মেঘ পিওন পর্ব-১+২

0
3

#মেঘ_পিওন
#গোলাপী_আক্তার_সোনালী

১.
“হাতে মেহেন্দি দিয়েছো?
তাতে আমার নাম লিখেছো তো?”

নিজের ছোট্ট রুমের ব্যালকনিতে বসে ক্লাসের পড়া পরছিলো মার্জিয়া।৩য় বর্ষের পরিক্ষা হবে ঈদের পরেই।আর দুদিন পর রোজার ঈদ।এখন ও কেনাকাটা করা হয়নি মার্জিয়ার।চেয়েছিলো কিছুই কিনবে না।কিন্তু মামার চাপে যেতেই হবে কাল।ঈদের কয়েকটা দিন পড়াশোনা থেকে দুরেই থাকবে তাই আজ একটু পড়ে নিচ্ছে।বর্তমানে বিদ্যুৎ যেভাবে ঘন ঘন যায় তাতে সাধারণ মানুষের টিকে থাকা মুশকিল।তাই বারান্দায় বসে পড়ছিলো সে।ছোট্ট এই ব্যালকনিটা মনের মতো করে সাজিয়েছে মার্জিয়া।সব সময় হাওয়া উপভোগ করা যায়।এখানে এলে যে কারোর মন ভালো হয়ে যাবে বাইরের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখলে।পড়ার মাঝেই হুট করে পানির বোতল টা পরে যায়।বোতলটা কিভাবে পরলো সেটা দেখতে গিয়ে দেখলো ইটের টুকরোর সাথে মোড়ানো একটা কাগজ তাতে লেখা –
“হাতে মেহেন্দি পরেছো তো?
তাতে আমার নাম লিখেছো?”

কে লিখেছে তা বুঝতে বাকি নেই মার্জিয়ার।এই অনলাইনের যুগেও সে যে তাকে এতো যত্ন করে চিঠি লিখে দেয় এতে খুব ভালো লাগে মার্জিয়ার।
পাছে মামি এসে দেখে নেয় সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেললো।একবার উকি দিল রাস্তার দিকে, না কেউ নেই।পূর্বের ন্যায় এবার ও লুকিয়ে আছে সে।

“এভাবে লুকিয়ে থেকে কি মজা পায় কে জানে।
পরক্ষণেই মনে হলো দুপুরে তার মায়ের বলা কিছু তিক্ত কথা।যেটায় মার্জিয়ার মন ক্ষুন্ন হয়েছে বারংবার। যখনই মনে হচ্ছে তখনি চোখ যেন আপনা আপনিই ভিজে যাচ্ছে।
” না এতো দুর্বল হলে চলবে না।তাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আমিও তাকে ভালোবাসি।তার মায়ের বলা সেই বিষাক্ত কথা গুলো বার বার হজম করার সাহস আমার নেই।আমরা ভাড়াটিয়া তাতে কি হয়েছে এমনি এমনি এখানে থাকি না নাকি?তার জন্য মাস শেষে মোটা এমাউন্টও দেওয়া হয় তাদের।কিন্তু এভাবে আর কতদিন মানুষের মুখ তো আমার পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব নয়।

এসব ভাবনার মধ্যে সেখানে রুবি বেগমের আগমন। রুবি বেগম মার্জিয়ার মামি।মায়ের থেকে যতনা আদর যত্ন পেয়েছে তার চেয়েও বেশি রুবি বেগমের থেকে পেয়েছে।তার এক ছেলে আছে বয়স ১০ বছর। নাম মনির।মার্জিয়াকে কখনো ছেলের থেকে কম ভালোবাসেন না তিনি।বাবা মারা যাওয়ার পর মাও অন্য খানে বিয়ে করে নিয়েছে সেই থেকে মামা জহির রায়হান আর মামি রুবি বেগমের কাছেই বড় হয়েছে মার্জিয়া।নিজেদের মেয়ের ছাড়া অন্য চোখে দেখে না কেউ মার্জিয়াকে।

“শুধু পড়াশোনা করলে হবে খেতেও তো হবে নাকি।আর এভাবে বাইরে বসে বসে পড়ছিস যে মশা কামড়াচ্ছে না?

” বাতাস আছে মামি মশা তেমন লাগছে না।

“তোর মামা ডাকছে খেতে চল।আর দুপুরে যা হয়েছে তা যেন তোর মামা না জানে।লোকটা কষ্ট পাবে শুনলে।

” কেন বলো তো মামি সব সময় আমার সাথেই এমন হয়?আচ্ছা মে যে অন্য একটা বিয়ে করেছে এটা কি আমি মাকে শিখিয়ে দিয়েছি নাকি যে সিব সময় আমাকেই কথা শুনতে হবে?

“ভাগ্যে কখন কি হবে তা কি আগে থেকে কেউ জানে পাগলি।তবে যাই বলিস ছেলেটা কিন্তু তোকে বড্ড ভালোবাসে।এভাবে অবহেলা করিস না।

” মামি তুমিও!

“হ্যাঁ আমিও।নে এবার চল।গরম গরম খিচুড়ি আর ডিম ভুনা করেছি।যে কোনো সময় বৃষ্টি হবে।কারেন্ট আছে পরে গেলে আর আসবে না।

” আর একটু বাকি আছে মামি তুমি যাও আমি আসছি।

রুবি বেগম যাওয়ার পর আরো ২০ মিনিটের মত পড়লো মার্জিয়া।এই সময়ে কয়েকবার রাস্তার পাশে তাকিয়েছে কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না।আর অন্যদিকে মার্জিয়াকে এভাবে তাকাতে দেখে লুকিয়ে থাকা মানুষটাও মনে এক আকাশ সমান আনন্দ উপভোগ করলো।

“মুখে যতই বলো ভালোবাসো না কিন্তু ভালো তো তুমি আমাকেই বাসো সেটা আমজ বুঝে গেছি।এখন শুধু মুখ দিয়ে সেটা বের করার অপেক্ষা। একবার নিজের মুখে বলো তারপর দেখবে তোমাকে অভিযোগ করার সুযোগ দেবো না।

” তোর তো ছুটি পরে গেছে মার্জু।এক কাজ কর কাল তোর মামিকে নিয়ে কিছু টুকিটাকি কেনাকাটা সেরে ফেল।আমার তো ছুটি হবে পরশুদিন আমিই নিয়ে যেতাম না হয়।

“কিন্তু আমার তো কাল একটু কাজ আছে মনিরের আব্বু।

” সমস্যা নেই মামি আমি যেতে পারবো।

“তুই শিওর তো?

” একদম মামা তুমি চিন্তা করো না।

২.

আজ রোদের তাপ অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই।বিকেল বেলা তাও গরমের প্রখর অনেক।নিজের জন্য আর মামা মামিদের জন্য টুকিটাকি মার্কেট করতে এসেছে মার্জিয়া।ও খুব ভালো করেই জানে মামা মামিও এখনও কিছু নেন নি নিজেদের জন্য।বাসা থেকে খানিকটা এগোলেই রিক্সা পাওয়া যায়।সাধারণত বাসার সামনেই পাওয়া যায় তবে আজ আর পেলো না।এদিকে গরমে ইতিমধ্যে নাজেহাল অবস্থা মার্জিয়ার।

“মনে হচ্ছে রিক্সা এই ঢাকাশহর থেকে বিদায় নিয়েছে।২০ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি একটা রিক্সাও নেই!যেগুলো আসে সেটাতেও প্যাসেঞ্জার। ধুর বাবা ভালো লাগে না।

এমন সময় সামনে একজন বাইক থামালো।প্রথমে সেদিকে পাত্তা দেয় নি মার্জিয়া। কিন্তু বার বার করে হর্নের শব্দে প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো।ঠিক তখনই দেখলো সেটাতে আহিল বসে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

” আপনি এখানে!

“চলে এসো।রিক্সা পাবে না ম্যাডাম। সবাই ঢাকা ছাড়ছে।বেশি ভাড়া ছেড়ে কি রিক্সা মামারা আপনার জন্য অপেক্ষা করবে?

” প্রয়োজনে পায়ে হেটে যাব তবুও আপনার সাথে যাব না।

“ঠিক বলছো যাবে না তো?
” না যাব না।

“অযথা জেদ করোনা মার্জু।এতো গরমে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন।

” মার নাম মার্জিয়া।আর দাঁড়িয়ে থাকলে আমি আছি তাতে আপনার কি?আপনাকে আমি বলেছি আমার এতো হেল্প করতে?শুনুন আপনি নিজে থেকে আসবেন আর আপনার মা আমার মামা মামিকে যা নয় তাই বলবে আমাকে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলবে এটা আর হবে না বুঝতে পেরেছেন।চলে যান এখান থেকে আমি ঠিক নিজের মতো করে যেতে পারবো।

“দেখো মা তোমাকে কি বলেছে আমি জানি না।শুধু এইটুকু জানি আমি তোমাকে ভালোবাসি।তুমি যদি রাস্তার মেয়ে হও তাও তোমাকেই ভালোবাসি।তুমি যদি কোনো প*তি*তা হও তাও তোমাকেই ভালোবাসি।এখানে এখন দাঁড়িয়ে থাকা তোমার জন্য সেফ না প্লিজ চলো।পরে আমাকে যা ইচ্ছা হয় বইলো।

বেশ অনেকটা সময় গেলেও যখন মার্জিয়া এলো না।তখন আহিল হতাশ। এই মেয়ে এতো জেদি কেন আল্লাহ!ঠিক তখনই আহিল দেখলো মার্জিয়ার পেছনের তিনটি কুকুর।আর মার্জিয়া কুকুরকে অনেক ভয় পায়।ছোট বেলায় একবার কামড়ে দিয়েছিলো সেখান থেকেই ভয় তার কুকুরে।আহিল যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো।বাহ এবার শিকারী নিজের ধরা দিবে।

“আচ্ছা ঠিক আছে যাবে না তো।ওকে ফাইন আমিও চলে যাচ্ছি।আর তারপর, ওই যে তোমার পিছনে কুকুরগুলো দাঁড়িয়ে আছে ওরা কিছু বললে আমি কিন্তু আর বাঁচাতে আসবো না এই বলে দিলাম।
কুকুরের কথা শুনেই মার্জিয়ার গলা শুকিয়ে গেলো।পেছনে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই তিনটি কুকুর তার দিকেই এগিয়ে আসছে।এটা দেখে মার্জিয়া আর এক মিনিট ও দেরি করলো না।প্রায় ছুটেই এলো আহিলের কাছে।

” আচ্ছা বদলোক তো আপনি। কুকুর ছিলো আগে কেন বলেন নি।চলুন চলুন দেরি হচ্ছে তো।

“আমার কি দোষ ওই বজ্জাত গুলোই তো দেরি করে এলো।

” আরে কি বলছেন বির বির করে।নিন স্টার্ট করুন।কুকুরগুলো চলে এলো তো।

“যাচ্ছি তো।এখন কেন এতো তাড়া দিচ্ছেন ম্যাডাম তখন তো খুব ভাব নিলেন যাবেন না।

” ও মজা নিচ্ছেন তো ঠিক আছে যাব না।নেমে যাচ্ছি আমি।প্রয়োজনে আজ কুকুরের হাতে শহিদ হবো তবুও যাব না।

“বললেই হলো নাকি। এই যে দিলাম স্টার্ট দেখি এখন কিভাবে নামো।

এতোক্ষণ গরম লাগলেও এখন বেশ ঠান্ডা হাওয়া লাগছে।মার্জিয়ার একটা হাত আহিলের কাধে।হুট করেই বাইকটা এক সাইড করলো আহিল।মার্জিয়া কিছুই বুঝলো না।

” কি হলো থামলেন যে।কিছু হয়েছে?

“চুল কেন খোলা রেখেছো?

” ভেজা ছিলো তো তাই।

“শুকিয়ে গেছে বাধো জলদি।

আহিকে খুব সিরিয়াস লাগলো তাই আর কথা বাড়ালো না মার্জিয়া।ব্যাগের সাথে একটা চুলের ক্লিপ সবসময় রাখে তাই সেটা দিয়েই বেধে নিলো।

” হয়েছে চলুন এবার।

“না হয়নি।মাথায় কাপড় দাওনি আগে দাও তারপর যাব।

মার্জিয়া এবার ও কিছু বললো না।আসলে সে ইচ্ছে করেই এভাবে এসেছে।এমনটা আহিল মাঝে মাঝেই করে ভার্সিটি যাওয়ার সময় রাস্তায় দেখা হলে।আজও যখন বের হচ্ছিল তখন নিচেই দাঁড়িয়ে ছিলো আহিল। মার্জিয়া জানত সে বের হলে আহিল তার পিছু নিবে তাই এভাবে আসা।লোকটাকে সেও খুব ভালোবাসে কিন্তু বিন্দুমাত্র তা প্রকাশ করে না।এমন একটা ছেলেকে ভালো না বেসে থাকা যায়?

” এবার চলুন।

“এর পর থেকে এভাবেই বের হবে।আর যেন বলতে না হয় বুঝেছো?

” ঠিক আছে।

“(এতো সহজেই মেনে নিলো ব্যাপার টা কি হলো।এ তো এক কথায় মেনে নেওয়ার মেয়ে না!)
এতো সহজেই মেনে নিলে ধান্দা নেই তো আবার কোনো?

” কি বলছেন এসব। মেনে নেব না তাহলে কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝগড়া করবো আশ্চর্য।

“আরে রেগে যাচ্ছো কেন।ঠিক করে বসো পরে যাবে তো।

বাইক থামলো নিউ মার্কেট এর সামনে।ঢাকার অন্যতম ব্যাস্ত মার্কেট এটা।পার্কিং-এ বাইক পার্ক করে আহিল মার্জিয়াকে নিয়ে ভেতরে যেতে চাইলে মার্জিয়া গেলো না।

” আরে ভেতরে যাব না আমি ফুটপাত থেকেই নিব।

“ফুটপাত কেন?ভেতরে চলো মার্জু আজ আমি তোমাকে শপিং করে দিবো।

” তার কোনো প্রয়োজন নেই স্যার। আমার যতটুকু সামর্থ্য আমি ততটুকুতেই খুশি।মলের চেয়ে ফুটপাতের জিনিস আমাদের বেশি ভালো লাগে।আপনার সমস্যা হলে আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন।বেশি সময় লাগবে না আমার।

“খেপেছো!এতো ভিড়ের মধ্যে তোমাকে একা ছাড়বো না কিছুতেই। আমিও যাবো তোমার সাথে।কিন্তু কেনাকাটা শেষ করে আমার সাথে তোমাকে মলেও যেতে হবে আইরার জন্য কিছু কিনবো।আমি ওকে তেমন কিছুই দেই না।যা লাগে বাবাই দেন।

” ঠিক আছে যাব।

চলবে-

#মেঘ_পিওন
#গোলাপী_আক্তার_সোনালী
#পর্ব_২
৩.
“এই শাড়ি টা তোমার জন্য কেমন হয়েছে?
” এটা কখন নিলেন আপনি। আমি তো দেখলাম না!
“সব কি তোমাকে দেখিয়েই করতে হবে নাকি।তুমি যখন আইরার ড্রেস দেখছিলে তখন নিয়েছি।

” কিন্তু আমি এটা নিতে পারবো না।আপনি বরং এটা নিয়ে যান আইরাকেই দিন ও অনেক খুশি হবে।আর অরিন আপুও তো আছে চাইলে ওনাকেও দিতে পারেন।

” এটা আমি তোমার জন্য নিয়েছি আর তুমিই পরবে।ভয় নেই ম্যাডাম এটা আমি আমার রোজগারের টাকা দিয়েই নিয়েছি মায়ের ভয় পাওয়ার কোনো দরকার নেই।আর এই প্যাকেট টাতে মনিরের জন্যও শপিং আছে।আঙ্কেল আন্টি তো নিবে না তাই দেই নি।যেদিন তোমাকে আমি নিজের করে পাবো সেদিন সবাইকেই গিফট দিব।এবার চলো আজ আমরা বাইরেই ইফতার করবো।অলরেডি ইফতারের সময় হয়ে গেছে।

মার্জিয়া কথা বাড়ায়নি।এতো ভালো একটা ছেলে তার মা এতো ছোট মনের কিভাবে হয় ভেবে পায় না মার্জিয়া।

ইফতারের পর ফুটপাত থেকেই সামান্য কিছু জুয়েলার্স নিল মার্জিয়া শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে।সাথে আহিলকেও একটা পাঞ্জাবি কিনে দিলো।এই প্রথম মার্জিহা নিজ থেকে আহিলকে কিছু দিলো। আহিলেন মুখটা দেখার মতো ছিলো।সে হয়তো তার জীবনে এতো খুশি হয়নি।

” তুমি এটা কখন নিলে আমি তো দেখিনি?

“কেন আপনাকে দেখিয়েই কি আমার এটা নিতে হতো? যখন শাড়ি নিচ্ছিলেন তখনই নিয়েছি।

“তাই! এই না বললে তুমি দেখোনি?

” দেখেছি তনে এটা যে আর জন্য ছিলো সেটা তো জানতাম না।

“বাই দ্যা ওয়ে আমি কিন্তু এটা নেওয়ার সময় দেখেছি।এন্ড পাঞ্জাবি টা খুব সুন্দর হয়েছে ধন্যবাদ।

” হয়েছে এবার চলুন বৃষ্টি হবে যে কোনো সময়।

“হোক না তাতে কি বা যায় আসে
তোমায় নিয়ে ভিজবো না হয়
বিশাল এই আকাশের নিচে।

” থাক আর কবি হতে হবে না।এমনিতেই যেমন আছেন সেটা সামলাতেই তো। যাই হোক চলুন এবার।

বাসার সামনে মার্জিয়াকে নামিয়ে দিলো আহিল।তারপর বাইক পার্ক করে ব্যাগ গুলো নিজেই নিলো।

“আমি নিতে পারবো তো।

” জানি পারবে।তবুও আমিই দিয়ে আসবো মামা মামির সাথেও একটু দেখা করে আসবো।

“মানে আপনি এখন ফ্ল্যাটে যাবেন নাকি।আপনার মা দেখলে আবার একটা অশান্তি হবে কি দরকার।

” সেটা আমি বুঝবো। তুমি শুধু আমার কথা ভাব্বে। আমাকে নিয়ে ভাব্বে অন্য কিছু নিয়ে নয় বুঝেছো? আমি তোমার দ্বায়িত্ব নিয়েছি এভাবে হাত ছেড়ে দেওয়ার জন্য নয়। সারাজীবন তোমার হাতে হাত রেখে বাঁচার জন্য।

রুবি বেগনের সাথে খুব ভালো একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে আহিলের।বেশিরভাগ সময় মার্জিয়া যখন আহিলের মায়ের তিক্ত কথা শুনে তার সাথে কোনো রকমের যোগাযোগ করে না তখন রুবি বেগমই একমাত্র মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।তিনি এমনিতেও খুব ফ্রেন্ডলি স্বভাবের। আহিলকে ওনারও খুব পছন্দ। ছেলে হিসেবে খুবই ভালো। মার্জিয়াকে যে কোনো মুল্যে যে কোনো পরিস্থিতিতে আগলে রাখবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।তাই তো আহিলের মায়ের তিক্ত কথা শোনার পরও তিনি শুধু আহিলের জন্যই সব কিছু ভুলে যান।তার একটাই চাওয়া মেয়ের সুখ দেখা।ছোট থেকে কম কষ্ট পায়নি মেয়েটা।এমন সোনার টুকরো ছেলে কয়জনের ভাগ্যেই যোটে।কতো মেয়ের স্বপ্নের পুরুষ না চেয়েও পেয়ে যাচ্ছে মার্জিয়া আর মেয়েটা কিনা ছেলেটার সাথে কতো খারাপ ব্যবহার করে।আসলে কি তা মন থেকে করে?

৪.
মার্জিয়াদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আহিল তার ছোট বেলার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যায়।অফিস যেহেতু ছুটি তাই সকালে কাজে যাওয়ার কোনো চাপ নেই।নিজেদের কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও আহিল চাকরি করে অন্য একটা অফিসে।সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরুন চাকরি নিয়ে খুব বেশি দৌড়ঝাঁপ করতে হয়নি আহিলকে।রেজাল্ট ও যথেষ্ট ভালো। বাবার বলা সত্ত্বেও নিজেদের অফিসে জয়েন্ট হয়নি।তার কারণ একটাই।নিজের একটা আলাদা পরিচিতি গড়ে তোলা।যেখানে শুধুমাত্র শুধুমাত্রই আহিলের অবদান থাকবে যেমনটা তার বাবার ও আছে।

ডাইনিং এ বসে সবাই মিলে রাতের ডিনার সারছিল। আহিল বরাবরই চুপচাপ। খাওয়ার সময় কথা বলা তার পছন্দ নয়।আহাদ রহমান টুকটাক খোজ নিলেন অফিসের বিষয়। আহিল শুধু সেগুলোর উত্তর দিল।

“কাল মিমি আসবে ওকে একটু রিসিভ করিস তো বাবা।সকাল সকাল চলে যাস এয়ারপোর্টে।

” কোন মিমি?

“মজা করছিস?তোর একমাত্র মামার মেয়েকে তুই চিনিস না?

ভায়ের কথা শুনে মুখ টিপে হাসছে আইরা সাথে আহাদ রহমানও।ওদের হাসা দেখে কিছুটা রাগান্বিত হয়ে তাকালেন আদিবা বেগম। সেটা দেখে দুজনেই আবার খাওয়াতে মনোযোগ দিল।

” তোমার ভাতিজি আসছে এতে আমি কি করবো।ড্রাইভার চাচাকে পাঠিয়ে দিও।সকালে আমার ঘুম নষ্ট করে তোমার ভাতিজিকে আনতে যেতে পারবো না।

“এটা কোন ধরনের কথা আহিল। বেচারি এতো দূর থেকে আসবে কি ড্রাইভারের সাথে আসার জন্য।আমাদের একটা দ্বায়িত্ব আছে না?

” মা চিটাগং থেকে ফ্লাইটে আসতে খুব বেশি সময় লাগে না।এয়ারপোর্ট ও দূরে নয়।এতেও যদি তোমার আপত্তি থাকে তাহলে তুমিই যেও আমি পারবো না।খাওয়া শেষ আমি উঠছি।

“দেখেছো! তুমি তোমার ছেলেকে কিছুই বললে না?

” তোমাদের মা ছেলের মধ্যে আমি কিইবা বলবো বলো।তাছাড়া ও তো ভুল কিছু বলেনি।

অবস্থা বেগতিক দেখে আইরাও তারাতাড়ি উঠে পরে।সেটা দেখে আহাদ রহমান ও বুঝে যায় কি করতে হবে তাকে।এখন আদিবা বেগন ন্যাকা কান্না জুরে দিবে আর আহাদ রহমানের গুষ্টি উদ্ধার করবে।এগুলো শুনতে শুনতে কান পচে গেছে একপ্রকার। তাই তিনিও মেয়ের পেছন পেছন ডাইনিং ছাড়লেন।এটা দেখে আদিবা বেগম আরো রেগে যান আর যেটা হবার সেটাই হলো।

আইরা এবার উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্রী। যেহেতু এখন ঈদের ছুটি চলছে পড়াশোনার কোনো চাপ নেই।তবুও রাত জেগে পড়া তার অভ্যাস। ভাইয়ের অনুকরণে বড় হয়েছে তাই ভাইয়ের স্বভাবই পেয়েছে বলতে গেলে।সেই অনুযায়ী রাতে পড়ছিলো নিজের পড়ার টেবিলে বসে।
অমনি পেছন থেকে চুলে টান অনুভব করে আইরা।
ও জানে ভাই ঘুমোতে যাওয়ার আগে ওর রুমে একবার হলেও আসে আর এমন দুষ্টুমি করে তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা তার ভাই।

“ভালো হচ্ছে না ভাইয়া।চুল ছাড়ো।

” যেইনা ঘোড়ার লেজের মতো চুল এতে এতো অহংকার কিসের তোর?

“কি বললে ঘোড়ার লেজ?তুমি জানো না আমার মতো চুল এই বংশে আর কারো নেই।

” সে তো আমার মতো ছেলেও নেই।আচ্ছা এটা বলতো মা ওই পেত্নীকে কেন এখানে আনছে?

“সেটা আমি কি করে জানবো।তোমার সমস্যা তুমি গিয়ে জিগ্যেস করো।

” আমি জানি তুই জানিস।বলে দে নাহলে যেটা এনেছি সেটা আমি ওই পেত্নিকেই দিয়ে দেব।

“কি এনেছো!

” উহু আগেই দেখা যাবে না।যেটা জানতে চেয়েছি সেটা আগে বল তারপর।

“তুমি তো জানোই ও এখানে কেন আসে।ওর একটাই কাজ তোমাকে বিরক্ত করা আর আমাকে মায়ের কাছে ছোট করা।রুপবতী কিনা।কিন্তু তখন মায়ের কথায় যা বুঝলাম এবার শুধু এই জন্য ওকে আনা হচ্ছে না মা কাকে যেন সায়েস্তা করার কথা বলছিলো।আমি যদি ভুল না হয়ে থাকি সেটা মার্জিয়া আপু ছাড়া কেউ না।

” কি বলছিস।

“হ্যাঁ। বর্তমানে মায়ের একমাত্র চোখের বিষ মার্জিয়া আপুই।ভাইয়া মার্জিয়া আপু খুব ভালো। আমাকে অনেক আদর করে।তুমি ওনাকে কষ্ট দিও না প্লিজ।মায়ের কথায় ওনাকে ছেড়ে যেওনা।

” দুনিয়া উল্টে গেলেও মার্জুকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।

আজ মার্জিয়া বারান্দায় যায়নি।কাল ঈদ এই সময় হয়তাও সব মেয়েরা হাতে মেহেন্দি দিচ্ছে।ঈদ নিয়ে তারা আনন্দে মেতে আছে।কিন্তু এসব কিছুই মার্জিয়াকে টানে না।অনেক গুলো বছর হয়ে গেছে মার্জিয়া হাতে মেহেন্দি পরে না।গতকাল পাশের ফ্ল্যাটের ১২ বছরের দুটো মেয়েকে মেহেন্দি পরিয়ে দিয়েছিল। মনির সেটারই একটা ছবি দিয়েছিলো আহিলকে তাই তখন আহিল ওই চিঠিটা দিয়েছিল যাতে তার নাম লিখেই মার্জিয়া মেহেন্দি পরে।
এসব ভাবনাতে মার্জিয়া এতোটা ভাবুক ছিলো যে তার বারান্দায় একের পর এক কেউ ঢিল মেরে চিঠি দিচ্ছে তা খেয়ালই করেনি।তার ধ্যান ফিরে যখন বিছানায় থাকা মুঠোফোন টা কর্কশ সুরে বেজে উঠলো।স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো আহিলের কল।প্রথমে তুললো না।পরে আবারও কল এলে এবার তুললো।

“কোথায় আছো। এতোগুলো চিঠি পাঠিয়েছি একটার ও উত্তর দিলে না কেন?আর বারান্দায় কেন আসছো না? কি হলো কথা কেন বলছো না মার্জু?

” বলুন শুনছি।
কন্ঠে কেমন উদারতা ভাব।এবার আহিল বুঝি একটু নরম হলো।

“কি হয়েছে মন খারাপ?

” না।

“তাহলে! টায়ার্ড লাগছে?

” তাও না

“তাহলে কি হয়েছে?

” কিছু হয়নি।বলুন কেন এতো চিঠি পাঠানো হচ্ছে।যখন দেখলেন চিঠির উত্তর দেইনি তখন তো বুঝেও নিতে পারতেন আমি সেখানে নেই।

“ভেবেছিলাম।বাদ দাও।একটু ছাদে আসবে? তোমার সাথে ঈদের চাঁদ দেখবো।

” এখন এতো রাতে! কেউ দেখলে কি মনে করবে।

“কে দেখবে আমার বাড়ি আমার সিড়ি আমার ছাদ এই ছাদে আসা কারো জন্য পারমিশন নেই শুধু তুমি ছাড়া। কিন্তু তুমি তো ছাদে আসোই না।দেরি হয়ে যাচ্ছে মার্জু তারাতাড়ি এসো আমি অপেক্ষা করছি।আইরাকে পাঠিয়েছি ওর সাথেই এসো কেউ কিছু বলবে না।মামিকে আমি বলে রেখেছি।

” আপনি মামিকেও এর মধ্যে রেখেছেন!আপনার কি একটুও লজ্জা করে না?

“এখানে লজ্জার কি আছে।শাশুড়ীর সাথে ফ্রি হবো না তো কার সাথে হবো?আরে বাবা মেয়েকে নিজের করে নিতে চাইলে মেয়ের মাকে পটানোটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট বুঝলে।সময় খুব কম এসো তো।

ফোন রাখার কিছুক্ষণ পর আইরা আর মার্জুয়া ছাদে এলো।মুলত ওরা আজ রঙ খলেবে।চাঁদরাতে রঙ খেলে এটা মার্জিয়ার জানা ছিলো না।অবশ্য শহরে আরো এমন অনেক কিছু হয় যেটা অনেকেই জানেই না।

” ভাইয়া আমি ওই পাশে থাকছি নাকি চলে যাব?

“যাবে মানে তুমি রঙ খেলবে না?

না গো রঙ তো বাহানা মাত্র।তবে তুমি চিন্তা করো না রঙ তোমার গালে এমনিতেও বসে যাবে।বলেই একটা চোখ মারলো আইরা।

“আচ্ছা যা আর হ্যাঁ মা যেন না জানে আমি এখানে আছি।যেটা আনতে বলেছিলাম সেটা দিয়ে ভাগ এখান থেকে।

” এই জন্যই বলে –
কাজের বেলায় কাজি,
কাজ ফুরোলেই পাজি।
এখন নিজের কাজ হয়ে গেছে অমনি আমি ভাগ তাই না। আমিও দেখবো পরে আবার এসো কোনো প্রয়োজনে তখন বুঝাবো মজা হুহ।

“আরে ও তো রাগ করেছে।এভাবে বলার কি দরকার ছিলো।আর এতো রাতে এখানেই বা ডাকলেন কেন।আর ওকেই বা যেতে বললেন কেন শুনি।

” জামাই বউ এর রোমাঞ্চকর সময় ছোট বোন থাকবে কেন আশ্চর্য! আমাদের বাসর ঘরেও ছোট ভাই বোনদের রাখার ইচ্ছে আছে নাকি তোমার?

“ছিঃ,কথার কি ছিরি।। আপনার মুখে একটুও লাগাম নেই।

” লাগাম আছে বলেই এখন ও ভালো মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছো বুঝেছো।

“অসভ্য লোক।

” সেটাও তোমার জন্য।

চলবে