#মেঘ_পিওন
#গোলাপী_আক্তার_সোনালী
#শেষ পর্ব(প্রথম অংশ)
২১.
মধ্যরাতে ঘুমের ঘোরে কারো কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে আহিলের।বুঝতে বাকি নেই এটা মার্জিয়া।অমন একটা ঘটনা ঘটার পর মা হিসেবে যে কোনো মেয়ের জন্য কষ্টদায়ক ব্যাপার।সেই ঘটনার পর থেকে মাঝে মাঝেই এমন করে মার্জিয়া।আজ প্রায় এক বছরের কাছাকাছি তবুও ভুলতে পারে না। যখন খুব বেশি স্মৃতি চারন হয় তখন এমন কান্নাকাটি করে ।আহিলো ধীরে সুস্থে উঠে মার্জিয়ার সাথে গা লাগিয়ে বসে।মার্জিয়ার মাথাটা নিজের বুকে জরিয়ো নেয়।মার্জিয়া আহিলের সংস্পর্শ পেয়ে আরো নেতিয়ে পরে।ওভাবে বসে থেকেই আহিলের সেদিনের কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
সেদিন বাড়িতে ফিরে আহিল দেখেছিলো তার বাবার রাগ।জীবনের এতোগুলো বছরে আহাদ রহমানকে কখনো রাগ করতে দেখেনি আহিল।সেদিন তার রাগ দেখে নিজেও ঘাবড়ে গিয়েছিলো রীতিমতো। লোকে বলে যারা খুব শান্তশিষ্ট স্বভাবের হয় তারা সহজে হুট করে রেগে যান না। কিন্তু, যখন রেগে যান তখন আর আশেপাশের কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।আহাদ রহমানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো।
★অতীত ★
আহিল আর মাহিন যখন থানা থেকে বাড়িতে আসে ঠিক তখনই বাড়ির অবস্থা দেখে থমকে যায়।
আদিবা বেগম আহাদ রহমানের পা ধরে বসে আছে। আইরা পাশেই কাঁদো কাঁদো চোখে বাবা মাকে দেখছে।বাড়ির এই অবস্থার কথা শুনে অরিনও এসেছে।বাবার রাগ দেখে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
বাবার এমন কঠোর রুপ মায়ের এমন করুন অবস্থা দেখে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আহিল।এগিয়ে এসে বাবাকে কিছু বলতে গেলে সবাইকে অবাক করে আহিলকে ধমকে উঠলেন তিনি।
“তোমাকে এখানে কেউ কথা বলতে বলেছে ?এটা আমার নিজের সিদ্ধান্ত আহিল।কেউ পরিবর্তন করতে চাইবে না।এই মানুষটা সেই মানুষ নয় যাকে ভালোবেসে একসময় সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে আমি বিয়ে করেছিলাম।তোমার দাদিও তাকে পছন্দ করতো না।কিন্তু সে বলতে পারবে আমার মা তার সাথে এমব ঘৃণ্য কাজ করেছে।কোন কাজে কর্মে বুঝতে দিয়েছে যে সে ঘৃণা করে?
” তুমি কি করতে চাইছো বাবা স্পষ্ট করে বলো?
“ডিভোর্স।
” কিহ!
“আমি স্পষ্ট করেই বলেছি এভাবে অবাক হওয়ার কিছু নেই।মার্জিয়া পুলিশ কেস তুলে নিয়েছে এটা ওর বিষয় কিন্তু আমি আমার কথা তুলতে চাই না।
এবার অরিন অনেকটা চেচিয়ে উঠলো বাবার এমন কথায়।
” তুমি এসব কি করে বলছো বাবা একটা বাইরের মেয়ের জন্য।
“তুমি চুপ করো অকৃতজ্ঞ মেয়ে।তুমিও মায়ের থেকে কোন অংশে কম নও।সুন্দর চেহারার সাথে যদি মনটাও সুন্দর করতে পারতে আমি অনেক খুশি হতাম অরিন।কিন্তু আফসোস তুমি তোমার মায়ের অনুসারী। তোমার স্বামীর সাথে তোমার কেমন সম্পর্ক তা আমি জানি তবে এতটুকু বুঝতে পারছি খুব তারাতাড়ি যদি নিজেকে পরিবর্তন না করো তাহলে তোমার অবস্থা তোমার মায়ের মতোই হবে।এখনও সময় আছে।এই মহিলার সঙ্গ ছেড়ে স্বামী সন্তানকে আগলে নাও এতে তোমারই ভালো হবে।
যেই মেয়েকে বাইরের মেয়ে বলছো সে আমার ঘরের লক্ষি।যে আমার ঘরে আলো দিয়ে আলোকিত করেছে।তাকে নিয়ে কোন রকমের কটুক্তি আমি মেনে নিবো না।
বাবার এমন তিক্ত কথায় মন ক্ষুন্ন হয় অরিনের।তবে তিনি যা বলেছেন তা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো না।ইদানীং স্বামী কবির ও তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে রাগারাগি হচ্ছে।ছেলেটাও বড় হচ্ছে।মাঝে মাঝে অবুঝের মতো তাকিয়ে থাকে বাবা মায়ের ঝগড়া দেখলে।তার মানে এটার ইফেক্ট ওই বাচ্চাটার ওপর ও পরছে।এবার বাবার কথায় সত্যিই ভাবনায় ডুবে গেল অরিন।কিন্তু উপরে তা প্রকাশ করলো না।
” তুমি এসব বলো না আহাদ। আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি।এই বয়সে ডিভোর্স এর মত কাজ তুমি কি করে করতে চাও? আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ।
“এই বয়সে এমন কাজ করার আগে তুমি ভেবেছিলে একবার ও?ভেবেছিলে এর পরিনাম কি হতে পারে?
“বাবা আমি জানি তুমি খুব কষ্ট পেয়েছো কিন্তু এটা কি ঠিক হচ্ছে বলো?আমরা সবাই এখন বড় হয়েছি।সবারই সংসার আছে। তাছাড়া তুমি তো মা-কে অসম্ভব ভালোবাসো তাই না।
” বাসতাম।আমি যাকে ভালোবাসতাম এ সে নয় আহিল।দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছি।এই স্বার্থপর নারী আমায় কখনো ভালোবাসেনি।আমাকে ভালোবাসলে আমার সন্তানদের ও ভালোবাসতো।দেখো আদিবা যে যাই বলুক তুমি এখানে থাকবে না।তোমার বাপের বাড়ি যেতে চাইলে বলো আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি কিন্তু এখানে না।আর যদি আমার ছেলেমেয়ে আমাকে বাধা দেয় তাহলে আমিই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব এই আমি বলে রাখলাম।
“তোমার বাড়ি ছেড়ে তুমি কেন যাবে আমিই চলে যাচ্ছি।
এটা বলে আদিবা বেগম কিছু একটা ভেবে উপরে আহিলের রুমের দিকে ছুটে। সকলে সেদিকে লক্ষ্য করে তারাও তার পিছু নেয়।আদিবা বেগম সরাসরি মার্জিয়ার কাছে আসে।তার চোখে মুখে অসহায়ত্ব। নার্স তাকে সেখান থেকে সরাতে চাইলো কিন্তু এক চুল ও সরাতে পারলো না।
” আপনি প্লিজ ওনার কাছে যাবেন না।উনি অসুস্থ দয়া করে উত্যক্ত করবেন না।
“আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।মার্জিয়া জানি আমাকে তুমি ক্ষমা করবে না।কিন্তু আজ আমি মন থেকে আমার সব দোষ শিকার করে নিচ্ছি।তোমার শশুড় আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইছে আমি তাকে ডিভোর্স দিতে চাই না।
হঠাৎ এমন আক্রমণে কিছুটা ভরকে যায় মার্জিয়া।ঘাড় কাত করে শাশুড়ীকে দেখে।মুখটা শুকিয়ে গেছে।এতো এতো অন্যায়ের পরেও মার্জিয়ার আদিবা বেগমকে দেখে খুব মায়া হলো।ততক্ষণে সবাই রুমে চলে এসেছে।আহাদ রহমান এক ঝটকায় সেখান থেকে আদিবা বেগমকে সরিয়ে দেয়।কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন সেই মুহুর্তে মার্জিয়া ছোট্ট করে বাবা বলে ডাক দিলে থেমে যায় আহাদ রহমান।
” যা হয়েছে সেটা অন্যায় বাবা।কিন্তু এর জন্য আপনারা নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করবেন না প্লিজ।আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।আমি জানি আপনি মা-কে খুব ভালোবাসেন।আর মা ও হয়তো। যে চলে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না বাবা।তাহলে কেন নিজেদের মধ্যে অশান্তি করবেন।আপনার তিনটি ছেলে মেয়ে আছে এই বয়সে এসব ডিভোর্স ছাড়াছাড়ি ওদের সাংসারিক জীবনেও অনেক প্রভাব ফেলবে বাবা প্লিজ।
এইটুকু কথা খুব শান্ত ভাবে সময় নিয়ে বললো মার্জিয়া। আহাদ রহমান বুঝলেন ছেলে মেয়ে কেউ তার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছে না।তাই কাউকে কিছু না বলে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এটা দেখে মাহিন আহিলকে বাবার সাথে যেতে ইশারা করে।আর আশ্বাস দেয় এদিকটা সে সামলে নিবে চিন্তা না করতে।
বাড়ি থেকে রাগ করে আহাদ রহমান আপন মনে হাটছিলেন।কিন্তু এখন তিনি কোথায় যাবেন সেটাই ভাবছেন। স্ত্রী ছেলে মেয়েদের রেখে এভাবে কোনোদিন রাগ করে তিনি বাড়ির বাইরে থাকেননি।এখন প্রায় সন্ধ্যে। আকাশে মেঘ জমেছে যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে।এই মুহুর্তে আহাদ রহমান একটা পার্কে বসে আছেন।এখানে সকালে প্রায়ই হাটতে আসেন তিনি।একটা বেঞ্চে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন আহাদ রহমান। আহিল তখন ধুপ করেই বাবার পাশে বসে পরলো।সময় ব্যয় না করে বাবার কাধে মাথা দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরলো।
“তোমার গা থেকে বাবা বাবা গন্ধ বের হচ্ছে বাবা।
আহিলের কথা শুনে আহাদ রহমান সরু চোখে তাকালেন ছেলের পানে।এ কেমন কথা বাবা বাবা আবার গন্ধ হয় নাকি।ছেলে যে তাকে হাসানোর চেষ্টা করছে তা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি।
” কি হচ্ছে কি আহিল সর এখান থেকে গরম লাগছে আমার।
“তা কি করে হয়।আমি তো তোমার সাথে থাকবো বলেই এসেছি বাবা।
” আমার সাথে থাকবি মানে কি?দেখ আহিল বউমা আছে।সে অসুস্থ । এভাবে রাত বিরেত তাকে ছেড়ে বাইরে আসা তোর একদম উচিৎ হয়নি।বাড়ি ফিরে যা।
“গেলে তোমাকে নিয়েই যাব নয়তো যাব না।
” বাচ্চামি করিস না আহিল।
“আমি বাচ্চামি করছি বাবা!আর তুমি যেটা করছো সেটা কিছু না?
” মানে?
“উফফফ বাবা আমার সত্যি বাচ্চা হয়ে গেছে।আচ্ছা তুমি যেটা করতে চাইছো সেটা একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো তো বাবা।তোমাদের কি এখন এসব মানায় বলো।আমাদের এগুলো দেখতে ভালো লাগবে?আজ তুমি আর মা যদি আলাদা হয়েও যাও যার জন্য হচ্ছো আদোও সে এটা চায় কিনা তা ভেবেছো?তুমি হয়তো বলবে তুমি নিজের ভালো থাকার জন্য আলাদা হতে চাইছো আদোতেও কি তাই?কোথাও না কোথাও এখানে আমিও দোষী থেকে যাবো বাবা।যেটা আমি চাই না।আর আমার মনে হয় না মার্জিয়াও তা চায়।তুমি হয়তো ভাবছো এর মাধ্যমে আমরা ভালো থাকবো।কিন্তু বিশ্বাস করো আমরা কেউ ভালো থাকবো বা।তুমিও না।মার্জিয়াও ভালো থাকবে না বাবা।আমরা তোমাদের দুজনকেই চাই বাবা।তোমাকেও চাই মা-কেও চাই।তোমরা ছাড়া আমার পরিবার পরিপূর্ণ হবে কি করে বাবা?প্লিজ লক্ষি বাবা আমার বাড়ি ফিরে চলো।এসব ছাড়াছাড়ি ভুলে গিয়ে দুজন দুজনকে সময় দাও।তারপর আমি তোমাদের ঘুরতে পাঠাবো বুঝলে।দুজনকে নতুন করে বিয়ে দেবো।তারপর হানিমুনে পাঠাবো। কোথায় যাবে বলতো?নিউইয়র্ক নাকি মায়ের পছন্দের সেই রোমে।
ছেলের এসব লাগামহীন কথায় লজ্জা পেলেন আহাদ রহমান। এই বয়সে নাকি সে বাবা মাকে পাঠাবে হানিমুনে ভাবা যায় এসব!
” আহিল তুই বড্ড ঠোঁটকাটা।আমি তোর বাবা হই ফাজিল ছেলে।
“হ্যাঁ জানি তো।তুমি আমার বাবা আমার বন্ধু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সবকিছুই।রাগ করো আর যাই করো সেটা সামনে থেকে।এভাবে দূরে গিয়ে নয়।এবার চলো বাবা বৃষ্টি হবে যেকোনো সময়।
বলতে বলতে ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি পরতে শুধু করলো।আহিল তাগাদা করে উঠতে নিলে আহাদ রহমান আহিলের হাত ধরে আটকে দিলেন।
” কি হলো বাবা আটকে দিলে কেন? উঠে পরো ভিজে যাবে তো।
আহাদ রহমান তবুও নির্বিকার। এতোক্ষণ আহিলের বলা সব কথাই তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন।ভেবে দেখলেন ছেলে তার ঠিকি বলেছে।মনটাও অনেকিটা ভালো হয়েছে আহাদ রহমানের।তার ছেলে কতো বড় হয়ে গেছে।ছোট বেলায় আহিল যখন কোনো কিছু নিয়ে এমন আপসেট থাকতো তিনিই তো ছেলের কাধে হাত রেখে কতো উপদেশ দিতেন বুঝাতেন।আর আজ তার কাছে মনে হলো তিনিই আহিল আর আহিল তার দ্বায়িত্ব পালন করলো।
“ও বাবা কি ভাবছো?
” তোর মনে আছে আহিল ছোট বেলায় তুই বৃষ্টিতে ভিজতে চাইলে তোর মা ভিজতে দিতো না বলে তুই আমার কাছে কত নালিশ করতি।আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তোকে নিয়ে ভিজতাম। আবার তোর মা বুঝে ফেলার আগেই শুকনো জামা পরিয়ে দিতাম।কিন্তু তবুও তোর মা বুঝে যেতো। কারণ তুই বৃষ্টির পানি সহ্য করতে পারিস না।একটু ভিজলেই ঠান্ডা লেগে যেতো।
“হ্যাঁ সব মনে আছে। কিন্তু সেটা তো ছোট বেলায় হতো।
” হ্যাঁ। তবে আজ মনে চাচ্ছে বড়ো বেলায়ও ওই ভুলটা আবার করি।ভিজবি?
“সিরিয়াসলি বাবা?
” হ্যাঁ রে।
“ঠিক আছে চলো।বৃষ্টিতে সব দুঃখ ধুয়ে ফেলে আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করি।
বাইরের বৃষ্টি থেমে গেছে। আহাদ রহমানকে নিয়ে আহিল কাক ভেজা হয়ে বাড়িতে ঢুকলো।তখন প্রায় রাত ন’টা বাজে।এতোক্ষণ আইরা অরিন চিন্তিত মুখে সোফায় বসে আছে।মার্জিয়া ঘুমিয়ে গেছে।আইরা খাবার খাইয়ে নার্সের সাহায্য নিয়ে সব ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে।আহিলরা যখন বাড়িতে ঢুকছিলো তখন আহাদ রহমান আর আহিল কিছু একটা নিয়ে খুব হাসছিলো।আহিল তো হাসতে হাসতে তার বাবার গায়ে ঢলে পরছিলো বার বার।
“আহিল তারাতাড়ি গায়ের জামা প্যান্ট পালটে নে বাবা।নইলে অসুস্থ হয়ে পরবি।
” তুমিও পালটে নাও বাবা।
এই বলে দুইজন দুদিকে চলে গেলো।এদিকে সোফায় বসা আইরা, অরিন অবাক হয়ে দেখছিল বাবা, ভাইকে।আশ্চর্যের বিষয় আহিল বা আহাদ রহমান কেউই ওদের কে দেখেও দেখলো না।ওরা যখন চলে গেলো তখন আইরা অরিনের দিকে তাকিয়ে রইলো।
অরিন বললো-
“কি হলো কিছুই তো বুঝলাম না।গেলো রেগেমেগে আর এলো দুজনে হেসে হেসে!
” আমিও তো বুঝলাম না আপু।ভাইয়া আসলেই জানতে পারবো।
ওদের দুই বোনের কথায় বিরক্ত হলো মাহিন।ভ্রু কুচকে তাকালো দুজনকে বকবে বলে কিন্তু এই প্রথম দেখলো অরিন নিজে থেকে আইরার কাছে গিয়ে বসেছে।টুকটাক কথা বলছে।আইরা হাসি হাসি মুখ করে সব উত্তর দিচ্ছে।তাই আর কিছু বললো না মাহিন।
★বর্তমান ★
আহিলের বুকেই আবার ঘুমিয়ে পরে মার্জিয়া।এতক্ষণ আহিল অতিতের কথা ভাবছিল।এখন অবশ্য অনেক কিছুই পালটে গেছে।আদিবা বেগম অনেকটা পরিবর্তন হয়েছেন।আহিলের মাঝে মাঝে আফসোস হয় যদি তার মা আরও আগে নিজের এই পরিবর্তন টা আনতেন তাহলে তাদের সংসারটা আজ পরিপূর্ণ থাকতো।এসব ভেবে চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আহিলের।মার্জিয়াকে সাবধানে আবার শুইয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু একে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পরে।ক্লান্তিতে আহিলও ঘুমিয়ে পরে।
সকাল থেকে আইরার মেজাজ খুবই খিটখিটে। ইদানীং এই জিনিসটা একটু বেশিই হচ্ছে লক্ষ্য করেছে আইরা।ভেবেছে হয়তো সব সময় একা একা থাকা হয় এই জন্য হয়তো।তবে আজ এই মাত্রা যেন ছাড়িয়ে গেছে।কোনো কারণ ছাড়াই সে রেগে যাচ্ছে।মাহিনের মতো গোছানো পরিপাটি ছেলের কাজ কর্মেও বেশ বিরক্ত হচ্ছে আইরা।মাহিন অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো।এর মধ্যে কয়েকবার আইরাকে দেখেও নিলো সে।আইরার মেজাজ খারাপ করা, মুখে বিরক্তির ছাপ, বিরবির করে কথা বলা সব কিছু দেখেছে মাহিন।
“আপনার টিফিন।
টিফিন রেখে যাওয়ার সময় খাটের ওপর ভেজা টাওয়াল দেখে আইরা থেমে যায়।ধপাধপ পা ফেলে এগিয়ে টাওয়াল টা হাতে নেয়।আইরার কি হলো কে জানে।ধপ করে ফ্লোরে বসে কাঁদতে শুরু করে দেয়।এটা দেখে মাহিন কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।সে বুঝার চেষ্টা করছে সে কি করেছে যার জন্য তার বউ কাঁদছে বাচ্চাদের মতো।
” আরু কি হয়েছে। এভাবে কাঁদছিস কেন!
“তো কাদবো না?আপনি কেন ভেজা টাওয়াল এখানে রেখেছেন।আপনি খুব অগোছালো মাহিন ভাই।আমার সারাদিন এসব গোছাতে কত কষ্ট হয় আপনি জানেন?
কষ্ট! আইরার কথায় মাহিন এবার অবাকের চরম পর্যায়ে। সে এমন কি করে যে আইরার এতো কষ্ট হয়?তবুও সে অপরাধির মতো বললো_
“সরি আমি এক্ষুণি এটা মেলে দিচ্ছি।তুই কান্না করিস না প্লিজ।
তারপর মাহিন তারাতাড়ি টাওয়াল টা বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়ে আসে। আরু তখনও ওভাবেই বসে।মাহিন দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে আরুর কাছে।টেনে তোলে ফ্লোর থেকে।দুইহাতে মুছে দেয় আরুর চোখের পানি।
” কি হয়েছে কোনো কারণে মন খারাপ?
“জানি না। আমার কিছুই ভালো লাগছে না।
” বাড়ির কথা মনে পরছে?শরীর খারাপ লাগছে?
“না।
” তাহলে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে?কেউ কিছু বলেছে? তুই আজকাল সামান্য বিষয় নিয়ে রিয়েক্ট করছিস আমি লক্ষ্য করেছি আরু।
“আমিও তো বুঝতে পারছি না।বিষয়টা আমিও লক্ষ্য করেছি কিন্তু কোনো কারণ খুঁজে পাইনি।আজ অফিস না গেলে হয় না প্লিজ।
” ঠিক আছে যাব না।কিন্তু বিনিময়ে আমি কি পাবো?
এক মিনিট তোর পিরিয়ড ক্লিয়ার হচ্ছে তো?
এই প্রশ্নে আরু একটু থতমত খেলো।উপরনিচ মাথা নাড়ালো।অর্থাৎ না।
“কিহ!কবে থেকে।আর আমাকে কিছু বলিসনি কেন?
” তিন মাস।
“তিন মাস!আর আমি জানি না।ইচ্ছে কি করছে জানিস এক চড়ে তোর সবগুলো দাত ফেলে দিতে বেয়াদব মেয়ে।
” আমি ভেবেছিলাম আপনাকে বললে আপনি যদি বকেন এই জন্য।এমনিতে তো আপনি এখন বেবি নিতেই চান না তাই।
“তাই বলে আমাকে জানাবি না?হ্যাঁ বেবি নিতে চাই না ঠিক আছে কিন্তু তাই বলে আমাকে জানাবি না।আর এই বেবির ওপরে কি আমার কোনো অধিকার নেই।
” আপনি রাগ করছেন কেন।আমি তো জানাতাম আপনাকে। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।
সরি আর এমন ভুল হবে না।প্লিজ রাগ করবেন না।
“রাগ করবো না?এতো বড়ো একটা খবর আমি আজ জানতে পারলাম।এখন কেন বললি একেবারে ডেলিভারির দিনই আমায় জানাতি। তারপর আমি তোর বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বলতাম হ্যালো বাবু আমি তোমার একমাত্র মামা বাবা হই যে কিনা জানতোই না তুমি পৃথিবীতে আসছো ইডিয়ট।
“মামা বাবা আবার কি!
” কেন সারাদিন যে ভাই ভাই করে মরে যাচ্ছিস সেই ডাকের একটা পুর্নতা দিতে হবে না?
“উফফ আচ্ছা ঠিক আছে আমার ভুল হয়েছে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব প্লিজ ক্ষমা করে দিন
চলবে
#মেঘ_পিওন
#গোলাপী_আক্তার_সোনালী
#শেষ_পর্ব (দ্বিতীয় অংশ)
২৩.
রুবি বেগম সকাল থেকে আজ খুব ব্যস্ত। আজ জহির রায়হান আহিলদের স্ব-পরিবারে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সেই আয়োজনই চলছে এখন। রুবি বেগমের সাথে মার্জিয়াও হাত লাগিয়েছে। সকালেই এখানে চলে এসেছে মার্জিয়া।দুপুরে লাঞ্চের জন্য আসতে বলা হয়েছে তাদেরকে।
রান্না প্রায় শেষের দিকে। রুবি বেগম মার্জিয়াকে রুমে পাঠিয়ে বাকিটা নিজেই করছেন।এমন সময় কলিং বেল।বেজে ওঠে।হাতের কাজ রেখে রুবি বেগমই দরজা খুলে দেন।আদিবা বেগম হাতে মিষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কথা ব্যয় না করে তিনি হাতের মিষ্টি গুলো রুবি বেগমের হাতে ধরিয়ে দেন।রুবি বেগম যেন একটু লজ্জা পেলেন।আদিবা বেগম পরিবর্তন হলেও এই কয়েকদিনে তেমন কথা বলেনি রুবি বেগমের সাথে। রুবি।বেগম ও নিজে থেকে কিছু বলেননি।তাই আজ আদিবার এমন কাজে কিছুটা লজ্জা পেয়েছেন বইকি।
“আপনার কি আমার এখানে আসাতে অস্বস্তি হচ্ছে আপা তাহলে আমি বরং চলে যাই।
” এমা না না অস্বস্তি হবে কেন।
“তাহলে কি আমি আসাতে খুশি হননি?
” এসব কিছুই না আপা।খুশি কেন হবো না অবশ্যই খুশি হয়েছি।
“তাহলে হয়তো আপনি আমাকে এখন ও ক্ষমা করতে পারেননি।নইলে আপনার মুখটা এমন শুকনো কেন?
” আপনি একটু বেশিই ভেবে নিয়েছেন আপা তেমন কিছুই না।আসলে বুঝতেই তো পারছেন।অতিতের অনেক কিছুই চাইলেও ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।আপনি তো এমন নরমাল ভাবে কখনো আমার সাথে কথা বলেননি তাই আমার এখটু মানিয়ে নিতে সময় লাগছে।একেবারে পারবো না তা জানি তবে একটু সময় লাগবে।আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না।
“না কিছু মনে করছি না।আপনারা যে আমাকে ক্ষমা করেছেন এতেই আমি কৃতজ্ঞ আপা।
অরিন অসুস্থ থাকায় কবর কয় দিন হয় কাজে যাচ্ছে না।নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা হওয়ায় জবাবদিহিতাও নেই তার।গত কয় দিন অরিনের প্রচন্ড জ্বর ছিলো।সংসারে শশুর শাশুড়ী নেই। সংসার বলতে অরিনে ছেলে অভি স্বামী কবির।যেহেতু অরিনকে দেখাশোনা করার কেউ নেই তাই কবির কাজ করতে পারছে না।অভিকে এই বছর স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে।অরিন অসুস্থ হওয়ায় সবকিছু এখন কবিরই দেখছে।সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্নাটা করতে হয় না।রান্নার জন্য একজন খালা আছেন তিনিই রান্না করে দিয়ে যান।বাকি কাজ গুলো কবির করে।এমনি দিনে অরিন করে।অভির স্কুলে দিয়ে আসা আবার নিয়ে আসা আপাতত এইসব কবিরই করছে।
আজ অরিন মোটামুটি সুস্থ। এই কয়েকদিন অরিন নতুন করে কবিরের প্রেমে পররেছে।একজন পারফেক্ট স্বামী যাকে বলে কবিরের মধ্যে সেসব গুনই আছে।এতোদিন অরিন এই মানুষটাকে দূরে ঠেলেছে বলে খুব আফসোস হয় তার।
কবির তখন কিচেনে ছেলের জন্য নুডলস রান্না করছিলো।এর পর তাকে আনতে যাবে।এই সমহ অরিন কবিরের পিছু পিছু ঘুরতে থাকে।কবির বিষয় টা প্রথমে লক্ষ্য করলেও কিছুই বললো না।কিন্তু যখন দেখলো অরিন তার পিছুই ছাড়ছে না তখন সে কাজ করা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে তাকালো।
” কি ব্যাপার অরিন।এভাবে ঘুর ঘুর করছো কেন।কি সমস্যা?
চোর ধরা পরার মতো অবস্থা হয়েছে অরিনের।এতো সহজেই কবির বুঝে যাবে তা ভাবেনি।
“কি হলো কথা কেন বলছো না।জ্বর এসেছে আবার?
তারপর নিজেই অরিনের কপালে হাত দিয়ে দেখলো না সব ঠিকই আছে।
” জ্বর তো নেই তাহলে কি হয়েছে?
অরিনের থেকে কোনো জবাব না পেয়ে একটা চাপা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে কবিরের।
“দেখো কাজ করার সময় এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকলে আমি কাজ করতে পারি না।তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো।আর না থাকলে এখান থেকে যাও।কিছু খেতে চাইলে বলো বানিয়ে দিচ্ছি।
” খাবার নয় তোমাকে লাগবে।
“কি! দিনদুপুরে নেশা টেশা করেছো নাকি?
” নেশা কেন করবো সত্যি বলছি।আমি আবার তোমার প্রেমে পরেছি কবির এটা কি আমার দোষ বল?
“সে তো তুমি ৬ বছর আগেও পরেছিলে।তারপর বিয়ে করলে।হুট করেই ভালোবাসা হারিয়ে গেলো।তখন তো দেখতে একটু সুদর্শন ছিলাম তাই প্রেমে পরেছিলে।তা এখন কি এমন দেখলে বুঝলাম না।
” এভাবে কেন বলছো কবির? মানছি আমার ভুল হয়েছে। আমি আমার ভুল শুধরে নিতে চাই একটা সুযোগ দাও তোমাকে অভিযোগ করার সুযোগ দেবো না আমি।
“যখন তুমি আমায় প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলে আমি তোমায় সবটা বলেছিলাম অরিন।বাবা মা ছাড়া মানুষ হয়েছি আমি।আপন বলতে বড় আপা ছিলো। তারপর তুমি এই বাড়িতে বউ হয়ে এলে।একদিন বড়ো আপাও আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলো না ফেরার দেশে।তার কিছুদিন না যেতেই তুমিও কেমন যেন পালটে গেলে।আমার তখন তোমার সাপোর্ট খুব প্রয়োজন ছিলো অরিন।কতদিন তোমার বুকে মাথা দিয়ে ঘুমোতে চেয়েছি কিন্তু সাহসে কুলোয়নি।শুধু ভেবেছি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।এত দেরিতে কেন ঠিক হচ্ছে বলতো?
এবার অরিন হু হু করে কেদে দিলো।ঝাপিয়ে পরলো কবিরের বুকে।শক্ত করে জরিয়ে নিলো নিজের সাথে।
” ওগো আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও।আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি।আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবো না।আসলে বাবার বাড়িতে থাকতে মায়ের সব কিছু মেনে নিতাম।শাসন করতো বকতো।বাবার ভাইয়ার আড়ালে কিছু করতে পারতাম না।কিন্তু তোমার এখানে আসার পর সেসব হয়নি বলে আমার মনে হয়েছিলো আমি মুক্ত।আমাকে আর কেউ কিছু বলতে পারবে না।বড়ো আপাও কখনো মায়ের মতো করতো না।কখন যে নিজে এতোটা বদলে গেছি তোমাকে এতো কষ্ট দিয়েছি আমি বুঝতে পারিনি।পুরোনো সব কিছু ভুলে যাও কবির আমরা নতুন করে আবার শুরু করবো আর কখনো কোনো কষ্ট আসতে দেবো না।
জহির রায়হানের ফ্ল্যাটে আজ মেলা বসেছে। ছোট্ট ড্রয়িং রুমে সকলেই বসে আড্ডা দিচ্ছে।একটা সোফায় মনিরকে নিয়ে আলাদা বসে আছে মার্জিয়া।এতো কোলাহল তার ভালো লাগে না ইদানীং। তার এই দূরত্ব। মাহিন আর আহিল গেছে বাইরে।আহাদ রহমান জহির রায়হান বসে টিভি দেখছেন বাংলাদেশ বনাম ইন্ডিয়া ম্যাচ চলছে।টানটান উত্তেজনা চলছে দুই দলের দর্শকদের মধ্যে।এমন সময় উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়ে লোড শেডিংয়ের দেখা মিললো।জহির রায়হান মুখটাকে ছোট করে নিলেন।এখনই বিদ্যুৎ যেতে হলো?
লোকজন বেশি থাকায় খাবারের আয়োজন করা হলো ফ্লোরে। আদিবা বেগমকে নিয়ে চিন্তায় পরে গেলেন সবাই।যদিও তিনি সবার সাথে মানিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছেন তবে মাটিতে এর আগে কখনো বসেছেন কিনা আদোও বসতে দিবেন কিনা তা বুঝতে পারছেন না রুবি বেগম।
প্লেটে খাবার সাজিয়ে তাদের ছোট্ট ডাইনিং এ রাখলেন রুবি বেগম। আদিবা বেগম তখন সালাদ আনতে কিচেনে গিয়েছিলেন।এসে দেখলেন একটা প্লেট টেবিলে রাখছেন রুবি বেগম।
“এটা এখানে কেন রাখছেন আপা?
” ওই আসলে আপনার জন্য।আপনার তো নিচে বসে খাইয়ার অভ্যাস নেই।
“তাতে কি হয়েছে।আমি তো আরও এক্সাইটেড নিচে বসার জন্য।দিন দিন আমিও সবার সাথে নিচেই বসে খাবো।
আদিবা বেগমের কথা শুনে সবাই এখন তার দিকে তাকালো।এটা দেখে আদিবা বেগমের বেশ অস্বস্তি হলো।
” এভাবে দেখার কি আছে?আমি কি তোমাদের সাথে বসলে কোনো সমস্যা আছে নাকি?
“না ফুপি একদম সমস্যা নেই।তুমি আমাদের সাথেই বসো।
সবাই খেত্ব বসে দেখলো যায়গা আরো খালি আছে।এখন ও তিনজন মানুষ অনায়াসে বসা যাবে।আইরা একটু মন খারাপ করে বলে উঠলো-
” আপা থাকলে ভালো হতো তাই বাবা?পুচকিটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
” আমরাও আছি আরু।আমার ছেলের জন্যও যায়গা আছে তো?
“আপা তোমরা সত্যিই এসেছো?
” আস্তে আরু।এতো ছুটছিস কেন।তুই কিন্তু এখন একা না।
“একে বলে কোনো লাভ নেই।উড়নচণ্ডী হলে এমনই হবে।
মাহিনের পাশ থেকে ফোড়ন কেটে উঠায় আইরা চোখ গরম করে তাকালো। আহিল না দেখার ভান করে খাওয়াতে মনযোগী হলো।
২৪.
বাড়িতে এখন ডাবল খুশি চলছে।আইরার প্রেগন্যান্সির এখন ছয় মাস চলছে।এরই মাঝে খবর এলো অরিনও কন্সিভ করেছে।মার্জিয়ার মনটা ভিষণ খারাপ।বাড়িতে যখন সবাই মিষ্টিমুখ করছিল এটা ওটা নিয়ে কথা বলছিলো মার্জিয়া তখন একা একা ছাদে গিয়ে বসে ছিলো।সময়টা তখন বিকেল। আহিল মার্জিয়াকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ছাদে এসে মার্জিয়াকে দেখতে পায়।দূর থেকে দেখে মনে হবে গাছে পানি দিচ্ছে কিন্তু আহিল একটু সামনে এসে দেখলো মার্জিয়া কাঁদছে।এটা দেখে আহিলের বুকটা খাখা করে উঠলো। নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো খুব সাবধানে। শক্ত করে জরিয়ে নিলো নিজের বুকে।
” তুমি এভাবে মন খারাপ করে থাকলে আমার কি ভালো লাগে মার্জু?এই দেখো বুকের ঠিক এইখানে ব্যাথা করে গো।
“আমরা কেন আবার বাচ্চা নিচ্ছি না আহিল?
” তুমি এখানো ফিট নও।আরেকটু স্ট্রং হও আমরাও বেবি নিবো বউ।
“কিন্তু আমি সুস্থ আহিল।আমার কি মনে হয় জানেন একটা বাচ্চার অভাবেই আমি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারছি না।
আরু আগের থেকে গোলগাল হয়েছে।দেখতে যেন রসগোল্লা। মাহিন আরুকে এখনও নিজের কাছেই রেখেছে।মহিউদ্দিন এখনো আরুকে বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নেয়নি।মনিরা বেগম এখন বেশির ভাগ সময় এখানেই থাকেন।আজ মাহিন বাড়িতে থাকায় তাকে আসতে হয়নি।আরুর একটু জ্বর হয়েছে।মাহিন তার জন্য নিজ হাতে সকালের নাস্তা বানালো।আরুকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিলো সাথে।আরুর এখন সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। যদিও প্রথম বাচ্চার সময় বাঙালি মেয়েরা বাবার বাড়িতেই থাকে। কিন্তু আরুকে মাহিন যেতে দেয়নি।ওর কথা অনুযায়ী ওর বাচ্চা ওর এখানেই হবে।সবার আগেই ওই কোলে নিবে ওই দেখবে।বাচ্চা ওর বউ ওর কষ্ট করেছে ওরা আর মজা নিবে সবাই তা তো হবে না।
“এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন তখন থেকে?
” দেখছি না ভাবছি।
“তা কি ভাবছেন শুনি?
” ভাবছি একটা মিষ্টির দোকান দিবো যেটার নাম হবে ‘দ্যা মাহিন সুইটস’।ভালো না নাম টা?
“ভালো। তা হঠাৎ এই মিষ্টির বিজনেসের আইডিয়া মাথায় এলো কেন?
” আরে চোখের সামনে এমন একটা মিষ্টির বস্তা ঘুর ঘুর করলে আইডিয়া আসবে না?দেখলেই তো খেতে ইচ্ছে করে।এই আরু আমার না আজ একটু প্রেম প্রেম পাচ্ছে রে।দে না একটু প্রেম।
“মানে আপনি আমার কথা বলছিলেন এতোক্ষণ!
” হ্যাঁ, তো কার কথা বলবো।তুই তো মাহিনের ব্যাক্তিগত মিষ্টি বউ।
অরিন সকালে কবিরের জন্য নাস্তা বানাচ্ছিল। সাথে ছেলের টিফিন রেডি করে দিলো।কবির হাতে হাতে সাহায্য করছে অরিনকে।রান্নার খালা নিজের গ্রামের বাড়িতে গেছেন বলে অরিনকেই সব করতে হচ্ছে এতে অরিনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।বরং ভালোই লাগছে।সে কবিরকে তাগাদা দেয় রেডি হওয়ার জন্য।
“আর কত হেল্প করবে আমার তো কাজ শেষ। তুমি গিয়ে তৈরি হয়ে নাও।
” আজ যেতে ইচ্ছে করছে না।না গেলে কি তোমার লস হবে?
কবিরের কথায় ভ্রু কুচকে চায় অরিন।যে লোক কাজ ছাড়া কিছুই বুঝে না।সংসারের জন্য দিন রাত খেটে যাচ্ছে সেই লোক নাকি কাজে যাবে না কথাটা বিশ্বাস হলো না অরিনের।
“তুমি বলছো তুমি কাজে যাবে না?তাও আমাকে বিশ্বাস করতে বলছো?
” হ্যাঁ সত্যিই যাব না।আর বাবুকে এনে আমরা ঘুরতে যাব।যাবে অরি?
“তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
” মজা করছো কেন।সত্যি ইচ্ছে করছে তোমাদের নিয়ে একান্তে সময় কাটাতে।জীবনটা আর কতই বা বড় বল।তোমাকে যদি একটু ভালো স্মৃতিই দিতে না পারি তাহলে আর দিলাম কি।
“এভাবে কেন বলছো।তোমার কি মন খারাপ?আমি কিছু করেছি কি?
” ধুর পাগলি তুমি কি করবে।আমার ইচ্ছে হলো তোমাদের নিয়ে একটু ঘুরতে। বেশি দূরে কিন্তু যেতে পারবো না।তোমার এই শরীর নিয়ে ঢাকার বাইরে যেতে চাইছি না।ঢাকার ভেতরেই কোথাও যাবো তিন দিনের জন্য যাবে?
“যাব।তোমার সাথে জাহান্নামে ও যেতে রাজি মশাই।
“ঠিক আছে তাহলে আমিও বাবুর স্কুল থেকে ছুট নিয়ে আসবো কেমন।
সময় অতিবাহিত হয় নিজের ধারাতে।আহিল আজ বেলা করেই অফিস এসেছে তার কারণ মার্জিয়ার দুষ্টুমি। সকাল থেকে মার্জিয়া তাকে বেশ নাস্তানাবুদ করেছে।বলা নেই কওয়া নেই আহিলকে অকারণে জ্বালিয়েছে মেয়েটা।যার দরুন অফিসে আসতে দেরি হয়েছে।আহিল অফিসে এসেছে এক ঘন্টা হয়ে গেছে এই এক ঘন্টায় মার্জিয়া কোনো কল করেনি বলে আহিল পকেট থেকে ফোন বের করার সময় একটা চিরকুট পায়।তাতে লেখা ছিলো ‘আজ একটু তারাতাড়ি বাড়িতে ফিরবেন #মেঘপিওন ‘।
আহিল মুচকি হাসে।মার্জিয়া আগের থেকে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। দুপুর বেলা।আহিল অফিস থেকে একেবারেইবের হয়ে যাচ্ছে।আজ আর আসবে না।এরই মধ্যে খবর এলো আরুকে হসপিটাল নেওয়া হয়েছে।আহাদ রহমান আদিবা বেগমকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে চিটাগং এর উদ্দেশ্যে।আহিলকে বললো মার্জিয়াকে নিয়ে যাবে কিনা সাথে।আহিল না করে দেয়।সে বলে সেই নিয়ে যাবে তারা যেন চলে যায়।
আদিবা বেগমরা যাওয়ার পর দুপুরের ভাতঘুম দিয়েছিলো মার্জিয়া।আহিল বলেছিলো আসছে এখনো আসেনি বলে ফোনটা হাতে নিলো সময় দেখার জন্য।একি এতো গুলো কল কেরেছে আহিল।আর সে বুঝতেই পারেনি।কোনো সমস্যা হলো কিনা এটা ভেবে দ্রুত আহিলের নম্বরের কল করতে যাচ্ছিলো মার্জিয়া ঠিক সে সময় আবারও আহিলের কল আসে।এবার আর দেরি হয় না।
” সময় হলো ফোন তোলার?কতবার কল করেছি দেখেছো ম্যাডাম?
“আমি একটু ঘুমিয়ে গেছিলাম আহিল।আপনি কোথায় এখনো আসেননি কেন?
” একটু কাজ ছিলো। তুমি এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে জলদি নিচে নামো।আর হ্যাঁ সুন্দর করে সেজেগুজে আসবে কেমন?
“সেজেগুজে কোথায় যাব?আর এই সময় কে সাজে।
” তুমি সাজবে এখন এতো কথা বলো না তো জলদি করো।
মার্জিয়া আহিলের কথা রাখলো।খুব সময় নিয়েই সাজলো।এদিকে আহিল বার বার কল করেই যাচ্ছে।মার্জিয়া ফোন তো ধরলোই না উলটো ফোন টা অফ করে রাখলো।
প্রায় এক ঘন্টা পর মার্জিয়া বের হলো।আহিল গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পরনের শার্টটা গাড়িতেই পাল্টে নিয়েছে সে।মার্জিয়াকে দেখে একটা স্বচ্ছ পরি মনে হলো আহিলের কাছে।সাদা একটা সারি সাথে কোন জুয়েলারি নেই।গলায় শুধু একটা চিকন চেইন সেটাও হোয়াইট গোল্ডের।এটা আহিল ইতালি থেকে এনে দিয়েছিলো।হাতে শুধু দুটো চুরি সেটাও হোয়াইট গোল্ডের।এই সাজেই মার্জিয়াকে অপ্সরার থেকে কম লাগছে না।দেখতে দেখতে মার্জিয়া আহিলের একদম সামনে চলে এলো।আহিল তখনো দেখছে তার অর্ধাঙ্গিনীকে।
“তাকিয়েই থাকবেন নাকি যাবেন?
” হু।এতো সময় লাগলো শুধু এইটুকু সাজতে।আমাকে জ্বালানোর জন্য করো এমন তাই না।
“স্বামীকে না জ্বালালে আর জ্বালাবো কাকে।তা কোথায় যাবেন জানতে পারি?চিটাগং যাবেন না সেটা বুঝে গেছি।
” বলবো তবে এখন না।তোমাকে সাদা সারিতে পরির মতো লাগছে বউ।বেছে বেছে সাদাই কেন পরলে?
“কারণ আপনার পছন্দের রঙ সাদা।
” আমার পছন্দের রঙ কালো ও।
“হ্যাঁ। কিন্তু সাদা মানে স্বচ্ছতা। সাদা মানে আলো।আমি আমাদের জীবনে আর কোনো অন্ধকার রাখতে চাই না।আজ আমরা কোথায় যাচ্ছি?
” আপাতত আজ ঢাকার বাইরে যাচ্ছি না।ভেতরেই কোথাও একটা থাকবো।তারপর তোমাকে নিয়ে লম্বা একটা ট্যুর দেবো।অনেক যায়গা যাবো ঘুরবো।তোমাকে নিয়ে একান্ত সময় কাটাবো।
তখন ধরনীর বুকে আধার নেমেছে।বাইরে বাতাস বইছে।একটা ঘাসের মাঠ।দূরে দূরে দু একটা মানুষ দেখা যাচ্ছে।তারা এখন একটা রিসোর্টে আছে।বিশাল একটা মাঠ।আহিল আর মার্জিয়া পাশাপাশি শুয়ে রাতের আকাশ দেখছে।রিসোর্টে সব সময় সিকিউরিটি দিয়ে সুরক্ষিত রাখা হয়।আহিলের বিশেষ অনুরোধে রিসোর্টের একটা পাশে তাদের খাওয়ারের আয়োজন করা হয়েছে।এখন এখানে আর কেউ আসবে না।আজ তারা এখানেই একটা রুম বুক করেছে।
“খাবেন না খাবার তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আহিল।
” খাবো তো।তবে এই খাবার যে আমায় টানছে না বউ।আমাকে বউ বউ খাবারটাই টানছে বেশি।
“চুপ করুন কেউ শুনে ফেলবে।সব যায়গায় এমন লাগামছাড়া কথা কেন বলেন আপনি।
” তোমাকে বলবো না তো কাকে বলবো।আমার কি আরো চারটা বউ আছে?আর এখানে কেউ নেই স্পেশাল পারমিশন আছে ম্যাডাম।
“চারটা বউ রাখার খুব শখ বুঝি?
” একদম না।এক বউতেই তো নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না আবার চারটা।তুমি একাই চার বউয়ের সমান বুঝলে।
“ইশ আল্লাহ আমায় রক্ষা করুন এই লাগামছাড়া মানুষটার থেকে।
সমাপ্ত