#মেঘ তুমি বৃষ্টি হয়ে নামো
#পর্ব-৮
#শারমিন আঁচল নিপা
কারণ মেঘের বাবা আকরাম সাহেব এসেছেন। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল
“আমার ছেলেকে খু/ন না করে হাত কেটে ফেলতে পারতে, পা কেটে ফেলতে পারতে। তবুও তো আমার ছেলেটা আমাকে বাবা বলে ডাকত। আমার একমাত্র ছেলে। আমার আর কোনো সন্তানও নেই। আমি কী নিয়ে বাঁচব ভাবতে তো পারতে। এ বয়সে ছেলের লাশ কাঁধে বহন করা অনেক কঠিন। এত ভার আমি সইতে পারছি না। এক বিন্দু মায়া হয়নি যখন আমার ছেলেকে দঁড়ি দিয়ে শ্বাস আটকে দিয়েছিলে? নিশ্চয় আমার ছেলেটা বাঁচার জন্য অনেক ছটফট করেছে। তখন কী একটা বারও মনে হয়নি তাকে বাঁচাই। বিয়ে না করাই কী তার অপরাধ ছিল? সে হয়তো বুঝে গিয়েছিল তোমার মতো হিং/স্র মেয়েকে বিয়ে করলে তার জীবন নরক হয়ে যাবে। তাই সে বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু হিং/স্রতা থেকে রেহাই পেল কোথায়? ঠিকেই তাকে যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেললে।”
বৃষ্টির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। এত অপবাদ সে নিতে পারছে না। সে কান্না গলায় আকরাম সাহেবকে জবাব দিল
“আংকেল আমি সত্যিই খু/ন করিনি। আমি তো মেঘকে ভালোবাসি। আমি বাসায় গিয়েছিলাম সত্য। তবে খু/ন করতে না মেঘের সাথে দেখা করতে। কিন্তু পারিনি৷ ব্যর্থ হয়ে আমি ফিরে আসি। আপনার কী মনে হয় মেঘের মতো মানুষটাকে আমি একটা ফ্যানে ঝুলাতে পারব? তার ওজন ছিল ৯৪ কেজি। আমার ওজন ৪৯ কেজি। আমার পক্ষে আদৌ কী এটা সম্ভব বলুন? এখানে কোনো একটা রহস্য চাপা পড়ে আছে যেটা আমাদের চোখে ধরা পড়ছে না। দয়াকরে আমাকে মেঘের খু/নী বলবেন না। আপনি সন্তানহারা আমিও স্বামীহারা। আমার কষ্টটা বুঝুন।”
আকরাম সাহেব রেগে উচ্চ সুরে জবাব দিল
“একদম চুপ। এ পাপী মুখে আমার ছেলের নাম নিবে না। তোমাকেও আমি শান্তিতে বাঁচতে দিব না। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছাড়ব তোমাকে।”
কথাগুলো বলে তিনি চলে গেলেন। এদিকে ডাক্তার আবীর আর বৃষ্টির মা এসেছে বৃষ্টির সাথে দেখা করতে। কিন্তু পুলিশ কোনোভাবেই তাদের অনুমতি দিচ্ছে না। উপর মহল থেকে নিষেধ করা হয়েছে৷ তাই শত চেয়েও তারা দেখা করার অনুমতি পেল না। পরশু কোর্টে চালান দিলে এরপর যদি তারা দেখা করতে চান আইনী ভাবে করতে পারবেন। আপাতত দেখা করতে পারবে না। তারা দুজনেই ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল।
এদিকে বৃষ্টি প্রহর গুনছে তার মায়ের জন্য। কখন তার মা দেখা করতে আসবে। গোটা একটা দিন কেটে গেল তার মায়ের দেখা সে পেল না। ভীষণ একাকীত্ব তাকে গ্রাস করছে। উর্মি আর সায়েবা বৃষ্টিকে স্বান্ত্বণা দিয়ে বলল
“বিপদের সময় কারও আশা করতে হয় না। নিজের লড়াই নিজেকে করতে হয়। হয়তো তোর মা ও তোর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তিনিও ভাবছেন তুই খু/ন করেছিস। এরকম কত দেখেছি। পরিবারও একটা সময় স্বার্থের কাছে পাল্টে যায়। নিজের আখের নিজে গুছা। যদি তোর আগে আমরা বের হতে পারি তাহলে তোকে পালাতে আমরা সাহায্য করব।”
বৃষ্টি ভারী নিঃশ্বাসটা ছাড়ল শুধু। মায়ের প্রতিক্ষায় সে বসে আছে। আজকের এ দিনে সে টের পাচ্ছে মা কী জিনিস। এ বিপদেও তার মা মুখ ফিরিয়ে নিবে এটা সে ভাবতে পারছে না। দুনিয়ার সব ভুল একদিকে আর মায়ের কাছে সন্তান একদিকে। তাই তার ভেতরের আশার আলোটা এখনও নেভেনি। সে এখনও তিতির পাখির মতো মায়ের অপেক্ষা করছে। কেনোকিছু মুখে তুলছে না। শরীরটাও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে বুঝা যাচ্ছে না কখন দিন হচ্ছে আবার কখন রাত। তবে খাবারের ম্যানু গুলোতে বৃষ্টি আন্দাজ করে নিচ্ছে কখন দিন কখন রাত। এই যে যেমন এখন সকাল। তাই তার কপালে জুটেছে পোড়া রুটি আর সবজি। কতদিন আর না খাইয়ে থাকবে। মায়ের প্রতি ভীষণ অভিমান জমেছে তার। তার চোখের জলও শুকিয়ে গিয়েছে। কোনোরকম রুটি ছিড়ে মুখে নিয়ে খেতে লাগল। বুক ভারী হওয়া নিঃশ্বাসে কখন যে খাবার গলায় আটকে গেল বুঝতে পারল না। জোরে কাশি দিতেই সায়েবা আর উর্মি বৃষ্টির দিকে পানি এগিয়ে দিয়ে বলল
“আস্তে খা। আর তোর জন্য সুখবর আছে।”
সুখবরের কথা শুনে বৃষ্টির মনটা হালকা হয়ে গেল। বৃষ্টি অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করল
“কী সুখবর?”
সায়েবা হালকা হেসে জবাব দিল
“আমাগো উস্তাদ আমাদের জামিনের ব্যস্থা করব আজকে। আমরা আজকে জেলের বাইরে যামু।”
বৃষ্টির মুখটা মলিন হয়ে গেল। অন্তত জেলে কথা বলার মানুষ তো দুজন ছিল৷ আজকে সেটাও থাকবে না৷ মলিন মুখে উত্তর দিল
“দুজন সঙ্গী ছিল তারাও চলে যাবে। এতে খুশি হওয়ার কী আছে। সুখবর তোমাদের জন্য আমার জন্য না। আমি হয়তো এখানে পঁচেই মরব। আমি তো আর তোমাদের জামিনের ব্যবস্থা করতে পারিনি। আমাকে কী আর সাহায্য করবে?”
সায়েবা বিরক্তি গলায় কপাল কুঁচকে বলল
“ঢং দেখে আর বাঁচি না। শুন চুর হলেও জবান শক্ত আমাদের। আমরা তোকে বাঁচাব। তোকে কাল কোর্টে চালান করা হবে। তোকে এখান থেকে বের করে গাড়িতে তুলা হবে৷ গাড়িটা মাঝপথে যখন যাবে। আমাদের গ্যাঙ একটা গ্যান্জাম বাঁধাবে। পুরো রাস্তা তুলপার হবে। এ সময় আমাদের মধ্যেই একজন গাড়ি থেকে তোকে নামিয়ে অন্য গাড়িতে তুলে দিবে। সাথে একটা বোরকা থাকবে। তুই গাড়ি থেকে নেমেই বোরকা পরে নিবি৷ এরপর পালানোর দায়িত্ব তোর। যদি কখনও আল্লাহ সহায় হয় দেখা হবে৷ তোকে আল্লাহ বদলা নেওয়ার সুযোগ করে দিক এ দোয়া করব।”
বৃষ্টির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। অন্ধকার কুঠুরিতে এক বিন্দু আলোক রশ্নি লাগছে সায়েবাকে। সে সায়েবাকে জড়িয়ে ধরে ফেলল। আলিঙ্গন করে বলতে লাগল
“আমি হয়তো জীবনে ভালো কাজের বিনিময়ে তোমাদের এখানে পেয়েছি। আমার পরিবারও আমার পাশে নেই। গোটা দুটো দিন কেটে গেল আমার সাথে দেখা পর্যন্ত করতে আসল না। এ জীবনে সত্যিই অনেক কিছু দেখার বাকি। খারাপ সময়ের শুরু। তবে চলমান খারাপ সময় এটাই জানান দেয় একটা সময় সুদিন আসবে।”
বিকেল বেলায় সায়েবা আর উর্মি জামিন নিয়ে চলে গিয়েছে। বৃষ্টি একা বসে আছে৷ কাল তাকে কোর্টে চালান করা হবে। তবে বৃষ্টি এটাই বুঝছে না কেন তার পরিবারের তার সাথে দেখা করতে আসল না। তার ভেতরে এ বিষয়টা নিয়ে বেশ ভার হয়ে আছে। এমন সময় একজন মহিলা কনস্টেবল প্রবেশ করল। সে জেলখানায় ঢুকেই বৃষ্টিকে লাথি, কিল,ঘুষি দিতে লাগল। আর বলতে লাগল
“বল কেন খুন করেছিস তুই? আর কীভাবে খুন করেছিলি? ভালোই ভালোই স্বীকার কর তুই। নাহয় তোকে এখানেই জ্যান্ত পুঁতে ফেলব।”
বৃষ্টির দম নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। তবে যতদূর বৃষ্টি জানে রিমান্ডের অনুমতি না দিলে কেউ এভাবে আসামীকে মারতে পারে না। বৃষ্টি লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল
“আমাকে আপনি বিনা কারণে কোর্টের অনুমতি ছাড়া মারছেন, এটা ক্রাইম। আমি জানি আপানাকে ঘুষ দেওয়া হয়েছে আমাকে মারার জন্য। নিজেকে বিক্রি করে নিরাপরাধ মানুষকে মারতে এসেছেন লজ্জা লাগে না? আপনার এতে সমস্যা হতে পারে আপনি বুঝতে পারছেন তো?”
এ কথা শুনে পুলিশ কনস্টেবল আরও রেগে গেল। সে রেগে গিয়ে উত্তর দিল
“তোকে মারার জন্য একদম উপর থেকে পারমিশন এসেছে। আমার সমস্যা হবে তোকে কে বলল? নিজে বাঁচবি কি’না সেটা আগে ভাব। চুরের মায়ের বড়ো গলা।”
এই বলেই একের পর এক লাথি, লাঠির আঘাত, চুল ধরে টেনে টেনে আঘাত করা। যতভাবে আঘাত করা যায় করছিল। বৃষ্টি মেঝেতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে কেবল মার খাচ্ছিল। টানা ৭,৮ মিনিট মারার পর পুলিশ কনস্টেবল চলে গেল। বৃষ্টির ব্যথা যেন শেষ হচ্ছে না। সে হাহাকার করে ভেতরে ভেতরে বলছে
“আল্লাহ আমার জীবনের কষ্ট কী শেষ হবে না? বিনা অপরাধে আমি শাস্তি পাচ্ছি। হে আল্লাহ আমি স্বামী হারা এক নারী। আমার জীবনে এমনিই বিভীষিকা। আর বিভীষিকাময় জীবনে এত বিষাদ কেন বাড়ালে?”
কথাগুলো বলেই নিঃশব্দ হয়ে কাঁদতে লাগল বৃষ্টি। সে সাথে মেঘের খু/নীকে বের করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের প্রতিজ্ঞা করল সে। কাল সকাল হওয়ার অপেক্ষায় সে। কখন তাকে কোর্টে চালান করা হবে আর কখন সে এখান থেকে পালাতে পারবে সেটাই ভাবছে সে৷ শরীরটা ভীষণ ব্যথা করছে তার। এভাবে যে তার জীবন পাল্টে যাবে কে জানত?
পরদিন সকালের শুরু হলো। বৃষ্টি ভেবেছিল আজকে তার জীবনে একটা সুযোগ আসবে এ বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পাবার। কিন্তু সে সুযোগটাও নষ্ট হয়ে গেল একটা নতুন বার্তার আগমণে। এরকম একটা বার্তা আসবে সেটা সে কল্পনাও করতে পারছিল না। হতাশা যেন তাকে ঘিরে ধরল। সে তো ভুলে বসেছিল মেঘের…