মেঘ বলেছে তুমি আমার পর্ব-১১

0
315

#মেঘ_বলেছে_তুমি_আমার❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ১১
_______________

বাড়ির মেজেতে বসে বালতিতে সব আম ভিজিয়ে একটা একটা করে কাঁচা আম কাটছেন ছোট চাচি, নীলয়ের মা আর নীলা। অহনার মা আর বড় চাচি রান্না ঘরে। সন্ধ্যার নাস্তা হিসেবে চা,চালভাজা বানাতে ব্যস্ত তারা। সামনেই একটা চেয়ারে বসে আছে নীলয় মোবাইল দেখছে সে। অহনাও পাশে এসে বসলো ওদের। বললো,

‘ আমিও কি কেটে দিবো আম?’

উত্তরে অহনার ছোট চাচি বললেন,

‘ না আর লাগবে না। আম কাটা তো প্রায় শেষই তুই এক কাজ কর কুচানো মেশিনটা এনে আম কুচানো শুরু করে দে।’

অহনা শুনলো ‘আচ্ছা ছোট চাচি আম্মা’ বলে ছুটে গেল রান্না ঘরের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মেশিন হাতে ফিরে এসেই আম কুচানো শুরু করে দিলো অহনা।’

এমন সময় সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলো নীলয়ের বাবা, অহনার বাবা আর দুই চাচা। চারজনেই চাষাবাদের কাজ করেছেন। হাতে পায়ে কাঁদায় ভরপুর। নীলয় শুরু দেখে গেল তার বাবাকে তার বাবা এখানে এসে পুরো গ্রামের মানুষ হয়ে গেছে।’

ওনাদের দেখে ছোট চাচি উঠে গেল পানি এগিয়ে দিল সবার হাতে। ওনারাও পানি খেয়ে তোয়ালে হাতে ছুটে গেল কলপাড়ের দিকে।’

প্রায় আধঘন্টার মতো আম কুচানো শেষ হলো সবার। তার মাঝে চা আর বিস্কুট খেয়ে নিয়েছে সবাই।’

অতঃপর সবাইকে ছোট্ট পিরিচে করে আম বানিয়ে দিল ছোট চাচি। নীলয় প্রথমে খেতে না চাইলেও পরে আবার খেয়েছে দারুণ লেগেছে তার। নিজস্ব গাছের আম বানানো যেন অসম্ভব সুস্বাদু টেস্ট।’
_____

বিষণ্ণ রাত। বাড়ি জুড়ে কারেন্ট নেই। তার মধ্যে পরিবেশ গরম। অহনার বড় চাচার দুই মেয়ে লিলি আর বুশরা এসেছে। দুজনেই প্রচুর কথা বলে নীলয়ের কেন যেন সেটা বিরক্ত লাগে। তাই নিচ ছেড়ে ছাঁদের এক কিনারায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে নীলয়। তার কিছু ভালো লাগছে না এখান থেকে গেলেই যেন বাঁচে। আচমকাই নীলয়ের ভাবনার মাঝে ওর দিকে ওর ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো অহনা,

‘ আপনার ফোনটা সেই অনেকক্ষণ থেকে বাজতে ছিল নীলয় সাহেব হয়তো জরুরি কেউ তাই বাধ্য হয়ে নিয়ে আসলাম।’

নীলয় শুনলো একপলক অহনা আর এক পলক তার মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে বেশি না ভেবেই ফোনটা ধরলো সে। বললো,

‘ হুম বলো।’

অপরপ্রান্তের মানুষটি কিছু বলতে থাকলো যার প্রতিটা উত্তর হিসেবে নীলয় শুধু হুম হা ঠিক আছে বলেই চালিয়ে দিলো। নীলয় ফোন কাটার উদ্দেশ্যে লাস্ট বারের মতো বললো,

‘ বেশি ভেবো না মিহি আমি বাড়ি ফিরে দেখছি।’

অহনা তখনও নীলয়ের থেকে দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পাশে। রাতের আকাশ বয়ে হিমশীতল বাতাসেরা ছুঁয়ে দিচ্ছিল তাদের। ‘মিহি’ নামটা একটা মেয়ের নাম যে নামটা নীলয়ের মুখে একদমই শুনতে ইচ্ছে হলো না অহনার কিন্তু তাও সে শুনে গেল। নীলয় তার ফোনটা কেটে রেলিংয়ের দিকে ঘুরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। অহনা নীলয়ের দিকে তাকালো। খুব নিশ্চুপ স্বরে বললো,

‘ মিহি কি আপনার গার্লফ্রেন্ড হয় নীলয় সাহেব?’

নীলয় ঘুরে তাকালো অহনার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ কি বললে?’

অহনা থমকে গেল নিশ্চুপ বনে বললো,

‘ না কিছু না।’

‘ আরে বলো না সমস্যা নেই আমি ওদিকে মন দিয়ে তাকিয়ে থাকায় ঠিকভাবে শুনতে পাই নি।’

অহনা দোনামনা করলো ওড়নার আঁচল পেঁচিয়ে বললো,

‘ আপনি রাগ করবেন না তো?’

‘ না রাগ করবো কেন আর আমার মনে হয় না তুমি আমায় এমন কিছু বলবে যা শুনে আমি রাগ করবো।’

অহনা তাও চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। অহনাকে এখনও চুপ থাকতে দেখে আবারও বললো নীলয়,

‘ কি হলো কথা বলছো না কেন?’

এবার অহনা মুখ খুললো। বললো,

‘ রাগ করবেন না প্লিজ মিহি মেয়েটা কি আপনার গার্লফ্রেন্ড ছিল?’

অহনার প্রশ্ন শুনে উচ্চ স্বরে হাসতে লাগলো নীলয়। যেন খুবই মজার একটা প্রশ্ন করেছে অহনা। নীলয়ের উচ্চ স্বরের হাসি দেখে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেল অহনা। মৃদু স্বরে বললো,

‘ আপনি হাসছেন কেন?’

নীলয় তার হাসি থামায়। বলে,

‘ হাসবো না মিহি আমার গার্লফ্রেন্ড নয় মেয়েদের মতোন দেখতে একটা বান্ধবী। যার বিয়ে হয়ে গেছে সাথে বাচ্চাও আছে দুটো।’

নীলয়ের কথা শুনে থমত খেল অহনা। জিহ্বা কাটলো মুহুর্তেই। বললো,

‘ ওহ আচ্ছা না মানে,

পুরো কথা শেষ করতে দিলো না নীলয় তার আগেই বললো,

‘ হয়েছে তোমায় আর মানেতে যেতে হবে না। তোমরা মেয়েরা আসলে এমনই একটা ছেলে একটা মেয়ের সাথে কথা কি বলে নিল ওমনি তাদের গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড ভেবে বসো।’

অহনার খানিকটা অপমান ফিল করলো নীলয়ের কথায়, একটু না হয় ভুল ভেবেই বলে ফেললো তাই বলে এত কথা শোনানো লাগলো। অহনা খানিকটা কঠিন গলায় বললো,

‘ আমরা মেয়েরাই শুধু এমনটা ভাবি আপনারা ছেলেরা ভাবেন না।’

অহনার কথা শুনে নীলয় বললো,

‘ সব ছেলের কথা জানি না কিন্তু আমি নীলয় ওমনটা ভাবি না।’

অহনা কিছু বলে না নাক ফুলিয়ে চুপ করে রয়। নীলয় তা দেখে হাসে। বলে,

‘ রাগ করলে নাকি?’

উত্তরে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে অহনা,

‘ না রাগ করবো কেন।’

নীলয় কিছু বলে না চুপ হয়ে যায় আকাশ পথে ঘুরে তাকায়। শীতল কণ্ঠে বলে,

‘ একটা কথা জানো অহনা কিছু কিছু মানুষের সাথে ঠিক রাগ জিনিসটা যায় না। তাদের শুধু হাসি খুশি আর লাজুক দেখতেই ভাড়ি মিষ্টি লাগে।’

নীলয় আর দাঁড়ায় না নীরবে জায়গা প্রত্যাখান করে। অহনা থমকে গিয়ে পাশে তাকায় কিন্তু নীলয়কে চলে যেতে দেখে আরো হতাশ হয়। তার প্রশ্ন করতে মন চায় একা মনে বিড়বিড় করে ওঠে,

‘ সেই কিছু মানুষের মাঝে কি আমিও একজন নীলয় সাহেব?’

নীলয় যেতে যেতে হাল্কা হাসে। বলে,

‘ হুম তুমিও সেই দলেরই একজন।’
____

হাতে কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ বাজছে কানে, হাল্কা পায়ের শব্দও আসছে, তাজা ফুলের গন্ধ আসছেও নাকে। কিন্তু এসব ভিড়ে কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দটা এতটাই কাছ থেকে শুনেছিল যে মগ্ন হওয়া ঘুমটায় চরমভাবে ব্যাঘাত ঘটলো নীলয়ের। নীলয় বিরক্ত হলো এতে। চোখ খুলে আশপাশ না ভেবে সামনে তাকিয়েই ধমকের স্বরে বললো,

‘ হচ্ছেটা কি এভাবে শব্দ করছো কেন?’

অহনা চমকে উঠলো। আচমকা ধমকে হাতের কফির মগটা হাত থেকে ছুটে পড়ে গেল। কফির কাপটা গেল ভেঙে। কিছু ভাঙার শব্দে পুরোপুরি ঘুমটা ভেঙে গেল নীলয়ের। ভালো মতো চোখ তুলে তাকাতেই সামনে লাল টুকটুকে রঙের শাড়ি, চুড়ি পরিধিত অহনাকে দেখে থমকে গেল সে। চোখ আটকালো মুহূর্তেই লাল শাড়ি, হাতে লাল চুড়ি, মাথায় খোঁপা করে তাজা গোলাপ ফুল গুঁজানো, চোখে কাজল আর লাল রঙা লিপস্টিকে যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছে অহনাকে। তার সাথে নীলয়ের ধমকের ভয় পাওয়ার বিষয়টা নীলয় অহনার চোখের দিকে তাকালো। বললো,

‘ তুমি এই রুমে কি করছো?’

অহনা আঁতকে উঠলো নীলয়ের আচমকা ধমকে সে চরম ভয় পেয়েছে। অহনাকে কথা বলতে না দেখে আবারও ধমক দিয়ে বললো নীলয়,

‘ কি হলো কথা বলছো কেন?’

অহনা মুখ খুললো কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,

‘ আসলে আমি শুধু কফিটা এখানে রাখতে এসেছিলাম আপনার ঘুমের ডিসটার্ব করতে নয়। সরি!’

নীলয় কিছু বলে না। অহনা নীরবে নিচে বসে ভেঙে যাওয়া কফির কাপের কাঁচের টুকলোগুলো উঠাতে লাগলো। নীলয় শুধু তাকিয়ে রইলো অহনার মুখের দিকে কপালের সামনে থাকা অবাধ্য চুলগুলো যেন আরো মুগ্ধনীয় করছে অহনাকে। হঠাৎই অহনা ‘আহ্’ করে উঠলো নীলয়ের ধ্যান ভাঙলো তাতে সে তাকালো অহনার হাতের দিকে। কাঁচ উঠাতে গিয়ে উঠাতে গিয়ে হাত কেটে গেছে তার। অহনার হাতে রক্ত দেখে নীলয়ের বুকটা যেন ছ্যাত করে উঠলো উতলা হয়ে বিছানা থেকে নেমে নিরদ্বিধায় অহনার কাছে বসে হাত ধরে বললো,

‘ এভাবে খালি হাতে এগুলোকে কে উঠাতে বলেছে তোমায়?’ দেখি ওঠো।’

অহনা উঠলো হাতে কাঁচের ছোট্ট একটা কাঁচের টুকরো ঢুকে পড়ায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে হাতে। নীলয় অহনাকে খাটে বসিয়ে দিল। হাতের একটা আঙুলে ছোট্ট কাঁচের টুকরো ঢুকে গিয়েছে পুরো। নীলয় বুঝলো সবার আগে এই কাঁচের টুকরোটা বের করতে হবে অহনার হাত থেকে। নীলয় অহনার দিকে তাকালো। খুব নরম স্বরে বললো,

‘ ভয় পেও না আমি আছি কিন্তু।’

নীলয়ের কথাটায় কি মুগ্ধতা ছিল জানে না অহনা সে শুধু তাকিয়েই রইলো নীলয়ের মুখের দিকে এরই মাঝে নীলয় চিমটি কাটার মতো করে কাঁচের টুকরোটা শক্ত করে চেপে ধরে দিল টান সঙ্গে সঙ্গে আরো রক্ত বের হতে লাগলো আঙুল দিয়ে। অহনা ঘাবড়ে গিয়ে তার বাম হাত দিয়ে ধরে বসলো নীলয়ের কাঁধ খিঁচে চোখ বন্ধ করে ফেললো নিমিষেই। নীলয় শুধু দেখলো হাত দিয়ে চেপে ধরলো অহনার আঙুল তারপর আশপাশ তাকিয়ে টেবিলের উপরে থাকা তার পরিষ্কার রুমালটার কিছু অংশ ছিঁড়ে বেঁধে দিলো অহনার আঙুল। অহনা তখনও ভয়ের চোটে চোখ বন্ধ করে ছিল। নীলয় অহনার কান্ড দেখে মনে মনে আওড়ালো অহনার বন্ধ হওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে,

‘ তুমি কি জানো তোমার ওই থমকানো চোখেতে
আমি হারিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত,
সময়টা যে বড্ড বেমানান
তবুও-মন নিয়ে কেন খেলছো বলো এমন অবিরত?’

#চলবে….