#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৪
“বৃষ্টি… শুভ জন্মদিন। আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের বিয়ের পর এটা তোমার প্রথম জন্মদিন। বিয়ের হট্টগোলে নিজের জন্মদিনের কথা ভুলে গিয়েছো হয়তো। তাই একটু মনে করিয়ে দিলাম। সেই ১৭ বছরের মেয়েটা আজকে ২৯ এ পা দিবে৷ আমি আজও তোমার প্রথম চাহনি ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না তোমার তোতাপাখির মতো আওরানো প্রথম বুলিগুলো। পড়াশোনার চাপে কোনোদিকে তাকানোর সময় পেতাম না। হয়তো আশেপাশের কোনো কিছু আমাকে আকৃষ্ট করত না। কিন্তু সেদিন ঠিকই তোমার কথার টোন আমার কানে ভেসে আসে। ঢাকা মেডিকেলে করিডোরে বসে পাশে বসে থাকা রিদিতার সাথে তুমি অনবরত কথা বলে যাচ্ছিলে। চোখ সরানো যাচ্ছিল না তোমার থেকে। বুকের ভেতরটায় মনে হচ্ছিল কোনো উত্তাল ঝড় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল সব৷ ক্লাসের সময় হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ভাগ্য মেলেনি। আমার কাছে তুমি সেই ১৭ তেই আটকে আছো। দেখতে দেখতে আমাদের পরিচয়ের ১২ টা বছর পার হয়ে গেল। এক যুগের সহস্র সংমিশ্রণে আমরা আজকে একে অপরের পরিপূরক।
তোমাকে প্রথম দেখেই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলা, শব্দ করে হাসা এ দুটো জিনিস আমাকে বিমোহিত করেছিল । চোখের পলকে তুমি সেদিন হারিয়ে গেলে। প্রায় দুটো বছর তোমার চোখ দুটো আমার চোখে ভাসত। কাজল কালো চোখের প্রেমে নয় বরং কাজলহীন নীল চোখের প্রেমে পড়েছিলাম। তোমার চেহারার গঠন, চোখের বর্ণ সবমিলিয়ে ধরে নিয়েছিলাম তুমি হয়তো অন্য দেশের তাই তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। মিশরীয় বলে আন্দাজ করেছিলাম আমি। ভেবে নিয়েছিলাম কোনো মিশরীয়র প্রেমে আমি পড়েছি আমি। যে কি’না বাংলা ভাষাটা বাঙ্গালিদের মতো রপ্ত করেছিল।
কারণ টানা দুটো বছর তোমাকে আমি মনে মনে অনেক খুঁজেছি। কোথাও পাইনি। ব্যর্থ হয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তবে সৃষ্টিকর্তা সে আশা নিরাশ হতে দেননি।
যাকে আমি খুঁজে বেরিয়েছি প্রান্তরে প্রান্তরে সে আমার বাড়ির এত কাছে কে জানত? দুটো বছর পর তোমার দেখা পাই আমাদেরেই পুকুর পাড়ে। আর সে পুকুড় পাড়েই আমাদের প্রথম ভালোবাসার সূচণা ঘটে। সেখান থেকেই আজকের এ পরিণয়।
এ মুহূর্তে তোমার থেকে আমি ভীষণ দূরে এটাই ভাবছো এখন। বিয়ের রাতে স্বামী নিঁখোজ শব্দটা তোমাকে ভীষণ প্যারা দিচ্ছে তাই না? সকাল থেকে আমাকে কলে পাচ্ছ না। বাসার কেউ জানে না আমি কোথায়? আবার হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছো আমি নেই। দীর্ঘ একটা সময় আমাকে না পওয়ার আর্তনাদ আমার প্রতি কেবল তোমার ভালোবাসা বাড়িয়ে দিবে৷ আমি চাই তোমার ভালোবাসা পুড়ে পুড়ে খাটি হোক। সোনা পুড়ে যেভাবে খাটি করা হয়। সেভাবেই তোমার ভালোবাসাও পুড়ে খাটি হোক। তবে তোমাকে আমি খুব বেশিক্ষণ কষ্ট দিব না।
আমাদের এলাকায় হেমন্ত বাজারে চলে এসো। সেখানে নীলাম্বরী রেস্টুরেন্টে আসো। হ্যাঁ অবশ্যই নীল শাড়ি পরে আসবে। যে শাড়িটা আমি তোমাকে প্রথম উপহার দিয়েছিলাম সেটা।
চোখ দিয়ে নিশ্চয় পানি পড়তেছে তোমার? চোখের পানি মুছে দ্রূত চলে আসো তো আমার হুররাম।”
আমার চোখ দিয়ে সত্যিই তখন পানি পড়ছিল। মনে হচ্ছিল মেঘ বেঁচে আছে। এ সবকিছুই মেঘ আমার ভালোবাসার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য করেছে। সে চেয়েছিল আমাকে সারপ্রাইজ দিতে। এটা ভেবেই হালকা অভিমান এসে আমাকে ঘিরে ধরল। অভিমানের সুরে তাকে কিছু বলতে যাব সে মুহুর্তেই কানে ধেয়ে আসলো মেয়েলী কণ্ঠস্বর।
“ভয়েজ কলটি শেষ হয়েছে। সময়ের অভাবে প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা দিতে ভুলে যাচ্ছেন? এ নিয়ে সমস্যায় পড়ছেন? তাহলে সে সমস্যার সমাধান হিসেবে আপনারা বেছে নিন আমাদের ভয়েজ টিউন সার্ভিসটি। *২৯৯# এ ডায়াল করে নিজের ভয়েজটি রেকর্ড করুন। তারপর ভয়েজটি শেষ করে সেটিং অপশনে গিয়ে ডেইট এবং টাইম টি লিখে সেট করুন৷ আপনার দেওয়া ভয়েজটি সময় মতোই আপনার প্রিয়জনের কাছে আমরা পৌঁছে দিব। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।”
আমি এবার বুঝতে পারলাম এটা কেবল একটা রেকর্ড কল ছিল। যেটা মেঘ বিয়ের আগেই সেট করে রেখেছিল। আমার জন্মদিনের খুশিটা বাড়িয়ে দিতেই এত কিছু সে আয়োজন করে রেখেছিল। আমি এক দন্ডও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না।
সোজা বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। পেছন থেকে মা জিজ্ঞেস করছে কোথায় যাচ্ছি। আমি মায়ের এ ডাক উপেক্ষা করে বের হয়ে গেলাম। বাইরে শীতল বাতাস, মেঘের গর্জনে চারপাশটা অস্থির হয়ে আছে। আজকে প্রকৃতিও শান্ত হওয়ার জন্য এক পশলা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছে।
কোথাও কোনো রিকশা নেই। অনেক দূর থেকে একটা রিকশা দেখা যাচ্ছে। রাস্তার বালি চারপাশে তুলোর মতো উড়ছে। দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলা হেঁটে যাচ্ছে। আমার দিকে কিছুটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তারা নিজেদের মধ্যেই কথা বলছে৷ তাদের কথার কেন্দ্রবিন্দু হলো আমার বিয়ে ভেঙে গেছে। আর বিয়ের ভেঙে যাওয়ার রাতেই হবু স্বামী আত্মহত্যা করেছে।
তারা আমার চিরিত্র বিশ্লেষণ করছে আবার ভাগ্যও নির্ধারণ করছে। তাদের এ কথা কেন জানি না আমাকে খুব বেশি আঘাত করতে পারছে না। অথচ বিয়েতে রাজি হতাম না বলে কত মানুষ কত ঠুনকো কথা বলত। সে কথাগুলো শুনে কত রাত কেঁদেছি সে হিসেবের ঝুলি মিলানো বড়ো দায়। ভাবতে ভাবতেই রিকশাটা চলে আসলো সন্নিকটে। আমি তাকে দাঁড় করিয়ে বললাম আমাকে যেন নীলাম্বরী রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। এই বলেই রিকশায় উঠে গেলাম আমি।
আমাদের বাসা থেকে নীলাম্বরী রেস্টুরেন্টে রিকশায় যেতেও ৩০ মিনিটের মতো সময় লাগে৷ রিকশাটা চলছে। চারপাশে বাতাসের গতিবেগ ঝড়ের আগাম বার্তা নিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এখন বড়ো একটা ঝড় হবে৷ একটা আচমকা ঝড় যেভাবে আমার মনটাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে ঠিক সেভাবেই এ ঝড়টাও সবকিছু লন্ডভন্ড করে যাবে এমনটায় মনে হচ্ছে।
রিকশা বেশ গতিতে চলছে। তবুও মনে হচ্ছে রিকশা যেন চলছে না। সময় যেন পার হচ্ছে না। আমি অস্থির গলায় বলতে লাগলাম
“মামা রিকশাটা জোরে চালান একটু। এত আস্তে চললে তো সময়ের আগে পৌঁছাতে পারব না।”
রিকশা ওয়ালা আমার অস্থিরতায় ভীষণ বিরক্ত প্রকাশ করছে। মুখের অবয়ব সেটা প্রকাশ করলেও তিনি কিছু বলছেন না। কেবল চুপ হয়ে শুনে যাচ্ছিলেন।
এদিকে আমার অস্থিরতা বাড়তেছে। হার্টবিটটা দ্বিগুণ গতিতে চলছে। দম নিতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ঘনঘন দম নিচ্ছি আমি। চোখ বন্ধ করে আমি কেবল মেঘের মুখটায় কল্পনা করছি। এমন সময় রিকশা ওয়ালা মামা ডেকে বললেন
“চলে আসছি নীলাম্বরীতে। আমার ভাড়াটা দিন। মেঘ, বাদলের দিন নিয়া আইছি। ২০ টা টাকা বাড়াইয়া দিন। ৮০ টাকা ভাড়া। আপনি আমারে ১০০ টাকা দিবেন৷ ”
রিকশাওয়ালা মামার কথা শুনে আমি লক্ষ্য করলাম কোনো টাকায় আমি সাথে নিয়ে আসিনি। আমি বেশ নম্র গলায় তাকে বললাম
“মামা তাড়াহুড়োতে বাসা থেকে টাকা নিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছি। আপনি এখানেই দাঁড়ান আমি আবার বাসায় যাব। আমাকে নিয়ে যাইয়েন। তখন বাসা থেকে টাকা নিয়ে আপনাকে পুষিয়ে দিব।”
রিকশাওয়ালা মামা আমার দিকে বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বললেন
“টাকা নাই তো রিকশায় উঠেছেন কেন? আমি আর আপনারে নিয়ে যেতে পারুম না৷ আমার কাজ আছে। এভাবে গরীবের হক মাইরা খাইয়েন না। রিকশায় উঠে পাগল হইয়া গেছিলেন। এভাবে পাগল হলে জীবনে কিছু পাবেন না। আমার হক মাইরা বড়োলোক হইয়া যাবেন না।”
কথাগুলো জোরে চিল্লাতে চিল্লাতে বলে তিনি রিকশা নিয়ে চলে গেলেন। আমি চুপ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। সবকিছু খারাপ ঘটতে ঘটতে এ বিষয়টাও ভীষণ স্বাভাবিক লাগছে৷ অভিশপ্ত এ সময়ে অভিশাপটা আমাকে আর নাড়া দেয়নি৷
স্থিরতা কাটিয়ে নীলাম্বরী রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলাম। সেখানে ঢুকতেই একটা কল আসলো আমার ফোনে। আমি কলটা রিসিভ করে খেয়াল করলাম অফিসার মাহির কল দিয়েছেন।
আমি হ্যালো বলতেই তিনি অনর্গল কিছু কথা বলে যাচ্ছেন। তার কথা শুনার পর আমার চোখে ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল৷ আমার নিঃশ্বাস পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। আমি চোখ ঠোঁট নাড়িয়ে বলতে লাগলাম এত সাসপেন্স তো আমি জীবনে চাইনি। ঠিক সে সময় আমি লক্ষ্য করলাম রেস্টুরেন্টের এক কোণে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। আমি মেঘকে ডাকতে নিয়েও পারছিলাম না। আমার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল। এরপর কী থেকে হলো কিছু বুঝলাম না।
যখন চোখ খুললাম….
শারমিন আক্তার
শারমিন নিপা