মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব-০৫

0
2

#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫

যখন আমি চোখ খুললাম তখন আমি খেয়াল করলাম আমি হাসপাতালে ভর্তি। তিনদিন যাবত আমার জ্ঞান নেই।”

কথাগুলো বলে বৃষ্টি থেমে গেল। কিছুটা আনমনা হয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। পাশেই ডাক্তার আবির বসা। তিনদিন ধরে বৃষ্টির কাউন্সিলিং করছে সে। বৃষ্টির অবস্থা একটু খারাপ। অজ্ঞান হওয়ায় তিনদিন পর তার জ্ঞান ফিরে। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই পাগলের মতো কাঁদত। মেঘ মেঘ বলে চিৎকার করত। অবস্থার অবনতি হতে লাগল দিনকে দিন। আজ ৯ দিন যাবত সে এ হাসপাতালে ভর্তি। মানসিক অবস্থার অবনতির জন্যই মূলত এরকম করছিল সে। মেঘের মৃত্যুটা সে মানতে পারেনি। তাই মানসিক ভাবে সুস্থ করার জন্যই ডাক্তার আবিরকে এসাইন করা হয়। ডাক্তার আবির টানা তিনদিন বৃষ্টির কাউন্সিলিং করছে। প্রথম দিকে বৃষ্টিকে কিছু বললে সে উত্তর দিত না৷ শুধু চিৎকার করে কাঁদত। আজকে তৃতীয় দিনে সে মন খুলে এতগুলো কথা বলেছে। ডাক্তার আবীর বৃষ্টিকে মোলায়েম কণ্ঠে ডাক দিয়ে বলল

“মিস বৃষ্টি আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? তাহলে আজ আমি উঠি। কাল নাহয় বাকি ঘটনা বলবেন। তবে আপনি রেস্টুরেন্টে ঝাঁপসা চোখে যে মেঘকে দেখেছিলেন সেটা মেঘের বড়ো ছবি ছিল। আপনাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য মেঘ তার আর আপনার ছবি একসাথে রেখেছিল। তবে শেষ মুহুর্তে আপনি মেঘকে নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন তাই মেঘের ছবিটায় আপনার দৃষ্টি আবদ্ধ করতে পারছিল বাকিগুলো পারে নি। আর একটা প্রশ্ন জানার আগ্রহ বেড়ে গেল৷ অফিসার মাহির আপনাকে কী বলেছিল?”

বৃষ্টি আবিরের প্রশ্নে হুহু করে কেঁদে উঠল আবার। আবির বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে নম্রতার সহিত বলল

“থাক বলা লাগবে না। আজকে তাহলে উঠি৷ কাল দেখা হবে। ”

বৃষ্টির কান্নার গতি বাড়তে লাগল। আবির ভীষণ বিব্রতকর একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। স্বাভাবিকভাবে সে কোনো পেশেন্টকে পাল্টা প্রশ্ন করে না। কারণ এতে পেশেন্টের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে এত থ্রিল যে, সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলস্বরূপ বৃষ্টির কান্নার গতি বেড়ে গেল। বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতেই বলল

“মেঘ এইচ আই ভি পজিটিভ ছিল। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তাই বলেছে। এটা সে জানতে পারে বিয়ের দিন। আর সেজন্যই সে বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছিল। পুলিশ জানায় মেঘ একজন ডোনার থেকে রক্ত গ্রহণ করে আর সে রক্তের মধ্যে এইচ আই ভি পজিটিভ থাকায় তার শরীরে প্রবেশ করে। কিন্তু এখানেও একটা কিন্তু থেকে যায়। যদি মেঘ এইচ আই ভি পজিটিভ হয় তাহলে তো আমারও হওয়ার কথা। জ্ঞান ফোর পর আমিও টেস্ট করি। একবার না দুইবার। আর দুইবার টেস্টেই আমার নেগেটিভ আসে৷ মেঘ রক্ত নিয়েছিল ২ মাস আগে। একটা এক্সিডেন্টে তার পা কেটে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সেজন্য ইমারজেন্সি তাকে ব্লাড দেওয়া হয়। এরপর আর সে ব্লাড দেয়নি। দিলে অবশ্যই আমি জানতাম। আর সে যখন ব্লাড দেয় সে ডোনারের ব্লাড টেস্ট করেই দিয়েছিল। একজন ডাক্তার সে। এতটাও অসচেতন হবে না। আর ব্লাডের মাধ্যমে যদি এইচ আই ভি হত তাহলে আমিও তার বাহক হতাম। ১৫ দিন আগেও আমরা মিলিত হয়েছি। নিশ্চয় আমার শরীরেও এইচ আই ভি এর জীবাণু প্রবেশ করত। এটা আমার কাছে একদমেই বিশ্বাসযোগ্য লাগছে না। অফিসার মাহিরের ভাষ্যমতে মেঘ এইচ আই ভি পজিটিভের রিপোর্ট পেয়ে হতাশ হয়ে যায়। সে তার পরিবারকেও বিষয়টি জানায়। তার পরিবার এ বিষয় জানার সাথে সাথে বিয়ে ভাঙার পরামর্শ দেয় প্রথম। আর সেজন্যই বিয়ে ভাঙা হয়। আর এরপর মেঘ আবারও টেস্টের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবারকেও সেটা জানিয়েছিল। কিন্তু রাতে সে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে নিজেই আত্মহত্যা করে। আর রোগের এ বিষয়টি কোনোভাবে যেন কেউ জানতে না পারে সেজন্য সে বিয়ে ভাঙার জন্য আমার বয়সের মতো ঠুনকো জিনিসকে দায়ী করেছে।
কিন্তু অফিসার মাহিরের এ কথার সাথে কেন জানি না আমি একমত হতে পারছি না। কারণ মেঘ অবশ্যই আবার টেস্ট করে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করত। সে আমাকেও টেস্টের কথা বলত। আর মেঘ এতটাও অধৈর্য ছিল না৷ এখানে অনেক কিন্তু থেকে যায়। মেঘ আত্মহত্যা করেনি। মেঘকে খুনেই করা হয়েছে। আর এ খুনের সাথে নিশ্চয় তার পরিবার জড়িত। নাহয় এমন কেউ জড়িত যে আমাদের খুব কাছে কিন্তু তাকে আমরা ধরতে পারছি না।”

কথাগুলো বলেই বৃষ্টি আবার কাঁদতে লাগল। ডাক্তার আবিরও দ্বিধাদ্বন্ধে পড়ে গেল। বৃষ্টির কথাগুলো যৌক্তিক। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বৃষ্টিকে বলল

“আপনি শান্ত হোন। আপনার যদি মনে হয় মেঘকে খুন করা হয়েছে তাহলে সবার প্রথম প্রমাণ দরকার। আপনি যদি এভাবে অসুস্থ হয়ে থাকেন তাহলে প্রমাণ জোগাড় করতে পারবেন না। আর প্রমাণ জোগাড় করা ছাড়া মেঘের খুনীকে শাস্তিও দিতে পারবেন না৷ কারণ আইন প্রমাণ দেখে। আপনার চোখের জল মনের সাজানো সন্দেহ আইন দেখবে না। এটা আইনের কাছে ভিত্তিহীন।”

বৃষ্টি আবিরের কথায় নিজেকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করেও পারছিল না। মেঘের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলোই তার চোখে ভাসছে বারংবার। আর সে স্মৃতির বিষাদময়তায় সে আরও তলিয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতরটায় অদ্ভুতরকম কষ্ট হচ্ছে তার। ডাক্তার আবির বৃষ্টির অবস্থা বুঝে একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিল। এ মুহূর্ত তার ঘুম দরকার। বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে গেল।

ডাক্তার আবির কেবিন থেকে বের হলো। কেবিন থেকে বের হতেই অফিসার মাহিরের সাথে দেখা তার। অফিসার মাহির রোগীর কন্ডিশান জানতে চাইলে ডাক্তার আবির সবকিছু খুলে বলেন। অফিসার মাহিরও বৃষ্টির এ পরিস্থিতি মেনে নিতে পারছে না। ইনভেস্টিগেশনের দিনে বৃষ্টিকে প্রথম দেখেই তার অদ্ভুত রকম অনুভূতি জেগে উঠে। এরপর থেকে তার প্রতি একটা মায়া কাজ করছে। মেঘের কেইসটা ক্লোজ হয়ে গিয়েছে। তারপরও সে এসেছে কেবল বৃষ্টির খোঁজ নিতে। অফিসার মাহির কেবিনে প্রবেশ করে বৃষ্টির পাশেই বসে রইল। বৃষ্টি ঘুমাচ্ছে। তার মুখের মায়ায় সে যেন বারবার ডুবে যাচ্ছে।

সে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বলতে লাগল

“যত তাড়াতাড়ি মেঘের ভূত তোমার মাথা থেকে নামবে তত তাড়াতাড়ি আমি তোমাকে পাব। তোমাকে আমি আর মেঘকে নিয়ে ভাবতে দিব না। মেঘের প্রতি তোমার ঘৃনা বাড়িয়ে দিব আমি৷ সবে তো শুরু৷ বৃষ্টি মেঘ মরে নি। বরং তোমার চোখে আমি মেঘকে মেরে দিয়েছি। মেঘের ময়না তদন্ত রিপোর্ট আমি পরিবর্তন করেছি। তবে মেঘ আত্মহত্যা করেছে এটা সত্যি। কিন্তু কী কারণে আমি সেটা জানি না। আমি কেবল একটা গল্প দাঁড় করিয়ে তোমাকে বলেছি। মেঘের পরিবারকেও বলেছি এমন করেই যেন গল্পটা বলা হয়। তাহলে মেঘের লা/শ নিয়ে আর বেশি কাটা ছেঁড়া করবে না। নাহয় এ লা/শকে নিয়ে বারবার কাটা ছেঁড়া করা হবে৷ পরিবার মেঘের এ পরিণতি মানতে পারছিল না। তাই স্টেটমেন্টে সই করে তারা লা/শ নিয়ে চলে যায়। আমি তাদের বলেছি বিষয়টা কাউকে জানতে দিব না। আমি সেটা কাউকে জানতে দেয়নি। শুধু তোমাকে জানিয়েছি মেঘকে ঘৃনা করে ভুলে যাবার জন্য। কিন্তু তুমি তো মেঘকে ভুলে যেতে পারছো না৷ আমি কী করলে তোমার মন থেকে মেঘ মরে যাবে? তবে এখনও একটা প্রশ্ন থেকে যায় মেঘ কেন আত্মহত্যা করেছিল আর বিয়েই বা কেন ভেঙেছিল?”

এমন সময় বৃষ্টি চিৎকার করে জেগে উঠে। বৃষ্টির চিৎকার করে সামনে তাকিয়ে দেখে বৃষ্টির মা বসে আছে। বৃষ্টি চেঁচাতে চেঁচাতে বলল

“অফিসার মাহির এসব কী বলছেন? অফিসার মাহির কোথায়?”

বৃষ্টির মা বৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল

“আবীর তোকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে চলে গেছে। এরপর তো কেউ আসেনি। অফিসার মাহির কোথায় আসবে? উনি উনার কাজে ব্যস্ত।”

বৃষ্টি একটু স্বাভাবিক হলো। স্বাভাবিক হয়ে বুঝতে পারল ঘুমের ঔষধ দেওয়ার পর সে ঘুমিয়ে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু মেঘের তাড়া থেকে সে নিস্তায় পায়নি। তাই এমন স্বপ্ন দেখেছে। কত অদ্ভুত স্বপ্নই দেখেছে সে। মনে হচ্ছিল একদম বাস্তব। এমন সময় তার মোবাইলে কল বেজে উঠে। অপরিচিত একটা নম্বর থেকে কেউ একজন কল দিয়েছে। সে ধরতেই একটা নাম শুনে চমকে উঠল। নামটি হলো বৈশাখী। নামটি শুনে চমকানোর একটা কারণ ছিল অবশ্য। আর সেটা হলো…