুনী কে? সেখানে ঘর সার্চ করা তো বোকামি। তবে আমি যখন বুঝতে পারি আপনি মেঘের ড্রয়ার থেকে নেশার দ্রব্যগুলো নিয়ে নিয়েছেন তখন মনে হলো এতে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই সেখানে গিয়েছিলাম আপনার গতিবিধি বুঝার জন্য। আর আপনার মটিভ চেন্জ করার জন্য বৃষ্টির সিসিটিভিটা আকরাম সাহেবের মাধ্যমে আপনার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। এতে যেন আপনার মনে হয় বৃষ্টিই মেঘকে খু/ন করেছে। আপাত দৃষ্টিতে আমরা অনেক কিছু দেখি যেটা সত্য না। তবে সত্যের মতোই দেখায়। তেমনি ঐ সিসি টিভি ফুটেজটাও দেখে মনে হবে বৃষ্টিই খু/ন করেছে। আর দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আমি ঐভাবেই তৈরী করেছি। যাতে বৃষ্টিই এ খু/ন করেছে প্রমাণ হয়৷
তবে শেষ রক্ষা আর হলো না। আপনার আগেই বৃষ্টি সবটা বুঝে গেল। সে তো খু/নের শাস্তি দিয়েই দিয়েছে। তবে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ আর থাকল না। আর আমি তো আর সাহায্য করব না তাকে নির্দোষ প্রমাণের। কারণ এতে আমিও ফেঁসে যাব। আমার একটায় দাবি থাকবে বৃষ্টিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এতগুলো খু/নের শাস্তি দেওয়া। যদিও সে নির্দোষ যা করেছে বদলা হিসেবে। তবে সে নিজেকে প্রমাণ করার কোনো উপায় রাখেনি। আর সততার মূল্য আমি কখনও দিব না। যে সততায় আমি কিছু পাইনি সে সততা কাউকে দিব না। সততার যন্ত্রণায় আমি সবাইকে পুড়াব।
সামির সাহেব অফিসার মাহিরের কথা শুনে হালকা হেসে বলল
“আপনাকে আর সাহায্য করতে হবে না। কোর্ট সঠিক সময়ে সবটা করে নিবে। বৃষ্টিকে হেফাজতে নিন। বাকিটা কোর্টে হবে। আর বৃষ্টি প্যাগন্যান্ট। ফাঁসির রায় হলেও বাচ্চা হওয়ার পর কার্যকর হবে৷ আর কোর্ট থেকেই আমি তাকে নির্দোষ প্রমাণ করব। তবে আইন হাতে তুলে নেওয়ার জন্য একটা সাধারণ শাস্তি তার হবে সেটা সইবার ক্ষমতা তার কাছে।
অফিসার মাহির বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সামির সাহেবকে বলল
” দেখে নিব। বাই।”
বৃষ্টিকে থানায় নেওয়া হয়। থানায় নেওয়ার একদিন পরেই তাকে কোর্টে চালান করা হলো। খুব দ্রূতই তার বিচার কার্যের জন্য কোর্টে হাজির করা হলো। বৃষ্টির পক্ষ থেকে সামির সাহেব আর ডাক্তার আবির এবং তার মা এসেছে। বৃষ্টির মা ভেঙে পড়েছে। সামির সাহেব মনে মনে ভাবলো এটা শুধু বৃষ্টির লড়াই না তার সাথে অফিসার মাহিরের সততার লড়াই। তাকে এটাই জিততেই হবে। সে অবশ্য অফিসার মাহিরের সকল কথা রেকর্ড করে রেখেছে। এতে বৃষ্টিকে নির্দোষ প্রমাণ করা সহজ হবে। তার শাস্তি কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করা যাবে।
তবে কোর্টে যখন ডাক্তার আবির, বৃষ্টির মা আর সামির সাহেব আসলো। তখন অফিসার মাহিরের কিছু কান্ড দেখে তারা নিজেই চমকে গেল। সে সাথে দ্বিধায় পড়ে গেল সত্যিই কী তারা সততার লড়াইয়ে হেরে যাবে?
#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২০
অফিসার মাহির নিজেকে বেশ ক্ষত বিক্ষত করে নিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে তাকে কেউ মেরেছে। তবে প্রথম দিকে এমন ভাবে আসার মানে সামির সাহেব বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে বুঝতে পারে কেন তিনি এমন করেছেন।
কাঠগড়ায় বৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে। অপর পাশেই অফিসার মাহির। মেঘের পরিবারের পক্ষ থেকে এসেছে এডভোকেট তরুন রায়। আর বৃষ্টির পক্ষ থেকে আনা হয়েছে এডভোকেট মুমুকে। তরুন রায় বেশ দক্ষ একজন এডভোকেট। এ পর্যন্ত তিনি কোনো কেইসে হারেননি। কোর্টে তরুন রায়ের বিপক্ষে লড়তে কেউ চায় না। কারণ সবাই জানে যে কেইসে তরুন রায় আছে সে কেইসে আর কেউ জিততে পারবে না৷ তবে মুমু এদিক থেকে আলাদা। সে নতুন হলেও নিজেকে বেশ দক্ষভাবে গড়ে তুলেছে। সে এটাতে বিশ্বাসী সত্যের জয় সর্বত্রই।
প্রথমেই তরুন রায় অফিসার মাহিরকে কাঠগড়ায় জিজ্ঞেস করল
“অফিসার মাহির দুটো ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আপনি। আপনিই বলুন মেঘের মৃত্যুর দিন কী ঘটেছিল আর যেদিন বৃষ্টি মেঘের পরিবারের প্রাণ নেয় সেদিন কী ঘটেছিল?”
অফিসার মাহির বেশ অসহায় গলায় বলল
“আমার আজকের এ অবস্থার জন্যও বৃষ্টি দায়ী। যেদিন মেঘ মারা যায় সেদিন সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট বুঝা যায় মেঘকে বৃষ্টি দেয়াল টপকে মেরে ৩০ মিনিট পর সে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। মেঘকে মারার একটায় কারণ ছিল মেঘ ওর সাথে বিয়ে ভেঙে দিয়ে বৈশাখীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল।
এরপর যখন আমি সবকিছু বুঝে তাকে আটক করি। তখন বৃষ্টি জেল থেকে পালায়। জেল থেকে পালিয়ে সে সামির সাহেবের বাসায় আশ্রয় নেয়। সামির সাহেবও চেয়েছিল বৃষ্টিকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। কারণ বৃষ্টির চরিত্র তো ভালো না। একই বাসায় একই রুমে থেকেছে। তাদের মাঝে কত কী হয়েছে সেটা আর কোর্টে খোলাখোলি বলে পরিবেশ নষ্ট না করি।
আর এদিকে আমাদের সামির সাহেব বৃষ্টির এ ফাঁদে পা দিয়ে তাকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। সে মেঘের ড্রয়ারে নেশার ঔষধ রেখে দেয়। সেখানে কৌশলে জমশেদ সাহেবের হাতের ছাপ মিশিয়ে দেয়। যাতে করে সে বুঝাতে পারে এ খুন মেঘের পরিবার করেছে৷
উন্মাদ চরিত্রহীন মেয়ের জন্য সামির সাহেবের মতো সরকারের এমন একজন কর্মচারী বিক্রি হয়ে যাবে ভাবলেই অশান্তি লাগে৷ তবে এখানে একটা কথা আমি খোলাসা করতে চাই। আমার প্রতিপক্ষ হয়তো বলতে পারেন মেঘ আকরাম সাহেবের সন্তান না। হ্যাঁ এটা ঠিক। তবে আকরাম সাহেব আর রেহনুমা রশীদ মেঘকে অনেক ভালোবেসে বড়ো করেছেন। সেটা আশেপাশে মেঘের চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষগুলোকে জিজ্ঞেস করলেই প্রমাণ মিলবে৷
যাইহোক প্রসঙ্গে আসি। এ বৃষ্টি মেয়েটা উন্মাদ। জেদের বশে সে সব করতে পারে। জেদের বশে সে মেঘকে খু/ন করেছে সে সাথে মেঘের পরিবারকেও খু/ন করেছে৷ সে বুঝতে পেরেছিল মেঘের পরিবার বেঁচে থাকলে তাকে জেলে পঁচে মরতে হবে। আর সে তো জেলে পঁচে মরবে না। তার কলিজা অনেক বড়ো। জেদের বশে একটা খুন করতে পেরেছে বাকিটাও করতে পারবে।
আর সে জেদ ধরেই সে আকরাম সাহেব, রেহনুমা রশীদ আর জমশেদ সাহেবকে খু/ন করেছে। ঘটনা স্থলের সাক্ষী সে বাসার কাজের মেয়ে সুরাইয়া। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখতে পারেন৷ সে সাথে সেখানের দারোয়ান যিনি আমাকে থানা থেকে নিয়ে গিয়েছেন। তাকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন৷ এবং আমি গিয়ে সেখানে যে ছুরি উদ্ধার করি সেখানে বৃষ্টির হাতের ছাপ স্পষ্ট।
মহামান্য আদালত বিষয়গুলো এখানেই থেমে গেলে পারত। তবে এখানে থেমে আর যায়নি। বৃষ্টি বুঝে গিয়েছিল আমি তাকে জেলে নিব। তাই রাগের বশে সে আমার উপর হামলা করে। আর আমাদের গুয়েন্দা বিভাগের সামির সাহেব তো বৃষ্টির প্রেমে অন্ধ হয়ে তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করে। আমাকে ক্ষত বিক্ষত করে আমাকে দিয়ে জাবানবন্দি নেয়। আর সেটা রেকর্ডও করে। আমি জানি কিছুক্ষণ পরে সেটা কোর্টে প্রকাশও করা হবে৷ তবে আমি জোর দিয়ে বলছি এটা আমাকে দিয়ে জোর করে বলানো হয়েছে। নিজের প্রাণের ভয়ে বলতে বাধ্য হয়েছি।
আমার সারা শরীরের আঘাতের চিন্হ দেখলেই সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে। আমার সাথে যে কয়জন কনস্টেবল ছিল তাদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন৷
অফিসার মাহিরের চতুরতা দেখে সামির সাহেব থমকে গেল। রেকর্ডিং আর কোনো কাজে আসবে না। সে এর মধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছে রেকর্ডিং টা সামির জোর করে করিয়েছে। তবে সে নিজেকে কতটা নীচে নামিয়েছে তাই ভাবছে সামির সাহেব। বৃষ্টি আর তাকে নিয়ে বলা কথাগুলো তাকে ভীষণ প্যানিকে ফেলে দিল। এদিকে তরুন রায় জজ কে বলে উঠল
“মহামান্য আদালত আপনি অফিসার মাহিরের মুখে সব শুনলেন এবং দেখলেন। এখানে নতুন করে আর কিছু প্রমাণ করার থাকে না। কাঠ গড়ায় দাঁড়ানো অফিসার মাহির নিজেও ভুক্তভুগী। শুধুমাত্র দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকেও এরকম ঝামেলায় পড়তে হলো। যোগ্য পুলিশ অফিসার এরকম হওয়ায় তো দরকার। তবে তার সাথে যা হয়েছে সেটাও অন্যায়, জুলুম।
অপরদিকে বিপরীত পাশে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো বৃষ্টি মেয়েটি চরিত্রহীন, জেদী, বেপারোয়া। মেঘ তার প্রেমে অন্ধ ছিল। তবে অন্ধত্ব কেটে গেল একটা সময়৷ তবে সে সময়টা ছিল ভুল সময়। বিয়ের দিন অন্ধত্ব কেটে গেলে সে সফলভাবে বিয়ে ভেঙে দেয়। সে বুঝতে পারে এ বৃষ্টি মেয়েটি তার জন্য পারফেক্ট না। আর বৃষ্টি মেঘকে ফাঁসিয়েছিল তার টাকা পয়সা আর যোগ্যতা দেখে। একটা সময় পর সেটা মেঘ বুঝতে পেরে নিজেকে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বৃষ্টি সেটা মানতে পারে না। তাই সে মেঘকে খুন করেছে ঠান্ডা মাথায়। এরপর জেদের বশে খুন করেছে মেঘের পুরো পরিবারকে। সে তো উন্মাদ হিংস্র এবং চরিত্রহীন।
পেছন থেকে এডভোকেট মুমু বলে উঠলেন
” এডভোকেট তরুন রায়। আপনার কোনো রাইট নেই আমার মক্কেলকে মিথ্যা দোষ দেওয়ার। এটা সত্য যে সে মেঘের পরিবারকে খুন করেছে। তবে মেঘকে খুন করেনি। একটা মেয়ে কোন পর্যায়ে গেলে এ কাজটা করে আদালতকে সেটা ভাবতে হবে, বুঝতে হবে। আর আপনার কোনো অধিকার নেই বৃষ্টিকে চরিত্রহীন বলার। কোর্টের মতো একটা সুশীল জায়গাকে এসব বলে অশ্লীল করে তুলা আপনার উচিত হয়নি। আপনি বৃষ্টি আর সামির সাহেবকে নিয়ে মনগড়া একটা তথ্য বানিয়ে উপস্থাপন করছেন৷ সামির সাহেবের মানহানী করছেন। এটা যুক্তিযুক্ত না। বৃষ্টির চরিত্র খারাপ সেটার প্রমাণ আছে? আছে কোনো মেডিকেল সার্টিফিকেট? যেখানে বলা হয়েছে সামির সাহেব এবং বৃষ্টির মাঝে শারিরীক সম্পর্ক হয়েছে? তাহলে প্রমাণ ছাড়া এতগুলো অপবাদ আপনি কী করে দিচ্ছেন?
আর এই যে অফিসার মাহির সাহেব আপনাকে আমরা কী করে বিশ্বাস করব? আপনার ডিপার্টমেন্টে এর আগে অনেকেই মোটা অঙ্কের ঘুষ খেয়ে স্ট্যাটমেন্ট চেন্জ করেছে। আপনি যে সে কাঁতারে না সেটা কী করে বিশ্বাস করি বলুন তো? সরকারি চাকুরি। বেতন আহামরি না৷ টাকার অভাবে ছেলে পর্যন্ত মারা যায়। সেই আপনি হঠাৎ কী এমন যক্ষের ধন পেলেন যে এত টাকার মালিক হলেন? শুনেছি আপনার বউয়ের নাকি রেডিসানের নাস্তা ছাড়া চলে না। বড়ো বড়ো ফাইভ স্টারে আপনার এবং আপনার বউয়ের যাতায়াত। আপনার বাড়ির ছোট্ট দালান কোঠা হঠাৎ করে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স কী করে হলো বলুন তো? আপনার মতো একজন অফিসারের কী করে ঢাকার বুকে ৭ টা বাড়ি হয়ে গেল অল্প সময়ে?
অফিসার মাহির আমতা আমতা করে জবাব দিল
“এগুলো সব আমার স্ত্রীর টাকা, তার বাবা মায়ের টাকা। তাই সে টাকা দিয়েই এগুলো করেছে। সব কিছু স্ত্রী আর তার বাবা মায়ের নামে। আমার তো কিছু নেই। আমি যা ইনকাম করি তা দিয়েই চলি।”।
এডভোকেট মুমু হেসে বললেন
” কোনো অফিসারেই নিজের নামে কিছু কেনে না। কেন কেনে সেটা নিশ্চয় আর নতুন করে বলতে হবে না। আপনি যে এখানে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলছেন সেটা প্রমাণ আমি করে দিব।”
এডভোকেট তরুন রায় মুমুকে উদ্দেশ্য করে বলল
“আপনারও কোনো রাইট নাই আমার মক্কেলকে ঘুষখোর বলে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার। আপনিই তো বললেন বৃষ্টি তিনটি খুন করেছে। তাহলে তো প্রমাণ হয়েই যায় সে খু/নী।”
এরপর তিনি জজকে উদ্দেশ্য করে বললেন
“মহামান্য আদালত বিপরীত পক্ষের উকিলও স্বীকার করেছেন বৃষ্টি তিনটি খু/ন করেছে। তাহলে এখানে প্রমাণ হয়েই যায় সে খু/নী। নতুন করে প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না। প্রমাণ অনুযায়ী আমি আপনার কাছে এ খু/নীর সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ফাঁসি চাই।”
এডভোকেট তরুন রায়ের কথায় ব্যাগড়া বসিয়ে মুমু আবারও বলল
“মহামান্য আদালত বৃষ্টি তিনটে খু/ন করেছে এটা প্রমাণ হয়েছে ঠিকই কিন্তু কেন খু/ন করেছে? খু/নের কারণ কী? সেটা বিবেচনা করা জরুরি। আর সে সাথে তিনটি খু/নের প্রমাণ হলেও মেঘের খু/নী কে সেটা প্রমাণ হয়নি। আমার মক্কেল বৃষ্টি তিনটি খু/ন স্বীকার করেছে। সে যদি মেঘকেও খু/ন করত স্বীকার করে নিত। এখন কী এ তিনটি খুন করেছে বলে আরেকটি খুনের ভার তার উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে? নিশ্চয় যাবে না। তাহলে কেন আরেকটি খুন কে করেছে সেটায় মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না৷ আমার মক্কেলের শাস্তির দাবিই করা হচ্ছে শুধু। অবশ্যই জানতে হবে মেঘের খু/নী কে? মেঘ কেন খু/ন হয়েছিল। নাহয় একজন আসামী তো খু/ন করেও বাইরে ঘুরাফেরা করবে৷ শাস্তি পাবে না। অবশ্যই মেঘের খু/নী কে? কারা খুনে জড়িত ছিল তাদেরও শাস্তি দেওয়া জরুরি৷ আমি কোর্টে আজকে সেটাই প্রমাণ করব কীভাবে মেঘ খু/ন হয়েছে আর বৃষ্টি কেন মেঘের পরিবারকে খুন করেছে। এরপর আপনি যা সিদ্ধান্ত নিবেন মেনে নিব।”
তরুন রায় মুমুর বিপরীতে বলে উঠল
“শুধু শুধু কোর্টের সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমি আপনাকে প্রমাণ করে দিব কাঠগড়ায় দাঁড়ানো বৃষ্টি মেঘকে খু/ন করেছে।”
এরপর তিনি বৃষ্টির কাছে গিয়ে বললেন
“বলুন আপনি মেঘকে খু/ন করেছেন কি’ না?”
বৃষ্টি প্রথমে স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিল না। এরপরও পাল্টা একই প্রশ্ন বারবার করা হলে বৃষ্টি উত্তেজিত হয়ে উত্তর দিল না,না।
এরপর যা ঘটল সেটা কেউ এই আশা করে নি।