মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব-০৬

0
10

#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৬

আর সেটা হলো বৈশাখীর আচরণ। বৈশাখী মেঘের মামাত বোন। মেঘকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসত। বৃষ্টিকে একদম মেনে নিতে পারত না সে৷ তাদের সম্পর্কের ভাঙন ধরানোর জন্য অনেক চেষ্টায় সে করেছে। মেঘ অবশ্য বৈশাখীর এসব কর্মকান্ড ছোটো বলে মাফ করে দিত। টানা তিনটা বছর ধরে বৈশাখীকে বৃষ্টি সহ্য করে আসছিল। বৈশাখী আর মেঘের বয়সের পার্থক্য আট বছরের মতো। আজ হঠাৎ বৈশাখী কল দিয়েছে এটা ভেবেই বৃষ্টির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। বৃষ্টি একদম শান্ত হয়ে বসে রইল। কোনো কথায় তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না। নীরবতা যেন তাকে গ্রাস করছে। নীরবতার অবসান ঘটে বৈশাখীর কণ্ঠে।

“বৃষ্টি আমি জানি তোমার জন্যই আজকে মেঘের এ হাল। তুমি মেঘকে খু/ন করেছো। মেঘ তোমাদের বিয়ে ভেঙে দিয়ে আমাকে প্রপোজ করেছিল। বলেছিল তোমার মতো বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে সে সংসার করতে পারবে না। আমাকে সে বিয়ে করতে চায়। পরদিন সে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাদের বাসাতেও আসত। কিন্তু যখনই তুমি এটা টের পেলে তখন তাকে খু/ন করে দিলে। মানতে পারলে না মেঘ আর আমার ভালোবাসা। নিজেকে আয়নায় দেখেছো? ভয়ংকর লাগে তোমাকে।”

বৈশাখীর কথা শুনে বৃষ্টির রাগটা অনেক বেড়ে গেল। বৈশাখী এসব ভিত্তিহীন কথা কী করে বলছে? একটা মৃত মানুষকে নিয়েও সে এসব মিথ্যা রটাচ্ছে। বৃষ্টি রাগান্বিত গলায় বৈশাখী বলে উঠল

“এসব ভিত্তিহীন কথা কী করে বলছো? তুমি জানো মেঘ এখন বেঁচে নেই তাই এসব কুৎসা রটাচ্ছ? একটা মৃত মানুষকে নিয়ে বিজনেস করতে তোমার বিবেকে বাঁধছে না? তোমাকে আমি মেঘের জন্য অনেক সহ্য করেছি। মেঘ সবসময় ভাবত তুমি বয়সে অনেক ছোটো তাই তোমাকে কিছু বলতে মানা করত। কারণ সে মনে করত বড়ো হলে তুমি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সত্যি বলতে তুমি কখনও শুধরানোর পাত্রী না। তোমার কথার কী প্রমাণ যে, মেঘ আমাকে রেখে তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল? প্রমাণ দিতে না পারলে আমি এসে তোমার জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলব।”

বৈশাখী বৃষ্টির কথায় একদম রাগান্বিত হলো না। বেশ ঠান্ডা মাথায় বলল

“তোমার ওয়াটস এপে আমি আর মেঘের কথোপকথনের কিছু স্ক্রিনশট দিয়েছি। পড়ে নিও৷ আর শুনো মেঘকে আমি তোমার থেকে বেশি ভালোবাসি। তাই মেঘকে নিয়ে আমাকে কিছু বলতে আসবে না। তুমি যে মেঘকে খু/ন করেছো এটা আমি প্রমাণ করেই ছাড়ব। আমার জীবনটাকে নরক বানানোর শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।”

বৈশাখীর এত কনফিডেন্ট নিয়ে বলাটা বৃষ্টির কাছে বেশ সন্দেহজনক মনে হলো। সে বৈশাখীকে আরও জোর গলায় বলল

“আমার তো এখন মনে হচ্ছে মেঘকে আমি না তুমি খু/ন করেছো। আমাদের সংসার তোমার সহ্য হবে না সেজন্য। তাই মেঘকে রাতে খুন করে দুটো মোবাইল দিয়ে কথাগুলো তুমিই বলেছো। বিয়ে বাড়িতেই তো ছিলে তুমি। মামাত বোন যেহেতু দাওয়াত তো পেয়েছিলেই অবশ্য।”

“জাস্ট স্টপ বৃষ্টি। আমি তোমাদের বিয়েতে যাইনি। বিয়েতে না যাওয়ার কারণ ছিল তোমার মতো মেয়ের মুখ দেখতে হবে না তাই। মেঘ আমাকে মেসেজ করেছিল দুপুরে। আর সে সময় আমি বাসায় ছিলাম। এরপর তোমাদের বিয়ে ভেঙে দেয়। এ খবরটা আমাকে দিয়েছিল আমার মা। তদন্ত করে দেখো আমি সে সময় কোথায় ছিলাম। আর মেঘ খু/ন হয় রাতে। যদি মেঘ আমাকে বিয়ে করতে চায় এটা বলে থাকে,তাহলে আমি মেঘকে খু/ন করতে যাব কোন যুক্তিতে? যেখানে মেঘকে পাওয়ার জন্য পাগলের মতো উন্মাদ হয়েছিলাম আমি। এ মুহূর্তে কার দিকে আঙ্গুল যাচ্ছে তুমি বুদ্ধিমান মেয়ে, তুমি নিজেও বুঝছো?”

বৃষ্টি ভারী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল

“মানুষটার জন্য আমি হাসপাতালে ভর্তি। এ সময়ও তুমি এমন করছো? আমাকে জ্বালানো ছাড়া তোমার কোনো কাজ নেই? নিজেকে কী ভাবো? তুমি জানো না আমি মেঘকে কতটা ভালোবাসি। ১০ বছরের ভালোবাসার রত্ম আমি খু/ন করবো? মাথায় সমস্যা তোমার?”

বৈশাখী উপহাসের হাসি হেসে জবাব দিল

“তুমি মেঘের জন্য হাসপাতালে না। বরং মেঘের খু/নের রহস্য উন্মোচন হলে তুমি ফেঁসে যাবা। আর ফেঁসে গেলে তোমার কী হবে এটা ভেবে ভয় পাচ্ছ। আর সেজন্য তুমি হাসপাতালে। আমি তোমাকে ছাড়ব না বৃষ্টি।”

কলটা কেটে গেল। বৈশাখীর কলটা কাটতেই বৃষ্টি ওয়াটস এপে মেসেজ চেক করলো। সেখানের একটা স্ক্রিনশট বৃষ্টির বুকের দহন বাড়িয়ে দিল। মেঘ বৈশাখীকে মেসেজ দিয়েছিল ঠিক দুপুর ১২ টা ৫৫ তে। সেখানে লেখা ছিল

“আমি আর বৃষ্টির চোখে আমার ভালোবাসা খুঁজে পাই না। তোমার দূরন্তপনা, আমার প্রতি তোমার উদ্যম ভালোবাসা। আমাকে পাওয়ার প্রবল পাগলামি আমার মনকে অনেক আগেই সিক্ত করেছিল। তবে বৃষ্টির প্রতি থাকা দায়িত্ব আমাকে বারবার বাঁধা দিয়েছে। তুমি যে এভাবে সুক্ষ্ম আলোক রশ্নির মতো আমার জীবনে প্রবেশ করে বৃষ্টিকে সরিয়ে জায়গায় দখল করে নেবে কে জানত? আমি বৃষ্টির সাথে আমার বিয়েটা ভেঙে দিয়েছি। আমি অতি শিঘ্রই তোমার পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব।”

মেসেজটা পড়ে বৃষ্টি দ্বিধায় পড়ে গেল। কোনটা সত্যি? মেঘের এইচ আই ভি পজেটিভের বিষয়টা নাকি এটা? বিয়ে ভাঙার কারণ হিসেবে সে কোনটাকে বেশি প্রাধান্য দিবে? অনেক কিছুই ভাবছে সে। এ যন্ত্রণাময় জীবন তার একদম ভালো লাগছে না। অনেক প্রশ্নই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অস্থিরতা তাকে আবারও গ্রাস করছে। বৃষ্টির মা এ অবস্থা দেখে তার মেয়েকে বলল

“একজনকে তুমি ১০ বছর ভালোবেসে তার পরিণতি মানতে পারছো না। আর আমি যে তোমাকে ২৯ বছর ভালোবেসেছি তাহলে আমি কীভাবে তোমার এ করুণ পরিনতি মেনে নিব? বৃষ্টি যা হওয়ার হয়েছে৷ নিজেকে একটু সামলাও। সবকিছু ভুলে আবার জীবনটা শুরু করো। এভাবে চলতে থাকলে নিজেও শান্তিতে থাকতে পারবে না আমাদেরও শান্তি দিবে না। চারপাশের লোকজনের কত নোংরা কথা সহ্য করছি। একটাবারও বাবা মায়ের কথা চিন্তা করছো না? মনে হয় না বাবা মায়ের মান সম্মানের দিকে তাকিয়ে একটু নিজেকে সামলাই। সফুরার মা এসে বলতেছে তোমাকে আমরা হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি বাচ্চা নষ্ট করতে। তোমার আর মেঘের অবৈধ সন্তান নাকি তোমার পেটে। তাই সে কলঙ্ক ডাকতে এখানে এসেছি। অথচ আমরা তো জানি কেন এসেছি। ওদের মুখ তো আমরা আটকে ধরতে পারছি না। সমাজ অনেক কঠিন রে মা। এ সমাজে বেঁচে থাকতে হয় লড়াই করে। একটা ২৫ পার হওয়া সিনগেল মেয়ের জন্য সমাজটা যে কত বিষাক্ত সেটা তুমি বুঝবে না মা। আমি আর এসব নিতে পারছি না৷ নিজেকে একটু সুস্থ করো। সব কিছু মানিয়ে বাসায় চলো। এরপর আমরা যেখানে বিয়ে ঠিক করি সেখানে বিয়ে করো।”

মায়ের শেষ বাক্য শুনে বৃষ্টির অনেক রাগ উঠলেও সে নিজেকে সংযত করল। হালকা গলায় সে জবাব দিল

“আমি সবকিছু তোমাদের মতো করব তবে আমি বিয়ে করব না। ভবিষ্যতেও আমি মেঘের জায়গা কাউকে দিতে পারব না। কখনও যদি পরিস্থিতি আমাকে দিতে বাধ্য করে তখন সেটা ভেবে নিব। তবে স্বইচ্ছায় আমি আর বিয়ে করতে চাই না।”

বৃষ্টির এসব এলোমেলো কথা বৃষ্টির মায়ের আর ভালো লাগছে না। সে হালকা দম নিয়ে বলল

“তোমার যা ইচ্ছা করো। মা, বাবার সুখের কথা আর ভাবতে হবে না। তোমার পরেও আমার আরেকটা মেয়ে আছে। তোমার জন্য সে মেয়েরও জীবন বিপন্ন হবে বুঝতে পারছি। আমারেই দোষ তোমাকে শাসন করা জরুরি ছিল। আর নাহয় সময়মতো জোর করে হলেও বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।”

কথার সমাপ্তিও হলো না। বৃষ্টির মা আরও কিছু বলতে চেয়েছিল। তবে হঠাৎ করে মহিলা পুলিশের আগমণে সেটা থেমে যায়। পুলিশ কনস্টেবল আইরিন আক্তার এবং মীরা সাহা এসেছেন। তাদের সাথে এসেছেন অফিসার মাহির। অফিসার মাহির বৃষ্টির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল

“বৃষ্টির শারিরীক অবস্থা ভালো না আমরা জানি। তবে এ মুহূর্তে তাকে এরেস্ট করা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। বৃষ্টির নামে মামলা করেছে মেঘের পরিবার। তাদের সন্দেহ এবং কিছু প্রমাণ এটা জানান দেয় বৃষ্টিই মেঘকে খু/ন করেছে। মেঘকে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত করা হয়। আর সেখানে মেঘের আগের ময়না তদন্তের সাথে কোনো মিল নেই।”

বৃষ্টির চোখ দুটো ছলছল করতে লাগল। সে বুঝতে পারল এটা বৈশাখীর কাজ। সে বেশ রেগে বলল

“মেঘ আমার স্বামী হয়। এটা ষড়যন্ত্র । নিশ্চয় বৈশাখী করেছে?”

তবে অফিসার মাহির স্পষ্ট গলায় বলল

“বৈশাখী এ বিষয়ে জড়িত না। সে অনেক আগেই এসেছিল মামলা করতে তবে মেঘের পরিবারের দ্বিমত ছিল তাই করতে পারে নি। বর্তমানে মামলা করেছে অন্য কেউ। সে ও মেঘের পরিবারের কেউ না। কিন্তু মেঘের পরিবারের এতে সম্মতি রয়েছে। তবে তার কথা মতোই আমরা কেইসটা ওপেন করি। আমার কাছে আপনাকে এরেস্টের নোটিশ এসেছে এ মুহুর্তে এটা ছাড়া কোনো উপায় নেই।”

বৃষ্টি নিজেকে শক্ত করে বলল

“এরেস্ট করতে চান তো? করেন.. তবে আমি সে ব্যক্তির নাম কী জানতে পারি?”

এরপর অফিসার মাহির যার নাম বলল তা শুনে বৃষ্টির মনে আরও বেশি অস্থিরতা বাড়তে লাগল। আর ভাবতে লাগল তার জীবনে এত দুর্বিষহ কেন হয়ে পড়ছে??

….